প্রতিবাসীরা নিন্দা করে, করুক আমি–তাহাদের পাড়ায় যাইব না। চণ্ডীদাস বলিতেছেন, সে কানুপ্রেমে পড়িয়াছে, তাহার জাতি-কুল-শীল সব গিয়াছে।
এই পদটি খুব উচ্চাঙ্গের, কৃষ্ণ প্রেমিকের ধর্ম্ম- কর্ম্ম কিছু থাকে না। চণ্ডীদাসের আর একটি পদে আছে–
“মরম না জানে ধরম বাখানে, এমন আছয়ে যারা।
কাজ নাই সখি, তাদের কথায়, বাহিরে রহন তারা।
আমার বাহির দুয়ারে কপাট লেগেছে,
ভিতর দুয়ার খোলা।”
যিনি ঈপ্সিতকে পাইয়াছেন,–তাহার বহিরিন্দ্রিয়ের খেলা খামিয়া গিয়াছে। মোহনা পর্য্যন্ত ডাক-হাক, কিন্তু নদী যখন সমুদ্রে পড়িয়াছে–তখন তাহার রব সমুদ্রের রবে মিশিয়া গিয়াছে। তাহার ক্ষুদ্র অস্তিত্ব দিগন্তপ্রসারী বিশাল জলধারার অস্তিত্বে মিশিয়াছে, তখন তাঁহার গতি থামিয়াছে–কর্ম্ম সমাপ্ত হইয়াছে, ভাল-মন্দের এ-পথ ও-পথের বিচার চলিয়া গিয়াছে। তখন—“কি আর শিখাও—ধরম-করম” এবং তখন “কহে চণ্ডীদাস পাপ-পুণ্য সম, তোমার চরণ মানি।” পাপ-পুণ্যে ভেদ নাই, তোমার চরণপদ্মই আমার সব।
“কানু অনুরাগে এ দেহ সঁপেছি তিল-তুলসী দিয়া”,
তিল-তুলসী দিয়া যে দান হয়–তাহা ফিরিয়া লইবার আর অধিকার থাকে না। রাধা সেই ভাবে তাঁহার দেহ কৃষ্ণকে সমর্পণ করিয়াছেন, দেহ এই ভাবে নিবেদিত হইলে কর্ণ কেবল তাঁহারই প্রিয় কথা শুনিবে, চক্ষু তাঁহার রূপ দর্শন করিবে, চরণ তাঁহারই মন্দিরের পথে যাইবে, জিহবা তাঁহারই নামের আস্বাদ করিবে। সর্ব্বেন্দ্রিয় সহ দেহ তিনি “কৃষ্ণায় নমঃ” বলিয়া তাঁহাকে নিবেদন করিয়া দিয়াছেন, তাহার উপর আর তাঁহার কোন সত্ত্বা নাই। এরূপ নির্ব্যূঢ় সত্ত্বে যিনি নিজেকে দান করিতে পারিয়াছেন, তিনি অবশ্য প্রেমের তপস্যায় সিদ্ধি লাভ করিয়াছেন।
সুতরাং যখন কানুকে ভালবাসি বলিয়া লোকে নিন্দা করে, তখন তাহা রাধার শাপে বরঃ–
“সবে বলে মোরে কানু কলঙ্কিনী, গরবে ভরয়ে দে।
হামার গবর তুঁহু বাড়াইলি, অব টুটায়ব কে।”
১১. মাথুর
কৃষ্ণ মথুরায় গিয়াছেন, মন্দির খালি, বৃন্দাবন শূন্য।
‘‘কৈছনে যাওব যমুনাতীর,
কৈহে নেহারব কুঞ্জকুটীর
সহচরি সঞে যাহা করল ফুল-খেরী।
কৈছনে জীয়ব তাহি নেহারি।’’
সে ফুল খেলা ফুরাইয়াছে–তোমার বিলাসকুঞ্জের দিকে চাহিয়া কেমন করিয়া জীবন রাখিব? আর কাহার সহিত নীলাম্বরতলে সন্ধ্যানিলবাহিত যমুনাতীরে হাত-ধরাধিরি করিয়া বেড়াইব?
বৃন্দাবনচন্দ্র চলিয়া গিয়াছেন, বৃন্দাবন হইয়াছে, এই প্রসঙ্গের গৌর চন্দ্রিকা।
‘‘কার ভাবে কিসের অভাবে গৌর আমার এমন হৈল
নবদ্বীপচন্দ্র বিনা নবদ্বীপ আঁধার হৈল।’’
কাহার জন্য প্রত্যূষে উঠিয়া সদ্যস্নাতা রাধা মালার জন্য পুষ্পকুঞ্জে ফুল কুড়াইবেন? কাহার শ্রীমুখ অলকা-তিলকা দিয়া সাজাইবেন? চন্দন ঘষিয়া কপালে বিন্দু আঁকিয়া দিবেন? কাহার জন্য ফল-ফুলের নৈবেদ্য তৈরী করিবেন? কাহার জন্য সদ্যবিকশিত শতদলের প্রতিটি দল লইয়া সযত্নে পুষ্পশয্যা তৈরী করিবেন? মিলনপর্ব্ব শেষ হইয়া গিয়াছে। মন্দির ভাঙ্গিয়া গিয়াছে–বিগ্রহ অপহৃত হইয়াছে।
এমন যে হইবে, কে জানিত?
“আমারে ছাড়িয়া পিয়া, মধুরায় রইল গিয়া–
এও বিধি লিখিলা করমে।”
আমার কর্ম্মে–আমার ভাগ্যে ইহাও লেখা ছিল, আমি কৃষ্ণ-হারা হইয়া বাঁচিয়া থাকিব?
বিদ্যাপতি মাথুরের প্রথম অধ্যায়ে ভগবদ্ভাবে আবিষ্ট হইয়া লিখিয়াছেন,
‘‘হরি হরি কি ইহ দৈব দুরাশা।
সিন্ধুর নিকটে যদি কণ্ঠ শুকায়ব, কো দূর করব পিপাসা?
চন্দনতরু যব সৌরভ ছোড়ব, শশধর বরথিব আগি।
চিন্তামণি যদি নিজ গুণ ছোড়ব কি মোর করম অভাগী।
শাওন মাহ ঘন, যব বিন্দু না বরখব, সুরতরু বাঁঝ কি ছাদে।
গিরিধর সেবি, ঠাম নাহি পাওব, বিদ্যাপতি রহ ধন্দে।’’
এখানে একটু ঐশ্বর্য্যের ভাব আছে–তিনি এই বিরাট, তাঁহার কাছে আসিয়া বঞ্চিত হইতে হইবে, এমন তো কখনও ভাবি নাই। এই সুললিত শব্দে গ্রথিত কাব্যরসপূর্ণ পদটির মধ্যে যেন একটু
‘‘বাচঞা মোঘা বরমধিগুণে নাধমে লব্ধ কামা’’
গন্ধ পাওয়া যায়। যিনি সিন্ধুর মত বিরাট্ তাঁহার কাছে বিন্দু পাইব না, এই আক্ষেপে দেখা যায়, রাধা যেন কৃষ্ণ-প্রেমের কণিকা ভিখারী। শ্রাবণ মাসের ভরা বাদরের অজস্র বর্ষণশীল আকাশের কাছে কণিকামাত্র জলের প্রত্যাশা নাই, ইহাও কৃষ্ণের ঐশ্বর্য্য ব্যঞ্জক। সুরতরু (কল্পবৃক্ষ) আমার কাছে বন্ধ্যা হইয়া রহিল, ধর্ম্ম-অর্থ- কাম মোক্ষের দাতা ভগবানকে কল্পতরু বলা হইয়াছে–তিনি কাম্য ফল প্রদান করেন। এখানেও রাধার প্রার্থীর বেশ, রাধা তাঁহার নিকট কাম্যবস্তুর সন্ধানে আসিয়াছেন, এখানে নিষ্কাম অহেতুক গোপী প্রেমের আভাষ নাই। শেষ ছত্রে স্পষ্ট করিয়া বলা হইয়াছে–সর্ব্ব শক্তিমান, সর্ব্ব ইষ্ট প্রদায়ী ভগবানকে সেবা করিয়া কোনই ফল পাওয়া গেল না, কবি এ রহস্যের সমাধান করিতে পারিতেছেন না।
কিন্তু কৃষ্ণ যতই বড় হউন না কেন, গোপী তাঁহার বিরাট রূপ দেখিতে চায় না, তাহারা তাহাকে পঞ্চ রসের ম্ধ্য দিয়া দেখিতে চায়; মাতা রূপে তিনি যেমন আমারই মা, স্ত্রীরূপে তিনি যেমন আমারই স্ত্রী, সেই রূপ তিনি আমারই হইয়া আসিলে, আমি তাঁহার নাগাল পাইতে পারি। তিনি অণুর কাছে সম্পূর্ণরূপে অণু হইয়া ধরা দেন, ব্যবধান থাকিলে গলাগলি ভাব হয় না, বৈষ্ণব প্রেমের আদর্শ ছোট ও খর্ব্ব হইয়া যায়।