১৫. মান-মিলন
মান ও অভিসারের পর মিলন। শুধু দুঃখের কথা বলিয়া বৈষ্ণব কবিরা কোন কিছু পরিসমাপ্ত করেন না। শুভ-অশুভ দুইই সংসারে আছে, কিন্তু আমাদের বিশ্বাস করিতে হইবে যে, আপাত সমস্ত অশুভের পরিণতি শুভে। শুধু মনে আঘাত দেওয়ার উৎকট আনন্দ দানব-প্রকৃতির উপযোগী। আমরা বিশ্ব প্রকৃতির অভিপ্রায় বুঝি আর না-বুঝি, এটুকু বিশ্বাস করিতে হইবে যে, সকলই সেই মঙ্গলময়ের বিধান–সুতরাং শুভান্ত। মানের পর মিলন না হইলে মান অসম্পূর্ণ, মাথুরের পর ভাব সম্মেলন না হইলে মাথুর অসম্পূর্ণ। আমরা সমস্ত পথটা দেখিতে পাই না, কিন্তু পৌছাইবার যে একটা স্থান আছে–তাহা অন্তরে বুঝি। বিয়োগান্ত কথার লোক রাস্তার এমন একটা জায়গায় পড়িয়া থাকে, যাহাতে মনে হয় পথ ফুরাইয়া গিয়াছে, কিন্তু পথ ফুরাইলে হৃদয়ের হাহাকার থাকিয়া যায় কেন, গম্যস্থানে গেলে কি আর ক্ষোভের কারণ থাকিতে পারে? বিয়োগান্ত রীতিটা গ্রীকগণ পছন্দ করিয়াছেন, তাঁহারা অশ্রু ও দীর্ঘ-নিঃশ্বাস ফেলিয়া–ফাঁসীতে প্রিয়জনকে ঝুলাইয়া আসর ছাড়িয়া উঠিবেন। হিন্দুর প্রাণ এই অবিশ্বাস ও অসোয়ান্তির রাজ্যের কথা দিয়া যবনিকা-পতন ইচ্ছা করেন না।
তাঁহারা যদি দুঃখ বর্ণনা করিবেন, তবে তাহা কোন উন্নত আদর্শ লক্ষ্য করিয়া করেন। পিতৃসত্য রক্ষা করিবার জন্য রামের বনবাস, স্বামীপ্রেম দেখাইবার জন্য সাবিত্রী ও দময়ন্তীর কষ্ট বর্ণিত হইয়া থাকে। কিন্তু রাজকুমার শিশু আর্থারের চক্ষু উৎপাটন বা শেষাঙ্কে হ্যমলেট-কর্ত্তৃক অকারন কতকগুলি মানুষ হত্যা–এই সকল বৃথা কষ্টের অবতারণা করিয়অ শ্রোতার হৃদয়ে অহেতুক ব্যথা দেওয়া সংষ্কৃতের আলঙ্কারিকগণ নিষেধ করিয়াছেন।
অভিসার ও মানের পর কৃষ্ণ রাধার সঙ্গে মিলিত হইয়াছেন। অভিসারে রাধা “দুই সখীর কাঁধে দুই ভুজ আরোপিয়া, বৃন্দাবনে প্রবেশিল শ্যাম-জয় দিয়া”—“বৃন্দাবনে প্রবেশিয়া ধনী ইতি-উতি চায়, মাধবী তরুর মূলে দেখে শ্যাম রায়,”–গায়েন বলিতেছে, শ্যাম ধ্যান-ধরা যোগীর মত দাঁড়িয়ে আছে। তপ-সিদ্ধির প্রাক্কালে যোগী যেরূপ ধ্যানস্থ হইয়া আনন্দময়ের উপলদ্ধির পরীক্ষায় দাঁড়ায়–ইহা সেইরূপ ধ্যানের প্রতীক্ষা।
‘‘ধেয়ে গিয়ে শ্যামচাঁদ রাইকে ধরে কারে,
ললিতা দাঁড়িয়ে হাসে কুঞ্জলতার আঁড়ে।’’
কুঞ্জলতার ঘন অথচ তরল পত্রান্তরাল হইতে ললিতার দুটি সকৌতুক চক্ষু যূগল-মিলনের এই দৃশ্য দেখিতেছিল।
‘‘(তখন) শির হইতে গুঞ্জা ফল তুলি শ্যাম রায়,
নমো প্রেমময়ী বলিয়া দিলা রাধার পায়।”
এবং “খুলিয়া চাঁপার মালা এলায়ে কবরী,
বধুঁর যুগল পদ বাঁধেন কিশোরী।’’
এই যুগল-মিলনে দেব-দেবী উভয়ে উভয়ের পূজা করিতেছেন। দেহের চাঞ্চল্যের উর্দ্ধে–ভোগলালসার দুর্নীত হাওয়া যেখানে পৌঁছিতে পারে না, সেই অম্নান অধ্যাত্ম কুঞ্জবনে–ইঁহাদের লীলা, এবং ইহাই উচ্চাঙ্গের ভক্তের নিত্য বৃন্দাবন। ইন্দ্রিয় প্রশমিত না হইলে, দৈহিক কামনা একেবারে পুড়িয়া ছাই না হইয়া গেল কেহ বৃন্দাবনের কিশোর-কিশোরীর প্রেম বুঝিতে পারিবেন না, কবিরাজ ঠাকুর এই প্রেমকে নির্ম্মল ভাস্কর এবং লালসাকে “অন্ধ তম” বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন (“কাম অন্ধ তম প্রেম নির্ম্মল ভাস্কর”)।
এই মিলনের চিত্র নানা কবি নানা ভাবে আঁকিয়াছেন; একজন লিখিয়াছেনঃ–
“মোহন বিজন বনে, দূর গেল সখীগনে–
একেলি রহল ধনি রাই।
দুটি আঁখি ছল ছল, চরণ কমলতল
কানু আসি পড়ল লুটাই।
কমলিনী জীবন সফল ভেল মোর,
তোমা হেন গুণনিধি, পশ্বে আনি দিল বিধি,
আজিকে সুখের নাহি ওর।”
যে দেশে শীতে জল জমিয়া বরফ হইয়া যায়, সেখানকার হাওয়া বাঙালা দেশে আসিয়া লাগাতে অশ্রু শুকাইয়া গিয়াছে। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকে এখন চক্ষের জলের মূল্য স্বীকার করেন না। প্রেম-স্নেহ প্রভৃতি কোমল ভাবের সর্ব্বপ্রধান নিদর্শন এই অশ্রুর মূল্য স্বীকার করিতে হইলে নিগৃহীত পিতামাতার ও উপেক্ষিতা স্ত্রীর ঋণ স্বীকার করিতে হয়, শিক্ষিত সংজ্ঞায় অভিহিত দুর্নীত পুত্র ও স্বামীর তাহা হইলে খামখেয়ালী করায় বাঁধা জন্মে। অন্য দেশের কি তাহা জানি না, কিন্তু এই অশ্রুই বঙ্গদেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। চৈতন্য বক্তৃতা করেন নাই–উপদেশ দেন নাই–ধর্ম্মপ্রচার করেন নাই। তিনি চোখের জল দিয়া সমস্ত দেশটা বিজয় করিয়াছিলেন। তাঁহার এক বিন্দু অশ্রুতে যে প্লাবন আনাইয়াছিল, তাহা এখনও সমস্ত নগর ও পল্লী ভাসাইয়া লইয়া যাইতেছে। বড় ব্যথা–বড় আনন্দের ক্ষেত্রে এই অশ্রুর জন্ম ইহা এখন Sentimentalism এর লক্ষণ বলিয়া যাঁহারা অগ্রাহ্য করিতে চান, তাঁহাদের মত কাটখোট্টা পণ্ডিত ইতিপূর্ব্বেও এদেশে অনেক ছিল। পাঁচ শত বৎসর পূর্ব্বে একদা শ্রীবাদ গীতার আলোচনা সভায় কাঁদিতেছিলেন, এইজন্য সে-সভার পণ্ডিতেরা তাঁহাকে গলাধাক্কা দিয়া তাড়াইয়া দিয়াছিল এবং স্বয়ং চৈতন্যদেবও বাসুদেব সার্ব্বভৌমের নিকট “ভাবুক” বলিয়া ভৎসিত হইয়াছিলেন ও কাশীর প্রকাশানন্দ স্বামীও চৈতন্যকে ইহার জন্য নিন্দা করিয়াছিলেন। কিন্তু সমস্ত পণ্ডিতকে মূঢ় প্রতিপন্ন করিয়া চৈতন্যের দুইটি চক্ষুর মুক্তাসম অশ্রু কোটী কোটী লোকের মহাশাস্ত্র হইয়া আছে। এই পরমানন্দজ অশ্রুয় কথাই কবি এখানে বলিতেছেন-
‘‘দুটি আঁখি ছল ছল, চরণ-কমলতল,
কানু আসি পড়ল লুটাই।’’
আর এক কবি এই মিলনকালে বলিতেছেন, “আদরেতে আগুসারি, রাইকে হৃদয়ে ধরি”–কৃষ্ণ জানুর উপরে রাধার পা দু’খানি রাখিয়া মুগ্ধনেত্রে চাহিয়া আছেন, “নিজ কর-কমলে চরণযুগ মুছই, হেরই চির থির আঁখি।” রাধার পা দু’খানি দেখিয়া কৃষ্ণের চোখের তৃষ্ণা মিটিতেছে না, “এ ভর দুপুর বেলা, তাতিল পথের ধুলা, কমল তিহনিয়া পদ তোর,” পথে কোথায় কাঁটা পায়ে ফুটিয়াছে, দেখিতে যাইয়া কৃষ্ণ অশ্রুসংবরণ করিতে পারিতেছেন না এবং “পুছই পহু কি দুখ”–পথে কি কি কষ্ট পাইয়াছেন, অতি আদরে জিজ্ঞাসা করিতেছেন।