হারিয়ে নিঃস্ব রিক্তের মত। চারিদিকে কলেরার প্রকোপ। ইনজেকশন পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলা বনধ হতে পারে। পুলিশের গুলি আর আততায়ীর ছোরায় দশজনের মৃত্যু। বোম্বাইয়ে জাম্বো জেট। অন্ধ্রপ্রদেশে হরিজন বালককে পুড়িয়ে মারা সম্পর্কে কমিশন গঠন। ফ্যাক্টরিতে লক আউট। ভিয়েতনামে আবার বোমাবর্ষণ। বোগাস, খবরের কাগজেও সেই একই খবরের কচকচি। শালা, কোথাও শান্তি নেই। বিরক্তিতে কাগজটা ছুঁড়ে মারল দেয়ালে।
অস্বস্তি কাটাবার জন্য ঘরময় পায়চারি করল ক্ষানিকক্ষণ, তারপর পাশের ঘরে গেল। বাসবী শাড়ি পালটাচ্ছে, বুবুলও জামা প্যান্ট পরেছে, পায়ে জুতো। কোথায়ও যাবে মনে হচ্ছে।
খুকখুক করে কাশল একবার মৃগাংক, তারপর বলল, কী ব্যাপার, চললে কোথায়?
কোনা উত্তর নেই,আবার জিজ্ঞেস করল মৃগাংক।
—ভবানীপুর, সংক্ষিপ্ত কাটা জবাব।
ভবানীপুরে বাসবীর বাপের বাড়ি। মৃগাংক আর কিছু বলল না, বলার দরকার আছে মনেও করল না। কারণ, বাসবী একবার যখন ঠিক করেছে, তখন যাবেই। কিছুতেই রোখা যাবে না। বরং রুখতে গেলেই উল্টো ফল হবে। ঝগড়া ঝাটি চিৎকার সমস্ত পাড়া সচকিত হয়ে উঠবে। তার চেয়ে এই ভালো, রাগ পড়লে দু’তিন দিন পরে নিজেই ফিরে আসবে।
বাসবী চলে গেল বুবুলকে নিয়ে। যাবার সময় ল্যাচকির দরজাটা দুম করে বন্ধ করে গেল সশব্দে। এত জোরে শব্দ করবার দরকার ছিল না, হয়তো ছিল, মৃগাংক ভাবল, নিজের রাগকে বাইরে দেখাবার জন্য।
এরপর মেজাজ খারাপ করে বসে রইল বেশ খানিকক্ষণ। অসহ্য হয়ে উঠেছে। ঘর সংসার, আর ভালো লাগে না, ইচ্ছে করে সন্ন্যাসী হয়ে যায়, এখন ও বুঝতে পারে কেন গৌতম বুদ্ধ স্ত্রী পুত্র সংসার ত্যাগ করেছিলেন। মাঝে মাঝে ভাবে ও, জাহাজের নাবিক হয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ বিদেশের বন্দরে।
ঘড়ি দেখল। বেলা হয়ে গেছে, অফিস যেতে হবে। তাড়াতাড়ি দাড়ি কামিয়ে। মান করতে গেল। চৌবাচ্চা ভর্তি টলটলে জল। গায়ে এক মগ ঢালতেই প্রাণটা যেন জুড়িয়ে গেল। মনের ভাবনা, চিন্তা, গ্লানি আপাতত অনেক কম হচ্ছে। হঠাৎ বেশ হালকা লাগছে নিজেকে। বাড়িতে এখন কেউ নেই, একেবারে ফাঁকা, কোনো দায় দায়িত্ব নেই, এই চিন্তাটা মন্দ লাগল না ওর। গুনগুন করে গান করল খানিকটা, ওর মেজাজ এখন বেশ ভালো।
অফিসে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসল আয়েস করে। হাতের সামনে টেবিলে অনেকগুলি ফাইল। কিন্তু এখন কোন কাজ করতে ইচ্ছে না। মনটা কেমন উড়ু উড়ু লাগছে। তবু দু’একটা ফাইল টেনে খানিকক্ষণ পড়ল, তারপর সই। কিন্তু এভাবে আর। কতক্ষণ কাটে। টিফিনের পর ফোন তুলে ডায়াল করল। গুডলাক, ফোনে পাওয়া গেল নন্দিতাকে, ওর পুরনো বান্ধবী।
—হ্যাঁলো নন্দিতা, আমি মৃগাংক বলছি।
—কি বল।
—কি করছ?
—আপাততঃ গোটাকয়েক জরুরি চিঠি টাইপ করছি।
—ছুটির পর—
—আপাতত কোন প্রোগ্রাম নেই।
—এই শোনো, মেট্রোর সামনে পাঁচটার সময় আসতে পারবে?
—হঠাৎ, কি ব্যাপার?
–এসোই না—
—ঠিক আছে, তবে পাঁচটা নয়, সওয়া পাঁচটা।
ফোন ছেড়ে দিল মৃগাংক। নন্দিতা ওর কলেজ জীবনের বান্ধবী, কয়েক বছরের জুনিয়র। এককালে ভালবাসা-টাসাও ছিল। কিন্তু বিয়ে হয়নি নানা কারণে। শেষ পর্যন্ত নন্দিতা অবশ্য বিয়ে করেছিল এক মেরিন ইঞ্জিনিয়ারকে। কিন্তু বছর দুয়েক যেতে না যেতেই ডিভোর্স। তারপর থেকে নন্দিতা একলাই থাকে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে, পাম এভেনিউতে। ভাল মাইনের চাকরি একটা বিদেশি ফার্মে। মৃগাংকর সঙ্গে বিয়ে না হলেও এখনো বন্ধুত্ব আছে বলা যায়, যদিও ইদানীং আর বিশেষ দেখা-সাক্ষাৎ হত না। বাসবী অবশ্য এসব কিছুই জানে না।
অফিস থেকে পৌনে পাঁচটা নাগাদ বেরোল মৃগাংক। গন্তব্য মেট্রোর দিকে। ফুটপাতের দুধারে দোকান, সেখানে নানান জিনিসের পশরা। এত চওড়া ফুটপাত, অথচ লোকের ভিড়ে পথচলা দায়। এই ক’বছরে প্রচুর লোক বেড়েছে কলকাতায়, অথচ রাস্তা বা ফুটপাত বাড়েনি সে অনুপাতে। ভিড় ঠেলে চলতে চলতে বিরক্তি ফুটে উঠল মৃগাংকর মুখে। ন্যাস্টি! সমস্ত শহরটাকে ভিখিরি আর হকাররাই দখল করে নেবে দেখছি।
মেট্রোর নীচে পৌঁছে দেখল, নন্দিতা এসে গেছে। মৃগাংক বলল, কি, বিফোর টাইম যে!
নন্দিতা হাসল, ঠিক আগের মত, মৃগাংক দেখল, ওর চেহারায় বেশ চাকচিক্য এসেছে, পোশাক-পরিচ্ছদ আগের চেয়ে অনেক স্বচ্ছ, কোমরের অনেকটা অংশই অনাবৃত। ওকে দেখলে কে বলবে ওর বয়স তেইশ-চব্বিশের বেশি, অথচ মৃগাংক জানে, ওর বয়স তিরিশ ছুঁই ছুঁই করছে।
ওরা কাফে-ডি-মণিকোর একটা কেবিনে ঢুকল। নন্দিতা বলল, আজ অফিস একটু তাড়াতাড়ি ছুটে হয়ে গেল, তাছাড়া
—তাছাড়া কি?
–হঠাৎ তুমি এতদিন পরে ডাকলে কেন, কৌতূহল ছিল, বছরখানেক তো কোন পাত্তাই ছিল না তোমার!
গরম কফির কাপে চুমুক দিয়ে মিটিমিটি হাসল মৃগাংক, কৌতূহল মিটেছে?
-দেখছি তোমাকে, বেশ বদলেছ!
–যেমন—
—আগে তুমি বেশ লাজুক ছিলে—
—তুমিও পালটেছ। অবশ্য সবাই পালটায়। তাই নিয়ম। সময় তার অভিজ্ঞতার ছাপ রেখে যায় দেহে, মনে। মৃগাংকর গলাটা বেশ ভরাট শোনাল এবার।
-তুমি কি এইসব জ্ঞানগর্ভ কথা শোনাবে বলে ডেকেছ?
—আরে না না, তোমাকে অনেকদিন পরে দেখতে ইচ্ছে করল, তাই ফোনে ডাকলাম। আচ্ছা, একটা সিনেমা দেখলে হয় না।
—কোথায়।
–মেট্রোতে। বেডসাইড স্টোরি চলছে।