চণ্ডীদাস বলিয়াছেন,
‘‘তোমারই গরবে গরবিনী হাম, রূপসী তোমার রূপে’’
এই ছত্র কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার তন্ময়ত্ব জ্ঞাপক। তাঁহার রূপ, গুণ, সকলই কৃষ্ণ হইতে পাওয়া। অগ্নির সঙ্গে তাপের, চন্দ্রের সহিত জ্যোৎস্নার পরস্পরে যে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক রাধার সঙ্গে কৃষ্ণের তাহাই; রাধা কৃষ্ণের হলাদিনী শক্তি।
রূপের স্পৃহা, দেহের সঙ্গ সুখ, বাহিরের সেবা স্তুতি, হোম, যাগ, যজ্ঞ, বৈধী ভক্তির সমস্ত আয়োজন মাথুরে লুপ্ত। জগন্নাথ বিগ্রহ অত্যাচারীরা ভাঙ্গিয়া দিয়াছে। কাশীর বিশ্বনাথ আজ অপহৃত। এখন প্রত্যূষে উঠিয়া বন্দীরা সুললিত স্বরে কাহাকে জাগাইবে, কাহার জন্য প্রভাতী গান গাহিবে? ছত্রধারিণী, তাম্বূল বাহিকা, ব্যজনকারিণীরা কাহার সেবায় নিযুক্ত হইবে? দেবভাগ রাধিবার জন্য সূপকারেরা আর কেন আয়োজন করিবে? মালীরা শত শত মালা হাতে লইয়া স্তব্ধ হইয়া আছে। মন্দির আর নাই যজ্ঞকুণ্ড নাই, হোমাগ্নি নিবিয়া গিয়াছে।
তবে কি মাথূরে গোপীপ্রেমের পরিসমাপ্তি, এখন কি শুধু আক্ষেপোক্তি ও অশ্রুতেই গোপীপ্রেম পর্য্যবসিত হইল? ক্রূরতার অবতার অক্রূর আসিয়া কি এই ভাবেই বৃন্দাবনের প্রেমের হাট ভাঙ্গিয়া দিয়া গেলেন? শাস্ত্রে অবশ্যই এ কথা লিখিত আছে, মথরা যাওয়া অস্বীকার করিয়াছেন। তাঁহাদের মতে কৃষ্ণ বৃন্দাবন পরিত্যজ্য পাদমেকং ন গচ্ছতি। মাথুর তাঁহাদের মতে “বৃন্দবনং পরিত্যজ্য পাদমেকং গচ্ছতি”। “মাথূর” তাঁহাদের মতে বৃন্দাবনের নিত্যলীলায় প্রোষিত-ভর্ত্তৃকা রসাস্বাদের জন্য পরিকল্পিত। কৃষ্ণকমল লিখিয়াছেন,–
‘‘গোস্বামী সিদ্ধান্ত মতে স্বয়ং ভগবান,
বৃন্দাবন ছাড়ি এক পদ নাহি যান।
তবে যে গোপিকার হয় এতই বিষাদ।
তার হেতু প্রোবিততর্ত্তৃকা রসাম্বাদ।’’
মাথুরের পর শাস্ত্রানুসারে বৈষ্ণবদের সমন্ত কথা শেষ। প্রেম লীলার তাঁহাদের আর কিছু বলিবার থাকে নাই। যে ছেলেটি একটা বাঁশের আগা কাটিয়া বাঁশী বানাইত, নেংটির মত ধরি পরিত, বৃন্দাবনের মাঠে কুড়াইয়া পাওয়া ময়ুরের পালক মাথায় দিয়া গোয়াল বালকদের মধ্যে রাজা সাজিত, বনে বনে ঘুরিয়া বনফুল ও গুঞ্জা ফলের মালা গাঁথিয়া গলায় পরিত এবং যশোদার হাতে ননী মাখন খাইত–সেই পাড়াগেঁয়ে মোড়রের ছেলে হঠাৎ আবু হোসেনের মত একদিনের মধ্যে সমন্ত মথূরামগুলের রাজ্যটা পাইল। আর্য্যাবর্ত্তের মধ্যে এত বড় সাম্রাজ্য আর কোথাও ছিল না। যাহাকে বলাইদা একটা শিঙা ফুকাইয়া কাক্কা কানাইয়া বলিয়া ডাকিলে সে দাদার পিছনে পিছনে ছুটিত, সখাদের উচ্ছিষ্ট খাইত, সখারা দ্বন্দ্ব করিয়া যাহাকে লাথি মারিত কিংবা খেলার সময়ে ঘাড়ে চড়িয়া বসিত, যে গয়লা মেয়েদের সঙ্গে লুকাচুরি খেলিত–সেই ছোঁড়াটা এখন রাজরাজেশ্বর–নয় মহাল পাড়ি দিয়া সপ্ততল অট্টালিকায় সে এখন বাস করে, শত শত রক্ষী সোণার লাঠী হাতে করিয়া তাহার মহালে মহালে পাহারা দেয়: ইন্দ্র, চন্দ্র, বরুণ, এমন কি ব্রহ্মাও তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিয়া এতেলা দিয়া প্রতীক্ষা করেন। বৃন্দা যখন কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিল, তখন মথূরা বাসিনীরা টিটকারী দিয়া তাহাকে বলিয়াছিল–
‘‘সপ্ততল ঘর, উপরে সো বৈঠত, তাহা কাঁহে যাওব নারী’’
প্রভাস-যজ্ঞে নন্দ উপানন্দ, এমন কি স্বয়ং মা যশোদা দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়া প্রহরীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হইয়া যাঁহার দরবারে প্রবেশের পথ খুঁজিয়া পান নাই, যাঁহার কথা বলিতে যাইয়া রাধিকা কাঁদিয়া বলিয়াছেন,
‘‘আমরা গ্রাম্য গোপবালিকা, সবহ পশুপালিকা,
আহিরিণী কুরূপিনী–আমরা কৃষ্ণসেবার কিবা জানি।
মথুরানগর-যোষিতা, সবহ তারা পণ্ডিতা,
তারা রূপ-গুণে বেঁধেছে গো,
এই রাজকুল সম্ভবা ষড় রসজ্ঞা মথুরাবাসিনীদের দ্বারা তিনি বেষ্টিতা।
‘‘তাবৎ অলি গুঞ্জরে, যাই ফুল ধুতুরে,
যাবৎ মালতী নাহি ফুটে’’
এখন আর তিনি এখানে ফিরিবেন কেন?
সুতরাং মাথুর পালার পরে রাধাকৃষ্ণ লীলার সম্পূর্ণ ছেদ হইবার কথা।
কিন্তু এদেশে মহাপ্রভুলীলা করিয়া গিয়াছেণ। তৎপূর্ব্বে মাধবেন্দ্র পুরী প্রেমের সেই রাজরাজেশ্বরের মধুকর ডিঙ্গার জন্য খাত কাটিয়া গিয়াছিলেন। এখানে ব্রজের নাম নিত্য বৃন্দাবন, কৃষ্ণলীলার এখানে অন্ত স্বীকৃত হয় নাই। শাস্ত্র মানিয়া যেখানে অন্যান্য দেশের বৈষ্ণবেরা সম্পূর্ণ বিরাম-চিহ্ন দিয়াছিলেন, বাঙ্গালী তাহা মানিয়া লইল না।
এখানে বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাস ভাব-সম্মেলন নামক মাথুরের পরে আর একটা অধ্যায়ের সৃষ্টি করিয়া পূজার ঘরের হোমানল জ্বালাইয়া রাখিলেন। এই আহিতাগ্নিকদের পবিত্র অগ্নির নির্ব্বাণ নাই। রাধিকা দেহ সম্বন্ধ বিচ্যূত হইয়া চিন্ময় রূপে ভগবানকে ফিরিয়া পাইলেন, ইহাই “ভাবসম্মেলন”। পূর্ব্বে শ্যামকুণ্ড, রাধাকুণ্ড ও মদনকুঞ্জের নিকটে গেলে কৃষ্ণকে পাওয়া যাইত, “যাঁহা ধেনু সব করতহি রব” সেই গোষ্ঠের পথে নীপতরুমূলে সখাদের মধ্যে তাহাকে পাওয়া যাইত, দ্বাদশ বনের উপান্তে যমুনাতীরর পুষ্পকুঞ্জে তাঁহার বিলাস হইত, আজ সে দিন ফুরাইয়াছে,
আজ “ব্রজকুল আকুল, দুকুল কলরব,
কানু কানু করি ঝুর।
আজ যশোবতী নন্দ, অন্ধসম বৈঠত,
কোকিলা না করতহি গান।
কুসুম ত্যজিয়া অলি ক্ষিতিতলে লুটই–
তরুগণ মলিন সমান।”
আজ সখাগণ, ধেনুগণ বেণুরব ভূলিতে চলিয়াছে; কারণ তাহাদের অকস্মাৎ বিপদে মুহমান বিমূঢ়