গোড়ায় সুরু করিয়াছিলাম চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতির মুদ্রিত পুস্তকের কথা লইয়া। বাবার আল্মারীতে জন্সনের র্যাম্ব্লার, এডিসনের স্পেক্টেটার ও থিওডোর পার্কারের গ্রন্থাবলীর মধ্যে শিক্ষিত-সমাজের অবজ্ঞাত এই চণ্ডীদাসের পদাবলী কি করিয়া স্থান পাইল? আমি নিশ্চিত বলিতে পারি, বৈষ্ণবগায়কের মুখে দুই একটি ‘স্বপ্ন-বিলাসে’র গান শুনিয়া প্রীত হইলেও, পিতৃদেব চণ্ডীদাসের পদ কখনও পড়েন নাই–তথাপি চণ্ডীদাসের পদাবলী তাঁহার আল্মারীতে প্রবেশ করিল কি সূত্রে?
বৈষ্ণব-চূড়ামণি স্বর্গীয় জগদ্বদ্ধু ভদ্র মহাশয় এই পুস্তকখানি সম্পাদন করিয়াছিলেন; শিক্ষিত-সমাজে চণ্ডীদাসের এই সর্ব্ব-প্রথম আবির্ভাব। ভদ্র মহাশয় উত্তর-কালে ত্রিপুরার গর্ভর্ণমেণ্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষিক হইয়াছিলেন; তখন সেইখানেয়ামি কতকদিন পড়িয়াছিলাম–কিন্তু পিতৃদেবের সঙ্গে তাঁহার আলাপ ছিল না। ঢাকা জানার মত্ত গ্রামবাসী স্বর্গীয় উমাচরণ দাস মহাশয় পিতৃদেবের দূর সম্পর্কে আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। উমাচরণ দাসের মত ইংরেজী-সাহিত্যবিৎ পণ্ডিত এবং সঙ্গীতজ্ঞ ব্যক্তি তখন পূর্ব্ববঙ্গে কেহ ছিলেন না। ভদ্র মহাশয় তাঁহার সম্পাদিত চণ্ডীদাসের ভূমিকার বিশেষ করিয়া ইঁহার কথা উল্লেখ করিয়াছিলেন। তিনি লিখিয়াছিলেন, উমাচরণবাবু তাঁহার অগ্রজপ্রতিম ছিলেন এবং তাঁহার পূর্ণ সাহায্য ভিন্ন তিনি পুস্তকখানি সম্পাদন করিতে পারিতেন না। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, উমাচরণবাবু সেকালের ইংরেজী-জানা শিক্ষিত সম্প্রদায়ের শীর্ষস্থানীয় হইলেও, গ্রাম্যকবি চণ্ডীদাসের অনুরাগী ছিলেন। পিতামহাশয়কে উমাচরণবাবুই চণ্ডীদাসের পদাবলী উপহার দিয়া থাকিবেন।
এইভাবে চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় এবং পদাবলী-সাহিত্যে আমার প্রথম প্রবেশ। আমি বইখানি আদ্যন্ত পড়িলাম। ১২।১৩ বৎসর বয়সেই আমি বাইরণ ও শেলীর কাব্য, এমন কি মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট লইয়াও নাড়াচাড়া করিতাম। আমার শিক্ষত পূর্ণচন্দ্র সেন আমাকে বিদ্যাপতির পদ পড়িয়া শুনাইতেন। তিনি প্রথমতঃ ব্রাহ্ম ছিলেন, তার পর উলটা খোঁজ দিয়া একবার গোঁড়া হিন্দু হইয়াছিলেন। তিনি সর্ব্বপ্রথম আমাকে বলেন–এই বৈষ্ণব-কবিদের ভাব আধ্যাত্মিক জীবনের গূঢ় রহস্যপূর্ণ। তিনি অবশ্য বৈষ্ণব-কবিদের ভাব কতকটা উপলব্ধি করিয়াছিলেন, কারণ “নিজ করে ধরি দুঁহু কানুক হাত। যতনে ধরিল ধনি আপনার মাখ” প্রভৃতি পদ পড়িতে পড়িতে তিনি আবিষ্ট হইয়া পড়িতেন। কিন্তু স্কুলে ছিলেন শাক্তের অবতার–সাক্ষাৎ মায়ের মূর্ত্তি; আমরা সকলেই তাঁহার প্রহারে জর্জ্জিরিত হইয়াছি।
কৈশোরান্তে যখন আমার জীবনে নব অনুরাগের ছোঁয়াচ লাগিয়াছিল, তখনও বৈষ্ণব পদ আমি ভোগের রাজ্যের অভিধান দিয়া বুঝি না–ইহা পূর্ণবাবুর কৃপায়।
০২. “এ কথা কহিবে সই এ কথা কহিবে”
আমি নিবিষ্ট হইয়া চণ্ডীদাসের পদাবলী পড়িতাম।–বটতলার পদকল্পতরু কিনিয়া লইলাম। ধীরে ধীরে এক গানটিতে আমার মনে একটা নূতন রাজ্যের দরজা খুলিয়া গেলঃ-
“এ কথা কহিবে সই এ কথা কহিবে,
অবলা এমন তপঃ করিয়াছে কবে?
পুরুষ-পরশমণি নন্দের কুমার,
কি ধন লাগিয়া ধরে চরণে আমার।”
–তিনি স্পর্শ-মণি, যাহা ছুঁইয়া ফেলেন, তাহাই সোনা হইয়া যায়; এমন ধনী তিনি, কুবেরও তাঁহার কাছে ধন প্রার্থনা করেন, সেই কৃষ্ণ কি ধনের প্রত্যাশায় আমার পা ধরিয়া থাকেন, সখীগণ তোমরা বল, আমার মত তপস্যা কে করিয়াছে?–এরূপ অসাধনে সিদ্ধি আমি কি করিয়া লাভ করিলাম!
সাধকের চক্ষে বিশ্বের সকলই ভাগবত-মূর্ত্তি–তাঁহারই প্রকাশ। স্ত্রী-পুত্র-পরিবার, যাঁহারা নিবিড় স্নেহ দ্বারা আমাকে বাঁধিতেছেন, তাঁহারা ভাগবত শক্তি, তাঁহারা কি নিত্যই চরণ ধরিয়া আমার সেবার জন্য, আমায় সাধিতেছেন না? এমন তপস্যা আমি কি করিয়াছি, তিনি সেবা দিয়া নিরন্তর আমাকে আকর্ষণ করিতেছেন! যিনি বহুর মধ্যে কেবল এককে চিনিয়াছেন, এবং শত হন্তের সেবার মধ্যে সেই কর-কমল দুইটির পরশ পাইয়াছেন, তিনিই বলিতে পারেন–
পুরুষ-পরশমণি নন্দের কুমার,
কি ধন লাগিয়া ধরে চরণে আমার!”
এই পদের পরের পদগুলি এইরূপঃ-
“আমি যাই-যাই-যাই বলে’ তিন বোল।
কত না চুম্বন দেয়, কত দেহি কোল।
পদ আধ যায় পিয়া, চায় পালটিয়া,
বরান নিরথে কত কাতর হইয়া।” (চ)
কি অপার্থিব দৃশ্য! বিদায়কালে চিবুক ধরিয়া কৃষ্ণ “যাই” “যাই” বলিতেছেন; ‘যাই’ বলিলেই চলিয়া যাইতে পারেন না, রাধার মুখখানি তাঁহাকে ধরিয়া রাখে। পুনরায় ‘যাই’ বলিয়া বিদায় চান–প্রতিবারই ফিরিয়া আসিয়া সোগাগ করেন, আধ পা যাইয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চান এবং কাতর-দৃষ্টি মুখখানির প্রতি আবদ্ধ করিয়া থামিয়া দাঁড়ান, সে মুখ যে কোন কেন্দ্রীয় শক্তি দ্বারা তাঁহাকে পুনঃ পুনঃ ফিরাইয়া আনে! এই অসাধনের ধন পাইয়া কি ফেলিয়া যাইতে ইচ্ছা হয়? কিন্তু যাইতে তো হইবেই; যদি সত্যই অঞ্চলের নিধি হারাইয়া যায়, যদি আবার না দেখিতে পান, তবে বাঁচিবেন কেমন করিয়া?
“করে কর ধরি পিয়া শপথি দেয় মোরে।
পুন দরশন লাগি কত চাটু বোলে।”
“রলয়োরভেদত্বাৎ”–‘মোরে’ ও ‘বোলে’র গরমিল পাঠক ধরিবে না। এগুলি গান, কাব্যের নিয়ম এখানে সর্ব্বদা চলে না।
তিনি হাত ধরিয়া শপথ চাহিতেছেন, “আমার হাত ছুঁইয়া বল, আবার দেখা পাব”–যে দর্শন সমস্ত সাধনার শেষ সিদ্ধি, সহস্র কষ্টের উপশম, ভবরোগের শ্রেষ্ঠ ভেষজ–সেই দর্শনের জন্য ভিক্ষা।
সেই সনাতন ভিক্ষারী জীবকে এমনই করিয়া চান। হে মানব! তোমার দেবতা তোমাকে এমন করিয়া চান, মাতার উৎকণ্ঠার মধ্যে, স্বামীর সোহাগে, শিশুর ব্যাকুলতার মধ্যে সেই চিরন্তন ভিখারী এমনই করিয়া বারম্বার তোমার কাছে হাত পাতিয়া আছেন–তোমার চোখের মায়ার ঢাকনিটা খুলিয়া দেখিতে চাহিলে সেই প্রেম ভিক্ষুকের এই চিত্রই দেখিতে পাইবে। কবে তোমাকে পাইব–এইজন্য তিনি কাকুবাদ করিয়া শপথ চাহিতেছেন।
০৩. কেবা শুনাইল শ্যাম-নাম
চণ্ডীদাসের একটি কবিতা, যাহা সচরাচর চণ্ডীদাসের পদাবলীতে মুখবন্ধস্বরূপ প্রথমে স্থান পাইয়া থাকে, এখানে সেইটির উল্লেখ করিব। কেহ কেহ এই পদটির মধ্যে শ্লীলতার অভাব দেখিয়াছেন। এমন লোকও আছেন, যাঁহাদের কাছে কালীঘাটের কর্দ্দমাক্ত গঙ্গাজলও পবিত্রতার খনি। আমি বৈষ্ণব-কবিতাগুলি যে ভাবে পড়িয়াছি, যে চক্ষে দেখিয়াছি, তদ্ভাবে ভাবিত লোক ছাড়া আমি সে চক্ষু অপরকে দিব কি করিয়া? যাঁহারা আমার ভাবে এই পদগুলি বুঝিবেন না, তাঁহাদিগকে বুঝাইবার সাধ্য আমার নাই। তাঁহাদের নিকট আমার এই অনুরোধ, তাঁহারা যেন শেলী পড়েন, কীট্স্ পড়েন, বৈষ্ণব পদ পড়িয়া তাঁহাদের কোন লাভই হইবে না, অথচ হয় ত এমন কথা বলিয়া ফেলিবেন, যাহাতে অহেতুকভাবে অপরের প্রাণে ব্যথা লাগিতে পারে।
আমি “সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম” গানটির কথাই বলিতেছিলাম।
পার্থিব প্রেম ও ইন্দ্রিয়াতীত প্রেম–এই দুইয়ের মধ্যে একটা তফাৎ থাকিলেও, সাংসারিক প্রেমের মধ্য দিয়া এমন একটা সন্ধিস্থলে পৌঁছান যায়–যেখানে যেরূপ আকাশ ও পৃথিবী দিগ্বলয়ে পরস্পরকে ছুঁইয়া ফেলে, সেইরূপ পার্থিব ও অপার্থিব প্রেমের সেখানে দেখাদেখি হয়; গাছের ডালটারে আশ্রয় করিয়া যেরূপ স্বর্গের ফুল ফুটে, এই প্রেম সেই ভাবে জড়রাজ্য হইতে আনন্দলোক দেখাইয়া থাকে। কোন নায়ক-নায়িকা নাম জপ করিয়াছে, সেমন তো বড় দেখা যায় না। তবে যাহাকে ভালবাসা যায়, তাহার নামটি যে মিষ্ট লাগে–তাহার উদাহরণ সাধারণ সাহিত্যে একেবারে দুর্লভ নহে! বঙ্কিমচন্দ্র কুন্দ-নগেন্দ্রের নামটিতে সেইরূপ মিষ্টত্ব আবিষ্কার করিয়া সংগোপনে অতি সন্তর্পণে ‘নগ’ ‘ নগ’ ‘নগেন্দ্র’ এই অর্দ্ধস্ফুট শব্দগুলি উচ্চারণ করিয়াছিল। অর্দ্ধোদ্গত কুসুম-কোরকের ন্যায় এই নাম লইতে যাইয়া তাহার ব্রীড়াশীল কণ্ঠস্বর কাঁপিয়া উঠিয়াছিল। বৈষ্ণব পদ-মাধুর্য্যের এখানে একটু আভাষ পাওয়া যায় মাত্র।
কিন্তু ভাগবত-রাজ্যে নামই মুখ-বন্ধ। এ পথের নূতন পান্থ প্রথম প্রথম বিব্রত হইয়া পড়িবেন; নাম করিতে যাইয়া দেখিবেন, সাংসারিক চিন্তার নানা জটিল ব্যূহ তাঁহাকে ঘিরিয়ে ধরিয়াছে,–করাঙ্গুলীর সঙ্গে মালা ঘুরিতেছে, কিন্তু দুই এক মিনিট পরে পরেই অসতর্ক মন সংসারের নানা কথায় নিজকে জড়াইয়া ফেলিয়াছে। তখন তিনি সাবধান হইয়া মনকে শুধু নামের মধ্যে আবদ্ধ করিয়া রাখিবার সঙ্কল্প করিবেন। পুনরায় দেখিবেন, সাংসারিক চিন্তা, সন্তানের পীড়া, মোকদ্দমার কথা, অর্থাগমনের উপায় প্রভৃতি বিষয় হইতে বিষয়ান্তরে মন চলিয়া যাইতেছে–এ যেন কাঁঠালের আঠা, ছাড়াইতে চাহিলেও ছাড়াইতে পারা যায় না।
কিন্তু দৃঢ়সংকল্প-দ্বারা অসাধ্য সাধন হয়। ধীরে ধীরে মনের আবর্জ্জনা দূর হইতে থাকে। পৌষের কুয়াশা কাটিয়া গেলে প্রাতঃসূর্য্যোদয়ের মত ক্রমে ক্রমে মনের মহিমা প্রকাশ পায়। এইভাবে মন স্থিত হইলে, ইন্দ্রিয়-বিকার থামিয়া গেলে, নাম আনন্দের স্বরূপ হইয়া অপার্থিব-রাজ্যের বার্ত্তা বহন করে। নামের এই অপরূপ আস্বাদ কতদিনে মানুষ পাইতে পারে জানি না, ইহা সাধনা ও যুগ-যুগের তপস্যা-সাপেক্ষ।
তখন নাম শোনা মাত্র উহা মর্ম্মে মর্ম্মে প্রবেশ করে, কান জুড়াইয়া যায়–প্রাণ জুড়াইয়া যায়। প্রেমিক তখন পৃথিবী ভুলিয়া নামের পোতাশ্রয়ে নঙ্গড় বাঁধেন। সেস্থান শুধু নিরাপদ্ ও নির্ব্বিঘ্ন নহে–তাহার মোহিনীতে মন মুগ্ধ হইয়া যায়।