পরদিন সকালে উঠিয়া রাধিকার একটু দেরি হইয়া গিয়াছিল : উঠিয়া দেখিল শম্ভু নাই; সে বোধ হয় দুই চারজন মজুরের সন্ধানে গ্রামে গিয়াছে। বাহিরে আসিয়া সে শিহরিয়া উঠিল।
কিষ্টোর তাঁবুর চারিপাশে পুলিশ দাঁড়াইয়া আছে। দুয়ারে একজন দারোগা বসিয়া আছেন। এ কি? সে সটান গিয়া দারোগার সামনে সেলাম করিয়া দাঁড়াইল। দারোগা তাহার আপাদমস্তক দেখিয়া বলিলেন, ডাক সব, আমরা তাঁবু দেখব।
আবার সেলাম করিয়া বেদেনী বলিল, কি কসুর করলাম হুজুর?
–মদ আছে কিনা দেখব আমরা। ডাক বেটাছেলেদের। এইখান থেকেই ডাক।
রাধিকা বুঝিল, দারোগা তাহাকে এই তাঁবুরই লোক ভাবিয়াছেন, কিন্তু সে আর তাঁহার ভুল ভাঙিল না। সে বলিল, ভিতরে আমার কচি ছেলে রইছে হুজুর–
–আচ্ছা ছেলে নিয়ে আসতে পার তুমি। আর ডেকে দাও পুরুষদের।
রাধিকা দ্রুত তাঁবুর মধ্যে প্রবেশ করিয়া সেই দেখা জায়গাটার আলগা মাটি সরাইয়া দেখিল, তিনটা বোতল তখনও মজুদ রহিয়াছে। সে একখানা কাপড় টানিয়া লইয়া ভাঁজ করিয়া বোতল তিনটাকে পুরিয়া ফেলিল, সুকৌশলে এমন করিয়া বুকে ধরিল শীতের দিনে সযত্নে বস্ত্রাবৃত অত্যন্ত কচি শিশু ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। তাঁবুর মধ্যেই কিষ্টো অঘোরে ঘুমাইতেছিল, পায়ের ঠেলা দিয়া তাহাকে জাগাইয়া দিয়া রাধিকা বলিল, পুলিশ আসছে, ব’সে রইছে দুয়ারে উঠ্যা যাও।
সে অকল্পিত সংযত পদক্ষেপে স্তন্যদানরত মাতার মতো শিশুকে যেন বুকে ধরিয়া বাহির হইয়া গেল। তাহার পিছনে পিছনেই কিষ্টো আসিয়া দারোগার সম্মুখে দাঁড়াইল।
দারোগা প্রশ্ন করিলেন, এ তাঁবু তোমার?
সেলাম করিয়া কিষ্টো বলিল, জি, হুজুর।
–দেখব তাঁবু আমরা, মদ আছে কিনা দেখব।
মেলার ভিড়ের মধ্যে শিশুকে বুকে করিয়া বেদেনী ততক্ষণে জলরাশির মধ্যে জলবিন্দুর মতো মিশিয়া গিয়াছে।
শম্ভু গুম হইয়া বসিয়া ছিল, রাধিকা উপুড় হইয়া পড়িয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতেছিল। শম্ভু তাহাকে নির্মম প্রহার করিয়াছে। শম্ভু ফিরিয়া আসিতে বিপুল কৌতুকে সে হাসিয়া পুলিশকে ঠকানোর বৃত্তান্ত বলিয়া তাহার গায়ে ঢলিয়া পড়িল, বলিল, ভেল্কি লাগায়ে দিছি দারোগার চোখে।
শম্ভু কঠিন আক্রোশভরা দৃষ্টিতে রাধিকার দিকে চাহিয়া রহিল, রাধিকার সে দিকে ভ্রূক্ষেপও ছিল না, সে হাসিয়া বলিল, খাবা, ছেলে খাবা?
শম্ভু অতর্কিতে তাহার চুলের মুঠি ধরিয়া নির্মমভাবে প্রহার করিয়া বলিল, সব মাটি ক’রে দিছিস তু; উহাকে আমি জেহেল দিয়ার লাগি, পুলিশে ব’লে এলাম, আর তু করলি ই কাণ্ড!
রাধিকা প্রথমটায় ভীষণ উগ্র হইয়া উঠিয়াছিল, কিন্তু শম্ভুর কথা সমস্তটা শুনিয়াই তাহার মনে পড়িয়া গেল গত রাত্রির কথা। সত্যই, এ কথা শম্ভু তো বলিয়াছিল! সে আর প্রতিবাদ করিল না, নীরবে শম্ভুর সমস্ত নির্যাতন সহ্য করিয়া উপুড় হইয়া পড়িয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিল।
আজ অপরাহ্ন হইতে এ তাঁবুতেও খেলা আরম্ভ হইবে।
শম্ভু আপনার জীর্ণ পোশাকটা বাহির করিয়া পরিয়াছে, একটা কালো রঙের চোঙার মতো প্যান্টালুন, আর একটা কালো রঙেরই খাটো হাতা কোট। রাধিকার পরনের পুরনো রঙিন ঘাঘরা আর অত্যন্ত পুরনো একটা ফুলহাতা বডিস। অন্য সময় মাথার চুল সে বেণি বাঁধিয়া ঝুলাইয়া দিত; কিন্তু আজ সে বেণিই বাঁধিল না, আপনার সকল প্রকার দীনতা ও জীর্ণতার প্রতি অবজ্ঞায় ক্ষোভে তাহার যেন লজ্জায় মরিতে ইচ্ছা হইতেছিল। উহাদের তাঁবুতে কিষ্টোর সেই বিড়ালির মতো গাল মোটা, স্থবিরার মতো স্থূলাঙ্গি মেয়েটা পরিয়াছে গেঞ্জির মতো টাইট পাজামা, জামা, তাহার উপর জরিদার সবুজ সাটিনের একটা জাঙ্গিয়া ও কাঁচুলি ঢঙের বডিস। কুৎসিত মেয়েটাকেও যেন সুন্দর দেখাইতেছিল। উহাদের জয়ঢাকের বাজনার মধ্যে কাঁসা-পিতলের বাসনের আওয়াজের মতো একটা রেশ শেষকালে ঝঙ্কার দিয়া উঠে। আর এই কতকালের পুরনো একটা ঢ্যাপঢ্যাপে জয়ঢাক, ছি-!
কিন্তু তবুও সে প্রাণপণে চেষ্টা করে, জোরে জোরে করতাল পেটে।
শম্ভু বাজনা থামাইয়া হাঁকিল, ও-ই ব-ড়-বা-ঘ!
রাধিকা রুদ্ধস্বর কোনোমতে সাফ করিয়া লইয়া প্রশ্ন করিল, বড় বাঘ কি করে?
শম্ভু খুব উৎসাহভরেই বলিল, পক্ষীরাজ ঘোড়া হয়, মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করে, মানুষের মাথা মুখে ভরে, চিবায় না।
সে এবার লাফ দিয়া নামিয়া ভিতরে গিয়ে বাঘটাকে খোঁচা দিল, জীর্ণ বৃদ্ধ বনচারী হিংসক আর্তনাদের মতো গর্জন করিল।
সঙ্গে সঙ্গে ও-তাঁবুর ভিতর হইতে সবল পশুর তরুণ হিংস্র ক্রুদ্ধ গর্জন ধ্বনিত হইয়া উঠিল। মাচার উপরে রাধিকা দাঁড়াইয়াছিল, তার শরীর যেন ঝিমঝিম করিয়া উঠিল। ক্রূর হিংসাভরা দৃষ্টিতে সে ঐ তাঁবুর মাচানের দিকে চাহিয়া দেখিল, কিষ্টো হাসিতেছে! রাধিকার সহিত চোখাচোখি হইতেই সে হাঁকিল, ফিন একবার!
ও-তাঁবুর ভিতর হইতে দ্বিতীয়বার খোঁচা খাইয়া উহাদের বাঘটা এবার প্রবলতর গর্জনে হুঙ্কার দিয়া উঠিল। রাধিকার চোখে জ্বলিয়া উঠিল আগুন।
অল্প কয়টি লোক সস্তায় আমোদ দেখিবার জন্য শম্ভুর তাঁবুতে ঢুকিয়াছিল। খেলা শেষ হইয়া গেল, শম্ভু হিংস্র মুখ ভীষণ করিয়া বসিয়া রহিল। রাধিকা দ্রুতপদে মেলার মধ্যে বাহির হইয়া গেল। কিছুক্ষণ পরেই সে ফিরিল কিসের একটা টিন লইয়া।
শম্ভু বিরক্তি সত্ত্বেও সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, কি উটা?
কেরাচিনি। আগুন লাগায়ে দিব উয়াদের তাঁবুতে। পুরা পেলম নাই, দু সের কম রইছে।
শম্ভুর চোখ হিংস্র দীপ্তিতে জ্বলিয়া উঠিল। সে বলিল, লিয়ে আয় মদ।
মদ খাইতে খাইতে রাধিকা বলিল, দাউ দাউ ক’রে জ্বলবেক যখন! সে খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। সে অন্ধকারের মধ্যে বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল, ঐ তাঁবুতে তখনো খেলা চলিতেছে। তাঁবুর ছেঁড়া মাথা দিয়া দেখা যাইতেছিল, কিষ্টো দড়িতে ঝুলানো কাঠের লাঠিতে দোল খাইতে খাইতে কসরৎ দেখাইতেছে।
উঃ, একটা ছাড়িয়া আর একটা ধরিয়া দুলিতে লাগিল! দর্শকেরা করতালি দিতেছে।
শম্ভু তাহাকে আকর্ষণ করিয়া বলিল, এখুনলয়, সে-ই নিশুত-রাতে!
তাহারা আবার মদ লইয়া বসিল।