রাধা ও কৃষ্ণ উভয়েরই পরস্পরের পদের দিকে দৃষ্টি–ইহাতে প্রমাণ হয়, এ প্রেমের জন্ম পূজার ঘরে। কবি কৃষ্ণকমল বলিয়াছেন–
‘‘অতুল রাতুল কিবা চরণ দুখানি,
আলতা পরাত বঁধু কতই বাখানি।’’
এই চরণ-পদ্মের শোভা এখনকার উচ্চ-গোড়ালী, খুরওয়ালা জুতার দিনে আমরা এ-যুগের তরুণদের কি করিয়া বুঝাইব? রবীন্দ্র বাবুর পরে আর কেহ রমণী-চরণের সৌন্দর্য্য বর্ণন করেন নাই।
এই মিলন-দৃশ্যে রাধা-কৃষ্ণের গীতিকা অপূর্ব্ব আনন্দের ছবি অঙ্কিত করিয়াছে। পদ-সাহিত্যের কৌস্তুভমণি “জনম অবধি” এই পদটী মিলনের গীতি।
‘‘জনম অবধি হাম রূপ নেহারিলু–
নয়ন না তিরপিত ভেল।
সোহি মধুর বোল শ্রবণে হি শুনিলু,
শ্রুতিপথে প্রবেশ না গেল।
কত মধু যামিনী–রভসে গোয়াইলু,
না বুঝিলু কৈছন কেলি,
লাখ লাখ যুগ হিরে হিয়া রাখিলু
তবু হিয়া জুড়ন না গেলি।’’
এই গানটি সর্ব্বত্রই কবি-বল্লভের ভণিতায় পাওয়া যায়। কোন কোন স্থানে নাকি অন্য গানে বিদ্যাপতির কবি-বল্লত উপাধি পাওয়া গিয়াছে–যাহা হউক তাহাতে সন্দেহের কারণ আছে। বিচার পতি সারদাচরণ যখন বিদ্যাপতির সংস্করণ প্রকাশ করেন, তখন তিনি এই সূত্রে “কবিবল্লভ” অর্থে বিদ্যাপতি বুঝিয়াছিলেন; অক্ষয় সরকার মহাশয় নির্ব্বিচারে সারদাচরণকেই অবলম্বন করিয়া পদটি বিদ্যাপতির খাতায় লিখিয়াছিলেন। কিন্তু বিদ্যাপতির যদিই বা “কবিবল্লভ” উপাধি থাকিয়া থাকে, তবে, যাহার উপাধি “কবিবল্লভ” তিনিই যে বিদ্যাপতি হইবেন–তাহা নহে। তারপর “বিদ্যাসাগর” বলিতে যেরূপ ঈশ্বরচন্দ্রকেই বুঝায়, “কবিবল্লভ” উপাধি সম্বন্ধে বিদ্যাপতির সেরূপ কোন যোগরূঢ়ত্ব হয় নাই। যদিই বা স্বীকার করা যায় যে, বিদ্যাপতির “কবিবল্লভ” উপাধি ছিল, তাহার এই উপাধি জনসমাজে কতকটা অবিদিত ছিল। বরঞ্চ “নব জয়দেব”, “কবিরঞ্জন”–এই দুটিই ছিল তাঁহার উল্লেখযোগ্য উপাধি।
‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিতে ঈম্বরচন্দ্র বুঝাইলেও, উহাতে তাঁহার একচেটিয়া সত্ব জন্মিয়াছে, একথা স্বীকার করা যায় না। বঙ্গের কয়েক জন বিশিষ্ট লোক ঈম্বরচন্দ্রের সময়েই “বিদ্যাসাগর” উপাধি গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং তাঁহাদের ক্ষুদ্র পরিবেষ্টনীয় মধ্যে ‘বিদ্যাসাগর’ বলিলে তাহাদিগকে বুঝাইত, যথা ঢাকার কালীপ্রসন্ন ঘোষ এবং বিবিধ সংস্কৃত গ্রন্থের টীকাকার ও সম্পাদক জীবানন্দ। এদেশে পল্লী খুঁজিলে আরও বিদ্যাসাগর মিলিতে পারে, সুতরাং “কবিবল্লভ” বলিতে যে শুধু বিদ্যাপতিকেই বুঝাইবে, এ-কথা একেবারেই বলা চলে না। কবিবল্লভ উপাধি বিদ্যাপতির আদৌ ছিল কিনা–তাহারই নিশ্চয়তা নাই। এই উপাধিটি বাঙালা দেশেরই উপাধি বলিয়া মনে হয়, মিথিলায় ইহার তাদৃশ প্রচলন ছিল কিনা সন্দেহ। ‘কবিবল্লভ’ বলিতে এদেশে কিংবা মিথিলায় পূর্ব্বে কখনও বিদ্যাপতিকে বুঝাইত না। তবে আমাদের দেশে যাঁহারা কোন প্রাচীন কাব্য সম্পাদন করেন, তাঁহারা বিচারবুদ্ধি তাদৃশ ব্যবহার করেন না–যতটা গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধি করিতে ব্যগ্র হন। সুতরাং যদি পূর্ব্বের কোনো সংস্করণে ভুলক্রমে কোন সম্পাদক কোন পদ কবি-বিশেষের খাতায় লিখিয়া ফেলেন, পরবর্ত্তী কবিরা কিছুতেই তাহা বাদ দিতে স্বীকৃত হন না, পাছে পূর্ব্ব সংষ্করণ ছোট হইয়া যায়। এই ভাবে গতানুগতিকদের প্রসাদে কবি বল্লভ উপাধিক বাঙালী কবির পদটি মিথিলার বিদ্যাপতির খাতায় লিখিয়া ফেলেন, পরবর্ত্তী কবিরা কিছুতেই তাহা বাদ দিতে স্বীকৃত হন না, পাছে পূর্ব্ব সংস্করণ ছোট হইয়া যায়। এই ভাবে গতানুগতিকদের প্রসাদে কবি বল্লভ উপাধিক বাঙালী কবির পদটি মিথিলা বিদ্যাপতির খাতায় উঠিয়াছে। বিদ্যাপতির মত শ্রেষ্ঠ কবির মর্য্যাদা এই একটি পদে বাড়ে নাই, কিন্তু কবিবল্লভ নামক বাঙালী-কবি এই পদটি হারাইয়া হৃত-সর্ব্বস্ব হইয়াছেন। শুধু কবিবল্লভ নহে, রায়শেখর এবং অন্যান্য কয়েক জন বাঙালী কবিকে নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত মহাশয় বিদ্যাপতির নামে চালাইয়াছেন। যখন তিনি মিথিলায় বিদ্যাপতির পদ-সংগ্রহ করেন, তখন একদিন আমাকে বলিয়াছিলেন, মিথিলার কোন পুঁথিতেই তিনি “জনম অবধি হাম রূপ নেহারলু” পদটি পান নাই, অথচ বিদ্যাপতির ভক্ত টীকাকার তাঁহার সংস্করণে পূর্ব্ববর্ত্তী সম্পাদকদের অনুসরণ করিয়া বিদ্যাপতির পদ বলিয়াই উহা চালাইয়াছেন। যিনি বঙ্গে বৈষ্ণবকবিকুলচূড়ামণি গোবিন্দ দাসকে অজ্ঞাতনামা মৈথিল কবি গোবিন্দ দাস ভ্রম করিয়া তাঁহার সমন্তগুলি উৎকৃষ্ট পদ মিথিলায় সংগ্রহ পুস্তকে সঙ্কলিত করিবার প্রেরণা দিয়াছেন, তাঁহার পক্ষে কবিবল্লভ ও রায় শেখরকে এইভাবে বিদ্যাপতির পদাবলীতে স্থান দেওয়ায় আমরা দুঃখিত হইয়াছি, কিন্তু আশ্চর্য্য হই নাই। বর্ত্তমান দ্বরবঙ্গাধিপ সেই অজ্ঞাতনাম মৈথিল কবি গোবিন্দ দাসের বংশধর, সুতরাং এই সকল কার্য্যে রাজ মনস্তুষ্টি ও মিথিলাবাসীদের প্রীতি সাধিত হইয়াছে; সুপ্রসিদ্ধ বৈষ্ণবশাস্ত্রবিৎ পণ্ডিত এবং সাহিত্য পরিবৎ হইতে প্রকাশিত পদকল্পতরুর সম্পাদক সতীশচন্দ্র রায় এম-এ, নগেন্দ্রবাবুর এই কার্য্যের বিস্তারিত সমালোচনা করিয়াছেন, আমি এইটুকু মাত্র বলিতে পারি যে, যখন তিনি বিদ্যাপতির পদ সংগ্রহ করেন, তখন সম্ভবতঃ তিনি জানিতেন না, বাঙালী বহু বৈষ্ণব কবি মৈথিলভাষার ছন্দে ব্রজবুলিতে পদ লিখিয়া গিয়াছেন। সুতরাং ব্রজবুলি পাইলেই তাহা মৈথিল পদ মনে করিয়া যাহা কিছু হাতের কাছে পাইয়াচেন-তাহাই বিদ্যাপতির রচনা মনে করিয়াছিলেন। তাহার পর যখন জানিতে পারিলেন যে, বাঙ্গালী একথা নিশ্চিত নহে যে, ব্রজবুলী ও মৈথিলীর সুক্ষ্মতার তারতম্য করিতে পারেন, এরূপ বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত অল্পই আছেন। নগেন্দ্রবাবু আদৌ ভাষাবিৎ নহেন, যেক্ষেত্রে তাঁহার বর্ণপরিচয় পর্য্যন্ত হয় নাই, সেখানে তাঁহার বিচার কেহ মানিয়া লইবে না। পূর্ব্বভারতীয় ভাষাগত নানা সূক্ষ্ম বিভিন্নতা বুঝিতে স্বয়ং গ্রিয়ারসন সাহেব ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছেন; অপরের কি কথা!