এ যেন পুষ্পতরু, মাটীকেই একমাত্র আশ্রয় মনে করিয়াম বহু শিকড় দ্বারা তাহাকে আকঁড়াইয়া ধরিয়াছে। তাহার উর্দ্ধে নীলাকাশ, শত শত পাখী কলবর করিয়া তথায় উড়িয়া যাইতেছে, কিন্তু তরু উড়িতে চাহিয়া জল ভিক্ষা করে না, তাহার দশদিকে কত পশু, জীব, মানব নান কাম্যবস্তুর লোভে ছুটাছুটি করিতেছে–সেই দশ দিকের দশপথ সে দেখে না। সে যাহা আরাধনা করে, তাহা সমস্তই মাতৃক্রোড়ে বসিয়া, মাতার নিকট। এইভাবে সকল দিক্ হইতে মন সরাইয়া আনিয়া তাঁহাকে সমর্পণ করিলে এবং যোগীর মত আত্মস্থ, ধ্যানস্থ হইয়া তপস্য করিতে পারিলে, সর্ব্বসিদ্ধি লাভ হয়। কাম্যের অধিক ফল অযাচিতভাবে আসিয়া হাতে পড়ে। যে মাটীর আপাত দৃষ্টিতে কোন বর্ণ সম্পদই নাই –যাহা ঘ্রাণহীন ও নীরস, সেই মাটী হইতে বর্ণের সম্রাজ্ঞী পদ্মিনী ফুটিয়া উঠে কিরূপে? কোথা হইতে গোলাপ, মল্লিকা, বেলা, কুন্দ এত শোভা এত গন্ধ পায়? কোথা হইতে ফজলী ও নেংড়া আমের গাছ এবং খর্জ্জর তরু ও ইক্ষুলতা অফুরন্ত অমৃত রসে সমৃন্ধ হয়? কোথা হইতে চন্দন তাহার সুবাস সংগ্রহ করে? এই আত্মস্থ তপস্যার বলে। উহারা সংসারের নানাদিকের নানা প্রলোবনে আকৃষ্ট হয় নাই, উহারা বুঝিয়াছে জীব মানবের গতিশীলতা ভুল পথে লইয়া যায়। তাহারা বুঝিয়াছে, যিনি চারিদিকে এত সম্পদের সৃষ্টি করিয়া বিশ্ব চরাচরে ঝলমল করিয়া প্রকাশ পাইয়াছেন, তিনি এই মূহূর্ত্তে এইখানেই আছেন। যিনি জীবের নিকট হইতেও নিকট, তাঁহাকে খুঁজিতে অন্যত্র যাইয়া লাভ নাই–বরং তাহাতে লোকসান আছে। বাহিরের ছবি ছায়াবাজির মত, তাহারা খাঁটী জিনিস দেখায় না। এইজন্য তরু যেখানে জন্মিয়াছে, সেইখানেই আসন পাতিয়া বসিয়া তপস্যা করিতেছে। সে বুঝিয়াছে, বাড়ী ঘর নিরাপদ নহে, উহা মাথায় ভাঙ্গিয়া পড়িতে পারে, বজ্রপাতে ছাদ ভাঙ্গিয়া যায়। গৃহের মধ্যেও সর্পে দংশন করে, আবৃত স্থানে থাকিলেও পীড়া হয়- ইহা সংস্কার ও অভ্যাস মাত্র, বরং পশু পক্ষীর জীবনই স্বাভাবিক জীবন। ভগবানের চরণপদ্ম ছাড়া আর কোন আশ্রয়ই আশ্রয় নহে। এজন্য তরু আশ্রয়ের জন্য চতুর্দ্দিকে ধাবমান হয় না, সে শুধু লতার মত তাঁহাকেই জড়াইয়া থাকিতে চায়; ভগবানের চরণপদ্মই তাহার সর্ব্ব আশ্রয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আশ্রয়। আকাশ যখন ঘনঘটাচ্ছন্ন হয়, বিদ্যুৎস্ফূরণে দিক্ প্রকম্পিত হয়, ভীষণ অজগর যখন ফোঁস ফোঁস করিতে করিতে নেত্রে অগ্নিবর্ষণ করিয়া ছুটিয়া আসে, তখন হয়ত সে তাঁহার কৃপালাভ করিতে পারিলে নিরাপদে থাকে, ঘন বর্ষণে তাহার পত্র পল্লব আরও সবুজ হয়, তাহার শিব তুল্য দেহ জড়াইয়া ধরিয়া সর্প নিজের বিষের জ্বালা তুলিয়া যায়–কারণ সে অমৃতময়কে আশ্রয় করিয়া অমৃতময় হইয়া উঠিয়াছে।
বৈষ্ণবের জ্ঞানকর্ম্ম ছাড়িয়া এজন্যই তাঁহাকে আশ্রয় করাই প্রেমিকের শেষ লক্ষ্য বলিয়া নির্দ্দিষ্ট করিয়াছেন এবং গীতা বলিয়াছেন “সর্ব্বসর্ম্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরশং ব্রজ।”
চণ্ডীদাসের রাধা এইভাবে সমন্ত আশ্রয় ত্যাগ করিয়াছেন। একুল ওকুল, এই দুই কুল ত্যাগ করিয়া তিনি একেবারে কৃষ্ণপ্রেমের মাঝ দরিয়ায় ঝাপ দিয়াছেন। তিনি ধনিশ্রেষ্ঠ আয়াণ ঘোষের অট্টালিকা ও বৃষভানুর প্রাসাদ ছাড়িয়া দিয়া, বসনভূষণ পরিত্যাগপূর্ব্বক একেবারে রিক্তা হইয়া পথে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন–তখন কানু-অনুরাগই তাঁহার একমাত্র রাজাবাস, কানুর কলঙ্কই এই দিগম্বরী সন্ন্যাসিনীর অঙ্গভষ্ম, কানুর নাম শ্রবণই তাঁহার শ্রুতির মহর্ঘ অলঙ্কার–যোগিনীর কুণ্ডল, ভিতরে ও বাহিরে তিনি সম্পূর্ণরূপে কৃষ্ণের হইয়া বলিতেছেনঃ–
‘‘সবে বলে মোরে শ্যাম সোহাগিনী, গৌরবে ভরল দে।
হামারি গরব তুহুঁ বাড়ায়লি অব টুটায়ব কে?’’
আর একটি পদে গৃহে থাকাকালীন তিনি যে কষ্ট পাইয়াছেন–তাহার ইতিহাস দিতেছেন–হে কৃষ্ণ, আমি স্ত্রীলোক, কি করিয়া তোমায় মনের দুঃখ বুঝাইব? আমার পা আছে, কিন্তু চলিবার সাধ্য নাই, কোন ছলে তোমার শ্রীমন্দিরের দিকে পা বাড়াইলে লোকে টিট্কারী দেয়; আমার মুখ আছে, কিন্তু কিছু বলিবার সাধ্য নাই, এজন্যই লোকে স্ত্রীলোককে “অবোলা” বলে। এক স্থানে চণ্ডীদাস রাধিকার মুখে বলিয়াছেন–চোরের মা যেমন ফুকারিয়া কাঁদিতে পারে না, তাঁহার সেই অবস্থা। আমার চোখ আছে, কিন্তু নয়নাভিরাম মূর্ত্তি আমার দেখিবার সাধ্য নাই। (“নিশ্বাস ফেলিতে না দেয় ঘরে ননদিনী”) চোখ মেলিলে বলে—‘কি দেখ্ছ’; চোখের জল ফেলিলে বলে—‘কেন কাঁদ্ছ’। বঁধু, স্ত্রীলোকের মনের দুঃখ মনেই থাকে।
‘‘শুনহে চিকন কালা,
বলিব কি আর, চরণে তোমার,
অবলার যত জ্বালা!,
চরণ থাকিতে না পারি চলিতে
সদা যে পরের বশ,
কোন ছলবলে তব কাছে এলে
লোকে করে অপযশ!
বদন থাকিতে না পারি বলিতে
তেঁই সে ‘অবোলা’ নাম,
নয়ন থাকিতে সদা দরশন
না পেলেম নবীন শ্যম।
অবলার যত দুঃখ প্রাণনাথ,
সব থাকে মনে মনে।’’
চণ্ডীদাস কাব্যলোকের ঊর্দ্ধে–সরস্বতীর এলাকা ছাড়িয়া তিনি সরস্বতীনাথের রাজ্যে গিয়াছেন। এজন্য উপমা ও উৎপ্রেক্ষায় যেরূপ বিদ্যাপতির পদ ঝলমল, সে তুলনায় ইঁহার কবিতা কতকটা নিরাভরণ–তাহার যোগিনীর বেশ; কিন্তু মর্ম্মের মর্ম্মকথা তিনি যেরূপ আবেগে প্রকাশ করিয়াছেন, তাহাতে সর্ব্বত্যাগী আত্মবিস্মৃত প্রেমের মূর্ত্তি মহিমান্বিত হইয়া উঠিয়াছে। তাঁহার এক একটি পদ হৃদয়ে ঘা দিয়া মর্ম্মের কথা টানিয়া বাহির করে। পরবর্ত্তী কবিরা তাঁহার পদগুলির মধ্যে আখর যোজনা করিয়া সেগুলি সমৃদ্ধ করিতে চেষ্টা পাইয়াছেন, তাঁহার পদে সেরূপ আখর-যোজনার অজস্র অবকাশ আছে। ধরুণ বর্ষা রজনীর একটি বিরহের পদ-ইহা স্বপ্নাধ্যায় ভূক্ত।
‘‘আমি পরাণনাথের স্বপনে দেখিলাম
সে যে বসিয়া শিয়র পাশে।
নাসার বেশর পরশ করিয়া
ঈষৎ মধুর হাসে।
আমার মরমে পশিল লেহ, হৃদয়ে লাগিল দেহ,
শ্রবণে ভরল সেই বাণী,
দেখিয়ে তাহার রীত, যে করে আমার চিত,
আমি কি করিব কুলের কামিনী!
(তাহে) অঙ্গ পরিমল, সুগন্ধি চন্দন,
কুঙ্কুম-কস্তুরী পারা।
পরশ করিতে রস উপজিল,
জাগিয়া হইনু হারা।
(তখন) চাতক পাখীরে চকিতে ষাটুল
মারিলে যেমত হয়,
স্বপন ভাঙ্গিয়া তেমতি হইল,
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়।’’
এই গানটি গভীর অনুভূতি ও প্রিয়সঙ্গের আবেশে পূর্ণ, স্বপ্নে রাজ্য-প্রাপ্তির মত। যাহাকে হারাইয়া ফেলিয়াছি, সেই তপস্যার ধনকে যে স্বপ্নে পাওয়া গিয়াছে, সে স্বপ্নটিও কি অভূতপূর্ব্ব সুখদায়ক। তিনি আসিয়া শিয়রে বসিলেন এবং হাসিয়া বেশর স্পর্শ করিলেন, তাঁহার স্পর্শে হৃদয়ে স্নেহের বান ডাকিয়া উঠিল; রাধার কর্ণে তাঁহার বাণী বাজিয়া উঠিল এবং তিনি তাঁহার বক্ষে কৃষ্ণদেহের স্পর্শ অনুভব করিলেন, তাঁহার আদরে মন যেরূপ করিতে লাগিল, তিনি কুলকামিনী হইয়া তাহা মুখ ফুটিয়া কিরূপে প্রকাশ করিবেন? তাঁহার অঙ্গ-গন্ধ চন্দন-কস্তুরী তুল্য; সেই গন্ধ রাধাকে পাগল করিয়া ফেলিল কিন্তু রসাবেশের এই পূর্ণ মুহূর্ত্তে সহসা ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। চাতক-পাখী ইন্দ্রদত্ত মেঘের একবিন্দু বারি পাইবার আশায় তৃষ্ণার্ত্ত কণ্ঠে ধাবিত হইতেছিল, এই সময়ে কে তাহার বুকে বাটুল মারিয়া তাহাকে মাটীতে ফেলিয়া দিল! স্বপ্ন-ভঙ্গে রাধার সেই বাটুলাহত চাতকের দশা।