মান শব্দটির প্রতিশব্দ আর কোন ভাষায় আছে কি না, জানি না। কোমল মনোভাব বুঝাইতে বাঙালীরা অনেকগুলি শব্দ সৃষ্টি করিয়াছে মানটি তাহাদের অন্যতম, ইংরেজীতে ইহার প্রতিশব্দ থাকা তো দূরের কথা, ইহার ভাবার্থ বুঝানও একরূপ অসম্ভব। ইহার অর্থ রাগ, ক্রোধ, গোস্মা বা খাপ্পা হওয়া নহে। এই সকল কাঠ-খোট্টা শব্দে মানের মাধুর্য্য বুঝান শক্ত। ইহা রাগও নহে; কারণ মূলে উপেক্ষার আঘাত আছে। ইহা প্রণয়ীর চিত্তের প্রেমের গভীরতা পরীক্ষা করিবার একটা কষ্ঠিপাথর; যিনি মান করেন, তিনি প্রেমিককে ছাড়িতে চাহেন না, বরং আরও কাছে আনিতে চাহেন–যদিও ইহা বাহ্যে কঠোর, ইহার ভিতরটা একবারে কুসুমকোমল। মানিনী যাহা চাহেন না বলেন, তাহাই আরও বেশী করিয়া চাহেন, অথচ মুখ মুখ ফুটিয়া কিছুতেই বলিবেন না–ইহা গভীর প্রেমের ছদ্মবেশ। এক বাঙালী কবি নিম্নলিখিত কয়েকটি ছত্রে মানের স্বরূপ বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছেন–
‘‘এক চক্ষু বলে আমি কৃষ্ণরূপ হেরব,
অপর চক্ষু বলে আমি মুদিত হয়ে রব।
এক পদ কৃষ্ণ পাশে যাইবারে চায়,
আর পদে বার বার বারণ করে তায়।’’
যাহা হউক, এখন মানের মূল প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। সখীরা রাধাকে নানারূপ মিষ্ট ভর্ৎসনা করিতেছেঃ–
‘‘ভাগে মিলল ইহ সময় বসন্ত,
ভাগে মিলল ইহ শ্যাম রসবন্ত!
ভাগে মিলল ইহ প্রেম-সঙ্ঘতি।
ভাগে মিলল ইহ সুখময় রাতি।
আজি যদি মানিনী তেজবি কান্ত,
জনম গোঙাঙিবী রোই একান্ত।’’
ভাগ্যে এমন বসন্তকাল, এমন রসিক প্রেমিক, এমন বন্ধুও এমন সুখময় রাত পাইয়াছ, আজি যদি এমন দিনে মান করিয়া কান্তকে ত্যাগ কর, তবে তোমার কাঁদিয়াই জীবন কাটাইতে হইবে। এখানে সঙ্ঘতি অর্থে বন্ধু (প্রেমিক)। পূর্ব্ববঙ্গে এখনও সাঙ্গাইত কথা প্রচলিত আছে। ইহার অর্থ প্রেমিক।
কৃষ্ণ পদ স্পর্শ করিয়া আছেন, সেই স্পর্শের গৌরবে রাধা আবিষ্ট হইয়া আছেন–তাঁহার বাহিরের জ্ঞান নাই। স্পর্শরসে তিনি আত্মহারা। হতাশ কৃষ্ণ এবার ফিরিয়া যাইতেছেন–রাধাকুণ্ডে প্রাণত্যাগ করিতে। কিন্তু একবার কতকটা যাইয়া ফিরিয়া চাহিতেছেন, রাধার মান ভাঙ্গিল কি না দেখিতে। এইভাবে পুনঃ পুনঃ থামিয়া থামিয়া কৃষ্ণ চলিয়া গেলেন।
কৃষ্ণের কোমল স্পর্শে আত্মহারা হইয়া রাধার মন বাস্তব জগতে জাগিয়া উঠিল, তখন মান আপনা হইতেই ভাঙ্গিয়া গেল এবং কৃষ্ণের জন্য মন হাহাকার করিয়া উঠিল। তাঁহাকে ফিরাইয়া আনিবার জন্য রাধা সখীদের সাধিতে লাগিলেন। অনেক কথার কাটাকাটি হইল, সখীরা সময় পাইয়া বেশ দু’কথা শুনাইতে ছাড়িল না। রাধা বিলাপ করিয়া বলিলেনঃ “নারী জনমে হাম না করিলু ভাগী। এখন মরণ শরণ ভেল মানকি লাগি।” নারীজন্মে আমি কোন ভাগ্যই করি নাই, এখন মানের জন্য আমার মৃত্যুর শরণ লইতে হইল। কৃষ্ণকমল গেঁয়ো কথায় “আমি অতি পাষাণ-বুকী, সে মুখে হ’লাম বিমুখী–সে যে কেঁদে কেঁদে সেধে গেল গো” বলিয়া হৃদয়ের তীব্র ব্যথা বুঝাইয়াছেন; তাঁহার আর একটি পদ এইরূপ “আমি নহি প্রেমযোগ্য, করেছিলাম প্রেমযজ্ঞ, যোগ্যাযোগ্য বিচার না করে”–এই যজ্ঞের আমি যোগ্য নই, যজ্ঞেশ্বর কেন আমার যজ্ঞ গ্রহণ করিবেন?
রাধার এই মর্ম্মন্তিক কষ্টের এই দৃশ্য কি সখীরা সহিতে পারে? তাহারা তাঁহার আপনার, গালি দিয়াও তাহাদের প্রাণ অস্থির হইয়া উঠিল। বৃন্দা চক্ষের জল মূছিতে মূছিতে কৃষ্ণের সন্ধানে চলিল। বৃন্দার সাশ্রু আঁখি বৃন্দারণ্যের সমস্ত স্থান খুজিতে লাগিল। কৃষ্ণ কোথাও নাই। ধীর মন্থর গতিতে বৃন্দা যাইতেছে, বংশীবট, যমুনাতট–যেখানে কৃষ্ণ রাধার প্রতীক্ষা করিয়া বাঁশীতে রাধাকে সঙ্কেত করেন, তিনি কোথাও নাই। নিশ্চয়ই রাধার নিষ্ঠুর ব্যবহারে প্রাণত্যাগ করিয়াছেন। বৃন্দার চক্ষের জল গণ্ডে গড়াইয়া পড়িতেছে, সে তাহা আঁচলে মূছিয়া আবার চলিতেছে। শ্যামকুণ্ড, মদনকুঞ্জ ও রাধাকুণ্ডের পার বৃন্দা বারং বার খুজিঁয়াছে। গোবর্দ্ধন পাহাড়ের উপত্যকা-পথে তন্ন তন্ত্র করিয়া তথাকার দ্বাদশ বনের প্রতিটি বন সন্ধান করিয়াছে। বড় আশা করিয়া বৃন্দা গোচারণের মাঠে ছুটিয়া গেল। হয়ত সেখানে কৃষ্ণ আছে। কারণ “সেও তে ধেনুর রাখাল বটে!” ধেনুর রব সখাদের কোলাহল শুনিয়া সে আশা করিয়াছিল, সেখানে হয়ত কৃষ্ণ আছেন, কিন্তু সেখানে শ্রীদাম, সুদাম ও মধুমঙ্গলাদি কৃষ্ণসখাদিগকে দেখিতে পাইল, আর দেখিতে পাইল বলরামকে, কিন্তু গোপীগণের নয়নাভিরাম কোথায়? বৃন্দা মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল। রাধা-কুণ্ডের পারে কৃষ্ণের পদচিহ্ন দেখিয়া বুঝিল, কৃষ্ণ নিশ্চয়ই অভিমানে সেই কুণ্ডে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছেন! তখন সে সেই পদচিহ্নের উপর লুটাইয়া পড়িল।
‘‘জিতি কুঞ্জর, গতি মন্থর, চলল বর নারী,
বংশীবট যমুনাতট-বন সঘনে নেহারি।
শ্যামকুণ্ড, মদনকুঞ্জ রাধা কুণ্ড তীরে,
দ্বাদশ বন-হেরত সঘন শৈলহি কিনারে।
যাঁহা ধেনু সব করত্যহি রব,
তাঁহা চলতি জোরে,
(দেখে) শ্রীদাম, সুদাম, মধুমঙ্গল হেরত বল বীরে।”
এই নৈরাশ্যের অবস্থা অতিক্রম করিয়া বৃন্দা আবার ছুটিল, যে-পর্য্যন্ত আশার লেশ আছে–সে পর্য্যন্ত সে চেষ্টা ছাড়িবে না। রাধার কাছে সে মুখ দেখাইবে কিরূপে? তাহাকে কি বলিয়া বুঝাইবে? আজ যে মানের দায়ে তাহার প্রাণ যাইতে বসিয়াছে।
হঠাৎ যমুনাকূলে কদম্ববৃক্ষমূলে তাহার দৃষ্টি পড়িল, সেখানে সে হারাণো রতন কুড়াইয়া পাইল। কৃষ্ণের অবস্থা দেখিয়া এই দুঃখের মধ্যেও বৃন্দার হাসি পাইল। একদিকে বাঁশীটি পড়িয়া আছে–এত সাধের বাঁশী—সুখ-দুঃখের সঙ্গী বাঁশী কৃষ্ণের হস্ত চ্যূত কৃষ্ণ ধূলায় ধূসর অপর দিকে, ময়ুরপুচ্ছের কত গৌরবের চুড়াটি–তাহাও শির-চ্যুত, ধুলায় লুটাইতেছে। কৃষ্ণের কম্পিত ওষ্ঠ এই অবস্থায়ও “হা রাধে, হা রাধে” বলিতেছে, এত দুঃখেও কৃষ্ণ নাম ছাড়েন নাই, এ যুগে নাম সত্য,–সেই নাম ছাড়েন নাই। এদিকে তাঁহার হাতছাড়া বাঁশীর রন্ধে রন্ধে পবন হিল্লোলিত হইতেছে, ‘রাধানামে সাধা বাঁশী’ তখন আপনা হইতেই “জয় রাধে শ্রীরাধে” বলিয়া বাজিয়া উঠিতেছে। কারণ বাঁশী আর কিছু জানে না। ওষ্ঠাধরের সেই অর্দ্ধস্ফুট রাধানাম ও বাঁশীর আকুল ‘রাধা রাধা’ ধ্বনি সেই নীপমূলে অদৃশ্য চিত্তহারী কল্পলোকের সৃষ্টি করিয়াছে। সেই কল্পলোকে উন্মত্তের ন্যায় পরিবেশ বিমূঢ়, আর্ত্ত, ধূলিধূসর কৃষ্ণ পড়িয়া আছেন।
‘‘যমনুকূলে, নীপহি মূলে, লুট বনওয়ারী,
শশিশেখর ধুলিধূসর, কহত প্যারী প্যারী।’’
উপরে আমি এই পদটির যে বিবৃত্তি দিয়াছি, তাহার একটি কথাও আমার নিজের নহে, কীর্ত্তনীয়াদের আখর হইতে পাওয়া।
১৪. পরিহাস রস
গোপীরা কৃষ্ণকে লইয়া যে-সকল লীলা করিয়াছে, তাহা মাধুর্য্য-পূর্ণ হইলেও একঘেয়ে হয় নাই, মাঝে মাঝে পরিহাসের চাটনি দিয়া তাহার আস্বাদ মুখরোচক করা হইয়াছে। সত্য বটে কৃষ্ণ রাধার পায়ে ধরিয়া সাধিয়াছেন। এতটা করার পর রাধার তাঁহাকে ক্ষমা করা উচিত ছিল, রাধা তাহা করেন নাই। এখন কৃষ্ণ-বিরহে রাধার প্রাণান্ত হইবার উপক্রম হইয়াছে, বৃন্দা নিজেও অনেক ঘোরা ফেরা করিয়া মনঃ ক্লেশ পাইয়াছেন। গোপীরা স্বভাবতঃই মুখরা ও পরিহাস-প্রিয়া; বৃন্দা এখানে একটা চাতুরী খেলিয়া কৃষ্ণকৃত তাহাদের এই কষ্টের প্রতিশোধ লইতে ইচ্ছুক হইলেন। রাজকুমারী রাধার একটা মান-সম্ভ্রম আছে, সখীদের কাছে তাঁহার মান বজায় রাখিতে হইবে। এখন যদি সে হঠাৎ দেখা দেয়, তবে তিনি নিশ্চয়ই ভাবিবেন, রাধা তাঁহার বিরহে একান্ত অধীরা হইয়া তাঁহাকে খুজিবার জন্য বৃন্দাকে পাঠাইয়াছেন; কৃষ্ণের কাছে রাধাকে এতটা খেলো করিতে বৃন্দা রাজী নহেন। কৃষ্ণকে পাইয়া বৃন্দার দেহে প্রাণ আসিয়াছে, কিন্তু সে তাহার সামনে আনন্দ গোপন করিয়া ফেলিল। সে যেন কৃষ্ণকে দেখিতেই পায় নাই–এই ভাবে তাঁহার পাশ কাটিয়া হন্ হন্ করিয়া চলিয়া গেল। এদিকে কৃষ্ণ দূর হইতে বৃন্দাকে দেখিতে পাইয়া মনে করিলেন, নিশ্চয়ই মানভঙ্গের পর অনুতপ্তা হইয়া রাধা তাঁহার সন্ধানে দূতীকে পাঠাইয়াছেন, তখন হর্ষের উচ্ছ্বাসে তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিয়া কৃষ্ণ গায়ের ধূলা ঝাড়িতে লাগিয়া গেলেন; অতিশয় ক্ষিপ্রতার সহিত ময়ূরপুচ্ছের চূড়াটা মাথায় আঁটিয়া বাঁধিয়া, বাঁশী হাতে সাজগোজ করিয়া বৃন্দার আগমনের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেনঃ–