“রাজহংসী জিনি, গমন সুলাবণী”; এই পদে ‘সুলাবণী’ শব্দটির প্রতি লক্ষ্য করুণ। এই শব্দ ব্যাকরণশুদ্ধ নহে, এমন কি চলিত কথাও নহে, স্বর্ণকারের মত সংস্কৃতের সোণা গড়িয়া পিটিয়া তিনি এই শব্দটি রচনা করিয়াছেন।
“কিবা কনকলতা জিনি, জিনি সৌদামিনী, বিধির অবধি রূপ সাজে।”
এখানে “বিধির অবধি রূপ”–অর্থাৎ বিধাতার যতটা শক্তি তাহা তিনি রাধার রূপ সৃষ্টিতে প্রয়োগ করিয়াছেন, সুতরাং পদগুলি কবিত্বহীন, এ কথা কেহ বলিতে পারিবেন না।
এই অভিসার লইয়া বৈষ্ণব করিবা নতুন নতুন কত শ্রেণীই না বিভাগ করিয়াছেন! চৈতন্য বর্ষা-বাদলে, অমানিশার ঘোর অন্ধকারে, রৌদ্রোজ্জ্বল দিবা-দ্বিপ্রহরে, জ্যোৎস্নায়ময়ী নিশীথিনীতে হরিনাম কীর্ত্তন করিয়া বেড়াইয়াছেন, তাঁহার এই অভিসার নানা সময়ে নানা স্থানে নব নব রূপের সৃষ্টি করিয়াছে। কৃষ্ণের রূপের সন্ধান যে পাইয়াছে, তাহার মুখে চোখে সেই রূপের প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে, তাহারও রূপের অন্ত নাই। সেই রূপের যথাযথ চিত্র আঁকিতে যাইয়া কবিরা কি অলঙ্কারশাস্ত্রের খাতিরে বাদসাদ দিতে সম্মত হইতে পারেন? এইজন্য এই অভিসারের চিত্র বিচিত্র, শাস্ত্র বিমুক্ত এবং অভিনব। কবিরা অলঙ্কারশাস্ত্রের নূতন অধ্যায় সৃষ্টি করিয়াছেন। তাঁহাদের কাব্যে যেরূপ বর্ষা রাত্রির অভিসার আছে, তেমনই জ্যোৎস্নার অভিসার আছে। অমানিশির অভিসার ও দিবাভিসার উভয়ই তাঁহারা বর্ণনা করিয়াছেন এবং বাধ্য হইয়া বৈষ্ণব আলঙ্কারিকেরা তাঁহাদের শাস্ত্রে অভিসারের এই সকল নব পর্য্যায় মানিয়া লইয়াছেন।
অভিসার-বর্ণনাকারী কবিদের মধ্যে গোবিন্দদাস শ্রেষ্ঠ; তাঁহার পদাবলীতে কবিত্ব, পদমাধুর্য্য এবং অধ্যাত্মসম্পদ্ এত বেশী যে, তাহা যেরূপ কাব্য রসাম্বাদির পক্ষে উপাদেয়, সাধকের পক্ষেও তাহা কম উপভোগ্য নহে। যে দুঃখসহ বিপদের পথ অতিক্রম করিয়া রাধা কৃষ্ণের কাছে উপনীত হইয়াছেন, তাহার বর্ণনা আমাদিগকে একটা কাল্পনিক জগতে লইয়া যায়; কিন্তু গূঢ় অন্তদৃষ্টিতে দেখিলে, সাধন-ক্ষেত্রে উহা ভক্তের সিদ্ধির ইঙ্গিত স্বরূপ প্রতীয়মান হইবে।
‘‘মন্দির ত্যজি যব পদচারি আইনু, নিশি দেখি কম্পিত অঙ্গ,
তিমির দুরন্ত পথ হেরই না পারই, পদযুগ বেড়ল ভুজঙ্গ।
একে কুলকামিনী তাহে কুহু যামিনী, ঘোর গহন অতি দূর,
আর তাহে জলধর বরখিয়ে ঝর ঝর, হাম যাওব কোন পুর।
একে পদ-যুগ্ম পঙ্কে বিভূষিত, কন্টকে জর জর ভেল।
তুয়া দরশন-আশে কিছু নাহি জানিনু চিরদুঃখ অব দূরে গেল।
তোহারি মুরলী যব শ্রবণে পশিল, ছোড়ল গৃহসুখ আশ।
পথহু দুঃখ তৃণ করি মানিনু, কহতহি গোবিন্দদাস।’’
‘‘কুহু যামিনী” অর্থে অমানিশা। এই ঘনান্ধকার বাদলে অমানিশায় ঘোর গহন পথে রাধা কোন্ পুরে যাইতেছেন? কৃষ্ণ তাঁহাকে দেখা দেওয়ার আশ্বাস দিয়া কোন্ পথে লইয়া যাইতেছেন, সে পথ বৃন্দারণ্যের শ্যামকুঞ্জে কিংবা যোগী-ঋষির অধ্যূষিত কোন নিবিড় গিরিগুহায়, তাহা রাধা জানেন না। শুধু মুরলীর ধ্বনি শুনিয়া, পথ-বিপথ গণ্য না করিয়া তিনি ছুটিয়া আসিয়াছেন। যেদিন তিনি তাঁহার সেই ডাক শুনিয়াছেন, সেই দিনই তাঁহার গৃহ লোপের চিন্তা লুপ্ত হইয়াছে এবং সাধন পথের এই সমস্ত ভীষণ কষ্ট তৃণবৎ উপেক্ষা করিয়াছেন। এই সুললিত ও সুমিষ্ট শব্দে গ্রথিত পদটি কি অধ্যাত্মপথের স্পষ্ট ইঙ্গিত নহে?
কৃষ্ণদর্শনের এই যে দুর্দ্দমনীয় আবেগ ও গতিশীলতা, তাহা বিষ্ণু পদচ্যূতা সুরধুনীর স্রোতেরই মত। ইহা সাধারণ নায়ক-নায়িকা সন্ধন্ধে প্রযুজ্য নহে। এইজন্যই ইহা এমন নিছক কবি-কল্পনা ও গূঢ়-রহস্য-জড়িত ভাষায় ব্যক্ত হইয়াছে, যে–জড়বাদীরা ইহার মর্ম্ম তেমন বুঝিবেন না, যেরূপ ভাবপ্রবণ প্রেমিক বুঝিবেন।
‘‘মন্দির বাহিরে কঠিন কপাট,
চলইতে শঙ্কিত পঙ্কিল বাট,
তাহে অতি দূরতর বাদল দোল,
বাকি কি বারই নীল নিচোল।
সুন্দরি কৈছে করবি অভিসার।
হরি রহু মানস সুবধনীপার।
ঘন ঘন ঝন্ ঝন্ বজর-নিপাত,
শুনইতে শ্রবণে, মরমে মরি জাত।
দশদিশ দামিনী দহই বিথার,
শুনইতে উচকই লোচন-তার।
ইথে যদি সুন্দরি তেজব গেহ,
প্রেমক লাগি উপেথবি দেহ।
গোবিন্দ দাস কহে ইথে বিচার,
ছুটল বাণ কিয়ে যতনে নিঘার।।’’
সংসার টিটকারী দিতেছে–শত হস্ত বাড়াইয়া রাধাকে নিরন্ত করিতে চাহিতেছে। তুমি হরির সন্ধানে কোথায় যাইবে–ইহা দুরাশা; তিনি মানস-গঙ্গার ও -পারে আছেন (মনোনবদ্ধারনিষিদ্ধ-বৃত্তি আত্মসমাহিত যোগী শুধু যাঁহাকে পান)– তাঁহাকে পাইব বলিলেই কি পাওয়া হয়? এই ঘন ঘন বজ্রপাত, বিদ্যুতের চকিত আলোকে চক্ষের তারা ঝলসিয়া যাইতেছে। তুমি কি প্রেরমর জন্য দেহকে এমন করিয়া উপেক্ষা করিবে?
গোবিন্দ দাস বলিতেছেন, এখন কি আর এ বিষয়ে বিচারের অবকাশ আছে? বাণ হস্তচ্যূত হইয়াছে, এখন আর শত চেষ্টায়ও তাহার গতি ফিরান যাইবে না।
এই গীতে আবার সেই স্পষ্ট ইঙ্গিত। গোবিন্দ দাসের চক্ষের সম্মূখেই কত কুবের-তুল্য ধনাঢ্য ব্যক্তি, কত রাজপুন্ত্র কৃষ্ণপ্রেমে সর্ব্বস্ব ত্যাগ করিয়া, দুর্গম পথের কষ্ট শিরোধার্য্য করিয়া, ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছেলেন, সে ছিল বাঙালীর ত্যাগ-ধর্ম্মের সুবর্ণ যুগ। সুতরাং গোবিন্দ দাসের কবিতা কল্পনালোকের কথা নহে, সেই অধ্যত্ম-কল্প-লোকেরই কথা। কৃষ্ণ যমুনাতীরে আছেন, কিম্বা রাধাকুণ্ডের তীরে আছেন, সে সকল মামুলী কথা তিনি বলেন নাই। তিনি ধ্যানলোকে বসিয়া, সমস্ত লৌকিক সংস্কার ও কবিপ্রসিদ্ধির এলাকা ছাড়িয়া দিয়া বলিয়াছেন—“হরি রহু মানস-সুবধুনী-পার” এবং রাধাকে বলিতেছেন, “তুমি কেন অভিসার করিয়া মরিবে?–তাঁহাকে পাইবে না (“সুন্দরী কাহে করবি অভিসার”)!” কেবলই অধ্যাত্ম-তথ্যের ইঙ্গিত দিয়া তিনি কাব্যের মর্য্যাদা ক্ষুন্ন করেন নাই, কবিদের পথেই চলিয়াছেন–
‘‘তহে অতি দূরতর বাদল-দোল,
বারি কি বারই নীল নিচোল।’’
বর্ষার অবিরত বৃষ্টিপাতে দূর প্রসারিত অরণ্যের রেখা পর্য্যাস্ত দোল খাইতেছে। তুমি কি এই ক্ষীণ নীল শাড়ীর আঁচল দিয়া সেই বাদলের বেগ নিবারণ করিতে পারিবে?