দুধ নিয়ে ফিরে আসামাত্র বাসবী বাজারের থলে দুটো এগিয়ে দিল নিঃশব্দে। বেশ বোঝা যায়, ঝি আসেনি বলে মুখ গম্ভীর, ব্যাজার।
মৃগাংক বলল, দাঁড়াও, বাথরুমটা ঘুরে আসি আগে।
মৃগাংকর এই এক দোষ। সকালের প্রাতঃকৃত্য সারতে ঝাড়া একটি ঘণ্টা লাগে। কিন্তু আজ হাতমুখ ধুয়ে, দাঁত মেজে, প্রাতঃকৃত্য সেরে মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে। বাসবী তখন রান্নাঘরে গতরাত্রের বাসনপত্ৰ মাজতে বসেছে। তারই ঝনঝন আওয়াজ হচ্ছে। বুবুল ওদিকে কয়লা রাখবার জায়গা থেকে একমনে কয়লা তুলছে, খাচ্ছে, হাতে মুখে মাখছে।
বুবুলের ব্যাপারে কোনোরকম অবহেলা সহ্য করতে পারে না মৃগাংক। গলায় ঝঝ মিশিয়ে মৃগাংক বলল, ওদিকে বুবুল তো কয়লা খাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছ না।
বাসনপত্রের ঝনঝন শব্দ উঠল, দুটো হাতে কত আর সামলাবো। তোমারই তো প্রাতঃকৃত্য সারতে পুরো একটি ঘণ্টা। খোটা নিঃশব্দে হজম করল মৃগাংক, তারপর কিছু না বলে বুবুলকে বাথরুমে নিয়ে গেল, ওর মুখ থেকে কয়লার টুকরো বার করল, হাত-মুখ ধোয়ালো সাবান দিয়ে।
ঠিক করল, বুবুলকে নিয়েই বাজারে যাবে। বুবুলকে নিয়ে বাজারের থলে দুটো হাতে নিয়ে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেশ করল বাসবীকে, কি আনতে হবে।
আরো গম্ভীর স্বরে উত্তর এল, যা খুশি।
এরপর হঠাৎ বাসবী ওর কোল থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল বুবুলকে। থমথমে গম্ভীর মুখে বাজার গেল মৃগাংক। বাড়ির কাছেই ছোট বাজার। জিনিসপত্রের দাম চড়া হলেও সময় সংক্ষেপের জন্য এখানেই বাজার সারে মৃগাংক। বাজারে ঢোকবার মুখে দেখা শোভনবাবুর সঙ্গে। শোভন বলল, এই যে মৃগাংকবাবু, কি খবর? আপনার তো আজকাল দেখা পাওয়াই যায় না।
–চলে যাচ্ছে, ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিল। পরক্ষণেই মনে হল, একটু যেন অভদ্র হল, তাই পালটা প্রশ্ন করল, ঠোঁটে হাসি ফোঁটাল, আপনি ভালো।
–আর আমার কথা বলবেন না, বাচ্চা দুটোর পেটের অসুখ, তাছাড়া মাও ভুগছে আজ বস্ত্রখানেক। মিসেসের আবার টিউমার, শিগগিরই অপারেশন করতে হবে। আপনি আছে বেশ, ঝাড়া গা হাত পা–
মৃগাংক কিছু শুনল, কিছু শুনল না। এধ্ব সাংসারিক বিশেষত যে ব্যাপারে ওর নিজের কোনো সম্পর্ক নেই, ভালো লাগে না। কিন্তু কি করা, এক পাড়ায় সৎ প্রতিবেশী হিসেবে থাকতে গেলে মুখে সমবেদনার ছায়া ফেলে শুনতেই হবে এসব।
গলার স্বরে সহানুভূরি ভাব ফোঁটাল মৃগাংক, তাহলে তো বেশ ঝামেলায় আছেন দেখছি।
—আর বলবেন না, সংসার নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছি। এদিকে আর এক বিপদ, ভাগনেটাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, মার্ডার চার্জে। কী যে করি!
এরপর শোভনবাবু পাক্কা মিনিট পনেরো ধরে নিজের সুখ-দুঃখের ফিরিস্তি শুনিয়ে গেলেন। মৃগাংক কুইনিন গেলার মত করে কথাগুলো কোনোরকমে গলাধঃকরণ করল। আবার পরমুহূর্তেই উগরে ফেলল।
মিনিট কুড়ি এভাবে নষ্ট হবার পর তাড়াতাড়ি বাজার সেরে ফিরে দেখল, বাসবী চা তৈরি করছে। ওকে দেখে বলল, এতক্ষণে ফেরা হল। এক্ষুণি তো বলা হবে, অফিসের ভাত চাই!
মৃগাংক বাজারের থলে দুটো রান্নাঘরের দরজায় রেখে হাতমুখ ধুয়ে চেয়ারে বসল। এবার বাসবী দু’কাপ চা করে এক কাপ এগিয়ে দিল ওর দিকে। সঙ্গে দুটো ক্রিম ক্র্যাকার। সামনেই বুবুল ঘুরঘুর করছিল। ওদের চা খেতে দেখে বুবুল এগিয়ে এল বাসবীর দিকে। ওর কোলে চড়ল। বাবী নিজের কাপ থেকে খানিকটা চা’ ঢালল প্লেটে, তারপর বুবুলের মুখের কাছে ধরল। মৃগাংক দেখল, চুকচুক করে চা খাচ্ছে দেড় বছরের বুবুল।
এত বাচ্চা ছেলের চা খাওয়ার ব্যাপারটা ওর দাও হয় না। এ নিয়ে বার দুয়েক কথা কাটাকাটিও হয়ে গেছে বাসবীর সঙ্গে। তাই গত দিন কয়েক চা দেয়নি। বুবুলকে। অন্তত মৃগাংক দেখেনি।
মৃগাংক ভ্রুকুটি করল, ওকে চা দিচ্ছ যে।
বাবী অত্যন্ত সহজ ভঙ্গীতে, যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে বলল, কেন, কি হয়েছে, একটুখানি তো চা।
মৃগাংক বুঝল, এখনো চটে আছে বাসবি, কারণ ও চটে গেলেই তবে এমন নৈব্যক্তিক ভঙ্গীতে কথা বলে।
–কিন্তু তোমাকে তো আগেই বলেছি, চা হচ্ছে নেশার জিনিস, বুবুলকে দেবে, ক্ষতি হতে পারে।
—কেন, টুলুদি তো ওর বাচ্চাটাকে চা খাওয়ায়, কফি খাওয়ায়, কিছু তো হয়নি। মৃগাংক ওর জবাব শুনে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিল ক্রমশ, তবু শান্ত গলায় বলল, এফেক্ট তো আর একদিনে বোঝা যায় না। সময় লাগে।
-কেন অতীনদা তো ডাক্তার। তাহলে বুঝি টুলুদিকে কিছু বললে না। অতীনদা বলেছে, চায়ে নাকি কেফিন আছে। এনার্জি যোগায়।
হঠাৎ মৃগাঙ্কর স্বর কর্কশ হয়ে উঠল, হ্যাঁ, অতীনদা যখন বলেছে, তবে আর কি! আমার কথার তো কোন দামই নেই তোমার কাছে। অতীনদা, বুলুদা, এদের কথাই তো তোমার কাছে বেদবাক্য, আর আমি তো ফালতু–
বুলুদার নাম শুনে বাসবির কপালের রগ শক্ত হয়ে উঠল, চিৎকার করে বলল, ইতরের মত কথা বল না।
এরপর নিজের কাপের অবশিষ্ট চা একটানে বেসিনে ঢেলে ফেলে দিয়ে বুবুলকে নিয়ে দুমদাম শব্দে শোবার ঘরে ঢুকল। মৃগাংক বুঝল, আজ কপালে দুর্ভোগ আছে। একবার মনে হল, বুলুর নামটা না বললেই হত। প্রথম যৌবনের ভালবাসা সম্বন্ধে মেয়েদের একটা দুর্বলতা থাকে। বুবুল এতক্ষণ মুখ দিয়ে নানারকম শব্দ করছিল, কথা বলছিল আধধা আধো স্বরে। কিন্তু এখন ও স্তব্ধ হয়ে গেছে, কেমন অসহায় দৃষ্টি। এক চুমুকে বাকি চাটা শেষ করে মৃগাঙ্ক বদ্বার ঘরে এল খবরের কাগজটা নিয়ে। যদি অশান্ত মনটাকে শান্ত করে তোলা যায়। দূর শালা, খবরের কাগজেও আজকাল সেই একই খবর। বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ রিফিউজি আসছে।