যে কৃষ্ণ “জপিতে তোমার নাম, বংশী ধরি অনুপাম–তোমার বরণের পরি বাস” (চ)–প্রভৃতি কত মিষ্ট কথায় রাধাকে সোহাগ করেন, রাধা মান করিলে যিনি চক্ষে সরিসার ফুল দেখিয়া পায় ধরিয়া মান ভাঙ্গান, তাতেও মান না ভাঙ্গিলে রাধাকুণ্ডে পড়িয়া মরিতে যান, যাঁহার প্রেমের অভাব দেখিলে তিনি জগৎ আঁধার দেখেন এবং “রাধা তুমি সে আমার গতি, তোমার কারণে, বৈকুণ্ঠ ছাড়িয়া গোকুলে আমার স্থিতি” (চ) প্রভৃতি পদে তাঁহার রাধাগত প্রাণের গৌরব করেন, কখনও বা “যমুনা তীরে, নীপতি মূলে” রাধা পরিত্যক্ত “লুটত বনওয়ারী, চূড়া এই ঠাই, বাঁশী এক ঠাই”—“ধূলি ধূসর কহত পারী পারী” (রায়)–এত কষ্টেও রাধা নামটি ছাড়িতে পারেন না, সে রাধার এই আশঙ্কা কেন? কেন রাধিকা কৃষ্ণের ভাবান্তর কল্পনা করিয়া “তুমি বঁধু মোরে যদি নিদারুণ হও, মরিব তোমার আগে, দাঁড়াইয়া রও” এইরূপ প্রলাপোক্তি করেন?
চণ্ডীদাসের রাধা ভগবৎপ্রেমের প্রতীক। তিনি সময়ে সময়ে কৃষ্ণ-সঙ্গ লাভ করিয়া ধন্য হন, কিন্তু সে প্রেমের একটা না পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। যোগীর হৃদয়ে সেই অবাঙমনসাগোচর ভগবান বিদ্যুতের মত ক্ষণিক প্রভা দিয়া অন্তর্হিত হন। বৈষ্ণব প্রেমিকের মত তাঁহাকে বাঁধিয়া রাখিবার গৌরব যোগী কোথায় পাইবেন? রাধা-সাহিত্য মিথ্যা ইহয়া যাইত, যদি চৈতন্য প্রভু নিজের মধ্যে রাধা-ভাব না দেখাইতেন; তিনি অনেক সময়ে তাঁহার চোখের ইঙ্গিতে কৃষ্ণসঙ্গের অপ্রমেয় অথচ জটিল, নিগূঢ় অথচ ঈষৎপ্রকাশিত আনন্দ আভাবে ব্যক্ত করিয়া দেখাইতেন। তাঁহারই সঙ্গে লীলা-মাধুরী–কোপ, মান, অভিমান, খণ্ডিতার নিদারুণ কষ্ট, বিরহের অসীম-কারুণ্যমথিত মাথুর-ভাব, এ সমন্তই ক্ষণে ক্ষণে চৈতন্যের নয়ন-কোণে ফুটিয়া উঠিত। রূপ-গোস্বামী তাঁহার দান-লীলা-কৌমুদীর মুখবন্ধে নয়টি মিশ্র কিলকিঞ্চিৎ ভাবের যে চিত্র আভাষে আঁকিয়াছেন, তাহা চৈতন্যের ভাবাবিষ্ট অবস্থায় চোখের চাহনী হইতে পাওয়া। কৃষ্ণসঙ্গ পাইয়া যিনি অকুল আনন্দ সায়রে ঝাঁপ দিয়াছেন, সেই ভাবের অবসানে তিনি যে অসীম কষ্ট পাইয়াছেন, তাহার চিত্র চৈতন্যচরিতামৃতে আছে। তিনি গাম্ভীরায় মুখ ঘষিয়া রক্তাক্ত করিয়া ফেলিতেন এবং সারারাত্রি স্বরূপ দামোদর ও রাম রায়ের সঙ্গে বিচ্ছেদের বিলাপগীতি গাহিয়া কাটাইতেন।
যিনি অবাঙ্মনসাগোচর, অসীম–অনন্ত, তাঁহাকে জীব কতক্ষণ নিজের কাছে বাঁধিয়া রাখিবার স্পর্দ্ধা করিতে পারে? তাই সিড়ি ভাঙ্গীয়া উর্দ্ধলোকে উঠিয়া পতনের আশঙ্কা একবারে যায় না। জীবের পক্ষে স্থায়ী ভাবে শিবলোকে বাস করা সম্ভব নহে–
“কৃষ্ণরূপে মূর্ত্তি যখন দেখেন নয়নে,
তখন ভাবেন কৃষ্ণ আছেন বৃন্দাবনে,
অদর্শনে ভাবেন কৃষ্ণ গেছেন মধুপুরী।” (কৃ)
এই বিরহের অবস্থায়
“ক্ষণে গোরাচাঁদ, হয়ে দিব্যোষ্মান–দুটি চক্ষে ধারা বহে অনিবার, দুঃখে বলে বারবার, স্বরূপ দেখায়ে একবার, নতুবা এবার মরি।” (কৃ) বিরহে তিনি কখনও মুর্চ্ছিত হইয়া পড়েন। তখন ভক্তমণ্ডলী গাহিতেন,
“গৌর কেন এমন হল,–(স্বরূপের সাথে) এই না কৃষ্ণ কথা কহিতেছিল, তোয়া দেখে যা গোরা বুঝি প্রাণে মৈল।”
সুখের সাগর দেখাইয়া–পূর্ণানন্দের আস্বাদ দিয়া কৃষ্ণ লুকাইয়া পড়েন। ভাব-রাজ্যে তাঁহার এই লুকোচুরী খেলা গৌর-জীবনে প্রতিফলিত হইয়াছে।
রাধিকা তাঁহার সর্ব্বস্ব কৃষ্ণের পায়ে “কৃষ্ণার নমঃ” বলিয়া ডালি সাজাইয়া দিয়াছেন। বিদ্যাপতির রাধা বলিতেছেন-
‘‘হাতক দরপণ মাথক ফুল,
নয়নক অঞ্জন, মুখক তাম্বুল,
হৃদয়ক মৃগমদ, পীমক হার,
দেহক সরবস্ব, গেহক সার,
পাথীক পাণ, মীনক পানী,
জীবক জীবন হাম তুরা জানি।’’
অর্থাৎ “তুমি আমার সব, পাখীর পাখা না হইলে উড়িবার শক্তি লোপ পায়, সে মাটীতে পড়িয়া মরে, মৎস্যকে জল হইতে ডাঙ্গায় তুলিলে সে কতক্ষণ বাঁচে? তুমিও আমার কাছে সেইরূপ।” চণ্ডীদাসও লিখিয়াছেন,
‘‘জল বিনু মীন জনু কবহ না জীয়ে’’।
রাধা নানা উপমায় নিজের প্রেম বুঝাইয়া বলিয়াছেনঃ–
“জীবক জীবন হাম তুয়া জানি” “তুমি আমার জীবনের জীবন, আমি ইহাই জানি।”
এত কথা বলিবার দরকার কি? দরকার কিছু ছিল, “আমার সম্বন্ধে বুঝাইবার কিছু নাই, তুমি সকলই জান”, তোমা ছাড়া রাধা কায়া-ছাড়া ছায়া–তাহার পৃথক অস্তিত্ব নাই। “আমার মনের ভাব পরিষ্কার, কিন্তু তুমি কেমন, তাহা তো এত দিন ধরিয়াও বুঝিতে পারিলাম না। আমি সকল বিসর্জ্জন করিয়াও সোয়ান্তি পাইতেছি না। আমি কাহার হাতে সর্ব্বস্ব দিলাম, কে সে বিরাট প্রহেলিকা, তাঁহাকে তো আমি এখনও চিনিতে পারিলাম না।” তাঁহাকে রাধা কত গাল মন্দ দিয়াছেন, “ক্রুর, লম্পট, শঠ,”–এ সেই না চিনার জন্য, বিদ্যাপতির রাধা এই পদের শেষ ছত্রে আর্ত্ত স্বরে জিজ্ঞাসু হইয়াছেনঃ—
“মাধব, তুহু কৈছে কহবি মোর” তুমি বল তুমি কেমন? তুমি কে? এই চির-রহস্যময় বিশ্বের কারণস্বরূপ ভগবানের সঙ্গে লীলাচ্ছলে নানা অভিনয় করিয়াও যে একটা খোঁচার মত সন্দেহ মনে থাকয়া যায়- এই সন্দেহ, এই আশঙ্কা হইতেই মাথুরের উৎপত্তি।
আমি তো তাঁহাকে ভালবাসিয়াছি, সে তো বিন্দুর সিন্ধুকে ভালবাসা। আমি তাঁহাকে সমগ্রভাবে চাই–সেই যমুনাতীরকুঞ্জে যত অমৃতোপম কথা শুনিয়াছিলাম, বংশীধর পরশিতে চাই তোমার চরণের ধূলি, বলিয়া আমার পায়ে ধরিয়া সেবা করিয়াছিলেন,–মাতৃরূপে, সখারূপে তিনি জীবকে সমগ্রভাবে ভালবাসার স্বপ্ন দেখাইয়া থাকেন। আমি যেন তাঁহার সব,
‘‘জ্বালিয়া উজ্জ্বল বাতি, জাগি পোহাইত রাতি,
তিল নাহি যায় পিয়া ঘুম,
ধরিয়া দুখানি হাতে, কখন ধরয়ে মাখে,
ক্ষণে ধরে মাথার উপরে,
ক্ষণে পুলকিত হয়, ক্ষণে আঁখি মুদে রয়
বলরাম কি কহিতে পারে? ”
“বিনি কাজে কত পুছে, কত না মুখানি মোছে
তুমি মোর প্রাণধন, তোমা বিনা নাহি আন,
কহে পিয়া গদ গদ ভাষে।” (ব)
কত ছন্দ-বন্ধে নানা কথা বিলয়া আমাকে ভুলাইয়াছিলেন, কত রাত্রি জাগিয়া অভিসারের পথে “পততি পতত্রে বিচলিত পত্রে” আমার পদক্ষেপ শুনিবার জন্য কাণ পাতিয়া প্রতীক্ষা করিয়াছেন, কত তিমির রজনীর মেঘের ঘটা, পিচ্ছিল বাটে অতি সম্ভর্পণে আসিয়া আমার আঙ্গিনার এক কোণে অপরাধীর মত দাঁদাইয়াছেন, সেই প্রেমের কল্পতরু আমাকে বুঝাইয়াছিলেন, তাঁহার সকল ফুল-ফল আমারই প্রেমের নৈবেদ্য, আমি ছাড়া তাঁহার আর কেহ নাই–আমারও যেমন তাঁহাকে ছাড়া আর কেহ নাই। কিন্তু তিনি যদি তাহা না হন? তিনি যে জগদীশ্বর–সমস্ত জগতের, আমার মত তাঁহার শত শত আছে,
‘‘আমার মতন তোমার অনেক রমণী
তোমার মত আমার তুমি গুণমণি,
যেমন দিনমণির অনেক কমলিনী,
(কিন্তু) কমলিনীগণের ঐ একই দিনমণি।’’
তবে কি আমি শত শত কোটীর একজন?