গৌরদাসের মুখে এই গোষ্ঠ শুনিতে শুনিতে ভগবানকে কিরূপে সখ্য-ভাবে পাওয়া যায়, তাহা আমি আভাসে বুঝিয়াছিলাম। জগৎ তাঁহার লীলাস্থল, সম্পূর্ণরূপে তাঁহার উপর নিজকে ছাড়িয়া দিয়া, তাঁহাকে প্রাণাপেক্ষা ভালবাসিয়া, তাঁহার সহিত সম্পূর্ণরূপে বৈষম্য-ভাব-বর্জ্জিত হইয়া কিরূপে সেই স্বর্গীয় যোগ দেওয়া যায়, গোষ্ঠ- গানে তাহা বুঝিয়াছিলাম। এই সখারা কৃষ্ণকে কখনই মান্য করে নাই- (“আমরা সামান্য ভেবে কখন মান্য করি নাই” (কৃ), “কত মেরেছি ধরেছি, কাঁধে করেছি, চড়েছি”, নিজে ফলটি খাইয়া উহা ভাল লাগিলে উচ্ছিষ্ট তাহার মুখে দিয়াছি “আপনি খেয়ে খাওয়ায়েছি”। এটি বুঝিতে হইবে, বৃন্দাবনের পূজার বিধি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র রকম। এখানে ভক্তি-শ্রদ্ধা রসাতলে গিয়াছে, এখন মনের উপর আইন-কানুনের জোর জবর্দ্দস্তি নাই, স্বেচ্ছায় তাঁহাকে সর্ব্বস্ব দিয়া ঠিক নিজের মত ভাবিলে, তবে লীলায় যোগদান করার অধিকার হয়। যদি সখারা প্রতিদিন প্রত্যূযে উঠিয়া গঙ্গা-স্নান, করিয়া নিত্য-নৈমিত্তিক সন্ধ্যা তর্পনাদি সমাধাপূর্ব্বক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে গঙ্গামৃত্তিকার ছাপ দিয়া, নৈবেদ্য সাজাইয়া পূজায় বসিয়া যাইত, তবে কি তাহারা কৃষ্ণের খেরু হইতে পারিত? রাধার পা ধরিয়া কৃষ্ণ মান ভাঙ্গাইতেছেন কিংবা সখারা তাঁহাকে উচ্ছিষ্ট খাওয়াইতেছেন-একথা বৈধী ভক্তির শাস্ত্রে নাই; গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় বলিতেছেন–“সব অবিধি নদের বিধি”–যাহা কিছু অশাস্ত্রীয় তাহাই নদীয়ার শাস্ত্র। ভক্তি ও প্রেমের রাজ্যে ইহার অধিক স্বাধীন মত অন্য কোন ধর্ম্ম-সম্প্রদায় দেখাইতে পারিয়াছেন বলিয়া জানি না। চণ্ডীদাস বুঝাইয়াছেন, সম্পূর্ণরূপে তচ্চিন্তাশীল, তদধিকৃত, তন্ময় ভয়-লাজ-শঙ্কা-বিরহিত ও একান্তভাবে সমতাপন্ন না হইলে কৃষ্ণপ্রেম-লাভ হয় না। এজন্য রাধার প্রেম-বর্ণনাকালে অলঙ্কার-শাস্ত্রোক্ত সমস্ত উপমান ও উপ্রেক্ষা অগ্রাহ্য করিয়াছেন-
ভানু কমলে বলি সেহ হেন নহে,
হিমে কমল মরে, ভানু সুখে রহে।
কুসুম-মধুপে বলি সেহ নহে তুল,
না আসিলে ভ্রমর আপনি না যায় ফুল।
চাতক জলদে বলি সে নহে তুলনা,
সময় না হৈলে না দেয় এক কণা।
কি ছার চকোর চাঁদ দুহ সম নহে,
ত্রিভুবনে হেন নাই, চণ্ডীদাস কহে। (চ)
একজন মরিয়া যায়, অপর সুখে থাকে, এ আবার কেমন প্রেম? একজন আসিলে মিলন হইবে, সে না আসিলে অপরে তাহার স্বস্থান ছাড়িয়া একটুও নড়িবে না, সেই প্রসাদকাঙ্খীর আবার প্রেমের বড়াই কোথায়? একজন বিন্দু-কৃপার জন্য প্রতীক্ষা করিয়া থাকিবেন, অপরে ঠিক ঘড়ি ধরিয়া তাহার সুবিধানুসারে যৎকিঞ্চিৎ দিবেন, তখন না হইলে দিবেন না, এতো রাজবাড়ীর অতিথিশালার বরাদ্দ-মাফিক ভিক্ষাদান, এখানে প্রেম কোথায়? আর একজন অত্যূর্দ্ধে বসিয়া স্বীয় অপূর্ব্ব বৈভব লইয়া দর্প করিবে, অপর ব্যক্তি ক্ষুদ্রতম ভিক্ষুর ন্যায় তাহার কণা-প্রসাদের আকাঙ্কা করিয়া থাকিবে, দুই জনের পদ-পার্থক্য এতটা হইলে, সম-জ্ঞান না হইলে প্রেম কোথায় পাওয়া যাইবে?
বৈষ্ণব পদে ভক্ত ও দেবতার মধ্যে এক তিল ব্যবচ্ছেদ রেখা নাই। জগতে বাঙালীর মত আর কোন জাতি ভগবানকে এত আপনার করিয়া দেখিতে সাহসী হন নাই। কৃষ্ণ কখনও যশোদার হাতে, কখনও রাধিকার পদতলে, কখনও সখাদের মারধরের মধ্যে কত লাঞ্ছনা পাইতেছেন–সেই অবাধ, সম্পূর্ণরূপ একাত্মবোধ দ্বারা পরিশোধিত ক্ষেত্রে প্রেমের পূর্ণ বিকাশ হইয়াছে। যাহাকে সর্ব্বস্ব দিয়াও কিছু চায় না, তাহার কাছে দর্পহারীর দর্প থাকিবে কিরূপে? তিনি তাহাকে কি দিবেন?–সে শুধু তাঁহাকেই চায়। কি ভয় দেখাইবেন? সে শুধু তাঁহার বিরহকে ভয় করে–এরূপ লোকের কাছে ভগবান পরাজিত।
সখারা যখন বিপন্ন তখনও তাহারা পরম বিশ্বাসে কৃষ্ণের মুখের দিকেই চাহিয়া আছে, তাহাদের বিপদের জ্ঞান নাই, প্রেমের বলে তাহারা নির্ভয় হইয়া গিয়াছে, “আনন্দং ব্রহ্মণো বেত্তা না বিভেতি কদাচন।” অপোগণ্ড শিশু মায়ের কাঁধে মাথা রাখিয়া দুর্গম পথে চলিয়াছে, চারিদিকে ব্যাঘ্রগর্জ্জন, আকাশে কৃষ্ণদৈত্যের মত রাশি রাশি মেঘের ভ্রুকুটী, শিশু নিশ্চিন্ত, সে কোন ভয়ই পাইতেছে না, ভয়-ভাবনা সমস্ত তাহার মায়ের, মাতৃক্রোড়ের দুর্গ আশ্রয় করিয়া সে প্রেমের জোরে নির্ভয়–সখারা কৃষ্ণ-প্রেমে সেইরূপ নির্ভয়, তাহারা কংস চরের ভয় রাখে না।
গৌরদাসের কীর্ত্তন যে অপূর্ব্ব বৈকুণ্ঠ রচনা করিত, তাহাতে কিছুকালের জন্য আমি পার্থিব সমস্ত কথা ভূলিয়া যাইতাম, তাহাতে বৃন্দাবন-লীলাচ্ছলে ভাগবত তত্ত্ব এমনিভাবে প্রকটিত হইত। চৈতন্য চরিতামৃত প্রভৃতি গ্রন্থেরও পদাবলীর যে সকল স্থানের অর্থ আমি বহুকাল হাতড়াইয়া পাই নাই, এই মূর্খ কীর্ত্তনীয়ার গান তাহা আমাকে স্পষ্টভাবে বুঝাইয়া দিত। গান করিবার সময়ে যেন সে ভাগবত উদ্যানের একটি ভাবকল্পবৃক্ষের মত হইয়া যাইত, তাহার আখরে ও হন্তের ভঙ্গীতে যে লীলার কথা ফুটিয়া উঠিত, সেরূপ মূর্ত্ত মহাকাব্য–দিব্য সঙ্গীত আমি আর কখনও শুনি নাই। অন্য দেশ হইলে, এই গৌরদাসের জন্য কত কি না হইত। সে কথা বলিয়া কাজ নাই। কিন্তু বিলাতের অনুকরণে আমরা জীবন চরিত সাহিত্যের সৃষ্টি করিয়া যাহাদের গুণকীর্ত্তন করিয়া বড় বড় গ্রন্থ লিখিতেছি ও নব নব সৌধ নির্ম্মাণ করিতেছি, তাঁহাদের মধ্যে কয় জন যে গৌরদাসের গা ঘেঁষিয়া দাঁড়াইতে পারেন, তাহা বলিতে পারি না। তবে বুহ সরসীতে শতদল পদ্ম ও বনান্তে মল্লিকা, কুন্দ ও মালতী ফুটিয়া অনাদরে শুকাইয়া ঝরিয়া পড়ে, তাই বলিয়া তাহাদের মূল্য যে জগতের কোন মূল্যবান বন্ত অপেক্ষা অল্প তাহা কখনই স্বীকার করিব না, আমাদের দৃষ্টিশক্তির প্রসার অল্প,সেই জন্য বিরাট জ্যোতিষ্ক-গুলিকে আমরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দুর মত দেখিয়া থাকি।