অভিসারের অধ্যায় বৈষ্ণব কবিতা-রত্নমালার মধ্যমণি-স্বরূপ। বিদ্যাপতি অভিসারের অনেকগুলি পদ লিখিয়াছেন, তাহা অলঙ্গারশাস্ত্রের অনুবর্ত্তী শব্দ চ্ছন্দ ও ভাবের ঐশ্বর্য্যে ঝলমল–
‘‘জিনি করিবর রাজহংস-গতি গামিনী চললহি সঙ্কেত গেহা।
অমল তড়িতদণ্ড হেমমঞ্জরী জিনি অতি সু্ন্দর দেহা।
কনকমুকুর শশী কমল জিনিয়া মুখ বিম্ব-অধর পবায়ে।
দশনমুকুতাপাঁতি কুন্দ করগ বীজ জিনি কুম্বু কণ্ঠ-আকারে।’’
এই ভাবে পদের পর পদ চলিয়াছে, অলঙ্কারে বোঝাই যেন একখানি পানসী নৌকা চলিয়াছে। শব্দগুলি শ্রুতির চমকপ্রদ, কিন্তু সংঙ্কত শব্দের বাহুল্য ও উপমা ও উৎপ্রেক্ষা যেন অভিসারিকার গতি কতকটা রোধ করিয়া ফেলিয়াছে। চৈতন্যপ্রেমের বন্যায় কিছু পরে অভিসারিকার ভিঙ্গি আশ্চর্য্য গতিশীলতা লাভ করিয়াছিল।
প্রেমের জন্য অভিসার কি, তাহা চৈতন্যদেব বুঝাইয়া দিলেন। ঘর বাড়ী, আত্নীয়গস্বজন–সমস্ত ত্যাগ করিয়া প্রেমযাত্রী কি ভাবে অভিসার করেন, তাহার একখানি সুস্পষ্ট পট কবিরা এবার চোখের সামনে দেখিতে পাইলেন। সে প্রেম-যাত্রীর রূপ কি কখনও ভোলা যায়? সংকীর্ত্তনের মধ্যে যে পরমানন্দেন মূর্ত্ত-রূপ তাঁহারা দেখিলেন, তাহা তাঁহাদের হৃদয়ে ভাবোচ্ছ্বাস বহাইয়া দিল। বৈষ্ণব কবিরা এই অভিসারের রূপক দিয়া চৈতন্যকে যতটা বুঝাইয়াছেন, তাঁহার চরিতকারেরা তাহা পারেন নাই। এখানে রাইকিশোরীর মূর্ত্তি যেরূপ ফুটিয়াছে, বৈষ্ণব কবিতায়ও অন্য কোন স্থানে তাঁহার রূপ তদ্রুপ ফোটে নাই। এজন্য বৈষ্ণবেরা অভিসারের নাম রূপাভিসার দিয়াছেন। যিনি রূপের ফাঁদে পা দিয়া, সেই আনন্দ স্বরূপের সন্ধানে যাইতেছেন, তিনি প্রেমিকের চক্ষে অপূর্ব্ব রূপসী। রাধা এজন্য বলিতেছেনঃ–
‘‘তোমার গরবে, গরবিনী হাম, রূপসী তোমার রূপে।’’
রমণী মনি শ্যাম-অভিসারে যাইতেছেন, মুখখানি পূর্ণেন্দুর মত–
‘‘একে সে তরুণ ইন্দু, মলয়জ বিন্দু বিন্দু,
কস্তুরী-তিলক তাহে রাজে,
পিঠে দোলে হেম ঝাপা, রঙ্গিয়া পাটের খোঁপা,
নাসার মুকুতারাজি সাজে।”
“শ্যাম-অভিসারে চলু বিনোদিনী রাধা,
নীলবসনে মুখ ঝাঁপিয়াছে আধা।
সুকুঞ্চিত কেশে রাই বাঁধিয়া কবরী,
কুন্তলে বুকলমালা গুঞ্জরে ভ্রমরী।
নাসার বেশর দোলে মারুত-হিল্লোলে,
নবীন কোকিলা যেন আধ-আধ বোলে।
আবেশে সখীর অঙ্গে অঙ্গ হেলাইয়া
বৃন্দাবনে প্রবেশিল শ্যাম জয় দিয়া।’’
অভিসার বর্ণনা করিতে করিতে কবি অনন্ত দাস চৈতন্যের ভাবে আবিষ্ট হইয়া পড়িয়াছেন। কারণ সে রাধা রূপক হইলেও চৈতন্যেরই রূপ। অনন্ত দাস চৈতন্যের সমসাময়িক কবি, সংকীর্ত্তন কালে তাঁহারই মুখ দেখিয়া অভিসারিকাকে আঁকিয়াছেন। অনন্ত দাস সংস্কৃতে সুপণ্ডিত ছিলেন, কিন্তু সেই রুপ দেখিয়া তিনি অলঙ্কারশাস্ত্র ভুলিয়া গেলেন। এই শাস্ত্রের নির্দ্দেশে মুখর নূপুর পা হইতে খুলিয়া ফেলিয়া নিঃশব্দে যাইতে হয়; (“মুখরমধীরং ত্যজ মঞ্জীরং”)–কিন্তু কবি লিখিলেন, “চৌদিকে রমণী সাজে, ডম্ফ রবার বাজে”–সমস্ত আইন-কানুন উলটপালট হইয়া গেল, প্রেমযাত্রী এখানে রণ-যাত্রীর ন্যায় নির্ভীক; কলঙ্কের ভয় আর নাই–ডম্ফ, রবার, রামশিঙ্গা, বাজাইয়া চলিয়াছেন। ডম্ফ, অর্থাৎ জয়ঢাক, এত বড় এই যন্ত্র যে, একজন পিঠে বহে আর একজন বাজাইতে বাজাইতে তাহার প্রবল শব্দে দশদিক প্রকম্পিত হয়। এক কবি রাধার মুখে বলিতেছেন “ননদিনী তুই বল গিয়ে নাগরে, ডুবেছে রাই রাজ-নন্দিনী কৃষ্ণপ্রেম-কলঙ্ক-সাগরে।” অলঙ্কারশাস্ত্রের ক্ষীণপ্রাণা ভীরু অভিসারিকা এত জোর পাইবে কোথা হইতে? অভিসারিকার আর এখানে সে যুগের ভয় শঙ্কিতা মূর্ত্তি নাই, এই যুগের অভিসার অর্থ কৃষ্ণপ্রেমে আকণ্ঠ নিমির্জ্জিত কৃষ্ণ প্রেমে গর্ব্বিত চৈতন্যের সংকীর্ত্তন যাহারা কাজীর ফৌজের মাথায় ঢিল ছুঁড়িয়াছিল।
মনে হইতে পারে–সাম্প্রদায়িক ধর্ম্মের কথা এতটা স্পষ্ট করিয়া বলাতে কবিত্বের দিক্ হইতে কবি পথ-ভ্রষ্ট হইয়া পড়িয়াছেন; কিন্তু তিনি তাহা হন নাই। যিনি চৈতন্যকে কীর্ত্তনের মধ্যে দেখিয়াছেন—“কত সুরধুনী বহে ও দুটি নয়নে”–ধারাহত পদ্মের ন্যায় অশ্রুপ্নাবিত শ্রীমুখের সৌন্দর্য্য দেখিয়াছেন, তিনি কাব্য-রস বিচ্যুত হইবেন কেন? কাজীর বাড়ীর কাছে চৈতন্যের মহাসংকীর্ত্তনের বর্ণনা কালে বৃন্দাবন দাস বলিয়াছেন, সেই কীর্ত্তনে শত শত মশালে ও দেউটির আলোকে নদীয়ার রাত্রি দিনের মত উজ্জ্বল হইয়াছিল। কিন্তু যাহার “ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবনী” অবনী বহিয়া যায়, সেই গোবিন্দের অশ্রুসিক্ত মুখখানি কীর্ত্তনে যে যে জায়গায় জাগিয়া উঠিত, সেখানে সেই মুখ শোভা দেখিবার জন্য শত শত দীপ জ্বলিয়া উঠিত ও জনতার ভীড় তথায় উদ্দাম হইয়া উঠিত। তাঁহার সেই ‘সরসিজমনুবিদ্ধং শৈবালে পিবম্যং’ শুধু কুঞ্চিত কেশদামশোভিত মুখখানি, এবং কৃষ্ণবিরহ খিলক ‘পরিমৃদিত স্টব মৃণালী’ তনু যে দেখিত, তাহার হৃদয়ে কি কবিত্বের উৎস কখনও শুকাইতে পারে!
অনন্তদাস লিখিয়াছেন,–
‘‘চলাইতে চরশের সঙ্গে চলে মধুকর, মকরন্দ পান কি লোভে?
সৌরভে উনমত, ধরণী চুমুয়ে কত, যাঁহা যাঁহা পদ-চিহ্ন শোভে।’’
গৌরহরি বলিতেছেন–
‘‘ছুটল পদ্মের গন্ধ বিমোহিত করি,
অজ্ঞান হইয়া নাম করে গৌরহরি’’
এখানে রাধার অঙ্গে পদ্ম-গন্ধ, ভ্রমরগণ সেই ঘ্রাণে আকৃষ্ট হইয়া তাঁহার কাছে উড়িয়া বেড়াইতেছে, এদিকে রাধার আলতা রঞ্জিত চরণ চিহ্ন মাটীর উপর পড়িতেছে, সেই রক্তিম চিহ্নকে পদ্ম ভ্রম করিয়া ভ্রমরগুলি মৃত্তিকা চুম্বন করিতেছে। অনন্তদাসের কবিত্ব সাম্প্রদায়িক জটিল রূপকের মধ্যে পড়িয়া হারাইয়া যায় নাই–তিনি লিখিয়াছেন–