শিব ও ব্রহ্মা–এই দুই দেবতামাত্র বিষ্ণুমায়ায় অভিভূত হন নাই। নিবৃত্তির স্বর্গে আর কোন দেবতার প্রবেশাধিকার নাই।
গ্রাম্য কবি লিখিয়াছেন-
‘‘বিকার নাকো অন্য সুতো, বিনে তাঁতি নন্দের সুত
সে হাটের প্রধান তাঁতি, প্রজাপতি, পশুপতি,
আর যত আছে তাঁতি, তাঁদের শুধু যাতায়াত।’’
স্বয়ং বিষ্ণুর ছাপ-মারা সুতোই এই হাটের একমত ক্রয়-বিক্রয়ের পণ্য। বিষ্ণু নিজে চৈতন্যপার্ষদ পুণ্ডরীক বিদ্যানিধির মত ভোগের মুখোস-পরা নিবৃত্তির দেবতা। তাঁহার আবাস স্থান তিমি-নক্র-তিমিঙ্গিল সঙ্কুল উত্তাল তরঙ্গ ও আবর্ত্তময় মধ্য সমুদ্র তথায় তাঁহার শয্যা একটি বট পত্র, মন্তকোপরি শতশীর্ষ বিযধর ভীষণ অনন্ত নাগের লেলিহান জিহ্বা; এই ভয়ঙ্কর স্থান ও পরিবেষ্টনীর মধ্যে তিনি যোগ নিদ্রায় নিদ্রিত–এই অবস্থায় কি কাহারও চক্ষে ঘুম আসিতে পারে, কিন্তু পরম নির্ব্বির যোগেশ্বরের যোগ-সমাধির ইহাই উপযোগী স্থান। ঈদৃশ দেবতার নিকট যে ভক্ত যাইতে ইচ্ছা করিবে, শত কষ্টিপাথরে কষিয়া সে মেকী কিনা তিনি পরীক্ষা করিয়া লইয়া থাকেন। যে ভোগৈশ্বর্য্য-বিমুখ হইয়া নিবৃত্তির পথে যাইতে চাহিবে বৈষ্ণবী মায়া তাহাকে ফিরাইবার জন্য কত প্রলোভন ও কত বিভীষিকা প্রদর্শন করে, তাহা যিশুর সয়তান কর্ত্তৃক প্রলুদ্ধ হওয়ার কাহিনী, বুদ্ধদেবের মারের সহিত সংঘর্ ও শিবকৃত মদনভস্মের পরিকল্পনায় কবিরা আঁকিয়া দেখাইয়াছেন। এই নিবৃত্তিপন্থীকে টলাইবার জন্য ইন্দ্রদেব সর্ব্বদা অপ্সরীদিগের শরণ লইয়াছেন, সে সকল গল্প পুরাণকারেরা রচনা করিয়া এই সত্য প্রমাণ করিয়াছেন যে, যাঁহারা ভোগের পথ ছাড়িয়া যোগের পথে যাইতে চাহেন, প্রকৃতি তাহাদিগকে লুব্ধ করিবার জন্য সতত প্রয়াসী। ভিখারী রাস্তায় রাস্তায় সারাদিন চীৎকার করিয়া মুষ্টি ভিক্ষা পাইতেছে না, কিন্তু ভোগবিমুখ নিবৃত্তিকামী সাধুকে ভুলাইবার জন্য ধনকুবেরগণ তাঁহাদের ভাণ্ডার মুক্ত করিয়া দিতেছেন; সন্ন্যাসী তাহার নেংটী ছাড়িতেছে না, দিগম্বর সন্ন্যাসী সেই নেংটীটুকুও ফেলিয়া দিয়াছেন। এ যুগের প্রধান অস্ত্র অর্থের মুখ ভোতা হইয়া গেল, গান্ধিজী তাঁহার আটহাতী খদ্দর ছাড়িলেন না, এবং চার্চ্চহিলের কটুক্তি তাঁহার কাছে পুষ্পবৃষ্টির মত বোধ হইল।
সুতরাং এবম্বিধ ত্বৎ-সমর্পিত প্রাণ–একান্তভাবে ত্বদগত ও ত্বদবলম্বিত ব্যক্তির মান ভাঙ্গিতে যে ভগবান সাধ্যসাধনা করিবেন, বৈষ্ণবদের এই কল্পনার ভিত্তি-মূলে কতকটা পারমার্থিক সত্য নিহিত আছে, তাহা স্বীকার করিতে হইবে। বৈষ্ণবেরা নিবৃত্তির পথ মধুরাদপি মধুর করিয়াছেন–তাহা অনুরাগের দ্বারা পুষ্পাকীর্ণ করিয়া। মান-অধ্যায়ের ভূমিকা-স্বরূপ এইটুকু বলিয়া আমরা পদাবলীর উদ্যানে পুনরায় প্রবেশ করিব। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস ও গোবিন্দ দাসের পরে মান সম্বন্ধে কীর্ত্তনীয়ারা যাঁহাদিগকে প্রধানতঃ অবলম্বন করিয়া থাকে, রায়শেখর ও শশিশেখর তাঁহাদের অন্যতম।
আমরা শমিশেখরের একটি পদ অবলম্বন করিয়া এই প্রসঙ্গ আরম্ভ করিব।
প্রথমেই কীর্ত্তনীয়া সখীগণপরিবৃতা রাধাকে মানের অবস্থায় শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে উপস্থিত করিল। কৃষ্ণ তাঁহার পদযুগল ধরিয়া আছেন। শুক-শারী বিবাদ করিতেছে; একজন কৃষ্ণ-পক্ষে, অপরে রাধা-পক্ষে। সখীরা ব্যধিকাকে গঞ্জনা করিয়া বলিতেছে, “শ্যামকে না দেখিলে মরবি, দেখিলেও মান করবি” এই রকমের উক্তি; কিন্তু চিত্রার্পিতা মূর্ত্তির ন্যায় রাধা বসিয়া আছেন, মুখে কোন কথা নাই। আপনারা বাজারে এই ভাবের অনেক চিত্র দেখিয়া থাকিবেন। এদিকে “চরণ-নথ রমণী-রঞ্জন ছাদ। ভূতলে লুটাইল গোকুলচাঁদ”–এই পদটি লইয়া অনেক টীকাকার ভূলের একটি দপ্তর-মত জাল তৈরী করিয়াছেন। বিদ্যাপতির একজন প্রসিদ্ধ ভক্ত ও টীকাকার লিখিয়াছেন “চরণনথর মণিরঞ্জন” অর্থ নখ-রঞ্জিনী বা নরুণ। কৃষ্ণ ও নরুণ, উভয়ের বর্ণই কালো, সুতরাং পদটির অর্থ হইল যে, গোকুলচন্দ্র কৃষ্ণ একটা নরুনের মত ভূতলে পড়িয়া আছেন। এই উপমার আর একটি সার্থকতা এই যে, নরুণ দিয়া পায়ের নখ কাটা হয়। গোকুলচন্দ্রও রাধার পায়ের কাছেই পড়িয়া আছেন। বিদ্যাপতির মত এত বড় কবির তাঁহার একজন ভক্তের কৃত এরূপ নরসুন্দরী টীকার লাঞ্ছনা আমি কল্পনা করিতে পারিতাম না। পদটি কোন কোন সংস্করণে এইভাবে লিখিত হইয়াছেঃ—“চরণ-নখর-মণি-রঞ্জন ছাদ” এইভাবে লিখিত হইলে উহাকে টানিয়া বনিয়া কতকটা পূর্ব্বোক্ত ব্যাখ্যার পরিপোষক করা যাইতে পারে; তথাপি “নখরঞ্জিনী” না হয় নরুণ হইল, কিন্তু “নখরমণিরঞ্জিনী” যে নরুণ হইবে, ইহাও নিতান্ত কষ্ট-কল্পনা না করিলে সিদ্ধ হয় না। বিশেষতঃ মানুষের পায়ের নখকে নখর বলে না, বাঙালায় নখর বলিতে পশু-পক্ষীর নখ বুঝায়–মিথিলায় কি বুঝায় বলিতে পারি না। কিন্তু এই নরুণের উপমা অন্যদিক্ দিয়া সমর্থিত হইলেও কবিত্বের দিক্ দিয়া উহা একবারে মারাত্মক। পদটী এইভাবে লিখিত হওয়া উচিত “চরণ-নখ রমণীরঞ্জন ছাঁদ” এবং ইহার অর্থ এই যাহার পদনখের দ্যুতি, রমণীর মনোরঞ্জন করে, সেই শ্যামচন্দ্র রাধিকার পাদমূলে লুটাইয়া পড়িলেন। এই উক্তি-দ্বারা একদিকে শ্রীকৃষ্ণের রমণী-মন আকর্ষণ করিবার অসামান্য শক্তির ইঙ্গিত করা হইয়াছে, (সেই কৃষ্ণ যাঁহার পদ-নখ দ্যুতিতেই রমণী মুগ্ধ হয়), অপর দিকে তিনি রাধার পায়ের কাছে ভূতলে লুটাইয়া পড়িলেন–এই উক্তি দ্বারা তাঁহার গৌরবের সম্পূর্ণ ধ্বংস ও নতি স্বীকারের পরাকাষ্ঠা তুলনায় প্রদর্শিত হইয়াছে।