ইহার পরে গোবিন্দ দাসের অভিসারের আর একটি পদ উদ্ধৃত করিব, তাহা একেবারেই মর্ত্ত্যেলোকের কথা নহে। তন্ত্রোক্ত শব-সাধনা, যেখানে সাধক শবের উপর বসিয়া তপস্যা করেন– পঞ্চাগ্নিকের দুশ্চর প্রচেষ্টা, যেখানে তিনি গ্রীষ্মকালে চারিদিকে প্রজ্জলিত অগ্নিকুণ্ডের দুঃসহ তাপ সহ্য করিয়া পঞ্চম অগ্নি স্বরূপ মধ্যাহ্নের প্রখর মার্ত্তণ্ডের দিকে বন্ধদৃষ্টি হইয়া থাকেন–শত কল্পারূঢ় যোগীর নিশ্চল আসন, যেখানে তিনি অনাহারে অনিদ্রায় অপশ্চরণ করেন–এই পদোক্ত প্রেমিকের সাধনা তাদেরই এক পাঙতেয়। প্রভেদ এই যে, তপস্বীরা বহুকষ্টে সংযমী হইয়া তপস্যা করেন, কিন্তু প্রেমিকের তত্তুল্য বা ততোধিক কষ্ট অনুরাগের সহিত বলিয়া তৃণবৎ উপেক্ষিত হয়। কবি বলিতেছেন;–
‘‘কন্টক গাড়ি’, কমল সম পদতল মঞ্জীর চীয়হি ঝাঁপি’
গাগরি-বারি ঢারি, করি পিছল পথ, চলিছি অঙ্গুলী চাপি।
মাধব তুয়া অভিসারক লাগি’।
দুরতর পন্থা গমন ধনী সাধয়ে,
মন্দিরে যামিনী জাগি;
কর-যুগে নয়ন মুদি’ চলু ভামিনী,
তিমির গয়ানক আশে।
মণি কঙ্কণ পণ ফণি-মুখ-বন্ধন,
শিখই ভুজগরুপাশ।
গুরুজন-বচন বধির সম মানই,
আন শুনই কহ আন।
পরিজন-বচনে মুগধি সম হাসই,
গোবিন্দ দাস পরমান।’’
ইহা সামান্য নায়িকার অভিসার নহে–সে একটু ইশারা পাইলেই ইডেন-গার্ডেন বা গোল দীঘির বেঞ্চে বসিয়া গল্প করিবার জন্য প্রতীক্ষা করিবে কিম্বা লেক রোডে একত্র ঘুরিয়া বেড়াইবার লোভে ছুটিয়া যাইবে। এই অভিসারের জন্য তৈরী হইতে হইলে, যুগ যুগের তপশ্চরণের দরকার। আঙ্গিনায় কাঁটা পুতিয়া, কলসী কলসী জল ঢালিয়া কন্টকাকীর্ণ পিচ্ছল পথে যাতায়াত শিখিতে হইবে, পায়ের নূপুরের কলম্বন চীর-খণ্ডে বন্ধ করিয়া সারা রাত্রি আঙ্গুল চাপিয়া হাঁটা অভ্যাস করিতে হইবে এবং আঁধার পথে যাওয়া শিখিবার জন্য চক্ষু বুজিয়া পথে চলিতে হইবে–কারণ “আমার যেতে যে হবে গো–রাই ব’লে বাজিলে বাশী”, তখন তো আমি এক মুহূর্ত্তেও ঘরে অপেক্ষা করিতে পারিব না। রাধিকা সর্পসস্কুল পথে চলা-ফেরা শিখিবার জন্য ভূজগ গুরুর (ওঝার) নিকট নিজ মণিময় কঙ্কণ-মূল্য (পণ) দিয়া সাপের মুখ কিরূপে বন্ধ করিতে হয়, তাহাই শিখিতেছেন; গুরু-জন যখন ভৎসনা করেন, তখন তিনি বধির হইয়া থাকেন–যেন কিছুই শুনিতে পান না। বাহিরের লোক উপদেশ দিতে আসিলে, যেন তিনি তাঁহাদের কথা বুঝেন নাই–পাগলীর মত (মুগ্ধী) অকারণে হাসেন। এই সকলই সংসার হইতে বাহির হইবার যোগ্যতার্জ্জনের শিক্ষা এবং ইহা প্রেমের পথে তাঁহাকে পাইবার তপস্যা। কবি নিজেই ইহাকে সাধনা বলিয়াছেন (“দুর তর পন্থা গমন ধনী সাধয়ে”)।
১৩. মান
মানুষের যতগুলি ভাব প্রণয়-ব্যাপারে বর্ণিত হইয়াছে, তাহার সবগুলি কবিরা রাধা-কৃষ্ণ লীলায় আরোপ করিয়াছেন। ধরুণ–মান। কোথায় সেই অব্যক্ত, অনন্ত, শত শত বিশ্বের অধিপতি, সর্ব্বব্যাপী, সর্ব্বশক্তিমান ঈশ্বর–আর ধূলি কণার কোটী-কোটীর অংশের একটি নগণ্য রেণুর মত মানুষ! সেই রেণু ভগবানের সঙ্গে মান করিবে এবং তিনি সেই রেণুর পা ধরিয়া মান ভাঙ্গাইবেন? সাধারণের নিকট এই তত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে অনধিগম্য, সিন্ধুর সহিত বিন্দুর মান, ইহা শিশুর কল্পনা।
কিন্তু তিনি তো অণু হইতেও অনীয়ান্; এত বড় তিনি, কিন্তু ক্ষুদ্রের উপরও তাঁহার পূর্ণ দৃষ্টি পূর্ণ ভালবাসা। পর্ব্বতের ছায়া বিশাল জলধির বক্ষে যেরূপ পড়ে, একটি ক্ষুদ্র জলবিন্দুর উপরেও তেমনই পূর্ণভাবে পড়ে। ক্ষুদ্রের নিকট তিনি ক্ষুদ্র। এই বিরাট বিশ্বের কর্ম্ম-শালায় কত সহস্র, কত কোটী বৃহৎ যন্ত্র কাজ করিতেছে, আবার একটি জীবাণুর শরীরেও সূক্ষ্ম শিরা, উপশিরা তেমনই পূর্ণভাবে ক্রিয়াশীল–ক্ষুদ্র বলিয়া তাহার আভ্যন্তরীণ সূক্ষ্ম যন্ত্রগুলির কোনটিই অপূর্ণ বা অঙ্গহীন নহে। সেই বহুরূপী বিরাট্ পুরুষবর আমার কাছে আমারই মত হইয়া আসেন। ভগবানের এই সর্ব্বব্যাপক, সূক্ষ্ম ও স্থূল উভয়ের উপযোগী, বৈষম্যহীন রূপভেগ স্বীকার করিলে মান লীলা, দান লীলা, নৌকা বিলাস বুঝিতে কষ্ট হইবে না। এক সাধু আমাকে বলিয়াছিলেন—“রাধা-কৃষ্ণ লীলা দেখিবে? সৌর-কেন্দ্রে সূর্য্য তাঁহার জ্যোতিষ্ক মণ্ডলীকে লইয়া কতই খেলা করিতেছেন–তাহাদিগকে অনুরাগের বন্ধনে বাঁধিয়া কখনও কাছে আনিয়া, কখনও দূরে রাখিয়া ঋতুভেদে লীলা করিতেছেন–আমার কাছে ইহাই রাধাকৃষ্ণের লীলা। আবার একটি ক্ষুদ্র ফুলকে লইয়া ভ্রমর কত কথাই না গুঞ্জন করিয়া বলিতেছে–কখনও ফুলটি নতমুখে তাহা শুনিতেছে, কখনও ঘাড় নাড়িয়া ভ্রমরটিকে ‘যাও, যাও’ সরাইয়া দিতেছে–আমার কাছে ইহাই রাধাকৃষ্ণের লীলা। প্রেমের অঞ্জন চক্ষে পরিয়া এস, দেখিবে জগৎ ব্যাপিয়া এক অফুরন্ত লীলা চলিতেছে; গাছে গাছে, পল্লবে পল্লবে, নদীতে ও সিন্ধুতে গ্রহ-উপগ্রহে–সকলেই ভালবাসায় ধরা দিয়াছে–ইহাই নিত্যবৃন্দাবনের নিত্য উৎসব।”
এই জগৎকে প্রেরণা দিতেছে বাসনা। খাদ্য, আশ্রয়, ধন, মান, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, ঐশ্বর্য্য, ক্ষমতা ইত্যাদির লোভে মানুষ সারাজীবন প্রতিনিয়ত প্রবৃত্তির পথে ঘুরিতেছে। কাম্যলাভের ব্যপদেশে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ঝগড়া বিবাদ ও লড়াই চলিতেছে। এই কাম্যের পাছে পাছে দিবারাত্র খুনোখুনি ব্যাপার—উহা এবিসিনিয়া বা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধই হউক, বা সামান্য জ্ঞাতিঘটিত মোকদ্দমাই হউক। কিন্তু যে ফিরিয়া বসে, যে বলে এই সকল কাম্যবস্তুর কিছুই আমি চাই না, এগুলি ক্ষণস্থায়া ও অসার বাহিরের ঘটা দেখিয়া সে ভোলে নাই; কিন্তু যে বিশ্বের প্রাণস্বরূপ, জীবের প্রাণস্বরূপ, যিনি মনের মন, প্রাণের প্রাণাধিক, যাঁহার শ্রীমুখের অনুপরমাণু শোভা লইয়া সরসীতে পদ্ম ও বনে উপবনে গোলাপ-কুন্দ-যূঁই-মল্লিকা ফুটিতেছে, যাঁহার অপরূপ লাবণ্যের এক তিল প্রিয়তমার মুখে ও শিশুর হাস্যে প্রকাশ পাইয়া আমাদিগকে মুগ্ধ করিতেছে, শত কুসুম ও শত চন্দনতরুর সুঘ্রাণে যাঁহার অঙ্গগন্ধ ঘোষিত হইতেছে, শত মধুচক্র, খর্জ্জুর আম্র-পনস-ইক্ষু যাঁহার অমৃতরসের সন্ধান দিতেছে, যিনি সমস্ত সৌন্দর্য্য-মাধুর্য্য ও আনন্দের উৎস-স্বরূপ–তাঁহাকেই মাত্র যদি কেহ চাহিয়া, সমস্ত ইন্দ্রিয়ের গতি মুখ ফিরাইয়া তাঁহারই জন্য প্রতীক্ষা করে–সেইরূপ অসামান্য ব্যক্তির মনস্তত্ত্ব অন্যদেশ সহস্য বুঝিতে পারিবে না। কিন্তু তাহা ভারতে অবিদিত নহে। যে ব্যক্তি এইভাবে বৈষ্ণবী মায়া কাটাইয়াছে, সে তাঁহার সহিত সমান আসনের দাবী করিতেছে। দেবতার মধ্যে একমাত্র শিব ও ব্রহ্মা এই বৈষ্ণবী মায়ায় ধরা দেন নাই। এদিকে বিষ্ণুও নিশ্চেষ্ট ছিলেন না। কৈলাসের রত্নময় পুরী শিবকে দিয়া তিনি বুবেরকে তাঁহার ভাণ্ডারী নিযুক্ত করিয়া দিলেন; কিন্তু শিব শ্মশানে-মশানে ফিরেন, বুড়ো বলদের উপর শওয়ার হন, উচ্চৈঃশ্রবা ঘোড়া বা ঐরাবত হাতীর দিকে ফিরিয়াও তাকান না। চন্দন, অগুরু প্রভৃতি গন্ধদ্রব্যের তাঁহার কাছে কোন মূল্যই নাই; ভস্ম-চন্দন ও শ্মশানের নর-কঙ্কাল তাঁহার অঙ্গের সৌষ্ঠব সাধন করে।