এই তর্ক-বিতর্কে মা যশোদার আঙ্গিনা মুখরিত হইয়া উঠিল। সখারা কাঁদিয়া বিভোর হইতেছে, রাণীকে বলিতেছে- আমরা তোমার গোপালকে চারিদিকে ঘিরিয়া থাকি, সকল রাখাল মিলি, মাঝে থাকে বনমালীর কানুর পায়ে একটি কুশাঙ্কুর ফুটিলে আমাদের প্রাণে বিঁধে। তাহারা যশোদাকে অনেক অনুনয় বিনয় করিল- কৃষ্ণের দিকে চাহিয়া সজল চক্ষে বলিল, আমাদের মত বিনি কড়িতে হেন নফর কোথা পাবি? সে সকল উচ্ছ্বসিত আবেদন নিবেদনে যশোদার মত কতকটা গলিয়া গেল। তিনি কৃষ্ণকে সাজাইতে বসিলেন- বিবিধ অলঙ্কারে কৃষ্ণের অঙ্গ ঝলমল করিতে লাগিল, কৌটা খুলিয়া অলকা-তিলকা পরাইলেন, চন্দনের ফোঁটায় যেন কপালে চাঁদের উদয় হইল। সমস্ত দেবতাকে ডাকিয়া রাণী কানুকে কাননে রক্ষা করিবার জন্য প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। এইবার সখাদের সঙ্গে কৃষ্ণ গোষ্ঠে বাহির হইবেন। রাণী কানুর পায়ে নূপুর পরাইতে পরাইতে ভাবাবেশে সাশ্রুনেত্র হইলেন। কিন্তু পায়ে আলতা পরাইবার সময়ে আর নিজকে সামলাইতে পারিলেন না, তখন কাঁদিয়া বিবসা পাগলিনীর ন্যায় রাণী আজিনায় বসিয়া পড়িলেন এবং বলিলেন- আমি কিছুতেই আজ গোপালকে গোষ্ঠে যাইতে দিব না। তোরা যদি জোর করবি, তবে মাতৃবধের দায়িক হবি।
সখায়া মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল। এই সময়ে তাহাদিগের মনে নূতন আশায় সঞ্চার করিয়া আকাশে বলরামের শিঙা বাজিয়া উঠিল। দাদা বলাই আসিতেছেন, সুতরাং যশোদা তাঁহার সঙ্গে ঘাঁটিয়া উঠিতে পারিবেন না। বারুণী-পানে মত্ত বলাই আসিতেছেন, কবি বলিতেছেন, বলাই এর বারুণী বিশুদ্ধ কৃষ্ণপ্রেম, তিনি একটু তোতলা, (নিত্যানন্দ একটু তোতলা ছিলেন, কবিরা বলরামে তাহাই আরোপ করিয়াছেন), টলিতে টলিতে বলাই আসিতেছেন, শিঙায় কানাই এর নাম একটু ঠেকিয়া ঠেকিয়া আসিতেছে, কাক্কা কানাই বলিতে বলিতে আসিতেছেন, তাঁহার মুখপদ্ম-কৃষ্ণ-প্রেমাশ্রুতে ভাসিয়া যাইতেছে। মা রোহিণী যেখানে যেটি সাজে, তাই দিয়া বলাইকে সাজাইয়া দিয়াছেন।
“গলে বনমালা হাতে হাড়-বালা, শ্রবণে কুণ্ডল সাজে।
ধব-ধব-ধব ধবলী বলিয়া ঘন ঘন শিঙা বাজে।
(কিবা) নব নটবর নীলাশ্বর লস্ফে ঝম্পে আওয়ে।
মদে মাতল কুঞ্জর গতি উলটি পালটি চাওয়ে।”
এই সুদর্শন শুভ্রকান্তি বিরাট্ দেহ বলদেবের পদভরে ধরিত্রী কম্পিত হইতেছে। মাতাল বলাই বলিতেছেন, খির রহ ধরনী পৃথিবীকে এই ভাবে আশ্বাস দিয়া আসিতে আসিতে বৃন্দাবনের প্রাতঃ সূর্য্যকরে প্রতিবিম্বিত স্বদেহের বিরাট ছায়া দেখিয়া তিনি মনে করিলেন, সত্যই বৃন্দাবন দখল করিতে কোন প্রবল আগন্তুক অভিযান করিয়া আসিয়াছে, তখন মত্ত বলাই ছায়াকে জিজ্ঞাসা করিতেছে তুই কে, পরিচয় দে? আমি কা-ক্কা কানাই এর দাদা, জানিস আমি কত বড়। বলাই বলিল না, যে তাঁহার হলকর্ষনে জগৎ উলটিয়া যাইতে পারে, সে বড় বড় অসুরকে অবলীলাক্রমে বধ করিয়াছে। বৃন্দাবনে সমস্ত রাজসিক দর্প ভাসিয়া গিয়াছে, কৃষ্ণপ্রেম ছাড়া সেখানে গৌরব করিবার কিছু নাই। তাই সে পরম দর্পে নিজ ছায়াকে বলিতেছে, জানিস্ আমি ভাই কানাই এর দাদা, এই পুরুষ বাক্যের উচ্চারণকালে তাঁহার ভ্রমরপুঞ্জের ন্যায় কজ্জল-
কৃষ্ণ ভ্রু-যুগল কৃঞ্চিত হইল। তাঁহার হন্তের আন্দোলন ও মুখ-ভঙ্গী ছায়ায় প্রতিবিম্বিত হইল। তখন শত্রুর উত্তেজনা ভ্রম করিয়া বলদেব সত্যই রাগিয়া গেলেন।
‘ আপন তনু ছায়া হেরি, রেষাবেশ হই,
হু হু পথ ছোড়াই বলি- অঙ্গুলি ঘন দেই।
কর পাঁচনি কক্ষে দাবি, রাঙ্গা ধুলি গায় মাখে,
কা-ক্কা কা-ক্কা কানাইয়া বলি ঘন ঘন ডাকে।’
এই মত্ততা, এই স্খলিত পদ, বিভ্রান্ত বাক, নিজের ছায়ার সহিত লড়াই, সুদর্শন বলাই এর গতিবিধি সমন্তই কৃষ্ণপ্রেমের ছাপ-মারা; এজন্য প্রস্ফুটিত শ্বেতপদ্ম যেরূপ জলের উপর ভাসে, সেইরূপ তাঁহার মূর্ত্তিকে আঁকা কৃষ্ণ-প্রেম সমস্ত উদভ্রান্ত ব্যবহারের মধ্যে ফুটিয়া উঠিয়াছে। তোতলার কানাই বলিতে কা-ক্কা কানাই ও ধবলী বলিতে ধব-ধব-ধব ধবলী বলিতে যাইয়া মুখে লালা পড়িতেছে, কবি তাহার মধ্যেও অপরূপ সৌন্দর্য্য আবিষ্কার করিয়াছেন।
বলাই এর মুখ যেন বিধুরে, বুক বহি পড়ে মুখের নাল
যেন শ্বেত কমলের মধুরে।
বলদেবকে দেখিয়া যশোদা ভীত হইলেন, এবার আর কৃষ্ণকে রাখা যাইবে না। তিনি মিনতি করিয়া বলিলেন, “গোপাল অতি শিশু, কোন বোধ সোধ নাই-সে কাপড়খানি পর্য্যন্ত পরিতে শিখে নাই, নন্দালয়ে আসিবার পথে কাপড় খসিয়া পড়িলে সে থমকিয়া দাঁড়ায়, এদিকে কাপড় পড়িয়া গিয়া তাহার নুপূরসহ পা দুখানি বেড়ীর মত জড়াইয়া কাঁদিতে থাকে, এমন অসহায় অব্স্থায় আমি কত বার খুঁজিয়া পাইয়া তাহাকে বাড়ী লইয়া আসিয়াছি, তোরা এমন শিশুকে বিপদ-সঙ্কুল গোষ্ঠে লইয়া যাইবি কোন প্রাণে?”
যশোদার এই বাৎসল্য অতুলনীয়। কংস-ধ্বংসকারী, বক-কিস্মির-কালীয়-বিধ্বংসী, পুতনারাক্ষসীর স্তনসহ প্রাণ-শোষণকারী, যমলার্জ্জুনোৎ- পাটক পরম পুরুষবরকে তিনি যে চক্ষে দেখিয়াছেন, তাহা মাতৃ-স্নেহের প্রতীক। মাতা জগজ্জয়ী বীর পুন্ত্রকেও শিশু বলিয়াই মনে করেন। যিনি জগতে মহাবিপ্লব ঘটাইয়া শক্তিশালী সাম্রাজ্য স্থাপন করিয়াছেন, তিনিও মায়ের কাছে শিশু, তিনি দিনরাত চিন্তা করেন। যদি মুহূর্ত্ত-কালের জন্য তিনি পুত্রের শৌর্য্য-বীর্য্যের কথা স্মরণ করেন, তখন জগৎপালনকারী রস-শ্রেস্ঠ বাৎসল্য আর তাঁহার মনে স্থান পাইতে পারে না। ভগবানের পালনী শক্তির মূর্ত্ত প্রকাশ সন্তানের প্রতি মমতার অবসান হইলে জগৎ-রক্ষার প্রধান আশ্রয় ভাঙ্গিয়া পড়ে, কুটীরের প্রধান অবলম্বন শালের খুটিটীর অস্তিত্বের বিলোপ হয়। বৈষ্ণব কবিরা সেরূপ রস-ভঙ্গ করেন নাই। একদিন মাত্র যশোদা মুহূর্ত্তের জন্য বিন্দুর মধ্যে প্রতিবিম্বিত ষড়ৈশ্বর্য্যশালী বিশ্ব-রূপের প্রকাশ বুঝিতে পারিয়া ক্রোড়ের অতি ক্ষুদ্র শিশুটির মধ্যে বিশ্ব-শক্তির স্বরূপ দেখিয়া তিনি অধীর হইয়া পড়িয়াছিলেন, এজন্য বাল-গোপাল হাঁ করিয়া মাতাকে যাহা দেখাইয়া চমৎকৃত করিয়াছিলেন, সে রূপ তিনি তখনই সম্বরণ করিলেন।