এই চিত্রে স্বপ্নে-পাওয়া কৃষ্ণসঙ্গের সুখোপলব্ধির প্রগাঢ়ত্ব ও তাঁহাকে হারাইবার মর্ম্মস্তুদ ক্ষোভ প্রদর্শিত হইয়াছে।
এই কবিতাটির রসাস্বাদ করিতে করিতে চণ্ডীদাসের সম্মোহন সুরে জ্ঞানদাসের হৃদ্তন্ত্রী বাজিয়া উঠিয়াছিল। তিনি পদটি বড়াইয়া নিজের ভণিতা দিয়া চালাইয়াছেন–চোরের মত নহে, শিষ্যের মত, আখরিয়ার মত, টীকাকারের মত–তাহাতে পদটির ভাবের মর্য্যাদা একটুকুও খর্ব্ব হয় নাই, কিন্তু কবিত্বের সৌন্দর্য্য বাড়িয়াছে। এই কবিত্ব চণ্ডীদাসের পদ তাঁহার মনে জাগাইয়া তুলিয়াছিল, উহা তিনি অপর কোন স্থান হইতে কুড়াইয়া পান নাই। এ যেমন গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজার মত। চণ্ডীদাসের ভাবধারা অনুসরণ করিয়া, সেই ধারায় উদ্ভূত হৃদয়োচ্ছ্বাস দিয়া তিনি চণ্ডীদাসের কবিতাটি সাজাইয়াছেন। আমি তৎকৃত যোজনাসহ কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত করিতেছি।
আমি তৎকৃত যোজনাসহ কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত করিতেছি।
“আমি পরাণনাথেরে স্বপনে দেখিলাম, সে যে বসিয়া শিয়র পাশে,
নাসার বেশর পরশ করিয়া ঈষৎ মধুর হাসে।
কিবা রজনী শাওণ, ঘন দেয়া গরজন,
রিমি ঝিমি শবদে বরিবে,
পালঙ্কশয়ন রঙ্গে, বিগলিত চীর অঙ্গে,
আমি নিঁদ যাই মনের হরিষে।
শিখরে শিখণ্ডী রোল, মত্ত দাদুরী বোল,
কোকিলা ডাকিছে কুতূহলে,
ঝিঁ ঝিঁ ঝিমকি ঝাঁজে, ডাহকী সে গরজে,
আমি স্বপন দেখিলাম হেন কালে।
আখরিয়া কৃষ্ণের হাসিটির ব্যাখ্যা করিয়া বলিবে–সে হাসি ছুরির মত, হৃদয় কাটিয়া যায়; মিষ্টত্বের এই তীক্ষ্ম আঘাত যিনি বুঝিয়াছেন, তিনিই এই কথার অর্থ বুঝিবেন। কোন সময়ে হাসি যে ধারাল ছুরির মত হৃদয় কাটিয়া যায়, তাহা কেহ কেহ হয়ত অনুভব করিয়া থাকিবেন।
পরবর্ত্তী অংশে জ্ঞানদাস যে কয়েকটি ছত্র (কিবা রজনী শাওণ… আমি স্বপন দেখিলাম হেন কালে) যেন করিয়াছেন, তাহাতে মনের অবস্থার উপর রং ফলাইয়া তিনি বর্ষারাত্রের এই মিলনের রস প্রগাঢ় করিয়াছেন।
যদিও কোন কোন সংগ্রহ-পুস্তকে সমস্ত পদটিই চণ্ডীদাসের ভণিতায় পাওয়া যায়, এই প্রকৃতি -বর্ণনার সুরটি কখনই চণ্ডীদাসের নহে, ইহা শব্দ-কুশলী পরবর্ত্তী কোন কবির রচনা। সে কবি কে, তাহা আবিস্কার করাও কষ্টসাধ্য নহে। বহু সংগ্রহ গ্রন্থে–বিশেষ ময়নাডলার মিত্র-ঠাকুরদের সংগৃহীত কোন কোন খাতায় এই গানটির ভণিতায় জ্ঞানদাসের নাম পাওয়া যায়। প্রধানতম পুঁথিগুলিতে এই প্রকৃতির বর্ণনার অংশটুকু বাদে বাকী চণ্ডীদাসের ভণিতায় দেওয়া হইয়াছে। সুতরাং স্বীকার করিতে হইবে, নিরাভরণা সুন্দরীর গলায় কেহ মতির মালা পরাইয়া দিলে যেরূপ হয়, জ্ঞানদাস সেইভাবে চণ্ডীদাসের পদটির অঙ্গসৌষ্ঠব সাধন করিয়াছেন।
এই যোজনায় মেঘাগমে বিরহের চিত্র অতি স্পষ্ট হইয়াছে রাধিকার ঘুমস্ত অবস্থায় দৃশ্যপটে কোন রূপের বর্ণনা সঙ্গত বা শোভন হইত না। এজন্য কবি কেবল শ্রুতির দিকে লক্ষ্য রাখিয়া এরূপ বর্ণনা দিয়াছেন–যাহাতে ঘুমের আবেশ বৃদ্ধি হয়। কেবল সুরই তাঁহার লক্ষ্য। কর্ণ যদিও কতকটা নিষ্ক্রিয়, তথাপি যেটুক সজাগ, তাহাতে সুরের মোহ নিদ্রিতের ঘুমের আবেশ বৃদ্ধি হয়। কেবল সুরই তাঁহার লক্ষ্য। কর্ণ যদিও কতকটা নিস্ক্রিয়, তথাপি যেটুকু সজাগ, তাহাতে সুরের মোহ নিদ্রিতের মনে পৌঁছিতে পারে। শিশুর ঘুমন্ত অবস্থায়ও কিছুকাল জননী ঘুমপাড়ানিয়া গান আবৃত্তি করিতে থাকেন, চক্ষু যখন একেবারে মুদিত, তখনও ঘুমের অবস্থায় শ্রুতি কিছুকাল সজাগ থাকে। “রজনী শাওণ (শ্রাবণ) ঘনঘন (বারংবার) দেয়া (মেঘ) গরজন”–এখানে মেঘের সম্পদ্ বা আকৃতি সম্বন্ধে একটি অক্ষরও নাই,–মেঘের “রিমিঝিমি” শব্দে ঘুমের আবেশ বৃদ্ধি করে। বৃষ্টি-বিন্দুর রূপ হীরার মত কি মুক্তার মত, কবি তাহা বলেন নাই; কারণ শব্দই কবির লক্ষ্য। “ঝিঁ ঝিঁ ঝিমকি ঝাঁকে–ডাহকী সে গরজে” প্রভৃতিও শব্দমন্ত্র; ইহা দিয়া কবি আমাদিগকে এক ঘুমন্ত পুরীতে লইয়া গিয়াছেন। সেই মোহনিদ্রাতর রজনীর আবেম বর্দ্ধক বিচিত্র সুরের রাজ্যে কৃষ্ণের স্বপ্ন শ্রুত মধুরাক্ষরা বাণী রাধাকে অপর কোন জগতের আকস্মিক প্রিয়-জনের আহবানের মত আবিষ্ট করিয়া ফেলিল। চণ্ডীদাসের কবিতায় এই যোজনা তাঁহার প্রিয় শিষ্য জ্ঞানদাস ভাবের সঙ্গতি রাখিয়া করিয়াছেন, এজন্য ইহাতে নিন্দার কিছু নাই।
আর একটি পদ, যাহা কোন কোন প্রাচীন পুঁথিতে চণ্ডীদাসের কোন কোনটিতে জ্ঞানদাসের ভণিতায় পাওয়া যায়, তৎসম্বন্ধেও আমার কিছু বক্তব্য আছে। সে পদাটি বিখ্যাত–
‘‘সুখের লাগিয়া এঘর করিনু, আগুনে পুড়িয়া গেল,
অমিয় সাগরে সিনান করিতে সকলই গরল ভেল।
উচল ভাবিয়া অচলে চড়িনু, পড়িনু অগাধ জলে,
লছমী চাহিতে দারিদ্র্য বাড়ল, মাণিক হারালাম হেলে।
সাগর সেচিলাম, নগর বাঁধিলাম, বসতি করিবার আশে।
সাগর শুকাল, নগর ভাঙ্গিল, অভাগীর করম দোষে।’’
সকলেই অবগত আছেন। জ্ঞানদাস চণ্ডীদাসের অনেক পদই নূতন করিয়া ঢালাই করিয়াছেন। এই গানে চণ্ডীদাসের সুরটী পাওয়া গেলেও ইহার মালিকানা সাব্যস্ত করা সহজ হইবে না। এখনও অনেক তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথের ভাবের প্রতিধ্বনি তুলিয়াই ক্ষান্ত হন না, তাঁহার হস্তাক্ষরেরও অবিকল অনুকরণ করিয়া–কোনটি গুরুর পদ, কোনটি শিষ্যের, এই প্রশ্ন সময়ে সময়ে জটিল করিয়া তোলেন। জ্ঞানদাসেরও মৌলিকতা ও কবিত্বশক্তি যথেষ্ট ছিল; সুতরাং তিনি যে উদ্ধৃত পদটির মত একটি সুন্দর পদ নিজেই রচনা করিতে পারিতেন না, তাহা বলা যায় না। তবে প্রাচীনতম পুঁথির পাঠগুলি ও ভণিতাই এক্ষেত্রে প্রামান্য। অপেক্ষাকৃত আধুনিক পুঁথিতে এবং মুদ্রিত পুস্তকগুলিতে দেখা যায়, কোন কোনটিতে পদটী চণ্ডীদাসের এবং কোন কোনটিতে জ্ঞানদাসের ভণিতায় পাওয়া যায়, একথা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। খুব প্রাচীন পুঁথিতে ইহা চণ্ডীদাসের ভণিতায়ই পাওয়া যায়। কিন্তু যে ভাবে পাওয়া যায়, তাহা ঠিক উদ্ধৃত পাঠের মত নহে, কাঠামোটা ঠিক রাখিয়া পরবর্ত্তী কবি চাল চিত্রটা অনেকখানি বদলাইয়াছেন।