সুতরাং বলা যাইতে পারে “আমি পরাণনাথেরে স্বপনে দেখিনু” পদটিতে জ্ঞানদাস যেরূপ কততটা যোগ করিয়া সৌষ্ঠব সাধন করিয়াছেন, এই পদেও তিনি তাহাই করিয়াছেন। পদগুলিতে তিনি নিজের ভণিতা দিতে গেলেন কেন?–এই প্রশ্ন হইতে পারে। সমালোচনার আদালতে মোকদ্দমাটি উপস্থিত করিলে, জ্ঞানদাস দোষী কি না নির্ণীত হইবে; আমি শুধু এই বলিব, যে প্রাচীন ছাঁচে ঢালাই করিয়া নূতন কবির নামের ছাপ দেওয়া হয়ত সেকালের রীতি ছিল। একথাও বলা চলে যে, গায়েনেরাই এই ভাবের ভণিতা দিয়াছেন, তজ্জন্য কবি দোষী নহেন। তাঁহারা তো ভণিতা লইয়া এরূপ খামখেয়ালী অনেক সময়েই করিয়া থাকেন। সেদিনও কবিওয়ালা এন্টানির গানে ইঁহারা “দ্বিজ এন্টোনী বলে” এইরূপ ভণিতা দিয়া ফিরিঙ্গী কবিকে জাতে তুলিয়া লইয়াচেন। এখনও কবিরা পূর্ব্ববর্ত্তী কবিদের রচনার উপর অধিকার স্থাপন না করেন, তাহা নহে। টেনিসনের রাউন্ড-টেবিলের গল্পগুলি মোবিনিজিন গাথার অনেকটা পুনরাবৃত্তি।
১২. অভিসার
চণ্ডীদাসের গানে অভিসারের পদ একরূপ নাই বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না, অথচ বহু পূবর্ববর্ত্তী জয়দবের পদে তাহা আছে। অলঙ্কার শাস্ত্রে অভিসারিকা সম্বন্ধে অনেক নিয়ম ও রীতির উল্লেখ দৃষ্ট হয়। প্রোষিতভর্ত্তৃকা, খণ্ডিতা, কলহাস্তরিতা সম্বন্ধেও অনেক আইনকানুন আছে। প্রোষিত ভর্ত্তৃকা একেবাণীধরা হইবেন, অভিসারিকা আঁধারে গা ঢাকা দিবার জন্য নীলাম্বরী পরিবেন, নুপুর ত্যাগ করিয়া নিঃশব্দে পথে চলিবেন ইত্যাদি। কিন্তু চণ্ডীদাস নিজের মনে চলিয়াছেন, তিনি অলঙ্কারশাস্ত্রের প্রতি মোটেই লক্ষ্য করেন নাই। একটি সুবিখ্যাত পদে তিন কৃষ্ণের অভিসার বর্ণন করিয়াছেন। প্রাচীন পল্লী গীতিকায়ও আমরা মহিষাল বধুর অভিসার ও ধোপার পাটে রাজকুমারের অভিসারের সঙ্গে পরিচিত হইয়াছি। এই শেষোক্ত প্রণয়ীর অভিসার যেভাবে বর্ণিত হইয়াছে, তাহা অনেকটা চণ্ডীদাস বর্ণিত এ ঘোর যামিনী মেঘের ঘটা, কেমনে আইলা বাটে প্রভৃতি পদের অভিসারের মত। চণ্ডীদাসের এই পদটির সমালোচনা কালে রবীন্দ্রনাথ বহুপূর্ব্বে ইহার গূঢ় বিশ্লেষণ করিয়া দেখাইয়াছিলেন। তিনি কতকটা এই ভাবে কবির কবিত্ব ও রচনানৈপুণ্য বুঝাইয়া ছিলেন, (সকল কথা আমার মনে নাই ও সেই সমালোচনাটিও এখন সুলভ নহে)। কবি তাঁহার কথার ফাঁকে এমন সকল কথা বলিয়াছেন যে, তদ্দ্বারা বুঝা যায়–রাধার বলিবার উর্দ্দিষ্ট এক ব্যক্তি নহে। তিনি কখনও কৃষ্ণকে কখনও সখীকে, কখনও বা নিজেকেই নিজে সম্বোধন করিয়া বলিয়াছেন, অথচ কাহাকে তিনি সম্বোধন করিতেছেন, তাহা স্পষ্ট করিয়া বলেন নাই।
আমরা তদ্রচিত “কাহারে কহিব মনের মরম, কেবা যাবে পরতীত” পদের আলোচনা-কালে বলিয়াছিলাম, কবির কথায় অনেক ছেদ থাকে, তিনি সমস্ত কথা বলেন নাই; যাহা বলিয়াছেন, তাহা ছাড়া অনেক ইঙ্গিত করিয়াছেন–সমঝদার পাঠক সেই সকল ফাঁক পূর্ণ করিবেন। এখনকার কাব্যক্ষেত্র অনেক সময়ে বাকপল্লব ও আগাছায় পূর্ণ, সেক্সপীয়রের “Brevity is the soul of wit” নীতি-পালনের লোক খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন। কিন্তু চণ্ডীদাস যখন ভাবে আবিষ্ট হইয়া যাইতেন, তখন গূঢ় অনুভূতির দরুণ বাজে কথা, এমন কি বক্তব্য বিষয় বুঝাইবার পক্ষে যাহা কতকটা দরকার, তাহাও তাহার বলিবার একান্ত অবসর হইত না।
‘‘এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা, কেমনে আইলা বাটে?’’
এ কথাটা রাধা স্পষ্টই কৃষ্ণকে সম্বোধন করিয়া বলিয়াছেন। তাহার পরে যেন মুখ ফিরাইয়া সখীকে বলিতেছেন-
‘‘আঙ্গিনার মাঝে বঁধুয়া ভিজিছে, দেখে যে পরাণ ফাটে।’’
তারপর জনাস্তিকে বলিতেছেন–
‘‘ঘরে গুরুজন, ননদী দারুন, বিলম্বে বাহির হৈনু।’’
এবং আবার কৃষ্ণকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন–
‘‘আহা মরি মরি সঙ্কেত করিয়া কত না যাতনা দিনু।’’
তারপর পুনশ্চ সখীর প্রতি–
“বঁধুর পীরিতি আরতি দেখিয়া, মোর মনে হেন করে,
কলঙ্কের ডালি মাথার করিয়া, অনল ভেজাই ঘরে।
আপনার দুঃখ, সুখ করি মানে, আমার দুঃখের দুঃখী,
চণ্ডীদাস কহে কানুর পীরিতি, শুনিয়া জগৎ সুখী।”
এই পদটিতে একটা প্রচ্ছন্ন নাট্যকৌশল উপলব্ধ হইবে। রাধা ঘুরিয়া ফিরিয়া বারংবার মুখ ফিরাইয়া যাহা বলিতেছেন, কবি যেন তাহা মানসকর্ণে শুনিতেছেন এবং মানস চক্ষে সে দৃশ্য দেখিতেছেন; তিনি যাহা শুনিতেছেন বা দেখিতেছেন, তাহাই বলিয়া যাইতেছেন। আত্মবিস্মৃত কবি ভুলিয়া গিয়াছেন যে, তাঁহার কথা শুনিবার জন্য বাহিরের লোক কাণ পাতিয়া আছে, তাহাদের জন্য পরিচয়ের ভূমিকাটার দরকার ছিল। এই সম্পূর্ণ আত্মস্থভাব শুধু মহাকবিদের মধ্যেই দেখা যায়। বাল্মীকির রামায়ণে এইরূপ দৃষ্টান্ত মাঝে মাঝে আছে। এমনও হইতে পারে যে, যাঁহারা সেকালে চণ্ডীদাসের গান গাইতেন, তাঁহারা অঙ্গুলী সঙ্কেত ও অঙ্গভঙ্গী দ্বারা কবির অকথিত কথাগুলি পূরণ করিয়া বুঝাইতেন।
ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে আমার অভিসারিকাদের সম্বন্ধে কথা হইয়াছিল। তিনি বলিয়াছিলেন, “আমাদের দেশে পুরুষেরাই নায়িকার কাছে যায়। নায়িকারা কখনই এ-ভাবে মিলনের জন্য অভিসারে যাত্রা করেন না। এই রীতি নারী-প্রকৃতির স্বাভাবিক লজ্জা শীলতার বিরোধী।” উত্তরে আমি বলিয়াছিলাম—“যে দেশে নারী ও পুরুষ স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করেন এবং একে অন্যের কাছে যখন তখন যাওয়া আসা করিতে পারেন, সেখানে পুরুষের যাওয়া ঠিক ও সঙ্গত; কিন্তু আমাদের অন্তঃপুরের অবরোধের মধ্যে পুরুষের প্রবেশ অসম্ভব। পুরুষ কি করিয়া কোন নারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিবে? সুতরাং নারীকেই সংগোপনে চুরি করিয়া বাহির হইতে হয়–ভ্রমরের সন্ধানে ফুলকেই বাহির হইতে হয়।”