- বইয়ের নামঃ আরোগ্য-নিকেতন
- লেখকের নামঃ তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ মাটিগন্ধা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০০. সূচনা
আরোগ্য-নিকেতন অর্থাৎ চিকিৎসালয়। হাসপাতাল নয় দাতব্য চিকিৎসালয়ও নয়—দেবীপুর গ্রামের তিন পুরুষ চিকিৎসা-ব্যবসায়ী মশায়দের চিকিৎসালয়।
স্থাপিত হয়েছিল প্রায় আশি বৎসর পূর্বে। এখন ভাঙা-ভগ্ন অবস্থা; মাটির দেওয়াল ফেটেছে, চালার কাঠামোটার কয়েকটা জায়গাতেই জোড় ছেড়েছে মাঝখানটা খাজ কেটে বসে গেছে কুঁজো মানুষের পিঠের খুঁজের মতো। কোনো রকমে এখনও খাড়া রয়েছে, প্রতীক্ষা করছে তার সমাপ্তির; কখন সে ভেঙে পড়বে সেই ক্ষণটির পথ চেয়ে রয়েছে।
অথচ যেদিন স্থাপিত হয়েছিল সেদিন স্থাপন-কর্তা জগদ্বন্ধু কবিরাজ মহাশয় তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু ঠাকুরদাস মিশ্রকে বলেছিলেন, বুঝলে ঠাকুরদাস, যাবৎ চন্দ্ৰাক মেদিনী বলব না তবে … আমাদের বংশের বসতি এখানে যতকাল থাকবে ততকাল এ আটন, এ পাট পাকা হয়ে রইল। হেসে বলেছিলেন দম্ভ মনে করি না ভাই, দম্ভ নয়। হাত দুখানি জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলেছিলেন, অক্ষয় লাভের কারবার। যতই করিবে দান তত যাবে বেড়ে। পুরনো ঘিয়ের মতযত দিন যাবে তত দাম বাড়বে। বলতে গেলে সংসারে শ্রেষ্ঠ লাভের কারবার। দেনা-পাওনা দেওয়া-নেওয়া দুই দিকেই শ্ৰেষ্ঠ লাভ মিলবে এখানে, অথচ দুই পক্ষের কেউ ঠকবে না।
জগদ্বন্ধু মহাশয়ের বন্ধু ঠাকুরদাস মিশ্র ছিলেন একেবারে হিসেবনবিশ বিষয়ী লোক, পেশায় জমিদারের গোমস্তা। তিনি বড় বড় অঙ্ক বুঝতেন, মামলা মকদ্দমা বুঝতেন, দলিল আরজি জবাব বুঝতেন, কিন্তু এইসব তত্ত্ব বুঝতেন না। তিনি বক্রভাবেই বলেছিলেন নাড়ি টিপে আর গাছগাছড়া তুলে এনে হেঁচে পিষে শুকিয়ে পাঁচন-বড়ি দিলেই পয়সা। টাকায় অন্তত চোদ্দ আনা লাভ তোমার বাধা সে বুঝলাম। কিন্তু রোগীর লাভ? ওটা কী করে বললি জগ? তোর লাভ, রোজকার রোগীর খরচ, সে দেনা করেও করতে হবে। তার তো ধনে-প্রাণে মরণ।
বাধা দিয়ে জগদ্বন্ধু মশায় বলেছিলেন—তুই বাঁকা পথে হাঁটিস ঠাকুরদাস। পয়সার কথাটা পরের কথা। যে লাভ বললাম সে লাভ পয়সার নয়, অথচ এইটাই সংসারে শ্রেষ্ঠ লাভ। একপক্ষের লাভ আরোগ্যলাভ, অন্যপক্ষের লাভ সেবার পুণ্য। জানিস? বিশ্ব সংসারে আরোগ্যলাভই হল শ্রেষ্ঠ লাভ। যক্ষরূপী ধর্ম যুধিষ্ঠিরকে যেসব প্রশ্ন করেছিলেন তার মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল—লাভানামুত্তমং কি? সংসারের লাভের মধ্যে সর্বোত্তম লাভ কী? যুধিষ্ঠির বলেছিলেন—লাভানাং শ্ৰেয় আরোগ্যম অর্থাৎ আরোগ্যলাভই সংসারের শ্রেষ্ঠ লাভ।
সেদিন ঠাকুরদাস মিশ্ৰ হেসেছিলেন। বলেছিলেন শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না জগ। তা সে গঙ্গার চরের নালতের শাক হলেও না। ও তোর ধম্মপুত্ত যুধিষ্ঠিরের সংস্কৃত শোলোকেও কবরেজদের টাকার লাভের হিসেব ধরা পড়বে না। কথা শেষ করে জগদ্বন্ধুকে বেশ এক হাত নেওয়ার আনন্দে হো-হো করে হেসেছিলেন তিনি। কিন্তু কিছুদিন পরই হঠাৎ বাত-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মাস তিনেক পঙ্গু হয়ে থেকে ওই জগদ্বন্ধু মশায়ের চিকিৎসাতেই আরোগ্যলাভ করে। বলেছিলেন—তুই ভাই আমাকে জীবন দান করলি, তুই জেনে রাখিস ভাই যে, যদি কোনোদিন। দরকার হয় আমি তোর জন্যে জীবন দেব।
হেসে জগদ্বন্ধু মশায় বলেছিলেন—তা হলে—লাভানাং শ্ৰেয় আরোগ্যম্-কথাটা স্বীকার করলি আজ?
মিশ্ৰ হেসেই বলেছিলেন–হ্যাঁ, তা করলাম।
পরদিন মিশ্র নিজে জগদ্বন্ধু মশায়ের আরোগ্য-নিকেতনে এসে একটা কাঠির ডগায় ন্যাকড়া জড়িয়ে তেল-সিঁদুরের লালরঙে নিজের হাতে দেওয়ালে মোটা হরফে লিখে দিয়েছিলেন লাভানাং শ্ৰেয় আরোগ্যম্।
আরোগ্য-নিকেতন নামকরণ তখন হয় নাই। তখন এ অঞ্চলের লোকেদের কতক বলত মশায়ের হোথা, কতক বলত–মশায়ের কোবরেজখানা।
আরোগ্য-নিকেতন নামকরণ হয়েছিল পুরুষান্তরে জগদ্বন্ধু মশায়ের ছেলে জীবন মশায়ের আমলে। তখন কালান্তর ঘটেছে। একটি নতুন কাল শুরু হয়েছে। দেশের কেন্দ্রস্থল নগরে নগরে তার অনেক আগে শুরু হলেও এ অঞ্চলে তখন তার প্রারম্ভ। জীবন মশায় তাদের চিকিৎসালয়ের নামকরণ করে বড় একটি কাঠের ফালির উপর কালো হরফে আরোগ্য-নিকেতন নাম লিখে বারান্দার সামনে টাঙিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়—জগদ্বন্ধু মশায় যে ঘরখানি করেছিলেন সে ঘরেরও অনেক অদলবদল করেছিলেন। তক্তপোশর উপর ফরাসের ব্যবস্থা যথাযথ রেখে তার সঙ্গে চেয়ার টেবিল বেঞ্চি জুড়ে দিয়েছিলেন।
আজও দেখতে পাবেন। নড়বড়ে টেবিল, হাতলভাঙা চেয়ার এখনও আছে। বেঞ্চিখানা শক্ত। সেটা আজও নড়ে না।
আরোগ্য-নিকেতনের জীৰ্ণ পতনোন্মুখ ঘরখানিওই নাম লেখা কাঠের ফলক—এমনকি জীবনবন্ধু মশায়কেও দেখতে পাবেন, সেখানে গেলে।
যাবেন, মহানগরী থেকে শতাধিক মাইল। চলে যাবেন বড় লাইনের ট্রেনে … জংশনে নেমে পাবেন একটি অপরিসর শাখা-রেলপথ। মাইল দশেক গিয়ে পাবেন একটি সমৃদ্ধ গ্রামের স্টেশন। চারিদিকে দেখতে পাবেন কালান্তরের সুস্পষ্ট পরিচয়। দেখতে পাবেন একখানা ট্যাক্সি, একখানা মোটর বাস, সাইকেল রিকশা, গরুর গাড়ি। স্টেশন থেকে এই আরোগ্য-নিকেতন দূর পথ নয়, সামান্য পথ, এক মাইলের কিছু উপর প্রয়োজন হলে গরুর গাড়ি একখানা নেবেন। কিংবা সাইকেল রিকশা। কিন্তু তার চেয়ে হেঁটে যাওয়াই ভাল। দেখতে পাবেন ভাঙাগড়ায় বিচিত্র গ্রামখানিতে পুরাতন-নূতনের সমাবেশ।
পাকা লাল কাঁকরে তৈরি সড়ক ধরে যাবেন। দেখবেন প্রাচীন কালের জমিদারদের বড় বড় নোনাধরা পাকা বাড়ি। ভাঙা বাগান। ধসেপড়া পাঁচিল। শ্যাওলা-পড়া মন্দির। পুকুরের ভাঙা ঘাট। পুরনো মন্দির। চারিদিকেই দেখবেন ধূলি-ধূসরতা; আবর্জনার স্তুপ। পতিত জায়গায় আগাছার জঙ্গল। এরই মধ্যে এক জায়গায় পাবেন এক পুরনো বৃদ্ধ বট; শাখা-প্রশাখা জীর্ণ; গোড়াটা বাঁধানো; তাতেও দেখবেন অনেক ফাটল। এটি গ্রামের ষষ্ঠীতলা। এর পরই এই রাস্তাটি শেষ হয়েছে, মিশেছে প্রশস্ত একটি পাকা সড়কের সঙ্গে। লাল মাটি ও মুড়ি জমানো রাস্তা, রাস্তার দুপাশে দোকান। এইটিই হল বাজারপাড়া। প্রাণস্পন্দনে মুখরিত। মাল-বোঝাই গরুর গাড়ির সারি চলেছে, মানুষ চলেছে, কোলাহল উঠছে, গন্ধও এখানকার বিচিত্র। বাজারটা দিন দিন বেড়ে চলেছে। চা-মিষ্টানের দোকান পাবেন; ক্ষুধা তৃষ্ণা অনুভব করলে এখানে ঢুকে। পড়বেন। নবগ্রাম মেডিকেল স্টোর্সের পাশেই আছে সবচেয়ে ভাল চা-মিষ্টির দোকান। খুব খুঁজতে হবে না, নবগ্রাম মেডিকেল স্টোর্সের ঝকঝকে বাড়ি, আসবাব, বহু বর্ণে বিচিত্র বিভিন্ন ওষুধের বিজ্ঞাপন আপনার দৃষ্টি অবশ্যই আকর্ষণ করবে। বুশশার্ট-প্যান্ট-পরা হরেন ডাক্তারকে গলায় স্টেথোসকোপ ঝুলিয়ে বসে থাকতেও দেখতে পাবেন। ভাল চায়ের দোকানটা ঠিক এর পাশেই।
এখান থেকেই আবার উত্তরমুখী একটি শাখাপথ পাবেন। রাস্তাটি খুব পরিসর নয়; একখানি গাড়ি যায়, দুপাশে দুসারি তোক বেশ স্বচ্ছন্দে চলতে পারে।
একটু, বোধহয় সিকি মাইল, চলবেন ছায়াচ্ছন্নতার মধ্য দিয়ে; দুপাশে চার-পাঁচটি পুষ্করিণী। পুষ্করিণীর পাড়ের উপর আম, জাম, শিরীষ, তেঁতুলের গাছগুলি দুপাশ থেকে পল্লব বিস্তার করে পথটিতে ছায়া ফেলেছে। একটি পুকুরে একটি ছোট বাধা ঘাট পাবেন। এখান থেকে বের হলেই পাবেন উন্মুক্ত প্রান্তর। এখানে দেখবেন বিচিত্র দৃশ্য। নতুন বাড়িঘর, একেবারে নতুন কালের ফ্যাশন, নতুন কালের ইঞ্জিনিয়ারিঙের নিদর্শন। ক্যানেল আপিস তৈরি হয়ে গেছে। আশেপাশে ছোট ছোট কোয়ার্টার। এ দিকে নতুন ক্যানেল তৈরি হচ্ছে। এর পরই পাবেন আর একদফা বাড়ির সারি; গুটিকয়েক ছোট ইমারতকে ঘিরে বড় বড় ইমারত তৈরি চলেছে। চারিদিকে ভারা বাধা, রাজমজুর খাটছে, মজুরনীরা গান গাইছে আর ছাদ পিটছে। হ্যাটকোট-প্যান্ট-পরা ইঞ্জিনিয়ার ঘুরছে সাইকেল হাতে নিয়ে। ওই ছোট বাড়িগুলি এখানকার হাসপাতাল। ছোট হাসপাতালটি, ডাক্তার-কম্পাউন্ডারের ছোটখাটো দুটি কোয়ার্টার; আরও ছোট কয়েকটি কাচাবাড়ির বাসা, এখানে থাকে নার্সেরা। একটু দূরে একটি ছোট ঘর দেখবেন সেটি মোতিয়া ডোমের বাড়ি। আর ওই অর্ধসমাপ্ত বড় ইমারতটিওটিও হাসপাতালের ইমারত, এ অঞ্চলের স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি হচ্ছে।
এসব দেখে থমকে দাঁড়াবেন না। নতুন গঠনের মধ্যে আশা আছে, ভবিষ্যৎ গড়ছেসুতরাং মনে মোহের সঞ্চার হবে, স্বপ্ন জেগে উঠবে মনশ্চক্ষুর সম্মুখে; সেই স্বপ্নে ভোর হয়ে পড়বেন, আরোগ্য-নিকেতন পর্যন্ত যেতে আর মন উঠবে না।
চলে যাবেন এগিয়ে, এইসব নতুন কালের ঝকঝকে ইমারতগুলিকে বায়ে রেখে চলে যাবেন। আরও মাইলখানেক পথ যেতে হবে। দুধারে শস্যক্ষেত্র; মাঝখানে লাল কাকর-দেওয়া ওই একখানি গরুর গাড়ি যাওয়ার মতো আঁকাবাকা পথটি। মাইলখানেক পর গ্রাম দেবীপুর; এই গ্রামেই আছে পুরাতন আরোগ্য-নিকেতন।
শ্ৰীহীন গ্রাম দেবীপুর, দারিদ্র্যের ভারেই শুধু নিপীড়িত নয়, কালের জীৰ্ণতাও তাকে জীর্ণ করে তুলেছে। লক্ষ্য করে দেখবেন গ্রামের বসতির উপরে যে গাছগুলি মাথা তুলে পল্লব বিস্তার করে রয়েছে তার অধিকাংশই প্রবীণ প্রাচীন, নতুন গাছের লাবণ্যময় শোভা কদাচিৎ চোখে পড়বে। জীবনের নবীনতার ধ্বজা হল নতুন সতেজ গাছের শ্যাম-শোভা। প্রথমেই চোখে পড়বে—ঝড়ে—শুয়ে-পড়া শূন্যগর্ভ বকুলগাছতলায় ধর্মঠাকুরের আটন। তার পরেই পাবেন। একটি কামারশালা; অবশ্য কামারশালাটির অস্তিত্ব অনেক আগে থেকেই অনুভব করবেন আপনি। কামারশালার ঠং-ঠং শব্দ দেবীপুরের দক্ষিণে–এই নতুনকালের বসতি স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে উঠছে যে প্রান্তরে—সেই প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। ইমারতের দেওয়ালে প্রতিধ্বনি তুলছে।
কামারশালে দেখবেন চাষীদের ভিড়, গলিত লোহার ফুলকি। তারপরই গ্রম শুরু। শান্ত ছোট গ্রাম। বাঁশের বনে শিরীষগাছের মাথায় পাখি ডাকে। নানা ধরনের পাখি।
কুহু কুহু-কুহু!
চোখ গেল! চোখ গেল!
কৃষ্ণ কো-থা হে!
বউ কথা কও!
কা-কা-কা! ক-ক্ ক-ক্ ক-ক্!
মধ্যে মধ্যে বড় অর্জুনগাছের মাথার উপরে ছিল ডেকে ওঠে–চি-লো! চি-লো! পথের উপর শালিকের ঝাকের কলহ-কলরব–ক্যা-ক্যা করকর কিচিরমিচির কটকট কটকট তারপরই লেগে যায় ঝাপটাঝাপটি।
মানুষের দেখা পাবেন কদাচিৎ। যা দু-একজন পাবেন তারা দেহে জীর্ণ, মনে ক্লান্ত, দৃষ্টিতে সন্দিগ্ধ। আপনাকে দেখেও কথা বলবে না। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে যাবে, কিছুদূর গিয়ে পিছন ফিরে আবার তাকাবে। কে? বামপন্থী না দক্ষিণপন্থী? ভোট চায়? না চাঁদা?
সেকালে অর্থাৎ যখন আরোগ্য-নিকেতন প্রথম স্থাপিত হয়েছিল তখন ধারা ছিল অন্যরকম। দেশের অবস্থাও ছিল আর-এক রকম। গোলায় ধান ছিল, গোয়ালে গাই ছিল, ভাঁড়ারে গুড় ছিল, পুকুরে মাছ ছিল। লোক এক হাতে পেট পুরে খেত—দু হাতে প্রাণপণে খাটত। দেহে ছিল শক্তি, মনে ছিল আনন্দ। সে মানুষেরাই ছিল আলাদা। একালের মত জামা জুতো পরত না; হাঁটু পর্যন্ত কাপড় পরে অনাবৃত প্রশস্ত বক্ষ দুলিয়ে চলে যেত। ধবধবে কাপড় জামা চকচকে জুতোপরা আপনাকে দেখলে হেঁট হয়ে নমস্কার করে বলত কোথা থেকে আসা হচ্ছে বাবুমহাশয়ের? কোথায় যাওয়া হবে প্ৰভু?
আপনি বলতেন—আরোগ্য-নিকেতন।
—ওঃ! তা নইলে আপনাদের মত মনুষ্য আর কোথা যাবেন ই গেরামে। তা চলে যান। ওই সামনেই দেখছেনমা কালীর থান, বায়ে চন্দ মশায়ের লটকোনের দোকান-ডাইনে ভাঙবেন—দেখবেন বাঁধানো কুয়ো; সরকারি কুয়ো, তার পাশেই জীবন মশায়ের কবরেখানা, অর্থাৎ আরোগ্য-নিকেতন। লোকে লোকারণ্য। গাড়ির সারি লেগে আছে। চলে যান।
আজ কিন্তু সেখানে মানুষজন পাবেন না। লোকারণ্য কথাটা আজ অবিশ্বাস্য, এমনকি হাস্যকর বলেই মনে হবে। সকালের দিকে দুজন বড়জোর ছ-সাত জন রোগী আসে, হাত দেখিয়ে চলে যায়; আরোগ্য-নিকেতনে আজ আর কোনো ওষুধ পাওয়া যায় না; ওষুধের। আলমারিগুলি খালি পড়ে আছে। বার্নিশ চটে গেছে, ধুলোয় সমাচ্ছন্ন। দুটো-তিনটের কজা ছেড়ে গেছে। যারা হাত দেখাতে আসে তারা হাত দেখিয়ে ওষুধ লিখে নিয়ে চলে যায়, তারপর বাকি সময়টা স্থানটা প্রায় খাঁখাঁ করে।
অপরাহ্নের দিকে গেলে দেখতে পাবেন জীবনবন্ধু মশায় একা বসে আছেন। দেখতে পাবেন। উত্তর-দক্ষিণে প্রায় পঁচিশ হাত লম্বা একখানা খোড়ো কোঠাঘর। প্রস্থে আট-দশ হাত। সামনে একটি সিমেন্ট-করা বারান্দা, সেটা এখন ফেটে প্রায় ফুটিফাটা হয়ে গিয়েছে, মধ্যে মধ্যে খোয়াও উঠে গিয়েছে, তিন পাশের স্বল্পগভীর ইটের ভিত ঠাঁই ঠাঁই বসে গিয়েছে। ধুলো জমে আছে চারিদিকে। শুধু বারান্দার দুই কোণে দুটি রক্তকরবীর গাছ সতেজ সমারোহে অজস্র লাল ফুলে সমৃদ্ধ হয়ে বাতাসে দুলছে। ওই গাছ দুটির দিকে চেয়ে বসে আছেন বৃদ্ধ মশায়। প্রায় সত্তর বছর। বয়স;—স্থবির, ধূলিধূসর,দিক-হস্তীর মত প্রাচীন। এককালের বিশাল দেহের কাঠামো কুঞ্চিত দেহচর্মে ঢাকা; বক্ষপঞ্জর প্রকট হয়ে পড়েছে, মোটা মোটা হাততেমনি দুখানি পা, সামনে দেখবেন প্রকাণ্ড আকারের অতিজীর্ণ একজোড়া জুতো, পরনে থান-ধুতি-তাও সেলাই-করা; শোভা শুধু শুভ্ৰ গজদন্তের মত পাকা দাড়ি-গোঁফ; মাথার চুলও সাদা—কিন্তু খাটো করে ছাঁটা।
পুরনো আমলের একখানা খাটো-পায়া শক্ত তক্তপোশের উপর ছেঁড়া শতরঞ্জি বিছিয়ে বসে থাকেন। ফুলে-ভরা গাছ দুটির দিকে চেয়ে শুধু ভাবেন নানা ভাবনা। বিচিত্র এবং বহুবিধ।
ভাবেন-মানুষের চেয়ে গাছের আয়ু কত বেশি! ওই করবীর কলম দুটি তার বাবা লাগিয়েছিলেন—সে প্রায় ষাট বৎসর হল! আজও গাছ দুটির জীবনে এতটুকু জীৰ্ণতা আসে নাই।
ভাবনায় ছেদ পড়ে যায় তাঁর। কে যেন কোথায় অস্বাভাবিক বিকৃতস্বরে কী যেন বলছে। চারিদিকে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পান না। পরক্ষণেই হাসেন তিনি। হাটকুড়ো জেলের পোষা শালিক পাখিটা আশেপাশে কোনো গাছে বসে আছে, গাছতলায় পথে কাউকে যেতে দেখে কথা বলছে। বলছে-মাছ নাই! মাছ নাই! মাছ নাই!
পাখিটা সাধারণ পাখি থেকে খানিকটা ব্যতিক্রম। পোষমানা পাখিছাড়া পেয়ে উড়ে গেলে। আর ফেরে না। প্রথম প্রথম বাড়ির কাছে আসে–উড়ে বেড়ায়–চালে বসে–উঠানেও নামে কিন্তু খাঁচাতে আর ঢোকে না। এ পাখিটা কিন্তু ব্যতিক্রম। ওকে সকালে ঘঁচা খুলে ছেড়ে দেয়, পাখিটা উড়ে যায়, আবার সন্ধ্যার সময় ঠিক ফিরে আসে। খাঁচার দরজা খোলা থাকলে একেবারে খাঁচায় ঢুকে পড়ে। না থাকলে–খাঁচার উপর বসে ডাকে–মা-মা-মা! বুড়ো, বুড়ো, অ-বুড়ো!
বুড়ো হল হাটকুড়ো জেলে। হাইকুড়োর স্ত্রী ওকে বুড়ো বলে ডাকে। সেইটা পাখিটা শিখেছে। ওই পাখিটা বোধহয় কাছেই কোথাও বসেছে, জীবন দত্তকেই দেখে ডেকে কথা বলছে। মানুষের দর্শনে পাখিটা জীবনে সাৰ্থকতা লাভ করেছে। অন্তত লোকে তাই বলে। বলে পূর্বজন্মের সাধনা কিছু আছে। কেউ বলে—মানুষই ছিল পূর্বজন্মে, কোনো কারণে শাপগ্রস্ত হয়ে পক্ষী হয়ে জন্মেছে।
জীবন মশায় দাড়িতে হাত বোলান। সঙ্গে সঙ্গে হাসেন। জীবন জন্মান্তর সম্পর্কে বিশ্বাস এ যুগে উলটে-পালটে গেল। তাই তিনি কোনো ভাবনাই ভাবেন না। ঘন ঘন হাত বোলান। তিনি দাড়িতে। এক-একবার খুব ছোট করে ছাটা মাথার চুলের উপর হাত বোলান, বেশ লাগে। হাতের তালুতে সুড়সুড়ি লাগে।
সঙ্গে সঙ্গে ভাবেন, মুখুজ্জে তো এখনও এল না!
সে এলে যে দাবা নিয়ে বসা যায়। কালসমুদ্রের খানিকটা অন্তত রশিখানেক কাগজের নৌকায় পরমানন্দে অতিক্রম করা যায়। সেদিন শ্রাবণের অপরাহ্ব। মশায় পথের দিকে মুখ তুলে তাকালেন। আকাশে মেঘ জমে রয়েছে। ঘুনি-ঘুনি বৃষ্টি পড়ছে, উতলা হাওয়া বইছে; অপরাহ্লােই ছায়া এমন গাঢ় হয়েছে যে সন্ধ্যা আসন্ন মনে হচ্ছে। কিন্তু সেতাবের সাদা-ছাউনি-দেওয়া ছাতা এর মধ্যে বেশ দেখা যাবে; বয়স হলেও জীবন মশায়ের চোখ বেশ তাজা আছে। ইদানীং সুচে সুতো পরাতে চশমা সত্ত্বেও একটু কষ্ট হলেও দূরের জিনিস বিশেষ করে কালোর গায়ে সাদা কি সাদার মধ্যে কালো ছাতার মত বড় জিনিস—চিনতে কোনো কষ্ট হয় না তার। দেহ সম্পর্কে ভাল যত্ন নিলে এটুকু দৃষ্টিহানিও বোধহয় হত না। সেতাবের দেহও ভাল আছে। মধ্যে মধ্যে সেতাবের নাড়ি তিনি পরীক্ষা করে দেখেন। বুড়োর যেতে এখনও দেরি আছে। নাড়ির গতি কী?
জীবন মশায়, নাড়ির মধ্যে, কালের পদধ্বনি অনুভব করতে পারেন। এটি তার পিতৃপিতামহের বংশগত সম্পদ। তাঁরা ছিলেন কবিরাজ। তিনি প্রথম ডাক্তার হয়েছেন।
কবিরাজি অবশ্যই জানেন। প্রয়োজনে দুই মতেই চিকিৎসা করে থাকেন। তবে এই নাড়ি দেখাই তাঁর বিশেষত্ব। নাড়ির স্পন্দনের মধ্যে রোগাক্রান্ত জীবনের পদক্ষেপ থেকে রোগীর রোগের স্বরূপ এবং কালের দ্বারা আক্রান্ত জীবনের পদক্ষেপ থেকে কাল কতদূরে তাও তিনি বুঝতে পারেন।
নিদান হকায় জীবন মশায়ের নাম ছিল—আজও আছে।
নাড়ি দেখে বহুজনের মৃত্যু তিনি পূর্বাহ্নেই ঘোষণা করেছেন তার চিকিৎসক জীবনে। একের পর এক রোগীর কথা পলকে পলকে মনে উঠে মিলিয়ে যায়। এই মনে পড়াটার গতি অতি অস্বাভাবিক রকমের দ্রুত। থেমে গেল এক জায়গায়। সুরেন মিশ্রের ছোট ছেলে শশাঙ্কের মৃত্যু ঘোষণার কথায়। মনে পড়ল শশাঙ্কের ষোড়শী বধূর সেই বিচিত্র দৃষ্টি; তার সেই মর্মান্তিক কথাগুলি।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন তিনি।
কত মৃত্যু, কত কান্না, কত নীরব মর্মান্তিক শোক তিনি দেখেছেন। রোগীর জীবনান্ত ঘটেছে–তিনি ভারী পায়ে স্থির পদক্ষেপে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা তিনি করেছেন, কিন্তু জেনেই যে, চেষ্টা ব্যর্থ হবে। মনকে প্রস্তুত রেখে করেছেন; এমন রোগীর বাড়ি থেকে চলে আসতেন—ভাবতে ভাবতেই পথ চলতেন। তখন পথে অতি অন্তরঙ্গ-জনও চোখে পড়ত না। রোগের কথা, চিকিৎসার কথা ভাবতেন; কখনও কখনও মৃত্যুর কথাও ভাবতেন। মশায়ের ভাবমগ্ন চিত্ত তখন বিশ্বলোক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাতার পর পাতা উলটে যেত। তাই বাইরের দৃষ্টিপথে মানুষ পড়েও পড়ত না। বহু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে দূরের গ্রামে, রোগীর মৃত্যুর পর বাধ্য হয়েই সেখানে প্রতীক্ষা করতে হত; শোকবিহ্বল পরিবারটির মধ্যে বসে থাকতেন অঞ্চল হয়ে, গুমটে ভরা বায়ুপ্রবাহহীন গ্রীষ্ম-অপরাহ্নের স্থির বনস্পতির মত। লোকে এইসব দেখে ডাক্তারদের বলে থাকে-ওরা পাথর। খুব মিথ্যে বলে না তারা। পাথর খানিকটা বটে ডাক্তারেরা। মৃত্যু এবং শোেক দেখে চঞ্চল হবার মত মনের বেদনাবোধও নষ্ট হয়ে যায়। মনে ঘটা পড়ে; সাড় হারিয়ে যায়। শশাঙ্কের মৃত্যু-রোগে মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ঘোষণা করতে গিয়ে আঘাত তিনি পেয়েছেন কিন্তু চিকিৎসকের কর্মে কর্তব্যে ত্রুটি তিনি করেন নি। তাঁর নিজের পুত্র–।
আবার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বিষণ্ণ হাসি হাসলেন। নিজের পুত্রের হাত দেখেও তিনি তার মৃত্যু ঘোষণা করেছিলেন। তিন মাস আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। একথা তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন। ছেলে ছিল ডাক্তার, তাকেও ইঙ্গিতে বুঝিয়েছিলেন। আজ ভাবেন–কেন বলেছিলেন এ কথা?
চিকিৎসাবিদ্যায় পারঙ্গমতার দম্ভে।
তাই যদি না হবে, সত্যকে ঘোষণা করে মনের কোণে আজও এমন বেদনা অনুশোচনা সঞ্চিত হয়ে রয়েছে কেন? ওই স্মৃতি মনের মধ্যে জেগে উঠলেই একটি ছি-ছি-কার সশব্দে মৰ্মস্থল থেকে বেরিয়ে আসে কেন? পরমানন্দ মাধবকে মনে পড়ে না কেন? উদাস দৃষ্টি তুলে মশায় তাকিয়ে থাকেন আকাশের নীলের দিকে। অথচ জানাতে হয়, বলতে হয়। তার বিধি আছে। চিকিৎসকের কর্তব্য সেটা। তার ক্ষেত্র আছে।
০১. উনিশশো পঞ্চাশ সাল–বাংলা তেরশো ছাপ্পান্ন
উনিশশো পঞ্চাশ সাল–বাংলা তেরশো ছাপ্পান্ন সালের এক শ্রাবণ-অপরাহ্নে জীবন মশায় এমনি করেই তাকিয়ে ছিলেন আকাশের দিকে। পথের উপর থেকে কেউ যেন তাকে ডাকলে।
–প্ৰণাম গো, ডাক্তার জ্যেঠা।
–কে? মতি! কোথায় যাবি রে?
মতি কর্মকার কয়লার ধুলোমাখা আটহাতি কাপড়খানা পরেই কোথায় হনহন করে চলেছে। গোষ্ঠ কর্মকারের ছেলে মতি। গোষ্ঠ ডাক্তারকে বড় ভক্তি করত। ডাক্তারও তাকে ভালবাসতেন। গোষ্ঠ অনেকগুলি ওষুধ জানত। সন্ন্যাসীদত্ত ওষুধ। রঘুবর ভারতী ছিলেন বড়দরের যোগী। এসব ওষুধ তার কাছ থেকে পেয়েছিল সে। ডাক্তারকে গোষ্ঠ ওষুধগুলি দিতে চেয়েছিল। ডাক্তার নেন। নি। তবে অনেক রোগীকে তিনি পাঠিয়ে দিতেন গোষ্ঠের কাছে। বিশেষ করে দুদিন অন্তর জ্বরের জন্য। বড় পাজি জ্বর ওটা। পালাজ্বর অর্থাৎ একদিন অন্তর জ্বর—তবু ওষুধ মানে। কিন্তু ওই দুদিন অন্তর জ্বর ও ওষুধ মানে না। মানাতে অন্তত দীর্ঘদিন লাগে। কুইনিন ইনজেকশনও মানতে চায় না। অথচ ওই রঘুবর ভারতীর ওষুধে একদিনেই বন্ধ হয়ে যাবে। আগে গোষ্ঠ দিত, এখন মতিই দেয়, জ্বরের নির্দিষ্ট দিনে একটা হলুদমাখা ন্যাকড়ায় একটা জলজ গাছের পাতা কচলে রস বার করে বেঁধে শুকতে দেয়। তাতেই জ্বর বন্ধ হয়। হবেই বন্ধ। বিচিত্র দ্ৰব্যগুণ রহস্য! অতি বিচিত্র। এই রোগী পাঠানো নিয়েই গোষ্ঠের সঙ্গে ডাক্তারের তরঙ্গতা হয়েছিল। এদেশের সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা চিকিৎসা-প্রণালী প্রচলিত ছিল বিস্ময়কর ফলপ্রদ চিকিৎসায় একবার তার ইচ্ছা হয়েছিল এই চিকিৎসা-প্রণালী জান পর, কিন্তু—হুঁ। কিন্তু তাঁর গুরুর নিষেধ ছিল। তিনি বলেছিলেন ডাক্তারি যখন শিখেছ, তখন ওদিকে যেয়ো না। যার গুণ বিজ্ঞানসম্মতভাবে জান না, তাকে প্রয়োগ কোরো না।
মতি কর্মকার বললে—একবার আপনার কাছেই এলাম জ্যেঠা।
বাঁচলেন মশায়। একজন কথা বলবার লোকের জন্য তিনি অধীর হয়ে উঠেছিলেন। এবার তক্তপোশে ভাল করে বসলেন তিনি, পুরনো তাকিয়াটাকে টেনে নিয়ে বললেন–আয় আয়। বোস। কী খবর বল?
—একবার আমার বাড়িতে যেতে হবে।
–কেন?
–মাকে একবার দেখতে হবে।
–কী হল মায়ের?
–আজ্ঞে, মাসখানেক হবে, পুকুরঘাটে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল, তাপরেতে খুবই বেদনা হয়, নিয়ে গিয়েছিলাম হাসপাতালে। তখন দেখে বেঁধেছেদে ছেড়ে দিয়েছিল, বলেছিল,–দিনকতক ওঠাহাঁটা কোরো না, সেরে যাবে। তাই গিয়েও ছিল। কিন্তু আবার আজ দিন আষ্টেক হল বেদনাটা চাগিয়ে উঠেছে; দিনরাত কনকন করছে। আবার নিয়ে গেলাম হাসপাতাল বললে, এক্স-রে করতে হবে, সে না হলে কিছু বলতে পারবে না। তা—সে তো অনেক খরচ–অনেক ঝাট! তাই বলি, যাই জ্যেঠার কাছে।
হাসলেন জীবন মশায়। বেচারি মতি! বুড়ো মা গলায় কাঁটার মত লেগেছে। মায়ের উপর মতির গভীর ভালবাসা। মায়ের প্রতি তার এই ভুক্তির জন্য লোকে বুড়ো খোকা বলে। মায়ের কষ্টও সে দেখতে পারছে না-আবার এক্স-রে করানোও তার পক্ষে অনেক ঝাট। অগত্যা। এসেছে তার কাছে। তা বেশ কাল সকালে যাব।
–আজ্ঞে না, একবার চলুন এখুনি। বুড়ি চিৎকার করছে আর গালাগাল করছে আমাকে। বলছে, নিজের মেয়ে হলে এমনি অচিকিৎসেতে ফেলে রাখতে পারতিস?
বলতে বলতে খানিকটা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল মতি। বললে—সারা জীবন মায়ের অযত্ন করি নাই, আজ মা আমাকে–কেঁদে ফেললে মতি।
ডাক্তার বললেন, চল হবে। দেখে আসি।
খালি গায়েই বেরিয়ে পড়লেন মশায়। মতি ব্যস্ত হয়ে বললে—আপনার ছাতা?
–ছাতা লাগবে না, চল। এই ফিনফিনে জলে—এতে ছাতা লাগে না। ভারী পায়ে ডাক্তার হটেন; গতি একটু মন্থর। মতি ছুটে চলে গেল।–আমি যাই জ্যেঠা, বাড়িতে খবরটা দিই গে।
—যা।
এগিয়ে গিয়ে মতি বাড়িটা একটু পরিষ্কার করে ফেলবে। ছেলেপুলেগুলোকে সামলাবে। বোধহয় মতির মা ময়লা ছেঁড়া কাপড় পরে আছে, সেখানা পালটে তাড়াতাড়ি একখানা ফরসা কাপড় পরাবে। ডাক্তারের অজানা তো কিছু নাই।
বাড়ির দোরে গিয়ে গলা ঝাড়লেন ডাক্তার। তারপর ডাকলেন–মতি!
মতি সাড়া দিলে—আজ্ঞে, এই যাই।
তার মানে–আরও খানিকটা অপেক্ষা করুন ডাক্তার জ্যেঠা। এখনও প্রস্তুত হতে পারি নাই। দাঁড়ালেন ডাক্তার, ভালই হল, বরাবর সামনে দেখা যাচ্ছে সোজা কাঁচা সড়কটা। এই পথেই সাদা কাপড়ের ছাউনি দেওয়া ছাতা মাথায় দিয়ে আসবে সেতাব মুখুজ্জে। এক হাতে ছাতা, অন্য হাতে নেভানো লণ্ঠন আর দাবার পুঁটুলি। কিন্তু কই সেতাব?
মতি ডাকলে—আসুন জ্যেঠা।
বৃদ্ধা কাতর হয়ে পড়েছে। মতি ঠিক বলেছে—জেরবার হয়ে পড়েছে বুড়ি। হাঁটুটা ফুলেছে। স্ফীত স্থানটার উপর হাত দিলেন ডাক্তার। রোগী কাতরে উঠল, ডাক্তার চমকে উঠলেন। জ্বরও হয়েছে যেন! হটু থেকে হাত তুলে বললেন–হাতটা দেখি।
নাড়ি ধরে বসলেন ডাক্তার।
–জ্বর কবে থেকে হল?
মতি বললে—জ্বর তো হয় নাই জ্যেঠা।
–হয়েছে। নাড়ি দেখতে দেখতেই বললেন– ডাক্তার।
মতির মা ঘোমটার ভিতর থেকেই ফিসফিস করে বললেও বেথার তাড়সে গা খানিক জ্বর-জ্বর করছে। বেথা সারলেই ও সেরে যাবে।
–হ্যাঁ, ব্যথা সারলেই জ্বর সারবে, জ্বর সারলেই ব্যথা সারবে।
–না-না, জ্বরের ওষুধ আমি খাব না। জ্বর আমার আপনি সারবে। আপুনি আমাকে পায়ের বেদনার ওষুধ দেন। জ্বরের চিকিৎসের দরকার নাই। ও কিছু নয়। কুনিয়ান খেতে নারব–ফোঁড় নিতেও নারব। ওপোস দিতে–বুড়ি থেমে গেল। না খেয়ে থাকতে পারব না বলতে বোধ করি লজ্জা পেল।
ডাক্তার হেসে বললেন–উপোস তোমাকে করতে হবে না। সে আমি বলব না তোমাকে। তুমি তো আমার আজকের রোগী ও গো। নতুন বই থেকে তোমাকে দেখছি আমি। সেবার পুরনো জ্বরসে তো আমিই সারিয়েছিলাম। গোষ্ঠ আমার কাছে কবুল খেযেছিল। রাতদুপুরে হেঁসেল থেকে মাছ ভাত বের করে তোমাকে খাওয়াত সে। সে আমি জানি। তাতেই আমি তোমার জন্যে পোরের ভাতের ব্যবস্থা দিয়েছিলাম।
হাসতে লাগলেন ডাক্তার।
ঘোমটার মধ্যে জিভ কেটে লজ্জায় স্তব্ধ হয়ে গেল মতির মা। গোষ্ঠ তাকে চুরি করে খাওয়াত না, সে নিজেই চুরি করে খেত। একদিন স্বামীর কাছেই ধরা পড়েছিল। তার পরদিনই গোষ্ঠ ডাক্তারের কাছ থেকে পোরের ভাতের ব্যবস্থা এনেছিল।
ডাক্তার বললেন–তা বল না কী খেতে ইচ্ছে?
চুপ করে রইল মতির মা। এরপর আর কী উত্তর দিতে পারে সে? লজ্জায় তার মাটির মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। ছিঃ ছিঃ ছি!
–বল, লজ্জা কোরো না। যা ইচ্ছে হয় খেয়ো। যা খুশি। মতির দিকে তাকিয়ে বললেন– মায়ের যা খেতে ইচ্ছে খেতে দিবি, বুঝলি?
—আর ওষুধ? শঙ্কিতভাবেই প্রশ্ন করলে মতি। চাপান কি কিছু?
–কিছু না। খেতে দে বুড়িকে ভাল করে। কালীমায়ের স্থানের মৃত্তিকা লাগিয়ে দে। বাস।
মতির মা-ও মাথার ঘোমটা খানিকটা কমিয়ে দিলে। বললে—যাতনায় পরান যে বেরিয়ে যাচ্ছে আমার।
—তবে আগুনের সেঁক। শত বৈদ্য সম অগ্নি, ওর চেয়ে বেদনার আর ওষুধ হয় না। নুনের পুঁটলি করে সেঁক দে। ওতেই যা হয় হবে।
—ওতেই যা হয় হবে? ওষুধ দেবেন না? যা খুশি তাই খাব? আমি তা হলে আর বাঁচব না? পরিপূর্ণভাবে ঘোমটা খুলে মতির মা এবার ডাক্তারকে প্রশ্ন করে নিম্পলক দৃষ্টিতেই তাঁর দিকে চেয়ে রইল। বিচিত্র সে দৃষ্টি! কঠিনতম প্রশ্ন সে দৃষ্টিতে সমুদ্যত হয়ে রয়েছে। জীবনের শেষ প্রশ্ন।
এমন দৃষ্টির সম্মুখে কেউ বোধহয় দাঁড়াতে পারে না। পারে তিন প্রকারের মানুষ। এক পারে বিচারক–যাকে প্রাণদণ্ড দিতে হয়। আসামি যদি তাকে প্রশ্ন করে–আমাকে মরতে হবে?–তবে বিচারক বলতে পারে–হ্যাঁ, হবে।
আর পারে জল্লাদ—যে ওই দণ্ড হাতে তুলে দেয়।
আর পারে চিকিৎসক।
জীবন মশায় সেকালে বলতে পারতেন। অবশ্য প্রবীণ রোগীকেই সাধারণত বলতেন–আর কী করবে বেঁচে? দেখলেও অনেক, শুনলেও অনেক, ভোগ করলেও অনেক, ভুগলেও অনেক। এইবার যারা রইল তাদের রেখে–। প্ৰসন্ন হাসি হাসতেন।
তাঁর বাবা জগৎমশায় শেষটায় বলতেন, গোবিন্দ! গোবিন্দ! হরিনাম কর, ইষ্টনাম কর। নামের তরী বাঁধা ঘাটে।
তাঁর ডাক্তারিবিদ্যার গুরু রঙলাল ডাক্তার ছিলেন বিচিত্র মানুষ। রোগীর সামনে সচরাচর মৃত্যুর কথা বলতেন না। তবে জিজ্ঞাসা করলে বলতেন—Medicine can cure disease but cannot prevent death; বলেই লম্বা পা ফেলে রোগীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতেন।
আজ জীবন ডাক্তার মতির মায়ের দিকে চেয়ে হেসে বললেন–তাতেই বা তোমার দুঃখ কিসের গো? নাতিপুতি ছেলে বউ রেখে ড্যাং ড্যাং করে চলে যাবে। পার তো চলে যাও তীর্থস্থানে।
কথার মাঝখানেই মতি বলে উঠল—এই দেখুন ডাক্তার জ্যেঠা, কী বলছেন দেখুন। হাঁ গো, সে টাকা আমাদের আছে?
—কেন? এই তো দশ ক্ৰোশ পথ, ট্রেনে যাবি, বাড়ি ভাড়া করে রেখে আসবি। কী-ই-বা খরচ? কাটোয়াতে ভিড় বেশি, অনেক পূর্ববঙ্গের লোকজন এসেছে—তার চেয়ে উদ্ধারণপুর ভাল। পাড়াগা-গঙ্গাতীর, সারবার হলে এক মাস গঙ্গার বাতাস গায়ে লাগালেই সব ভাল হয়ে যাবে। নিত্য গঙ্গাস্নান করবে, দেখবি মায়ের নবকলেবর হয়ে যাবে। না হয়–
কথা অসমাপ্ত রেখেই ডাক্তার বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। দাওয়ায় দাঁড়িয়ে হাত দুখানি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন–মতি, জল দে হাতে।
০২. মন খারাপ হল না ডাক্তারের
মন খারাপ হল না ডাক্তারের। মতির মায়ের বয়স হয়েছে, বয়সের অনুপাতে দেহ অনেক বেশি। ভেঙেছে। বাত-জ্বর, পেটের গোলমাল–নানানখানা রোগ তো আছেই। তার উপর এই আঘাতে পায়ের হাড়ে আঘাত লেগেছে। ভেঙেছে। হয়তবা শেষ পর্যন্ত আঘাতের স্থানটা পাকবে। একমাত্র ছেলে, বউ, কয়েকটিই নাতি-পুতি, তা যাক না বুড়ি; এ তো সুখের যাওয়া। বুড়ির যেতে ইচ্ছে নাই। ডাক্তার এক নজরেই বুঝতে পারেন। মৃত্যুর কথা শুনলে চমকে ওঠে না—এমন লোক বোধহয় সংসারে খুব কম। তবু বলেন এই কারণে যে, মানুষের এগিয়ে যাওয়ারও তো সীমা নেই।
বেচারি মতির মা পিছনে পড়ে আছে অন্ধকারের মধ্যে। তাকে দোষ দিতে পারবেন না। ছেলে, বউ, নাতি, নাতনী, ঘর-সংসার–বড় জড়িয়ে পড়েছে বুড়ি।
অন্যহনি ভূতানি গচ্ছতি যমমন্দিরং
শেষাঃ স্থিরত্বমিচ্ছন্তি কিমাশ্চর্যমতঃপরম্।
বুড়ি সেই সনাতন আশ্চর্য হয়ে উঠেছে আজ। কিন্তু যেতে হবে বুড়িকে। আর যাওয়াটাই ওর পক্ষে মঙ্গল। হ্যাঁ মঙ্গল। নইলে দুর্ভোগের আর অন্ত থাকবে না।
জীবন ডাক্তারের দেহখানা খুব ভারী। পা দুটো মাটির উপরে দেহের ওজনে জোরে জোরেই পড়ে। ডাক্তার পথ দিয়েই চলেন-পাশের বাড়ির লোকেরা জানতে পারে ডাক্তার চলেছেন। এই শ্রাবণ মাসের ফিনফিনে বৃষ্টিতে পিছল এবং নরম মেটে রাস্তার উপর সন্তৰ্পণে পা ফেলে চলতে হবে। চোখ রাখতে হবে মাটির উপর। দুটোই ডাক্তারের পক্ষে বিরক্তিজনক। কিন্তু উপায় নাই—পিছল পথে পা ফসকালে অঙ্গ আর থাকবে না। পৃথিবীকে মানুষ বলে মা, সবুজ ঘাসে আর ফসলে ঢাকা দেখে বলে—কোমলাঙ্গী; একবার পড়লেই ভুল ভেঙে যায়। আপন মনেই ডাক্তার হাসেন।
আরে–আরে–আরে! ডাক্তার থেমে গিয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেন। পথের ধারের একটা ডোবার মুখে এই অনাবৃষ্টির বর্ষায় সামান্য পরিমাণে খানিকটা জল জমেছে—দুটো ছেলেতে পরমোৎসাহে তাই হেঁচতে শুরু করেছে। কাদাগগালা জল ছিটিয়ে রাস্তার ওইখানটা। কর্দমাক্ত করে তুলেছে।
ছেলে দুটো থেমে গেল। জীবন মশায় এখানে সর্বজনমান্য।
–কী করছি? হচ্ছে কী?
–মাছ গো। এই এতু বড়ি একটা ল্যাঠা মাছ।
–তুই তো মদন ঘোষের ব্যাটা?
–হি গো, মদনার ব্যাটা বদনা আমি।
ডাক্তার হেসে ফেললেন, বললেন–শুধু মদনার ব্যাটা বদনা? তুই মদনার ব্যাটা—বদনা ঠাটা! পাজির পা-ঝাড়া! উল্লুক!
–ক্যানে? কী করলাম আমি?
–কী করলি? এবার কণ্ঠস্বর স্নিগ্ধ করে ডাক্তার বললেন, এমনি করে বাবার নাম, নিজের নাম বলতে হয়? ছিঃ ছিঃ ছি! বলতে হয়—আজ্ঞে হ্যাঁ, শ্রীমদনলাল ঘোষের ছেলে আমি, আমার নাম শ্ৰীবদনলাল ঘোষ। বুঝলি?
বদন ঘাড় কাত করে মাথাটা কাঁধের উপর ফেলে দিলে। খুব খুশি হয়েছে বদন। ডাক্তার বললেন– আর এটি? এটি কে?
ছেলেটি বেশ সুশ্ৰী। সুন্দর চেহারা। এ গ্রামের বলে মনে হচ্ছে না। ডাক্তারের কথার উত্তরও দিলে না। বদন বললেও আমাদের গায়ে এসেছে। সরকারদের বাড়ি। মামার বাড়ি এসেছে।
–আচ্ছা! অহীন্দ্র সরকারের মেয়ে অতসীর ছেলে?
ছেলেটি ঘাড় নেড়ে দিলে দুবার–হ্যাঁ।
ডাক্তার বললেন––জলে ভিজো না, বাড়ি যাও। সর্দি হবে। জ্বর হবে। মাথা ধরবে।
বদন বললে—আপুনি ভিজছে ক্যানে?
ডাক্তার কৌতুকে সশব্দেই হেসে উঠলেন। বললেন–আমি ডাক্তার রে দুষ্টু। অসুখ আমাকে ভয় করে। যা–বাড়ি যা। চল, আমার সঙ্গে চল।
ছেলে দুটোকে সঙ্গে নিয়েই তিনি ফিরলেন। সেতাব না এসে থাকলে এদের নিয়েই একটু আমোদ করবেন। চলতে চলতে বললেন––-জানিস, আমড়া খেলে অম্বল হয়, অম্বল হলে জ্বর হয়। কিন্তু ডাক্তারেরা খায়। লোককে বলি আমড়া খাই আমরা, লোককে বলি খেয়ো না আমড়া।
আরোগ্য-নিকেতনের বারান্দায় ইতিমধ্যেই সেতাব মুখুজ্জে কখন এসে বসে আছেন। ডাক্তারকে দেখে তিনি বললেন, গিয়েছিলি কোথা? আমি এসে ভাবি গেল কোথায়! নন্দ কি ইন্দির দুজনের একজন পর্যন্ত নাই।
ছেলে দুটোকে ছেড়ে দিয়ে ডাক্তার বললেন, যা—বাড়ি যা তোরা। সেতাবকে বললেন, গিয়েছিলাম মতি কর্মকারের বাড়ি। মতির মায়ের হুকুম এসেছে। বোস, চায়ের জন্য বাড়িতে বলে আসি। কঙ্কের টিকেটা ধরিয়ে দে তুই, ইন্দির বাইরে গিয়েছে।
একেবারে সাত-আটটা কল্কেতে তামাক সাজা আছে। এ ছাড়াও তামাক-টিকে আছে। খাওয়াদাওয়ার পরই নন্দ সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছে। তারপর প্রয়োজনের সময় ইন্দির থাকলে ইন্দির, না থাকলে ডাক্তার বা সেতাব নিজেরাই কেউ দরকারমত কল্কেতে আগুন দিয়ে নেন। এখন দুজনে বসবেন দাবাতে। কতক্ষণ চলবে কে জানে! বাড়িতে ভাত ঢাকা থাকবে। তবু তো আগেকার কালের শক্তি নাই—উৎসাহও নাই।
চায়ের বরাত করে তামাকের টিকে ধরিয়ে নিয়ে দাবায় বসলেন দুজনে। খেলাটা হঠাৎ যেন। জমে উঠল। সেতাবের মন্ত্রীটা ধাঁ করে মেরে বসলেন মশায়। ওদিকে আকাশে মেঘও বেশ জমেছে, বৃষ্টিও বেশ সুর ধরেছে; ঝিপঝিপ করে বৃষ্টি নেমেছে, বৃষ্টি খানিকটা হবে বলে মনে হচ্ছে। নীরবেই খেলা চলছিল, সেতাব মুখুজ্জে বললেন–ভিতরে চল জীবন—গা শিরশির করছে।
–শিরশির করছে? কেন রে? আমার তো বেশ আরাম বোধ হচ্ছে।
–তোমার কথা আলাদা। এত চর্বিতে শীত লাগে কখনো? আমার শরীরটাও ভাল নাই।
–জ্বর হয় নি তো? দেখি হাত?
–না, হাত দেখতে হবে না। ওই তোর বাতিক। আমি নিজেও জানি হাত দেখতে। দেখেছি নাড়ি গরম একটু হয়েছে। ও কিছু নয়; চল ভেতরে চল। সেতাব সরিয়ে নিলেন। হাতখানা।
ডাক্তার কিন্তু ছাড়লেন না, হাত বাড়িয়ে একরকম জোর করে সেতাবের হাতখানা টেনে নিলেন। হ্যাঁ, বেশ উত্তাপ হাতে! কিন্তু নাড়ি অনুভব করার সুযোগ পেলেন না। সেতাব মুখুজ্জে হাতখানাকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করছেন।
—ছাড়, হাত ছাড়, জীবন। হাত ছাড়।
–পাগলামি করিস নে সেতাব। নাড়ি দেখতে দে।
–না। চিৎকার করে উঠলেন সেতাব।
–আরে, হল কী তোর? আরে! বিস্মিত হয়ে গেলেন জীবন ডাক্তার।
–না–না–না। ছেড়ে দে আমার হাত। ছেড়ে দে। ঝটকা মেরে ডাক্তারের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সেতাব উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর নিজের লণ্ঠনটা একপাশে নামানো ছিল। সেটা জ্বালাবার অবকাশও ছিল না; নেভানো লণ্ঠনটা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়লেন দাওয়া থেকে।
—সেতাব, ছাতা, তোর ছাতা।
এবার সেতাব ফিরলেন। ছাতাটি নিয়ে লণ্ঠনটি জ্বালাতে জ্বালাতে বললেন– নিজের নাড়ি দেখ তুই। তুই এইবার যাবি আমি বললাম। লোকের নাড়ি দেখে নিদান হেঁকে বেড়াচ্ছি, নিজের নিদান হাঁক।
সেতাব চলে গেলেন সেই বৃষ্টির মধ্যে।
ডাক্তার চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। সেতার মধ্যে মধ্যে এমনি অকারণে রেগে ওঠেন। অকারণ ঠিক নয়, নিজের চাল ভুল হলে মনে মনে রাগেন নিজের উপরেই, তারপর একটা যে-কোনো ছুতোতে ঝগড়া করে বসেন। উঠেও চলে যান। ফেরানো তাকে যায় না, পরের দিন ডাক্তার যান তার বাড়ি। গেলেই সেতাব বলেন-আয়-আয় বোস। এই যাব বলে উঠেছিলাম আর তুইও এলি।
ডাক্তার একটু হেসে বাড়ির ভিতরে যাবার জন্যে ঘুরলেন; ডাক্তারখানার দরজা বন্ধ করতে গিয়ে কিন্তু থমকে দাঁড়ালেন। আজ সেতাবের রাগটা প্রচ্ছন্ন বিকার নয় তো? উত্তাপে অল্প জ্বর মনে হল। কিন্তু নাড়ি দেখতে তো দিলেন না সেতাব। ঐ দুটি কুঞ্চিত করে তিনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। ভাবছিলেন যাবেন এখুনি সেতাবের বাড়ি।
ফল নেই। তাই যদি হয় তবে সেতাব কিছুতেই তাকে হাত দেখতে দেবেন না, বরং আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠবেন।
আর এই বৃষ্টিতে ভিজে অনিষ্ট? সে যা হবার হয়েছে।
মৃত্যু-রোগের একটা যোগাযোগও আছে, যা বিচিত্র এবং বিস্ময়জনক।
পরের দিন।
সাধারণত ডাক্তার বেশ একটু দেরিতে ওঠেন। আজ কিন্তু উঠলেন সকালেই। সমস্ত রাত্রি ভাল ঘুম হয় নি। সেতাব সম্পর্কেই দুশ্চিন্তা একটা বাতিকের মত তাকে চঞ্চল করে রেখেছিল। কত উদ্ভট চিন্তা। তাঁর অভিজ্ঞতায় যত বিচিত্র রোগলক্ষণ উপসর্গ তার চোখে পড়েছে, তিনি যেন। উপলব্ধি করেছেন সেইসব উপসর্গের লক্ষণ তিনি সেতাবের আচরণের সঙ্গে মিলিয়ে পেয়েছেন। সেদিন। যত দেখেছেন ততই যেন মিলেছে। মনে মনে অনুতাপ হয়েছে, সেতাবকে তিনি জাপটে ধরে জোর করে ঘরে বন্ধ করে রাখলেন না কেন? ওই বৰ্ষণের মধ্যে যেতে দিলেন কেন? প্রচ্ছন্ন বিকার নিয়ে জ্বরই খুব খারাপ, তার উপর এই বর্ষায় ভিজে যদি সর্দিটা প্রবল হয় তবে
যে অসাধ্য হয়ে উঠবে।
বয়স সেতাবের হয়েছে, জীবনে বন্ধনও নাই। বন্ধন বলতে স্ত্রী—কিন্তু সে স্ত্রী এমনই সক্ষম ও আত্মপরায়ণা যে, সেতাবের অভাবে তার বিশেষ অসুবিধা ঘটবে না। সেতাবের অভাব অনুভব করবেন তিনি নিজে। সেতাব না হলে তার দিন কাটে না। তিনি থাকবেন কাকে নিয়ে?
সকালে উঠেই তিনি সেতাবের বাড়ি যাবার জন্যে প্রস্তুত হলেন। ডাক্তার-গ্নিনিও সকালেই ওঠেন। এবং তাঁর বিচিত্র স্বভাবের বিচিত্রতম অংশটুকু এই প্রথম প্রভাতেই আত্মপ্রকাশ করে থাকে। নাম তার দুর্গা। দুৰ্গা প্রভাতে ওঠেন যুদ্ধোদ্যতা দশপ্ৰহরণ ধারিণীর মত। মেজাজ সপ্তমে উঠেই থাকে; সেই মেজাজে বকেঝকে বাড়িটাকে সন্ত্রস্ত করে দিয়ে কিছুক্ষণ পর আশ্চর্যভাবে ধীরস্থির হয়ে আসেন। ডাক্তার দেরিতে ওঠেন যেসব কারণে ওটা তার মধ্যে একটা প্রধান কারণ। গিন্নি স্থির হলে নিশ্চিন্ত হয়ে গাত্রোত্থান করেন তিনি।
ডাক্তার-গিন্নি অনেক আগেই উঠে বাসনমাজা-ঝিকে তিরস্কার করছিলেন, বালি এবং করকরে ছাই দিয়ে বাসন মাজার জন্য। ওতে বাসনের পরমায়ু কতদিন? সংসারে যারা সিদ্ধপুরুষ, মৃত্যু যাদের ইচ্ছাধীন, তাদের মাথায় ডাণ্ডা মারলে তারাও মরতে বাধ্য হন। ও তো নির্জীব কাসার গেলাস। বালি দিয়ে দুবেলা ঘষলে ও আর কতদিন। কাসার দাম যে কত দুমূল্য হয়েছে সেও তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন। ডাক্তার উঠে আসবার সময় কেশে গলা পরিষ্কার করে সাড়া দিয়ে নামলেন। তারপর গম্ভীরভাবে বললেন– আমি বেরুচ্ছি একবার মাঠে। সকালবেলা উঠেই প্রথম কথাটি তাঁকে মিথ্যে বলতে হল। নইলে গিনির দৃষ্টি এবং হুঙ্কার ভস্মলোচন ভস্মকারিণীর মত প্রখর এবং ভীষণ হয়ে উঠবে।
ছাতাটি নিয়ে বেরিয়ে সোজা এসে উঠলেন ওই বড়বাজারের গ্রামখানিতে। সদর রাস্তা থেকে ছোট পথ ধরে সেতাবের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং ডাকলেন।
–সেতাব!
সেতাবও তখন উঠেছেন। ঘরের ভিতর তক্তপোশের উপর বসে তামাক খাচ্ছেন। বাইরে ডাক্তারকে দেখে হেসে বললেন–এসেছিস?
ডাক্তার ঘরে ঢুকে তক্তপোশের উপর বসে বললেন–যাক। জ্বরটর নাই তো? মুখ দেখে মনে হচ্ছে ছেড়ে গিয়েছে।
–সেতাব হাতখানি বাড়িয়ে দিলেন–দেখ।
–দেখব? হাসলেন ডাক্তার।
–দেখ। নিদান একটা হাঁক দেখি। আর তো পারছি না। জীবনে ঘেন্না ধরে গেল।
ডাক্তার হেসে বললেন–তা কাল রাত্রে বুঝেছি। যে রাগ তোর আমার উপর।
সেতাব ওদিক দিয়েই গেলেন না, বললেন, কাল রাত্রে বুড়ি আমাকে যা বলে, সে তোকে কী বলব? এক মুঠো মুড়ি পর্যন্ত খেতে দিলে না রে। বললাম সর্দিতে গা গরম হয়েছে, জীবন আমাকে দুধ-মুড়ি খেতে বলেছে। ঘি-ময়দা থাকলে চারখানা গরম লুচি সব থেকে উত্তম। ঘরে ঘি-ময়দা আছে, বুঝলিজেনেই আমি বলেছিলাম। বাজারে ময়দা মেলে না—আমার জমিতে মন দুই গম হয়েছিল, সে পিষিয়ে ময়দা করিয়ে রেখেছি। বাড়ির দুধ হয়-না হয়-না করেও সের দেড়েক হয়। তার সব সরটুকু জমিয়ে বুড়ি ঘি করে। একদিন সরের মুখ দেখতে পাই না। কালই বিকেলে সর গালিয়েছে রে! তা তোকে কী বলব, আমাকে ন ভূতো ন ভবিষ্যতি, তোর পর্যন্ত বাপান্ত করে ছাড়লে। এই সকালে খিদেতে পেট জ্বলছে খাণ্ডব দাহনের মত।–কী করব–বসে বসে তামাক টানছি। এর চেয়ে যাওয়াই ভাল। কী হবে বেঁচে!
ডাক্তার হাতখানা এবার টেনে নিলেন–স্পর্শমাত্রেই বুঝলেন জ্বর ছেড়ে আসছে। বললেন––জ্বর ছেড়ে আসছে। কাল রাত্রে গিনি খেতে না দিয়ে ভালই করেছে। কয়েক মুহূর্ত নাড়ি পরীক্ষা করে বললেন– আজ সকাল সকাল ঝোল-ভাত খা। এখন বরং চায়ের সঙ্গে কিছু খা। আর জ্বর হবে বলে মনে হচ্ছে না।
–কিছু খা! সেতাব রুস্বরে বলে উঠলেন-–কিছু খা! ঠাকুরসেবা নাই? সে কে করবে?
–কাউকে বল না, করে দেবে।
—দেবে? একালের কোন ব্যাটা এসব জানে, না এতে মতি আছে। আছে এক মুখ্য ভাঙ ওই ঠ্যাঙবাকা চাটুজ্জেদের ছেলে। তা এখন তার কাছে যায় কে? যদি ব্যাটা বুঝতে পারে যে আমি খেয়েছি তবে এক বেলাতেই আট আনা চেয়ে বসবে।
—তাই দিবি। শরীর আগে না পয়সা আগে! খিদেয় তোর পেট জ্বলছে–আমি বুঝতে পারছি, তুই খা। আমি বরং ব্যবস্থা করছি। আমাদের গ্রামের মিশ্রদের কাউকে পাঠিয়ে দোব, বুঝলি? খা তুই, পেট ভরে খা। চায়ের সঙ্গে মুড়ি ফেলে নাশতা কর।
সেতাব এবার চুপিচুপি বললেন–তুই বল না, একটু হালুয়া করে দিক। ময়দা চাললেই সুজি বেরুবে। চিনি অবিশ্যি নাই, তা ভাল গুড় আছে। খেজুরগুড়ের পাটালিও আছে ওর ভাঁড়ারে। বুঝলি, রোজ রাত্রে দুধের সঙ্গে ভাত খায় আর ওই পাটালি বার করে। ভাবে আমি ঘুমিয়ে গিয়েছি। আমি সাড়া দিই না, কিন্তু গন্ধ পাই। বল না ওকে।
ডাক্তার হেসে ফেললেন।
খাওয়ার বিলাসে সেতাব চিরকাল বিলাসী, একটু ভালমন্দ খেতে ভালবাসেন বলে ওঁর স্ত্রী নাম দিয়েছে বালকদাসী। বলে, উনি আমার বালকদাসীভালমন্দ খেতে ভালবাসি। রাম রাম রামজিভখানা কেটে ফেলো গিয়ে না খেলে মানুষ বাঁচে না, খিদে পেলে পৃথিবী অন্ধকার, তাই খাওয়া। তা বলে এটি খাব, ওটি খাব, সেটি খাব-এ কী আবদার! রামচন্দ্র।
ভালমন্দ খাওয়ার রুচি ওঁদের স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই। বার্ধক্যের সঙ্গে সে রুচি আরও বেড়েছে। এই নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বাধে। ডাক্তারকে মধ্যে মধ্যে মধ্যস্থতা করতে হয়। সেতাবের কথা শুনে ডাক্তার তাই হাসলেন।
সেতাব ভ্রূ কুঞ্চিত করে বললেন–হাসলি যে!
ডাক্তার বললেন–নিদান হাঁকতে বলছিলি না?
মুহূর্তে সেতাবের মুখ শুকিয়ে গেল। ডাক্তার সেটুকু লক্ষ্য করলেন–এবং সমাদরের সঙ্গে অভয় দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন–না-না, তা বলি নি, ভয় পাস নে, এখনও অনেক দেখবি রে তুই। দেরি আছে। রুচি এখনও সমানে আছে। কিন্তু আজ আর হালুয়াটা খাস্ নে। জ্বরটা একেবারে ছেড়ে যাক। বরং একবেলা আজ ঝোল-ভাত খাস। ওবেলা যদি আর জ্বর না আসে–কই দেখি দে, নাড়িটা দেখি। গায়ে হাত দিয়ে জ্বর ছাড়ছে বুঝে আর নাড়ি দেখি নি। জ্বর আসবে কি না দেখি। নাড়ি ধরে ডাক্তার হাসলেন, বললেন–না। জ্বর আর আসবে না মনে হচ্ছে। হালুয়া কাল তেকে আমি খাওয়াব। আজ না। কিন্তু হঠাৎ হালুয়াতে এমন রুচি হল কেন বল তো?
–চা-মুড়ির নাম শুনে বমি আসছে। বুঝেছি না? কী রকম অরুচি হয়ে গিয়েছে। তা তুই এক কাজ কর, দোকান থেকে চারখানা বিস্কুট আনিয়ে দিতে বল। তাই বলে যা। চায়ের সঙ্গে ভিজিয়ে সে ভাল লাগবে।
বিস্কুট নিজে পাঠিয়ে দেবেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ডাক্তার উঠলেন। সেতাব-গৃহিণী এখনই তর্ক তুলবেন, রোগীর এই অবস্থায় মুড়ি বেশি উপযোগী অথবা বিস্কুট বেশি উপযোগী? একেবারে সমকক্ষ চিকিৎসকের মতই তর্ক তুলবেন। এবং প্রশ্ন করবেন—দেশে যে আগেকার কালে বিস্কুট ছিল না তখন রোগীরা খেত কী? এবং বিস্কুট খেত না বলে তারা কি মনুষ্যপদবাচ্য ছিল না, না তাদের রোগ সারত না? সেতাব-গৃহিণী নারী না হয়ে যদি পুরুষ হতেন তবে বড় উকিল হতে পারতেন। রাগ করে চেঁচামেচি করবেন না, নিজের খুঁটে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে কূটতর্ক করবেন; কার সাধ্য তাকে এক পা হটায়। এ-যুগে জন্মালেও জন্ম সার্থক হতে পারত। এখন তো মেয়েরাও উকিল জজ ম্যাজিস্ট্রেট হচ্ছেন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
ডাক্তারের মনের মধ্যেই কথাগুলি খেলে গেল। প্রকাশ্যে সেতাবকে বললেন– গিন্নিকে বলে। কাজ নাই। আমি বরং ফিরবার পথে বাজার থেকে দেখেশুনে কারুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুই যেন বাইরে থাকিস। বুঝলি!
নিজের পথ্য সম্পর্কে আশ্বস্ত হয়ে সেতাব এবার হাত ধরে বললেন–বোস বোস, একটু চা খেয়ে যা।
ডাক্তার হেসেই বললেন–চা খাব তো তোর বিস্কুট কিনে পাঠাবে কে? তা ছাড়া কৰ্মফল ভোগ, সেই বা কে করবে? দু-চার জন হাত দেখাতে আসবে তো! বসে থাকবে তারা। আমি উঠি।
বলেই তিনি উঠলেন।
সেতাব সম্পর্কে দুশ্চিন্তা কেটে গেছে তার। পরমানন্দ মাধব, পরমানন্দ মাধব! মৃদুস্বরে নাম জপ করতে করতে ভারী পা ফেলে তিনি অগ্রসর হলেন।
মাথার ছাতাটা একটু নামিয়ে মাথার উপর ধরলেন। সাধারণ লোকে—যাদের ঘরে রোগী আছে—তারা দেখতে পেলে তাকে ছাড়বে না।—ডাক্তারবাবু একটু দাঁড়ান। ছেলেটার হাত দেখে যান। কি—একবার আমার বাড়ি চলুন। আজ দশ দিন পড়ে আছে আমার বাবা–একবার ধাতটা দেখুন।
তারপর অনর্গল প্রশংসা। যার নাম নিছক তোষামোদ। বিনা পয়সায় একবার ডাক্তার দেখানো। ওতে অবশ্য জীবন মশায়ের খুব একটা আপত্তি বা দুঃখ নেই, কারণ বাপের আমল থেকে তার আমল পর্যন্ত বিনা ফিতেই গরিবগুনা মধ্যবিত্তদের ঘরে চিকিৎসা করে এসেছেন। কিন্তু এখন এই বয়সে আর না। তা ছাড়া এই বাদলা দিনের ঠাণ্ডা সকালবেলাতেও তাঁর কান ঝ ঝ করে উঠল। লোকে তাকে আর চায় না। হ্যাঁ, চায় না। বলে—সে আমলের ডাক্তার, তাও পাসকরা নয়। আসলে হাতুড়ে। এখনকার চিকিৎসায় কত উন্নতি হয়েছে। সেসবের কিছু জানে না।
কেউ কেউ বলে, গোবদ্যি।
হনহন করে হাঁটলেন ডাক্তার।
পথের পাশেই হাসপাতাল; পাশেই তৈরি হচ্ছে নতুন হেলথ সেন্টার। ওদিকে একবার না তাকিয়ে পারলেন না। যাবার সময়ও তাকিয়েছিলেন, তখন সব নিঝুম স্তব্ধ ছিল। এখন জেগেছে সব। হাসপাতালটার বারান্দায় কজন রোগী বইরে এসে বসেছে। ঝাড়ুদারেরা ঘুরছে স্বামী স্ত্রীতে। ওই নার্সদের ঘর থেকে দুজন নার্স বেরিয়ে চলেছে হাসপাতালের দিকে। এদিকে চ্যারিটেবল ডিসপেনসারির বারান্দায় এর মধ্যেই কজন রোগী এসে গেছে। আরও আসছে। ওই ওদিকে হেলথ সেন্টারের নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে। প্রকাণ্ড বড় বাড়ি। অনেক আয়োজন, অনেক বেড, অনেক বিভাগ, শিশুমঙ্গল, মাতৃমঙ্গল, সংক্রামক ব্যাধির বিভাগ, সাধারণ বিভাগ। সার্জারি বিভাগটা বড় হবে, তাতে রক্ত থেকে যাবতীয় পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। তা ভালই হচ্ছে। রোগে যে রকম দেশ ছেয়ে ফেলছে তাতে এমনি বিরাট ব্যবস্থা না হলে প্রতিবিধান হবে না। ডাক্তারের মনে পড়ল-প্রথমে হয়েছিল ওই চ্যারিটেবল ডিসপেনসারিটি। সে হল উনিশ শো দুই বা তিন সালে।
তার আগে–।
—প্ৰণাম ডাক্তারবাবু! কোথায় গিয়েছিলেন? ডাকে?
ডাক্তার চকিত হয়ে মুখ ফেরালেন। দেখলেন এখানকার চ্যারিটেবল ডিসপেনসারির কম্পাউন্ডার হরিহর পাল তার পিছনেই সাইকেল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ি থেকে ডিসপেনসারিতে আসছে, তাকে চিনেই বোধহয় বেল না দিয়ে রথ থেকে নেমে পদাতিক হয়ে তাঁকে সম্মান দেখিয়েছে। সস্নেহে ডাক্তার বললেন–ভাল আছ হরিহর?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
–তারপর খবর ভাল তো? কী রকম চলছে তোমার?
–ওই কোনো রকমে চলে যায় আর কি।
ডাক্তার বুঝলেন হরিহরের প্র্যাকটিস ভালই চলছে আজকাল। ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। বললেন–
পেনিসিলিন চালাচ্ছ খুব! এ তো পেনিসিলিনের যুগ!
–আজ্ঞে তা বটে। সবেই পেনিসিলিন। ওষুধটা খাটেও ভাল। বলতে বলতেই সামনের দিকে অর্থাৎ মশায়ের পিছনের দিকে তাকিয়ে হরিহর একটু চঞ্চল হয়ে বললে—ডাক্তারবাবু আসছেন আমাদের। আপনাদের গ্রাম থেকেই আসছেন দেখছি। ওঃ, বোধহয় মতি কর্মকারের মাকে দেখতে গিয়েছিলেন। কাল রাত্রে মতি এসেছিল, কল দিয়ে গিয়েছিল।
মনের মধ্যে একটা বিদ্যুৎ-তরঙ্গ বয়ে গেল মশায়ের। তাকে অবিশ্বাস করেই তা হলে মতি কল দিয়ে গিয়েছে তার মাকে দেখতে? মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ালেন মশায়। ওদিকে হাসপাতালের নূতন ডাক্তারটির বাইসিক্ল দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে। জীবন মশায় নমস্কার করলেন—নমস্কার!
হাসপাতালের ডাক্তার নামলেন বাইসিক্ল থেকে। তরুণ বয়স, পরনে প্যান্ট, বুশ-শার্টের উপরে ওয়াটারফ, মাথায় অয়েলস্কিনের ঢাকনি-মোড়া শোলার হ্যাট। চোখে শেলের চশমা; কলকাতার অধিবাসী—নাম প্রদ্যোত বোস। প্রতিনমস্কার করে প্রদ্যোত ডাক্তার বললেন– ভাল আছেন?
–ভাল? তা রোগ তো নেই। সংসারে তো একেই ভাল থাকা বলে। তারপর মতির মাকে দেখে এলেন?
–হ্যাঁ। কাল রাত্রে মতি এসে বলে রাত্রেই যেতে হবে। তার মা নাকি যন্ত্রণায় অধীর অস্থির হয়ে পড়েছে। সে কিছুতেই ছাড়বে না। সেটা তো জানা। প্রথম যখন পড়ে যায় তখন কিছুদিন হাসপাতালে ছিল। কমেও গিয়েছিল বেদনা। তারপর বেদনা বেড়েছে আবার, বোধহয় ওই অবস্থাতেই ঘোরাফেরা কাজকর্ম করেছে। আমার ধারণা, আবারও ধাক্কাটাক্কা লাগিয়েছিল। আপনি তো দেখেছেন কাল বিকেলে। সবই তো জানেন।
–হ্যাঁ দেখেছি। তাই তো জিজ্ঞাসা করছি, কেমন দেখলেন?
–একটু পাকিয়ে গেছে, এক্স-রে না করলে ঠিক ব্যবস্থা তো হবে না। ভিতরে কোথাও হাড়ের আঘাত গুরুতর হয়েছে, ফেটে থাকতে পারে, যদি ফ্র্যাকচার হয়ে হাড়ের কুচিটুচি থাকে তো অপারেশন করতে হবে। ব্যবস্থা হলেই সেরে যাবে। মারাত্মক কিছু নয়। ঠোঁট দুটিতে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি ফুটিয়ে তুললেন তিনি।
মশায় একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, কুচিটুচি নেই। ফ্র্যাকচার নয়। ব্যথাটা সরে নড়ে বেড়াচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ফুলোটাও। আমার অবিশ্যি সার্জারিতে বিদেবুদ্যি নাই। ভাল বুঝি না। বুঝি নাড়ি। আমার যা মনে হল—তাতে ওটা উপলক্ষ। যাকে বলে হেতু। আসলে–কথাটা অর্ধসমাপ্ত রেখে একটু হেসে ইঙ্গিতের মধ্যে বক্তব্য শেষ করলেন।
প্রদ্যোত ডাক্তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে একটু কড়া সুরেই বললেন–হ্যাঁ—আপনি তো জ্ঞানগঙ্গার ব্যবস্থা দিয়ে এসেছেন। হাসলেন প্রদ্যোত ডাক্তার। এবার রসিকতা করেই বললেন–আমি গিয়ে দেখি ভয়ে বুড়ির এমন প্যালপিটেশন হচ্ছে যে, জ্ঞানগঙ্গাও আর পৌঁছুতে হবে না। স্টেশনে যাবার জন্য গাড়িতে তুলতে তুলতেই হার্টফেল করবে।
আরও একটু হেসে নিলেন প্রদ্যোত ডাক্তার। তারপর বললেন–নাঃ, বেঁচে যাবে বুড়ি! মতি কিছু খরচ করতে প্রস্তুত আছে, বাকিটা হাসপাতাল থেকে ব্যবস্থা করে ওকে আমি খাড়া করে দেব। ওকে মরতে আমি দেব না।
শেষের কথাটিতে প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্যের ব্যঙ্গ রনরন করে বেজে উঠল। মনে হল ডাক্তার তীর ছুঁড়লে—তীরটা তার মাথায় খাটো-করে-ছাঁটা চুলগুলি স্পর্শ করে বেরিয়ে চলে গেল; তীরটার দাহ–তীরটা তার কপালে কি ব্ৰহ্মতালুতে বিদ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা থেকেও শতগুণে মর্মান্তিক।
ঘাড় নেড়ে মশায় বললেন–আমাকে মারতে হবে না ডাক্তারবাবু, বুড়ি নিজেই মরবে। তিন মাস কি ছ মাস-এর মধ্যেই ও যাবে। ওর অনেক ব্যাধি পোষা আছে। এই আঘাতের তাড়সে সেগুলি–
প্রদ্যোতবাবু চকিতে ঘাড় তুললেন—তারপর বাধা দিয়ে বললেন–পেনিসিলিন, স্ক্রেপ্টোমাইসিন—এক্স-রে–এসবের যুগে ওভাবে নিদান হাকবেন না। এগুলো ঠিক নয়। জড়ি বুটি সর্দি পিত্তি এসবের কাল থেকে অনেক দূর এগিয়ে এসেছি আমরা। তা ছাড়া এসব হল ইনহিউম্যান—অমানুষিক।
এরপর জীবন মশায়কে আর কথা বলার অবকাশ না দিয়েই প্রদ্যোত ডাক্তার বললেন– আচ্ছা নমস্কার, চলি। দেরি হয়ে যাচ্ছে হাসপাতালের সঙ্গে সঙ্গে বাইসিক্লে উঠে ভিতরের দিকে চালিয়ে দিলেন দ্বিচক্রযানখানিকে। কটু কথা বলে মানুষের কাছে চক্ষুলজ্জা এড়াবার জন্য মানুষ এমনি নাটকীয়ভাবেই হঠাৎ পিছন ফিরে চলে যায়।
খানিকটা গিয়ে আবার নেমে বললে—আসবেন একদিন, আমাদের ব্যবস্থা দেখলেই বুঝতে পারবেন সব। নতুন নতুন কেসের সব অদ্ভুত ট্রিটমেন্টের হিস্ট্রি পড়ে শোনাব–মেডিক্যাল জার্নাল থেকে। হাতুড়ে চিকিৎসা ছাড়া এককালে যখন চিকিৎসা ছিল না তখন যা করেছেন করেছেন। কিন্তু একালে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা যখন হয়েছে, লোকে পাচ্ছে—তখন ওই হাতুড়ে চিকিৎসা ফলানো মারাত্মক অপরাধ। অন্য দেশ হলে শাস্তি হত আপনার।
কঠিন হয়ে উঠেছে তরুণ ডাক্তারটির মুখ।
জীবন মশায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তিনি অপরাধী? অন্য দেশ হলে তার শাস্তি হত?
এত বড় কথা বলে গেল ওই ছোকরা ডাক্তার? জীবন ডাক্তার স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েই রইলেন; কয়েকটি রোগী হাসপাতালে ঢুকবার সময় তাকে দেখে থমকে দাঁড়াল, সবিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। জীবন মশায় লক্ষ্য করলেন না। তিনি আত্মসংবরণ করছিলেন। এ তো তার পক্ষে নতুন নয়। দীর্ঘ জীবনে পাস-করা ডাক্তার এখানে অনেক এল-অনেক গেল। জেলা থেকে বড় ডাক্তারও এসেছেন। কলকাতা থেকেও এসেছিলেন। মতভেদ হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনি অবজ্ঞাও তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে জীবন মশায়ই অভ্রান্ত। না, জীবন মশায় নয়—তিনি নয়, নাড়িজ্ঞান-যোগ অভ্রান্ত।
মনে পড়ছে। সব ঘটনাগুলি মনে পড়ছে।
পিতামহ দীনবন্ধু দত্ত এই জ্ঞানযোগ পেয়েছিলেন এখানকার বৈদ্যকুলতিলক কৃষ্ণদাস সেন কবিরাজ মহাশয়ের কাছে।
আবার তিনি চলতে শুরু করলেন।
০৩. জীর্ণ আরোগ্য-নিকেতনের দাওয়ায়
জীর্ণ আরোগ্য-নিকেতনের দাওয়ায় তখন জনদশেক রোগী এসে বসে আছে। এদের অধিকাংশই মুসলমান। আজ তিন পুরুষ ধরে দীনবন্ধু মশায়ের আমল থেকে মশায় বংশ পুরুষানুক্রমে চিকিৎসাই করে আসছেন। জীবন মশায় আজ বৃদ্ধ, আসক্তিহীন, উৎসাহহীন কিন্তু তবু এরা তাকে ছাড়ে না। একমাত্র পুত্র মারা গেছে, নতুন কালের চিকিৎসাবিজ্ঞান এসেছে তার বিপুল সমারোহ নিয়ে, নিজে স্থবির হয়েছেন, সংসারে শান্তি নাই, জীবন মশায় মধ্যে মধ্যে ভাবেন। একেবারেই ছেড়ে দেবেন। কিন্তু দেব-দেব করেও দিতে পারেন না, দেওয়া হয় না। আজ তিনি ভাবলেন না। আর না, আজই শেষ করবেন।
আরোগ্য-নিকেতনে আজ আর ওষুধই নাই; ও ব্যবস্থা ডাক্তার উঠিয়ে দিয়েছেন। আজকাল প্রেসক্রিপশন লিখে দেন। নবগ্রাম বি কে মেডিক্যাল স্টোর্স ওষুধ দেয়। দু-তিন মাস অন্তর কিছু অর্থও দেয় কমিশন বাবদ।
এখনও ওই ভাঙা আলমারি তিনটের মাথায় ওষুধের হিসেবের খাতা স্থূপীকৃত হয়ে জমা হয়ে রয়েছে। খেরো-মলাটগুলো আরশোলায় কেটেছে। ভিতরের পাতাগুলি পোকায় কেটে চালুনির মত শতছিদ্র করে তুলেছে। তবু আছে। ডাক্তারের দুর্ভাগ্য উই নেই; অথবা কোনোদিন অগ্নিকাণ্ড হয় নি। জঞ্জাল হয়ে জমে আছে। ওগুলোর দিকে তাকিয়ে জীবন দত্ত হাসেন। ওর মধ্যে অন্তত বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা পাওনার হিসেব আছে। বেশি, আরও বেশি। তিন পুরুষের হিসেব ধরলে লক্ষ টাকা। তাঁর আমলের—তাঁর নিজের পাওনা অন্তত ওই বিশ হাজার টাকা।
পিতামহ দীনবন্ধু দত্ত নবগ্রামে রায়চৌধুরী বংশের আশ্রয়ে এসে পাঠশালা খুলেছিলেন, পাঠশালা করতেন, রায়চৌধুরীদের দেবোত্তরের খাতা লিখতেন, কিছু আদায় করতেন। ওই রায়চৌধুরীদের বাড়িতে চিকিৎসা করতে আসতেন কবিরাজ-শিরোমণি কৃষ্ণদাস সেন। দীনবন্ধু দত্তকে তিনিই শিষ্যত্বে গ্রহণ করেছিলেন। রায়চৌধুরী বংশের বড়তরফের কর্তার একমাত্র পুত্রের সান্নিপাতিক জ্বরবিকার হয়েছিল; জীবনের আশা কেউই করে নি; মা শয্যা পেতেছিলেন, বাপ। স্থাণুর মত বসে থাকতেন, তরুণী পত্নীর চোখের জলে নদীগঙ্গা বয়ে যাচ্ছিল। আশা ছাড়েন নি শুধু ওই কৃষ্ণদাস কবিরাজ মহাশয়। তিনি বলেছিলেন একজন ধীর অক্লান্তকর্মা লোক চাই, সেবা করবে। তা হলে আমি বলতে পারি, রোগের ভোগ দীর্ঘ হলেও রোগী উঠে বসবে। সেবা করতে এগিয়ে এসেছিলেন দীনবন্ধু দত্ত। দীর্ঘ আটচল্লিশ দিনের দিন জ্বর ত্যাগ হয়েছিল। কবিরাজ দীনবন্ধুকে বলেছিলেন-আজও তোমার ছুটি হল না। অন্তত আরও চব্বিশ দিন তোমাকে সেবা করতে হবে। এই সময়টাতেই সেবা কঠিন। এখন স্নেহান্ধ আত্মীয়স্বজনেরা স্নেহাতিশয্যে সেবার নামে রোগীর অনিষ্ট করবে। রোগীকে কথা বলাবে বেশি, কুপথ্যও দেবে। এই সময়ে তোমাকে বেশি সাবধান হতে হবে। তাও দীনবন্ধু নিখুঁতভাবে করেছিলেন।
সন্তান আরোগ্য লাভ করাতে বড়কর্তা দীনবন্ধু দত্তকে পুরস্কৃত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দীনবন্ধু তা গ্রহণ করেন নি। কৃষ্ণদাস কবিরাজ বলেছিলেন আমি তোমাকে পুরস্কার দেব। প্রত্যাখ্যান কোরো না। ধীরতা তোমার আশ্চর্য, বুদ্ধিও তোমার স্থির; লোভেও তুমি নির্লোভ। তুমি চিকিৎসাবিদ্যা শেখ আমার কাছে। তুমি পারবে।
চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা করে নবগ্রামের পাশে এই ছোট শান্ত গ্রামখানিতে তিনি বাস। করেছিলেন। নবগ্রামে বাস করেন নি। গ্রামখানি ব্রাহ্মণ জমিদার বংশ-অধ্যুষিত, সুতরাং সেখানে কলহ অনেক এবং সেখানে বাজার আছে কাছেই, তাই কোলাহলও বড় বেশি। এসব থেকে দূরেই তিনি থাকতে চেয়েছিলেন। বলতেন—দেবতারা প্রসন্ন সহজে হন না, কিন্তু রুষ্ট হন এক মুহূর্তে; সামান্য অপরাধে আজীবন সেবার কথা ভুলে যান। আর বাজারে থাকে বণিক। সেখানে চিন্তার অবকাশ কোথা?
মশায় উপাধি পেয়েছিলেন এই দীনবন্ধু মশায়ই। পরনে থান-ধুতি, পায়ে চটি, খালি গা, দীনবন্ধু মশায় গ্রামান্তরে রোগী দেখে বেড়াতেন। এ অঞ্চলে প্রতিটি বালক তাঁকে চিনত। তিনি ডেকে তাদের চিকিৎসা করতেন; মধু খাওয়াতেন। টিনবন্দি মধু থাকত। আর আশ্চর্য ছিল তার সাধুপ্রীতি। সাধু-সন্ন্যাসীর সঙ্গে আলাপ করে, তাদের পরিচর্যা করে বহু বিচিত্র মুষ্টিযোগ তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। ভণ্ড সন্ন্যাসীর কাছে ঠকেছেনও অনেক। তাতে তার আক্ষেপ বা অনুশোচনা ছিল না; কিন্তু এ নিয়ে কেউ তাকে নির্বোধ বলে রহস্য বা তিরস্কার করলে বলতেন—সেই আমাকে ঠকিয়েছে, আমি তো তাকে ঠকাই নি। আমার আক্ষেপ কি অনুতাপের তো হেতু নাই। শুধু কি সন্ন্যাসীকত বেদে, ওস্তাদ, গুণীন—এদের কাছেও তাদের বিদ্যা তিনি সংগ্রহ করেছিলেন।
পুত্র জগদ্বন্ধু দত্ত ছিলেন উপযুক্ত সন্তান। তিনি পিতার কাছে সমস্ত বিদ্যাই আয়ত্ত করেছিলেন। মৃত্যুকালে দীনবন্ধু মশায় ছেলেকে বলেছিলেন বিষয় কিছু পারি নি করতে কিন্তু আশয় দিয়ে গেলাম মহৎ। মহাশয়ত্বকে রক্ষা কোরো। ওতেই ইহলোক পুরলোক দুই-ই সাৰ্থক হবে।
জগদ্বন্ধু দত্ত পিতৃবাক্য অক্ষরে অক্ষরে পূর্ণ করেছিলেন। তাকেও লোকে বলত—জগৎ মশাই। পিতার অর্জন করা মহাশয়ত্ব তিনি রক্ষাই করেন নি, তাকে উজ্জ্বলতর করেছিলেন। তিনি রীতিমত সংস্কৃত শিখে আয়ুর্বেদ পড়েছিলেন। পারুলিয়ার বৈদ্যপাটের ছাত্র তিনি চিকিৎসক হিসেবে আয়ুর্বেদশাস্ত্রে যেমন ছিল ব্যুৎপত্তি তেমনি ছিলেন নির্লোভ এবং রোগীর প্রতি স্নেহপরায়ণ। আবার মানুষ হিসেবে যেমন ছিল তার মর্যাদাবোধ তেমনি ছিল প্রকৃতির মধুরতা। সে মধুরতা প্রকাশ পেত তার মিষ্ট ভাষায়, সূক্ষ্ম রসবোধে ও রসিকতায়। তাঁর রসিকতার কয়েকটি স্মৃতি এখানকার মানুষের রসশাস্ত্রের অলিখিত ইতিকথায় কয়েকটি অধ্যায় হয়ে আছে। তাঁর রসিকতার সবচেয়ে বড় কথা এই যে, তাতে কটু বা অম্লরসের একটুকু প্রক্ষেপ থাকত না। মানুষকে মধুর রসে আপ্লুত করে দিত। প্ৰসন্ন হয়ে উঠত রসিকতায় অভিষিক্ত জনটি।
এই যে লাল কাঁকরের পাকা রাস্তাটি নবগ্রাম থেকে এই গ্রামে এসে পৌঁছেছে এবং এই গ্রাম পার হয়ে উত্তর দিকে বিস্তীর্ণ মাঠখানির বুক চিরে চলে গিয়েছে—ওই রাস্তাটির কথা উঠলেই লোকের মনে পড়ে যায় জগত্মশায়ের কথা, তার রসজ্ঞানের কথা এবং সঙ্গে সঙ্গে মন সরস ও প্রসন্ন হয়ে ওঠে। আপন মনে একা একাই লোকেরা হেসে সারা হয়।
পঁয়তাল্লিশ বৎসর আগে। তখন এখনকার এই পরিচ্ছন্ন গ্রাম্য সড়কটির শুধু আকারই ছিল, আয়তনও একটা ছিল, অবয়বও ছিল, কিন্তু কোনো গঠনই ছিল না। একটা অসমান, খানাখন্দে বন্ধুর এবং দুর্গম গো-পথ ছিল। বর্ষার সময় এক-বুক কাদা হত। সে কাদা একালে কেউ কল্পনাই করতে পারবেন না। মশায়ের রসিকতার কাহিনীটি থেকেই তা বুঝতে পারবেন।
এখনও দেবীপুরে সেকালের খানাখন্দের নাম শুনতে পাওয়া যায়। একটু প্রবীণ দেখে যাকে খুশি জিজ্ঞাসা করবেন—সে নাম বলবে—চোরধরির গাদ অর্থাৎ কাদা; মানে যে কাদায় পড়ে। চোর ধরা পড়ে যায়। গরুমারির খাল-ও খালটায় চোরাবালির মত একটা চোরা গর্তে ব্ৰজ পরামানিকের একটা বুড়ি গাই পড়ে মরেছিল। এই কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ হেসে উঠবে। না হেসে থাকে কী করে? ভাবুন তো ব্যাপারটা! ব্ৰজর গরু মরল, কিন্তু সে বিপদের চেয়েও বড় বিপদ হল—ব্রজ যে প্ৰায়শ্চিত্ত করবে তার মাথা কামাবে কে? সে নিজে নাপিত, ক্ষুর তার আছে, কিন্তু চালাবে কে? এখনকার মত তখন তো সবাই ক্ষুর চালাতে জানত না। জানলেও নিজের হাতে মাথা কামানো নিশ্চয় যায় না। শেষে ওই জগদ্বন্ধু মশায়ই দিয়েছিলেন ব্রজর মাথা কামিয়ে। কবিরাজ ছিলেন, বিকারগ্রস্ত রোগীর মাথা অনেক সময় তাঁকে কামিয়ে দিতে হত। কি না। এসব রোগীর মাথায় ক্ষুরের মত অস্ত্র চালাতে তিনি পরামানিকের হাতে ক্ষুর ছেড়ে দিতেন না। সেদিন ব্ৰজর মাথা কামাতে বসে তার মাথাটি বাঁ হাতে ধরে নিজেই হেসে ফেলেছিলেন, কামাবার সময় জগদ্বন্ধু মশায় হেসেই বলেছিলেন, ব্ৰজ, আজ শোধ নিই?
-আজ্ঞে? ব্ৰজ অবাক হয়ে গিয়েছিল—শোধ? কিসের শোধ?
—কামাবার সময় অনেক রক্ত দেখেছ বাবা, আজ আমি দেখি? শোধ নিই?
এই রাস্তাকে ভাল করেছেন তিনি অর্থাৎ জীবন মশায় নিজে। তিনিই ওই কাঠের নামফলকখানা টাঙিয়েছিলেন। জগদ্বন্ধু মশায় ছিলেন কবিরাজ। জীবন মশায়ডাক্তার কবিরাজ দুই। তখনকার দিনে একটা কথার চলন ছিল ঘরে ঘরে। জগৎ খাবি, না জীবন খাবি? সেকালে অসুখ হলে বাড়ির লোক রোগীকে প্রশ্ন করত জগৎ খাবি, না জীবন খাবি? অর্থাৎ ডাক্তারি ওষুধ খাবি-জীবন দত্তকে ডাকব? না-কবিরাজি ওষুধ খাবি-জগদ্বন্ধু কবিরাজ মশায়কে ডাকব?
যাক। আজ ওই কথাটা চিরদিনের মত ভুলে যাক লোকে।
—মশায়! বাবা!
জীবন মশায় আহত অন্তর নিয়ে ফিরে এসে ডাক্তারখানায় স্তব্ধ হয়ে বসলেন, স্থির নিম্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন বাইরের দিকে। আজ থেকে শেষ। শেষ হয়ে যাক মশার বংশের মশায় উপাধি চিকিৎসকের কাজ। যাক।
এরই মধ্যে শেখপাড়ার বৃদ্ধ মকবুল এসে দরজার মুখে বসে তাকে ডাকলে—মশায়! বাবা!
একটা দীর্ঘনিশ্বাস আপনাআপনি বেরিয়ে এল জীবন মশায়ের বুক থেকে।–কে? তিনি সচেতন হয়ে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন মকবুলের দিকে।
মকবুল বললেহাতটা একবার দেখেন বাবা। বড় কষ্ট পাচ্ছি এই বুড়া বয়সে। অষ্টাঙ্গে দরদ। ঘুষঘুষা জ্বর। মাটি নিতে হবে তা আমার মালুমে এসেছে। কিন্তু এই কষ্ট—এ যে সইতে নারছি বাবা। ইয়ার একটা বিধান দ্যান।
মশায় ঘাড় নেড়ে বললেন–আমার কাছে তোমরা আর এসো না মকবুল। চিকিৎসা আর আমি করব না। একালে অনেক ভাল চিকিৎসা উঠেছে, হাসপাতাল হয়েছে, নতুন ডাক্তার এসেছে। তোমরা সেইখানেই যাও।
মকবুল অবাক হয়ে গেল। জীবন মশায় এই কথা বলছেন? দীনুমশায়ের নাতি, জগত্মশায়ের ছেলে—জীবন মশায় এই কথা বলছেন? যে নাকি নাড়িতে হাত দিলে মকবুলের মনে হয়, অর্ধেক রোগ ভাল হয়ে গেল, তার মুখে এই কথা!
ডাক্তার তার মুখের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ হাসি হেসে, তাকে বুঝিয়েই বললেন–আমার আর ভাল লাগছে না মকবুল। তা ছাড়া বয়স হয়েছে, ভুল-ভ্ৰান্তি হয়।
–অ ডাক্তার! বলি, তুমি চিকিৎসা ছাড়লে আমাদের কী হবে হে? আমরা যাব কোথায়? নাও-নাও। লোকের হাত দেখে বিদেয় কর। তোমার ভুল-ভ্ৰান্তি! কী বলে, তোমার ভুল-ভ্রান্তি হলে সে বুঝতে হবে আমাদের অদৃষ্ট ফের! নতুন চিকিৎসা, নতুন ডাক্তার অনেক সরঞ্জাম, বৃহৎ ব্যাপার, ওসব করাতে আমাদের সাধ্যিও নাই, এতে আমাদের বিশ্বাসও নাই।–বললে কামদেবপুরের দাঁতু ঘোষাল। অনেক কষ্টেই বললে।
একসঙ্গে এতগুলি কথা বলে অনর্গল কাশতে শুরু করে দিলে সে। বুকের পাঁজরাগুলি সেই কাশির আক্ষেপে কামারের ফুটো হাপরের মত শব্দ করে উঁপছে। মনে হচ্ছে, কখন কোন মুহূর্তে দম বন্ধ হয়ে দাঁতু মাটিতে লুটিয়ে পড়বে। ডাক্তার চারিদিকে তাকিয়ে খুঁজলেন একখানা পাখা অথবা যা হোক একটা কিছু যা দিয়ে একটু বাতাস দেওয়া যায়। দতুর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে। কিন্তু কিছুই নাই কোথাও। ওই নন্দ হতভাগার জন্যে কিছু থাকবার যো নাই। শিশি-বোতল থেকে মিনিমগ্লাস, মলম তৈরির সরঞ্জাম, থারমোমিটারের খোল, এমনকি পুরনো বাতিল স্টেথোসকোপের রবারের নলের টুকরো দুটো পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছে হতভাগা। কিছু না পেয়ে ডাক্তার উঠে ভাঙা আলমারির ভিতর থেকে টেনে বের করলেন একখানা পুরনো হিসাবের খাতা; লাখ টাকা পাওনার তামাদি দলিল; তারই একদিকের খেরোর মলাটখানা ছিঁড়ে নিয়ে বাতাস দিতে শুরু করলেন। বাইরে সমাগত রোগীদের দিকে তাকিয়ে একজনকে বললেন– বাড়ি থেকে এক গ্লাস জল আন তো! চট করে।
কামদেবপুরের এই বৃদ্ধ দাঁতু ঘোষালের চিরকাল একভাবে গেল। দাঁতু যত লক্ষ্মীছাড়া তত লোভী; দুনিয়া জুড়ে খেয়ে খেয়ে লোভের তৃপ্তি খুঁজে বেড়ালে সারাজীবন; কিন্তু তাতে ললাভের তুষ্টি হয় নি, হয়েছে রোগ, পুষ্টির বদলে হয়েছে দেহের ক্ষয়। তার উপর গাঁজা খায় দাঁতু! এককালে গাঁজা খেত ক্ষুধার জন্য। গাঁজায় দম দিয়ে খেতে বসলে পাকস্থলীটি নাকি বেলুনের মত ফেপে ওঠে। তাতে আহার্য ধরে বেশি পরিমাণে। তাঁর বাড়িতেই দাঁতু ঘোষাল নিমন্ত্রণ খেতে বসে অন্ন-ব্যঞ্জনে বালতিখানেকেরও উপর কিছু উদরস্থ করে—মিষ্টির সময় সাতচল্লিশটি রসগোল্লা খেয়ে উঠেছে। জ্যৈষ্ঠ মাসে গোটা কাঁঠাল খেয়ে দাঁতু ঘোষাল যে কতবার বিছানায় শুয়ে ছটফট করেছে তার হিসেব নাই। বারচারেক তো কলেরার লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। তবু ঘোষাল লোভ সংবরণ করতে পারলে না। এখন বদহজম থেকে হাঁপানি হয়েছে। তার ওপর নেশা। গাঁজায় দম দিয়ে কো হাতে বসবে, টানবে আর কাশবে। কাশতে কাশতে হাঁপাতে শুরু করবে। এবং সপ্তাহে দুদিন ডাক্তারের এখানে আসবেওষুধ দাও ডাক্তার। ভাল ওষুধ দাও। আর ভুগতে পারছি না।
ভাল ওষুধ চায় ঘোষাল, কিন্তু মূল্য দিয়ে নয়। বিনা মূল্যে চায়। বাল্যকালে ঘোষাল জীবন ডাক্তারের সঙ্গে পাঠশালায় পড়েছিল, অনেক মন্দবুদ্ধি এবং মন্দকর্মে মতি সে যুগিয়েছে, সেই দাবিতে ডাক্তারের চিকিৎসায় ঔষধে তার অবাধ অধিকার। তার ওপরে ঘোষাল যজমানসেবী পুরোহিত ব্রাহ্মণ। অশুদ্ধ মন্ত্ৰ উচ্চারণ করে দেবতার পূজা করে বেড়ায়। সে হিসেবেও তার এ দাবি আছে। বিদেশী ডাক্তারেরা এ দাবি মানে না। তারা না মানতে পারে কিন্তু জীবন মানবে না কেন? এ দাবি তারা দীনবন্ধু মশায়ের আমল থেকে চালিয়ে আসছে, ছাড়বে কেন? তবে গুণও আছে ঘোষালের। কোনো যজ্ঞিবাড়ি থেকে কাকের মুখে বার্তা পাঠিয়ে দাও, ঘোষাল এসে হাজির হবে। কোমর বেঁধে দিবারাত্রি খেটে কাজ সেরে খেয়েদেয়ে বাড়ি যাবে। দক্ষিণা দাও ভালই, না দাও তাতেও কিছু বলবে না সে; পুরিয়া দুয়েক অর্থাৎ দু আনা কি চার আনার গাঁজা দিলেই ঘোষাল কৃতার্থ। আরও আছে, শ্মশানে যেতে ঘোষালের জুড়ি নাই। সে হিসেবে ঘোষাল এ অঞ্চলে সকলজনের একজন বান্ধব তাতে সন্দেহ নাই। উৎসবে আছে, শ্মশানে আছে–রাজদ্বারেও আছে ঘোষাল; মামলায় সে পেশাদার সাক্ষী।
সুস্থ হতে ঘোষালের বেশ কিছুক্ষণ লাগল। হেউ-হেউ শব্দে ঢেকুরের পর ঢেকুর তুলবার। চেষ্টা করে অবশেষে দু-তিনটে বেশ লম্বা এবং সশব্দ ঢেকুর তুলে একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে ঘোষাল বললে—আঃ, বাঁচলাম! তারপর আবার বললে—তুমি বরং ওদের হাত দেখে শেষ কর ডাক্তার। আমি আর একটু জিরিয়ে নিই।
এই সুযোগে মকবুল এগিয়ে এল, হাত এগিয়ে দিল। ডাক্তার তার হাতখানি ধরলেন। বিচিত্ৰ হাস্যে তার মুখখানি প্রসন্ন হয়ে উঠল। উপায় নাই। তিনি ছাড়তে চাইলেও এরা তাকে ছাড়বে না; এই মকবুলেরা। নূতনকে এরা ভয় করে তাকে গ্রহণ করার মত সামর্থ্য তাদের নাই; মনেও নাই; আর্থিক সঙ্গতিতেও নাই। মকবুলের দেহ পর্যন্ত বিচিত্র। এক গ্রেন কুইনিন খেলে মকবুলের ঘাম হতে শুরু হয়, শেষ পর্যন্ত নাড়ি ছাড়ে। মকবুল বিলিতি ওষুধকে বিষের মত ভয় করে। একে একে রোগীদের দেখে তাদের ব্যবস্থা দিয়ে সবশেষে দেখলেন দাঁতু ঘোষালকে।
ঘোষাল বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছে এরই মধ্যে। এবার সে হাতখানি বাড়িয়ে দিলে। জীবন ডাক্তার বললেন–তোর হাত দেখে কী করব ঘোষাল? রোগ তো তোর ভাল হবার নয়। তোর আসল রোগ হল লোভ। লোভ তো ওষুধে সারে না। তার ওপর নেশা। সকালে উঠেই এই অবস্থায় তুই গাঁজা টেনে এসেছিল।
দাঁতু লজ্জিত হয় না, সে বেশ সপ্রতিভভাবেই বললে, গাঁজাতে হয় নাই দত্ত। বিড়ি। বিড়ি। বিড়িতে হল। তোমার দাওয়াতে বসে ছিলাম, দেখলাম ওই কি বলে তাহের শেখ বিড়ি টানছে। ভারি পিপাসা হল, ওরই কাছে একটা বিড়ি নিয়ে যেই একটান টেনেছি, অমনি বুঝেছ। কিনা, হাঁপ ধরে গেল। তারপরেতে তোমাকে কতকগুলো কথা একসঙ্গে বলেছি আর ব্যস, হঠাৎ বুঝেছ কিনা–।
হাত দুটি নেড়ে দিলে দাঁতু ঘোষাল—এতেই বুঝিয়ে দিলে যে আচমকা রোগটা উঠে পড়ল। এতে আর তার অপরাধটা কোথায়? ঘোষাল নিরপরাধ ব্যক্তির মতই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে—এ সব গ্রহের ফের, বুঝলে না! তা দাও ভাই, যা হোক একটা এমন ওষুধ দাও। যাতে হাঁপানি-কাশিটা কমে। সকালে বিকেলে চায়ের সঙ্গে দুটো করে চারটে আরসুলা সিদ্ধ করে করে খাচ্ছি, তাতেও কিছু হচ্ছে না।
ডাক্তার বললেন–গাঁজা-তামাক বন্ধ করতে হবে। লোকের বাড়ি খাওয়া বন্ধ করতে হবে। একেবারে ঝোল আর ভাত। না হলে ওষুধে কিছু হবে না, ওষুধও আমি দেব না ঘোষাল।
—তবে আর একবার ভাল করে হাতটা দেখ। ঘোষাল হাতটা বাড়িয়ে দিলে।দেখ, দেখে বলে দাও কবে মরব। নিদান একটি হেঁকে দাও। ওতে তো তুমি বাক-সিদ্ধ। দাও। শুনলাম কামারবুড়িকে নিদান হেঁকে দিয়েছ। গঙ্গাতীরে যেতে বলেছ। আমাকে দাও।
ডাক্তার চমকে উঠলেন। নতুন করে মনে পড়ে গেল সকালবেলার কথা। তিনি চঞ্চল হয়ে নড়েচড়ে বসে বললেন–তুই থাম ঘোষাল, তুই থাম।
তিনি তাড়াতাড়ি একখানা কাগজ টেনে প্রেসক্রিপশন লিখে ঘোষালের হাতে দিয়ে। বললেন–এই নে। গাছ-গাছড়া শুধু, দু-তিনটে জিনিস মুদিখানায় কিনে নিবি। তৈরি করে নিয়ে খাস।
ডাক্তার উঠে পড়লেন। চেয়ারখানা ঠেলে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল অমরকুঁড়ির পরান খ্ৰী। সে সেলাম করে দাঁড়াল। সামনে ছইওয়ালা গরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। খয়ের তৃতীয়পক্ষের স্ত্রীর দীর্ঘস্থায়ী অসুখ। আজ ছ মাস বিছানায় পড়ে আছে। মৃত সন্তান প্রসব করে বিছানায় শুয়েছে। সপ্তাহে দুদিন করে পরান ডাক্তার নিয়ে যায়। আজ যাবার দিন। যেতে হবে। পরান খ অবস্থাপন্ন চাষী। নিয়মিত ফি দিয়ে থাকে। ডাক্তার হাসলেন। একটা কথা মনে পড়ে গিয়েছে। এইসব বিনা ফি-এর রোগীদের তিনি যখন বলেছিলেন আর তাদের চিকিৎসা করবেন না তখন তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন, চিকিৎসা ছাড়লে চলবে কী করে? বাঁচতে হবে তো! আজ যে তিনি প্রায় সর্বস্বান্ত। একা তিনি নন-ঘরে স্ত্রী আছে। ক্ষমাহীনা স্ত্রী।
পরান বললে—দেরি হবে নাকি আর!
–নাঃ, দেরি কিসের। ডাক্তার পা বাড়ালেন।–চল।
পরান এদিক ওদিক তাকিয়ে বললে—আপনি তা হলে গাড়িতে চড়েন। আমি পায়দলে তুরন্ত গিয়া ধরব গাড়ি। একটু অপ্রস্তুতভাবেই বললে—কিছুটা তরি নিয়া এসেছিলাম। নন্দ নিয়া গেছে ভিতরে। ডালাটা নিয়াই যাব আমি।
পুরনো কালের লোক পরান; এখনও ভালবাসার মূল্য দেয়। ক্ষেতের ফসল, পুকুরের মাছ। ডাক্তারের বাড়ি মধ্যে মধ্যে পাঠায়। কখনও নিজেই নিয়ে আসে। বিবির অসুখে এই ভেট পাঠানোর বহরটা একটু বেড়েছে। ডাক্তারের ওপর অগাধ বিশ্বাস পরানের। নতুন কালের। চিকিৎসায় বিশ্বাস থাক বা না-থাক, নতুন কালের অল্পবয়সী ডাক্তারদের ওপর বিশ্বাস তার নাই। তৃতীয়পক্ষের বিবি যুবতী, মেয়েটি শ্রীমতীও বটে; এর ওপর পরানের আছে সন্দেহবাতিক। বিবিকে বাঁচাবার জন্য তার আকুলতার সীমা নাই, অর্থব্যয় করতেও কুণ্ঠিত নয়, কিন্তু জেনানার আবরু জলাঞ্জলি দিয়ে বাঁচার চেয়ে মরাই ভাল। জীবন মশায়ের কথা আলহিদা। পরান আলাদা শব্দটাকে বলে আলহিদা। মাথার চুল সাদা হয়েছে, চোখের চাউনির মধ্যে বাপ-চাচার চাউনি ফুটে ওঠে, গোটা মানুষটাই শীতকালের গঙ্গানদীর জলের মত পরিষ্কার।
গাড়ি মন্থর গমনে চলল।
পরান খাঁয়ের মত ঘরকয়েক বাঁধা রোগীর জন্যই মশায় সংসারের ভাবনা থেকে নিশ্চিন্ত। বর্ষায় ধানের অভাব হলে ধান ঋণ দেয় তারা। অভাব-অভিযোগের কথা জানতে পারলেই পূরণ করে। অথচ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন ডাক্তার।
কী না ছিল?
মাঠের উপর এসে পড়েছিল গাড়িটা। চারিপাশের উৎকৃষ্ট ক্ষেতগুলির দিকে আপনি চোখ পড়ল। এগুলির অধিকাংশই ছিল মশায়দের। ওই বিরাট পঁজার পুকুর, ওই শ্ৰীলাইকার, ওই ঘোষের বাগান! শুধু জমি পুকুরই নয়—এই গ্রামের সামান্য জমিদারি অংশও কিনেছিলেন তাঁর বাবা জগদ্বন্ধু মশায়। এক আনা অংশ তিনি চড়া দামে কিনেছিলেন।
গাড়ির মধ্যে বসে যেতে যেতে মনে পড়ে গেল পুরনো কথা।
তখন তাঁর কিশোর বয়স।
পড়তেন নবগ্রাম মাইনর স্কুলে। সেইবারই তার মাইনর স্কুলে শেষ বৎসর। সে আমলে জমিদারত্বের একটা উত্তাপ ছিল। যে জমিদারি কিনেছে সেকালে তারই মেজাজ পাল্টেছে। জমিদারি কিনলেই লোকে মনে করত-লক্ষ্মী বাধা পড়লেন। সে আমলের প্রসিদ্ধ যাত্ৰাদলের অধিকারী কণ্ঠমহাশয়ের গানে আছে—আগে করবে জমিদারি তবে করবে পাকাবাড়ি। তারই স্বজাতি জ্ঞাতি ঘোষগ্রামের রাধাকৃষ্ণ মিত্র ওই নবগ্রাম মাইনর স্কুলে পড়ত। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা নবগ্রামের প্রতিপত্তিশালী জমিদারের ভাইয়ের সঙ্গে চলত তার অবিশ্রাম প্রতিযোগিতা। লেখাপড়ায় নয়, জমিদার-বংশধরত্বের। প্রায়ই খিটিমিটি বাঁধত। বাবার মূলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকত রাধাকৃষ্ণ। বলত, He is a Zaminders son, I am also a Zaminders son; এখন ঝগড়া হচ্ছে, বড় হলে দাঙ্গা হবে।
তাঁর বাবা জগদ্বন্ধু জমিদারি কেনার পর তার মনে এ উত্তাপ কিছুটা সঞ্চারিত হয়েছিল। লোকে সহপাঠীরা—বলেছিল, গুলবাঘা এবার ডোরাবাঘা হল! সাবধান!
সহপাঠীরা তাঁকে বলত–গুলবাঘা।
সেই কিশোর বয়সে তাঁর নিজের রূপের কথা মনে পড়ছিল। রূপ—যে রূপ সুকুমারকোমল-উজ্জ্বল—সে রূপ তার কোনোকালে ছিল না। কিন্তু রূপ তাঁর ছিল। সবল পরিপুষ্ট দেহ-গোল মুখ, ঝকঝকে চোখ, নির্ভীক দৃষ্টি, শ্যামবর্ণ দুর্দান্ত কিশোর। হাড়ু-ড়ু-ড়ু খেলবার সময় মালকোচা মেরে জীবন ডাক দিতে ছুটলে প্রতিপক্ষ দল খানিক পিছিয়ে থোল অর্থাৎ স্থল নিত। বলত-হাঁ গুলবাঘা ছুটেছে।
এধার থেকে ওধার মুহূর্তে ছুটে ঘুরবার ভান করে একেবারে মাঝের দাগের কাছে পর্যন্ত এসে বোঁ করে আবার ঘুরে আক্রমণ করতেন। কাউকে না কাউকে মেরে আবার ঘুরতেন।
বাড়ির পিছনে কুস্তির আখড়া ছিল। ল্যাঙট পরে নরম মাটির উপর দেহ ঠুকে আছাড় খেতেন শরীর শক্ত করবার জন্য। এর ওপর মুগুর ছিল, সে দুটো আজও আছে।
গুলবাঘ হিংস্রতর নরঘাতী ডোরাবাঘই হয়ে উঠত যদি না জগদ্বন্ধু মশায় মাথার উপরে থাকতেন। জগদ্বন্ধু মশায়ের চিত্ত এতে বিন্দুমাত্র উত্তপ্ত হয় নি। মশার বংশের মহাশয়ত্বই ছিল তার কাছে সবচেয়ে বড়। দম্ভের মোহে তিনি জমিদারি কেনেন নি। জমিদারির ওপর কোনো মোহ তার ছিল না। জমিদারি তিনি কিনেছিলেন জমিদারের দম্ভের উত্তাপ থেকে বাঁচবার জন্য। যেদিন জমিদারি কেনা হয় সেদিনের একটা কথা মনে পড়ছে।
জগদ্বন্ধু মশায়ের বন্ধু, পেশায় গোমস্তা ঠাকুরদাস মিশ্ৰ যে চিকিৎসালয়ের দেওয়ালে লিখেছিল লাভানাং শ্ৰেয় আরোগ্যম্, সে-ই তাঁকে শ্লেষ করে বলেছিল—তা হলে এবার জমিদার হলে। আশয়ের চেয়ে বিষয় বড় হল। আগে লোকে সম্ভ্রম করত—মশায় বলে, এবার লোক প্রণাম করবে জমিদার মশায় বলে! বাবুমশায় বলে! ঠাকুরদাস বাতের যন্ত্রণা এবং আরোগ্যের আনন্দ তখন একেবারেই ভুলে গেছে। অনেক দিন হয়ে গেছে তখন।
জগদ্বন্ধু বলেছিলেন—ভাই, ঢাল আর তরোয়াল দুটোই হল অস্ত্র। ওর একটা থাকলেই সে যোদ্ধা। কিন্তু তরোয়াল না নিয়ে তরোয়ালের চোট থেকে মাথা বাঁচাতে শুধু ঢালটা যে রাখে তাতে আর তরোয়ালধারীতে তফাত আছে। আছে কি না আছে—তুমিই বল। ঠাকুরদাস, ওটা আমার ঢাল, শুধু ঢাল। নবগ্রামের তরোয়ালধারী জমিদারদের উঁচানো তরেয়ালের কোপ থেকে আশয়ের মাথা বাঁচানো দায় হয়ে উঠেছিল। তাই ঢাল অস্ত্র হলেও ধরতে ল। কথাটা তোকে খুলেই বলি ঠাকুরদাস। নবগ্রামের জমিদারদের কাছে মান বজায় রাখা দায় হয়ে উঠেছে ভাই। সদাই ওঁরা শস্ত্ৰপাণি। নবগ্রামের রায়চৌধুরী বংশের তরোয়াল ভঙেছে, ওঁরা এখন বাট ঘুরিয়ে তারই ঘায়ে লোকের মাথা ভাঙতে চান। আবার নতুন ধনী ব্ৰজ লালবাবু এখন আমাদের গ্রামের আট আনা অংশের জমিদার। তাদের হল চকচকে ধারালো তরোয়াল। আজ মাসছয়েক থেকে দেখছি, ব্ৰজবাবুদের বাড়িতে অসুখবিসুখ হলে ডাক আসছে চাপরাসী মারফত। সেলাম অবিশ্যি করে। বলে—সালাম গো ডাক্তারবাবু বাবুদের বাড়ি একবার যেতে হবে যে। ওদের দেখাদেখি রায়চৌধুরীরা পথে-ঘাটে দেখা হলে হেঁকে বলতে শুরু করেছে—মশায় হে, একবার আমাদের বাড়ি হয়ে যাবে যেন। তবু তো বড়বাবুরা দর্শনী দেন, এরা আবার তাও দেয় না। বুঝেছ না, অনেক ভেবে ঢাল কিনলাম। এ আমার তরোয়াল নয়। এক হাতে ঢাল থাকল অন্য হাতে খলনুড়ি। ওটা ছাতার বদল।
কথাটা তিনি তার জীবনে সত্য বলেই প্রমাণিত করেছিলেন। তার ওই ঢালের আড়ালে এ গ্রামের অনেক জনকে তিনি আশ্রয় দিয়েছেন। এবং ওই ঢাল দেখিয়ে এ গ্রামের কাউকে কখনও অস্ত্রধারীর ঔদ্ধত্য অপমানিত করেন নি।
কথাগুলি জীবন দত্ত নিজের কানে শুনেছিলেন। পাশের ঘরেই তিনি বসে পড়ছিলেন সেদিন।
তবুও জীবন মশায়ের মনে বিষয়-বৈভবের দম্ভের উত্তাপ সঞ্চারিত হয়েছিল। কী করবেন তিনি? উত্তাপ লাগলে উত্তপ্ত হওয়া যে প্রকৃতি-ধর্ম। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া তো সহজ নয়। নইলে তিনি ডাক্তার হতেন না। বাপের কাছে কবিরাজিই শিখতেন। উত্তপ্ত বস্তু সহজ ধর্মে আয়তনে বাড়তে চায়। জমিদারের এবং বড়লোকের ছেলে তার বৈভব ও অহঙ্কারের উত্তপ্তচিত্ত তখন বাপপিতামহের জীবনপরিধিকে ছাড়িয়ে বাড়তে, বড় হতে চাচ্ছে! তাই জগদ্বন্ধু ছেলের মাইনর পড়া শেষ হওয়ার পর তাকে টোলে ভর্তি করতে চাইলেন। ব্যাকরণ শেষ করার পর আয়ুৰ্বেদ পড়বে। কিন্তু জীবন মশায় বলেছিলেন আমার ইচ্ছে ডাক্তারি পড়ি।
—ডাক্তারি!
–হ্যাঁ। দেশে তো ডাক্তারিরই চলন হতে চলল। কবিরাজিতে লোকের বিশ্বাস কমে যাচ্ছে। বর্ধমানে স্কুল হয়েছে। আমি ওখানেই পড়ব।
দেশে সত্যই তখন ডাক্তারি অর্থাৎ অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা রাজকীয় সমারোহে রথে চড়ে আবির্ভূত হয়েছে। কলিকাতায় মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল, বর্ধমান মেডিক্যাল স্কুল, জেলার সদরে সদরে হাসপাতাল, চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি, ইংরেজ সাহেব ডাক্তার, দেশী নামজাদা ডাক্তারদের পোশাক গলাবন্ধ কোট, প্যান্টালুন, গোল টুপি, গার্ডচেন, বার্নিশ-করা কাঠের কলবাক্স; ঝকঝকে লেবেল ঝাঁটা সুন্দর শিশিতে ঝাজালো রঙিন ওষুধ, ওষুধ তৈরির সংক্ষিপ্ত প্রক্রিয়া, সব মিলিয়ে সে যেন একটা অভিযান। এ অঞ্চলে তখনও কবিরাজির রাজ্য চলছে। এ যুগের সঁড়াশি আক্রমণের মত দুদিকে বসেছেন দুজন ডাক্তার। উত্তর এবং দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। উত্তরে বসেছেন ভুবন ডাক্তার। বড় লাল ঘোড়ায় চেপে ব্রিচেস আর গলাবন্ধ কোট পরে ভুবন ডাক্তার মধ্যে মধ্যে এ পথে যাওয়া-আসা করেন। আর উত্তর থেকে আসেন রঙলাল ডাক্তার তসরের প্যান্টালুন, গলাবন্ধ কোট, গলায় ঝোলানো পকেটঘড়ি। রঙলাল ডাক্তার যাওয়া-আসা করেন পালকিতে। রঙলাল ডাক্তার থাকেন এখান থেকে মাইল চারেক দূরে। এ অঞ্চলে তিনিই প্রথম অ্যালাপ্যাথি নিয়ে এসেছেন। অদ্ভুত চিকিৎসক। প্রতিভাধর ব্যক্তি। মেডিক্যাল কলেজ বা স্কুলে তিনি পড়েন নি; নিজে বাড়িতে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন। নদী থেকে, শ্মশান থেকে শব নিয়ে এসে গ্রন্থের নির্দেশ অনুসারে কেটে অ্যানাটমি শিখেছেন। বিস্ময়কর সাধনা। তেমনি সিদ্ধি। কোথায় বাড়ি হুগলী জেলায়, সেখান থেকে এসেছিলেন এ জেলায় রাজ হাই ইংলিশ স্কুলে শিক্ষকতার কর্ম নিয়ে। ইংরিজিতে অধিকার ছিল নাকি অসামান্য। আর তেমনি ছিল অগাধ আত্মবিশ্বাস। বিখ্যাত হেডমাস্টার শিববাবুর ইংরিজি খসড়া দেখে দু-এক জায়গায় দাগ দিয়ে বলতেন—এখানটা পালটে এই করে দিন। ইমপ্রুভ করবে! বলতে সঙ্কোচ অনুভব করতেন না। তিনি হঠাৎ কোনো আকর্ষণে ময়ূরাক্ষী-তীরে নির্জন একটি গ্রামে এসে এই সাধনা করেছিলেন। তপস্বীর মত। তারপর একদিন বললেন–এইবার চিকিৎসা করব। এবং কিছুদিনের মধ্যেই এ অঞ্চলে অসামান্য প্রতিষ্ঠালাভ করলেন। রঙলাল ডাক্তারের চিকিৎসার খ্যাতি রঙলালকেই প্রতিষ্ঠা দেয় নি—তাঁর সঙ্গে অ্যালোপ্যাথিরও প্রতিষ্ঠা করেছিল। চারিদিকে নতুন চিকিৎসার প্রতি মানুষ শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে শুরু করলে।
জীবন ডাক্তার সেদিন কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে কবিরাজির পরিবর্তে ডাক্তারির প্রতি আকৃষ্ট হলেন। প্রতিষ্ঠা চাই, খ্যাতি চাই, অর্থ চাই, মানুষের কাছ থেকে অগাধ শ্রদ্ধা চাই। তার প্রেরণা দিয়েছিল ওই জমিদারিটুকু। জমিদারি যখন কিনেছেন বাবা তখন অবশ্যই পারবেন ডাক্তারি পড়াতে। তাই মাইনর পাস করে তিনি গেলেন কাঁদী রাজ হাই স্কুলে এন্ট্রান্স পড়তে। এন্ট্রান্স পাস করে এফ. এ. পড়বেন, তারপর ডাক্তারি।
* * * * *
গরুরগাড়িটা থামতেই ডাক্তারের তন্ময়তা ভেঙে গেল। সামনেই পরান খাঁয়ের দলিজা। এসে পড়েছেন। পুরনো কাল থেকে বাস্তব বর্তমানও বটে।
০৪. পরানের বিবি একটু ভালই আছে
পরানের বিবি একটু ভালই আছে। আরও ভাল থাকা তার উচিত ছিল। কিন্তু তা থাকছে না। নাড়ির গতি দেখে ডাক্তারের যা মনে হয় উপসর্গের সঙ্গে ঠিক তার মিল হয় না। রোগের চেয়ে রোগের বাতিকটা বেশি। এখানে ব্যথা ওখানে ব্যথা, বিছানায় শুয়ে কাতরানো, পাকস্থলীতে যন্ত্রণা-এর আর উপশম নেই। আরও মজার কথা!—রোগী তো ভাল আছে বললেই রোগ বেড়ে যায়। কী করবেন ডাক্তার। এর চিকিৎসা তাঁর হাতে নাই। তিনি বুঝতে পেরেছেন, মেয়েটি ভাল হতে চায় না। পরান খাঁয়ের স্ত্রী হিসেবে সুস্থ দেহে উঠে হেঁটে বেড়াতে সে অনিচ্ছুক। তাই ডাক্তার কৌশল অবলম্বন করেছেন, রোগ আদৌ কমে নি বলে যাচ্ছেন। আজও তাই বলবেন—তবে হ্যাঁ, ভয় কিছু নাই খাঁ। ভয় কোরো না। এ ছাড়া খাঁকেই বা বলবেন কী? ও কথা খাঁকে বললে খাঁ যে কী মূর্তি ধরবে—সে ডাক্তারের অজানা নয়। বৃদ্ধের জীবনও অশান্তিময় হয়ে উঠবে। স্বামী-স্ত্রীর অমিলনের মত অশান্তি আর নাই। তিনি নিজেও চিরজীবন জ্বলছেন। আগুন তার জীবনে কখনও নিভল না। আজও রোগী দেখে বাড়ি ফিরে দেখলেন যে। সে আগুন যেন লেলিহান হয়ে উঠেছে। কোন্ আহুতি পেয়েছে বুঝলেন না।
আতর-বউ নিজে নিষ্ঠুর আক্ৰোশে বকছে। এই মুহূর্তেও বকে চলেছে আপনার মনে। বকছে তাকে এবং নবগ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার শশী মুখুজ্জেকে। শশীই দিয়ে গিয়েছে আহুতি; সে তার অনুপস্থিতিতে এসে হাজির হয়েছিল। জীবন ডাক্তারকে না পেয়ে বাড়ির ভিতর আতরবউয়ের কাছে বসে তাকেই জ্বালাতন করে গিয়েছে। তামাক খেয়ে ছাই এবং গুল ঝেড়ে ময়লা করে দিয়ে গিয়েছে গোটা দাওয়াটা। রাজ্যের সংবাদ দিতে গিয়ে ওই হাসপাতালের ডাক্তার তাকে যে কটু কথাগুলি বলেছে, সেগুলিও আতর-বউয়ের কানে তুলে দিয়ে গিয়েছে। হতভাগা শশীর উপর আতর-বউয়ের মমতাও যত ক্রোধও তত।
জীবন মশায়ের শিষ্য শশী। তাঁর আরোগ্য-নিকেতনেই ডিসপেনসিং শিখেছিল সে এখানেই তার হাতেখড়ি। তারপর বর্ধমান গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাকা কম্পাউন্ডার হয়ে ফিরে নবগ্রামের চ্যারিটেবল ডিসপেনসারির প্রথম কম্পাউন্ডার হয়েছিল সে। কম্পাউন্ডিং সে ভালই জানে। তার সঙ্গে চিকিৎসাবিদ্যাটাও মোটামুটি শিখেছে শশী। তিনিই তাকে নাড়ি দেখতে রোগ চিনতে শিখিয়েছিলেন। কিন্তু শশী আশ্চর্য অপরিচ্ছন্ন লোক! কামানোর ঝঞ্ঝাটের জন্য দাড়িগোঁফ রেখেছে। স্নান কদাচিৎ করে, দাঁতও বোধ করি মাজে না। এক জামা পনের দিন গায়ে দেয়; উৎকট দুর্গন্ধ না হলে সেটাকও ছাড়ে না। আর প্রায় অনবরতই তামাক টানে। জামার পকেটেই থাকে তামাক টিকে দেশলাই এবং হাতে থাকে কো। তার ওপর করে মদ্যপান। মধ্যে মধ্যে বেশ হয়ে পড়ে থাকে। এই কোর জন্যেই তার নবগ্রাম ডিসপেনসারির চাকরি গিয়েছিল। পকেটে হুঁকো, কল্কে, তামাক, টিকের টিনএ না নিয়ে শশী কোনো কালেই এক পা হাঁটে না। বলে—ওরে বাবা, লোকে লুকিয়ে বাবার কো টেনে তামাক খেতে শেখে। আমি আমার কর্তাবাবার মানে বাবার বাবার কাছে তামাক খেতে শিখেছি। লুকিয়ে নয়, তিনি আমাকে নিজে সেজে তামাক খাওয়াতেন। এ ছাড়া চলতে বারণ। ছেলেদিগে বলেছি, আমি মরলে আমার চিতায় যেন হুঁকো কল্কে তামাক টিকে দেয়। দেশলাই চাই না। ও চিতের আগুনেই হবে। ডাক্তারখানার ওষুধের আলমারিতে তামাক-টিকে রাখত। কোণে গুল ঝেড়ে গাদা করত, ডাক্তার সাহেব এলে কোনো কিছু একখানা কাগজ কি কাপড় কি প্যাকিং বাক্স দিয়ে চাপা। দিয়ে রাখত। তবুও ধরা পড়ত। তিনবার ধরা পড়ে চাকরি বেঁচেছিল, চারবারের বার বাচল না। তা না বাঁচলেও শশী ওই বিদ্যেতেই বেশ করে খেয়েছে, আজও খাচ্ছে। মদ্যপানটা কিছু কমেছে এখন। ছেলেরা চাকরি করে। নিজে এখনও একটা টাকা কোনোরকমে উপার্জন করে শশী। পরামর্শের দরকার হলে মাঝে মধ্যে জীবন মশায়ের কাছে আসে। জীবন ডাক্তারকে বলে। গুরুজী! বলে অনেক শিখেছি জীবন মশায়ের কাছে। যা কিছু জানি তার বার আনা। বলে আর প্রচুর হাসে। ইঙ্গিত আছে কথাটার মধ্যে। শশী তার কাছে শুধু ডিসপেনসিং এবং ডাক্তারিই। শেখে নি, দাবা খেলাও শিখেছিল সে। আরও শিখেছিল হরিনাম সংকীর্তনে দোয়ারকি। এ দুটোতে শশীরবিদ্যা শিষ্যবিদ্যা গরীয়সী বলে তাই।
শশীকে দাবা খেলতে বসিয়ে দিয়ে বন্ধুরা তার বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে এসে খেতে দিত। শশীর বাড়িতে গিয়ে বলত, শশীদাকে আজ রাত্রে রোগীর কাছে থাকতে হবে। কল পেয়েছে। শশীদা আমাদের বললে, ভাই বাড়িতে গিয়ে আমার খাবার যদি এনে দিস, তবেই তো খাওয়া হয়। শশীদার খাবার দিন।
শশী রাত্রে খেত রুটি এবং শশীর স্ত্রীর রুটি ছিল বিখ্যাত। রাত্রি দুটোর পর শশী যখন দাবা খেলে উঠত, তখন সঙ্গীরা খাবারের শূন্য পাত্রটা তার হাতে দিত, বলত নিয়ে যাও শশীদা। তোমাদের বাড়ির থালা। শশীর আর বাড়ি যাওয়া হত না। গালাগালি দিয়ে খালি পেটেই শুয়ে পড়ত সেই আঘরে। না হলে শশীর কলের মর্যাদা যায়। পরের দিন কারুর কাছে দুটো টাকা ধার করে নিয়ে তবে বাড়ি ফিরত। বলত, কলের টাকাটা রাখ তো!
তার কাছে শেখা তৃতীয় বিদ্যা সঙ্গীত। তাতে সে অসুর। অসুর বললেও ঠিক ব্যাখ্যা হয়। না, বলতে হয় বিকটাসুর। কণ্ঠস্বর তার যেমন কৰ্কশ তেমনি সে বেমক্কা বেতালা। তার ওপর মদ্যপান না করে আসরে সে নামে না। দৃষ্টান্ত দেয় বড় বড় ওস্তাদের।
সংকীর্তনের দলে শশী তারস্বরে চিৎকার করে।
জীবন মশায় কপালে হাত দিয়ে হেসে বলেন, আমার কপাল! মধ্যে মধ্যে শশীকে বলেন শশী, একসঙ্গে বেচারা হরিকে আর তানকে মেরে খুন করি না বাবা! শিষ্যের পাপ গুরুকে। অর্সায়! আমার যে নরক হবে। শশী বলে–ভাববেন না। আপনার রথ আটকায় কোন্ শা–।
বলেই সে হা-হা করে হাসে।
এই শশী ডাক্তার।
মধ্যে মধ্যে শশী আসে পরামর্শের জন্য, সেটা যে পেকে গেল ডাক্তারবাবু!
জীবন মশায় বলেন, রোগীটা কাঁচা না পাকা আগে বল। পাকা হলে খসতে দে। তোর চিকিৎসা-দোষের চেয়ে ওর বয়সের দোষ বেশি।
রোগী তরুণ হলে শোনেন, গভীরভাবে চিন্তা করে পরামর্শ দেন।
কখনও কখনও কল দিয়ে নিয়ে যায় শশী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব কলে ফি নাই, বিনা ফিয়ের কল। শশী কম্পাউন্ডার যেখানে ডাক্তার হিসেবে চিকিৎসা করে, সেখানে চারিদিকে দৈন্য; চার আনা আট আনা ফি-তে শশী সন্তুষ্ট। সেখানে জীবন মশায়কে একটাকা ফি দেবে কোথা থেকে। তা ছাড়া জীবন মশায় এখানকার মাটি, মানুষ, গাছপালাকে নিবিড়ভাবে চেনেন। তাদের দুঃখ তিনি জানেন। তাদের জন্য তার বাপ-পিতামহের চিকিৎসালয়ে দুয়ার ছিল অবারিত। তাঁর দুয়ারও তিনি বন্ধ করেন নি। এরা কঠিন রোগে শয্যাশায়ী না হলে ও চার আনা বাঁচাতে বুকে হেঁটেও দাতব্যালয়ের দুয়ারে এসে হাজির হয়। তাদের কাছে তিনি কি ফি নিতে পারেন?
ইদানীং কিন্তু শশীর মাথায় যেন একটু গোল দেখা দিয়েছে। যুদ্ধের মধ্যে চিকিৎসাশাস্ত্রে যে। কয়টা বিস্ময়কর আবিষ্কার হয়েছে, সেই আবিষ্কারের সঙ্গে শশী কোনোমতেই তাল রাখতে পারছে না। এতদিন পর্যন্ত খুব গোল বাধে নি। তারপর সালফারুপের বিভিন্ন নামে ট্যাবলেট বের হতেই বেচারার মুশকিল হয়েছে। এর পর পেনিসিলিন স্ট্রেপ্টোমাইসিন। নূতন কালের ডাক্তাররা ওই ওষুধগুলি প্রচুর পরিমাণে প্রয়োগ করে চলেছে। পেনিসিলিন ছাড়া তো কথাই নাই। শশী ওগুলো ব্যবহার করতে খানিকটা ভয় পায়। পাবারই কথা। পাওয়াও উচিত। এর ফলে কিন্তু শশী ক্ষেপে ওঠে মধ্যে মধ্যে এবং যা করে বসে চিকিৎসাশাস্ত্রে তা অভূতপূর্ব। কিছুদিন আগে বাউরিদের কুড়োরামের কন্যার হয়েছিল নিউমোনিয়া। শশীকে কুড়োরাম বলেছিল—ডাক্তারবাবু—এই হাসপাতালের ডাক্তার বললে, কুঁড় ওষুধ দিলে শিগগির সেরে যাবে। তা—
শশী বুঝেছিল—পেনিসিলিনের কথা বলছে কুড়োরাম। চটে গিয়ে বলেছিল—নিয়ে আয় টাকা। দিচ্ছি যুঁড়ে। প্যাক করে যুঁড়ে—একটু আঙুলের ঠেল, আমার তো ওই কষ্ট। তারপর তোরা সামলাবি দেহের দাহ। টাকার দাহ আছে। তাও সামলাবি। ও ইনজেকশন দিতে আমাকে টাকা-টাকা করে ফি নিতে হবে তাও বলে দিচ্ছি।
—তা হলে?
—তা হলে যা খুশি কর। হাসপাতালের ডাক্তার তো বললে তা হাসপাতাল থেকে দিলে না কেন? ভরতি করে নিলে না কেন?
—সে আজ্ঞে জায়গা নাই। আর হাসপাতালেও উসব ওষুধ দেয় না।
—তা হলে, আমি যা বলি, তাই কর। চিরকাল খাওয়ার ওষুধ আর মালিশে বড় বড় নীলমণি কেস ভাল হয়ে এল আর আজ কুড়োরামবাবুর কন্যের বুকে খানিকটা সর্দি হয়েছে পেনিসিলিন ছাড়া আর ভাল হবে না?
–তবে তাই দেন।
শশীর মাথায় বিকৃতি কিছু হয়েছে বার্ধক্য ও নেশার জন্য, সেটা নিস্ফলতার আক্ৰোশে আরও বেড়ে যায়। সে গভীর চিন্তা করে স্থির করেছিল মালিশের সঙ্গে সরষের তেল মেশানোর পরিবর্তে কেরোসিন মিশিয়ে মালিশ করলে মালিশের কাজ দ্রুততর হবে। কেরোসিনে আগুন জ্বলে। সুতরাং তার তেজে বুকের ভিতরের সর্দি নিশ্চয় দ্রুত গলবে। যেমন চিন্তা তেমনি কর্ম। ফলে ব্লিস্টার দেওয়ার মত বুক-পাঁজর জুড়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল টলটলে এক ফোস্কা। তখন ছুটে এসেছিল মশায়ের কাছে।
জীবন ডাক্তারই ব্যাপারটা সামলেও দিয়েছিলেন। বেগ অবশ্য খুব পেতে হয় নি। প্রচুর যত্ন নেওয়ার ফলে ঘা হতে পায় নি। ফোস্কার চামড়া উঠেই নিষ্কৃতি পেয়েছে। এবং বেঁচেও উঠেছে। সেটার জন্য কৃতিত্ব কার—সে কথা জীবন ডাক্তার জানেন না। শশীর উদ্ভাবিত ওষুধের গুণই হোক, আর মেয়েটার ভাগ্যই হোক, ফোস্কা উঠলেও নিউমোনিয়াটা বাগ মেনে গিয়েছিল। বিনা পেনিসিলিনে, বিনা মালিশে, বিনা অ্যাটিস্টিনে কয়েকদিনের মধ্যে সেদিক দিয়ে বিপন্মুক্ত হয়েছিল।
এই শশিভূষণ আজ এসেছিলেন। কেন এসেছিল শশী কে জানে? হতভাগা কিন্তু আতরবউকে জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছে। আতর-বউয়ের কানে কামার-বুড়ির কথাটা তুলেছে, তা বোঝা যাচ্ছে। ছিঃ ছিঃ ছি!
আতর-বউ এখন তাঁকে এই ছুতো ধরেই বকছে। চিরটা জীবন মানুষের এক স্বভাব? বার বার ঠেকেও মানুষ শেখে না! নিদান হকার অহঙ্কার কেন? তুই অমুক দিন মরবি বলে লাভ কী? তবু যদি পাসকরা ডাক্তার হতে! ঘরে ডাক্তারি শিখে কেউ সর্ববিদ্যেবিশারদ হয়?—ছি–ছি—ছি! নবগ্রামের ডাক্তারেরা কী বলছে তা শুনে আসুক গিয়ে। আর ওই মুখপোড়া নেমকহারাম শশী বলে কিনা বোগাস!
০৫. বোগাস শব্দটা শশী প্রয়োগ করে
এই ‘বোগাস’ শব্দটা শশী প্রয়োগ করেই বেশি গোল বাঁধিয়েছে। শব্দটার অর্থ মশায়-গিন্নি জানেন না, তবে ধ্বনিগত ব্যঞ্জনা বা সমস্ত কথাবার্তার পর ওই শব্দটার অর্থ মশায়-গিন্নির কাছে অত্যন্ত অপমানজনক মনে হয়েছে।
শশীরও অবশ্য দোষ নাই। সেও এসেছিল গায়ের জ্বালায়। নবগ্রামে প্রদ্যোত ডাক্তার ব্যাপারটা নিয়ে বেশ একটা শোরগোল তুলেছে। পৃথিবীতে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা মানুষের স্বভাবধর্ম। তাই একজন প্রতিবাদ করার সঙ্গে আরও পাঁচজন আপনি এসে তার সঙ্গে যোগ দিয়ে তাকে সবল এবং প্রবল করে তোলে।
প্রদ্যোত ডাক্তার নবগ্রামের পাসকরা ডাক্তারদের সকলকেই নাকি কথাটা জানিয়েছেন। এবং ডাক্তারদের আসর থেকে বাজার-হাঁটে ছড়িয়ে পড়েছে। কথায় আছে মরার বাড়া গাল নেই। মৃত্যুর চেয়ে কঠিন এবং ভীষণ আর কিছু হয় না। আজও এর ঠিকানা মেলে নি, দিগনির্ণয় হয় নি। মানুষ মরে নিত্যই অহরহ মরছে—তবু আজও কেউ তাকে দেখে নি, তার স্বর কেউ শোনে নি, বৰ্ণে-গন্ধে-স্পর্শে-স্বাদে আজও তার এক বিন্দু আভাসও কেউ কখনও পায় নি। এর ব্যাখ্যা করা যায় না, আজও কেউ করে নি। সাধারণ মানুষে মরবি বললে কেউ ভয় পায় না। কিন্তু চিকিৎসক বললে আতঙ্কিত হয়; বিশেষ করে রোগীকে বললে তার আতঙ্কে আর ফাঁসির আসামির আতঙ্কে কোনো প্ৰভেদ থাকে না। প্রদ্যোত ডাক্তার সেই কথাই বলেছে, বলেছে—এত বড় হৃদয়হীন ব্যাপার আর হয় না। এর সঙ্গে ডাকাত বা গুণ্ডার বা খুনের ছুরি তুলে তেড়ে আসায় প্রভেদ কী? প্রদ্যোত নাকি চায় ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দরখাস্ত করা হোক। সকল ডাক্তারের সই-করা দরখাস্ত।
নবগ্রামে এখন তিনজন পাসকরা ডাক্তার। প্রদ্যোত নিজে আছে হাসপাতালে, আর দুজনের একজন হরেন ডাক্তার নবগ্রামেরই ছেলে, বয়সে প্রদ্যোত থেকে কয়েক বছর বড়। মেডিকেল স্কুল থেকে পাস করে এসে গ্রামেই প্র্যাকটিস করছে। নিজের ছোটখাটো একটি ডিসপেনসারি আছে। আর আছেন প্রৌঢ় ডাক্তার চারুবাবু।
ডাক্তারের মধ্যে চারুবাবু সর্বাপেক্ষা প্রবীণ; পঞ্চাশের উর্ধ্বে বয়স। চারুবাবুই এখানকার প্রথম এম. বি.। প্রায় পঁচিশ বছর আগে সদ্য ডাক্তারি পাস করেই এখানকার হাসপাতালে চাকরি নিয়ে এসেছেন। দশ বছর আগে চাকরি ছেড়ে স্বাধীনভাবে প্র্যাকটিস ধরেছিলেন। আজ বছর চারেক থেকে সে প্র্যাকটিস তিনি একরকম ছেড়ে দিয়েছেন। এখন এখানে ইউনিয়ন বোর্ড, স্কুল বোর্ড প্রভৃতি নিয়ে মেতেছেন বেশি। লোকে অবশ্য বলে চারু ডাক্তারের প্র্যাকটিস পড়ে এসেছিল স্বাভাবিক নিয়মে, ডাক্তার তাই ওই দিকে ঝুঁকেছেন। ডাক্তারের ছেলেরাও বড় হয়েছে। বড়টি বেশ উঁচুদরের সরকারি চাকুরে। ছোটটি ডাক্তারি পড়ছে। চারু ডাক্তার লোকটি কিন্তু সাচ্চা। দিলখোলা মানুষ, সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত হিসেবী লোক। মেজার গেলাসে মেপে দুটি আউন্স ব্র্যান্ডি সন্ধেবেলা নিয়মিত তিনি পান করে থাকেন।
এ অঞ্চলে অনেক ডাক্তারেরই কিছু-না-কিছু ব্যাড-ডেট অর্থাৎ অনাদায়ী বাকি থেকে গেছে, কিন্তু চারু ডাক্তারের খাতায় হিসেবে যেমন একচুল গলদ থাকে না তেমনি পাওনাও এক পয়সা অনাদায় থাকে না। তার কম্পাউন্ডার প্রতি মাসেই দু-চার নম্বর বাকির জন্য তামাদির। মুখে ইউনিয়ন কোর্টে গিয়ে নালিশ দায়ের করে আসে। এ বিষয়ে কেউ কেউ অনুযোগ করে কঠোর বলতেও দ্বিধা করে না, কিন্তু চারুবাবু বলেন—লুক অ্যাট জীবন মশায়। ওই বৃদ্ধকে দেখে কথা বল বাবা। পঞ্চাশ হাজার টাকা বাকি খাতায় লেখা রইলউইয়ে খেলে। দেখেই শিক্ষা হয়েছে। ঠেকে শিখতে বোলো না বাবা। এখনও চারু ডাক্তার যে অল্পস্বল্প প্র্যাকটিস করেন। তা তার নিজের ব্যক্তিগত খরচা তুলবার জন্য। তাঁর প্র্যাকটিস কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ডিসপেনসারিটিও ছোট হয়ে এসেছে। চারটে আলমারির মধ্যে এখন ওষুধ আছে মাত্র একটাতে, আর একটার পাঁচটা থাকের মধ্যে তিনটে খালি।
আরও একজন পাসকরা ডাক্তার আছেন–চক্রধারীবাবু। চারুবাবুর চেয়েও বয়সে বড়। এল. এম. এফ.। চারুবাবুর আগে তিনিই ছিলেন এখানকার চ্যারিটেবল ডিসপেনসারির ডাক্তার। তাঁর চাকরিতেই চারুবাবু বহাল হয়েছিলেন। চক্রধারী এখন প্রায় সন্ন্যাসী। বাড়িতেই আছেন তবে গেরুয়াটেরুয়া পরে দিনরাত পুজোআচ্চা করেন। প্র্যাকটিস তো করেনই না, এখন কেউ হাত দেখাতে এলে বলেন বাজে বাজে। হাত দেখে কী হবে? কেউ কিছু জানে নাকি? কিছু জানে না বাবা। সব আন্দাজে ঢিল। লাগল তো লাগল, না লাগল তাতেই বা কী, ফি তো পকেটেই এল। বাবা, রোগ হলে সারে আপনি। রোগীর দেহেই আছে সারাবার শক্তি। ডাক্তার তেতো কষা ঝাজালো ওষুধ দেয় আন্দাজে। রোগী মনে করে ওষুধে সারল। তবে হ্যাঁ, দু-চারজন পারে।
চক্রধারী তামাক খেতে খেতে শুরু করেন তাঁর প্রথম যৌবনে দেখা বড় ডাক্তারদের কথা। স্যার নীলরতন, বিধান রায়, নলিনী সেনগুপ্ত প্রভৃতি ডাক্তারদের কথা। সে সব বিচিত্র বিস্ময়কর গল্প। বলেন, সে দেখেছি বটে। এখানে রঙলাল ডাক্তারকে দেখছি। একটা গোটা ডাক্তার ছিল। আর এখানে আছে একটা মানুষ, ওই জীবন মশায়। হ্যাঁ, ও পারে। ধরতে পারে। মশায়ের নিজের ছেলে বনবিহারী, সেও ডাক্তার ছিল। আমাদের বন্ধু লোক। একসঙ্গে মদ খেয়েছি। ফুর্তি করেছি। সেই ছেলের–বুঝেছ—রোগ হল। মৃত্যু-রোগ…আমরা বুঝতে পারি নাই। কিন্তু মশায়—
রোগীর ধৈর্যচ্যুতি ঘটে যায়। সে উঠে চলে যায়। চক্রধারী হেসে বলে—গোবিন্দ গোবিন্দ। তার পরই বলেবিনা পয়সায় অনেক হাত দেখেছি। আর না।
প্রদ্যোত ডাক্তার চক্রধারীকে চিকিৎসক বলেই ধরে না। তাই তার গণনায় নগ্রামে পাসকরা। ডাক্তারের সংখ্যা মাত্র তিন জন। প্রদ্যোতের কথায় প্রতিবাদ কেউ করেন নি, হরেন ডাক্তার বা চারুবাবু কেউ না। এক রকম মৌন থেকে তার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন বলতে হবে। মানুষের মুখের উপর তুমি আর বাঁচবে না এ কথা বলার চেয়ে নিষ্ঠুর আর কী হতে পারে? এবং এতে যে রোগীর মনোবল ভেঙে যায়, রোগের সঙ্গে যুদ্ধে দুর্বল হয়ে পড়ে, এও সত্য। বাবার ইচ্ছা, বাঁচব বিশ্বাসটাই যে বাছবার পক্ষে পরম ঔষধকে অস্বীকার করবে এ কথা? হরেন ডাক্তার চুপ করে প্রদ্যোতের অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েও হাত জোড় করেছে। অর্থাৎ মার্জনা করুন। আমাকে। প্রদ্যোত ডাক্তার তীব্র তিরস্কার করেছে—ডাক্তারিকে কি আপনি শুধু আপনার জীবিকার পেশা মনে করেন হরেনবাবু? আপনার কোনো সেক্রেড ডিউটি নাই? এই ধরনের নিদান হকা আর গেরুয়ারী করকোষ্ঠী গণকদের মধ্যে তফাত কী? আর জড়ি-বুটি-তুক-তাক-জলপড়া এইসব চিকিৎসার সঙ্গে বেদেদের চিকিৎসার অনাচারের মধ্যে ডিফারেন্স কী?
হরেন জোড়হাত করেই দাঁড়িয়ে ছিল সর্বক্ষণ। প্রদ্যোতের কথার শেষে হেসে বলেছে–আমি গ্রামের লোক। এক সময় আমার বাল্যকালে উনিই আমাকে বাঁচিয়েছিলেন।
একটু থেমে আবার বলেছে—এক সময় উনি খুব ভাল চিকিৎসা করতেন প্রদ্যোতবাবু। আমি অবশ্য ছোট ডাক্তার, আমার বিদ্যাবুদ্ধি সামান্য। তবে ওঁর নাড়ি দেখে রোগ ডায়গনিসিসচিকিৎসা অদ্ভুত ছিল। এখন বৃদ্ধ হয়েছেন, হয়ত মুনিনাঞ্চ মতিভ্ৰমঃ। তার ওপর বয়স হয়েছে। এ ক্ষেত্রে। এ ছাড়া কিশোরদা নেই, তিনি আসুন, তার অ্যাবসেন্সে এটা করা ঠিক হবে না।
কিশোরবাবু! কিশোরবাবু! প্রদ্যোত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। কিশোরবাবু কে? কোনো কথা না বলে তিনি উঠে এলেন।
চারুবাবু বলেছেন—আপনি ইয়ং ম্যান, রক্তের তেজ আছে। তা ছাড়া আজ আছেন কাল। নাই। চলে যাবেন অন্যত্র। কে যেন বলছিল—এ চাকরিও আপনার ট্রপিকাল ডিজিজের এক্সপিরিয়েন্সের জন্যে। এর পর আপনি ফরেনে যাবেন। স্পেশালাইজ করবেন। আপনার কি ওই বৃদ্ধের ওপর রাগ করা উচিত? যেতে দিন। দরখাস্ত করলে ওর সঙ্গে হয়ত অনেকের অন্ন উঠবে। শতমারি ভবেদ্বৈদ্য সহস্ৰমারি চিকিৎসক। মানুষ মেরে মেরে হাতুড়েরা নিজেরাও করে খায়, লোকেরও কিছু উপকার করে। আপনার মত লোকের এ রাগ সাজে না। আমি বরং বৃদ্ধকে বারণ করে দেব। বুঝেছেন। নিদানটিদান হঁকবেন না। জানেন আমাদের সময় একটা গান। ছিল—আমরা খুব গাইতাম—যা কর বাবা আস্তে ধীরে, ঘা কর কেন খুঁচিয়ে। বলেই হো-হো করে হেসে উঠলেন চারুবাবু।
প্রদ্যোতের বেশ লাগল চারুবাবুকে আজ। এখানে এসেই চারুবাবুর সঙ্গে আলাপ সে করেছে কিন্তু সে আলাপ একেবারে যাকে বলে ভদ্রতার মুখোশ এটে বাঁও-কষাকষি ব্যাপার। আজ চারুবাবু মুখোশ খুলে কথা বলেছেন। রসিক লোক। বেশ বসিয়ে আবৃত্তি করলেন—যা কর বাবা আস্তে ধীরে। প্রদ্যোতের মন অনেকখানি নরম হয়ে গেল। একটু লজ্জাও পেলে। চারুবাবু ওই যে বললেন–বৃদ্ধের ওপর রাগ করা তার উচিত নয়।
প্রদ্যোত বললে—বেশ, আপনার কথাই মানলাম। কিন্তু বৃদ্ধকে একটু সাবধান করে দেবেন। এ সব ভাল নয়। একে তো অত্যন্ত নিষ্ঠুর, তার ওপর আনসায়েন্টিফিক। হাত দেখে নাড়ি, পিত্ত, কফ, নিদান—এসব কী?
চারুবাবু বললেন– এক সময় কিন্তু মশায় লোকটার নিদান আশ্চর্যরকম ফলেছে। তা ফলত এবং এখনও। কণ্ঠস্বর মৃদু করে বললেন– আপনি কিন্তু দেখবেন—মতির মাকে বর্ধমান কি কলকাতা পাঠাব ভেবেছেন—তাই পাঠিয়ে দেবেন। নইলে বুড়োর কথা যদি ফলে যায়।
—যাবে না। দৃঢ়স্বরে কথার মধ্যেই প্রতিবাদ এবং দৃঢ় প্রত্যয় জানিয়ে প্রদ্যোত সাইকেল চেপে চলে এসেছে। হি মাস্ট গ্রুভ হিমসেলফ প্রমাণ সে করবেই। উইচক্র্যাফটের মত এই হাতুড়ে বিদ্যের ভেলকি ভেঙে সে দেবেই। জীবনে তার মিশন আছে। শুধু অর্থোপার্জনের জন্য
সে ডাক্তার হয় নি।
কথাটা গোপন থাকে নি। ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে পল্লবিত হয়ে সারা নবগ্রামেই ছড়িয়ে পড়ল। –প্রদ্যোত ডাক্তার নাকি জীবন মশায়কে জেলে দেবে! মতির মায়ের নিদান হেঁকেছে জীবন মশায়, ডাক্তার মতির মাকে বাঁচাবে। এবং তারপর দরকার হলে মামলা করবে। ম্যাজিস্ট্রেট, কমিশনার, মিনিস্টারের কাছে দরখাস্ত করবে। দরখাস্ত করবেহাতুড়ের চিকিৎসা করা আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হোক। কথাটা নিয়ে সবচেয়ে গরম এবং তীব্র আলোচনা হল বি কে মেডিক্যাল স্টোর্সে।
বিনয়ের ওষুধের দোকান–বি কে মেডিক্যাল স্টোর্স এ অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বড় ওষুধের দোকান। ডাক্তারেরা যারা প্র্যাকটিসের সঙ্গে ওষুধেরও ব্যবসা করে তারা সকলেই বিনয়ের দোকান থেকে পাইকারি হারে ওষুধ কেনে। এ অঞ্চলে বিনয়ের দোকানের নামডাক খুব। ওষুধ নেন না শুধু চারুবাবু। চারুবাবুর দোকানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই বিনয় দোকান খুলেছিল। চারুবাবু যেবার হাসপাতালের চাকরি ছাড়েন-হাসপাতালে আসে নতুন এম. বি. অহীনবাবু, সেইবার বিনয় দোকান খোলে। অহীনবাবুই খুলিয়েছিলেন। তার যত প্রেসক্রিপশন আসত বিনয়ের দোকানে, বিনয়ের দোকানে তিনি সন্ধের সময় নিয়মিত ঘণ্টা দুয়েক করে বসতেন। বিনা ফিয়ে রোগী দেখতেন। অহীনবাবুর পর তিন জন ডাক্তার এসেছেন হাসপাতালে–তাঁরাও অহীনবাবুর মতই বিনয়ের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। প্রদ্যোত কিন্তু তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নি। তার সঙ্গে কী কী নিয়ে বিনয়ের একটু-আধটু দরকষাকষি চলছে।
বি কে ফার্মাসির বিনয় চিকিৎসা জানে না, কিন্তু চিকিৎসকদের ডাক্তার-কবিরাজদের ইতিহাসে ইতিকথায় সে প্রায় শুকদেব বললেও অত্যুক্তি হয় না। দিন-রাত্রিই বিনয় এখানকার ডাক্তারদের নিয়ে আলোচনা করে। শশী পথ দিয়ে যাচ্ছিল হরিজন পল্লীতে রোগীর সন্ধানে। বিনয় তাকে ডেকে বললে—ডাক্তার, তামাক খেয়ে যাও। তারপর রসিকতা করে বলেছে—মলে, শশী ডাক্তার, তোমরা এবার মলে। প্রদ্যোত ডাক্তার বলেছে—সব হাতুড়ের রুটি মারব। জেলে দেব ব্যাটাদের। তারপর বিস্তৃত উত্তপ্ত আলোচনা।
শশী সেই কথা এসে বলেছে ডাক্তার-গিন্নিকে।
–কী দরকার? বিনা পয়সায় মতির মায়ের হাত দেখে নিদান হকার কী দরকার? এ কাল হল বিজ্ঞানের কাল। পাসকরা ডাক্তারদের কাল। সর্দি পিত্তি কফ নিদান—সেকালে চলত। একালে ওসব কেন? যত সব! হুঁ!
এই কথাটা ডাক্তারের অন্তরে বড় লাগে। জীবনের সকল দুঃখ-ব্যর্থতার উদ্ভব ওইখান থেকেই। মানুষের দেহে যেমন একটি স্থানে অকস্মাৎ একটি আঘাত লাগে বিষমুখ তীক্ষ্ণধার কোনো বস্তুতে, তারপর সেই ক্ষতবিন্দুকে কেন্দ্র করে বিষ ছড়ায় সর্বদেহে, এও ঠিক তেমনি। তার অদৃষ্ট। অদৃষ্ট ছাড়া কী আর বলা যায়! সঙ্গতি থাকতেও তাঁর ডাক্তারি পড়া হয় নাই। তিনি কলেজে পড়ে পাস করে ডাক্তার হলে, আতর-বউ—তুমিও আসতে না এ বাড়িতে।
বিচিত্ৰ ঘটনা সে। স্মরণ হতেই ডাক্তার দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।
এক সর্বনাশী ছলনাময়ী তাঁর জীবনটাকে ব্যর্থ করে দিয়ে গিয়েছে। কাঁদী স্কুলে পাঠ্যজীবনে এই সর্বনাশীকে নিয়ে ওখানকার এক অভিজাত বংশের ছেলের সঙ্গে বিবাদ হল। ছেলেটিও তাঁর স্বজাতি, কায়স্থ। পড়ন্ত জমিদারবাড়ির ছেলে।
হায় রে অবুঝ কৈশোর! শক্তি যোগ্যতা বিচার করে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে না। কিশোর ছেলে তালপত্র খাড়া হাতে রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধ করে। রাখাল ছেলে রাজার ছেলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সঙ্কোচ অনুভব করে না, ভয় পায় না।
০৬. জীবন মশায়ের মনে পড়ল
জীবন মশায়ের মনে পড়ল। এক কিশোর শাল আর এক কিশোর তমাল চারায় প্রতিযোগিতা হয়েছিল—তাতে কিশোর তমাল লজ্জা পায় নি।
নবগ্রামে মাইনর পাস করে জীবন ডাক্তার কাঁদী গেলেন এন্ট্রান্স পড়তে। কাঁদী রাজ হাই স্কুলে ভর্তি হলেন। এন্ট্রান্স পাস করে বর্ধমান মেডিক্যাল স্কুলে ভর্তি হবেন। জীবনে সে কত কল্পনা, কত আশা। নিজের ডাক্তারি জীবনের ছবি অ্যাঁকতেন মনে মনে। রঙলাল ডাক্তারের মত গরদের পাতলুন আর গলাবন্ধ কোট পরে, সাদা একটা ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াবেন এ অঞ্চল। বুকে সোনার চেনে বাঁধা সোনার পকেটঘড়ি। থারমোমিটার, স্টেথোসকোপ, কলবাক্স। ঘরে লক্ষ্মী ছিলেন, বাপও ছিলেন স্নেহময়, অর্থের অভাব ছিল না, জীবনের দেহেও ছিল শক্তি, মনেও ছিল সাহস; সুতরাং কাঁদীর পাঠ্যজীবনে উৎসাহের সূর্তির অভাব হয় নি। একদিকে করতেন হইহই, রইরই, অন্যদিকে বোর্ডিঙের তক্তপোশে শুয়ে স্বপ্ন দেখতেন ভাবীকালে জীবন দত্ত এল. এম. এস, সাদা ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন জীবনের মোড় ফিরে গেল। সদ্যযুবক জীবন দত্ত প্রেমে পড়ে গেলেন। প্রেমে পড়েছিলেন এক দরিদ্র কায়স্থ শিক্ষক-কন্যার। তার বয়স তখন আঠার, নায়িকার বয়স বার। সেকালে চোদ্দ বছরেই মেয়েরা যৌবনে প্রবেশ করত। দেহে মনে দুইয়েই তারা একালের বেণিদোলানো সতের বছরের মেয়েদের থেকে স্বাস্থ্য এবং মনে অনেক বেশি পরিপুষ্ট হয়ে উঠত। এ মেয়েটি আবার একটু বেশি পরিপুষ্ট হয়ে উঠেছিল। আজকালকার মতে অকালপক্ব বললে একটু আপত্তি করেন জীবন ডাক্তার। বলেন অকালে পাকার আর সকালে পাকার তফাত আছে। অকালে যা পাকে তাতে গঠনে খুঁত থাকে; উপাদানে খামতি থাকে। কিন্তু সকালে যা পরিপুষ্টিতে পূর্ণতা লাভ করে পাকে তাতে খুঁত থাকে। না; যে-যে উপাদানের রস-পরিপূর্ণতায় স্বাভাবিকভাবে ফলই বল বা দেহমনই বল, রাঙিয়েওঠা রঙ ধরে মিষ্ট গন্ধে মনকে আকর্ষণ করে, তার সবই থাকে তার মধ্যে। বরং একটু বেশি পরিমাণেই থাকে, নইলে সকালে পাকে কী করে? মঞ্জরী একটু সকালে ফুটেছিল।
মেয়েটির নাম মঞ্জরী।
মঞ্জরীর স্বাস্থ্য ছিল সুন্দর। বার বছরের মঞ্জরী একালের কলেজে পড়া ষোড়শী বা পূর্ণিমার। চেয়ে স্বাস্থ্যে শক্তিতে পূর্ণাঙ্গী ছিল। শুধু চুল দেখে সন্দেহ হত যে মেয়েটি ষোড়শী নয়—কারণ। চুলগুলি পিঠ ছাড়িয়ে নিচে নামে নি। কালো চুলের রাশিটি পিঠ ছাড়িয়ে নিচে নামলে তবে ষোড়শী রূপটি পরিপূর্ণ হবার কথা। ঠিক কেমন জান? যেন কোজাগরী লক্ষ্মীপ্রতিমার পিছনে চালপট লাগানো হয়েছে অথচ তাতে ডাকসাজের বেড়টি এখনও লাগানো হয় নি। সেইগুলি অ্যাঁটা হলেই নিখুঁত হয়ে লক্ষ্মীপ্রতিমা হয়ে উঠবে। এইটুকু খুঁত ছিল। তার বেশি নয়।
একটু বাড়িয়ে বলা হয়েছে। জীবন ডাক্তার মনে মনেই সংশোধন করে নেন সেটুকু। লক্ষ্মীপ্রতিমা বটে—তবে শ্যামা। এবং তাতেই যেন অধিকতর মনোরম মনে হত মেয়েটিকে। মঞ্জরীর রূপটি তখন ছিল ভুঁইচাঁপার সবুজ নিটোল ডাঁটাটির মত, মাথায় এক থোকা ফুলের কুঁড়ি তখনও ফোটে নি; ফুটবার সব আয়োজন সম্পূর্ণ।
অন্তরের দিক থেকেও বার বছরের মঞ্জরী ষোড়শীর চেয়ে কম ছিল না। দেহের পরিপুষ্টিতায়, স্বাস্থ্যসমৃদ্ধির কল্যাণে সে তখন কিশোরীর মন পেয়েছিল। একেবারে ষোল আনার অধিকারীর চেয়েও বেশি, আঠার আনা বলা চলে; বলা চলে কেন, জীবন দত্তের হিসাবে তাই হয়। ষোল বছরে কৈশোর পূর্ণ হলে বয়স মেপে হিসেবের আইনে বার আনা তো পাওয়ারই কথা, ষোল আনার বাকি চার আনার দু আনা পূরণ করেছিল তার সমৃদ্ধ স্বাস্থ্য, বাকি দু আনা সেকালের ঘরের শিক্ষায় এবং মায়ের প্রদত্ত শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার মন্ত্রপাঠের ফলে সে পেয়েছিল। এর ওপরও বাড়তি দু আনা মূলধন তার ছিল। সে পড়ে-পাওয়া নয়, সেটা সে পড়াশুনা করে পেয়েছিল। গরিব হলেও বাপ ছিলেন শিক্ষক, বাঙলা লেখাপড়া কিছু শিখিয়েছিলেন। বাপ শিশুবোধক থেকে বোধোদয় পর্যন্ত পড়িয়ে আর পড়ান নি, বলেছিলেন, কৃত্তিবাসী কাশীদাসী রামায়ণ মহাভারত পড়। কিন্তু রামায়ণ মহাভারত পড়েও সে ক্ষান্ত হল না। বৈষ্ণব পদাবলী থেকে ভারতচন্দ্র পর্যন্ত নিজেই পড়লে। ওগুলি বাড়িতেই তাদের ছিল। খাতায় লেখা পূর্বপুরুষের সম্পদ। এরপর বঙ্কিমচন্দ্র পেল হাতে। প্রতাপ-শৈবলিনী, জগৎসিংহ-আয়ের সঙ্গে পরিচয় হতেই ষোল আনা আঠার আনায় ফেঁপে উঠল। বঙ্কিমচন্দ্র তার হাতে এনে দিয়েছিল তারই বড় ভাই।
জীবন ওখানে সহপাঠী পেলে মঞ্জরীর বড় ভাই বঙ্কিমকে। বোর্ডিঙে জীবন নামক ছুটিয়েছিল; খরচ করত দরাজ হাতে। ওই যে বাপ জমিদারি কিনেছিলেন তারই হকটা জীবন ওখানে নানাপ্রকারে ছড়িয়ে দিয়েছিল। তার মধ্যে ভাল তামাকের গন্ধটা ছিল একটি বিশেষ প্রকার। ওই গন্ধে গন্ধে এলেন চতুরানন। বঙ্কিমের নামডাক ছিল চতুরানন। ছেলেরা বলত বঙ্কিম চার মুখে হুঁকো খায় চার মুখে কথা কয়। ভাল তামাকের গন্ধে এসে বঙ্কিমই আলাপ জমিয়ে তুললে। এবং আলাপের সূত্রে আবিষ্কার করলে যে, জীবন তাদের আত্মীয়। বঙ্কিমের মামা জীবনের নিজের মামির দেওরের আপন ভায়রার নাতজামাই। এবং একদা টেনে নিয়ে গেল নিজেদের বাসায়। বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল-জীবন আমাদের আপনার লোক বাবা। বঙ্কিমের বাবা নবকৃষ্ণ সিং সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দেন নি, তবুও তিনি পরিচয় পেয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করেই সমাদর করলেন।
–দীনবন্ধু দত্ত মহাশয়ের পৌত্র তুমি? জগদ্বন্ধু দত্ত মহাশয়ের ছেলে? তোমরা তো মহাশয়ের বংশ গো। আয়ুর্বেদ তোমাদের কুলবিদ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুনেছি তোমার বাবা জমিদারি কিনেছেন।
পুলকিত হয়েছিল জীবন। সলজ্জমুখে মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ভালই লেগেছিল এ প্রশংসাবাদ।
নবকৃষ্ণবাবু বলেছিলেন–আমার বাড়িও তো তোমাদের ওই দিকে গো। চাকরি করি যাওয়া-আসা পুজোর সময় গরমের ছুটিতে বড় যাই না। দেশে তো সম্পত্তি তেমন কিছু নাই; বিঘে পাঁচ-সাত জমি, শরিকে শরিকে বিবাদ। কী করব গিয়ে? নইলে পাঁচ কোশ দূরে বাড়ি, আত্মীয়তাও যাহোক একটা আছে, আলাপ থাকত। তা ভাল হল আলাপ হল। কিন্তু
একটু ভুরু কুঁচকে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন কিন্তু তুমি যে ইংরেজি পড়তে এলে?
প্রশ্নের মর্মার্থ বুঝতে পারে নি জীবন; উত্তরে প্রশ্নের সুরেই বলেছিল—আজ্ঞে?
—তোমাদের তো আয়ুর্বেদই এক রকম কুলগত বিদ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুলধৰ্মও বলতে পারি। এর জন্যে তোমার সংস্কৃত পড়া উচিত ছিল গো। ইংরেজি পড়তে এলে কেন? বিদ্যাই শুধু নয়, বাধা টাট, বাঁধা ঘর,সে এক রকম যজমানের মত। ওই থেকেই তো তোমাদের প্রতিষ্ঠা, মহাশয় উপাধি; জমি পুকুর জমিদারি সব তো ওই থেকে।
জীবন বলেছিল—আমার ইচ্ছে ডাক্তারি পড়ব।
—ডাক্তারি! বাঃ বাঃ! খুব ভাল হবে। সে খুব ভাল হবে। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন নবকৃষ্ণ সিংহ। তারপর তিনি বলেছিলেন যাও, বাড়ির ভিতরে যাও। বঙ্কিম, নিয়ে যা তোর মায়ের কাছে। তিনি তো হলেন আসল আত্মীয়। আমরা তো তার টানে-টানে আত্মীয়! যাও।
মঞ্জরী তখন উঠানে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে আনি-মানি ঘুরছিল। গাছকোমর বেঁধে হাত দুটোকে দুদিকে প্রসারিত করে দিয়ে বনবন করে খাচ্ছিল ঘুরপাক। মুখে সে ছড়া আওড়াচ্ছিল–
আনি মানি জানি না
পরের ছেলে মানি না
লাগলে পরে নাইকো দোষ
মানব নাকো রাগ কি রোষ
সরে যাও–সরে যাও
নইলে এবার ধাক্কা খাও।
বলেই পাশে ঘুরন্ত ভাইদের কোনো একজনের সঙ্গে খাচ্ছিল ধাক্কা। একজন—সে ভাই-ই হোক বা বোনই হোক পড়ছিল। পড়ে গিয়ে কেউ অবশ্য এসব ক্ষেত্রে রাগ-রোষ সত্যই করে না, পড়ে শুয়েই থাকে চোখ বুজে, মনে হয় মাটি দুলছে—আকাশ দুলছে–ঘরগুলোও দুলছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছে অতলের কি পাতালের দিকে সে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। সর্বাঙ্গ কেমন শিরশির করতে থাকে।
বঙ্কিম জীবনকে নিয়ে ঘরে যখন ঢুকল তখন মঞ্জরী পাক খেতে খেতে কাউকে ধাক্কা মারবার উদ্যোগ করছে এবং ঘুরপাকের বেগের মধ্যে ঠিক ঠাওর করতে না পেরে দাদা ভ্রমে জীবনের হৃৎপিণ্ডের উপর মারলে ধাক্কা; এবং নিজেই পড়ে গিয়ে খিলখিল করে হাসতে লাগল। জীবন দত্ত থ মেরে দাঁড়িয়ে গেলেন। এদিকে মঞ্জরীর হাসিও স্তব্ধ হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের। মধ্যে। তার ভুল ভেঙেছে। দাদা ভ্ৰমে অপরিচিত একজনকে ধাক্কা মেরেছে বুঝে বিস্ময়ে ও লজ্জায় চোখ দুটো বড় করে ভূমিশয্যা থেকে উঠেই ও মাগো বলে ছুটে পালিয়ে গেল। গৃহাভ্যন্তরে। এবং আবার শুরু করলে খিলখিল হাসি। জীবন বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
সে আমলে ওই যথেষ্ট।
ঘটনার ওইখানেই শেষ নয়, আরও আছে।
বঙ্কিম পলায়নপরা মঞ্জরীকে উদ্দেশ করে হেসে বলেছিল—মর হতচ্ছাড়ী! তারপর মায়ের সঙ্গে জীবনের পরিচয় করিয়ে দিলে। জীবন তাকে প্রণাম করতে গিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন না না। তুমি তো সম্পর্কে আমার বড় গো। আমার দাদা তোমার মাসিমার দেওরের ভায়রার নাতজামাই। সে হিসেবে তুমি আমার দাদার কোনো শ্বশুর-টশুর হবে। আমারও তাই তা হলে। বোসো, বোসো। প্রণাম আমিও তোমাকে করব না, তুমিও আমাকে কোরো না।
বঙ্কিম এ সম্পর্ক নির্ণয়ে খুব খুশি হয়েছিল—তা হলে তো তার সঙ্গে সম্পর্ক আর এক পর্ব তফাত অর্থাৎ তৃতীয় পুরুষ। নাতি দাদামশায় সম্পর্ক রসিকতার অবাধ অধিকার।
মা খাবার আনতে উঠে যেতেই বঙ্কিম ভিতরে গিয়ে মঞ্জরীকে ডেকে বলেছিল—আয় না হতচ্ছাড়ী, দাদামশায় দেখবি।
–কে? মঞ্জরীর কণ্ঠস্বর ঈষৎ চাপা হলেও শুনতে পাচ্ছিল জীবন।
–দাদামশায় রে!
–দূর! ওই আবার দাদামশায় হয়! ও একটা বুনো শুয়োর, মা গোকী হেঁতকা চেহারা, কালো রঙ!
—ছি! তুই ভারি ধিঙ্গি হচ্ছিস দিন দিন। আমাদের বড় মামা হল ওর মাসিমার দেওরের নিজের নাতজামাই।
—মরণ! সইয়ের বউয়ের বকুলফুলের বোনপোবউয়ের বোনঝি-জামাই!
–না। না। উঠে আয়, আমার বন্ধু। খুব ভাল ঘরের ছেলে।
–ভাল ঘরের ছেলে তো এমন হেতকা বুনো শুয়োরের মত চেহারা কেন?
–কী যা বলছিস? বীরের মত চেহারা। মুগুর ভাঁজে কিনা!
—তা হলে পড়তে না এসে যাত্রার দলে ভীম সাজতে গেল না কেন? আমরা সত্যিকারের ভাল গদাযুদ্ধ দেখতে পেতাম। তুই যা—আমি যাব না।
বঙ্কিম একটু ক্রুদ্ধ হয়েই ফিরে এল।
জীবনও বন্য বরাহের মত মাথা হেঁট করেই বসে ছিল; খুব প্রীতিপ্রদ নয়, তরুণ বয়সে ও কথায় কারুরই পুলক-সঞ্চার হয় না। সে চলে আসবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল। বললে—আজ যাব ভাই, কাজ আছে।
মা ঠিক এই সময়েই জলখাবারের থালা নিয়ে বেরিয়ে এলেন। থালাখানি নামিয়ে দিয়ে ডাকলেন মঞ্জী কই? মঞ্জী—জল নিয়ে আয় এক গেলাস। মঞ্জী!
মাটি বড় রাশভারী লোক। অমান্য সহজে করা যায় না। জীবন ওই কণ্ঠস্বর শুনেই না বলতে গিয়েও বলতে পারলে না। মঞ্জরীও মিনিটখানেকের মধ্যেই জলের গেলাস হাতে বেরিয়ে এল।
মা বললেন– প্রণাম কর। দাদার বন্ধুই শুধু নয়, আমাদের আপনার লোক। তাদের দাদামশায় হয়।
মঞ্জরী মুখে কাপড় চাপা দিয়ে হাসতে লাগল।
–হাসছিস যে? প্ৰণাম কর।
–ওইটুকু আবার দাদামশাই হয়?
–হয়। মামা-কাকা বয়সে ছোট হয় না? তুলসীপাতার ছোট বড় আছে?
মঞ্জরী এবার প্রণাম করলে। সে আমলে গড় করে প্রণাম করত। এ আমলের মত হেঁট হয়ে পা ছুঁয়ে মাথায় ঠেকানো প্ৰণাম নয়। উঠেই আবার হাসতে লাগল।
মা বিরক্ত হয়েই বললেন– হাসছিস কেন?
–দাদামশাই মিলছে না বলে হাসছি।
–কী? কী মিলছে না?
–দাদামশায়ের গালে কাদা কই? ছড়ায় আছে, ঠাকুরদাদা গালে কাদা–। বলেই মঞ্জরী হাসতে হাসতেই চলে গেল।
এরপর কিশোর জীবন দত্তের অবস্থার কথা বোধ করি না বললেও চলে।
সে একেবারে উন্মত্ত হয়ে উঠল। মঞ্জরী! মঞ্জরী! মঞ্জরীকে সে জয় করবেই। কিন্তু অকস্মাৎ পথ রোধ করে দাঁড়াল একজন।
এই হল সেই ছেলে যার সঙ্গে বিবাদ করে জীবনের সমস্ত আশা বিসর্জন দিয়ে তিনি বাড়ি ফিরেছিলেন। অভিজাত বংশের উগ্ৰ দাম্ভিক ছেলে ভূপতিকুমার বসু। লোকে ডাকত ভূপী বসু বলে। ভূপী বসুওখানকার নামজাদা দুর্দান্ত। মাঝখানে শহরে-বাজারে বেশ গা দুলিয়ে হেলে দুলে যে মাতঙ্গ-গমন ধরনের চলনটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেটা ওখানে অর্থাৎ কাঁদী অঞ্চলে আমদানি করেছিল ভূপী বোস। সে যখন যে পাখানা ফেলত-তখন তার সর্বাঙ্গটা সেই দিকে লোকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যেন হেলে যেত। সামনে বা পিছনে যারা থাকত তারা বাধ্য হয়ে দেখত; পাশে যারা চলত—যাদের পাশে তাকাবার অবকাশ থাকত না, তারা এই দোলার ধাক্কা খেয়ে তাকিয়ে সভয়ে সরে যেত; ওরে বাবা, ভূপী বসু যাচ্ছে।
ভূপী বসু ছিল গৌরবর্ণ দীর্ঘাকৃতি। মাথায় রেখেছিল বাবরি চুল; জমিদারের বাড়ির ছেলে। এই ভূপীও ছিল বঙ্কিমের বন্ধু। অনেক আগে থেকেই সে মঞ্জরীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল।
সুতরাং ভূপী বোসের সঙ্গে আরম্ভ হল প্রতিযোগিতা। ব্যাঘ্র-বরাহ-সংবাঁদরচনা শুরু করলেন কৌতুকপ্রিয় বিধাতা। ভূপী বোস ব্যাঘ্ৰ, জীবন দত্ত বরাহ। এ নাম মঞ্জরী দিয়েছিল।
০৭. বোর্ডিঙে পাশের সিটের ছাত্র
তাঁর সহপাঠী, বোর্ডিঙে পাশের সিটের ছাত্র, এরা তাঁকে সাবধান করে দিয়েছিল। কিন্তু একটু দেরি হয়ে গিয়েছে তখন। দোষ তাদেরও ছিল না, কিশোর জীবনেরও ছিল না।
সহপাঠীরা জানত না যে জীবন বুকে মঞ্জরীর ধাক্কা খেয়েছে এবং ধাক্কা খেয়েও সেইদিকেই ছুটেছে। এবং জীবনও জানত না যে, ভূপী বোস-রূপী ব্যাঘাটি মঞ্জরীর প্রত্যাশায় ওত পেতে বসে আছে। সে সময়ে সামান্য একটা কারণে অভিজাত-কুলপ্ৰদীপ ভূপী বোস মঞ্জরী ও মঞ্জরীর মায়ের উপর রাগ করে ওদিক দিয়ে যাওয়া-আসা বন্ধের ভান করে বসে ছিল। এরই মধ্যে বরাহ প্রবেশ করল।
ভূপী জীবন থেকে বয়সে বেশ ক-বছরের বড়। কিন্তু ফেল করেও জীবনের এক ক্লাস উপরে পড়ে। কাঁদী স্কুলের সর্বজনপরিচিত ভূপী। কাঁদী স্কুলে সেকালে যারাই পড়েছে তারা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পাঁচ দিন বা সাত দিনের মধ্যেই তাকে চিনেছে। প্রথমেই চোখে পড়ত তার হেলেদুলে চলন। তারপর শুনত তার বিচিত্র বাগবিন্যাস।
—কোথায় বাড়ি রে ব্যাটাচ্ছেলে? দরিদ্র অবস্থার পাড়াগেঁয়ে ছেলেদের প্রতি এইটিই ছিল তার প্রথম প্রশ্ন।
তার চেহারা বেশভূষা এবং বাগভঙ্গিতে আগন্তুক দরিদ্র সন্তানেরা শঙ্কিত হত, একালের মত বিদ্রোহ করা তাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। কাল ছিল বিরূপ। তারা সসম্ভ্ৰমেই বলত গ্রামের নাম। তারপরই ভূপী প্রশ্ন করত—অ! কোন্ থানা র্যা? কোন্ পরগনা? কত নম্বর লাট?
তারপর বলতওইখানে আমাদের একটা লাট আছে ৫০৭ কি ৭০৫ একটা নম্বর তাতে সে লাগিয়ে দিত।
জীবন দত্তের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে কিন্তু এই ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে নাই ভূপী; একটু খাতির করে বলেছিল—কোথায় বাড়ি হে ছোকরা? জীবনের বলিষ্ঠ দেহ এবং বেশ ফিটফাট পোশাক দেখেই তাকে র্যা এবং ব্যাটা না বলে বলেছিল হে এবং ছোকরা।
প্রথম দিন জীবন ভড়কে গিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে বিরক্তও হয়েছিল। কিন্তু সে বিরক্তি গোপন করেই বলেছিল—নবগ্রাম।
বলেই সে চলে গিয়েছিল। দন্তী নখী, শৃঙ্গীদের সান্নিধ্য পরিত্যাগই শ্ৰেয়,এই বাক্যটি স্মরণ করেছিল এবং ভূপীকে ওই দলেই ফেলেছিল। কিন্তু ভূপী ছাড়ে নাই। সে নিজেই এসেছিল এগিয়ে, দু-চার দিন পরেই একদিন বোর্ডিঙে জীবনের ঘরে এসে বলেছিল—শুনলাম নাকি ছোকরা, তুমি তামাক খাও ভাল। কই খাওয়াও দেখি! দেখি কী তামাক তুমি খাও! ভূপীর কণ্ঠস্বর রীতিমত পৃষ্ঠপোষকের কণ্ঠস্বর।
জীবন দুর্দান্ত ছিল, কিন্তু অভদ্র ছিল না। এবং জমিদারি যত কালের পুরনো হলে জমিদার বংশে পচ ধরে তাদের একখানা জমিদারি ততকালেরও পুরনো হয় নি। এবং সত্য বলতে কি, সেদিন একটু গোপন খাতিরও মনে মনে অনুভব করেছিল সে ভূপী বোসের প্রতি। বড় বংশের ছেলে, ভাল চেহারা, এমন বোলচাল, তার ওপর জীবন বিদেশী, ভূপী এখানকারই লোক, সুতরাং ওটা স্বাভাবিক ছিল। জীবন সেদিন তামাকও খাইয়েছিল। সেদিন যাবার সময় ভূপীর হঠাৎ নজর পড়েছিল জীবনের মুগুর দুটোর ওপর। একটু নেড়েচেড়ে দেখেও গিয়েছিল। হেসে নামও দিয়ে গিয়েছিল—মুদ্গর সিংহ।
ঝগড়াটা লাগল হঠাৎ।
ভূপী বোস নবকৃষ্ণ সিংহের বাড়ি থেকে বের হচ্ছে, জীবন ঢুকছে। ভূপী পান চিবুচ্ছিল, সঙ্গে বঙ্কিম, পিছনে বঙ্কিমের মা। জীবনের অনুপস্থিতিতে গরমের ছুটির মধ্যে ভূপীর সঙ্গে ওদের ঝগড়া মিটে গেছে।
জীবনের সঙ্গে একজন মুটে। তার দেশের লোক; গরমের ছুটির পর দেশ থেকে ফিরেছে। স্কুলে, আসবার সময় মস্ত আঁকায় বাগানের আম, ক্ষেতের ফুটি, কিছু তরকারি এবং খড় দিয়ে মুড়ে একটা মাছও এনেছে।
ভূপী থমকে দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হেসে বললে, কী রকম? মুদ্গর সিংহ এখানে? এ বাড়িতে।
পিছন থেকে তীক্ষ্ণ কণ্ঠের কথা ভেসে এল—উনি আমাদের সইয়ের বউয়ের বকুলফুলের বোন-পো বউয়ের বোনঝি-জামাই, আপনার লোক, সম্পর্কে আমার দাদামশাই! কী এনেছ গা দাদামশাই?
সকলের পিছন থেকে মঞ্জরী মুখে কাপড় চাপা দিয়ে হেসে সামনে এসে দাঁড়াল।
ভূপীও সঙ্গে সঙ্গে ফিরল। বললে—চল–চল—দেখে যাই দাদামশাই মুদ্গর সিংহ কী এনেছেন? নামা ঝুড়িটা।
জিনিসপত্রগুলি দেখে মুখ বেঁকিয়ে একটা আম তুলে নিয়ে দাঁতে কেটে একটু রসাস্বাদ করেই থুথু করে ফেলে দিয়ে বললে—আমড়া! আমি ভেবেছিলাম আম! কাল আমি আম পাঠিয়ে দেব। গোলাপখাস, আর কি বলে, কিষণভোগ। আমের গায়ে কাগজের টিকিটে লেখা থাকবে-কবে কখন খেতে হবে। ঠিক সেই সময়ে খাবেন কিন্তু। না হলে ঠিক স্বাদ বুঝবেন না।
ভূপী চলে গেল। মঞ্জরীর মা বললেন–এস বাবা। ভাল তো সব?
–হ্যাঁ ভাল। আমি কিন্তু চলি এখন। এই তো আসছি। বোর্ডিঙের বারান্দায় জিনিসপত্র পড়ে আছে। গাড়োয়ানকে রেখে এগুলি দিতে এসেছিলাম আমি। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না, ভূপীর কথাগুলিতে রীতিমত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল।
–একটু জল খেয়ে যাবে না?
–না। গাড়োয়ানটা অজ পাড়াগেঁয়ে। ভয় পাবে, আমি যাই।
কিশোর জীবন দত্ত সেদিনই ভূপীর অ্যাঁচটা অনুভব করেছিল। এবং সেই হেতুই সেদিন তার সহপাঠী বোর্ডিঙের পাশের সিটের বন্ধুটিকে সব কথা বলেছিল বাধ্য হয়ে। না বলে উপায়ও ছিল না। এত বড় মাছটা এবং এতগুলি আম ও ফুটির ওপর ছেলেদের লোভ হয়েছিল দুর্দান্ত। কোথায় কোন্ বাড়িতে এগুলি গেল জানতে তাদেরও কৌতূহলের অন্ত ছিল না। কাজেই প্রশ্নেরও বিরাম ছিল না। অবশেষে বলতে হল নাম।
বন্ধুরা শুনে শিউরে উঠল।—ওরে বাবা, গেছিস কোথায় তুই? বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা বাঁধতে গেছি! ও যে ভূপী বোসের মঞ্জরী।
–ভূপী বোসের মঞ্জরী?
–হ্যাঁ বাবা। ওদিকে হাত বাড়িয়ো না মানিক। হাত কেটে নেবে।
জীবন দত্ত কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে প্রশ্ন করেছিল—কথা পাকা হয়েছে কি না জান?
–না। তবে
–ব্যস। তবে দেখা যাক মঞ্জরী কার মঞ্জরী তো এখনও বাপরূপী গাছে ফুটে আছে রে। যার মুরদ থাকবে সেই পেড়ে মালা গেঁথে গলায় পরবে। আমিও জীবন দত্ত।
গাড়োয়ানের হাতেই সে মাকে একখানি গোপন পত্র পাঠালে—অবিলম্বে পঞ্চাশটি টাকা চাই। সেদিনের পঞ্চাশ টাকা আজ উনিশ শো পঞ্চাশ সালে অন্তত দু হাজার টাকা।
লাগল সংঘর্ষ।
প্রথমটা ভূপী বোস গ্রাহ্যই করে নাই। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ওই বরাহটা! বঙ্কিম অথবা মঞ্জরী দুজনের মধ্যে একজনের কাছে নিশ্চয় সেই প্রথম দিনের বরাহ-সম্বোধন-বৃত্তান্তটা শুনেছিল। এবং মনে মনে নিশ্চয়ই প্রচণ্ড কৌতুক ও পরম পরিতৃপ্তি অনুভব করেছিল। মঞ্জুরী জীবন দত্তকে দেখে বুনো শুয়োর বলেছিল বলে ভূপীও তার নামকরণ করেছিল বরাহ। আরও বলত মুদ্গর সিংহ। ওইসব নামে সে তাকে অভিহিত করত। অবশ্য আড়ালে। আর আমড়ার-স্বাদবিশিষ্ট আমের টুকরি বা কতকগুলো ফুটি কি একটা মাছকে সে মূল্যই দিত না। ওর বদলে কলমের গাছের অল্প গোটাকয়েক ল্যাংড়া কি বোম্বাই কি কিষণভোগ নামবিশিষ্ট আম এবং গণ্ডাকয়েক লিচু কি গোলাপজাম বা জামরুলের মূল্য যে বেশি এটা সে জানত। তার ওপর তার রূপ-গৌরব সম্পর্কে সে ছিল পূর্ণমাত্রায় সচেতন। কাজেই সে গ্রাহ্য করে নাই।
এদিকে জীবন নিজের পেলবরূপের অভাব পূরণ করতে হয়ে উঠল বিলাসী। বাড়িতে তার টাকার চাহিদার অঙ্ক বাড়তে লাগল। জগদ্বন্ধু মশায় বেশ একটু চিন্তিত হলেন। তবুও একমাত্র ছেলের দাবি সহজে অগ্রাহ্য করলেন না। বাপের কাছ ছাড়াও মায়ের কাছ থেকে টাকা আনাত জীবন। পুরো দাবিটা বাবাকে জানাতে সাহস করত না।
তার জন্য জীবন কখনও আক্ষেপ করেন নি। আজও করেন না।
কী আক্ষেপ? যৌবনের স্বপ্ন, নারীপ্রেমের প্রতিদ্বন্দিতা, এর চেয়ে মাদকতাময়, এর চেয়ে জীবনের কাম্য কৈশোরে আর কী আছে? শুধু কি কৈশোরে যৌবনে? সমস্ত জীবনে কোনো নারীকে যে সম্পূর্ণভাবে জয় করে জীবন ভরে পেয়েছে তার চেয়ে ভাগ্যবান কে আছে? মঞ্জরীর প্রেমের প্রতিযোগিতায় যদি জমিদারির এক আনা ছ-গঙা দু-কড়া দু-ক্রান্তি বিক্রি হয়েই যেত—তাতেই বা কী হত! তাতেও আক্ষেপ হত না তার।
তাই হয়ত যেত। বাবার কাছে টাকা না পেলে সে ধার করত। তখন তার হালচালে সেখানে রটে গিয়েছিল জীবন দত্ত ধনী বলে নয়—নামজাদা ধনীর ছেলে! সুতরাং টাকা ধার পেতে সেই আমলে তাকে কষ্ট পেতে হত না। বঙ্কিমদের বাড়িতে নিত্যনূতন মনোহারী উপঢৌকন পাঠাতে লাগল সে।
কাদীর বাজারে তখন তার নাম ছুটে গেল বাবুজী বলে। জীবন বাজারের রাস্তায় বের হলে দোকানিরা বলত-কী বাবুজী? কোনদিকে যাবেন?
খাস লালবাগের ছোঁয়াচ-লাগা কাঁদীতে আমীরি আমলের জী শব্দটা তখনও বেঁচে ছিল। কোম্পানির আমলের বাবু শব্দের সঙ্গে ওটিকে লাগিয়ে বাবুজীই ছিল ওখানকার সম্মানের আহ্বান।
জীবন বাবুজী হাসত।
ওসমান শেখ ওখানকার সব থেকে বড় মনোহারী দোকানের মালিক, তার সঙ্গে ব্যাপারটা আরও অনেকটা অগ্রসর হয়েছে। জীবন ওসমানকে বলত-চাচাজান। ওসমান বলত বাপজান। ওসমান শেখের মস্ত দোকান, দু-তিনটে শাখা। মনোহারী, জুতো, তামাক। বাকি খাতার পাতায় সসম্ভ্ৰমে জীবন বাপজানের নামপত্তন করে নিয়েছিল ওসমান চাচা। চাচা মানুষ চিনত। জীবনের প্রয়োজন না থাকলেও চাচা তাকে ডেকে বলত—বাপজান! আরে, শুনো শুনো!
–কী চাচাজান?
–আরে বাপজান আজ চার-পাঁচ রোজ তুমাকে টুড়ছি। নতুন খোশবয় এনেছি। শহরে (অর্থাৎ মুরশিদাবাদ) গেলাম, মহাজন দেখালে—দেখ ওসমান, খোশবয় দেখ। আতর ছোট হয়ে গেল। নিয়ে যাও-রাজবাড়িতে দিবা। রাজবাড়ির জন্যে নিলাম, আর তিন জমিদারবাড়ির জন্যে নিলাম, হাকিমদের জন্যে নিলাম। পরেতে বললাম আর দু শিশি! তুমার তো দু শিশি চাই আমি জানি। নিজের জন্য এক শিশি; আর
হেসে চাচা বলত—আর ই বাড়ির জন্য এক শিশি! নিয়ে যাও।
সঙ্গে সঙ্গে কাগজে মুড়ে তার হাতে তুলে দিত।
—দাম?
—সে হবে। নিয়া যাও তুমি। আর আমি রাখতে পারব নাই। ইয়ার মধ্যে ভূপী চাচা এসেছে দুদিন। ওই উকিল সাহেবের বাড়িতে দেখেছেন ই খোশবয়। বলে আমার চাই দু শিশি। দাও। আমি বলি নাই। সে বলে–জরুর আছে। আমি দোকান তল্লাশ করব। তুমি লুকায়ে রেখেছ, জীবনটারে দিবে। অনেক কষ্টে রেখেছি। নিয়া যাও তুমি। দাম সে খাতায় লিখে রাখব। তার তরে তোমার ভাবনা কী?
ওই গন্ধ রুমালে মেখে জীবন ভূপী বোসের সান্নিধ্যে এসে রুমালখানা পকেট থেকে বের করে মুখ মুছতে শুরু করত। ভূপী চকিত হয়ে উঠত। তার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাত। জীবন। বুঝত এবং হাসত। প্রশ্নটা ভূপীর এই—মঞ্জরীর কাপড়ে এবং এই বরাহটার রুমালে একই মিষ্টি গন্ধ কী করে এল?
ভূপী অবশ্য হটবার ছেলে নয়, ঠিক পরদিনই সেই গন্ধ সে রুমালে মেখে আসত। জীবন ভাবতেন—ভূপী বোস তো যে-সে নয়, ওসমান চাচার দোকানে না পেয়ে নিশ্চয় মুরশিদাবাদ থেকে আনিয়েছে।
হায়তখন কি জানতেন যে, মঞ্জরীকে পাঠানো উপঢৌকনটি ভূপীর কাছে এসেছে বিচিত্রভাবে!
থাক সে কথা। ও নিয়ে আক্ষেপ কেন? কোনো কিছু নিয়েই আক্ষেপ জীবন দত্ত আর আজ করেন না। পরিহাস করেন। প্রেম এক প্রকারের সাময়িক উন্মাদ রোগ। সেই রোগে সদ্যযুবক। জীবন দত্ত সেদিন আক্রান্ত হয়েছিল।
ভূপী বোসের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে হার মানবার চরম মুহূর্তটির আগেকার মুহূর্তে পর্যন্ত ভেবেছিল সে জিতেছে। জয় তার অনিবার্য। মনে করেছিল, পরাজয় আশঙ্কায় ভূপীর মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠেছে।
ভূপী বোস তখন জীবন দত্তের অর্থব্যয়ের প্রাচুর্য দেখে বেশ খানিকটা শঙ্কিত হয়ে উঠেছে। মধ্যে মধ্যে ছুতোনাতায় কথা-কাটাকাটি করত। জীবন আমোদ অনুভব করত। সঙ্গে সঙ্গে দুচার বার ডাম্বল ভঁজার ভঙ্গিতে হাত ভঁজত ভূপীর সামনেই। নিত্য মুগুর ভাজাটা সে বজায় রেখেছিল। এবং বোর্ডিঙে সহপাঠীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে রুটি খেত পঁচিশ থেকে তিরিশখানা। ভূপী তার দেহ দেখেও ভয় পেত। জীবন হাসত। জয় তার অনিবার্য। সম্পদের প্রতিযোগিতায় তার জয় হয়েছে, বীর্যের প্রতিযোগিতায় সে শ্ৰেষ্ঠ; স্বয়ংবরে আর চাই কী?
হায় রে হায়! হায় রে মানুষের দম্ভ! আর বিচিত্র মানুষের মন! বিশেষ করে নারীর মন! ও যে কিসে পাওয়া যায়, এ কেউ বলতে পারে না।
হঠাৎ একদিন জীবন দত্তের ভুল ভেঙে গেল। ভূপী বোসের সঙ্গে হয়ে গেল চরম সংঘর্ষ। এবং সম্পদ ও শক্তিতে শ্ৰেষ্ঠতা সত্ত্বেও সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
সেদিন দোলের দিন।
বেশ একটি মূল্যবান উপঢৌকনের ডালা সাজিয়ে জীবন দত্ত মঞ্জরীদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তখনও মঞ্জরীর সারা অঙ্গের কোথাও এক ফোঁটা আবীরের চিহ্ন ছিল না। জীবনের অভিপ্রায় ছিল সে-ই তার শ্যামল সুন্দর মুখখানিকে প্রথম আবীর দিয়ে রাঙিয়ে দেবে। প্রথমেই দেখা হল মঞ্জরীর মায়ের সঙ্গে। সে উপঢৌকনের ডালাটি তার সামনেই নামিয়ে দিয়ে বললে–মা পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমার কাছে আপনাদের কথা শুনেছেন কিনা।
মঞ্জরীর মা গম্ভীর মানুষ, জীবন তাকে ঠিক বুঝতে পারত না। একটু কেমন ভয় করত। যেন ভালও লাগত না লোকটিকে।
তিনি মুখে বললেনো না, এসব ঠিক নয় জীবন। বলে ডালাটি হাতে করে উঠে গেলেন উপরতলায়। নিচে রইল মঞ্জরী মঞ্জরীর মুখে চোখে নিষ্ঠুর কৌতুক। এ নিষ্ঠুর কৌতুক জীবনের যেন ভালই লাগত এবং এই নিষ্ঠুরতার জন্যেই তার কৌতুক যেন বেশি মধুর মনে হত, বেশি। করে টানত তাকে।
একলা পেয়ে জীবন পকেট থেকে আবীর বের করে বললে–নাতনীক আজ মাখাব কিন্তু।
মঞ্জরী হেসে বললে–আমিও মাখাব। রঙ গুলে রেখেছি। দাঁড়াও দাঁড়াও। সে ছুটে গেল ঘরের মধ্যে। বেরিয়ে এল হাত দুটি পিছনে রেখে। জীবনের তখন শ ছিল না। সে সঙ্গে সঙ্গে মঞ্জরীর মুখে মাথায় মাখিয়ে দিলে আবীর। এদিকে মঞ্জরীর দুখানি হাত মুখের সামনে উদ্যত হল, দুই হাতে মাখানো আলকাতরা।
জীবন সভয়ে পিছু হটল। সঙ্গে সঙ্গে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে বাহির দরজার দিকে ছুটল, বন্য বরাহের মত।
বাহির দরজার মুখেই তখন ব্যাঘ্ৰ। ব্যাঘ্রের পশ্চাতে প্রজাপতি চতুরানন বঙ্কিম।
বন্য বরাহে এবং ব্যাঘ্রে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়ে গেল। দ্রুত ধাবমান সবল দেহে জীবন দত্তের সঙ্গে ধাক্কা লাগল ভূপী বোসের; বঙ্কিম তখন রাস্তার উপর থেকে লাফ দিয়ে উঠেছে মঞ্জরীর দাওয়ায়। জীবন দত্তের ধাক্কা সহ্য করতে পারলে না ভূপী। একেবারে চিৎ হয়ে উল্টে যাকে বলে সশব্দে-ধরাশায়ী-হওয়া তাই হল ভূপী বোস। জীবন ধাক্কা খেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। আঘাত তাকেও কম লাগে নি, কিন্তু সে সহ্য করবার শক্তি তার ছিল। এবং একটু সামলে নিয়েই সে সত্য সত্য সহানুভূতির সঙ্গে হাত ধরে তুলতে গেল ভূপী বোসকে। ইচ্ছাকৃত না হোক, অনিচ্ছাকৃত হলেও ত্রুটিটা তারই বলে মনে হল তার। শুধু সে তাকে হাত ধরে তুলেই নিরস্ত হল না। ভূপীর শরীরে কোথাও আঘাত লেগেছে কি না দেখতে চেষ্টা করলে, ধুলো ঝেড়ে দিলে অপরাধীর মত।
এই অবসরে ভূপী ছিটকে যাওয়া পায়ের জুতোপাটিটা কুড়িয়ে নিয়ে তার মাথায় মুখে পিঠে আথালিপাথালি মারতে শুরু করলে। গাল দিলে—শুয়ার কি বাচ্চা। হারামজাদা! উল্লুক!
ব্যস। উত্তের মত জীবন হুঙ্কার দিয়ে পড়ল ভূপী বোসের উপর। সেদিন নেশাও করেছিল জীবন। সিদ্ধি খেয়েছিল। ভূপীর সঙ্গে যে যুদ্ধ কেমন করে হয়েছিল, সে তার মনে নাই; কিন্তু বুকে বসে ভূপীর নাকে তার প্রকাণ্ড হাতের প্রচণ্ড মুঠির একটা কিল সে মেরেছিল। মারতেই মনে হল নাকটা যেন বসে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এসে এাসিয়ে দিলে ভূপী বোসের মুখ, রক্তাক্ত হয়ে গেল জীবনের হাত—জামায়-কাপড়েও রক্ত লাগল। বঙ্কিম চিৎকার করে উঠল—করলি কী? আরও একটা আর্তকণ্ঠ তার কানে এ মঞ্জরীর কণ্ঠস্বরও মা গো! খুনে ডাকাত, খুন করলে মা গো!
চকিতে উন্মত্ত জীবন আত্মস্থ হয়ে গেল।
তাই তো! এ কী করল সে? ভূপী বোসের জ্ঞান নাই, বুকে চেপে বসে তার স্পর্শ থেকে সে তা বুঝতে পেরেছে। বিপদের কথাও সঙ্গে সঙ্গে মনে হল। ভূপীর দেশ। দেউলিয়া জমিদার ঘরের ছেলে। ওরা ভয়ঙ্কর। দাত-নখ-ভাঙা বাঘই হয় নরখাদক। আর মঞ্জরীর কান্না শুনেও আজ তার স্বপ্ন ভেঙেছে। মুহূর্তে সে লাফ দিয়ে উঠে ছুটল। ছুটল একেবারে নিজের গ্রামের অভিমুখে। পথ দশ ক্রোশ। কিন্তু সে পথ ধরে ফিরল না, ফিরল অপথে অপথে, ময়ূরাক্ষী নদীর তীর ধরে। বোধহয় তের-চোদ্দ ক্ৰোশ পথ হেঁটে বাড়ি এসে পৌঁছেছিল। জামাকাপড় নদীতে কেচে, কাদা মাখিয়ে, রক্তচিহ্নের আভাস গোপন করে বাড়ি এল।
মেডিক্যাল কলেজে পড়ার স্বপ্ন তার শেষ হল।
মঞ্জরীর মোহে পড়ে ঘুচে গেল। মঞ্জরীই দিলে ঘুচিয়ে।
সেদিন জগদ্বন্ধু মশায় ও তাঁর স্ত্রী ছেলের অবস্থা দেখে শিউরে উঠে প্রশ্ন করলেন-কী হয়েছে? এমন করে কেন তুমি ফিরলে? কী হয়েছে?
জীবন মাথা হেঁটে করে দাঁড়িয়ে রইল। কোনো উত্তর দিলে না।
জগদ্বন্ধু মশায়ের মত দৃঢ়চিত্ত প্রকৃতির মানুষের সামনেও সে অটল রইল। মঞ্জরীর নাম সে কিছুতেই প্রকাশ করবে না। শেষ পর্যন্ত বললে–একজন বড়লোকের ছেলে তাকে জুতো মেরেছিল, সে তার শোধ নিয়েছে। আঘাত অবশ্য বেশি হয়েছে, রক্তপাত হয়েছে খানিকটা, সেই জন্যই ওখান থেকে পালিয়ে এসেছে। ওখানে থাকলে সে হয়ত খুন করবার চেষ্টা করবে। ওখানে সে আর ফিরবে না। সে অন্য জায়গায় পড়বে। সিউড়ি বা বর্ধমান সরকারি হাই স্কুলে পড়বে সে।
–না! আর না!
জগদ্বন্ধু মশায় বললেন–আর না। বাইরে পড়তে আর আমি তোমাকে পাঠাব না। আমার আমাদের কৌলিক বিদ্যা শেখ তুমি।
জগদ্বন্ধু মশায়ের কণ্ঠস্বর কঠিন, কিন্তু মৃদু। এ কণ্ঠস্বর শুনে জীবনের সর্বদেহ যেন হিম হয়ে গিয়েছিল। মনে পড়েছিল, এ সেই কণ্ঠস্বর, এ কণ্ঠস্বরে যে কথা বলেন জগদ্বন্ধু মশায় তার আর লঙ্ন হয় না। জীবনের মনে পড়ল, একদিন নবগ্রামের বাবুদের বাড়ির এক অনাচারী, ব্যভিচারী প্রৌঢ়ের অসুখে চিকিৎসা হাতে নিয়ে হঠাৎ একদিন ঠিক এই কণ্ঠস্বরে চিকিৎসায় জবাব দিয়েছিলেন। বাবুটি ছিলেন মদ্যপায়ী; জগদ্বন্ধু মশায় তাকে মদ্যপান করতে নিষেধ করেছিলেন; কিন্তু তিনি নিষেধ লঙ্ন করেছিলেন। জগদ্বন্ধু মশায় ঘরে ঢুকে সেই কথা জানতে পেরেই ফিরে এসেছিলেন। রোগীর আত্মীয়েরা অনুনয় করে তাকে ফেরাতে এসেছিল—মশায় এমনি কঠিন মৃদুস্বরে বলেছিলেন না। ওই ছোট একটি না শব্দ শুনে জমিদার পক্ষ থমকে গিয়েছিল। এবং সে না-এর আর পরিবর্তন কোনো দিন হয় নাই। আজকের নাও সেই না। এবং এর সঙ্গে। জগদ্বন্ধু যে কথাগুলি বললেন– তার মধ্যেও কণ্ঠস্বরের সেই মৃদুতা এবং সেই কাঠিন্যই রনরন। করছিল।
জীবন দত্ত সচকিত হয়ে মুহূর্তের জন্য বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে পরমুহূর্তেই মাথা নামিয়েছিল। বুঝতে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে নি—এ না-এর আর পরিবর্তন নাই।
জগদ্বন্ধু মশায় পঞ্জিকা খুলে বসলেন, বিদ্যা আরম্ভের দিন ঠিক করবেন।
০৮. শুভকর্মে বিলম্ব করতে নাই
শুভকর্মে বিলম্ব করতে নাই এবং কর্মহীন মানুষের মনের মধ্যে মরে হাতছানি অহরহ ইশারা জানিয়ে ডাকে। জগদ্বন্ধু মশায় অবিলম্বে ফাল্লুনের শেষেই, জীবনের হাতে ব্যাকরণ তুলে দিয়ে। পাঠ দিয়েছিলেন। আয়ুর্বেদ-পঞ্চম বেদ। চতুর্বেদের মতই স্বয়ং প্রজাপতির সৃষ্টি। দেবভাষায় কথিত, দেবভাষায় লিখিত। সুতরাং দেবভাষায় অধিকার লাভ করতে হবে প্রথম। ব্যাকরণ কিন্তু। জীবনের খুব ভাল লাগে নাই, নরঃ নরৌ নরাঃ থেকে আগাগোড়া ব্যাকরণ মুখস্থ কি সোজা কথা! তবে ভাল লাগল অন্য দিকটা। সকালবেলা জগদ্বন্ধু মশায় যখন রোগী দেখতে বসতেন তখন ছেলেকে কাছে বসাতেন। তাঁর আয়ুর্বেদ-ভবনের ওষুধ তৈরির কাজে জীবনকে কিছু কিছু কাজ দিতেন। গাছ-গাছড়া মূল-ফুল চেনাতেন। সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছিল তার নাড়ি-পরীক্ষা বিদ্যা। অদ্ভুত বিস্ময়কর এ বিদ্যা! কবিরাজের ঘরের ছেলে, কিশোর বয়সেই অল্পস্বল্প নাড়ি পরীক্ষা করতে জানতেন। জ্বর হয়েছে কিনা, জ্বর ছেড়েছে কিনা, এগুলি তিনি নাড়ি দেখে বলতে পারতেন। জগদ্বন্ধু মশায় যখন তাঁকে নাড়ি-পরীক্ষার প্রথম পাঠ দিলেন সেদিন ওই পাঠ শুনে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন। আজও মনে পড়ছে।
দেবতাকে প্রণাম করে জগদ্বন্ধু মশায় বলেছিলেন—রোগ নির্ণয়ে সর্বাগ্রে সংগ্রহ করবে বিবরণ, তারপর রোগীর ঘরে ঢুকে গন্ধ অনুভব করবে, তারপর রোগীকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করবে। তারপর প্রশ্ন করবে রোগীকে তার কষ্টের কথা। তাই থেকে পাবে উপসর্গ। এরপর প্রত্যক্ষ পরীক্ষার প্রথম এবং প্রধান পরীক্ষা নাড়ি-পরীক্ষা। তারপর জিহ্বাগ্র, মূত্র ইত্যাদি। পাকস্থলী মলস্থলী অনুভব করবে। সর্বাগ্রে নাড়ি।
আদৌ সর্বেষু রোগেষু নাড়ি জিহ্বাগ্রে সম্ভবাম।
পরীক্ষাং কারয়েদ্বৈদ্যং পশ্চাদ্রোগং চিকিৎসয়েৎ।।
অতি সুকঠিন এ পরীক্ষা। বিশেষ করে নাড়ি-পরীক্ষা। রোগ হয়েছে—রোগদুষ্ট নাড়ি–সুস্থ নাড়ি এ অবশ্য বোঝা বিশেষ কঠিন নয়। তুমিও দেখ দেখেছি।
হাসলেন জগদ্বন্ধু মশায়। পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে বললেন, কিন্তু যে বোধে রোগ নির্ণয়, তার ভোগকাল নির্ণয়, মৃত্যুরোগাক্রান্ত হলে মৃত্যুকাল নির্ণয় পর্যন্ত করা যায়, সে অতিসূক্ষ্ম জ্ঞানসাপেক্ষ; জ্ঞান নয়, বোধ। তার জন্য সর্বাগ্রে চাই ধ্যানযেগ। আমরা যে চোখ বন্ধ করে নাড়ি দেখি তার কারণ নাড়ির গতি অনুভবে ধ্যানযোগে মগ্ন হয়ে গতি নির্ণয় করি। পারিপার্শ্বিকের কোনো কিছুতে আকৃষ্ট হয়ে আমার মন যেন যোগ থেকে ভ্রষ্ট না হয়। ইন্দ্রিয়ের অগোচর শক্তি এবং রহস্য,যা নাকি জগতের নিগূঢ় অন্তরে প্রবহমাণ প্রকাশমাণ—সেই শক্তি, সেই রহস্য যেমন ধ্যানযোগে যোগীর অনুভূতির গোচরীভূত হয়, ঠিক তেমনিভাবেই আয়ুর্বেদজ্ঞ যখন রোগীর নাড়ি পরীক্ষা করেন, তখন দেহের অভ্যন্তরে চক্ষু-অগোচরে রোগশক্তির ক্রিয়া, তার রূপ আয়ুর্বেদজ্ঞের ধ্যানযোগে যথাযথভাবে গোচরীভূত হয়। বায়ু, পিত্ত, কফ-এই তিনের যেটি বা যেগুলি কুপিত হয়ে দুষ্ট হয়ে রোগীর রক্তধারায় ক্রিয়া করছে, নাড়িতে তার গতি, তার বেগ কতখানি—সব একেবারে নির্ভুল অঙ্কফলের মত নির্ণীত হয়। আর
জগদ্বন্ধু মশায়ের কণ্ঠস্বর গভীর হয়ে উঠল। তিনি বললেন––জ্ঞানযোগে নাড়িবোধে আর মনঃসংযোগে ধ্যানযোগে যদি অনুভূতিতে সিদ্ধ হতে পার, তবে বুঝতে পারবে রোগের অন্তরালে কেউ আছে বা নেই।
জগদ্বন্ধু মশায় ছেলের মুখের দিকে দৃষ্টি তুলে বলেছিলেন—আমার বাবা বলতেন—এক সন্ন্যাসী তাকে বলেছিলেন, তিনি তাকে সাপের বিষের ওষুধ দিয়েছিলেন, বলেছিলেন সর্পদংশনে বিষক্রিয়ার ওষুধ আছে; কিন্তু যে সাপ কালের আজ্ঞা বহন করে আসে, তার দংশনে মৃত্যুই ধ্ৰুব; তার ওষুধ হয় না। ঠিক তেমনি, রোগের ওষুধও আছে, চিকিৎসাও আছে, কিন্তু কালকে আশ্রয় করে যে রোগ আসে, তার ওষুধও নাই, চিকিৎসাও নাই। আমরা বৈদ্য, আমরা চিকিৎসাজীবী—আমাদের চিকিৎসা করতেই হয়, কিন্তু ফল হয় না। এই নাড়িবোধের দ্বারা বুঝতে পারা যায়—রোগ তার দেহে নির্দিষ্টকাল ভোগ করেই ক্ষান্ত হবে অথবা রোগের অন্তে কাল তাকে গ্রহণ করবে।
জীবন মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন। শুনতে শুনতে সব যেন তার ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। সত্যই ওলটপালট।
সেকালে জীবন দত্তের চোখের সামনে ছিল রঙলাল ডাক্তারের প্রতিষ্ঠাতার গরদের কোট পেন্টালুন, সোনার চেন-সাদা ঘোড়া—আরও অনেক কিছু অর্থ, সম্পদ, প্রতিষ্ঠা। যার জন্য ডাক্তারি পড়াই ছিল স্বপ্ন। কিন্তু এ কথা তিনি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন যে, সেদিন শাস্ত্ৰতত্ত্ব শুনতে শুনতে এ সব তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। এক অপরূপ জ্ঞানলোকের সিংহদ্বারে তাঁকে তাঁর পিতা তার গুরু এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন ওই দরজা খুলে প্রবেশ করতে পারলে অমৃতের সন্ধান পাবে। তিনি যেন তার আভাসও পেয়েছিলেন।
তার বাবা বলতেন, তিনিও মানেন—কোনো শাস্ত্ৰ জানা আর সে শাস্ত্ৰে জ্ঞানলাভ, দুটো আলাদা জিনিস। বলতেন-বাবা, আমাদের শাস্ত্রে বলে, গুরুর কৃপা না হলে জ্ঞান হয় না। শিক্ষা হয়ত হয়। মুখস্থ অবশ্য করতে পার। কিন্তু সে শিক্ষা যখন জ্ঞানে পরিণত হয়, তখন পৃথিবীর রূপ পালটে যায়; চক্ষুর অগোচর প্রত্যক্ষ হয়, স্পর্শের অগোচর অনুভূতিতে ধরা দেয়। নাড়িপরীক্ষা-বিদ্যা জ্ঞানে পরিণত হলে তুমি জীবনের মধ্যে মৃত্যুকে অনুভব করতে পারবে।
সে কথা সত্য। জীবন দত্ত উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করে বলতে পারেন—সত্য, এ সত্য, এ সত্য।
এই সুদীর্ঘকালে কত দেখলেন—পৃথিবীর আয়তন জম্বুদ্বীপ থেকে প্রসারিত হয়ে পশ্চিম গোলার্ধ, পূর্ব গোলাৰ্ধ, উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত বিস্তৃত হল, প্রাচীনকালে যাকে সত্য বলে মেনেছে মানুষ, তা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হল, নতুন সত্যকে গ্রহণ করতে হল, কিন্তু এই সত্য মিথ্যা হয় নি। এ চিরসত্য।
একালে পড়েছেন ড়ুবুরীর কথা। সমুদ্রে নামে—আধুনিক যন্ত্রপাতি-সংযুক্ত পোশাক পরে মুক্তা আহরণ করে, তারা সেখানে গিয়ে সমুদ্রের তলদেশের বিচিত্র সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়, কয়েক মুহূর্তের জন্য ভুলেও যায় মুক্তা আহরণের কথা। ঠিক তেমনিভাবেই সেদিন জীবন দত্ত সব ভুলে গিয়েছিলেন; প্রতিষ্ঠার কথা, সম্পদের কথা, সম্মানের কথা—সব ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। সেদিন এই প্রসঙ্গে জগদ্বন্ধু মশায় তাঁকে এক বিচিত্র পুরাণ-কাহিনী শুনিয়েছিলেন। মৃত্যু কে? ব্যাধি কী? মৃত্যুর সঙ্গে ব্যাধির কী সম্পর্ক? সেই সব নিয়ে—সে কাহিনী বিচিত্র।
জগদ্বন্ধু মশায় ভাগবত-কথকের মত দক্ষ কথক ছিলেন। তার নিপুণ গভীর বাগবিন্যাসে জীবন দত্ত অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন।
বলেছিলেন—অবশ্য রোগমাত্রেই মৃত্যুস্পর্শ বহন করে। মহাভারতে আছে, ভগবান প্রজাপতি মনের আনন্দে সৃষ্টি করে চলেছেন, সৃষ্টির পর সৃষ্টি। বিচিত্র থেকে বিচিত্ৰতর। তখন পৃথিবীতে শুধু সৃষ্টিই আছে, লয় বা মৃত্যু নাই। এমন সময় তাঁর কানে এল যেন কার ক্ষীণ কাতর কণ্ঠস্বর। তিনি উৎকর্ণ হলেন। এবার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করল যেন অস্বাচ্ছন্দ্যকর কোনো গন্ধ। এবার সৃষ্টির দিকে তিনি দৃষ্টিপাত করলেন। দেখে চকিত হয়ে উঠলেন। এ কী? তার সৃষ্টির একটি বৃহৎ অংশ জীর্ণ, মলিন, স্থবির, কর্কশ হয়ে গিয়েছে। পৃথিবীর বুক বহু জীবে পরিব্যাপ্ত। স্বভাবে উচ্ছঙ্খল অথচ উচ্ছাসবিহীন—স্তিমিত। বিপুলভারে ক্লিষ্ট পৃথিবী করছেন কাতর আর্তনাদ। আর ওই যে অস্বাচ্ছন্দ্যকর গন্ধ? ও গন্ধের সৃষ্টি হয়েছে ওই জীর্ণ সৃষ্টির জরাগ্রস্ত দেহ থেকে।
উপায় চিন্তায় নিমগ্ন হলেন প্রজাপতি ব্ৰহ্মা ললাটে চিন্তার কুঞ্চনরেখা দেখা দিল। অকস্মাৎ এই চিন্তামগ্নতার মধ্যে তার মুখমণ্ডল অকারণে কুটিল হয়ে উঠল। ভ্ৰকুটি জেগে উঠল প্ৰসন্ন ললাটে। হাস্যস্মিত মুখে অপ্রসন্নতা ফুটে উঠল। প্ৰসন্ন নীল আকাশে যেন মেঘ উঠে এল দিগন্ত থেকে। সঙ্গে সঙ্গে তার অঙ্গ থেকে ছায়ার মত কী যেন বেরিয়ে এল; ক্ৰমে সে ছায়া কায়া গ্ৰহণ করল—একটি নারীমূর্তি তার সামনে দাঁড়াল কৃতাঞ্জলি হয়ে। পিঙ্গলকেশা, পিঙ্গলনেত্ৰা, পিঙ্গলবৰ্ণ; গলদেশে ও মণিবন্ধে পদ্ম-বীজের ভূষণ, অঙ্গে গৈরিক কাষায়; সেই নারীমূর্তি প্ৰণাম করে ভগবানকে প্রশ্ন করলেন পিতা, আমি কে? কী আমার কর্ম? কী হেতু আমাকে আপনি সৃষ্টি করলেন?
ভগবান প্রজাপতি বললেন–তুমি আমার কন্যা। তুমি মৃত্যু। সৃষ্টিতে সংহারকর্মের জন্য তোমার সৃষ্টি হয়েছে। সেই তোমার কর্ম।
চমকে উঠলেন মৃত্যু–অর্থাৎ সেই নারীমূর্তি; আর্তস্বরে বললেন– পিতা হয়ে তুমি এ কী। কুটিল কঠিন কর্মে আমাকে নিযুক্ত করছ? এ কি নারীর কর্ম? আমার নারী-হৃদয়—নারী-ধর্ম এ সহ্য করবে কী করে?
ভগবান হেসে বললেন–কী করব? উপায় নাই। সৃষ্টি যখন করেছি, তখন ওই কৰ্মই করতে হবে।
মৃত্যু বললেন–পারব না।
–পারতে হবে।
মৃত্যু তপস্যা শুরু করলেন। কঠোর তপস্যা করলেন। ভগবান এলেন–বললেন–বর চাও।
মৃত্যু বর চাইলেন—এই কঠিন নিষ্ঠুর কর্ম থেকে আমাকে অব্যাহতি দিন।
ফিরে গেলেন ভগবান–না।
আবার তপস্যা করলেন মৃত্যু, এবারের তপস্যা পূর্বের তপস্যার চেয়েও কঠোর।
আবার এলেন প্রজাপতি। আবার ওই বর চাইলেন মৃত্যু—এই নিষ্ঠুরতম কর্ম থেকে কন্যাকে অব্যাহতি দিন পিতা।
প্রজাপতি নীরবে ধীরভাবে ঘাড় নাড়লেন, জানালেন–না। সে হয় না। এবং মুহূর্তে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
কন্যারূপিণী মৃত্যু দীর্ঘক্ষণ আকাশমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর আবার আসন গ্ৰহণ করলেন।
তৃতীয়বার তপস্যামগ্ন হলেন মৃত্যু। এবার যে তপস্যা করলেন, তার চেয়ে কঠোরতর তপস্যা কেউ কখনও করে নি। আবার ভগবান ব্ৰহ্মাকে আসতে হল। আবার মৃত্যু ওই বর চাইলেন। বর প্রার্থনা করতে গিয়ে এবার তার ঠোঁট দুটি কেঁপে উঠল। চোখ দিয়ে অনর্গল ধারায় জল গড়িয়ে এল। ব্ৰহ্মা ব্যস্ত হয়ে নিজে অঞ্জলি বন্ধ করে সেই প্রসারিত অঞ্জলিতে অবিন্দুগুলি ধরলেন। বললেন–মা, তোমার চোখের জল এ সৃষ্টিতে পড়বামাত্র এর উত্তাপে সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে।
দেখতে দেখতে সেই অশ্রুবিন্দুগুলি হতে এক-একটি কুটিল মূর্তির আবির্ভাব হল। ভগবান বললেন–এরা হল রোগ; এরা তোমারই সৃষ্টি; এরাই তোমার সহচর।
মৃত্যু বললেন–কিন্তু আমি নারী হয়ে পত্নীর পার্শ্ব থেকে পতিকে গ্রহণ করব কী করে? মায়ের বুক থেকে তার বত্রিশনাড়ি-ছেঁড়া সন্তানকে গ্রহণ করব, এই নিষ্ঠুর কর্মের পাপ–
বাধা দিয়ে ভগবান বললেন–সব পাপ-পুণ্যের ঊর্ধ্বে তুমি। পাপ তোমাকে স্পর্শ করবে না। তা ছাড়া তাদের কর্মফল তোমাকে আহ্বান করবে এই রোগেদের মাধ্যমে। অনাচার, অমিতাচার, ব্যভিচারের ফলে রোগাক্রান্ত হবে মানুষ। তুমি তাদের দেবে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি, জ্বালা থেকে শান্তি, পুরাতন জন্ম থেকে নব জন্মান্তর।
কিন্তু মৃত্যু আকুল হয়ে বললেন–শোকাতুরা স্ত্রী পুত্ৰ মাতা পিতা মাটিতে লুটিয়ে পড়বে, বুক চাপড়াবে, মাথা কুটবে, সে দৃশ্য আমি দেখব কী করে?
ভগবান বললেন–তুমি অন্ধ হলে, দৃষ্টি তোমার বিলুপ্ত হল। দেখতে তোমাকে হবে না।
মৃত্যু বললেন–তার ক্ৰন্দন? নারীকন্ঠের আর্তবিলাপ কি—
বাধা দিয়ে ভগবান বললেন–তুমি বধির হলে। কোনো ধ্বনি তোমার কানে যাবে না।
জগদ্বন্ধু মশায় বলেছিলেন–মৃত্যু অন্ধ, মৃত্যু বধির। রোগই তার সন্তানের মত নিয়ত তার হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে নিয়ম-কাল। যার কাল পূর্ণ হয়, তাকে যেতে হয়। অকালমৃত্যুও আছে। নিজের পাপে মানুষ নিজের আয়ুক্ষয় করে কালকে অকালে আহ্বান করে। আমাদের যে পঞ্চম বেদ আয়ুর্বেদ তার শক্তি হল, কাল যেখানে সহায়ক নয় রোগের, সেখানে রোগকে প্রতিহত করা। রোগ এমন ক্ষেত্রে ফিরে যায়, তার সঙ্গে অন্ধ-বধির মৃত্যুও ফিরে যায়। কিন্তু কাল যেখানে পূর্ণ হয়েছে, সেখানে আক্রমণের বেগে নাড়িতে যে স্পন্দন।–বৈলক্ষণ দেখা দেয় তা থেকে বুঝতে পারা যায়, মৃত্যু এখানে কালের পোষকতায় অগ্রসর হচ্ছে। এমনকি কতক্ষণ, কয় প্রহর, কয় দিন, কয় সপ্তাহ, পক্ষ বা মাসে সে গ্রহণ-কর্ম শেষ করবে, তাও বলা যায় এই নাড়ি পরীক্ষা করে।
এই মুহূর্তটিতে সেদিন ঘরের কোণে একটা টিকটিকি টক টক শব্দে ডেকে উঠেছিল। মাটিতে আঙুলের টোকা দিয়ে জগদ্বন্ধু মশায় টিকটিকিটার দিকে তাকিয়ে হেসে বলেছিলেন ওই দেখ।
জীবন প্রথমটা ভেবেছিল—বাবা বলছেন-টিকটিকি তাঁর কথাকে সত্য বলে সমর্থন করছে। কিন্তু না। সেদিকে তাকিয়ে জীবন দেখেছিলেন, ডাক দিয়েই টিকটিকিটা লাফিয়ে ধরেছে একটা ফড়িংকে। ফড়িংটা ঝটপট করছে।
মশায় বলেছিলেন—অনুরূপ অবস্থায় মানে ধর যদি কোনো মানুষকে কুমির ধরেছে কি কোনো দুটো কঠিন জিনিসের মধ্যে চাপা পড়েছে—পিষ্ট হচ্ছে, এমন অবস্থায় তার নাড়ি যদি পরীক্ষা করা যায় তবে নাড়ির মধ্যে জীবনের আর্তনাদ অনুভব করতে পারবে। একেবারে প্রত্যক্ষ করতে পারবে, মনে হবে চোখে দেখছ।
নাড়িবিজ্ঞানে নিদান হকার প্রথম অভিজ্ঞতার গল্প বলেছিলেন জগদ্বন্ধু মশায়। বলেছিলেন গিরিশবাবুর মা—এই নবগ্রামের গিরিশবাবু, তাঁর মা-বর্ষার সময় বাধানন ঘাটের চাতালে পা পিছলে পড়ে গেলেন। পড়েই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। বাবা তখন দেহ রেখেছেন—আমার বয়স তখন কম। গেলাম। নাড়ি দেখে শঙ্কিত হলাম। কিন্তু সঠিক কিছু বুঝতে পারলাম না। দেখলাম আঘাতের ফলে যেমন নাড়ি স্পন্দনহীন হয়, তাই হয়েছে। সেক্ষেত্রে নাড়ি অসাধ্য নয়। তবু কেমন যেন সন্দেহ হল। বললাম প্রকাশ করে। এক্ষেত্রে মৃত্যু হতেও পারে—না হতেও পারে। আপনারা আরও বিচক্ষণ কবিরাজ এনে দেখান। পারুলিয়ার বৃদ্ধ কবিরাজ মশায় এলেন সন্ধ্যায়। তিনি দেখলেন। বললেন–এ অবস্থায় তিন দিন উত্তীর্ণ হলে এ যাত্রা রক্ষা পেলেন। তবে–
আবার নাড়ি দেখলেন, বাহুমূলে কণ্ঠে, নাড়ি পরীক্ষা করে বললেন– রক্ষা পেলেও এক বৎসর মধ্যেই ওঁর দেহান্ত ঘটবে এবং দেহান্তের পূর্বে যেখানে আঘাত পেয়েছেন আজ, সেইখানে তীব্ৰ বেদনা অনুভব করবেন। যেন নূতন করে সেদিন আঘাতটা পেলেন—এমনি মনে হবে।
গিরিশবাবু দ্বিতীয় দিনেই মাকে পালকি করে গঙ্গাতীরে নিয়ে গেলেন। সকলেই সন্দেহ করলেন তিন দিনের মধ্যেই দেহান্ত ঘটবে। গঙ্গাতীরে দেহরক্ষায় মায়ের একান্ত বাসনা ছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে চতুর্থ দিনের প্রভাতে বৃদ্ধার জ্ঞান হল। ধীরে ধীরে সেরেও উঠলেন। দেহরক্ষার সঙ্কল্প নিয়ে গঙ্গাতীরে গিয়ে ফেরার নিয়ম নয়। গঙ্গাতীরেই থাকলেন তিনি। ঠিক বৎসরের শেষে এক সপ্তাহ আগে, হঠাৎ একদিন তিনি যন্ত্রণা অনুভব করলেন আঘাতের স্থানে। যন্ত্রণা ক্রমে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল। চব্বিশ ঘণ্টা সেই যন্ত্ৰণা ভোগ করে তিনি অচেতন হয়ে গেলেন। তারপর আরও বার ঘণ্টা পরে ঘটল তার দেহান্ত।
এ আমার প্রত্যক্ষ প্রথম অভিজ্ঞতা। তারপর নিজেই অনেক দেখলাম। তুমিও দেখবে। এ ঠিক বুঝিয়ে দেবার নয়, ব্যাখ্যা করে ফল নাই। উপলব্ধি করবার শক্তি ভাগ্যের উপর নির্ভর করে বাবা। তোমার যদি সে ভাগ্য থাকে, সে শক্তি যদি অর্জন করতে পার, তবে তুমিও বুঝতে পারবে।
০৯. হঠাৎ আজ নিজের নাড়ি ধরলেন
হঠাৎ আজ নিজের নাড়ি ধরলেন জীবন মশায়, কত দেরি? কত দূরে সে? দীর্ঘক্ষণ নাড়ি ধরে বসে রইলেন। কই, কিছুই তো অনুভব করতে পারছেন না। কোথায় গেল তাঁর অনুভবশক্তি? ওই তরুণ ডাক্তারটির আঘাতে তিনি কি অন্তরে অন্তরে অসাড় হয়ে গেলেন?
–কী, হচ্ছে কী? নিজের নাড়ি দেখছ? প্রশ্ন করলেন আতর-বউ।
জীবন ডাক্তার ছেড়ে দিলেন নিজের নাড়ি। আতর-বউ এসেছে। আসবারই কথা। সারাটা জীবন ভাত খাওয়া শেষ করে, লোকজনকে খাইয়ে আতর-বউ পাখা হতে এসে তাঁর বিছানার। পাশে বসে। পান-দোক্তা খায়, বাতাস করে। কপূর দেওয়া জলের গ্লাসটি শিয়রে রেখে দেয়। হাতে সেবা করে, মুখে অনর্গল মর্মচ্ছেদী অথচ মিষ্ট কথা বলে যায়। তাঁকে উদ্দেশ্য করে বড় বলে না, নিজের কপালকে উদ্দেশ করে। আইনের পাঁচে তাকে ধরা যায় না। প্রতিবাদ করলেই আতর-বউ বলে—তোমাকে তো কোনো কথা আমি বলি নি। আমি বলছি আমার কপালকে। তুমি ফোঁস করে উঠছ কেন?
অনেককাল আগে জীবন ডাক্তার একবার ধৈর্য হারিয়েছিলেন। বলেছিলেন—তোমার কপালে যে ভগবান আমাকে বেঁধে অধিষ্ঠিত করে দিয়েছেন। আঘাত করলে আমাকেই লাগে যে!
আতর-বউ ঘাড় বেঁকিয়ে তির্যক দৃষ্টিপাত করে নিস্পৃহ কণ্ঠে প্রশ্ন করেছিলেন—তোমাকে লাগে?
–হ্যাঁ। বুঝতে পার না?
আতর-বউ একটা পাথরের খল নিয়ে কপালে ঘা মেরে কপালটা রক্তাক্ত করে তুলে বলেছিলেন কই? কই? কই?
এরপর থেকে জীবন ডাক্তার সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেলেই চোখ বুজে পড়ে থাকেন ঘুমের ভান করে। আজ অতীত কথা স্মরণ করতে গিয়ে এমনই মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন যে পায়ের শব্দ শুনতে পান নাই।
আতর-বউ আবার প্রশ্ন করলেন শরীর খারাপ?
জীবন দত্ত চেষ্টা করলেন মিথ্যা বলতে। বলতে চাইলেন—শরীরটা যেন ভাল বোধ হচ্ছে না। কিন্তু বললেই এই আতর-বউ আর এক আতর-বউ হয়ে যাবে। শিশুর মত অসহায় করে তুলে সেবা-যত্নে জীবন ডাক্তারকে অভিষিক্ত করে দেবে।
কতবার জীবন দত্তের মনে হয়েছে এই আতর-বউই তাঁর জীবনের ছদ্মবেশিনী মৃত্যু। তাঁর বাবা বলতেন, তিনিও তার সুদীর্ঘ চিকিৎসক জীবনে বুঝেছেন, উপলব্ধি করেছেন, মৃত্যু অবগুণ্ঠনময়ী। দূর থেকে তাকে চেনা যায় না। তাকে দেখে ভয় হয়, কারণ সে আসে জ্বালাযন্ত্ৰণাময়ী ব্যাধির পশ্চাদনুসরণ করে—কালবৈশাখীর ঝড়ের অনুসারিণী বৰ্ষণধারার মত। প্ৰচণ্ড বিক্ষোভে ব্যাধির জ্বালায়, যন্ত্রণায় জীবনের ওপর তোলে বিক্ষোভ, মৃত্যু আসে বর্ষাধারার মত, সকল জ্বালা-যন্ত্রণার বিক্ষোভ জুড়িয়ে দিয়ে, প্রশান্ত স্নিগ্ধ করে দেয়। আতর-বউ ঠিক তাই। দূরে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ ভয়ঙ্করী, তার অরুদ্ধ তপ্ত কথাগুলি ব্যাধির জ্বালার মতই যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু
না। আতর-বউ তার জীবনে ব্যাধি, শুধুই ব্যাধি। মৃত্যু হল সেই মঞ্জরী। জীবনে তো আয়ু থাকতে কেউ মৃত্যুকে পায় না। তাই জীবন দত্ত মঞ্জরীকে পান নি। মধ্যে মধ্যে মৃত্যু ছলনা করে যায় মানুষকে, আসতে আসতে ফিরে যায়, ধরা দিতে দিতে দেয় না। রেখে যায় আঘাতের চিহ্ন; অনেক ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী ব্যাধি রেখে যায়। মঞ্জুরীও তাই করেছে। ছলনা করে চলে গেছে,
রেখে গেছে ব্যাধিরূপিণী আতর-বউকে।
নীরবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জীবন ডাক্তার। আতর-বউয়ের প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন। ভেবে পেলেন না। আতর-বউ কিন্তু এ নীরবতায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সরস মনে থাকলে জীবন ডাক্তার বলেন-আতর-বউ রাগলে টেম্পারেচার ওঠে ম্যালেরিয়ার জ্বরের মত। দেখতে দেখতে একশো পাঁচ।
আতর-বউ তার জীবনে ম্যালেরিয়াই বটে; পোষাই আছে; এতটুকু অনিয়ম ব্যতিক্রম হলেই প্রকট হয়ে উঠবে। অনিয়ম না হলেও অমাবস্যা পূর্ণিমাতে দেখা দেওয়ার মত মধ্যে মধ্যে জর্জর জ্বরোত্তাপ ফুটবেই।
আজ কিন্তু শশী হতচ্ছাড়া এসে আতর-বউকে স্বরূপে প্রকট করে দিয়ে গিয়েছে। আতরবউ শশীকে স্নেহও করেন। অনেকদিন শশী যে এ বাড়িতে কাটিয়েছে; আতর-বউয়ের ফাইফরমাশ শুনত, তাদের ছেলে-মেয়েদের কোলে-পিঠে করত; এ বাড়ি ছেড়েও শশী সম্পর্ক ছাড়ে নাই, মধ্যে মধ্যে আসে। শশীকে ডাক্তার বলেন-ওটা হল ম্যালেরিয়ার পিলে। ওটা কামড়ে উঠলেই ম্যালেরিয়া জাগবেন।
আতর-বউ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিলেন, বললেন–বলি হাগা, কথা বললেও কি তোমার নিদান বুঝবার পক্ষে ব্যাঘাত হবে?
জীবন ডাক্তার এবার সোজাসুজি বললেন– শশী তোমাকে কী বলে গিয়েছে বল তো?
—শশী? শশী কী বলে যাবে? ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো! সবতাতেই শশী। কার না শুনতে বাকি আছে যে, তুমি কামারবুড়ির নিদান হেঁকেছ? কে না এ চাকলায় শুনেছে যে, সরকারি ডাক্তার তোমাকে হাতুড়ে বলে প্রকাশ্যে অপমান করেছে। নিদান হকাতে বারণ করেছে। বলেছে দরখাস্ত করবে। মকদ্দমা করবে। শশী বলবার মধ্যে বলেছে—পায়ের হাড় ভেঙেছে—এতে উনি নিদানটা না হলেই পারতেন। নিদানের রুগী আছে বৈকি। সেখানে পাসকরা ডাক্তাররা থই পাবে না। এই তো তারই হাতে রুগী রয়েছে—ডাক্তাররা কেউ কিছু করতে পারলে না। তোমাকে ডাকতে এসেছিল শশী। শশীর ওপর দোষ কেন?
বৃদ্ধ জীবন ডাক্তার চুপ করে রইলেন। কী বলবেন? আমল পালটেছে, চিকিৎসা শাস্ত্ৰ এগিয়ে গিয়েছে। তিনি পিছিয়ে পড়েছেন। নইলে আগের কালের চিকিৎসা অনুযায়ী তাঁর নিদান ভুল নয়, বুড়ির যাওয়ার কথা, নিশ্চয় যাওয়ার কথা এই আঘাতের ফলে। তবে এ কালের সার্জারির উন্নতি, এক্স-রে আবিষ্কার এ সব তার অজানা নয়; কিন্তু সে চিকিৎসা ব্যয়সাধ্য।
তাই সে হিসেব তিনি করেন না। আরও একটা কথা,-বুড়ির এই সময় যাওয়াটা ছিল সুখের যাওয়া, সমারোহের যাওয়া। স্বেচ্ছায় যাওয়াই উচিত। তাঁর বাবা বলতেন।
তার বাবার কথাগুলি স্মরণ করবার অবকাশ পেলেন না তিনি। বাইরে থেকে কেউ তাকে ডাকলে—ডাক্তারবাবু!
চমকে উঠলেন ডাক্তার। আতর-বউও চকিত হয়ে উঠলেন। এ যে নবগ্রামের কিশোরের গলা। দুজনের মুখই মুহূর্তে প্ৰসন্ন হয়ে উঠল। কিশোর কিশোর আসে যেন বর্ষার দুর্যোগরাত্রির অবসান করে প্রসন্ন শরৎপ্রভাতের মত। বয়সে প্রৌঢ় হয়েও কিশোর চিরদিন কিশোরই থেকে। গেল। আজন্ম কুমার কিশোর উনিশ শো সাতচল্লিশ সাল পর্যন্ত ছিল রাজনৈতিক এবং সমাজসেবক কর্মী। এখন সে সব ছেড়ে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে বেড়ায়, তবে অভ্যাসবশে দু-চারটে পরের উপকার না করে পারে না, না করলে লোকেও ছাড়ে না। কিশোর ছেলেটি ডাক্তারের জীবনের একটা অধ্যায়। তাঁর জীবনে প্রকাণ্ড বড় একটি স্থান অধিকার করে আছে।
—ডাক্তারবাবু! আবার ডাকলে কিশোর।
–সাড়া দাও, আসতে বল! প্ৰসন্ন স্বরেই তিরস্কার করলেন আতর-বউ। এবং স্বামীর অপেক্ষা না করেই তিনি নিচে নেমে গেলেন,ডাকলেন—এস বাবা এস।
মোটা খদ্দরের কাপড় এবং হাত-কাটা খাটো পাঞ্জাবির উপর একখানা চাদর—এই হল কিশোরের চিরকালের পোশাক। প্রসন্ন প্রশান্ত সুশ্রী মানুষ। যে পোশাকেই হোক কিশোরকে মানায় বড় সুন্দর। কর্মঠ সরল দেহ, সবল প্রদীপ্ত মন; মানুষটি ঘরে ঢুকলেই ঘরখানি যেন প্ৰসন্ন হয়ে ওঠে।
কিশোর এসে মাটির উপরেই বসে পড়ল এবং বিনা ভূমিকাতেই বললে—একবার বেরুতে হবে ডাক্তারবাবু।
আতর-বউ একখানা আসন পেতে দিলেন, বললেন–উঠে বোলো কিশোর। মাটিতে কি বসে।
ডাক্তার হেসে বললেন–মহারাজ অশোক মাটিতে বসে রাজা হয়েছিলেন। কিশোর মাটিতে বসে একদিন রাজা না হোক মিনিস্টার হবে। কেমন কিপোর?
কিশোর হাত জোড় করে বললে—তার চেয়ে এই বয়সে বিয়ে করতে রাজি আছি ডাক্তারবাবু। এমনকি শনির দশায় পড়তেও রাজি আছি। কিন্তু আপনাকে একবার তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। শেষের কটি কথায় কিশোরের কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা ফুটে উঠল—জানিয়ে দিলে সরস পরিহাসের মানসিকতা তার এখন নাই।
—কী ব্যাপার? কোথায় যেতে হবে?
–যেতে হবে আমাদের গ্রামেই। রতনবাবু হেডমাস্টার মশায়ের ছেলে বিপিনের অসুখ একবার যেতে হবে।
ডাক্তার বিস্মিত হলেন। বৃদ্ধ রতনবাবু এককালের নামকরা হেডমাস্টার, দুর্লভ দৃঢ় চরিত্রের মানুষ; তার ছেলে বিপিনও বাপের উপযুক্ত সন্তান, সপ্রকৃতির মানুষ, লব্ধপ্রতিষ্ঠ উকিল। বিপিন কয়েক বৎসর রক্তের চাপের আধিক্যে অসুস্থ রয়েছে। সম্প্রতি অসুখ বৃদ্ধি পাওয়ায় কলকাতায় গিয়েছিল চিকিৎসার জন্য। সেখান থেকে ওষুধপত্র নিয়ে দেশে এসে বিশ্রাম নিচ্ছে। বিশ্রামই এ রোগের চিকিৎসা। নবগ্রামের ডাক্তার হরেন চাটুজ্জে কলকাতায় গিয়েছিলেন এই উপলক্ষে। সেখানকার বড় ডাক্তারের কাছে চিকিৎসাবিধি বুঝে এসেছে এবং সেইমত চিকিৎসা সেই করছে। এখন হঠাৎ কী হল যে, কিশোর তাকে ডাকতে এসেছে?
কিশোর বললে–চলুন, পথে চলতে চলতে বলব।
কিশোর বলে যাচ্ছিল রোগের কথা। পথ চলতে চলতে কথা হচ্ছিল।
কলকাতায় বড় ডাক্তার রক্তের চাপ কমাবার জন্য রক্ত মোক্ষণ করেছিল। মূত্রাশয়ে দোষ পাওয়া গেছে। এখন গ্লুকোস ইনজেকশনই হল প্রধান চিকিৎসা। এর সঙ্গে অবশ্যই আরও অনেক ওষুধ আছে। এ ব্যবস্থায় কলকাতায় ভালই ছিলেন বিপিনবাবু। ভাল থাকতেই দেশে এসেছেন, হরেন ডাক্তার ভরসা দিয়েছিল; বড় ডাক্তারও সম্মতি দিয়েছিলেন। এখন দেশে ফিরে হঠাৎ রোগটি যেন বেঁকে দাঁড়িয়েছে। বিচিত্র এক উপসর্গ দেখা দিয়েছে—হিকা। আজ পাঁচ দিন হয়ে গেল হিক্কা চলছে সমানভাবে। হাসপাতালের ডাক্তার প্রদ্যোত বোসকেও ডাকা হয়েছিল, কিন্তু তাদের ওষুধে কোনো ফল হয় নাই। তবে একমাত্র ভরসার কথা এই যে, নাড়ির গতি বা হৃদযন্ত্রের গতির ওপর এখনও কোনো প্রতিক্রিয়ার লক্ষণ দেখা দেয় নাই। কিন্তু দিতে কতক্ষণ? কাল কিশোর হোমিওপ্যাথিক ওষুধ দিয়েছিল। তাতেও কোনো ফল হয় নাই। তাই আজ কিশোর জীবন মশায়কে ডাকতে এসেছে।
প্রদ্যোত ডাক্তারের নাম শুনে জীবন ডাক্তার সচেতন হয়ে উঠলেন, বললেন, হাসপাতালের ডাক্তারটি কি এখনও দেখছে? সেও কি থাকবে নাকি? তা ছাড়া হরেন? হরেনের মতামত নেওয়া। হয়েছে তো।
কিশোর তার দিকে ফিরে তাকাল, বললে–প্ৰদ্যোত ডাক্তারের কথা আমি শুনেছি। ডাক্তারবাবু। প্রদ্যোত ডাক্তার এমনিতে তো লোক খারাপ নয়, বরং ভাল লোক বলেই আমার ধারণা; হঠাৎ এমন অভদ্ৰ—
—ভদ্রতা-অভদ্রতার কথা নয় কিশোর। এ হল সত্য-মিথ্যার কথা। প্রদ্যোত ডাক্তারের যদি এই বিশ্বাসই হয় যে নাড়ি পরীক্ষা করে আমি যে ধরনের চিকিৎসা করি সে ভুল, সে মিথ্যা, তা হলে অবশ্যই তিনি আমাকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করতে পারেন। সে কথা এখন থাক। এখন আমি যে কথাটা জানতে চাচ্ছি তার উত্তর দাও। জীবন ডাক্তার পথের মধ্যেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন।
কিশোর একটু বিস্মিত হয়েই ডাক্তারের দিকে ফিরে তাকালে। জীবন ডাক্তার বললেন– তুমি আমাকে খুলে বল কিশোর। তুমি কি সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে সম্মতি নিয়ে আমার কাছে এসেছ? না, নিজেই এসেছ? তোমার তো এ ব্যাধি আছে। টাকাওয়ালা লোকের টাকাব্যাধি যেমন শোভন, তোমার পক্ষে এ কর্মটি তেমনি শোভনই বটে। পরের উপকার যারা করে, পরের ঘরের বিধি-ব্যবস্থা উলটে দিতে তাদের অধিকারও থাকে।
কিশোর এবার একটু হেসেই বললে—এই শেষ বয়সে আপনি অভিমান করলেন ডাক্তারবাবু! এবং এতখানি অভিমান?
—তা হয়েছে কিশোর। এবং সে অভিমান ছাড়তে পারব না। তুমি যখন যেখানে ডেকেছ—আমি গিয়েছি। আজ কিন্তু যেতে পারব না তোমার ডাকে।
–একা আমি ডাকি নি ডাক্তারবাবু। রোগীর বাপ আপনাকে আহ্বান জানিয়েছেন, রতনবাবু আপনাকে ডেকেছেন। বলেছেন, জীবন ডাক্তার নাড়িটা দেখলে আমি নিশ্চিন্ত হই। অন্তত অনিশ্চিত মনের সংঘাত থেকে নিষ্কৃতি পাই। সে ঠিক বলে দেবে।
অৰ্থাৎ মৃত্যুর কথা!
জীবন ডাক্তার একটু বিচলিত হলেন। বৃদ্ধ রতন তারই সমবয়সী। মাত্র দু বছরের ছোট। তার থেকে এক ক্লাস নিচে পড়ত। যে বছর জীবন ডাক্তার কঁদীর স্কুল থেকে ভূপী বোসের নাক ভেঙে দিয়ে পালিয়ে এলেন সেই বছরই রতন এম. ই. পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়ে ওখানে গিয়ে ভর্তি হল। রতন এন্ট্রান্সেও বৃত্তি পেয়েছিল। চিরকালই ধীর প্রকৃতির মানুষ রতন। রতন এই কথা বলেছে? বলেছে—জীবন নাড়ি দেখলে আমি চিন্তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাই! যা হবে সে ঠিক বলে দেবে!
বলবে বৈকি। জীবন ডাক্তার যে নিজের একমাত্র পুত্রের মৃত্যুর কথা তিন মাস পূর্বে থেকে নাড়ি দেখে জেনেছিলেন—শুধু জেনেই ক্ষান্ত হন নি, ঘোষণা করে জানিয়েছিলেন সে কথা। সুতরাং বলবে বৈকি রতন।
***
রতনবাবু মৃদুস্বরেই প্রশ্ন করলেন বটে কিন্তু মৃদু হলেও কণ্ঠস্বর কাপল না, প্রশ্ন করলেন কেমন দেখলে বল? কী দেখলে?
হাত ধুয়ে জীবন ডাক্তার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন––হিকার জন্যে ভেবো না, ও দু-তিন দিনেই বন্ধ হয়ে যাবে।
অশীতিপর বৃদ্ধ হলেও রতনবাবু খাড়া সোজা মানুষ। এতটুকু নজ হন নি। অবশ্য মাথায়। তিনি খাটো এবং দেহেও তিনি ভারী নন। তবুও খানিকটা ঝুঁকে পড়ার কথা, কিন্তু তা তিনি পড়েন নি। চোখের দৃষ্টি বিষণ্ণ হলেও স্থির এবং শুষ্ক, সহজে জল তাঁর চোখে আসে না। সেই যৌবনে তিরিশ বৎসর বয়সে পত্নীবিয়োগের পর থেকে স্বপাকে নিরামিষ খেয়ে ছেলেকে মানুষ। করেছেন। আদর্শবাদী নীতিপরায়ণ মানুষ রতনবাবু। রতনবাবু ঈষৎ হেসে বললেন–আমার প্রশ্ন
তো তা নয়। আমি যা জিজ্ঞাসা করেছি সে তো তুমি বুঝেছ জীবন।
–বুঝেছি। কিন্তু–
–তোমার কাছে তো কিন্তু প্রত্যাশা করি না। তুমি স্পষ্ট বল বলেই তোমার জন্য আমার এত আগ্রহ।
ডাক্তার মাটির দিকে চেয়ে রইলেন।
–জীবন? মৃদুস্বরে ডাকলেন রতনবাবু।
–ভাবছি।
—আমার জন্যে? রতনবাবু বললেন– আমার জন্য ভেবো না। যস্য ছায়ামৃতং যস্য মৃত্যু তিনিই তো পরমানন্দ।
চমকে উঠলেন ডাক্তার। তার সমস্ত অতীতকালের স্মৃতি যেন মুহূর্তে আলোড়িত হয়ে উঠল। তাঁর নাড়ি পরীক্ষা-বিদ্যা শিক্ষার গুরু এই কথাটি বলতেন। জীবন আর মৃত্যু? যস্য ছায়ামৃতং যস্য মৃত্যু—তিনিই আনন্দস্বরূপ!
বাবা জগৎ মশায় নস্য নিয়েছিলেন এই সময়,সে-কথা জীবন ডাক্তারের আজও মনে আছে। তার ফলেই হোক আর হৃদয়াবেগের জন্যই হোক তাঁর কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে উঠেছিল। ভারী গলার কথাগুলির প্রতিধ্বনিতে জীবন ডাক্তারের বুকের ভিতরটা যেন বর্ষার মেঘের ডাকে পৃথিবীর মত এক পুলকিত অনুভূতিতে অভিভূত হয়ে পড়েছিল। তিনি বলেছিলেন বাবা, এতে আমাদের দুই তত্ত্বই হয়, ইহলোক পরলোক দুই। পরমানন্দ স্বরূপ যিনি তিনিই আমার মাধব। আমাদের ইষ্টদেবতা।
ধ্যানযোগে সিদ্ধ চিকিৎসক যখন গভীর একাগ্রতায় তন্ময় হয়ে নাড়ি পরীক্ষা করেন—তখন জীবন এবং মৃত্যুর যুদ্ধ আর বিয়োগান্ত বলে মনে হয় না, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চিরন্তন লীলা বলে মনে হয়, তখন অনায়াসেই বলা যায় যে সূর্যাস্তের কাল সমাগত। সূর্যোদয় সূর্যাস্তের আনন্দ এক, পৃথক নয়।
রতনবাবু অপেক্ষা করে তারই দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবার তিনি তাঁকে ডাকলেন–জীবন!
জীবন ডাক্তার সচেতন হয়ে উঠলেন, রতনবাবুর মুখের দিকে চেয়ে একবার যেন কেঁপে উঠলেন, বললেন, তেমন কোনো লক্ষণ আমি আজ পাই নি রতন। তবে
কী হবে? বল! দ্বিধা কোরো না। হাসলেন রতনবাবু; বিষণা এবং করুণ সে হাসি। এ হাসির সামনে দাঁড়ানো বড় কঠিন। অন্তত মুখ তুলে চোখে চোখ রেখে মিথ্যা সান্ত্বনা দেওয়া যায় না। মাথা হেঁট করে বলতে হয়।
জীবন ডাক্তার তাকে মিথ্যা বলতে চান নি। তিনি যা সত্য তাই বলতে যাচ্ছিলেন, তাই বোধ করি মাথা হেঁট করলেন না তিনি। বললেন–এ রোগটি হঠাৎ মারাত্মক হয়ে ওঠে; রোগের বৃদ্ধি ধীরে ধীরে হয় না, এবং বৃদ্ধির হেতুও হিসাবের বাইরে। যে-কোনো একটা আঘাতের ছুতো, দৈহিক হোক মানসিক হোক হলেই চরম সর্বনাশের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
—সে আমি জানি।
—তা হলে আমার বলবার তো কিছু নাই রতন। রোগ এখন ষোলআনা দাঁড়িয়েছে। তবুও এমন কোনো লক্ষণ আমি পাই নি যাতে বলতে পারি সাধ্যাতীত। দুঃসাধ্য-কিন্তু অসাধ্য আমি। বলব না। তবে এ রোগের যা প্রকৃতি তাতে যে-কোনো মুহূর্তে অসাধ্য হয়ে উঠতে পারে। ভগবানের দয়া, সে দয়া তোমরা পিতাপুত্ৰে পাবার হকদার।
—হকদার! এ দয়ার উপর কি কারও হক আছে জীবন?
জীবন ডাক্তার এবার চুপ করে রইলেন। এ কথার সত্যই উত্তর নাই।
রতনবাবু বললেন–তুমি তা হলে হিষ্কাটা থামিয়ে দাও।
—আমার ওষুধে ডাক্তারদের আপত্তি হবে না তো? আলোপ্যাথি মতে যা ওষুধ সে বিষয়ে ওঁদের চেয়ে আমি তো অনভিজ্ঞ নই। আমি দেব আমাদের কৌলিক চিকিৎসা পদ্ধতি অনুযায়ী ওষুধ।
হরেন ডাক্তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে বললে—আমাদের ওষুধে আপনার আপত্তি হবে। না তো? প্রয়োজন হলে আমরা একটা-দুটো ইনজেকশন দেব, গ্লুকোজ দেব, বিশেষ করে ঘুমের জন্য ইনজেকশন না দিলে ওঁর ঘুম হয় না। তা ছাড়া—প্রেসার বাড়লে—তার জন্যে ওষুধ দিতে হবে। আর একটা কথা–।
থমকে গেল হরেন ডাক্তার। হাজার হলেও হরেন এই গ্রামের ছেলে, জীবন ডাক্তারকে সে শ্রদ্ধা করে, ছেলেবেলায় জীবন ডাক্তারের অনেক ওষুধ সে খেয়েছে। এখনও দু-চারটে রোগীকে বলে—এর জন্যে জীবন মশায়ের কাছে যাও বাপু। আমাদের ওষুধের চেয়ে ওঁর ওষুধে কাজ বেশি হবে।
সেদিন প্রদ্যোত ডাক্তারকে নিদান সম্পর্কে যাই বলে থাক হরেন, জীবন ডাক্তার নাড়ি দেখে রোগ নির্ণয় করলে রক্ত মল মূত্র পরীক্ষা না করেও তার নির্ণয়মত রোগেরই চিকিৎসা করে যেতে পারে। এই কারণেই কথাটা বলতে হরেন ডাক্তার সঙ্কুচিত হল।
-বল, কী বলছ?
–আপনাকে বলার দরকার নেই, তবুও–। হরেন ক্ষমা প্রার্থনা করে হাসলে। বাকিটা আর বললে না।
জীবন ডাক্তার কিন্তু একটু অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন। প্রদ্যোত ডাক্তারের মুখ মনে পড়ে গেল। দুজনেই একালের ছেলে প্রায় এক সময়ের পাস-করা ডাক্তার। দীর্ঘকালের পরিচয়ের জন্য প্রদ্যোতের মত কঠিন তিরস্কার করতে না পারলেও উপদেশের ছলে তিরস্কার করতে পারে। অসহিষ্ণুভাবেই জীবন ডাক্তার বললেন–বলার দরকার আছে হরেন, তুমি যা বলছ প্রকাশ করে বল।
হরেন একটু ভেবে নিয়ে বেশ হিসেব করেই বললে—আমরা লক্ষ্য রেখেছি হার্ট আর কিডনির ওপর। তার জন্যে ওষুধ দিচ্ছি; আফিংঘটিত ওষুধে হিকা থামতে পারে। কিন্তু হার্টের কথা ভেবে সেসব ওষুধ ব্যবহার করি নি। প্রেসক্রিপশন তো আপনি দেখেছেন।
আমার ওষুধে হার্টের কোনো অনিষ্ট হবে না, আফিংঘটিত ওষুধ আমি দেব না হরেন, তুমি নিশ্চিন্ত থাক।
১০. ডাক্তার হাঁটছিলেন বেশ একটু জোরে
ডাক্তার হাঁটছিলেন বেশ একটু জোরে জোরে। মনের মধ্যে উত্তাপ যেন ঘুরপাক খাচ্ছে। ওষুধ ঠিক হয়ে গিয়েছে, সে ওষুধ তিনি নিজে তৈরি করে দেবেন। এ দেশেরই সুলভ কয়েকটা জিনিস দিয়ে তৈরি মুষ্টিযোগ। সে কিন্তু ওদের বলবেন না। সংসারে যা সুলভ তার উপর মানুষের আস্থা হয় না। তা ছাড়া এ বলেও দেবেন না। কখনই বলবেন না। এবং একদিনে এই হিক্কা থামিয়ে দিয়ে ওদের দেখিয়ে দেবেন, কী বিচিত্ৰ চিকিৎসা এবং ওষুধ তার আছে। পথ চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। সেতাবকে একবার দেখে গেলে হত। তাহলে কিন্তু ফিরতে হয়, অন্যমনস্কভাবে পথ হাঁটতে হাঁটতে সেতাবের বাড়ির গলিটা ফেলে এসেছেন। থাকবুড়োর জ্বর আজ নিশ্চয় ছেড়ে গিয়েছে। একলাই বোধহয় ছকের উপর দাবার ঘুটি সাজিয়ে বসে আছে। কাল সকালে বরং দেখে যাবেন। এখন তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে এই ওষুধটা তৈরি করে দিতে হবে।
–জীবন মশায়, না কে গো? ওগো জীবন মশায়! পাশের গলি থেকে মেয়েলি গলায় কে ডাকলে।–শোন গো! দাঁড়াও!
দাঁড়ালেন জীবন মশায়। গলির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন এক প্রৌঢ়া বিধবা। নবগ্রামের নিশি ঠাকরুন। বিখ্যাত নিশি ঠাকরুন। গ্রামের এ কালের ছেলেরা আড়ালে আবডালে নিশি ঠাকরুনকে বলে—মিসেস শেরিফ অব নবগ্রাম। গ্রামের মধ্যে অসীম প্ৰতাপ নিশি ঠাকরুনের।
নিশি ঠাকরুন এসেই প্রশ্ন করল—বলি হাগো, একে, মানে রনবাবুর ছেলেকে দেখে এলে? কেমন দেখলে বল তো?
জীবন মশায় প্রমাদ গনলেন। কণ্ঠস্বর শুনে তিনি নিশি ঠাকরুনকে অনুমান করতে পারেন নি। কিন্তু অনুমান করা উচিত ছিল, কারণ এই গলিতে এমনভাবে আধিপত্য খাটানো কণ্ঠস্বরে আর কে ডাকবে? নিশি ঠাকরুন এই গলিতে নিজের দাওয়ার উপর বসে থাকে এবং যাকে দরকার তাকেই ডেকে তার প্রয়োজনীয় সংবাদটি সংগ্রহ করে।
জীবন ডাক্তার সংক্ষেপে বললেন–অসুখ কঠিন বটে, তবে হাল ছাড়ার মত নয়। আমি যাই নিশি, ওষুধ দিতে হবে।
—আঃ, তবু যদি মশায়, তোমার ঘোড়া থাকত! দাঁড়াও না।
–ওষুধ দিতে হবে নিশি।
–তা তো বুঝছি। সঙ্গে লোকও দেখেছি। ওরে লোকটাতুই এগিয়ে চল, ডাক্তার যাচ্ছে। আমার মামাতো ভাইয়ের মেয়েটা বড় ভুগছে। পেটের ব্যানো কিছুতেই সারছে না। একবার দেখে যাও মশায়। এই সব হালের ডাক্তারদের পাল্লায় পড়ে এককাড়ি টাকা খরচ করলাম কিছুতে কিছু হল না। তা তুমি তো আর এ গা মাড়াও না। একেবারে আমাদিকে ছেড়েছ। বলি–অ–নীহার, শুনছিস?
—ডাকতে হবে না, চল দেখেই আসি। ওরে দাঁড়া তুই পাঁচ মিনিট।
বাড়ির মধ্যে ঢুকেই নিশি প্রায় পথরোধ করে দাঁড়িয়ে বললে—ঠিক করে বল দেখি মশায়, রতন মাস্টারের ছেলে বাঁচবে না মরবে?
অবাক হলেন না জীবন মশায়। নিশি ঠাকরুনের স্বভাবই এই। পৃথিবীর গোপন কথাগুলি ওর জানা চাই। জেনে ক্ষান্ত হবে না, প্রচার করে তবে তৃপ্ত হবে।
গম্ভীর কণ্ঠে জীবন মশায় বললেন, আমি তোমাকে লুকিয়ে কথা বলি নি নিশি। নাড়িতে কিছু বুঝতে পারি নি।
–না পার নি! তুমি জীবন মশায়, তুমি বুঝতে পার নি, তাই হয়? লোকে বলে জীবন মশায় রোগীর নাড়ি ধরলে মৃত্যু রোগে মরণ পায়ের চুটকি বাজিয়ে সাড়া দেয়! লুকোচ্ছ তুমি।
এবার ডাক্তার ভ্ৰকুটি করে উঠলেন। নিশি এতে নিরস্ত হল কিন্তু ভয় পেলে না, বললে–আচ্ছা আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। ওই হয়েছে। এখন ওললা ও নীহার! বলিযাস কোথায় লা?
—কী পিসি? নীহার এতক্ষণে উত্তর দিলে ঘরের ভিতর থেকে। একটুখানি দরজা খুলে উঁকি মারলে মেয়েটি। সঙ্গে সঙ্গে আচারের গন্ধ পেলেন জীবন মশায়। মেয়েটি ঘরের মধ্যে লুকিয়ে আচার খাচ্ছিল। আমাশয় পেটের অসুখের ওটা একটা উপসর্গ। রোগটা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। নইলে অনিষ্টকারক বস্তুতে রুচি কেন?
মেয়েটি বেরিয়ে এল।
শীর্ণ কঙ্কালসার বাসি অতসী ফুলের মত দেহবর্ণ একটি কিশোরী। মাথায় সিন্দুর। বয়সে কিশোরী হলেও সন্তানের জননী হয়েছে।
জীবন মশায় চমকে উঠলেন। সর্বাঙ্গে যেন কার ছায়া পড়েছে।
নিশি ঠাকরুন বললে, গৰ্ভসূতিকা হয়েছে। দুটি সন্তান। সব ভেসে যাবে মশায়। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কেঁদে ফেললে নিশি।
দুটি সন্তান। কত বয়স? চোদ্দ? দুটি সন্তান? ডাক্তার সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলে।
চোখ মুছে মুহূর্তে সহজ হয়ে নিশি বললে–পূর্ণ বারতে প্রথম সন্তান হয়েছে। নেকটানেকটি বিয়েন—চোদ্দ বছরে কোলেরটি। চাঁদের মত ছেলে মশায়, কী বলব তোমাকে, চোখ জুড়িয়ে যায়।
চাঁদ নয় যম। মাকে খেতে এসেছে। বাপের মূর্তিমান অসংযম। সমস্ত অন্তরটা তিক্ত হয়ে উঠেছিল জীবন ডাক্তারের। এইসব অনাচারীর সাজা হয় না? পরক্ষণেই দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। ডাক্তার। বাবা বলতেন—রোগী যখন দেখবে বাবা, তখন কোনো কারণে তার ওপর ক্রোধ বা ঘৃণা কোরো না, করতে নাই। তিনি বলতেন, মানুষের হাত কী বাবা? মানুষ তো ক্রীড়নক।
তাঁর অ্যালোপ্যাথিক শাস্ত্রের গুরু রঙলাল ডাক্তার বলতেন মানুষ বড় অসহায়। তার অন্তরে পশুর কাম, ক্ৰোধ, লোভ; অথচ পশুর দেহের সহনশক্তি তার নাই! ওদের ওপর রাগ কোরো না! করতে পার, অধিকার অবশ্যই তোমার আছে। কিন্তু তা হলে চিকিৎসকবৃত্তি নিতে পার না।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ডাক্তার বললেন–এতদিন কী করছিলে নিশি?
—এই এটা-সেটা। তা ছাড়া সূতিকা তো হয় মশায়, এমন হবে কী করে জানব বল? তারপরে এই দিন কতক হালের ডাক্তারদের দেখলাম, ওরা আবার নানান কথা বলে। এই লম্বা খরচের ফর্দ। সে আমি কোথায় পাব?
—হুঁ। বলেই থেমে গেলেন ডাক্তার।
নিশির কথা তখনও ফুরোয় নি–বাঈয়ের কবচ, দেবতার ওষুধ, অনেক করেছি।
তা বুঝতে পেরেছেন ডাক্তার। গলায় এক বোঝা মাদুলি। হাতে ন্যাকড়ায় বাধা জড়িপুষ্প। কিন্তু কী করবেন? ডাক্তারই বা কী করবেন? আছে একমাত্র ওষুধ। কবিরাজি–সূচিকাভরণ।
পারবে? জল বারণ। খাওয়াতে পারবে নিশি?
–জল বারণ? নিশিও চমকে উঠল। কী বলছ মশায়?
–হাঁ! জল বারণ। দেখি আর একবার হাতখানি খুকি!
মরণ-রোগক্লিষ্টা খুকি—মুখে কাপড় দিয়ে হাসে। দুই সন্তানের জননী সে–সে নাকি খুকি? ডাক্তারও হাসেন। সঙ্গে সঙ্গে গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন। একমাত্র উপায় বিষ। বিষম। রোগের বিষজ ঔষধ! নাড়িতে পদধ্বনি শুনছেন তিনি।
নিশি মিথ্যা বলে নি। মরণের পায়ে এদেশের মেয়েদের চুটকি থাকলে তার ঝুমঝুম বাজনাও শুনতে পেতেন ডাক্তার। লোকে বলত, কেমন বাপ, কেমন শিক্ষা দেখতে হবে! বাপ ছিলেন গুরু, তিনি ছিলেন এই নাড়ি-পরীক্ষা বিদ্যায় প্রায় সিদ্ধপুরুষ। দীক্ষার নি ব্যাকরণ পাঠ আরম্ভের পর যেদিন হাতে-কলমে নাড়ি-পরীক্ষা বিদ্যায় শিক্ষা দিয়েছিলেন সে দিনটিও ছিল অতি শুভ দিন। বৈশাখী অক্ষয় তৃতীয়া।
এই বৃদ্ধ বয়সেও সেদিনের কথাগুলোকে মনে হচ্ছে যেন কালকের কথা। স্পষ্ট মনে পড়ছে সব। পথ চলতে চলতে মশায় ভাবছিলেন কথাগুলি।
***
হিক্কার ওষুধ তৈরি করে ওষুধ খাওয়ার প্রণালী পালনের নিয়ম কাগজে লিখে রতনবাবুর লোকের হাতে দিয়ে জীবন মশায় আয়ুর্বেদ-ভবনের দাওয়ার উপর বসে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। নিশি ঠাকরুনের কথা কয়টিই আবার মনে পড়ল।
চাকর ইন্দির এসে কোটা বাড়িয়ে দিয়ে দাঁড়াল।
ডাক্তার তার মুখের দিকে তাকালেন। ভাবছিলেন রতনবাবুর ছেলে বিপিনের হিষ্কার কথা। বোধ করি কাল ভোর নাগাদ হিক্কার উপশম হবে। কমে আসবেই। কী বলবে প্রদ্যোত ডাক্তার?
—তামাক খান। আর মা বললেন– চায়ের জল ফুটছে।
অর্থাৎ বাড়ির ভিতর যাবার জন্যে আতর-বউ বলে পাঠিয়েছেন। কোটি হাতে নিয়ে ডাক্তার বললেন–চা বরং তুই নিয়ে আয়। এখন আর উঠতে পারছি না।
—এই খোলাতে বসে থাকবেন? আকাশে মেঘ ঘুরছে। বৃষ্টি নামবে কখন!
আকাশের দিকে চাইলেন ডাক্তার। শ্রাবণের আকাশে এক স্তর ফিকে মেঘের নিচে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ ঘুরছে, এক যাচ্ছে এক আসছে। গতি দেখে ডাক্তারের মনে হল—বৃষ্টি আসবে না। বললেন, বেশ আছি। বৃষ্টি আসবে না।
তবু দাঁড়িয়ে রইল ইন্দির। ডাক্তারের মনে পড়ল, বাজারের খরচ চাইছে ইন্দির।
নিয়ম হল ডাক্তার কল থেকে ফিরে টাকাগুলি আতর-বউয়ের হাতে দিয়ে থাকেন। আজকাল ডাক্তার ব্যবসা প্রায় ছেড়েছেন। এককালে কুড়ি পঁচিশ ত্রিশ টাকা দৈনিক পকেটে নিয়ে ফিরতেন। এখন কোনোদিন চার টাকা কোনোদিন ছয় কোনোদিন বা দু টাকা। এক একদিন কল আসে না। আবার বেশি দূরের কল যাতে টাকা বেশি তাতে ডাক্তার নিজেই যান না। আজ ডাক্তার আতর-বউকে টাকা দেন নি। পরান শেখের বাড়ি থেকে ফিরে খাওয়াদাওয়ার পরই আতর-বউয়ের সঙ্গে কলহ বেধেছিল। তারপর কিশোর এসে ডেকে নিয়ে গেল রতনবাবুর বাড়ি। ডাক্তার ইতিমধ্যেই জামা খুলে খালি গা করে বসেছিলেন। জামাটা ইন্দিরের হাতে তুলে দিলেন। বললেন–পকেটে টাকা আছে দেখ–
—চার টাকা।
–দিগে আতর-বউকে। আমাকে আর বিরক্ত করিস নে।
–আর দুটো কল্কে সেজে রেখে যাই?
—যা, তাই যা। তুই বড় বেশি বকিস।
আকাশের দিকে চেয়ে কথা বলছিলেন ডাক্তার। দেখছিলেন আকাশের মেঘইন্দিরের কথার দিকে ছিল কান, মুখে তার জবাবও দিচ্ছিলেন কিন্তু মনের মধ্যে ঘুরছিল বিপিনের হিক্কার কথা, প্রদ্যোতের কথা, নিশির কথা। লোকে বলে জীবন মশাই নাড়ি ধরলে মরণ পায়ের চুটকি বাজিয়ে সাড়া দেয়। কেমন বাপ, কেমন শিক্ষা!
***
সেদিন ছিল বৈশাখের অক্ষয় তৃতীয়া। পুত্রের দীক্ষার জন্য এই প্রথম শুভ দিনটিই নির্বাচন করেছিলেন জগৎমশায়। একান্তে নিৰ্জন ঘরে পুত্রকে কাছে বসিয়ে তিনি যেন তার চৈতন্যকে প্রবুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন সেদিন। বাড়িতে বলে রেখেছিলেন যেন কেউ তাদের না ডাকে, কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি না করে।
জীবন অল্পস্বল্প নাড়ি দেখতে জানতেন। চিকিৎসকের বাড়ির ছেলে। বাল্যকালে খেলাচ্ছলে খেলাঘরে বৈদ্য সেজে বসে সঙ্গী সাথীদের হাত দেখতেন, কাদামাটি, ধুলো কাগজে মুড়ে ওষুধ। দিতেন। জীবনের মা পর্যন্ত নাড়ি দেখতে জানতেন। সেদিন বাপ তাকে প্রথম পাঠ দিয়ে নাড়িতত্ব বুঝিয়ে মৃত্যুর কাহিনী বলে আয়ুর্বেদ-ভবনে যেসব রোগীরা এসেছিল তাদের কয়েকজনের নাড়ি নিজে পরীক্ষা করে ছেলেকে বলেছিলেন, দেখ–এর নাড়ি দেখ।
রোগীকে ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দিয়ে অন্যদিকে যেদিকে ওষুধ পাওয়ার ব্যবস্থা সেই দিকে। পাঠিয়ে দিয়ে জীবনকে রোগীর নাড়ির বৈশিষ্ট্য বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। এই ছিল জগত্মশায়ের শিক্ষার ধারা।
আয়ুর্বেদ-ভবনের কাজ শেষ করে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কয়েকটি রোগীকে রোগীর বাড়িতে গিয়ে দেখে বাড়ি ফেরার পথে বলেছিলেন বাবা, যে চিকিৎসক নাড়িবিজ্ঞানে সিদ্ধিলাভ করতে পারে তার সঙ্গে মৃত্যুকে সন্ধি করতে হয়। মৃত্যুর যেখানে অধিকার সেখানে মৃত্যু বলে—আমার পথ ছেড়ে দাও। এ আমার অধিকার। আর যেখানে তার অধিকার নাই সেখানে ভুলক্রমে উঁকি মারলে চিকিৎসক বলেন-দেবী, এখনও সময় হয় নাই, এক্ষেত্রে তোমাকে স্বস্থানে ফিরতে হবে।
কারণ এমন চিকিৎসকের রোগনির্ণয়েও ভ্রান্তি ঘটে না, ঔষধ নির্বাচনেও ভুল হয় না। মৃত্যু যেমন অমোঘ, পঞ্চম বেদ আয়ুর্বেদের স্রষ্টা ব্ৰহ্মার সৃষ্টি ভেষজ এবং ওষধির শক্তিও তেমনি অব্যৰ্থ। যে ব্রহ্মার কুটিকুটিল দৃষ্টি থেকে সৃষ্টি হল মৃত্যুর, সেই ব্ৰহ্মারই প্ৰসন্ন দৃষ্টি থেকে সৃষ্টি হয়েছে ভেষজের। ব্ৰহ্মা এই শাস্ত্র দিয়েছিলেন দক্ষ-প্রজাপতিকে, দক্ষের কাছ থেকে এই শাস্ত্র পেয়েছিলেন অশ্বিনীকুমারেরা, তাদের কাছ থেকে পেলেন ইন্দ্ৰ, ইন্দ্র দিলেন ভরদ্বাজ আর দিবদাস ধন্বন্তরিকে। এইখানে আয়ুৰ্বেদ দু ভাগে ভাগ হয়েছে। ধন্বন্তরি শল্যচিকিৎসার ভাগ। পেয়েছিলেন। তারপর পুনর্বসু এবং আত্রেয়। তারপর অগ্নিবেশ। আচার্য অগ্নিবেশ রচনা করেছিলেন অগ্নিবেশ সংহিতা। এই সংহিতা থেকেই চরক সংহিতার সৃষ্টি। পঞ্চনদ প্রদেশের মনীষী চরক এই সংহিতাকে নতুন করে সংস্কার করেছিলেন। চরক হলেন চিরজীবী। কথা বলতে বলতেই পথ চলছিলেন পিতাপুত্রে। চলেছিলেন গ্রামান্তরে। জগন্মশায় সচরাচর গাড়ি পালকি ব্যবহার করতেন না। বেশি দূর হলে তবে গরুর গাড়ির এবং তাড়াতাড়ি যাওয়ার প্রয়োজন হলে তবে ড়ুলিতে চাপতেন। সেদিন ছেলেকে দেখিয়েছিলেন ঠিক আজকের ওই নিশির ভাইঝির মত একটি রোগিণী। ঠিক এমনি। কিশোরী মেয়ে, বড়জোর ষোল বছর বয়স সে আবার দুই সন্তানের পর তৃতীয়বার সন্তানসম্ভবা ছিল।
সেদিকে ফিরবার পথে জগৎমশায় বলেছিলেন–নির্দিষ্ট আয়ুর কথা শাস্ত্রে আছে। কিন্তু কর্মফলে সে আয়ুরও হ্রাসবৃদ্ধি আছে। ব্যভিচার করে মৃত্যুকে নিমন্ত্রণ করে আনে মানুষ। এসব ক্ষেত্রে তাই—অথচ–।
চুপ করে গিয়েছিলেন জগৎমশায়, বোধহয় সংশয় উপস্থিত হয়েছিল নিজের মনে। একটু চুপ করে থেকে বলেছিলেন, এক এক সময় শাস্ত্রবাক্যে সংশয় জাগে, জীবন। আমাদের শাস্ত্রে বলে স্বামীর পাপের ভাগ স্ত্রী গ্রহণ করে না। কিন্তু এক্ষেত্রে কী বলব? এক্ষেত্রে স্বামীর অমিতাচারের ফল ভোগ করছে মেয়েটা, সেই হেতুতেই ওকে যেতে হবে অকালে।
আবার খানিকটা চুপ করে থেকে বলেছিলেন-হয়তবা প্রাক্তন জন্মান্তরের কর্মফল ওই মেয়েটার—তার ফলেই স্বল্পায়ু হয়েই জন্মেছিল। তাই বা কে বলবে?
সেদিন জীবন মশায়ও ওই কথাতেই বিশ্বাস করেছিলেন। মনে মনে নিজের ভাগ্যবিধাতাকে। প্ৰণাম জানিয়েছিলেন। তাকে পরিত্রাণ করেছেন তিনি। মঞ্জরী স্বাস্থ্যবতী বটে, কিন্তু বয়স তো বার বৎসর। কে বললে—মঞ্জরীর ঠিক এই পরিণতি হত না?
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আজ বৃদ্ধ জীবন মশায় আকাশের দিকে চাইলেন আবার। এক বিচিত্ৰ হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। দাড়িতে হাত বুলালেন। আকাশে রক্তসন্ধ্যা দেখা দিয়েছে। গাঢ় লাল হয়ে উঠেছে দিগন্তবিস্তৃত মেঘস্তর। তার নিচে বকের সারি উড়ে চলেছে। হঠাৎ এতক্ষণে চোখে পড়ল সামনে ঢাকা রয়েছে চায়ের বাটি। ইন্দির কখন রেখে গিয়েছে। অতীত কথা স্মরণ করতে গিয়ে চায়ের কথা মনে হয় নি। ইন্দির নিশ্চয় কথা বলেছিল, খেয়াল করে দেবার চেষ্টাও সে নিশ্চয় করেছিল কিন্তু সে তিনি স্মরণ করতেই পারছেন না।
থাক। আজ চা থাক।
অতীত কালের কথার একটা নেশা আছে। বড় মনোরম বর্ণবিন্যাস। চোখে পড়লে আর ফেরানো যায় না। বিশেষ করে যেখানটার কথা মনে পড়ছে এখন সেখানটা যেন ওই আকাশের রক্তসন্ধ্যার বর্ণচ্ছটার মতই গাঢ়।
পথে তিনি ভাগ্যবিধাতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এলেন—মঞ্জরীর বন্ধন থেকে পরিত্রাণ দেওয়ার জন্য। আর বাড়ি ফিরেই দেখলেন–।
আবার হাসলেন এবং বার কয়েক দাড়িতে হাত বুলোলেন। হা কর্ম-পাক নিয়ে যিনি চক্র রচনা করেন তিনি যেমন চক্রী তেমনি রসিক।
***
সেদিন তৃতীয় প্রহরের শেষে তারা বাড়ি ফিরেছিলেন। মা বসে ছিলেন, তাঁরা ফিরে এলে ভাত চাপিয়ে দেবেন। অবশ্য সে দিক দিয়ে বিশেষ অনিয়ম হয় নি। চিকিৎসকের খাওয়া তৃতীয় প্রহরেই ঘটে।
মুখ-হাত ধুয়ে ভিজে গামছা পিঠে বুলিয়ে জগৎমশায় বললেন––জীবনকে কুলকর্মে দীক্ষা দিয়ে আজ আমি নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু জীবনের মা, তোমার মুখ এমন কেন?
কেমন?–যেন খুব চিন্তান্বিত মনে হচ্ছে। কিছু ভাবছ?
কী ভাবব? জীবনের মা কথাটা উড়িয়ে দিলেন যেন।–তা বটে। কী ভাববে! মেয়েদের ভাবনা অলঙ্কারের, মেয়ের বিয়ের, ছেলের বিয়ের। সুতরাং দুটোর একটা ভাবতে পার।
হাসলেন জীবনের মা। উঠে গিয়ে উনানে চড়ানো বকনোর ঢাকা খুলে হাতায় ভাত তুলে টিপে দেখতে বসলেন।
জগত্মশায়ের মনটা সেদিন প্রসন্ন ছিল—নির্মেঘ শরৎকালের আকাশের মত। তিনি প্রসন্ন। হেসে বললেন– কী, উত্তর দিলে না যে?
পিছন ফিরেই মা উত্তর দিলেনকী বলব? তুমি অন্তৰ্যামী। ভাবছি না বললেও বলছ–ভাবছ। তা হলে তুমিই বলে দাও কী ভাবছি?
জীবনের অভিভূত ভাবটা তখনও কাটে নি। তার মাথার মধ্যে তখনও প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল বাপের গম্ভীর মৃদুস্বরের কথাগুলি।
অভিভূত ভাবটা আকস্মিক একটা আঘাতে কেটে গেল। জীবন চমকে উঠল।
খাওয়াদাওয়ার পর ছোট রেকাবিতে হরীতকীর টুকরো নামিয়ে দিয়ে জীবনের মা বললেন–তুমি অন্তৰ্যামীই বটে। তামাসা তোমাকে আমি করি নি। কঁদী থেকে চিঠি নিয়ে দুপুরে লোক এসেছে। জানি না কী লেখা আছে, তবে কে চিঠি পাঠিয়েছে, তার নাম জেনে আমার ভাবনা হয়েছে। না ভেবে থাকতে পারি নি আমি। নবকৃষ্ণ সিংহ চিঠি লিখেছে—এই দেখ।
চিঠিখানি পড়লেন জগদ্বন্ধু মশায়। চমকিত হয়ে জীবন উদ্বিগ্নচিত্তে বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু মুখ দেখে কিছু অনুমান করতে পারলে না। জগদ্বন্ধু মশায় চিঠি শেষ করে স্থির দৃষ্টিতে বৈশাখের উত্তপ্ত আকাশের দিকে চেয়ে রইলেন।
মনে পড়ছে জীবন ডাক্তারের।
সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছিল। তৃতীয় প্রহরের শেষ পাদ। পূর্বদুয়ারী ঘরের বারান্দায় বসে ছিলেন : সামনে পশ্চিমদুয়ারী একতলা রান্নাঘরের চালার উপর দিয়ে, আচার্য ব্রাহ্মণদের বাড়ির উঠানের বকুল গাছের মাথার উপর দিয়ে রৌদ্রদগ্ধ বৈশাখী আকাশ যেন পোমগ্ন রুদ্রের অর্ধনিমীলিত তৃতীয় নেত্রের বহ্নির ছটায় ক্লিষ্ট নিথর। দিকে দিগন্তরে কোথাও ধ্বনি শোনা যায় না। বাতাসও ছিল না সেদিন। মনে হয়েছিল, বোধহয় সন্ধ্যার দিকে কালবৈশাখীর ঝড় উঠবে। পশ্চিম দিগন্তে আয়োজন হতে আরম্ভ হয়েছে। জীবন ওই আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারও বুকে বোধহয় ঝড় উঠবে মনে হয়েছিল। কী লিখেছে নবকৃষ্ণ সিংহ? মঞ্জরী, হয়ত মঞ্জরীর মা—এরা যে ওই দেউলিয়া অভিজাত ঘরের বর্বর ছেলেটার মোহে মুগ্ধ তাতে তার সন্দেহ নাই। বঙ্কিম মঞ্জরী সম্পর্কে তো নাই-ই, কোনো সন্দেহই নাই। তাকে নিয়ে তারা খেলা করেছে। তাই বা কেন? সে নিজেই মূৰ্খ বানর তাই তাদের বাড়ি গিয়ে বানর-নৃত্য করেছে—তারা উপভোগ করেছে। বানর-নৃত্য নয়—লুক-নৃত্য। মঞ্জরী মধ্যে মধ্যে তাকে ভালুকও বলত। ভালুক নাচই সে নেছেছে। ভালুক আর বানরে প্রভেদই বা কী? দুটোই জানোয়ার-দুটোই নির্বোধ! কিন্তু কী লিখেছে নবকৃষ্ণ সিংহ? মিথ্যা কদর্য অভিযোগ! কী করবে জীবন? ভগবান সাক্ষী, কিন্তু ভগবান তো সাক্ষি দিতে আসেন না। তিনি তো বলবেন না প্রাণ দিয়ে ভালবাসা। যদি অপরাধ হয় তবে জীবন অপরাধী। নইলে সে কোনো অপরাধ করে নাই। সে মৃত্যুদণ্ড প্রতীক্ষারত আসামির মতই অপেক্ষা করে রইল।
মশায় দৃষ্টি নামিয়ে বললেন––জীবনের মা! তাঁর কণ্ঠস্বর গম্ভীর।
চিন্তিত মুখেই জীবনের মা প্রতীক্ষা করছিলেন। সাগ্রহে তিনি বললেন–বল! শোনবার জন্য তো দাঁড়িয়েই আছি।
–জীবনের বিবাহের আয়োজন কর।
–কার সঙ্গে? ওই মেয়ের সঙ্গে? নবকৃষ্ণ সিংহের মেয়ের সঙ্গে?
–হ্যাঁ, দিতেই হবে বিবাহ। নবকৃষ্ণ সিংহ লিখেছেন—এই ঘটনায় এখানে তাঁর কন্যার দুর্নাম রটেছে চারিদিকে। ওই যে কুৎসিত প্রকৃতির ছেলেটিসে তার কন্যা মঞ্জরীকে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নানারকম মন্তব্য করেছে। বলেছে—ঘটনার দিন সে নাকি জীবনকে আবীর দেবার ছলে মঞ্জরীর অঙ্গে হাত দিতে দেখেছে।
মা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন––জীবন!
মাকে এমন মূর্তিতে কখনও জীবন দেখে নাই।
মা আবার বললেন–,বল, আমার পায়ে হাত দিয়ে বল–
জীবন সেদিন যেন নবজন্ম লাভ করেছে—বাপের সাহচর্যের ফলে, তাঁর অন্তরের স্পর্শে। সে উঠে এসে পায়ে হাত দিয়ে বললে–আমি তার কপালে আবীর দিয়েছি। আর কোনো দোষে দোষী নই আমি।
মশায় বললেন–কর কী জীবনের মা? ছি! বিবাহের আয়োজন যখন করতে বলছি, তখন ও-সব কেন? জীবন মনে মনে মেয়েটিকে কামনা করে। এক্ষেত্রে কি শপথ করায়? ছি! বিবাহের আয়োজন কর।
—সে কী? কোষ্ঠী দেখাও। নিজে মেয়ে দেখ। তারপর কথাবার্তা দেনাপাওনা–
–কিচ্ছু না, এক্ষেত্রে ওসব কিছু না। ছক এই চিঠির সঙ্গে আছে। ওটা আমি ছিঁড়েই দিচ্ছি, কী জানি যদি বাধার সৃষ্টি করে; আর দেনা-পাওনাই বা কী? কী লিখেছেন তিনি জান? লিখেছেন, আপনাদের বংশের উপাধিই হইয়াছে মহাশয়। মহাশয়ের বংশ আপনার। আপনি নিজে ও অঞ্চলে বিখ্যাত চিকিৎসক। আপনার পুত্র ডাক্তারি পড়িবার জন্য প্রস্তুত হইতেছে। এ অবশ্যই আমার বামন হইয়া চাঁদ ধরিবার বাসনা। কিন্তু যেরূপ ক্ষেত্র হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে আপনি প্রত্যাখ্যান করিলে আমার কন্যাকে গঙ্গার জলে ভাসাইয়া দিতে হইবে।
—আর কোনো কথা নয়। আয়োজন কর। বৈশাখে আর এক-দিনে বিবাহ হয় না। না। জ্যৈষ্ঠ মাসে জ্যেষ্ঠপুত্রের বিবাহ দেশাচারে নিষিদ্ধ। প্রথম আষাঢ়েই বিবাহ হবে।
১১. অতীত কালের কথা মনে করে
অতীত কালের কথা মনে করে যতই মনের মধ্যে বিচিত্র রসের সঞ্চার হয়—বৃদ্ধ জীবন মশায় ততই ঘন ঘন দাড়িতে হাত বোলান। সাদা দাড়ি, তামাকের ধোঁয়ায় খানিকটা অংশে তামাটে রঙ ধরেছে। যত্ন অভাবে করকরে হয়ে উঠেছে। তবুও হাত না বুলিয়ে পারেন না। সঙ্গে সঙ্গে হাসেন, সেকালের তরুণবয়সী নিজেকে পরিহাস করেন এই হাসির মধ্যে। একা নিজেকেই বা কেন—সমস্ত মানুষকেই করেন।
যৌবনে কী একটা আছে; জলের যেমন ঢালের মুখে গতির বেগ তেমনি একটা বেগ; যৌবনের মন যখন কোনো একজনের দিকে ছোটে তখন ওই বেগে ছোটে, তখন শাস্ত্রের কথা, ভালমন্দ বিবেচনার কথা, সমাজের বাধার কথা, হাজার কথাতেও কিছু হয় না, মন বাগ মানে না। এই সব শাস্ত্ৰকথাগুলিকে যদি বালির বাঁধের সঙ্গে তুলনা করা যায় তবে মন সেখানে ঢালের টানে ছুটন্ত জলস্রোত। হয় বাঁধ ভাঙে নয় জল শুকায়।
তাই তো আজ হাসছেন জীবন মশায়। সেই দিনই ওই রোগিণী দেখে ফিরবার পথে মঞ্জরীর সঙ্গে বিবাহ-সম্ভাবনা বন্ধ হওয়ায় তরুণ জীবন ভাগ্যবিধাতাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল। মঞ্জরীর আসল চেহারা দেখতে পেয়ে তার ওপর বিতৃষ্ণার সীমাও ছিল না। কিন্তু যে মুহূর্তে জগৎমশায় স্ত্রীকে বললেন– প্রথম আষাঢ়ে বিবাহ হবে, সেই মুহূর্তেই তরুণ জীবন সব ভুলে গিয়েছিল। শুধু ভুলে যাওয়াই নয়, মনে হয়েছিল হাত বাড়িয়ে সে আকাশের চাঁদের প্রায় নাগাল পেয়েছে। যেটুকু ব্যবধান রয়েছে আষাঢ় মাস পর্যন্ত নিশ্চয় সে ততখানি বেড়ে উঠবে।
জীবন দত্তের প্রত্যাশার আনন্দে টলমল মনের পাত্র হতে আনন্দ যেন উথলে উঠে তাঁর চারপাশে পড়েছিল। পৃথিবীর যতটুকু অংশ তার চোখে পড়েছিল সমস্তটুকু আনন্দময় হয়ে উঠেছিল। সব মধু। মধু বা ঋতায়তে!
ওদিকে পত্রবিনিময় চলছিল। জগৎমশায় পত্র দিয়েছিলেন নবকৃষ্ণ সিংহকে। কয়েক দিন পরই সে পত্রের উত্তর এল।
নবকৃষ্ণ সিংহ দ্বিতীয় পত্র লিখেছিলেন মঞ্জরী আমার লজ্জায় দুঃখে শয্যাগ্রহণ করিয়াছিল। আপনার পত্ৰ আসিবার পর তাহার মুখে হাসি ফুটিয়াছে। সে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে। তাহার মাকে বলিয়াছে—আমার শিবপূজা মিথ্যা হয় নাই।
জীবন দত্ত আনন্দে আপনাকে হারিয়ে ফেলেছিলেন। মঞ্জরী লজ্জায় দুঃখে শয্যাগ্ৰহণ করেছিল, জীবনের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধের কথা শুনে সে উঠে বসেছে? মুখে হাসি ফুটেছে? দুঃখের শয্যা ছেড়ে মঞ্জরীর হাসিমুখে উঠে বসার কথা মনে হতে তার চোখের সামনে ফুলে ফুলে সর্বাঙ্গ ভরা গুলঞ্চফুলের গাছটার ছবি ভেসে উঠেছিল।
ছুটে গিয়ে সেতাবকে , সুরেন্দ্রকে এবং নেপালকে দেখিয়েছিলেন চিঠিখানা। চিঠিখানা তিনি চুরি করেছিলেন।
নিজের গ্রামের সুরেন্দ্র এবং নবগ্রামের সেতাব ও নেপাল ছিল তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু। সুরেন আর নেপাল তখন মদ ধরেছে। সেকালে এ অঞ্চল সম্পর্কে লোকে বলত মাটিতে মদ খায়। তা খেত। তের চোদ্দ বছর হতেই মদ খেতে শিখত। তান্ত্রিকের দেশ, সবাই তান্ত্রিক বিশেষ তো ব্রাহ্মণেরা। তারপর দীক্ষা হলে ওটা সঁড়াত ধৰ্মসাধনের অঙ্গ। অর্থাৎ প্রকাশ্যেই খাওয়ার অধিকার পেত। খেত না শুধু সেতাব। সেতাবও ব্রাহ্মণ, শাক্ত ঘরের সন্তানও বটে, কিন্তু ভড়কে যেত। সেতাব সমস্ত জীবনটা পিতলের পাত্রে নারিকেলের জল ঢেলে তাই দিয়ে তান্ত্ৰিক তৰ্পণ চালিয়ে এল।
সুরেন গ্রামের ছেলে। ঠাকুরদাস মিশ্রের ছেলে। জমিদারি সেরেস্তার পাটোয়ারী কাজ শিখেছে। চতুর ছেলে। সে বললে—আজ তোকে খাওয়াতে হবে। মদ-মাংস খাব। দে, টাকা ফেল।
নেপাল বাপের আদুরে ছেলে। সবরেজেষ্ট্রি আপিসের কেরানী তার বাবার অনেক রোজগার। নবগ্রামের ছড়ায় ছিল—বিনোদ বুড়ো লম্বা জামায়, পকেট ভরে রেজকি কামায়। বিনোদ মুখুজ্জে সত্যিই রেজকি বোঝাই পকেট দুটো দুই হাতে ধরে বাড়ি আসত। নেপাল লোক ভাল। হাউ-বাউ করে বকত, হা-হা করে হাসত, দুম দুম করে চলত, সাদা দিলখোলা মানুষ। একবার রাঘবপুরে ব্রাহ্মণভোজনে নেমন্তন্ন খেতে যাবার পথে হঠাৎ নেপালের খেয়াল হল পৈতে নেই গলায়, কোথায় পড়েছে। নেপাল পথে কালী বাউরিকে দেখে জিজ্ঞাসা করছিল কী করি বল তো কেলে? আমাকে একটা পৈতে দিতে পারিস? জীবনের বাড়ি এসে মশায়ের কবিরাজখানায় ঢুকে কামেশ্বর মোদকের বদলে খানিকটা হরীতকী খণ্ডই খেয়ে ফেলত অম্লান বদনে। স্বাদেও বুঝতে পারত না। এবং তাতেই তার নেশাও হত।
নেপাল সেদিন বলেছিল-হাম, হাম খাওয়ায়েঙ্গা। আমি খাওয়াব।
নেপালই সেদিন খাইয়েছিল। তিন টাকা খরচ হয়েছিল। লুচি মাংস মিষ্টি মদ। গান-বাজনা হয়েছিল রাত্রি দুটো পর্যন্ত। সুরেন তবলা সঙ্গত করেছিল—জীবন আর নেপাল গান গেয়েছিল। সেতাব ছিল শ্রোতা।
চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতির পদাবলী। পূর্বরাগের পালাটাই শেষ করে ফেলেছিল তিন জনে। সেতাব ঘাড় নেড়েছিল, বাহবা দিয়েছিল।
ভুল হচ্ছে। বৃদ্ধ জীবন দত্ত দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন এতক্ষণে। এতকাল পরে ভুল হয়ে যাচ্ছে। জীবন নিজেই সেদিন গুলঞ্চ চাপার ফুলের মালা গেঁথেছিল। এক গাছি নয় চার গাছি। চার বন্ধু গলায় পরেছিল।
নেপাল এবং সুরেন সেদিন তাকে পায়ে ধরে সেধেছিল—একটু খা ভাই। আজ এমন সুখের সংবাদ পেয়েছি, আজ একটু খেয়ে দেখ! একটু!
জীবন কিন্তু ধর্মভ্রষ্ট হন নি।
বৈষ্ণব-মন্ত্ৰ-উপাসকের বংশ। মহাশয়ের বংশ। তিনি খান নি। তিনি বলেছিলেন না। ভাই। বাবার কথা তো জানিস। মঞ্জরীদের বাড়িও ঠিক আমাদের মত। তারাও বৈষ্ণব।
ওদিকে বাড়িতে চলছিল মহাসমারোহের আয়োজন। জগদ্বন্ধু মশায়ের একমাত্র সন্তানের বিবাহ। ব্রাহ্মণভোজন, জ্ঞাতিভোজন, নবশাখভোজন, গ্রামের অন্য লোকদের খাওয়াদাওয়া এমনকি আশপাশের মুসলমান পল্লীর মিঞা সাহেবদের লুচি মিষ্টি খাওয়ানো, ব্যবস্থার ত্রুটি রাখেন নি জগদ্বন্ধুমশায়। বাজনা, বাজি পোড়ানো, রায়বেশে তার ওপর দুরাত্রি যাত্ৰাগান হবে কি না এ নিয়েও কথা চলেছিল। সুরেন-সেতাব-নেপাল থেকে গ্রামের ঠাকুরদাস মিশ্রের মত মাতব্বর পর্যন্ত ধরেছিলেন—সে কি হয়! যাত্ৰাগান করাতে হবে বৈকি। না হলে অঙ্গহীন হবে।
মশায় বলছিলেন-আষাঢ় মাসের কথা। বৃষ্টি নামলে সব পণ্ড হবে। শামিয়ানাতে জল আটকাবে না। তার ইচ্ছা ওই খরচে বরং গ্রামের সরকারি কালীঘরের মেঝে দাওয়া বাঁধানো হোক, ঘরখানারও সংস্কার হোক।
এই প্রতীক্ষার কাল যত সুখের তত উদ্বেগের। উদ্বেগে দিনকে মনে হয় মাস, মাসকে মনে হয় বৎসর। তবুও কাটল দিন। আষাঢ়ের এগারই বিবাহ, আষাঢ়স্য প্রথম দিবস এল। আকাশে মেঘ এল। সে মেঘ ভুবন বিদিত বংশের পুষ্কর মেঘ নয়। অশনিগৰ্ভ কুটিলমনা কোনো অজ্ঞাতনামা মেঘ। বর্ষণের ফলে বজ্ৰপাত হয়ে গেল সে মেঘ থেকে।
মঞ্জরী নাই।
বেলা দুপহরের সময় তোক এল পত্র নিয়ে। পত্রে লেখা ছিল—গত পরশ্ব রাত্রে আমার কন্যা বিসূচিকা রোগে মারা গিয়াছে।
এক মুহূর্তে সুখস্বপ্ন একেবারে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। সেকালের তরুণ জীবন দত্ত। সেকালের মানুষের বিবাহিত পত্নীর মৃত্যুতে বুকখানা ফেটে চৌচির হয়ে গেলেও আর্তনাদ বের হত না মুখ থেকে। এ তো ভাবী পত্নী। জীবন কাঁদে নি। নির্জনে কবিরাজখানার উপরের ঘরে চুপ করে বসে ছিল। হঠাৎ ঠাকুরদাস মিশ্রের উচ্চ চিৎকারে চমকে উঠেছিল।
চিৎকার করছিল ঠাকুরদাস মিশ্র।–আমি ঠাকুরদাস মিশ্ৰ—আমার চোখে ধুলো দেবে? লোকে ডালে ডালে যায়—আমার আনাগোনা পাতায় পাতায়। মুখ দেখে আমি মতলব বুঝতে পারি, পাটোয়ারিগিরি করে খাই আমি। এদিকের চার দিকে গোলমাল চলছে, ওদিকে বেটা সুট করে উঠে রাস্তায় নামল! আমার সন্দেহ হল। কী ব্যাপার? জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় যাবে হে? বললে—একবার মাঠে যাব। প্রথমটা বুকটা ধড়াস করে উঠল। সেখানে ওলাউঠো হয়েছে লোকটা সেখান থেকে আসছে, ওর আবার কিছু হয় নি তো? লোকটা হনহন করে চলে গেল। গেল তো, একেবারে যে পথে এসেছে, সেই পথে। কাছের পুকুর জঙ্গল ফেলে চলল। হঠাৎ নজরে পড়ল ছাতাটিও বগলে পুরেছে। তখনই আমার সন্দেহ হল বেটা পালাচ্ছে, আমিও গলিপথে মাঠের ধারে এসে দাঁড়ালাম। দেখি, মাঠে এসেই ছুটতে শুরু করেছে। তখনই আমি বুঝে নিয়েছি। কিন্তু পালাবে কোথা? মাঠে চাষীরা হাল ছেড়ে ঘুরছে, হাকলামধর বেটাকে ধর ধর। ধর।
সোলেমান, করিম, সাতন-তিন জন বেটাকে ধরলে, বললাম নিয়ে আয় বেটাকে পঁজাকোলা করে। আনতেই সোলেমানের হাতের পাঁচনটা নিয়ে বেটার পিঠে কষে এক বাড়ি। বল বেটা, বল—সত্যি কথা বল। ঠিক বলবি, নইলে কাস্তে দিয়ে জিভ কেটে ফেলব। গলগল। করে বলে ফেললে সব।
জগদ্বন্ধু মশায়ের গম্ভীর শান্ত কণ্ঠ বেজে উঠেছিল—ওকে ছেড়ে দাও ঠাকুরদাস, ও গরিবের কী দোষ? ও কী করবে! ওকে পাঠিয়েছে-ও এসেছে। দূত অবধ্য। ও দৃত। নবকৃষ্ণ সিংয়ের। অপকর্মের জবাবদিহি বা প্ৰায়শ্চিত্ত ও কী করে করবে বল?
ঠাকুরদাস বললেন–দোষ তোমার। একখানা চিঠিতে তুমি বিয়ে পাকা করলে। নিজে গেলে না, তাকে আসতে লিখলে না।
মশায় তাঁর বাপের কথাগুলি পুনরাবৃত্তি করলেন, প্রবঞ্চনা আমি করি নি ঠাকুরদাস, প্রবঞ্চনা করেছে নবকৃষ্ণ। এতে আমার দোষ কোথায় বল?
জীবন নেমে এসেছিল উপর থেকে।
মঞ্জরীর বিসূচিকায় মৃত্যু মিথ্যা কথা। গত ২৯শে জ্যৈষ্ঠ তার সঙ্গে ভূপী বোসের বিবাহ হয়ে গিয়েছে।
জীবনের মনে হয়েছিল-দোলের দিন মঞ্জরী হাতে আলকাতরা নিয়ে তার মুখে লেপে দিতে এসেছিল; সেদিন পারে নি, কিন্তু আজ মঞ্জরী সেই আলকাতরা মুখে মাখিয়ে দিয়েছে। যেন মঞ্জরী সেই খিলখিল হাসি নতুন করে আসছে দূরান্তরে দাঁড়িয়ে।
ভূপী হেসে বলছে—বুনো শুয়োরটা!
মশায় ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সস্নেহে তাকে বলেছিলেন-ভগবান তোমার ওপর। সদয়, বাবা জীবন। তোমাকে তিনি আজীবন প্রবঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা করেছেন। ওই মেয়ে। ঘরে এনে তুমি সুখী হতে না। শুধু প্রবঞ্চনা নয়—আজীবন সে তোমাকে অশান্তির আগুনে দগ্ধ করত। তা ছাড়া যার যে পতি-পত্নী। এ তো তোমার আমার ইচ্ছায় হবে না! লজ্জা পেয়ো না, দুঃখ কোরো না। মনকে শক্ত কর।
শেষের কথা কটা ভাল লাগে নি জীবনের। সে মাথা হেঁট করে সেখান থেকে চলে এসেছিল।
মশায় বলেছিলেন—তোমার সঙ্গে কথা আছে। যেয়ো না কোথাও। সুরেন তুমি যাও, তোমাকেও চাই। পাশের ঘরে অপেক্ষা কর।
পাশের ঘরে বসেই জীবন সমস্ত বৃত্তান্ত পেয়েছিলেন। ঠাকুরদাস মিশ্র আস্তে কথা বলতে জানতেন না, অন্যের কাছে আস্তে উত্তর শুনতেও পছন্দ করতেন না। জগৎ মহাশয়ের অনুরোধে। দূতকে তিনি নির্যাতন করেন নাই বটে তবে ধমক দিয়েছিলেন অনেক। প্ৰশ্নোত্তরের মধ্যে যে কথাগুলি প্রকাশ পেয়েছিল, তা হল এই।
প্রতারণা নবকৃষ্ণ সিংহ ঠিক করেন নি।
করেছে মঞ্জরী, বঙ্কিম, আর ওদের মা।
জীবনের হাতে মুষ্ট্যাঘাত খেয়ে ভূপী বোস অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল; খুন করবে, সে খুন করবে বর্বর উল্লুককে, রোমশ কালো শুয়োরকে। তারপরই তার চোখ পড়েছিল মঞ্জরীদের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধ গিয়ে পড়ল তাদের ওপর। বঙ্কিমকে ঠেলে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মঞ্জরীর সামনে হাত নেড়ে কুৎসিত মুখভঙ্গি করে বলেছিল-এ তাদের ষড়যন্ত্র। তোদর! তোদের! ভাই বোন মা সবাই মিলে ষড়যন্ত্র করেছিলি আমাকে তাড়াতে। টাকার জন্যে ওই শুয়োেরটার সঙ্গে, ছোটলোকের ছেলের সঙ্গে প্রেম করতে বাধে না! ছি! ছিঃ ছি! তারপর সাড়ম্বরে পথে চিৎকার করে অপবাদ রটনা করে ফিরেছিল। কিছুদিন থেকেই তার সন্দেহ হয়েছিল মঞ্জরীরা জীবনকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। জীবনের খরচের বাহুল্য দেখে অনুমান করেছিল যে, প্রশ্রয় পেয়েই জীবন এমন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। সে এর প্রমাণ দিতে পারে। নইলে নাতনী। দাদামশায় সম্পর্ক ধরে যে হাসিখুশি বক্র রসিকতার বাগযুদ্ধ চলছিল সে এমন সীমা ছাড়াত না। সম্পর্কটা প্রকাশ্য হলে মঞ্জরী তার কাছ থেকে দামি আতর গোপনে উপহার নিত না। আর আলকাতরা মাখাতে যেত না। তাই সেদিন নাক ভেঙে রক্তমাখা মুখেই ওই কথা রটাতে রটাতে বাড়ি ফিরেছিল। এবং তার দলবল জড়ো করে বোর্ডিং থেকে আরম্ভ করে চারপাশ জীবনের। খোঁজে প্রায় সমুদ্র মন্থন করে ফেলেছিল। খুন করবে। তাকে না পেয়ে তার মুগুরটা কুড়ুল দিয়ে কেটে চেলা বানিয়ে তবে ক্ষান্ত হয়েছিল।
নবকৃষ্ণ সিংহ অথৈ সমুদ্রে পড়েছিলেন। কূল-কিনারা ছিল না। গোটা বাজারে ওই ছাড়া কথা ছিল না। মা মঞ্জরীকে বলেছিলেন—মর, মর—তুই মর!
মঞ্জরী মরতে পারে নি, কিন্তু শয্যা সত্যই পেতেছিল।
বঙ্কিম আস্ফালন করেছিল—আমিও বঙ্কিম সিংহী, আমি দেখে নেব।
বাপ তার গালে ঠাস করে চড় মেরেছিলেন-হারামজাদা, তুই সব অনৰ্থের মূল। দুজনকেই তুই ঘরে এনেছিলি।
বঙ্কিম তাতেও দমে নি, সে আরও প্রবল আস্ফালন করে বলেছিল–খুন করব ওকে আমি।
নবকৃষ্ণ বাঁকা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন কাকে? কাকে খুন করবি?
বঙ্কিম এর উত্তর দিতে পারে নি।
ওদিকে নিত্যনতুন রটনা রটাচ্ছিল ভূপী বোস। কঠিন আক্রোশ তার তখন। শেষ পর্যন্ত নবকৃষ্ণ এই পত্র লিখলেন জগদ্বন্ধু মশায়কে এবং পত্রোত্তর পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। মঞ্জরীও উঠে বসেছিল। ভূপী বোসের নির্মম নিষ্ঠুর অপবাদ রটনায় লজ্জা তার হয়েছিল বৈকি! দুঃখও হয়েছিল, বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে কেঁদেও ছিল। আঘাত যে নির্মম। কাঁদী শহরের চারিদিকে যে রটে গিয়েছিল এই কাহিনী। জগৎ মশায়ের পত্রে সেসব মুছে গেল। নবকৃষ্ণ মাথা তুললেন, সেই পত্র দেখিয়ে বেড়ালেন সকলকে। জগশায় লিখেছেন—মা লক্ষ্মীকে সসম্মানে ঘরে আনিব ইহাতে আর কথা কী আছে। মঞ্জরীও উঠে বসেছিল। ওদিকে ভূপী বোস গরজাতে লাগল খাঁচার বাঘের মত। আর সে কী করতে পারে? তবুও নবকৃষ্ণ সিং সাবধানতা অবলম্বন করে কাঁদী থেকে দেশে চলে এলেন। কাঁদীতে বিবাহ দিতে সাহস করলেন না। গ্রীষ্মের ছুটির কয়েকদিন পরই বিবাহের দিন। স্কুলে ছুটির জন্য দরখাস্ত পাঠালেন। দরখাস্ত নিয়ে গেল বঙ্কিম। সেখানে যে কী করে কী হল কেউ বলতে পারে না, তবে ভূপীর সঙ্গে বঙ্কিমের ছিন্ন প্রীতির সম্পর্ক গাঢ়তর হয়ে উঠল। বঙ্কিমই ফিরে এসে সব পণ্ড করে দিয়েছে।
লোকটি বললে–ওনারা জানতেন-পাত্র ডাক্তার হবে। কিন্তু জগৎ মশায় চিঠিতে লিখেছিলেন, ছেলে তার ডাক্তারি পড়বে না; কবিরাজি করবে, আমার কাছেই কবিরাজি শিখছে। এই শুনেই মায়ের মুখ বেঁকে গেল, কন্যের মুখে বোঝা নামল।
কিন্তু নবকৃষ্ণ সিংহ সেটা চাপা দিলেন, বললেন–তাতে কী হয়েছে?
মঞ্জরীর মা বলেছিলেনকোবরেজ? ছিঃ ছি! একালে কোবরেজের কি মানসম্মান আছে? পয়সাই বা কোথায়? তুমি বরং লিখে দাও ছেলেকে ডাক্তারি পড়াতে হবে।
ধমক দিয়েছিলেন নবকৃষ্ণ সিং। বলেছিলেন তার ছেলেকে তিনি যদি ডাক্তারি না পড়ান? দায়টা আমাদের না তাদের?
মঞ্জরী নাকি কেঁদেছিল গোপনে কিন্তু সে কথা মায়ের অগোচর ছিল না। তিনি আবারও বলেছিলেনো বাপু, একে তোে ছেলের ওই দত্যির মত চেহারা, তার ওপর কোবরেজ হলে খালি গায়ে-বড়জোর পিরান চাদর গায়ে—না বাপু।
নবকৃষ্ণ বলেছিলেন খবরদার! সাবধান করে দিচ্ছি আমি-এ বিয়ে ভেঙে গেলে তোমার মেয়েকে আইবুড়ো হয়ে থাকতে হবে। ভূপী বোস কালসাপের বাচ্চা তার বিষে তোমার মেয়ের জীবন নীল হয়ে গিয়েছে। ও দেখে তোমার মেয়েকে নিতে পারে শুধু জগৎআশায়। কবিরাজ বলে তাকে উপেক্ষা করতে চেয়ো না।
চুপ করতে বাধ্য হয়েছিলেন মঞ্জরীর মা। কিন্তু গজগজ তিনি করেছিলেন।
এই অবস্থায় ভূপীর সঙ্গে আপোস করে বঙ্কিম এল। ফলে আরও দুদিন প্রচণ্ড ঝগড়া হয়ে গেল। তৃতীয় দিন রাত্রে নবকৃষ্ণ ঘুমিয়ে থাকলেন বাড়িতে, বঙ্কিমকে সঙ্গে নিয়ে মা এবং মঞ্জরী গরুর গাড়ি ভাড়া করে এসে উঠল কাঁদীতে। পরের দিন ২৯শে বিবাহের দিন ছিল পাঁজিতে।
নবকৃষ্ণ সিংহ ছুটে গিয়েছিলেন বিবাহ বন্ধ করতে কিন্তু কিছু করতে পারেন নি।
তখন মঞ্জরী ভূপতির চাদরে নিজের অঞ্চল আবদ্ধ করে নবকৃষ্ণের বাসাবাড়ি পিছনে রেখে ভূপীদের জীর্ণ পুরনো চকমিলানো দালানে গিয়ে উঠেছে।
মঞ্জরীর মা ভূপতির বামপার্শ্বে মঞ্জরীকে দেখে আনন্দাশ্ৰু বিসর্জন করে বলেছেন দেখ তো, কী মানিয়েছে—এ যেন মদন-মঞ্জরী!
ভূপতিদের বাড়িতে ওখানকার অভিজাতবংশীয়দের সঙ্গে কুটুম্বিনীর দাবিতে রহস্যালাপ করে এসেছেন। একসঙ্গে দোতলার ঘরে বসে খেয়ে এসেছেন।
ঠাকুরদাস বলেছিলেন চিটিং কেস কর তুমি, করতেই হবে।
জগদ্বন্ধু বলেছিলেন—তার আগে ভাল পাত্রীর সন্ধান কর। ওই এগারই তারিখে বিয়ে। সদ্বংশের সুন্দরী পাত্ৰী খুঁজে বের কর। বিয়ে হয়ে যাক—কেসটেস তার পরে। আমোদ-আহ্লাদ খাওয়াদাওয়া সেরে হৃষ্ট চিত্তে, সবল সুস্থ দেহে আদালতে হাজির হয়ে বলা যাবে আমাদের ঠকাতে চেয়েছিল, কিন্তু আমরা ঠকি নি। ধারাটারাগুলো বরং দেখেশুনে রেখো অবসরমত।
হা-হা করে হেসে উঠেছিলেন মশায়।
সকলে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল জগৎ মশায়ের মুখের দিকে। এই অপমানেও জগৎমশায় হা-হা করে আসছেন।
জগৎ মশায়ের সেই এক কথা—বিয়ে এগারই। একদিন পিছুবে না। সুরেন্দ্ৰ তুমি আর সেতাব আমার সঙ্গে পাত্রী দেখতে যাবে। তোমরা পছন্দ করে ঘাড় নাড়লে আমি তবে হাঁ বলব। খোঁজ কর কোথায় আছে গরিবের ঘরের সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী মেয়ে। তবে বংশ সদ্বংশ হওয়া চাই।
সেতাব, সুরেন্দ্র, নেপাল এদের উৎসাহের আর সীমা ছিল না। উঠে পড়ে লেগেছিল-পাত্রী খুঁজে বের করবেই। ভাল মানুষ সেতাব হেসে বলেছিল—এ সেই রাজপুত্র মন্ত্রীপুত্ৰ সদাগরপুত্র কোটালপুত্রের গল্প হল, যারা উদ্দেশে রাজকন্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু ভাই জীবন, তুই এই একটু হাঁস দেখি!
সেতাব চিঠি লিখেছিল তার মামার বাড়িতে। সুন্দরী গুণবতী সদ্বংশের বয়স্কা পাত্রী থাকিলে অবিলম্বে জানাইবে। কোনো পণ লাগিবে না। পাত্রের পিতা এখানকার নামকরা কবিরাজ জগৎ মশায়। খুব রোজগার। জমি পুকুর বাগান জমিদারি আছে। ছেলেও কবিরাজি শিখিতেছে।
সুরেন্দ্র সত্য সত্যই চালচিড়ে বেঁধে বেরিয়ে পড়ার মত বেরিয়ে পড়েছিল। জগৎ মশায়ের কাছে কয়েকটি টাকা চেয়ে নিয়ে বলেছিল—আমি একবার সদর শহরটা ঘুরে আসি। পসার নাই এমন গরিব উকিল মোক্তারের তো অভাব নাই। এদের মধ্যে কায়স্থও অনেক। বয়সওয়ালা আইবুড়া মেয়ে এইসব জায়গাতে মিলবে।
জগৎমশায় তাই পাঠিয়েছিলেন সুরেন্দ্রকে।
নেপালটা ছিল ছেলেবেলা থেকেই আধপাগলা। সন্ধানের ধারা ছিল বিচিত্র। তার বাবা ছিলেন সবরেজেষ্ট্রি আপিসের মোহরার। নেপাল তখন বাপের সঙ্গে সবরেজেষ্ট্রি আপিসে গিয়ে টাউটের কাজ করত। দলিল যাতে আগে রেজেষ্ট্রি হয় তার ব্যবস্থা করে দাখিল দিত, কাটাকুটি থাকলে কৈফিয়ত লিখে দিত, শনাক্তদার না থাকলে শনাক্ত দিয়ে দিত। অর্থাৎ বলে দিত—এই ব্যক্তির নাম ধাম পিতার নাম যাহা বলিয়াছে তাহা সত্য আমি শ্ৰীনেপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায় পিতা শ্ৰীবিনোদলাল মুখোপাধ্যায় নিবাস নবগ্রাম-আমি ইহাকে জানি এবং চিনি। তার তলায় সই মেরে দিত। ফি নিত দু আনা। নেপাল সবরেজেষ্ট্রি আপিসের সামনে বটতলায় বসে জনে। জনে জিজ্ঞাসা করত-বলি চাটুজ্জেমশায়, আপনার খোঁজে ভাল কায়স্থ পাত্রী আছে?
—ওহে কী নাম তোমার? গোবিন্দ পাল? কায়স্থ পাত্রীর খোঁজ দিতে পার?
–কোথায় বাড়ি শেখজীর? আপনাদের গায়ের কাছাকাছি কায়স্থ আছে? বেশ সুন্দরী ভাল। বংশের কন্যে আছে? বলতে পারেন?
শুধু এই নয়, পথেঘাটে পথিক পেলেই সে প্রশ্ন করত। ভাল কন্যে আছে হে কায়স্থ বংশের?
শেষ পর্যন্ত লাগল একদিন। ওদের জমির ভাগজোতদার নবীন বন্দীকে বলেছিল-খোঁজ করিস তো নবীন! ভাল কায়স্থদের বড়সড় মেয়ে। নবীন যাচ্ছিল কাটোয়ার বয়ে গঙ্গাজল আনবে। নেপাল বলেছিল—যাবি তো এতটা পথ। আসিস তো নবীন খোঁজ করে।
***
আজকের জীবন মশায় তখন শুধু জীবন; বড়জোর জীবন দত্ত। সেদিন জীবনের পক্ষে এ আঘাত হয়েছিল মর্মান্তিক। কিন্তু ভেঙে পড়েন নাই। বরং ক্রোধে আক্ৰোশে বিবাহের জন্য উৎসাহিত হয়ে উঠেছিলেন। সে উৎসাহ অনেকের চোখে বেশি বেশি মনে হয়েছিল। জীবন কিন্তু গ্রাহ্য করেন নাই। তরুণ জীবন সেদিন মনের ক্ষোভে উল্লাসে উন্মত্ত হয়ে উঠতে চেষ্টা করেছিল।
আজ বৃদ্ধ জীবন মশায় হাসলেন। আজ তিনি দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজের তরুণ জীবনের দিকে চেয়ে আছেন রসজ্ঞ দ্রষ্টার মত।
সাপের বিষে জৰ্জর মানুষের জিভে নিমের মত তেতোকেও নাকি মিষ্টি লাগে। মিষ্টি রসকে মনে হয় তেতো।
নাঃ।
ভুল হল। বৃদ্ধ জীবন মশায় বার দুই ঘাড় নাড়লেন। না-না।
মঞ্জরী যে তাঁর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তার সঙ্গে মঞ্জরীর প্রতি তাঁর ভালবাসার সম্পর্ক কী? ভালবাসার সঙ্গে কি কখনও সাপের বিষের তুলনা হয়? তিনি ক্ষোভে নিজে হাতে বিষের নল মুখে তুলে শেষ বিন্দু পর্যন্ত পান করেছিলেন।
ক্ষোভে আক্ৰোশে তরুণ জীবন দত্ত সেদিন দুটি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।
খুব সুন্দরী পত্নী ঘরে এনে সর্বোত্তম সুখে সুখী হবেন। ভালবাসবেন তাকে রামায়ণের কাহিনীর ইন্দুমতীকে অজরাজার ভালবাসার মত।
আর প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ডাক্তার তিনি হবেনই।
নাইবা পড়তে গেলেন মেডিক্যাল স্কুল বা কলেজে। ঘরে বসে তিনি পড়ে ডাক্তার হবেন। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিল তার চোখের সম্মুখে।
এ অঞ্চলের প্রথম বিখ্যাত ডাক্তাররঙলাল মুখুজ্জে। নতুন দিনের সূর্যের মত তিনি তখন উঠলেন।
বিস্ময়কর মানুষ, বিস্ময়কর প্রতিভা, রোমাঞ্চকর সাধনা রঙলাল ডাক্তারের; তেমনি চিকিৎসা।
গৌরবর্ণ মানুষ; সবল স্বাস্থ্য, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, রঙলাল ডাক্তারকে একশো জনের মধ্যে দেখবামাত্র চেনা যেত। চেহারাতেই যারা প্রতিভার স্বাক্ষর নিয়ে আসেন তিনি ছিলেন তাঁদের একজন। এসব মানুষ দুঃসাহসী হবেই। স্বল্পভাষী কিন্তু সেই অল্প কথাগুলিও ছিল, রূঢ় ঠিক নয়, অতি দৃঢ়তায় কঠিন, সাধারণের কাছে রূঢ় বলে মনে হত। হুগলী জেলার এক গ্রামে সেকালের নিষ্ঠাবান ব্ৰাহ্মণ পরিবারে জন্ম। হুগলী স্কুলে এবং কলেজে এফ. এ. পর্যন্ত পড়ে বাপের সঙ্গে মনান্তরের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কলেজে পড়বার সময় তিনি হুগলীর মিশনারিদের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। তাদের ওখানে যেতেন, তাদের সঙ্গে খেতেন। বাপের সঙ্গে মনান্তরের হেতু তাই।
বাপের মুখের ওপরেই বলেছিলেন–জাত আমি মানি না। ধর্মকেও না। তাই ওদের ওখানে ওদের সঙ্গে খাওয়া আমি অপরাধ বলে মনে করি না। আর ধৰ্মই যখন মানি না তখন ধর্মান্তর গ্রহণের কথাই ওঠে না।
সেই দিনই গৃহত্যাগ করে বেরিয়েছিলেন পদব্রজে, কপদকশূন্য অবস্থায়। এই জেলায় প্রথম এসে এক গ্রামে হয়েছিলেন পাঠশালার পণ্ডিত। পাঠশালার পণ্ডিত থেকে হয়েছিলেন স্কুল মাস্টার। এ জেলার এক রাজ-স্কুলে শিক্ষকের পদ খালি আছে শুনে দরখাস্ত করে চাকরি পেয়েছিলেন। এই চাকরি করতে করতেই হঠাৎ আকৃষ্ট হলেন চিকিৎসাবিদ্যার দিকে। রাজাদের প্রতিষ্ঠিত। হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে হয়েছিল বন্ধুত্ব। প্রায় যেতেন তার কাছে। হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে রোগী দেখতেন। ডাক্তারের কাছে ডাক্তারি বই নিয়ে পড়তেন। ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করতেন রাত্রির পর রাত্রি। এক-একদিন সমস্ত রাত্রিব্যাপী আলোচনা চলত। আলোচনা থেকে তর্ক, তর্ক থেকে কলহ।
একদিন কলহ কী হয়েছিল কে জানে—সে কথা রঙলাল ডাক্তার কারও কাছে জীবনে প্রকাশ করেন নাই, ডাক্তারও করে নাই—তবে তার ফল হয়েছিল বন্ধুবিচ্ছেদ। কয়েকদিন পরেই হঠাৎ রঙলাল ডাক্তার মাস্টারি ছেড়ে তার বইয়ের গাড়ি নিয়ে এসে উপস্থিত হলেন এই অঞ্চলে। এখান থেকে ছমাইল দূরে ময়ূরাক্ষীর তীরে একটা বাঁকের উপর মুসলমানপ্রধান লালমাটি গাঁয়ে প্রথম রইলেন ঘর ভাড়া করে। তারপর গ্রামপ্রান্তে নদীর প্রায় কিনারার উপর একখানি বাঙলো বাড়ি তৈরি করে বাস করলেন। সামনে বিস্তীর্ণ ময়ূরাক্ষীকে রেখে বারান্দার উপর বসে দিনরাত্রি সাধনা শুরু করলেন। মধ্যে-মধ্যে রাত্রে বের হতেন পিশাচসাধকের মত। কাঁধে কোদাল নিয়ে বেরিয়ে যেতেন আর নিয়ে যেতেন একটা চাকাওয়ালা ঠেলাগাড়ি। কবরস্থানের টাটকা কোনো কবর খুঁড়ে শবদেহ বের করে নিয়ে আবার কবরটি পরিপাটি করে বন্ধ করে শবদেহটা ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে টেনে আনতেন। তারপর দু-একদিন রঙলাল ডাক্তারকে আর বাইরে দেখা যেত না। বাঙলোটার পিছনে পাঁচিল—ঘেরা বিস্তীর্ণ হাতার মধ্যে তিনি একটা কাচের-ছাদওয়ালা ঘর করেছিলেন। সে ঘরে কারুর ঢুকবার অধিকার ছিল না। সেইখানে তিনি মড়া কেটে বই মিলিয়ে দেহতত্ত্ব শিখেছিলেন। কিছুদিন পরই জুটেছিল এক যোগ্য উত্তরসাধক। ময়ূরাক্ষীর ওপারের মনা হাড়ি। মনা হাঁড়ি ছিল ময়ূরাক্ষী ঘাটের খেয়ামাঝি। আর একটা কাজ করত—সে ছিল শ্মশানের শ্মশানবন্ধু—দুর্দান্ত মাতাল, সব পরিচয়ের চেয়েও তার আর-একটা বড় পরিচয় ছিল—লোকে বলত মনা রাক্ষস। মনার ক্ষুধার কখনও নিবৃত্তি হত না। একবার এক হাঁড়ি ভাত নিঃশেষ করে মনা শ্মশানের অনতিদূরে একটা পাঠাকে দেশে আবার ক্ষুধার্ত হয়ে পাঠাটাকে ধরে ঘাড় মুচড়ে মেরে ওই চিতার আগুনেই সেটাকে পুড়িয়ে ৫ষ করেছিল। এই মনাই হল রঙলাল ডাক্তারের প্রথম ভক্ত। বছর দুয়েক পর থেকে মনাই হয়েছিল তার পাঁচক। তার হাতেই তিনি খেতেন। এই মনাই তাকে শব সংগ্রহে সাহায্য করত। ময়ূরাক্ষীর জলে ভেসে-যাওয়া শব তুলে এনে দিত। অনেক সময় শ্মশানের পরিত্যক্ত শব এনে দিত। এইভাবে বৎসর পাঁচেক সাধনার পর রঙলাল ডাক্তার একদিন ঘোষণা করলেন-আমি ডাক্তার। যে রোগ এখানে কেউ সারাতে পারবে না, সেই রোগী আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি সারিয়ে দেব।
কিছুদিনের মধ্যেই এই ঘোষণাকে তিনি সত্য বলে প্রমাণিত করলেন। লোকে বিস্মিত হয়ে গেল তাঁর প্রতিভায়। বললে, ধন্বন্তরি। ডাক্তার পালকি কিনলেন কলে যাওয়ার জন্যে।
মনা বললে—উঁহুঁ! একটা ঘোড়া কিনে ফেল বাবা। মানুষের পায়ে আর ঘোড়ার পায়ে! রঙলাল বললেন–দূর বেটা! মানুষের কাঁধে আর ঘোড়ার পিঠে? মানুষের কাঁধে আরাম কত?
–আজ্ঞে?
—সে তুই বুঝবি না বেটা! ঘোড়ায় চড়ে শেষে পড়ে হাড়গোড় ভাঙব?
জীবন দত্ত সেদিন আকাশকুসুম কল্পনা করে নাই। তার আদর্শ ছিল বাস্তব এবং সজীব। ডাক্তার হয়ে প্রচুর প্রতিষ্ঠা অর্জন করে সোনার গহনায় সুন্দরী স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে একদিন তার কাঁদী যাবার ইচ্ছা ছিল। সে যাবে বড় সাদা ঘোড়ায় চেপে, স্ত্রী যাবে কিংখাবে মোড়া পালকিতে।
মুরশিদাবাদ যাবার অছিলায় পথে কাঁদীতে ভূপী বোসের ফাটল ধরা বাড়ির দরজায় ঘোড়াটার রাস টেনে দাঁড় করিয়ে বলবে-আজকে রাত্রির মত একটু বিশ্রামের স্থান হবে কি? ইচ্ছে করেই প্রহরখানেক রাত্রে গিয়ে উপস্থিত হবে ওদের বাড়িতে।
স্ত্রীকে পাঠিয়ে দেবে অন্দরে। মঞ্জরীর কাছে।
সে গিয়ে বলবেআজ রাত্রির মত থাকতে আমাদের একটু জায়গা দেবেন? আপনি তো আমাদের আপনার লোক। সম্বন্ধটা সইয়ের বউয়ের বকুল ফুলের বোনপো-বউয়ের বোনঝি জামাইয়ের মত হলেও সম্বন্ধ তো বটে।
তারপর যা হবার আপনি হবে।
বিবাহের পর কিন্তু সব যেন বিপরীত হয়ে গেল। জীবন দত্ত আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল সেদিন, কেন এমন হল?
১২. সেদিন আশ্চর্য মনে হয়েছিল
সেদিন আশ্চর্য মনে হয়েছিল—আজ কিন্তু আশ্চর্য মনে হয় না।
বিবাহের পূর্বে জীবনের যে উচ্ছাস শুক্লপক্ষের চতুর্দশীর সমুদ্রের মত ফুলে ফেঁপে উঠেছিল, বিবাহের দিনেই সেই উচ্ছাস স্তিমিত নিরুৎসব বিষণ্ণ হয়ে গেল প্রতিপদ দ্বিতীয়ার ভাটার সমুদ্রের মত। জীবনে পূর্ণিমা তিথিটা যেন এই না কোনোদিন। অমাবস্যাই কি এসেছে? না, তাও আসে নাই আজও। একমাত্র সন্তান বনবিহারীর মৃত্যুতেও না।
এগারই আষাঢ়েই বিবাহ হয়েছিল। কন্যার এ দেশে অভাব হয় না।
কন্যা এ দেশে দায়ের শামিল। যা দায় তাই দুৰ্বহ বোঝ। সবল মানুষ বোঝা বইতে পারে, দুর্বল মানুষ বোঝা নামাতে গিয়ে ফেলে দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। সংসারে দুর্বলের সংখ্যাই তো বেশি।
দশটি কন্যার খোঁজ এসেছিল। ছটি কন্যাকে পরিচয় শুনেই নাকচ করেছিলেন জগৎমশায়। চারটি কন্যা চাক্ষুষ করে সদর শহরের এক বৃদ্ধ মোক্তারের পিতৃমাতৃহীনা ভাগ্নীকে পছন্দ করলেন। পণ হরীতকী। মেয়েটির নাম কৃষ্ণভামিনী। মেয়েটি তখনকার দিনে অরক্ষণীয়া হয়ে উঠেছিল। চোদ্দ বছর উত্তীর্ণ হয়ে মাস দুয়েক পরেই পনেরয় পড়বে। এ মেয়ের সন্ধান এনেছিল সুরেন্দ্ৰ।
বাইরে-ঘরে উৎসব সমারোহের কোনো ত্রুটি ছিল না। জগৎ মশায়ের তখন কবিরাজ। হিসেবে খ্যাতিতে, অবস্থাপন্ন ব্যক্তি হিসেবে সামাজিক প্রতিষ্ঠায় যাকে বলে একই আকাশে চন্দ্ৰসূর্যের একসঙ্গে উদয়। জীবন তার একমাত্র সন্তান, তার ওপর এই বিচিত্র অবস্থায় বিবাহ। কাঁদীতে মঞ্জরী এবং ভূপী বোসের বিবাহ হয়েছিল যত চুপিচুপি, এখানে জীবনের সঙ্গে কৃষ্ণভামিনীর বিবাহ তত উচ্চ সমারোহে নহবত থেকে ঢোল বাঁশি এমনকি ব্যান্ড বাজনা বাজিয়ে হয়ে গেল। ওই ব্যান্ড বাজনা আনা হয়েছিল কাঁদী থেকে। রাঢ় অঞ্চলে প্রথম ব্যান্ড বাজনার দল হয়েছিল মুরশিদাবাদে, তারপর কাঁদীতে। নবগ্রাম থেকে কাঁদী দশ ক্ৰোশ পথ; এখানকার বাজনার শব্দ দশ ক্রোশ অর্থাৎ বিশ মাইল অতিক্রম করে সেখানে নবদম্পতির নিদ্রার ব্যাঘাত না ঘটালেও বাজনদারদের মারফত খবরটা পৌঁছুবার কথা। এই এত সমারোহের মধ্যেও পাত্র জীবন যখন কন্যার বাড়িতে পৌঁছল তখন সে ম্লান স্তিমিত হয়ে গেছে। বাসরে গিয়ে জীবন অবসন্ন ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল, হাত জোড় করে বলল—আমাকে মাফ করবেন, আমার শরীরটা বড় খারাপ করছে।
তবুও অবশ্য ছাড়ে নি মেয়েরা। গানও গাইতে হয়েছিল, সেকালের নিয়ম অনুযায়ী কৃষ্ণভামিনীকে কোলে বসাতেও হয়েছিল।
কৃষ্ণভামিনীর রঙ ছিল পাকা সোনার মত। মুখশ্ৰী কোমল এবং স্নিগ্ধ হলে তাকে ডাকসাইটে সুন্দরী বলা যেত।
চৌদ্দ বছরের কৃষ্ণভামিনী যেদিন বধূবেশে মশায়দের ঘরে পদার্পণ করে, সেই দিনই তার নামকরণ হয়েছিল আতর-বউ। কৃষ্ণভামিনীর রঙ দেখে মানুষের চোখ ঝলসে গিয়েছিল। নামকরণ করে জীবনের পিসিমা বলেছিলেন—তোমার স্বভাবের সৌরভে ঘর ভরে উঠুক।
ফুলশয্যার রাত্রিও কেটেছিল একটি প্রচ্ছন্ন উদাসীনতার মধ্যে। জীবন হেসেছিল, ঠাকুমা বউদিদির পরিহাস-রসিকতাতেও যোগ দিয়েছিল, কিন্তু সে যেন প্ৰাণহীন পুতুলনাচের পুতুলের মত। আজ এই বৃদ্ধ বয়সেও মনে পড়ছে শোধ নেওয়ার আনন্দ কেমন যেন নিভানো প্রদীপের মত কালো হয়ে গিয়েছিল। নিগুঢ় একটা বেদনা তাকে যেন অভিভূত করতে চেয়েছিল।
বিবাহ করেছিলেন তিনি অপমানের প্রতিশোধ নিতে। কিন্তু বিবাহ করে বুঝলেন, অপমানের শোধ নেওয়া হয় নি; শুধু বিয়ে করাই হয়েছে।
এ সংসারে অপমান মাত্রেরই গ্লানি মর্মদাহী, সে মর্মদাহ একমাত্র প্রতিশোধের উল্লাসেই মুছে যায়; তার অন্তরে জ্বলে ওঠে যে আগুন, সেই আগুনে প্রতিপক্ষকে পুড়িয়ে ছাই করে শান্ত হয়। না পারলে সেই আগুনে নিজেই তিলে তিলে পুড়ে ছাই হয়। বড় মানুষ যারা, মহৎ যারা তাদের কথা স্বতন্ত্র। তাঁরা অপমানের আগুনকে ক্ষমার শান্তিবারি বর্ষণে নিভিয়ে ফেলেন।
জীবন মশায় মহৎ নন-নিজে তাই বলেন। তার মনের আগুন তাই বোধ করি আজও জ্বলছে। বাইরে দেখে কেউ বুঝতে পারে না। বুঝতে তিনি দেন না। বুঝতে পারে একজন। সে আতর-বউ। সে প্রথম দিন থেকেই বোঝে।
জীবনের প্রচ্ছন্ন বেদনা সংসারে সকলের কাছে প্রচ্ছন্ন থাকলেও নতুন বধূটির অগোচর ছিল না। শুধু তাই নয়, বধূটিকেও আক্রমণ করলে সংক্রামক ব্যাধির মত। ফুলশয্যার রাত্রেই জীবন দত্তের বেদনা নতুন বউয়ের মনে আঘাত করে প্রতিহত হয়ে ফিরে এল।
ফুলশয্যার শেষ রাত্রে জীবন বধূকে আকর্ষণ করেছিল—নিজের বুকের কাছে। বধূটি তিক্ত কঠিন স্বরে বলে উঠেছিল—আঃ, ছাড়!
—কেন? কী হল?
–কী হবে? ভাল লাগে না।
–ভাল লাগে না?
–না। ছেড়ে দাও, পায়ে পড়ি তোমার। ছেড়ে দাও।
–কী হল?
–কী হবে? আমাকে দয়া করে বিয়ে করেছ, উদ্ধার করেছ। দাসী হয়ে এসেছি—দাসীর মত খাটব। দু মুঠো খাব। আদর তো আমার পাওনা নয়। ছেড়ে দাও আমাকে।
আজও চলছে ওই ধারায়।
আতর-বউ আজ আগ্নেয়গিরি; অগ্ন্যার আরম্ভ হলে থামে না।
আতর-বউয়ের দোষ কী? আতর-বউয়ের বুকে আগুন লেগেছে তারই বুকের আগুনের সংস্পর্শে।
***
তবু এর মধ্যে গড়ে উঠেছিল সমৃদ্ধ একটি সংসার।
ওই যে আতর-বউ বলে—কত নামডাক ছিল—দু হাতে রোজগার করেছ, চার হাতে খরচ করেছ—এর অর্থই তো হল যশ-প্রতিষ্ঠা অর্থ-সম্পদ। সাধারণ মানুষের এ ছাড়া আর কী চাই?
সাজানো সংসার-তিন কন্যা এক পুত্র। সুরমা-সুষমা-সরমা। ছেলে বনবিহারী। তারা পেয়েছিল মায়ের বর্ণচ্ছটা, বাপের স্বাস্থ্য।
খ্যাতি প্রতিষ্ঠাও অনেক হয়েছিল; সে খ্যাতি কিশোর-জীবনের আকাঙ্ক্ষার পরিমাপে সমুদ্রের। তুলনায় গোষ্পদতুল্য না হলেও দিগন্তজোড়া বিলের তুলনায় মাঝারি আকারের পরিচ্ছন্ন একটি শখের পুষ্করিণী একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। যার বাঁধানো ঘাট আছে, জলে মাছ আছে, নামেও যে পুষ্করিণীটি কর্তার অভিপ্রায় অনুযায়ী শ্যামসায়র বা শ্যামসরোবর। জলও তার নির্মল ছিল, তপ্ত গ্রামবাসীরা তাতে অবগাহন করে তৃপ্তও হয়েছে। তৃষ্ণার্তেরা তার জল পান করে শ্যামসায়রের অধিকারীকে মুক্তপ্ৰাণে আশীর্বাদও করেছে। কিন্তু দিগন্তবিস্তৃত বিলের তুলনায় সে কতটুকু, কত অকিঞ্চিৎকর—তা সেই অধিকারীই জানে যে এই বিলের মতই একটি বিল কাটাতে চেয়েছিল। যার কল্পনা ছিল ওই বিলের ঘাটে ভিড়বে কত দেশদেশান্তরের বড় বড় বজরা নৌকা ছিপ!
আজ এই পরিণত বয়সে জীবনের সকল মোহই কেটে গেছে। লাল নীল সবুজ বেগুনে সাত রঙের ইন্দ্ৰধনু তিনি আর দেখতে পান না। আজ চোখের সামনে মাত্র দুটি রঙ আছে। একটি সাদা আর অন্যটি কালো। আলো আর অন্ধকার। তাই আশ্চর্য হয়ে ভাবেন—সেদিন কী করে জেগেছিল ইন্দ্ৰধনুর মত এমন বর্ণ-বৈচিত্র্যময় আকাঙ্ক্ষা।
এ প্রশ্ন মনে উঠতেই জীবন দত্ত হাসেন। নিজেকেই নিজে প্ৰশ্ন করেন—কেন? বার বার এ প্রশ্ন মনে ওঠে কেন তোমার? এ প্রশ্ন ওঠবার তো কথা নয়।
দুটি রঙ-দিন ও রাত্রির সাদা ও কালো রঙ দুটি ছাড়া বাকি রঙগুলি তুমি নিজেই তো ধুয়ে মুছে নিয়ে নিজের হাতে। অক্ষম লোকের রঙগুলি ধুয়ে যায় ব্যর্থতায়, বেদনার চোখের জলে। তুমি ধুয়ে মুছে দিয়েছ মিথ্যা বলে, তোমার মহাগুরু জগৎ মশায়ের শিক্ষার কথা ভুলে যাও কেন? তার শিক্ষার মধ্যে তো নিজেকে সেদিন ড়ুবিয়ে দিয়েছিলে তুমি।
নিজের ভুল নিজেই সংশোধন করে নিয়ে ঘাড় নাড়লেন জীবনমশায়। বার বার দাড়িতে হাত বুলালেন। ঠিক! ঠিক!
হঠাৎ একটা আলোর ছটা এসে চোখে বাজল। আলো? উঃসন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। রাত্রি নেমেছে। খেয়াল ছিল না। পুরনো কথা মনে করতে গিয়ে বর্তমানের কথা ভুলেই গিয়েছেন তিনি।
আলোটা আসছে ভিতর-বাড়ি থেকে, হয় ইন্দির, নয় নন্দ আলো নিয়ে আসছে। না তো। পায়ের দিকে কাপড়ের ঘের দেখে মনে হচ্ছে—মেয়েছেলে। আতর-বউ আসছেন। সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন জীবনমশায়। অসময়ে আতর-বউয়ের আসাটা তার কাছে শঙ্কার কারণ।
আতর-বউই বটে। আলোটা সামনে নামিয়ে দিয়ে আতর-বউ কাছে দাঁড়ালেন। দীর্ঘাঙ্গী গৌরবর্ণা আতর-বউ, কপালে সিদ্রের টিপটি আজও পরেন, সিঁথিতে সিন্দুর ডগ-ডগ করে। কঠোরভাষিণী আতর-বউ সুযোগ পেলে বোধ করি একটা রাজ্যশাসন করতে পারতেন। জীবন মশায় এ কথা অনেকবার বলেছেন রসিকতা করে। আতর-বউ উত্তর দিয়েছেন একটা মানুষকেই আনতে পারলাম না হাতের মুঠোয়, তো একটা রাজ্য! আতর-বউ উত্তর দিয়ে চিরকাল এক বিচিত্ৰ হাসি হাসেন।
আতর-বউ আলোটি নামালেন দাওয়ার উপর।
–কী খবর? মুখ তুলে বললেন– জীবনমশায়। আতর-বউয়ের মুখখানি বড় মধুর লাগছে। আজ। মমতায় যেন বর্ষার অভিষিক্ত ধরিত্রীর মত কোমল।
আতর-বউ ঈষৎ উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন—তুমি আজ চা খাও নি?
–ভুলে গিয়েছি।
–ভুলে গিয়েছ? হাসলেন আতর-বউ।–চা খেতে ভুলে যায় মানুষ! নন্দ ছোঁড়া গিয়ে বললে—তামাক পর্যন্ত খাও নি। এসে ডেকেছে, সাড়া দাও নি। শরীর ভাল আছে তো? না–মন ভাল নাই? কী হল তোমার?
অপ্রতিভের মত হেসে জীবনমশায় বললেন–হয় নি কিছু। এমনি ভাবছিলাম। নবগ্রাম রতন মাস্টারের ছেলেকে দেখে এলাম; পথে নিশি-ঠাকরুন ডেকে দেখালে তার ভাইঝিকে। রতন মাস্টারের ছেলের রোগ খুবই কঠিন, তবে জোর করে কিছু বলা যায় না। কিন্তু এই মেয়েটি-এর আর–।
ঘাড় নাড়লেন ডাক্তার। আবার বললেন,—এই কচি মেয়ে-বড়জোর পনের বছর বয়স এরই মধ্যে দুটি সন্তান হয়েছে। নিশি দেখিয়ে বললে–চাঁদের মত ছেলে। আমি দেখলাম চাঁদ নয়, যম। মাকে খেতে এসেছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
–নিশিকে বলে এলে নাকি? শিউরে উঠলেন আতর-বউ।
–না। তবে নিশি বুঝতে পারবে। বলেছি জলবারণ খেতে হবে। এছাড়া ওষুধ নাই। কে? আতর-বউয়ের পিছনে কেউ এসে দাঁড়াল। ও—ইন্দির!
–হ্যাঁ। ওকে চা করতে বলে আমি চলে এসেছিলাম। নাও চা খাও! ভাল মানুষ তুমি। যে চা নেশার জিনিস—তা না খেলেও তোমার কষ্ট হয় না? তামাক খেতে ভুলে যাও?
ইন্দির চায়ের পাথরের গেলাসটি এগিয়ে দিল। আতর-বউ বললেন–তুমি খাও, আমি দাঁড়িয়ে আছি। গেলাস আমি হাতে করে নিয়ে যাব। ইন্দিরের হাতে শনি আছে, ছ মাসে তিনটে পাথরের গেলাস ভাঙল। ইন্দির, তাকের ওপর বড় এলাচ গুঁড়ো করা আছে, নিয়ে আয়।
ইন্দির চলে যেতেই আতর-বউ বললেন–তুমি আমাকে লুকোলে। ওই হাসপাতালের ডাক্তারের কথায় তুমি খুব দুঃখ পেয়েছ। নতুন কালের ছেলেমানুষ ডাক্তার, অহঙ্কার অনেক। কাকে কী বলেছে জানে না। আমি তো জানি তোমার নিদান মিথ্যে হয় না। মতির মা যখন মরবে তখন বুঝতে পারবে ছোকরা ডাক্তার। আমিও তোমাকে ওবেলা কতকগুলো খারাপ কথা বললাম। মুখপোড়া শশী, যে এইখানে হাত-দেখা শিখলে, কম্পাউন্ডারি শিখলে সে এসে বলে। কিনা, হাত-পা ভাঙাতে নিদান হকা তো শুনি নি, বুঝিও না। ও যে কেন মশায় বলতে গেলেন কে জানে! শশীর মুখে এই কথা শুনে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমি তাকে বলেছি, এ কথা তুই কোন্ মুখে বললি শশী? বলতে লজ্জা লাগল না? কলিকাল, নইলে তোর জিভ খসে যেত।
জীবনমশায় হাসলেন। কিন্তু কথার কোনো উত্তর দিলেন না। শশীর ওপর আজ অত্যন্ত চটেছে আতর-বউ।
আতর-বউ প্রতীক্ষা করলেন স্বামীর উত্তরের। উত্তর না পেয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন। কিন্তু ভাল দেখতে পেলেন না স্বামীর মুখ। শ্রাবণ মাসের মেঘাচ্ছন্ন রাত্রি
তার পাশে অনেকখানি খোলা জায়গার মধ্যে বারান্দাটির ওপর একটি পুরনো লণ্ঠন যেটুকু আলোকচ্ছটা বিস্তার করেছিল সে নিতান্তই অপর্যাপ্ত। তার উপর আতর-বউয়ের দৃষ্টি বার্ধক্য ম্লান। হাত বাড়িয়ে আলোটা বাড়িয়ে দিলেন তিনি। তারপর ঝুঁকে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রুষ্ট স্বরেই বলে উলেন-হাসছ তুমি? তোমার কি গণ্ডারের চামড়া? হাসি দেখে অকস্মাৎ চটে উঠলেন আতর-বউ।
ডাক্তার কিন্তু আরও একটু হেসে বললেন–তা ছাড়া করব কী বল? কাঁদব?
কাঁদবে? হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠল। আতর-বউ বললেন–কাঁদবে? তুমি? চোখে জল তো বিধাতা তোমাকে দেয় নাই। কী করে কাঁদবে তুমি? যে মানুষ নিজের ছেলের নিদান হকে; মরণের সময় বাইরে বসে থাকে, বলে, কী দেখব? ও আমি ছ মাস আগে দেখে রেখেছি
ডাক্তার বাধা দিয়ে বললেন–থাম, আতর-বউ থাম। তোমাকে মিনতি করছি। থাম তুমি। আমাকে একটু চিন্তা করতে দাও। রতনবাবুর ছেলেকে দেখে এসেছি, আমাকে একটু ভাবতে দাও। বুঝতে দাও।
আতর-বউ যেন ছিটকে উঠে পড়লেন ছিলা-ছেঁড়া ধনুকের মত, বললেন–অন্যায় হয়েছে। আমার অন্যায় হয়েছে। তোমার সঙ্গে কথা বলতে আসাই আমার অন্যায় হয়েছে। আমার অধিকার কী? আমাকে এনেছিলে তোমরা দয়া করে, মামার বাড়ির মা-বাপ মরা ভাগ্নী, বিনা পণে দয়া করে ঘরে এনেছিলে দাসী-বাদীর মত খাটাতে আমার সেই অধিকার ছাড়া আর কোনো অধিকার তো নাই। একশো বার অন্যায় করেছি, হাজার বার। মাফ কর আমাকে।
উঠে চলে গেলেন তিনি অন্ধকারের মধ্যে।
এই তো আতর-বউ! চিরকালের সেই আতর-বউ! হাসলেন ডাক্তার। কিন্তু সে হাসি অর্ধপথেই একটা বিচিত্র শব্দে বাধা পেয়ে থেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেল স্থানটা। ডাক্তার এবার সশব্দে হেসে উঠলেন। আতর-বউ লণ্ঠনটার শিখা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন—বোধহয় মাত্রা অনেক পরিমাণে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কথাবার্তার উত্তেজনার মধ্যে কেউই লক্ষ্য করেন নি। সশব্দে লন্ঠনের কাচটা ফাটিয়ে দপ করে নিভে গেল আলোটা।
***
সশব্দে হাসিও হঠাৎ থেমে গেল তার। মনের ছিন্ন চিন্তা আবার জোড়া লাগল। আতর-বউ বলে গেলেন–বিধাতা তাকে চোখের জল দিয়ে পৃথিবীতে পাঠান নি। কথাটা মনে হতেই, হাসি থেমে গেল তাঁর।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাক্তার মনে মনেই বললেন––দিয়েছিলেন, অনেক অজস-তুমি অনুমান করতে পার না আতর-বউ, সমুদ্রের মত অথৈ লবণাক্ত চোখের জল ভগবান তার দুটি চোখের অন্তরালে অন্তরের মধ্যে দিয়েছিলেন। তার সংবাদ তুমি জান না। কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্রের জ্ঞানযোগ অগস্ত্য ঋষির মত গষে সে সমুদ্র পান করে নিঃশেষ করে দিয়েছে। অন্তর এখন শুষ্ক সমুদ্রগর্ভের মত বালুময় প্রান্তর। অনেক প্রবাল অনেক মণিমাণিক্য হয়ত আছে; কিন্তু তার সর্বাঙ্গে আছে চোখের জলের লবণাক্ত স্বাদ। তুমি তো কোনোদিন সে বুঝলে না, বুঝতে চাইলে। না! তুমি, মঞ্জরী—তোমরা দুজনেই যে মৃত্যু; অমৃত তো তোমরা চাও নি কোনোদিন। চাইলে তার কাছে আসতে, বুঝতে পারতে। আবার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন জীবন ডাক্তার।
মঞ্জরী, আতর-বউকে বা শুধু দোষ দিচ্ছেন কেন তিনি? তার নিজের কথা? তিনি নিজে? নিজেই কি তিনি জীবনে অমৃত পেয়েছেন বলে অনুভব করেছেন কোনোদিন? এ কথা অন্য কেউ জানে না, জানতেন দুজন, তারা আজ নেই। একজন তার বাবা, প্রথম শিক্ষাগুরু, দীক্ষাগুরু।
জগৎমশায় জানতেন তার এ অতৃপ্তির কথা। অমৃত-অপ্রাপ্তিই হল অশান্তি অতৃপ্তি। মৃত্যুকালে জগৎমশায় এ কথা তাকে ডেকে বলেছিলেন। জীবনকে চিকিৎসাশাস্ত্রে দীক্ষা দিয়ে আরও দশ বৎসর তিনি বেঁচে ছিলেন। মৃত্যুকালে জ্ঞানগঙ্গা গিয়ে গঙ্গাতীরে দেহত্যাগ করেছিলেন। মা তখন গত হয়েছেন। তিনিও খানিকটা জানতেন। কিন্তু তিনি এ অতৃপ্তির হেতু জানতেন না; তিনি হেতু সন্ধান করেছিলেন একেবারে বাস্তব সংসারে। বাবার মত গভীরভাবে বুঝে তাঁর অন্তর খুঁজে সন্ধান করেন নাই।
বিবাহের পর জীবন আয়ুর্বেদ শিক্ষায় মনপ্ৰাণ ঢেলে দিয়েছিল। যে পড়াশুনা তার ইস্কুলজীবনে ভাল লাগে নাই সেই পড়াশুনায় যেন ড়ুবে গিয়েছিল। জগৎমশায় আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। জগন্মশায় বলেছিলেন স্কুলে পড়াশুনার রকমসকম দেখে ভাবতম জীবনের বুদ্ধি বোধহয় মোটা; কিন্তু আয়ুর্বেদে দেখছি ওর বুদ্ধি ক্ষুরধার। তবে—হুঁ। থেমে গিয়েছিলেন তিনি ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আবার বলেছিলেন—তবে এর সঙ্গে গানবাজনা শেখ। আনন্দ কর। গান কর। ভগবানের নাম না করলে চিকিৎসকের বৃত্তি নিয়ে বাঁচবে কী করে?
ঠাকুরদাস মিশ্র সে সময় উপস্থিত ছিলেন, তিনি বলেছিলেন, ওহে ওটা যে ওর রক্তে রয়েছে। বংশগত বিদ্যেতে তাই হয়। আমার ওই হারামজাদা বেটাটার বিবরণ জান?
অর্থাৎ সুরেন্দ্রের। উচ্ছাসভরে বলেই গেলেন ঠাকুরদাস মিশ্র।
-হারামজাদা বেটা মদ ধরেছে তা তো জান। লেখাপড়া ছেড়েছে অনেক দিন। ভেবেছিলাম ও বেটাকে আর জমিদারি সেরেস্তার কাজে লাগাব না। পুজো-আর্চার মন্তরগুলো মুখস্থ করিয়ে বেটাকে লাট দেবগ্রামের বিশ্বেশ্বরী মায়ের পূজারী করে দেব। ওখানকার পূজারী বেটার বংশ নাই। পূজারীই সেবায়েত, পনের বিঘে জমি আছে চাকরান, তা ছাড়া বিশ্বেশ্বরী হল রেশমের পলু পোকা চাষের রাখে হরি মারে কের মত দেবতা! বিশ্বেশ্বরীর পুজো না দিয়ে পুষ্প না নিয়ে ও চাষই হয় না। পাওনা অঢেল। তা কিছুতেই না। ও বলে-ও মন্তর আমার মুখস্থ হবে না। তারপর ব্যাপার শোন বেটা সেদিন দশ বছর আগের এক জমাওয়াশীল বাকি নিয়ে এসে আমাকে দেখিয়ে বলে—এটাতে যে ভুল রয়েছে। শোন কথা! ভুল অবিশ্যি আমি জানিও ভুল আমারই কলমের ডগায় পুকুর লোপাট। কিন্তু দশ বছরের মধ্যে কেউ ধরতে পারে নি। জমিদারের ঘরে আর ধরাও পড়বে না। কিন্তু বেটার বিদ্যে দেখ। গোপনে গোপনে পুরনো কাগজ দেখে হিসেব বুঝেছে, বাপের ভুল ধরেছে। আমি তো বেটার মাথায় চড় মেরে বললাম, চুপ রে বেটা চুপ!
ঠাকুরদাস মিশ্র পুত্ৰগৌরবে যেভাবে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন জগৎমশায় তা হন নি। ঠাকুরদাস আঘাত পেতে পারে বলে শুধু একটু হেসেছিলেন, বাধাও দেন নি। শুধু একটু হেসেছিলেন। জগদ্বন্ধু ছিলেন জ্ঞানযোগী। সেই বাপের ছেলে এবং তাঁর শিষ্য হয়েও আসল বস্তুটি তিনি আয়ত্ত করতে পারলেন না। বাবা বলেছিলেন আয়ুর্বেদে ওর বুদ্ধি ক্ষুরধার।
বুদ্ধি তাঁর ক্ষুরধার ছিল, রোগ উপসর্গ—এমনকি রোগ ও উপসর্গের পশ্চাতে অন্ধ বধির পিঙ্গলকেশী মৃত্যু তার হিমশীতল হাত দুখানি জীবনকে গ্রহণ করতে উদ্যত হয়েছে, কি হয় নি, তাও তিনি অনুমান করতে পারতেন। আজ তুমি তরুণ ডাক্তার জীবন ডাক্তারকে উপহাস করেছ, তিরস্কার করেছ, নতুন কালের চিকিৎসাবিজ্ঞানের অহঙ্কারে তাকে অবহেলা করেছ। কর, কিন্তু সেকালে কেউ সাহস করত না।
স্মৃতি স্মরণ করতে করতে জীবনমশায় যেন প্রাচীন, স্থবির অজগরের মত ফুলে উঠলেন; একটা তরুণ বিষধর তার তারুণ্যের ক্ষিপ্ৰগামিতা আর বিষদন্তের তীক্ষতার অহঙ্কারে ছোবলের পর ছোবল মেরে গেল; বার্ধক্যের জীর্ণতায় তাঁর বিষদাত ভেঙে গিয়েছে, স্থবিরতায় তার বিপুল দেহে গতিবেগ মন্থর হয়েছে; অগত্যা তাঁকে সহ্য করতে হল।
নারায়ণ! নারায়ণ! পরমানন্দ মাধব হে!
বেশ স্কুট স্বরেই উচ্চারণ করলেন জীবন ডাক্তার।
মৃত্যুকালে গঙ্গাতীরে জগদ্বন্ধু মশায় তাঁকে বলেছিলেন–জীবন, বল আমাকে যদি কিছু জিজ্ঞাসার থাকে?
জীবনমশায় নিজেকে আর বেঁধে রাখতে পারেন নি, রুদ্ধ আবেগ চোখের জলের ধারায় পথ করে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। মুখে বলতে কিছু পারেন নি।
জগৎ মশায় বলেছিলেন—তুমি কাদছ? তোমার দীক্ষা আয়ুর্বেদে। জীবন এবং মৃত্যুর তথ্য তো তুমি জান; তবু কাঁদছ? ছি! আমাকে দুঃখ দিয়ো না; তুমি কদলে এই শেষ সময়ে আমাকে বুঝে যেতে হবে যে আমার শিক্ষা সার্থক হয় নি। তা ছাড়া, মৃত্যুতে আমার তো কোনো দুঃখ নাই, আক্ষেপ নাই। পরম শান্তি অনুভব করছি আমি, সুতরাং তুমি কাঁদবে কেন?
জীবন ডাক্তারের চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল।
জগৎ মশায় বলেছিলেন-আমি জানি তোমার মনে কোথায় আছে গভীর অতৃপ্তি। থাকা উচিত নয়। তোমার জীবনের কোনো দিক তো অপূর্ণ নয়!
কয়েক মুহূর্ত পরে বলেছিলেন—তবু আছে, রয়েছে। অবশ্য এর ওপর মানুষের হাত নাই আমি জানি। কিন্তু এ অতৃপ্তি থাকতে তো অমৃত পাবে না বাবা। পরমানন্দ মাধবকে অনুভব করতে পারবে না। অতৃপ্তি অবশ্য কামনার বস্তু না পেলে মেটে না। কিন্তু কামনা যে কী তাই কি কেউ জানে? শোন, আশীর্বাদ করে যাই কামনার বস্তু পেয়েই যেন তোমার সকল অতৃপ্তি মিটে যায়, অমৃত আস্বাদন করতে পার। দুঃখে স্থির থাকতে পার, পৃথিবীতে মৃত্যুর মধ্যে অমৃতকে অনুভব করতে পার; আর আনন্দে সুখে কাঁদতে পার। নাই পাও তৃপ্তি। তবে বাবা জ্ঞানযোগে ড়ুব দিয়ে। এই আয়ুর্বেদে। বড় কঠিন এবং শুষ্ক পথ। হোক। জ্ঞান হল অগস্ত্য ঋষি; গষে দুঃখের সমুদ্র পান করে নেন। স্বেচ্ছায় সৃষ্টির কল্যাণে চলে যান দক্ষিণে।
জ্ঞানযোগ-রূপী অগস্ত্যের গষপানে শুকিয়ে-যাওয়া সমুদ্রের বালির মত তার জীবন বালুময়। কিন্তু তার প্রতি বালুকণায় সমুদ্রের জলের লবণাক্ত স্বাদ। আতর-বউ কোনোদিন একবার আস্বাদন করেও দেখলেন না, কেবল মরুভূমি বলেই তাকে উত্তপ্ত দীর্ঘ নিশ্বাসে উত্তপ্ত করে তুললেন।
***
বাপের মৃত্যুর পর জ্ঞানযোগেই নিজেকে ড়ুবিয়ে দেবার জন্য জীবন দত্ত ডাক্তারি পড়বার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তখন বিলাতি চিকিৎসার অভিনবত্বে দেশ চকিত হয়ে উঠেছে। রঙলাল ডাক্তারের পালকির বেহারাদের হাঁকে দেশের পথঘাট মুখরিত; নবীন মুখুজ্জে ডাক্তারের ঘোড়ার খুরের ধুলোয় পথের দুই ধার ধূসর। শুধু পথঘাটেই নয়, কবিরাজদের মনের মধ্যেও এর সাড়া উঠেছে। এই বিদ্যা আগে থেকেই তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল, বাপের মৃত্যুর পর তিনি সুযোগ পেলেন।
বৃদ্ধ জীবনমশায় অন্ধকারের মধ্যে আবার একবার হাসলেন, দাড়িতে হাত বোলালেন।
হায়রে হায়! মানুষ সংসারে নিজেকে নিজে যত ছলনা করে, প্রতারণা করে, মিথ্যা বলে তার শতাংশের একাংশও বোধহয় পরকে করে না।
বৃদ্ধ বার বার মাথা নাড়লেন। ছোট ছেলের অপটু মিথ্যা বলার চাতুরীকে ধরে ফেলে কতকটা হতাশায়, কতকটা স্নেহবশে, কতকটা ধরে-ফেলার আনন্দে যেমন প্রবীণেরা মাথা নাড়ে তেমনিভাবেই মাথা নাড়লেন বার বার। সেদিনের আত্মপ্রতারণার কথাই আজ ধরে ফেলেছেন তিনি।
শুধু জ্ঞানলাভের জন্য, জ্ঞানযোগের মধ্যে নিজেকে সমাহিত করবার জন্য ডাক্তারি শিখতে চেয়েছিলেন? নিজে ঘোড়ায় চড়ে, আতর-বউকে পালকিতে চাপিয়ে কাঁদীতে ভূপী বোসের বাড়ি যাওয়ার কামনার তাড়নার কথাটা মিথ্যা?
শুধু কি এই? জগত্মশায়ের মৃত্যুর পর স্বাভাবিকভাবেই কতকগুলি বাধা ঘর কি হাতছাড়া হয় নাই তার? লোকে বলে নাই—এইবার মশাইদের বাড়ির পর গেল?
নবগ্রামে কি প্রথম অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার এসে বসে নি? তার প্রায় মাসদুয়েক পর ওই কিশোরের বাপ কৃষ্ণদাসবাবুর আশ্রয়ে কি হরিশ ডাক্তার আসে নি? তিনি কি নিজেই শঙ্কিত হন নি?
গুরু রঙলাল ডাক্তার এর অন্য অর্থ করেছিলেন। বলতেন জীবন, তোমাকে আমি ভালবাসি কেন জান? তোমাকে ভালবাসি তুমি জীবনে হার মান নি এই জন্যে। এ দেশের কবিরাজরা হার মেনে এই অ্যালোপ্যাথিকে শুধু ঘরে বসে শাপ-শাপান্তই করলে। না পারলে নিজেদের শাস্ত্রের উন্নতি করে এর সঙ্গে পাল্লা দিতে না চাইলে এর মধ্যে কী আছে সেই তত্ত্বকে জানতে। আধমরারা এমনি করেই মরে হে। তুমি জ্যান্ত মানুষ। তাই তোমাকে ভালবাসি। হার মানার চেয়ে আমার কাছে অপমানের বিষয় আর কিছু নাই। হার মানা মানেই মরা। ডেড ম্যান, ডেড ম্যান! বুঝেছ?
লম্বা একটা চুরুট ধরিয়ে খালি গায়ে একখানা খাটো কাপড় পরে রঙলাল ডাক্তার ময়ূরাক্ষীর দিকে তাকিয়ে কথা বলতেন আর পা দোলাতেন।
রোগী আসত। এ কথা যেদিন বলেছিলেন সেদিনের কথা মনে পড়ছে। একজন জোয়ান মুসলমানকে ড়ুলি করে নিয়ে এসেছিল। পেটের যন্ত্রণায় ধড়ফড় করছিল জোয়ানটা। রঙলাল। ডাক্তার তার দিকে তাকিয়ে দেখে নির্বিকারভাবেই বলেছিলেন, শুয়ে পড়, চিৎ হয়ে—এই আমার পায়ের তলায় শুয়ে পড়।
জীবন ডাক্তারকে বলেছিলেন—দেখবে নাকি নাড়ি? দেখ, তোমার নাড়িজ্ঞান কী বলে দেখ। অম্বল না অম্বলশূল না পিলের কামড় দেখ।
রোগী চিৎকার করে উঠেছিল, ওগো ডাক্তারবাবু, তুমি দেখ গো, তুমি দেখ! মরে গেলাম, আমি মরে গেলাম। নইলে একটুকুন বিষ দেন মশায়—খেয়ে আমি মরে বাঁচি। আঃ কোথাও কিছু হল না গো, কবরেজ হাকিম পীর কালীস্তান কিছু বাকি নাই মশায়।
বাধা দিয়ে রঙলাল বলেছিলেন, ঠাকুর-দেবতা কী করবে রে ব্যাটা? গোগ্ৰাসে গোশত খাবি তো তারা কী করবে? কতখানি গোশত খাস একেবারে দেড় সের না দু সের? কৃমি হয়েছে। তোর পেটে, তিন-চার হাত লম্বা কৃমি।
—হেই বাবা, ওষুধ দেন বাবা। যাতনায় আর বাঁচি না বাবা।
—তা দেব কিন্তু টাকা কই? অ্যাঁ? দুটো টাকা দে ফিজ আর ওষুধের দাম। দে আগে। টাকা না হলে হবে না।
–এক টাকা এনেছি বাবা—
জীবন বলেছিলেন, কাল তা হলে দিয়ে যেয়ো।
রঙলাল বলেছিলেন, ইউ আর এ ফুল। বিনা ফিজে চিকিৎসা কোরো না। ধারে ওষুধ দিয়ে না, মরবে তুমি। তা ছাড়া ওরা ভাববে এ লোকটার পর নেই ভাল। মানুষের বেঁচে থাকতে টাকা চাই। মানুষ খাটে ওই বাঁচার মূল্য উপার্জন করতে, তাতেও যে দাক্ষিণ্য দেখাতে যায় সে শুধু ফুলই নয় সে অপরাধী, অপরাধী। তাকে জীবনের যুদ্ধে হরতেই হবে। জাস্ট লাইক দি হিন্দুজ, ইতিহাসে পাবে হিন্দুরা প্রবল যুদ্ধ করে জিতে এল প্রায়, মুসলমানেরা যুদ্ধবিরতি প্রার্থনা করলে, ব্যস, হিন্দুরা বিরত হল। আচ্ছা, বিশ্রাম করে নাও, কাল আবার যুদ্ধ হবে। কিন্তু রাত্রে মুসলমান আক্রমণ করলে বিনা নোটিশে, অপ্রস্তুত হিন্দুরা হারল, মরল কিন্তু স্বর্গে গেল। আমি স্বৰ্গকামী নই। বুঝেছ? বলেই রোগীর সঙ্গের লোকদের বলেছিলেন, যাও, আর একটা টাকা নিয়ে এস। যাও। রোগী থাকুক এখানে। ভয় নেই। মরবে না। যাও।
তারা চলে গেলে বলেছিলেন, জীবনে টাকা চাই জীবন! টাকা চাওয়াটা অপরাধ নয়। কারও কাছে ভিক্ষা কোরো না, কাউকে ঠকিও না, কারও চুরি কোরো না, কাউকে সর্বস্বান্ত করে নিও না, কিন্তু তুমি যার জন্যে খাটবে তার মজুরি ফিজ, এ নিতে সঙ্কোচ কোরো না। করলে তুমি মরবে স্বর্গে যাবে কি না জানি না।
১৩. রঙলাল ডাক্তার
অদ্ভুত মানুষ ছিলেন রঙলাল ডাক্তার।
সাধারণ মানুষের সমাজ তাকে মহাদাম্ভিক অর্থপিপাসু হৃদয়হীন বলেই মনে করত। ঠিক তাঁর বাবার প্রকৃতির বিপরীত।
ভাষা ছিল রূঢ়, আপ্যায়নহীন অসামাজিক মানুষ।
জীবন ডাক্তারের সঙ্গেও প্রথম পরিচয়ে এমনই ভাষা প্রয়োগ করেছিলেন তিনি।
জগৎ মশায়ের মৃত্যুর পর। মনে তখন গভীর অশান্তি। সুপ্ত অতৃপ্তি যেন প্ৰচণ্ড তৃষ্ণায় জেগে উঠেছে জগৎ মশায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে, তার গুরুগম্ভীর অস্তিত্বের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে। তাঁর স্নেহ যেমন প্রসন্ন এবং গাঢ় ছিল, তার নির্দেশ এবং পরোক্ষ শাসনও ছিল তেমনি গুরুগম্ভীর, অলঙ্নীয়। জীবনের যে অসন্তোষ ছিল চাপা সে যেন চূড়া-ভেঙে-পড়া পাহাড়ের বুকের আগুনের মত বেরিয়ে পড়ল।
ওঃ–প্রথম দিনের অগ্ন্যুদ্গারের কথা মনে পড়ছে।
আতর-বউ সেদিন প্রথম মাথা কুটেছিলেন। আতর-বউও চিরকালের অসন্তোষের আগুন বুকে বয়ে নিয়ে চলেছেন। বিবাহের পর সেই ফুলশয্যার রাত্রি থেকেই জীবন ডাক্তার সে আগুনের উত্তাপ সহ্য করে আসছেন।
বাল্যকালে পিতৃমাতৃহীনা মেয়েটি মামার বাড়িতে মানুষ। চিরদিনের মুখরা। চিরদিনের–। কী বলবেন? প্রচণ্ডা ছাড়া বোধ করি বিশেষণ নাই। চিরদিনের প্রচণ্ডা। অদ্ভুত জীবনীশক্তি। সেই বাল্যকাল থেকেই মাথা কুটে বিদ্রোহ করতেন। শাসন যত কঠিন হয়েছে তত মাথা কুটেছেন। তত চিৎকার করে কেঁদেছেন। তারপর কৈশোরে দিনের পর দিন উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছেন মামা-মামির ঘরে, দিনেকের জন্য বিশ্রাম নেন নি। তার সঙ্গে উপবাস। মাসের মধ্যে সাতটাআটটা দিন উপবাস করতেন; অন্যপক্ষ শাসনের নামে নির্যাতন করে ক্লান্ত হয়ে হার মানলে তবে অন্ন গ্রহণ করতেন।
বিবাহের ফুলশয্যাতেই এমন মেয়ের বুক থেকে অগ্নিজ্বালা না হক অগ্নিতাপ বিকীর্ণ হবে তাতে আর বিস্ময়ের কী আছে। কিন্তু নতুন বউ হিসেবে সংসারে সে সুনাম কিনেছিল। দিনের বেলা দূর থেকে জীবনমশায় আতর-বউকে দেখতেন প্রসন্ন, প্রশান্ত, হাস্যময়ী; অবশ্য শাশুড়ির সমাদর তার একটা বড় কারণ। মা বউকে বড় সমাদর করতেন। মায়ের ধারণা ছিল আতরবউয়ের মত পয়মন্ত মেয়ে আর হয় না। বিয়ের পর বাপের কাছে আয়ুর্বেদ শিক্ষায় জীবনের মনপ্ৰাণ সমৰ্পণ করা দেখে এই ধারণা হয়েছিল তার। তিনি বলতেন—আমার বউয়ের পয়েই এমনটা হল। নইলে সেই জীবনে, যে মাথাটা নিচু করে টু মেরে বড় বড় জোয়ানকে ঘায়েল করেছে, বোশেখ মাসের দিনে সকালে বেরিয়ে বেলা দুপুর পার করে তা খেয়ে ফিরেছে, মোলকিনী পুকুর বিশবার এপার-ওপার করে পাক তুলে কাদা করে তবে উঠেছে, তার এই মতিগতি হয়। স্কুলে গিয়ে মারামারি করেছে। বই তো না। এ যেন সে মানুষই নয়। বউমার পয় ছাড়া আর কী বলব? বউমা বাড়িতে পা দেওয়ার পর এই হল!
এ কথা শুনে সেকালে আতর-বউয়ের মুখ স্মিতহাস্যে ভরে উঠত।
এই সময়টাই জগৎ মশায়ের জীবনের প্রবীণতম কাল, প্রবীণতার সঙ্গে সঙ্গে বিচক্ষণতা এবং বহুদৰ্শিতার খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন জগৎমশায় নিজে আর সাধারণ রোগী দেখতে বের হতেন না, জীবন ছিলেন সেজন্য। রোগ কঠিন হলে তবে নিজে যেতেন। নইলে বলতেন, আমার যাবার দরকার নাই বাবা, আমার জীবন যাচ্ছে। ও আমারই যাওয়া। সঙ্গে সঙ্গে মৃদু হাসতেন।
কথাটার ভিতরের অর্থ যে না বুঝত, তাকে তিনি ওর অর্থ বোঝাতে চেষ্টা করতেন না, রসিকতা যে বোঝে না তার সঙ্গে রসিকতা তিনি করতেন না, সাদা কথায় বলতেন, জীবন দেখে এসে আমাকে বলবে, তাতেই হবে। জীবনকেই আমি বলে দেব যা করতে হবে, যে ওষুধ দিতে হবে, তার জন্যে ভেবো না।
যেতেন, জীবন যখন বলত তখন। আর যেতেন অন্য চিকিৎসকের হাতের রোগী দেখবার জন্য ডাক এলে তখন। আর যেতেন যে ক্ষেত্রে নিদান হাকতে হবে সেই ক্ষেত্রে।
একটা ঘটনা মনে পড়ছে। এই ঘটনায় জগৎ মশায়ের খ্যাতি পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। নবগ্রামের বরদাপ্রসাদবাবুর কঠিন অসুখ। বরদাবাবুরা নবগ্রামের প্রাচীনতম জমিদার বংশ; এক পুরুষকাল আগে এই বংশেরই বড়তরফের কর্তার বাড়িতে জগৎ মশায়ের বাবা দীনবন্ধু মশায় খাতা লিখতেন এবং ছেলেদের পড়াতেন। এই বাড়ির ছেলের রোগের সেবা করে দীনবন্ধু মশায় প্রথম চিকিৎসাবিদ্যার আস্বাদ পেয়েছিলেন এবং কর্তার ছেলের আরোগ্যের পর বিখ্যাত কবিরাজ কৃষ্ণদাস সেনগুপ্ত নিজে ডেকে তাকে আয়ুর্বেদে দীক্ষা দিয়েছিলেন। এই কৃতজ্ঞতায় দীর্ঘকাল, জগৎ মশায়ের চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বৎসর বয়স পর্যন্ত, এই বংশের যে-কোনো বাড়িতে ডাকলে সসম্ভ্ৰমে বিনা দক্ষিণায় চিকিৎসা করেছেন। কিন্তু এরা তাঁর সমকে বজায় রাখত না, উপরন্তু পদে পদে অসম করত, এমনকি ওষুধের দামও দিত না; বলত খাজনায় কাটছিট করে দেব। এই কারণেই জগৎমশায় স্বগ্রামের কয়েক পয়সা জমিদারি কিনে অসম্ভমের হাত থেকে রক্ষা পেতে চেয়েছিলেন। এবং রক্ষাও পেয়েছিলেন। নবগ্রামের রায়চৌধুরী বংশ তাকে আর ডাকতেন না। তারা হরিহরপুরের কবিরাজ হীরালাল পাঠককে গৃহ-চিকিৎসক করেছিলেন। রোগ কঠিন হলে ডাকতেন রাঘবপুরের গুপ্ত কবিরাজদের। বরদাবাবুর অসুখে বাধ্য হয়ে তার ছেলে জগৎ মশায়কে ডেকেছিলেন। বরদাবাবুর ছেলে কলকাতায় ব্যবসায় করতেন। বাপের অসুখের সংবাদ শুনে গ্রামে এসেই ডাকলেন রাঘবপুরের গুপ্তকে। গুপ্ত এসে বললেন– তিন দিন, এক সপ্তাহ বা নবম দিনে মৃত্যু অনিবার্য।
ছেলে বললেন–আমি কলকাতায় নিয়ে যাব।
গুপ্ত বললেন–তাতে পথে মৃত্যু হবে। তিন দিন পরমায়ুও তাতে ক্ষয়িত হবে।
ছেলে এরপর রঙলাল ডাক্তারকে ডাকলেন, কবিরাজ হাত দেখে বললেন। রূঢ়ভাষী রঙলাল ডাক্তার বাধা দিয়ে বললেন–ও বিদ্যেটা আমি বুঝি না, বিশ্বাস করি না।
ছেলে বললেন– মানে উনি বলেছেন তিন দিন, এক সপ্তাহ বা নবম দিনে মৃত্যু অনিবার্য।
রঙলাল বললেন–সেও আমি বলতে পারব না। তবে ওর কাছে লিখে নিতে পারেন। মৃত্যু না হলে নালিশ করতে পারবেন। আমাকে লিখে দিলে আমি নালিশ করব।
ছেলে বললেন–এখন আমি চিকিৎসার জন্যে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাই।
—তবে আমাকে কেন ডেকেছেন? নিয়েই যান।
–কবিরাজ বলেছেন—তাতে তিন দিনও বাঁচবেন না, পথেই ত্ৰিশূন্যে অর্থাৎ গাড়িতেই মারা যাবেন।
—তা পারেন। আবার নাও পারেন। আমি ওষুধ দিয়ে যাচ্ছি। রোগ কঠিন। মরবেন কি বাঁচবেন সে আমি জানি না।
রঙলাল ডাক্তার চলে গেলে অগত্যা তাঁরা জগৎ মশায়কে ডাকলেন।
জগৎমশায় নাড়ি দেখে বলেছিলেন–সুচিকিৎসার জন্যে কলকাতা নিয়ে যাবেন, বাধা দেব না; নিয়ে যান। চিন্তার কোনো কারণ নাই আমি দায়ী রইলাম।
ছেলে বলেছিলেন—দেখুন, ভাল করে বুঝুন।
—না বুঝে কি এতবড় কথা বলতে পারি রায়চৌধুরীমশায়? নিয়ে যান। আমার কথার অন্যথা হলে আমি দশের সম্মুখে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, চিকিৎসা আমি ছেড়ে দেব। আর–।
হেসে বলেছিলেন–আর এ যাত্রায় কর্তার রোগভোগ আছে, দেহরক্ষা নাই। অচিকিৎসা কুচিকিৎসা হলে তার কথা আলাদা। চিকিৎসা হলে বাঁচবেন। আপনি কলকাতায় নিয়ে যান।
তার কথাই সত্য হয়েছিল। বরদাবাবুকে কলকাতা নিয়ে পৌঁছুতে কোনো বিঘ্ন ঘটে নাই এবং তিনি সেবার রোগমুক্ত হয়ে দেওঘরে শরীর সেরে বাড়ি ফিরেছিলেন।
বরদাবাবুর বাড়িতে তিনি কোনো দক্ষিণা গ্রহণ করেন নাই। বরদাবাবু বাড়ি ফিরে তাকে উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন। দেওঘরের পেঁড়া, একটি ভাল গড়গড়া ও নল, কিছু ভাল তামাক আর একখানি বালাপোশ।
এই ঘটনার পরই জীবন তাঁকে বলেছিল—এবার ফিজ বাড়াতে হবে আপনাকে। চার টাকা ফিজ করুন।
জগৎমশায় তাতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু জীবন ছাড়ে নাই। বলেছিল–গরিব যারা তাদের বাড়ি আপনি বিনা ফিজে যাবেন। কিন্তু যে যা দেবে—এ করলে আপনার মর্যাদা থাকবে না।
এই সময়টিই দত্তমশায়দের বাড়ির সর্বোত্তম সুসময়।
জীবনের মা বলতেন, এসব আমার বউয়ের পয়।
আতর-বউ নিজেও তাই ভাবতেন।
সেকালে জীবন ডাক্তার রোগী দেখতে বের হবার সময় নিয়মিতভাবে আতর-বউ সামনে এসে দাঁড়াতেন। তার মুখ দেখে যাত্রায় শুভ ফল অবশ্যম্ভাবী।
***
জগৎ মশায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে দত্তমশায়দের খ্যাতিতে প্রতিষ্ঠার ভাটা পড়ল স্বাভাবিকভাবে।
অনেক বাঁধা ঘর–চার-পাঁচখানা গ্রাম তাঁকে ছেড়ে কামদেবপুরের মুখুজ্জে কবিরাজের এবং হরিহরপুরের পাঠক কবিরাজের কাছে গিয়ে পড়ল। ওদিকে নবগ্রামের বাবুরা নিয়ে এলেন। একজন ডাক্তার। দুর্গাদাস কুণ্ডু। জীবনমশায় তখন শুধু জীবন দত্ত। মহাশয় তো সহজে লোকে বলে না। ওদিকে ডাক্তারির একটা সুবিধে আছে। বয়স যেমনই হোক, অভিজ্ঞতা থাক আর না থাক ডিগ্রি আছে; ডিগ্রির জোরেই ডাক্তার খেতাব তাদের প্রতিষ্ঠিত।
জীবন দত্তের সুপ্ত কামনা এই দুঃসময়ের ঝড়ে ছাই-উড়ে-যাওয়া আগুনের মত গগনে হয়ে উঠল। তিনি ডাক্তার হবেন। সম্মুখে রঙলাল ডাক্তারের দৃষ্টান্ত। ওদিকে নবগ্রামে আরও একজন নতুন ডাক্তার এল। তারই বন্ধু কৃষ্ণদাসবাবু, ওই কিশোর ছেলেটার বাপ, নতুন ডাক্তারকে আশ্রয় দিলেন। আরও শোনা গেল, নবগ্রামের নবীন ধনী ব্রজলালবাবু এখানে চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি অ্যালোপ্যাথিক দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করছেন। তিনি গোপনে গোপনে আরম্ভ করে দিলেন। অনেক সন্ধান করে দুখানি বই আনালেন—ডাক্তারি শিক্ষা ও বাঙলা মেটিরিয়া মেডিকা। ইচ্ছা সত্ত্বেও রূঢ়ভাষী রঙলাল ডাক্তারের কাছে যেতে সাহস হল না।
মাতিনেক পর হঠাৎ রঙলাল ডাক্তারের সঙ্গে তাঁর দেখা হল, তার সঙ্গে জীবনের যোগসূত্র রচিত হবার প্রথম গ্রন্থি পড়ল।
ওই কিশোর ছেলেটিকে তিনি এইজন্যই এত ভালবাসেন। এই গ্রন্থিটি পড়েছিল তাকে উপলক্ষ করেই।
হঠাৎ একদিন শুনলেন, নবগ্রামের কৃষ্ণদাসবাবুর ছেলে কিশোরের বড় অসুখ। আজ দশ দিন একজ্বরী। দেখছিল ওই নবাগত হরিশ ডাক্তার, আজ মাসখানেক সে নবগ্রামে এসেছে। কৃষ্ণদাসবাবুই তাকে আশ্রয় দিয়েছেন। পাসকরা ডাক্তার-পাটনা স্কুল থেকে পাস করে এসেছে। পোর না হওয়া পর্যন্ত কৃষ্ণদাসবাবুই তার সকল ভার বহন করবেন বলেছেন। সে ই দেখছিল—আজ রঙলাল ডাক্তার দেখতে আসবেন।
জীবন দত্ত বিস্মিত হলেন, শঙ্কিতও হলেন। নিজেকে একটা ধিক্কারও দিলেন। খবর রাখা উচিত ছিল। কৃষ্ণদাসবাবু তার চেয়ে বয়সে বড় হলেও বন্ধু। এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেপালের পরমাত্মীয়-সম্বন্ধী। তা ছাড়া এই কিশোর ছেলেটিকে তিনি বড় ভালবাসেন। এই নতুন ডাক্তারটি কৃষ্ণদাসবাবুর বাড়িতে আসবার আগে পর্যন্ত অর্থাৎ চার মাস আগে পর্যন্তও তারাই পুরুষানুক্রমে এঁদের বাড়িতে চিকিৎসা করতে আসছিলেন। তার তো একবার যাওয়া উচিত ছিল। চিকিৎসক হিসেবে না-ডাকতে যাওয়ায় মর্যাদায় বাধে, কিন্তু তার উপরেও যে একটা অন্তরঙ্গতার সম্পর্ক আছে। কৃষ্ণদাসবাবুর সঙ্গে আছে, ওই কিশোর ছেলেটির সঙ্গেও আছে। ও পাড়ায় গেলেই তিনি কিশোরের খোঁজ করে দু-চারটি কথা বলে আসেন। ছ-সাত বছরের এই শ্যামবৰ্ণ ছেলেটি আশ্চর্য রকমের দীপ্তিমান। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং রসবোধে সরস বুদ্ধি।
এই তো সেদিন।
নেপালের বাড়ি থেকে তিনি নেপালকে সঙ্গে নিয়েই বের হচ্ছিলেন। পথে যাচ্ছিল কিশোর। দুপুরবেলা শ্যালক-পুত্রকে একা দেখে পাগলা নেপালের কর্তব্যবোধ জেগে উঠল। কিশোরের গতিপথ দেখে যে-কেউ বুঝতে পারত যে, সে নিজেদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছে; পাগলা নেপাল সেই হিসেবে অকারণেই প্রশ্ন করলে—কোথায় যাবি? আমাদের বাড়ি?
–না।
–তবে? দুপুরবেলা যাবি কোথায়?
কিশোর উত্তর দিয়েছিল–যাব তোমার শ্বশুরবাড়ি।
নেপাল বুঝতে পারে নাই রসিকতাটুকু। জীবন হা-হা করে হেসেছিলেন।
জীবন ডাক্তার নিজেও অপ্রতিভ হয়েছেন তার কাছে। এই তো মাসকয়েক আগে। তখনও চিকিৎসা করতেন ওদের বাড়িতে। কিশোরেরই জ্বর হয়েছিল। নাড়িতে দেখলেন অশ্লদোষ। কৃষ্ণদাসবাবুর ভগ্নী বললেন–এই জ্বর অবস্থাতেও কাল খোয়া-ক্ষীর চুরি করে খেয়েছে। অশ্লদোষের আর দোষ কী?
জীবন ডাক্তার বলেছিলেন-অ্যাঁ? তুমি চুরি করে খেয়েছ?
কিশোর অপ্রস্তুত হয় নি। বলেছিল–হ্যাঁ।
—জান, চুরি করে খেলে পাপ হয়?
কিশোর ঘাড় নেড়ে বলেছিল—হয়। কিন্তু খোয়া-ক্ষীর খেলে হয় না।
জীবন ডাক্তার অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, বলেছিলেন,-কে বলেছে তোমাকে?
কিশোর বলেছিল—ভাগবতে শুনেছি। কৃষ্ণ নিজে খোয়া-ক্ষীর, ননি, মাখন চুরি করে খেতেন। তবে কেন পাপ হবে?
জীবন ডাক্তারকে হার মানতে হয়েছিল। অতঃপর চিকিৎসাশাস্ত্ৰতত্ত্ব বোঝাতে হয়েছিল। ছেলেটি মন দিয়ে শুনেছিল এবং শেষে বলেছিল—আচ্ছা আর বেশি খাব না। কম করে খাব।
এরপর জীবন ডাক্তার কিশোরকে দেখলেই পুরাণ-সম্পর্কে প্রশ্ন করেছেন। কিশোর প্রায়ই উত্তর দিয়েছে এবং বিচিত্র ভঙ্গিতে উত্তর দিয়েছে। রাবণের কটা মাথা কটা হাত জিজ্ঞাসা করায় বলেছিল দশটা মাথা কুড়িটা হাত। জানেন, রাবণ কখনও ঘুমোত না।
—কেন?
–শুয়ে পাশ ফিরবে কী করে?
এইভাবে ছেলেটির সঙ্গে একটি নিবিড় অন্তরঙ্গতা জমে উঠেছিল। তার অসুখবেশি অসুখ, রঙলালবাবুর মত ডাক্তার আসছেন–জীবন ডাক্তার আর থাকতে পারলেন না। তিনি নিজেই এলেন কৃষ্ণদাসবাবুর বাড়ি। কৃষ্ণদাস অপ্রস্তুত হলেন কিন্তু জীবন স্মিতহাস্যে বললেন– কিছু না কৃষ্ণদাস দাদা, আপনারা ব্রাহ্মণ, আমি কায়স্থ হলেও তো আমি আপনার ভাই। খুড়া হিসেবে দেখতে এসেছি। চলুন, কিশোরকে একবার দেখব।
কিশোর প্রায় বেশ হয়ে পড়ে ছিল। গলায় মৃদু সর্দির শব্দ উঠছে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে। দুচারটি ভুলও বকছে। ভাদ্র মাসে গরম কাপড় দিয়ে তাকে প্রায় মুড়ে রাখা হয়েছে। নতুন ডাক্তার বললেন–বুকে সর্দির দোষ রয়েছে; জ্বর উঠেছে এক শো তিন। নিউমোনিয়া এতদিন পূর্ণমাত্রায় দেখা দিত, কিন্তু আমি গোড়া থেকেই বেঁধেছি। তবু যে কেন জ্বর কমছে না বুঝছি না।
জীবন ডাক্তার দুটি হাতের নাড়ি দীর্ঘক্ষণ ধরে মনঃসংযোগের সঙ্গে পরীক্ষা করলেন। জিভ চোখ দেখলেন, পেট টিপে পরীক্ষা করলেন। তারপর উঠে হাত ধুয়ে কৃষ্ণদাসবাবুর কাছে বসে বললেন–একুশ দিন বা চব্বিশ দিনে জ্বরত্যাগ হবে কৃষ্ণদাস দাদা। ভয়ের কোনো কারণ নাই, তবে জ্বরটা একটু বাঁকা। আগন্তুক জ্বর, সানিপাতিক দোষযুক্ত, তবে প্রবল নয়; মারাত্মকও নয়। শ্লেষ্মা দোষ—ডাক্তারবাবু যেটা বলছেন–
হরিশ ডাক্তারের দিকে চেয়ে বললেন–এটা আনুষঙ্গিক, আসল ব্যাধি ওটা নয়।
হরিশ ডাক্তার প্রায় তার সমবয়সী; জীবন দত্তের থেকে বছর চার-পাঁচের ছোট। কর্মজীবনে এটা খুব পার্থক্যের বয়স নয়। প্রীতির সঙ্গেই বলেছিলেন। কিন্তু পাস-করা হরিশ ডাক্তার বলেছিল না। আমি স্টেথোসকোপ দিয়ে দেখেছি। সর্দির দোষটাই মূল দোষ। আর সান্নিপাতিক মানে টাইফয়েডের কথা যা বলছেন—ওটা আমার মতে ঠিক নয়।
জীবন দত্ত ধ্যানস্থের মত নাড়ি ধরে অনুভব করেছেন, যা বুঝেছেন তা ভুল হতে পারে না। তিনি মৃদু হাসির সঙ্গে ঘাড় নেড়েছিলেন। ঠিক এই সময়েই বাইরে পালকির বেহারাদের হক শোনা গিয়েছিল।
হরিশ ডাক্তার ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল—ওই, উনি এসে গিয়েছেন।
জীবন দত্তও বাইরে যাবার জন্য উদ্যত হলেন, হঠাৎ নজরে পড়ল কিশোরের শিয়রে বসে অবগুণ্ঠনবতী তার মা। জীবন দত্ত গভীর বিশ্বাসে আশ্বাস দিয়ে আবার বলেছিলেন কোনো ভয় নাই। যে যা বলবে বলুক মা, একুশ দিন বা চব্বিশ দিনে জ্বর ছেড়ে যাবে, ছেলে সেরে উঠবে।
রঙলাল ডাক্তারের সঙ্গেও সংঘর্ষ বাঁধল—এই একুশ দিন, চব্বিশ দিন নিয়ে।
রঙলাল ডাক্তার রোগী দেখলেন।
প্রথমেই বললেন– বাজে লোক—বেশি লোক ঘরে থাকা আমি পছন্দ করি না। যে ডাক্তার দেখছে আর রোগীর যে সেবা করছে, আর এক-আধজন।
জীবন দত্তও বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কৃষ্ণদাসবাবু বললেন–তুমি থাক জীবন।
উনি তার হাত ধরলেন। জীবন মশায়ের মনে আছে-ভীত কৃষ্ণদাসবাবুর হাত ঘামছিল; জীবন দত্ত মৃদুস্বরে সাহস দিয়ে বলেছিলেন—ভয় কী?
রোগী দেখে রঙলাল ডাক্তার কিছু বললেন– না। প্রেসক্রিপশন চাইলেন। পড়ে দেখলেন। সেগুলি ফিরিয়ে দিয়ে নিজে প্রেসক্রিপশন লিখে হরিশ ডাক্তারের হাতে দিলেন, বললেন–এসব পালটে এই দিলাম। পথ্য—বার্লি, ছানার জল, বেদানার রস চলতে পারে। কোনো শক্ত জিনিস নয়। ছেলের টাইফয়েড হয়েছে।
হরিশ ডাক্তারের মুখ ম্লান হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে জীবন দত্তের দিকে সকলের দৃষ্টি পড়েছিল—এ জীবন মশায়ের মনে আছে। জীবন দত্ত কিন্তু হরিশ ডাক্তারের মুখের দিকে তাকান নি। ছিঃ! অপ্রস্তুত হবেন উনি।
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রঙলাল ডাক্তার হরিশকে ভাল করে সব বুঝিয়ে দিলেন।
জীবন দত্তের কবিরাজি পদ্ধতির সঙ্গে তাতে কয়েকটিতে গরমিল ছিল। কিন্তু তিনি চুপ করে রইলেন। তার অধিকার কী? তারপর রঙলাল ডাক্তার ওষুধ তৈরি করতে বসলেন।
ওইটি ছিল তাঁর একটি বিশেষত্ব। নিজের কলবাক্স থেকে ওষুধ তৈরি করে দিতেন। অন্য কোনো ডাক্তারের কি ডাক্তারখানায় তৈরি ওষুধ তিনি রোগীকে খেতে দিতেন না। এমনকি হঠাৎ যে বিপদ বা পরিবর্তন আসতে পারে, তাও ওষুধ তৈরি করে দিয়ে বলতেন—এই রকম হলে এই দেবে। এই রকম হলে এটা। এক-একদিন পর অবস্থা লিখে লোক পাঠাবে আমার কাছে। তবে যে ডাক্তার দেখছে, তার কাছে গোপন রাখতেন না কিছু। বিশ্বাসের পাত্র হলে তারপর তাকে দিতেন প্রেসক্রিপশন—সে ওষুধ তৈরি করে দিত। বলতেন—বিষ মিশিয়ে রোগীর অনিষ্ট করবে না, সে আমি জানি; বিষের দাম আছে। আমার ই-করা প্রেসক্রিপশন আছে—আমাকে দায়ী করতে পারবে না। কিন্তু জোলো দেশে জলের দাম লাগে না, ওষুধের বদলে জল দিলে কী করব? ছটা ওষুধের তিনটে না দিলে কী করব? পচা পুরনো দিলে কী করব? আমার বদনাম হবে।
ঠিক এই সময়। ওষুধের শিশি দুটি ঝাঁকি দিয়ে একবার নিজে ভাল করে তার রঙ এবং চেহারাটা দেখে হরিশ ডাক্তারের হাতে দিলেন—দু রকম ওষুধ থাকল। এইটাই এখন চলবে। যদি ভুল বকে বা জ্বর বাড়ে—জ্বর বাড়লেই ভুল বকবে, ভুল বকলেই জানবে জ্বর বেড়েছে, তখন এইটে দেবে। বুঝেছ? আর ওই লেপকথাগুলো খুলে দাও। অত চাপা দিয়েই তো বাচ্চাটাকে খতম করবে। এমন করে জানালা-দরজা বন্ধ কোরো না। আলো-বাতাস আসতে দাও। বুঝেছ?
উঠলেন তিনি।
কৃষ্ণদাসবাবু এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলেন—রোগ কি টাইফয়েড?
–হ্যাঁ, কঠিন রোগ।
–আজ্ঞে হ্যাঁ, সে-ই জিজ্ঞাসা করছি।
–বাঁচা-মরা ঈশ্বরের হাত, সে আমি বলতে পারি না।
কৃষ্ণদাসও সাহসী লোক ছিলেন তিনি মুখে মুখে জবাব দিতে পটু ছিলেন। বলেছিলেন, সে কথা আপনি কেন, আমরাও বলতে পারতাম। আপনার দেখে কেমন মনে হল? টাইফয়েড সানিপাতিক হলেই তো অসাধ্য হয় না। রোগেরও প্রকারভেদ আছে। মৃদু, মধ্যম-কঠিন।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মুখের দিকে তাকিয়ে রঙলাল বলেছিলেন-আপনিই তো কৃষ্ণদাস বাবু? ছেলের বাবা?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
–রোগ মধ্যম রকমের বলশালী। তবে কঠিন হতে কতক্ষণ। উপযুক্ত সেবা, নিয়মিত ওষুধএ না হলে রোগ বাড়তে পারে। এ রোগে সেবাটাই বড়।
–তার জন্যে দায়ী আমরা। এ রোগ সারতে কতদিন লাগবে?
–সে কী করে বলব আমি? সে আমি জানি না।
জীবন কবিরাজের এতটা অসহ্য মনে হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, কৃষ্ণদাস দাদা, বাইশ থেকে চব্বিশ দিনের মধ্যে আপনার ছেলের জ্বর ত্যাগ হবে, আপনি উতলা হবেন না।
হেঁট হয়ে কলবাক্সে ওষুধ গুছিয়ে রাখছিলেন রঙলাল ডাক্তার তিনি খোঁচা খাওয়া প্রবীণ গোক্ষুর সাপের মত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফিরে ডাকলেন।
–আপনি কে? গণক?
–না। উনি আমাদের এখানকার কবিরাজ। জগদ্বন্ধু মশায়ের নাম বোধহয় জানেন।
–নিশ্চয় জানি। বিচক্ষণ কবিরাজ ছিলেন তিনি। রোগনির্ণয়ে আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল। এখানকার বরদাবাবুর কথা মনে আছে আমার।
—উনি তাঁরই ছেলে। জীবন দত্ত।
রঙলাল আবার একবার তাকালেন জীবন দত্তের দিকে, বললেন, বাইশ থেকে চব্বিশ দিন কী থেকে বুঝলে? নাড়ি দেখে?
—হ্যাঁ, নাড়ি দেখে তাই আমার অনুমান হয়। জ্বর চব্বিশ দিনে ছাড়বার কথা। তিন অষ্টাহ। তবে প্রায়ই আমাদের দেশে এ রোগে প্রথম একটা দুটো দিন গা ছ্যাঁকছ্যাঁকের শামিল হয়ে ছুট হয়ে যায়। সেই কারণেই বলেছি-বাইশ থেকে চব্বিশ দিন।
—তোমার সাহস আছে। অল্প বয়সতাজা রক্ত। হেসেছিলেন রঙলাল ডাক্তার। তোমাদের বংশের নাড়িজ্ঞানের প্রশংসা শুনেছি, বরদাবাবুর বেলা দেখেছিও। কিন্তু ওটা তো আমাদের শাস্ত্রের বাইরে।
ঠিক চব্বিশ দিনেই কিশোরের জ্বর ছেড়েছিল।
কৃষ্ণদাসবাবু জীবন দত্তকে ডেকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। রঙলাল ডাক্তারের কাছে লোক পাঠিয়েছিলেন। চিঠিতে লিখেছিলেনআজ চব্বিশ দিনেই জ্বর ত্যাগ হইয়াছে। ইহার পর ঔষধ এবং নির্দেশ দিলে সুখী হইব। আসিবার প্রয়োজন বোধ করিলে কখন আসিবেন জানাইবেন।
রঙলাল ডাক্তার আর আসেন নি। শুধু নির্দেশ এবং ওষুধ পাঠিয়েছিলেন। তার সঙ্গে লিখেছিলেন, জগদ্বন্ধু মশায়ের ছেলেটিকে আমার আশীর্বাদ দিবেন।
জীবন দত্ত উৎসাহিত হয়ে চার মাইল পথ হেঁটে তাঁকে প্রণাম করতে গিয়েছিলেন।
বহ্নিগর্ভ দুটি শমীবৃক্ষ পরস্পরের সান্নিধ্যে আসবামাত্র দুজনের ভিতরের বহ্নিই উৎসুক হয়ে উঠল।
***
সেই রঙলাল ডাক্তার তাঁর পিঠে সেদিন হাত বুলিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। সে হাতের স্পর্শের মধ্যে জীবন দত্ত স্নেহ অনুভব করেছিলেন। সে এক বিস্ময়। তান্ত্রিক শবসাধকের মত মানুষ রঙলাল ডাক্তার। বামাচারীর মত কোনো আচার-নিয়ম মানেন না, কঠিন রূঢ় প্রকৃতি, নিষ্ঠুর ভাষা, ময়ূরাক্ষীর জলে ভেসে-যাওয়া মড়া টেনে নিয়ে ফালি ফালি করে চিরে দেখেন। কবর থেকে মড়া টেনে তোলেন, মায়ের কোলে সন্তানকে মরতে দেখেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না, পৃথিবীর কারও কাছে মাথা হেঁট করেন না। এই মানুষটিকে এই তন্ত্রপ্রধান অঞ্চলের লোকে বলত, আসলে রঙলাল ডাক্তার হলেন প্রচ্ছন্ন তান্ত্রিক। বামাচারী।
কেউ কেউ বলত, নাস্তিক্যবাদী পাথর।
রঙলাল ডাক্তার তাকে প্রথম কথাই বলেছিলেন—তুমি যদি ডাক্তারি পড়তে হে! বড় ভাল করতে। তোমার মধ্যে একজন জাত চিকিৎসক রয়েছে। কবিরাজি শাস্ত্রে কিছু নেই এ কথা আমি বলছি না। কিন্তু আমাদের জাতের মত শাস্ত্রটিও কালের সঙ্গে আর এগোয় নি। যে কালে এ শাস্ত্রের সৃষ্টি চরম উন্নতি—সে কালে কেমিস্ত্রির এত উন্নতি ছিল না। তা ছাড়া আরও অনেক কিছু আবিষ্কার হয় নি। তারপর ধর, কত দেশ থেকে কত মানুষ আমাদের দেশে এসেছে। তাদের সঙ্গে তাদের দেশের রোগ এ দেশে এসেছে—জল বাতাস মাটির পার্থক্যে বিচিত্র চেহারা নিয়েছে। তা ছাড়া আয়ুৰ্বেদ আগন্তুজ ব্যাধি বলে যেখানে থেমেছে, ইউরোপের চিকিৎসাবিদ্যা মাইক্রোসকোপের কল্যাণে জীবাণু আবিষ্কার করে অনুমান ও উপসর্গের সীমানা ছাড়িয়ে চলে এসেছে বহুদূরে এগিয়ে।
আধুনিক কালের রোগ-চিকিৎসা নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। জীবন দত্ত তন্ময় হয়ে শুনেছিলেন। বার বার মনে পড়েছিল নিজের বাপ এবং মহাগুরু জগৎ মশায়কে। পার্থক্যের মধ্যে জগৎমশায় শিক্ষার মধ্যে বার বার উল্লেখ করতেন অদৃষ্টের, নিয়তির, ভগবানের; এবং সমস্ত বক্তব্যই যেন রোগবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা ছাড়াও অন্য একটি ভাব-ব্যাখ্যা-জড়িত বলে মনে হত, যেন কথার অর্থ ছাড়াও একটি ভাব থাকত; রঙলাল ডাক্তারের বক্তব্যের মধ্যে ঈশ্বর ছিল না, অদৃষ্ট ছিল না এবং সমস্ত বক্তব্য ছিল শুষ্ক, কেবলমাত্র বুদ্ধিগ্ৰাহ্য, কথার মানে ছাড়া কোনো ভাববাষ্পের অস্তিত্ব ছিল না। রঙলাল ডাক্তার বলতেন-মানুষ মরে গেলে আমরা আর কোনো দিকে তাকাই না। বুঝেছ, ওই দেহপিঞ্জর করি ভঙ্গ প্রাণ-বিহঙ্গ কেমন করে ফুড়ত করে উড়লেন—সে দেখতে আমরা চেষ্টা করি না। মধ্যে মধ্যে হেসে বলতেন—আরে, প্রাণ যদি বিহঙ্গ হয় তবে নিশ্চয় বন্দুকধারী শিকারিও আছে, তারা নিশ্চয় পক্ষিমাংস ভক্ষণ তা হলেই তো পুনর্জন্ম খতম।
সেই দিনই জীবন সুযোগ বুঝে বলেছিলেন, আমার একটি প্রার্থনা আছে। আমাকে যদি দয়া করে ডাক্তারি শেখান!
—তুমি ডাক্তারি শিখবে! তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন রঙলাল বাবু। অন্তর্ভেদী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, কপালে সারি সারি কুঞ্চনরেখা। বিস্ময়, প্রশ্ন অনেক কিছু তার মধ্যে ছিল। তারপর প্রশ্ন করেছিলেন, কবিরাজি ভাল চলছে না?
হেসে জীবন দত্ত বলেছিলেন, লেখাপড়াজানা বাবুদের সমাজে কবিরাজির চলন কম হয়েছে। বটে, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে ভাল চলে।
—তবে?
–আমার ছেলেবেলা থেকেই ডাক্তারি পড়বার ইচ্ছা ছিল কিন্তু–। জীবন দত্ত একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেছিলেন।
—তবে পড় নি কেন? তোমার বাবার তো অবস্থা ভাল ছিল।
জীবন দত্ত ম্লান হেসে বলেছিলেন—আমরা ভাগ্য মানি, তাই বলছি আমার ভাগ্য। আর কী বলব? নইলে বাল্যকাল থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল আমি ডাক্তারি পড়ব। কিন্তু–
—তোমার বাবা দেন নি পড়তে?
–আজ্ঞে না। অপরাধ আমার।
মঞ্জরীর কথাটা বাদ রেখে ভূপী বোসের সঙ্গে মারামারির কথা বলে বললেন– গ্রামে ফিরলাম-বাবা বললেন, আর না। আর তোমাকে বিদেশে পাঠিয়ে আমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারব না। কৌলিক বিদ্যায় তুমি দীক্ষা গ্রহণ কর।
কথাটা শুনে ন্যাড়া পাহাড়ের মত মানুষ রঙলাল ডাক্তার অকস্মাৎ হা-হা-হা শব্দে অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন কৌতুকে; যেন তৃণপাদপহীন কালো পাথরে গড়া পাহাড়টা এই কাহিনী শুনে কৌতুকে ফেটে গেল এবং ভিতর থেকে ঝরঝর শব্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বের হল ঝরনার ফোয়ারা। এমনভাবে রঙলাল ডাক্তারকে হাসতে বড় কেউ একটা দেখে নি।
বেশ খানিকক্ষণ হেসে বললেন– সেই ভূপী বোস ছেলেটার সুডৌল নাকটা এমন করে তুমিই ভেঙে দিয়েছ? আরে, তাকে যে আমি দেখেছি। চিকিৎসা করেছি। তার শ্বশুর নিজের বাড়িতে এনেছিল চিকিৎসা করাতে, সংশোধন করতে। অপরিমিত মদ্যপান করে লিভারের অসুখ। আমাকে ডেকেছিল। ছোকরার মাকাল ফলের মত টুকটুকে চেহারায় পোকাধরার কালো দাগের মত নাকে ওই খুঁত।
হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন রঙলালবাবু, বললেন–আমি কিন্তু সন্দেহ করেছিলাম, ওটা হয়েছে সিফিলিস থেকে। বড়লোকের ছেলেদুর্দান্ত মাতাল! সন্দেহ হওয়ারই কথা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম। কিছুতেই স্বীকার করে না। তারপর স্বীকার করলে। যা এ দেশের লোকের স্বভাব! উত্তেজিত হয়ে উঠলেন রঙলাল ডাক্তার হাতের চুরুটটা মুখ থেকে নামিয়ে বললেন– অদ্ভুত, এ দেশটাই অদ্ভুত! লজ্জায় রোগ লুকিয়ে রাখবে, বংশাবলীকে রোগগ্রস্ত করে যাবে! নিজে ভুগবে। কিছুতেই বুঝবে না তুই দেবতা নোস। তুই রক্তমাংসের মানুষ। ক্ষুধার দাস, ললাভের দাস, কামের দাস!
উঠে দাঁড়ালেন রঙলাল ডাক্তার, বললেন–সেই শুয়ারটা কী বলেছিল জান? বলেছিল, কী করে হল তা জানি না। আমার স্ত্রী ছাড়া আর কারও সংস্রবে তো আমি কখনও আসি নি। আমি আর থাকতে পারি নি। প্রচণ্ড এক চড় তুলে বলেছিলাম-মারব এক চড় উল্লুক
কিছুক্ষণ পায়চারি করে শান্ত হয়ে রঙলাল ডাক্তার এসে বসেছিলেন তার আসনে। চুরুট ধরিয়ে দুটো টান দিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ওটা তা হলে তোমার ওই মুরসদৃশ হস্তের মুষ্ট্যাঘাতের চিহ্ন? তুমি তো ভয়ানক লোক। তবে ভূপী বোসের বন্ধুর কাজ করেছ। ওই চিহ্ন থেকে ওর ওই পাপ রোগটাকে ধরার সুযোগ করে দিয়েছ।
তারপর রঙলাল ডাক্তার বলেছিলেন-হ্যাঁ, তোমাকে আমি শেখাব, যতটা পার নিয়ে নাও তুমি আমার কাছ থেকে। কী? কী ভাবছ তুমি?
সেদিন তখন জীবন দত্ত ভাবছিলেন—ভূপী বোসের কথা, মঞ্জরীর কথা। যতক্ষণ রঙলাল ভূপী বোসের কথা বলছিলেন জীবন দত্ত অবশ্য চিন্তাশক্তিহীন মানুষের মত তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। রঙলালবাবু তাকে ডাক্তারিবিদ্যা শিক্ষা দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে কথা শেষ করলেন, জীবন দত্ত তার উত্তরে কিন্তু প্রশ্ন করলেন—ভূপীর লিভারের দোষ হয়েছে? সেরেছে?
রঙলাল ডাক্তার তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভূপীর জন্যে যেন তোমার মমতা রয়েছে জীবন?
জীবন এবার সচেতন হয়ে উঠলেন; লজ্জিত হলেন।
রঙলাল বললেন– তোমরা তো বৈষ্ণব?
–হ্যাঁ।
—তাই। তারপর বললেন–ভূপীর অসুখ আপাতত সেরেছে। আবার হবে। ওটা বাঁচবে না বেশিদিন। ওতেই মরবে। যোগাযোগ যে ভারি বিচিত্র। ছোকরার স্ত্রী, এক ধরনের মা আছে দেখেছ, রোগা ছেলেকে খেতে দেয় লুকিয়ে, ঠিক সেই রকম! ডাক্তার বারণ করেছে, ভূপী মদের জন্য ছটফট করছে, স্ত্রী গোপনে লোককে বকশিশ দিয়ে মদ আনিয়ে স্বামীকে দিচ্ছে, বলে বেশি খেয়ো না, একটু খাও। আশ্চর্যের কথা হে, নিজের গহনা বিক্রি করে করছে। অদ্ভুত। পুরাণে আছে সতী স্ত্রী মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বামীকে বাঁচায়। আর এ মেয়েটা ভালবাসায় তো তাদের চেয়ে খাটো নয়, কিন্তু এ মৃত্যুকে ডেকে এনে স্বামীকে তার হাতে তুলে দেয়। অদ্ভুত।
এরপর স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন জীবন ডাক্তার। স্থান, কাল, পাত্র সব তিনি ভুলে গেলেন, মুছে গেল চোখের সম্মুখ থেকে। অর্থহীন একাকার হলে গেল। রঙলাল ডাক্তার সচেতন করে তুললেন জীবন দত্তকে। বললেন–ছেড়ে দাও ওই পচা ধনীর ছেলেটার কথা। ওসব হল মানুষের নিজের পাপের সৃষ্টির অপব্যয়। এখন শোন যা বলছি। শিখবে তুমি ডাক্তারি? আমার মত কঠিন নয় তোমার পক্ষে। তুমি চিকিৎসা জান—রোগ চেন। তোমার পক্ষে অনেক সহজ হবে। আমি এ দেশের জন্যে অনুবাদ করেছি ওদের চিকিৎসাশাস্ত্র। পড়ে ফেললেই তুমি পারবে। আমি তোমাকে সাহায্য করব। শেখাব। পড়াব।
এবার জীবন দত্তের কান এড়াল না। মুহূর্তে তাঁর সব উদাস অবসন্নতা দূর হয়ে গেল। আগুন জ্বলে উঠল জীবনে।
মঞ্জরী আর ভূপী বোস একদিন মেঘ আর বাতাসের মত মিলে তার জীবনের সদ্য প্ৰজ্বলিত। বহির উপর দুর্যোগের বর্ষণ ঢেলে নিভিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বনস্পতির কাণ্ড থেকে শাখাগ্র পর্যন্ত প্রসুপ্ত বহ্নির ধারা নেভে নি। সে জ্বলল। ভুলে গেলেন মঞ্জরীকে ভূপীকে। আতর-বউকেও মনে রইল না সে মুহূর্তে। সেদিন সামনে ছিলেন রঙলাল ডাক্তার। হাতে ছিল—মোটা বাঁধানো খাতা-চোখের সামনে ছিল ভবিষ্যৎ। উজ্জ্বল দীপ্ত।
১৪. উদয়লগ্ন
এরপর চার বৎসর-জীবন দত্তের জীবনের বোধ করি উদয়লগ্ন।
নতুন জন্মান্তর। অথবা নতুন জন্মলাভের তপস্যা।
রঙলাল ডাক্তার মধ্যে মধ্যে রহস্য করতেন। একবার বলেছিলেন—তাই তো হে জীবন, মনে বড় আক্ষেপ হচ্ছে। মনে হচ্ছে বিবাহ একটা করলাম না কেন?
এ ধরনের কথা হত রাত্রে। বারান্দায় বসে নিয়মিত পরিমাণ ব্রান্ডি খেতেন আর চুরুট টানতেন। জীবন দত্ত থাকে তার সঙ্গে গল্প করতেন, নইলে বই পড়তেন, কোনো কোনো দিন মনা হাড়িকে ডেকে তার সঙ্গেই গল্প করতেন। তিনি গল্প বলতেন না, গল্প বলত মনা, তিনি শুনতেন। ভূতের গল্প, তিনি শুনতেন আর মধ্যে মধ্যে অট্টহাস্যে ফেটে পড়তেন।
জীবন দত্তকে তার খাতাপত্র দিয়েছিলেন দত্ত সে-সবগুলি পড়তেন নিজের বাড়িতে, যথারীতি কবিরাজি পদ্ধতিতে চিকিৎসাও করে বেড়াতেন, দু-চার দিন অন্তর সকালের কাজ সেরে খাওয়াদাওয়া করে চলে যেতেন রঙলাল ডাক্তারের ওখানে। যা বুঝতে পারতেন না বুঝিয়ে। নিতেন। যে অংশটুকু পড়ছেন তাই বলে যেতেন, ডাক্তার শুনতেন। এই অবস্থাতেই কোনো কোনো দিন আসমৃত্যু রোগীর বাড়ির অবিলম্ব আহ্বান জানিয়ে ডাক আসত; ডাক্তার বিবরণ শুনে কোনোটাতে যেতেন না; যেটাতে যেতেন–জীবন দত্ত সঙ্গে যেতেন। গুরু যেতেন। পালকিতে, জীবন দত্ত যেতেন হেঁটে। সবল সুস্থ দেহ আটত্রিশ ইঞ্চি বুকের ছাতি, ওজনে। দু মনের ওপর, বিরাট মুগুরভাজা শক্ত শরীর-জীবন দত্ত জোয়ান হাতির মতই ভারী পা ফেলে সমানে বেহারাদের সঙ্গে চলে যেতেন।
কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই জীবন দেখলেন এ বিদ্যা আয়ত্ত করা তার বুঝি সাধ্যাতীত। তিনি পিছিয়ে গেলেন। গুরু-শিষ্যের মধ্যে গুরুর মনে বিরক্তির সুর বেজে উঠল। কদিন থেকেই রঙলাল ডাক্তার জীবন দত্তকে তাঁর সেই কাচের ঘরে মড়া কাটার জন্য বলছিলেন। জীবন দত্ত প্রথম দিন মড়া কেটেছিলেন কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ায় রাত্রে খাওয়ার পর বমি করে ফেলেছিলেন। তারপর দিন পাঁচেক আর গুরুগৃহের দিকে পা বাড়ান নাই। ছদিনের দিন ভেবেছিলেন—সেই পচা মড়াটা নিশ্চয় ডাক্তার ফেলে দিয়েছেন। সেদিন যাওয়া মাত্র তিরস্কার করেছিলেন গুরু। এবং মনাকে হুকুম করেছিলেন আর একটা নিয়ে আয় মনা।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মনা একটা বছর পাঁচেকের মেয়ের শব এনে হাজির করেছিল। এ অঞ্চলে হিন্দুরাও পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শব দাহ করে না, মাটিতে পুঁতে দেয়। সেদিন জীবন দত্ত হাতজোড় করে বলেছিলেন-ও আমি পারব না। ওই শিশুর দেহের উপরঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলেন তিনি। বলেছিলেন বিশ্বাস করুন, আমার মেয়েটা ঠিক এমনি দেখতে। ঠিক এমনি। এমনি চুল, এমিন গড়ন!
রঙলাল ডাক্তার তার দিকে যে চোখ তুলেছিলেন সে চোখ উগ্রতায় বিস্ফারিত। কিন্তু দেখতে দেখতে কোমল হয়ে এসেছিল। বলেছিলেন আচ্ছা থাক। তুমি বাঙলোয় গিয়ে বোসো—এটাকে আমি ডিসেকশন করে যাই। মনে হচ্ছে—অত্যন্ত হঠাৎ মৃত্যু হয়েছে। রোগের কোনো চিহ্ন নেই।
সত্যই মেয়েটি দেখতে অনেকটা জীবন ডাক্তারের প্রথম সন্তান সুষমার মত। আতরবউয়ের তখন দুটি সন্তান হয়েছে, বড়টি মেয়ে সুষমা, তারপর ছেলে বনবিহারী।
জীবন দত্ত কাচের ঘর থেকে বেরিয়ে আর অপেক্ষা করেন নাই, বাড়ি চলে এসেছিলেন। গুরুর মনে বিরক্তির সুর বেজে উঠেছিল এই কারণে।
কয়েক দিন পর জীবন দত্ত যেতেই গুরু সেই কথাই বলেছিলেন, বোসো। কয়েকটি কথা বলব তোমাকে। জীবন শঙ্কিত হয়ে বসে ছিলেন। ডাক্তার চুরুট টেনে চলেছিলেন। কিছুক্ষণ পর চুরুটটা নামিয়ে রেখে বলেছিলেন–জীবন, তোমাকে যেমনটি গড়ে তুলব ভেবেছিলাম তা হল না। তোমার মধ্যে সে শক্তি নাই। তা ছাড়া ইংরেজি ভাল না জানলে এ শাস্ত্রে গভীর ব্যুৎপত্তি লাভও অসম্ভব। ভেবেছিলাম-আমি তোমার সে অভাব পূরণ করে দেব। কিন্তু সেও দেখছি সহজ নয়। আমার বিরক্তি লাগে এবং তোমার পক্ষেও এ বিদ্যার শিক্ষা-পদ্ধতির একটা বড় অংশ অত্যন্ত অরুচিকর। সে অরুচি কাটানো তোমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
ডাক্তার চুপ করে গেলেন।
আবার বলেছিলেন—তোমার বাবা তোমার ধাতুকে পুড়িয়ে পিটিয়ে শক্ত করে গড়ে গিয়েছেন—তাকে নতুন করে না গালিয়ে আর নতুন কিছু করা যাবে না। তলোয়ার আর খঙ্গ দুটোই অস্ত্ৰ, কিন্তু প্রভেদ আছে। তলোয়ার দিয়ে মহিষ বলি হয় না, আর খাড়া দিয়ে এ যুগের যুদ্ধ হয় না। বুঝেছ?
ঠিক এই মুহূর্তেই এল একটি ডাক। এ অঞ্চলের একটি নামকরা বাড়ি থেকে ডাক। বাড়িটির সঙ্গে রঙলাল ডাক্তারের প্রথম চিকিৎসার কাল থেকেই কারবার চলে আসছে। তারও চেয়ে যেন কিছু বেশি। একটি প্রীতির সম্পর্কও বোধ করি আছে। এ দেশের সাধারণ মানুষ সম্পর্কে রঙলাল ডাক্তারের একটা অবজ্ঞা আছে। কিন্তু এ বাড়ি সম্পর্কে ঠিক অবজ্ঞা নাই। বাড়ির গৃহিণীর কঠিন অসুখ। মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে রোগ মারাত্মক হয়ে উঠেছে। মহিলাটি আগে। থেকেই অম্বলের ব্যাধির রোগিণী। তিনি আজই ঘণ্টা দুয়েক আগে পায়ে হোঁচট লেগে বাড়ির উঠানে পড়ে গিয়েছিলেন। তারপর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই এই অবস্থা। ধনুকের মত বেঁকে যাচ্ছেন। নিষ্ঠুর যন্ত্রণা। কথাও প্রায় বলতে পারছেন না। চোয়াল পড়ে গিয়েছে।
রঙলাল ডাক্তার বিস্মিত হলেন, কতক্ষণ আগে পড়ে গেছেন বলছ?
–এই ঘণ্টা দুয়েক।
–মাত্র দু ঘণ্টা?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
–তাই তো। এত শিগগির? মনা, বেহারাদের ডাক।
জীবন ডাক্তারও নীরবে গুরুর অনুসরণ করছিলেন।
রঙলাল ডাক্তার প্রথমটা লক্ষ্য করেন নাই; মধ্যপথে জীবনকে দেখেছিলেন, বলেছিলেন, তুমিও আসছ? এটা বোধহয় ইচ্ছা ছিল না তার। সম্পর্ক চুকিয়ে দেওয়ার জন্যই কথা শুরু করেছিলেন। কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই এই ডাকটি এসে পড়েছিল।
আজও স্পষ্ট মনে পড়ছে সে ছবি।
বর্ধিষ্ণু ঘর, রাঢ় অঞ্চলের মনোরম মাটির কোঠা অর্থাৎ দোতলা, প্রশস্ত, পাকা মেঝে, চুনকাম করা দেয়াল। উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল—সে আমলের শৌখিন শেড-দেওয়া চব্বিশবাতি টেবিলল্যাম্প।
অনেকগুলি লোক আত্মীয়স্বজন–দূরে বসে রয়েছে।
একটি বিছানায় রোগিণী ছিলায়-টান-দেওয়া ধনুকের মত বাঁকা অবস্থায় পড়ে আছেন। এর ওপরেও কেউ যেন টান দিচ্ছে; অদৃশ্য কেউ যেন মেরুদণ্ডে হটু লাগিয়ে সবল বাহুর আকর্ষণে টঙ্কার দিয়ে টানছে। রোগিণীর ওষ্ঠাধর দৃঢ়বদ্ধ। চোয়াল পড়ে গিয়েছিল এ কথা সত্য, কিন্তু তবু জীবন দত্ত বুঝতে পারলেন—অপরিসীম ধৈর্যের সঙ্গে ওই ক্ষীণকায়া মেয়েটি এই মর্মান্তিক যন্ত্ৰণা সহ্য করে চলেছেন। শুধু ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে যন্ত্রণার পরিচয় বেরিয়ে আসছে। তার সঙ্গে একটু শব্দ। সেইটুকুকে আর চাপতে পারছেন না ভদ্রমহিলা।
রঙলাল ডাক্তারও স্থির দৃষ্টিতে রাগিণীকে দেখছিলেন। বোধহয় পাঁচ মিনিট পর বললেন– আজই হোঁচট লেগে দু ঘণ্টার মধ্যে এমন হয়েছে?
–হ্যাঁ, দু ঘণ্টাও ঠিক হবে না।
ভ্রূ কুঁচকে উঠল রঙলাল ডাক্তারের-কই কোথায় হোঁচট লেগেছে? রক্ত পড়েছে?
–ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে। রক্তপাত হয় নি।
রঙলাল ডাক্তার পায়ের বুড়ো আঙুলে হাত দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ঘরখানাই যেন শিউরে উঠল; নিষ্ঠুরতম যন্ত্রণায় রোগিণী ভাষাহীন একটা অবরুদ্ধ আর্তনাদ করে উঠলেন। জীবন তখনও অবাক বিস্ময়ে রোগিণীকে দেখছিলেন-কী অপরিসীম ধৈর্য! চোখের দৃষ্টিতে সে যন্ত্রণার পরিচয় ফুটে উঠেছে। চোয়াল পড়ে গেছে, কণ্ঠ দিয়ে আৰ্তস্বর বের হচ্ছে, তাকে প্রাণপণে সংযত করবার চেষ্টা করছেন তিনি। এত যন্ত্রণাতেও জ্ঞান পূর্ণমাত্রায় রয়েছে।
ক্ষত কোথাও হয় নি, রক্তপাতের চিহ্ন নাই; বেঁকে যাচ্ছেন অসহ্য যন্ত্রণায়; শুধু তাই নয়–শরীরের কোনো স্থানে পাখির পালকের স্পর্শেও অসহ্য যন্ত্রণায় থরথর করে কেঁপে উঠছেন। কণ্ঠ দিয়ে অবাধ্য আৰ্তম্বর বের হচ্ছে।
নাড়ি দেখলেন রঙলাল। রোগিণী আবার যন্ত্রণাকাতর অস্ফুট শব্দ করে উঠলেন। স্নায়ু শিরাগুলি এমনই কঠিন টানটান হয়ে উঠেছে যে, সামান্য স্পর্শেই ছিঁড়ে যাবার মত যন্ত্রণায় অধীর করে তুলছে।
রঙলাল ডাক্তার ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন। গম্ভীর মুখে বললেন–দেখ তো জীবন, তোমার নাড়িজ্ঞানে তুমি কী পাচ্ছ?
সরে দাঁড়ালেন তিনি।
সন্তৰ্পণে এসে বসলেন জীবন দত্ত। আশঙ্কায় একবার বুকটা কেঁপে উঠল। শুক্রাচার্যের তুল্য। রঙলাল ডাক্তার, তার কাছে আজ পরীক্ষা দিতে হবে। নাড়ি অনুভবের অবকাশ তিনি পান নাই। যেটুকু পেয়েছেন তার মধ্যে নাড়ির স্পন্দন আছে কি নাই তাও বুঝতে পারেন নাই। রঙলাল ডাক্তার রোগীর মণিবন্ধ মোটা আঙুলে টিপে ধরে নাড়ি পরীক্ষা করেন। স্পন্দনের সংখ্যা গুনে দেখেন। মধ্যে মধ্যে তাতে ছেদ পড়ছে কি না দেখেন। এর বেশি কিছু না। বেশি কিছু বুঝতে চেষ্টা করেন না।
রোগিণীর হাতখানি বিছানার উপরে যেমনভাবে ছিল—তেমনিভাবেই রইল; জীবন দত্ত শুধু মণিবন্ধের উপর আঙুলের স্পর্শ স্থাপন করলেন। চোখ বন্ধ করে পারিপার্শ্বিকের ওপর যবনিকা টেনে দিলেন। প্রায়-রিক্ত-পত্ৰ অশ্বত্থ গাছের একটি সরু ডালে একটিমাত্র পাতা, অতি ক্ষীণ বাতাসের প্রবাহে দৃষ্টির অগোচর কম্পনে কাঁপছে; সেই কম্পন অনুভব করতে হবে; অথচ। অসতর্ক রূঢ় স্পর্শ হলেই পাতাটি ভেঙে ঝরে যাবে। অতিসূক্ষ্ম স্পর্শানুভূতিকে প্ৰবুদ্ধ করে তিনি বসলেন। ধ্যানস্থ হওয়ার মত।
তাঁর বাবা বলতেন—শক্তির ধর্মই হল ব্যবহারে সে সূক্ষ্ম এবং তীক্ষ্ণ হয়। অনুভূতি হল পরম সূক্ষ্ম শক্তি। আবার স্কুল করলে সে গদা হয়ে ওঠে।
ক্ষীণ ও অতি ক্ষীণ স্পন্দন তিনি অনুভব করলেন। কখনও কখনও যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
কানে এল রঙলাল ডাক্তারের কণ্ঠস্বর–পাচ্ছ?
অতি সন্তৰ্পণে ঘাড় নেড়ে জীবন দত্ত জানালেন–পাচ্ছি। যেন ঘাড় নাড়ার সঙ্গে হাত না। নড়ে ওঠে। দেহ-চাঞ্চল্যে মনের সূক্ষ্ম কোনো কম্পন-তরঙ্গের আঘাত না লাগে।
–কিছু বুঝতে পারছ? দেখ, ভাল করে দেখ!
জীবন এবার কোনো ইঙ্গিত জানালেন না। তিনি ধ্যানযোগকে গভীর এবং গাঢ় করে তুলতে চেষ্টা করলেন। জ্ঞান ও বুদ্ধির প্রদীপের শিখাকে উজ্জ্বলতর করে তুলে ধরে রোগের অন্তরাত্মাকে প্রত্যক্ষ করতে হবে।
কতক্ষণ অনুভব করেছিলেন নাড়ি তার নিজের ঠিক হিসাব ছিল না।
অনুভব করলেন নাড়ি যত ক্ষীণই হয়ে থাক এ নাড়ি অসাধ্য নয়। উচ্চ স্থান থেকে পড়ে গেলে বা ভগ্ন অস্থি সংযোজনকালে, অতিসারে, অজীর্ণ রোগে, বাতরোগে এমন হয়। কিন্তু অসাধ্য নয়। এখানে দুটি কারণ একসঙ্গে জুটেছে। অকস্মাৎ একটা নদীর বন্যার সঙ্গে আর একটা নদীর জল মিশে দেহখানাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। অজীর্ণ রোগে জীৰ্ণদেহে পড়ে যাওয়ার আঘাতের ফলে এমন হয়েছে। আঘাতটা শুধু হেতু হয়েছে, এখন প্রয়োজন কুপিত বায়ুর প্রভাবে শরীরের স্নায়ু-শিরাগুলির সংকোচন দূর করা।
–কী দেখলে? রঙলাল ডাক্তার প্রশ্ন করলেন এবং ব্যগ্রতার সঙ্গেই করলেন।
–আজ্ঞে? সবিনয়েই জীবন বলেছিলেন নাড়ি দেখে তো একেবারে অসাধ্য মনে হচ্ছে না। তিনি নিজের নির্ণয়ের কথা বলে বলেছিলেন ধনুষ্টঙ্কার নয়।
রঙলাল ডাক্তার ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলেছিলেন-হাঁ, টিটেনাস তো নয়ই এবং তুমি যা বলছ তাই খুব সম্ভব ঠিক। তুমি বলছ অসাধ্য নয়। জীবনের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন কিন্তু সাধ্য হবে কী করে? চোয়াল পড়ে গেছে—ওষুধ যাবে না। শরীরের কোথাও হাত দেবার উপায় নেই, মালিশ করা যাবে না। সাধ্য হবে কিসে?
ঘাড় নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে এলেন রঙলাল ডাক্তার।
বাইরে একান্তে জীবন বলেছিল—আপনি ওষুধ দিন, চামচ বা ঝিনুকে করে ফোঁটা ফোঁটা। করে মুখে দেওয়া হোক। আর—আপনি অনুমতি করলে আমি একটা মুষ্টিযোগের ব্যবস্থা করি। তাতে ওই বায়ুপ্রকোপের প্রভাব ধীরে ধীরে কমে আসবে। স্নায়ু শিরার টানভাবটা কমে আসবে। চোয়ালও খুলবে বোধহয়।
—মুষ্টিযোগ?
—আমাদের বংশের সংগ্রহ করা মুষ্টিযোগ। আমার পিতামহ পেয়েছিলেন এক সন্ন্যাসী চিকিৎসকের কাছে। তালগাছের কচি মাজপাতা, যা এখনও বাইরের আলোবাতাস পায় নি, তাই গরম জলে সিদ্ধ করে সেই জলের ভাপ–
দিতে পার, দেখতে পার। আমার কাছে ও মরার শামিল। রোগীর আত্মীয়দের বলেছিলেন–ওষুধ দিয়ে যাচ্ছি। জীবন রইল। আশা আমি করছি না। জীবন আশা ছাড়ে নি; ও দেখুক। এ অবস্থা যদি কাটে, চোয়ালটা ছাড়ে—আমাকে খবর দিয়ে। জীবন একটা মুষ্টিযোগ দেবে। ঠিকমত সব হয় যেন। বুঝলে?
সমস্ত রাত্রি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন জীবন ডাক্তার।
গরম জলের ভাপ দেওয়ার তত্ত্বাবধান করলেন। রাত্রি বারটার পর অসহনীয় যন্ত্রণা কমল। জীবন নাড়ি দেখলেন। মুখ প্রফুল্ল হল। প্রশ্ন করলেন এবার একটু দেখুন তো গায়ে সেক নিতে পারেন কি না?
নিজেই জল-নিঙড়ানো গরম কাপড়ের টুকরোটা সন্তৰ্পণে রোগিণীর হাতের উপর রাখলেন। লক্ষ্য করলেন–দেহে কম্পন ওঠে কি না। উঠল না। প্রশ্ন করলেন—পারবেন সহ্য করতে? কষ্ট হবে জানি, কিন্তু সহ্য করতে হবে।
অসাধারণ রোগিণী। মূর্তিমতী ধরিত্রীর মত সহনশক্তি। সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন তিনি। উৎসাহিত হলেন জীবন। নিজেই বসলেন সেঁক দিতে। ওষুধ চলছিল ফোঁটা ফোটা। ঘণ্টাখানেক পরে রোগিণীর অবস্থা লক্ষ্য করে বললেন–একটু বেশি বেশি দিয়ে দেখুন তো! মুখে ফোঁটা ফোটা ওষুধ দিচ্ছিলেন আর একটি মহিলা। নীরবে চলছিল জীবন-মৃত্যুর যুদ্ধ।
ক্রমে রাত্রি তৃতীয় প্রহর শেষ হল। জীবন ডাক্তার এবার লক্ষ্য করলেন প্রচণ্ড শক্তিতে গুণ দিয়ে বাঁকানো ধনুকের দণ্ডের মত দেহখানি ধীরে ধীরে সোজা হচ্ছে, সন্তৰ্পণে সভয়ে রোগিণী সোজা হতে চাচ্ছেন, যেন ধীরে ধীরে গুণ শিথিল করে দিচ্ছে কেউ।
জীবন মৃদুস্বরে বলল—দেখুন তো মা, হাঁ করতে পারেন কি না?
পারলেন, স্বল্প হলেও তার মধ্যে জিহ্বা সঞ্চালিত করবার স্থান পেলেন, চাপা উচ্চারণে। বললেন–পারছি।
এবার পূর্ণ এক দাগ ওষুধ খাইয়ে সেঁকের ভার রোগিণীর ছেলের উপর দিয়ে বললেন– বাইরের বারান্দায় আমার বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিন। একটু বিশ্রাম করব। আমার বিশ্বাস সূর্য উদয় হলেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন উনি আর ভয় নাই।
প্রায় নিশ্চিন্ত হয়েই বললেন– জীবন দত্ত। বায়ুর কাল চলে গিয়েছে; এবার কাল হয়েছে। অনুকূল। ঝড় থেমেছে; অনুকূল মৃদু বাতাসে নৌকার মতই জীবনতরী এবার পৃথিবীর কূলে এসে। ভিড়বে।
তাই হয়েছিল। সেদিনের আনন্দ তাঁর জীবনের শ্ৰেষ্ঠ আনন্দ।
গুরু রঙলাল ডাক্তারকে বিস্মিত করতে পেরেছিলেন তিনি।
বেলা তখন আটটা। রঙলাল ডাক্তার রোগী দেখছিলেন। এ সময় তিনি ফিজ নিতেন না। রোগী দেখতে দেখতেই তিনি উৎসুক দৃষ্টিতে জীবনের দিকে তাকালেন।
কান থেকে স্টেথোসকোপটা খুলে প্রশ্ন করলেন, বাঁচাতে পেরেছ?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। বিপদটা আপাতত কেটে গিয়েছে।
–বাঃ! আজ এইখানে থাক। বিশ্রাম কর। দুপুরবেলা নিজে রোগিণীকে দেখে এসে খুশি হয়ে বলেছিলেন, এর ক্রেডিট বার আনা তোমার জীবন। আমার ওষুধে কিছু ছিল না। যা ছিল তার পাওনা সিকির বেশি নয়। মেয়েটির এখন কলিকের চিকিৎসার প্রয়োজন। আমি বলেছি কবরেজি মতে চিকিৎসা করাতে। তুমি ব্যবস্থা কর।
সেইদিন রঙলাল ডাক্তার রাত্রে ব্রান্ডির রঙিন আমেজের মধ্যে মৃদু হেসে ওই কথাটা বলেছিলেন। বলেছিলেন, আক্ষেপ হচ্ছে হে জীবন—একটা বিয়ে করি নি কেন? তারপর হো-হো করে হেসে উঠেছিলেন।
হাসি থামিয়ে আবার বলেছিলেন–কেন বললাম জান? স্নে
স্নেহে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন জীবন। অভিভূত ভাবেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন-আজ্ঞে?
—তুমি আমাকে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের সঙ্গে তুলনা কর সেটা আমি শুনেছি। আমি তাতে রাগ করি না। শুক্রাচার্য বিরাট পুরুষ। হোক এক চোখ কানা। হাসতে লাগলেন আবার। তারপর বললেন– আজ আমার ইচ্ছে হচ্ছে তোমাকে কচের সঙ্গে তুলনা করতে।
হা-হা করে হাসতে লাগলেন—বিয়ে করলে একটা দেবযানী পেতাম হে।
১৫. আরও এক বৎসর পর
আরও এক বৎসর পর রঙলাল ডাক্তার তাঁকে বিদায় দিলেন।
হঠাৎ চিকিৎসা ছেড়ে দিলেন। বললেন–আর না। এইবার শুধু পড়ব আর ভাবব। জীবন এবং মৃত্যু। লাইফ অ্যান্ড ডেথ, তার পিছনের সেই প্রচণ্ড শক্তি—তাকে ধারণা করবার চেষ্টা করব। আর দেশী গাছ-গাছড়া নিয়ে একখানা বই লিখব।
জীবনকে বলেছিলেন—তোমার ডাক্তারি শেখাটা বোধহয় ঠিক হল না জীবন। ওইসব বিচিত্র অবিশ্বাস্য মুষ্টিযোগ নিয়ে যদি গবেষণা করতে পারতে! কিন্তু তাও ঠিক পারতে না তুমি। তোমার সে বৈজ্ঞানিক মন নয়। কার্য হলেই তোমার মন খুশি। কেন হল—সে অনুসন্ধিৎসা তোমার মনে নাই। যাক। তুমি বরং ডাক্তারি, কবিরাজি, মুষ্টিযোগ তিনটে নিয়েই তোমার ট্রাইসাইকেল তৈরি কর। ওতে চড়েই যাত্রা শুরু কর। নিজের একটা স্টেথোেসকোপ তিনি তাঁকে দিয়েছিলেন, থারমোমিটার দেন নি, কিনতেও বারণ করেছিলেন। বলেছিলেনওর দরকার নেই তোমার।
এর পরও জীবন দত্ত মধ্যে মধ্যে যেতেন। রঙলাল ডাক্তার দেখা করতেন, কিন্তু চিকিৎসা সম্পর্কে কোনো আলোচনা করতেন না। প্রশ্ন করলে বলতেন-ভুলে গিয়েছি। এখন বাগান করছি, গাছ-গাছড়ার সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন থাকলে কর।
আসল উদ্দেশ্য ফুলের বাগান নয়, রঙলাল ডাক্তার নিজের সমাধিক্ষেত্র তৈরি করছিলেন। ওইখানেই তাকে মৃত্যুর পর সমাধিস্থ করা হয়েছে। তাঁর ইচ্ছানুসারেই হয়েছে। তিনি উইল করে গিয়েছিলেন। সেই উইলে তিনি লিখেছিলেন—তাকে যেন সমাধি দেওয়া হয় এই বাগানের মধ্যে।
একা ঘরের মধ্যে মরেছিলেন। মৃত্যুকালে ঘরের মধ্যে কাছে কেউ ছিল না। সেও তার অভিপ্রায় অনুসারে। মনা হাঁড়ি ছিল দরজায় পাহারা। মনা অঝেরঝরে কেঁদেছিল কিন্তু ঘরে কাউকে ঢুকতে দেয় নি। বলেছিল—সে পারব না। বাবার হুকুম নাই।
ওই রঙলাল ডাক্তারের দেওয়া স্টেথোসকোপ নিয়ে তিনি অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা শুরু করলেন। কবিরাজি ত্যাগ করলেন না। মুষ্টিযোগও রইল। সেইবারই দত্ত মশায়দের চিকিৎসালয়ের নামকরণ করলেন—আরোগ্য-নিকেতন।
নবগ্রামে তখন হরিশ ডাক্তার খুলেছে হরিশ ফার্মেসি।
ধনী ব্রজলালবাবু দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করে নাম দিয়েছে—পিয়ারসন চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি।
হোমিওপ্যাথ এসেছে একজন। পাগল ছিল লোকটা, নাম বলতকে. এম. ব্রারোরী অর্থাৎ ক্ষেত্রমোহন বাড়ুরী। তার ডিসপেনসারির নাম ছিল—ব্রারোরী হোমিও হল।
জীবন দত্ত কলকাতায় অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ কিনতে গিয়ে ওই সাইনবোর্ডটা লিখিয়ে এনেছিলেন।–আরোগ্য-নিকেতন।
ওঃ-উদ্যোগপর্বে আতর-বউয়ের সে কী রাগ।
অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ, আলমারি এবং সরঞ্জামপাতি কিনবার জন্য পাঁচশো টাকায় পাঁচ বিঘে জমি বিক্রি করেছিলেন তিনি। রাগ ক্ষোভ তার সেই উপলক্ষ করে, নইলে ওটা ভিতরে ভিতরে জমাই ছিল।
ক্ষোভের দোষ ছিল না। জগৎ মশায়ের আমল থেকে তার আমল পর্যন্ত তখন লোকের কাছে ওষুধের দাম পাওনা তিন-চার হাজার টাকারও বেশি। সচ্ছল অবস্থার লোকের কাছেই পাওনা বেশি। কিন্তু তার মধ্যে এই প্রয়োজনে শতখানেক টাকার বেশি আদায় হল না।
এর জন্য ক্ষোভ তার নিজেরও হয়েছিল। কিন্তু আতর-বউয়ের ক্ষোভ স্বতন্ত্র বস্তু। সে ক্ষোভ তার ওপর এবং সে ক্ষোভ ক্ষমাহীন; আতর-বউয়ের বাহ্যিক ক্ষোভের আপাত উপলক্ষ যাই হোক, ক্ষোভ প্রকাশ হলেই মুহূর্তে মূল কারণ বেরিয়ে পড়ে; সেটা হল তার বিরুদ্ধে একটা
অনির্বাণ চিতার মত অসন্তোষের বহ্নিদাহ!।
তখন ওই জমি বিক্রির উপলক্ষ নিয়ে তার মনের আগুন জ্বলেছিল। মনে পড়ছে, পাওনা টাকা আদায় করতে গিয়েটাকা পাওনা দূরে থাক কটুকথা শুনে তখন তাঁর নিজের মনেও ক্ষোভ জমেছিল। ওষুধের বাকির প্রসঙ্গে লোকে বলেছিল-পঞ্চাশ টাকা? ওষুধের দাম? কী ওষুধ হে? সোনাভস্ম না মুক্তাভস্ম না মানিকভকী দিয়েছিলে? পঞ্চাশ টাকা? গাছ-গাছড়া আর গিয়ে এটা-ওটা টুকিটাকি-আর তো তোমার রসসিন্দুর—এর দাম পঞ্চাশ টাকা? যা ইচ্ছে তাই খাতায় লিখে রেখেছ? হরি-হরি-হরি!
এ নিয়ে আর বাদপ্রতিবাদ করেন নি জীবন ডাক্তার। ক্ষুব্ধ হয়ে ফিরে এসেছিলেন। এবং ফেরবার পথেই সাহাদের শিবু সাহাকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। ডাক্তারখানা তিনি করবেনই। বুকের ভিতর তখন অনেক আশা। অনেক আকাঙ্ক্ষা। রঙলাল ডাক্তারের স্থান তিনি পূর্ণ করবেন। তিনি যাবেন—রোগীর বাড়িতে আশার প্রসন্নতা ফুটে উঠবে। তিনি নাড়ি ধরবেন—রোগীর দেহে রোগ সচকিত হয়ে উঠবে। নবগ্রামের অহঙ্কারী জমিদার-সমাজ সমে বিনত হবে। শুধু নবগ্রাম কেন? সারা অঞ্চলের ধনী-সমাজ জমিদার-সমাজ বিনত হবে। বড় ঘোড়া কিনবেন। সাদা ঘোড়া। পালকিও রাখবেন একখানা। বেশি দূরের পথে যাবেন পালকিতে। এ অঞ্চল বলতে সীমানা তো কম নয়—পূর্বে গঙ্গার ধার পর্যন্ত কান্দী পাথুপি। এ দিকে অজয়ের ধার পর্যন্ত। কান্দী গেলে ভূপীর সঙ্গে দেখা করে আসবেন। চিকিৎসা করে তাকে সারিয়ে তুলবার নতুন আকাঙ্ক্ষা হয়েছে তাঁর। জীবনের তখন অনেক আশা। ছেলে বনবিহারীর বয়স মাত্র বছর তিনেক। তাকে ডাক্তারি পড়াবেন। বড় ডাক্তার করে তুলবেন। মেডিকেল কলেজ থেকে এল. এম. এস. পাস করে আসবে সে।
আজ যারা অবজ্ঞা করে তার পাওনা টাকা দিলে না, উপরন্তু ইঙ্গিতে অসাধুতার অপবাদ দিলে, তারাই তাঁর কাছে আসবে বিপদের দিনে। সে দিন তিনি তাদের! না–ফিরিয়ে দেবেন না, কটু বলবেন না। যাবেন। তার বংশের নাম হয়েছে মশায়ের বংশ-বংশের মহাশয়ত্ব ক্ষুণ্ণ করবেন না।
তিনিই পথেই দামদর করে জমি বিক্রির কথাবার্তা পাকা করে বাড়িতে এসে বললেন, তুমি বোসো শিবু। আমি দুটো মুখে দিয়ে নি। তারপর বের হব। কাগজ কিনে লেখাপড়া শেষ করে বাড়ি ফিরব। রেজিস্ট্রির সময় তো তিন মাস।
শিবু বলেছিল—দেখুন দেখি, লেখাপড়াই বা তাড়া কিসের গো? আপনি মশায়ের বংশের সন্তান, আজ আপনিই মশাই। আমি টাকা এনে গুনে দিয়ে যাচ্ছিলেখাপড়া রেজেষ্ট্রি হবে পরে।
শিবু পাঁচশো টাকা এনে দিয়ে গিয়েছিল সেই দিনই সন্ধ্যাবেলা।
ওদিকে বাড়িতে তখন আতর-বউ আগুন ছড়াতে শুরু করেছেন। অদৃষ্ট! অদৃষ্ট! সবই অদৃষ্ট! মা খেয়েছি, বাপ খেয়েছি, সারা বালিকা বয়সে মামা-মামির বাঁদীগিরি করেছি বিনা মাইনেতে। শ্বশুরবাড়িতে শাশুড়ি খেলাম, শ্বশুর খেলাম। এইবার লক্ষ্মী বিদেয় হবেন তার আর আশ্চর্য কী? আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি—মেয়ে হয়েছে ছেলে হয়েছে ওদের হাত ধরে ভিক্ষে করতে হবে আমাকে। পথে বসতে হবে।
জীবন দত্তের মাথার মধ্যেও আগুন জ্বলে উঠেছিল। তবু সে আগুনকে কঠিন সংযমে চাপা দিয়ে তিনি বলেছিলেন–ছি আতর-বউ! ছি!
–কেন? ছি কেন? আমার অদৃষ্ট তো এই বটে। কোনখানটা মিথ্যে বল? শ্বশুর দেহ রাখবার আগের মাসেও এ বাড়িতে জমি এসে ঢুকেছে। আজ সবে চার বছর তিনি গিয়েছেন এরই মধ্যে জমি বেরিয়ে গেল।
—এই বছর যেতে-না-যেতে আমি পাঁচ বিঘের জায়গায় দশ বিঘে কিনব।–
–তা আর কিনবে না? কত বড় ডাক্তার হয়ে এলে, একেবারে বিলাতি পাস সায়েব ডাক্তার।
এবার আর সহ্য করতে পারেন নি জীবন ডাক্তার। কঠিন কণ্ঠে বলেছিলেন-আতর-বউ!
চমকে উঠেছিলেন আতর-বউ সে ডাকে। কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর শুরু করেছিলেন কান্না। জীবন ডাক্তার সে কান্না গ্রাহ্য করেন নি। কাঁদতেই ওঁর জন্ম। ওই ওঁর বোধ করি প্রাক্তন। কাদুন উনি। তিনি কী করবেন?
সেই রাত্রেই তিনি কলকাতা রওনা হয়েছিলেন।
কলকাতা থেকে ওষুধ-আলমারি কিনে এনে ওই সাইনবোর্ডটা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন–আরোগ্য-নিকেতন।
সেতাব মুখুজ্জে এনে দিয়েছিল একটি গণেশ-মূর্তি।
সুরেন সিন্দূর দিয়ে তার নিচে লিখেছিল—শ্ৰীশ্ৰীগণেশায় নমঃ।
পাগলা নেপাল তাঁকে একখানা সে-আমলের বাঁধানো নোটবুক এনে দিয়েছিল। নেপাল তখন কাজ করত নবগ্রামের ধনী ব্রজলালবাবুর বাড়িতে। ব্রজলালবাবুর জামাই ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার; তার সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল নেপালের। খাতাখানা সে তার কাছ থেকে সংগ্রহ করে এনে দিয়ে বলেছিলনে, রঙলাল ডাক্তারের মত নোট করে রাখবি। আরও এসেছিল সেদিন স্থানীয়। ডাক্তারেরা। কৃষ্ণলালবাবুর বাড়ির ডাক্তার হরিশ ডাক্তার এসেছিল; এখানকার স্কুলের হেডমাস্টার এসেছিল। এসেছিল থানার দারোগা।
আর এসেছিল শশীকে নিয়ে শশীর পিসিমা।
–বাবা জীবন!
–আপনি? কী হয়েছে? জীবন দত্ত ভেবেছিলেন শশীরই কোনো অসুখ হয়েছে।
–বাবা, শশীর বড় ইচ্ছে, খানিক-আধেক চিকিৎসা শেখে। লেখাপড়া তো হল না। একটু-আধটু শিখিয়ে দিলে করে-কৰ্ম্মে খাবে।
শশী তখন নিতান্ত কচি। কত বয়স হবে? সতের-আঠার বছর। একটু পাগলাটে ভাব। ওই নেপালের মত। ফিকফিক করে হাসত।
ওঃ–সে এক মনোহর রাত্রি। খাওয়াদাওয়া, খেলাধুলা, গান-বাজনা। এরই মধ্যে পাগল নেপাল এক কাণ্ড করেছিল। ওষুধের সঙ্গে কয়েক বোতল গোলাপজল ছিল। নেপাল লুকিয়ে গোলাপজল মাখতে গিয়ে তাড়াতাড়িতে মাথায় দিয়েছিল ফ্রেঞ্চ বার্নিশ! আসবাবে দেবার জন্য জীবন দত্ত ওটা এনেছিলেন। তারপর সে এক কাণ্ড! মাথার চুলগুলিতে গালা জমে নেপালের আর দুর্গতির সীমা ছিল না। সে কী হাসি সকলের! শশী হেসেছিল সবচেয়ে বেশি। নিতান্ত তরুণ বয়স, তার ওপর সেদিন সে জীবন মশায়ের মনস্তুষ্টির জন্যে ছিল অতিমাত্রায় ব্যস্ত।
***
সেই শশী বিরক্তি প্রকাশ করে গেছে, তার নিদান হকার ভগ্নঃ কটু কথা বলে গেছে!–একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন বৃদ্ধ।
—মশায়! কে যেন ডাকলে।
বৃদ্ধ জীবন দত্ত চকিত হয়ে ফিরে তাকালেন। অন্ধকারের মধ্যেই তো বসে ছিলেন তিনি–হঠাৎ একটা আলোর ছটা এসে পড়েছে। কে তাঁকে ডাকছে। ওঃ, তিনি একেবারে যেন ড়ুবে গিয়েছিলেন অতীতকালের স্মৃতিতে। এতক্ষণে বর্তমানে ফিরে এলেন। হা—লোক এসেছে; তাঁকে ডাকছে। লোকটার হাতের আলোটা নিচের দিকে আলো ফেলেছে। উপরের দিকটায় হারিকেনের মাথার ঢাকনির ছায়া পড়েছে।
—কে? প্রশ্ন করলেন জীবন দত্ত। পরক্ষণেই মনে হল সম্ভবত রতনবাবুর বাড়ির লোক। বিপিনের অসুখ হয়ত বেড়ে উঠে থাকবে।
না। রতনবাবুর বাড়ির লোক তো নয়। যে গন্ধ লোকটির শরীর এবং কাপড়চোপড় থেকে ভেসে আসছে তাতে মনে হচ্ছে সাধু-সন্ন্যাসী গোষ্ঠীর কেউ। গাঁজা, ভস্ম, ধূলি-ধোঁয়া, রুক্ষ দেহচর্ম এবং চুলের গন্ধ মিশিয়ে একটা বিশেষ রকমের গন্ধ ওঠে এদের গায়ে, এ সেই গন্ধ। সম্ভবত চণ্ডীমায়ের মহান্তের দূত। কিছুদিন থেকেই বুড়ো সন্ন্যাসীর অসুখের কথা শুনেছেন জীবন দত্ত।
জীবন দত্তের অনুমান মিথ্যা নয়। লোকটি চণ্ডীমায়ের মহান্তের চেলাই বটে। বললে–সাধুবাবাকে একবার দেখতে যেতে হবে।
—এই রাত্রে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। সন্ধ্যা থেকে রক্তভেদ হচ্ছে। বড় কষ্ট। দুর্বল হয়ে পড়েছেন। বললেন– জীবনকে একবার খবর দে! মালুম হোয় কি আজই রাতমে ছুটি মিলবে। সে একবার দেখুক।
বৃদ্ধের প্রাণ বড় শক্ত প্রাণ। কতবার যে এমন হল! অন্তত বিশ-পঁচিশ বার। রক্তভেদ নিদারুণ হিক্কানাড়ি ছেড়ে যাওয়া, এ সব হয়েও বৃদ্ধ বেঁচে উঠেছে।
একমাত্র কারণ গাঁজা। কিন্তু গাঁজা বুড়ো কিছুতেই ছাড়বে না। মদ খায় না এমন নয়। খায় কিন্তু পর্বে-পার্বণে অতি সামান্য। তন্ত্রের নিয়ম রক্ষা করে। মদ্যপানকে বলে—ঢুকু ঢুকু। জীবন। দত্তই তাকে বরাবর ভাল করেছেন। ডাক্তারি ওষুধ বুড়ো খায় না। ইনজেকশনকে বড় ভয়। মশায়বাড়ির টোটকার ওপরেই তার একমাত্র বিশ্বাস। তাও খুব কঠিন হয়ে উঠলে তবে বুড়ো জীবনকে ডাকে, বলে, দেখ তো ভাই জীবন। তলব কি আইল? বুড়ো আবার পড়েছে। আজকাল বড় ঘন ঘন পড়ছে।
জীবন দত্ত উঠলেন।
বৃদ্ধ বয়স, রাত্রি প্রহর পার হয়ে গিয়েছে; বোধহয় সাড়ে দশটা। শ্রাবণ মস, দিন বড় রাত্রি ছোট, হবে বৈকি সাড়ে দশটা। তবু যেতে হবে। উপায় কী? চল। বাড়ির দিকে মুখ ফিরিয়ে তিনি ডাকলেন-আতর-বউ!
–কী? ভিতর থেকে রুক্ষস্বরেই জবাব দিলেন আতর-বউ।
–বেরুতে হচ্ছে। ঘুরে আসি একবার।
—এই রাত্রে কোথায় যাবে? কার বাড়ি? না, যেতে হবে না তোমাকে। অনেক ডাক্তার আছে। অল্প বয়স, বিদ্বান, বড় বড় পাসকরা। তারা যাক। এই বয়েস তোমার—তোমাকে ডাকতে এসেছে শুধু টাকা দেবে না বলে। যেয়ো না তুমি।
জীবন ডাক্তার কোমল স্বরেই বললেন––চণ্ডীতলায় সাধুবাবার অসুখ আতর-বউ।
ওই কথাতেই অনেক কিছু বলা হয়ে গেল। আতর-বউও মুহূর্তে নরম হয়ে গেলেন। তাই বা কেন? একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেলেন। বললেন–সাধু বাবার অসুখ? কী হয়েছে?
–কী হবে? সেই যা হয়। রক্তভেদ-পেটে যন্ত্ৰণা।
–এবার তা হলে বাবা দেহ রাখবেন। বয়স তো কম হল না।
–দেখি! বলে তো পাঠিয়েছেন–জীবনকে ডাকতলব আইল কি না দেখুক। দেখি! ভারী জুতোর শব্দে স্তব্ধ পল্লীপথের দুপাশের বাড়ির দেওয়ালে প্ৰতিধ্বনি তুলে বৃদ্ধ হস্তীর মত জীবন ডাক্তার চললেন গ্রাম পার হয়ে স্বল্প বিস্তৃতির একখানি মাঠ পার হয়ে নবগ্রামের। পূর্বপ্রান্তে ঘন জঙ্গলে ঘেরা দেবাশ্রমের দিকে। বর্ষার রাত্রি-অবশ্য অনাবৃষ্টির-বর্ষা—তবুও রাস্তা পিছল, একটু সাবধানেই পথ চলতে হচ্ছিল। আলো নিয়ে সাধুর অল্পবয়সী চেলাটি দ্রুতপদে চলেছে—ডাক্তার প্রায় অন্ধকারেই চলেছেন। তাতে ডাক্তারের অসুবিধে নাই। অন্ধকারে ঠাওর করে পথ চলা তার অভ্যাস আছে। কিন্তু সাধুর চেলার হাতের আলোটা দুলছে, অসুবিধে হচ্ছে তাতেই। মধ্যে মধ্যে চোখে এসে লাগছে। ডাক্তার বললেন–আলোটা এমন করে দুলিয়ো না হে ভোলানাথ। চোখে লাগছে। চল, চল, দাঁড়াতে হবে না। চল তুমি। আলোটা দুলিয়ো না।
—কে? মশায় নাকি?
সম্মুখের দেবস্থলের প্রবেশপথের ঠিক মুখ থেকে কে প্রশ্ন করলে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। কণ্ঠস্বরটা চেনা। তবু জীবন দত্ত ধরতে পারলেন না। অন্যমনস্ক হয়ে সাধুর কথাই ভাবছিলেন তিনি। বহুকাল এখানে আছেন সাধু। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
—রোগীকে আমি ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। হাসতে লাগল সে।
–শশী! চমকে উঠলেন ডাক্তার।–কী দিয়ে ঘুম পাড়ালি?
পাগলা শশী হাসতে লাগল—অসুখের চিকিৎসা আসুরিক।
–কিন্তু তোকে খবর দিলে কে?
—এসে পড়লাম হঠাৎ। গিয়েছিলাম গলাইচণ্ডী, রামহরি লেটকে দেখতে। বেটার খুব অসুখ। দুপুরবেলা আপনাকে কল দিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু ওই মতির মায়ের নিদানের কথা বলতে গিয়ে ভুলেই গেলাম। বউ-ঠাকরুন বলেন নি আপনাকে? কাল একবার রামহরিকে দেখতে যেতে হবে মশায়।
—সে তো পরের কথা। কাল হবে। এখানকার খবর বল। কী চিকিৎসা করলি মহান্তের উৎকণ্ঠা অনুভব করছিলেন তিনি। শশীকে যে তিনি জানেন।
শশী বললে—আর কী! গলাইচণ্ডী থেকে ফিরবার পথে ঢুকলাম ভিজে শরীরটা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল, আর কেমন ছমছম করছিল বুঝেছেন—তাই বলি মাকে একবার প্রণাম করি আর
শরীরটাকে তাড়া করে নি। বুড়োর কাছে একটান গাঁজা খেয়ে যাই।
–হুঁ, তারপর?
—দেখলাম বুড়ো পুঁকছে। রক্তদাস্ত হয়েছে। নাড়ি নাই। যাতনায় ছটফট করছে। শুনলাম তিন দিন গাঁজা খায় নাই। বললাম—যেতে তোমাকে হবে। তা গজা না খেয়ে যাবে কেন–একটানা গাঁজা খেয়ে নাও। তা বললে–না। তু বেটা বদমাশ শয়তান। আরে ওহি গাঁজা তো আমার মরণ আসবার পথ তৈয়ার করেছে। এক পাও পথ বাকি; সে আসুক নিজেই ওটুকু পথ তৈয়ার করে। আর গাঁজা কেন? আমি মশায়, এক ডোজ কানাবিসিন্ডিকা দিয়েছি। সঙ্গেই ছিল। আমি খাই তো। বাস–খেয়ে দু-তিন মিনিটের মধ্যে বুড়ো ঘুমিয়ে পড়ল। দেখুন, বোধহয় নাড়িও টিপটিপ করে উঠেছে। গাঁজা-খাওয়া ধাত তো। লেগে গিয়েছে।
হি-হি করে হাসতে লাগল পাগলা।
১৬. মিথ্যে বলে নি পাগলা
মিথ্যে বলে নি পাগলা। এক ডোজ ক্যানাবিসিন্ডিকাতে বৃদ্ধ সাধুর ঘুম এসেছে; ঘুম যখন এসেছে। তখন যন্ত্রণারও উপশম হয়েছে এবং নাড়ির স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বুঝতে কিছু পারা গেল না।
সাধুসন্ন্যাসীর ধাতু-প্রকৃতিও স্বতন্ত্র। সাধারণ মানুষের সঙ্গে অনেক প্রভেদ। জীবনে আচার এবং বিধিনিয়ম পালনের প্রভাব দেহের ওপর অমোঘ। দেহের সহনশক্তি আশ্চর্য ভাবে বেড়ে যায়। তেমনি আশ্চর্য ক্রিয়া করে ওষুধ। অকর্ষিত মৃত্তিকায় প্রথম চাষের বীজের মত। সুতরাং বলা তো যায় না। মৃত্যু সন্নিকটবর্তী হয়েও এদের প্রাণশক্তির কাছে হার মেনে ফিরে যায়। এমন অনেক ক্ষেত্রে দেখেছেন জীবন দত্ত। তাঁর বাবাও এ কথা তাকে বলে গেছেন। বলেছিলেন এদের নাড়ি দেখে সহজে নিদান হেঁকো না, বাবা। আগে জেনে নিয়ো—তাদের নিজের দেহরক্ষার অভিপ্রায় হয়েছে কি না। মানুষের অভিপ্রায় প্রচণ্ড কাজ করে, যে রোগী হতাশ হয়ে ভেঙে পড়ে তাকে বাঁচানো কঠিন হয়। সাধুদের হতাশা নাই, মনটি এদে। শক্ত। ইচ্ছাশক্তি প্রবল। এবং মৃত্যু বরণের অভিপ্ৰায় ওঁরাই করতে পারেন।
সাধু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। ডাক্তার বললেন–রাত্রিটা সজাগ থেকো ভোলানাথ। রাত্রে যদি ঘুম ভাঙে—তবে জল খেতে দিয়ে। আর কিছু না। আমি ভোরবেলা আসব।
শশী খুব হাসতে লাগল। আত্মপ্রসাদের আর অবধি নাই তার। ডাক্তার তাকে ডেকে সঙ্গে নিলেন।আয় একসঙ্গে যাই।
শশীও সঙ্গ ধরলে। বললে—চলুন রামহরির কেসটা বলে রাখি। কাল আপনাকে যেতেই হবে।
ডাক্তার বললেন– শশী, আজ যা করেছিস করেছিস, এমন কাজ আর করিস না।
–কী? বুড়োকে ক্যানাবিসিন্ডিকা দেওয়া?
–হ্যাঁ। অন্যায় করেছিল।
–অন্যায় করেছি তো বুড়ো সুস্থ হল কী করে?
–কী করে তা বলা শক্ত। গাঁজা খাওয়া অভ্যেস আছে, সেই গাঁজা না খাওয়ার জন্যেও একটা যন্ত্রণা ছিল রোগের যন্ত্রণার সঙ্গে—সেটা উপশম হয়েছে–তার ওপর মাদকের ক্রিয়া আছে। এখন ঘুম ভেঙে এর ফল হয়ত মারাত্মক হবে।
–উঁহুঁ! বুড়ো সেরে উঠবে এ আমি বলে দিলাম। কুড়ো বাউরির মেয়েটার নিউমোনিয়ায় কেরোসিনের মালিশ দিলে সবাই আপনারা গাল দিয়েছিলেন কিন্তু সেরে তো গিয়েছিল।
ডাক্তার ধমক দিয়ে বললেন– শশী, এ সব পাগলামি ছাড়। শেষ পর্যন্ত বিপদে পড়বি।
–আমি পাগল?
–হ্যাঁ, তুই পাগল। আমার আর কোনো সন্দেহ নাই।
একটু চুপ করে থেকে শশী বললে—তা বেশ। পাগলই হলাম আমি। তা বেশ। আবার খানিকটা চুপ করে থেকে বললে—কাল কিন্তু রামহরিকে দেখতে যেতে হবে। আমি কল দিয়ে রাখলাম।
রামহরির কী হল?
—সে সাত-দুগুণে চোদ্দখানা ব্যাপার। এবার যাবে।
—যাবে তো আমাকে টানাটানি কেন? যাক না। এ বয়সে গেলেই তো খালাস। না, যেতে চায় না কামারবুড়ির মত! তা রামহরির এ ইচ্ছে স্বাভাবিক। আবার যেন মালাচন্দন করেছে এই বয়সে!
হ্যাঁ। বছর পঁচিশেক বয়স মেয়েটার। কিন্তু রামহরি বাচবার আশায় আপনাকে ডাকছে। না। ডাকছে নিদান দিতে হবে, বলে দিতে হবে জ্ঞানগঙ্গা যেতে পারে কি না। বড় ইচ্ছে জ্ঞানগঙ্গা যায় উদ্ধারণপুর কি কাটোয়া। জ্ঞানগঙ্গা গিয়ে বেশিদিন বলে তো মুশকিল। কন্ট্রোলের বাজার এ জেলার চাল ও জেলায় যাবার হুকুম নাই। কিনে খেতে গেলে অনেক টাকা লাগবে।
বকবক করে বলেই চলল শশী।
—চোরের রাজ্য বুঝেছেন, সব চোর। আপাদমস্তক চোর। রাজা চোর, রানী চোর, কোটাল চোর,সব চোর। আমি চোর, তুমি চোর—সব চোর। চালের দর ষোল টাকা? তাও এ জেলায় ষোল তো ও জেলায় ছাব্বিশ, আর দুপা ছাড়াও ছত্রিশ—আর এক পা ওদিকে চল্লিশ।
মশায় ঠিক কথাগুলি শুনছিলেন না। তিনি ভাবছিলেন। ভাবছিলেন রামহরির কথা। শশী আপন মনেই বকে চলেছিল। হঠাৎ একবার থেমে আবার আরম্ভ করলে। এবার কথার সুর আলাদা। দেশের সমালোচনা বন্ধ করে অকস্মাৎ সরস রসিকতায় সুরসিক হয়ে উঠল শশী। বললে—রামহরি জ্ঞানগঙ্গা যাবে কিন্তু বেহিসেবি কাণ্ড করে তো যাবে না, কদিন বাঁচবে–আপনাকে বলে দিতে হবে; সেই হিসেব করে চাল ডাল বেঁধে নিয়ে যাবে। বলে, ঠাকুর, তোমার কী বল? দশ দিন বেশি বাঁচলে চাল কম পড়বে। তখন নগদ দামে কিনতে হবে। পাঁচ দিন। কম বাঁচলে চাল বাড়বে। সে চাল ঘরে ফিরে নিতে নাই, বেচে দিতে হবে। সেসব তো আমার হাত দিয়ে হবে না। তবে পরের হাত দিয়ে। পাঁচভূতে সব তচনচ করে দেবে আমার। বুঝুন ব্যাপারটারামহরি যে হিসেব নেবে তার উপায় থাকবে না। ব্যাটা বলে—তাতে আমার স্বর্গে। গিয়েও শান্তি হবে না। আমি বলি–স্বর্গে যাওয়াই হবে না তোর। রথে চড়ে বলবিরোখো রোখো! আমি নাম। রথ ফিরিয়ে দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখবি। মহা মুশকিল। গঙ্গাতীরে মৃত্যুভূত হবারও উপায় থাকবে না, সে হলে সান্ত্বনা থাকত রামহরির ঘাড় ভাঙতে পারত। পিছু পিছু গিয়ে খোনা স্বরে বলতে পারত-পেঁ—অ্যাঁমার টাকা ফিরে পেঁ।
হি-হি করে হাসতে লাগল শশী।
শ্রাবণের অন্ধকার রাত্রির মধ্যে দুজনে পথ হাঁটছিলেন।
বৃদ্ধ জীবন মশায় আপনার মনে রামহরির কথা ভাবছিলেন। এমনটা কী করে হল? কেমন। করে হয়? জ্ঞানগঙ্গা যেতে চায় রামহরি? বিনা ভাবনায়, বিনা কামনায় বৈরাগ্যযোগ—মুক্তিপিপাসা কি জাগে? আমি মরব এই কথা ভেবে প্রসন্নমনে সমস্ত কিছু পিছনে ফেলে অভিসারে চলার মত চলতে পারে? দীর্ঘকাল প্রতীক্ষার পর যুবতী বধূর স্বামী-সন্দর্শনে যাওয়ার কালে। বাপের-ঘরের-উঠানে-পাতা খেলাঘর ফেলে যাওয়ার মত যেতে পারে?
রামহরি প্রথম জীবনে ছিল ছিচকে চোর; তারপর হয়েছিল পাকা ধানচোর; বার দুয়েক জেল খাটার পর হঠাৎ রামহরির দেখা গেল ঘোরতর পরিবর্তন, রামহরি কপালে ফোটা তিলক কেটে। গলায় কষ্ঠীমালা পরে হয়ে উঠল ঘোরতর ধার্মিক। জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যবসা শুরু করলে। তরকারির ব্যবসা। চাষীর ক্ষেত থেকে তরকারি কিনে হাঁটে বাটে ঘুরতে লাগল অর্থাৎ ফড়ে হয়ে উঠল। মুখে রামহরি চিরকালই ফড়ে অর্থাৎ কথা সে বেশি চিরকালই বলত—এবার ব্যবসায়েও তাই হয়ে উঠল। লোকের বাড়ি ক্রিয়াকর্মে বরাত এবং বায়না নিয়ে তরকারি সরবরাহ করত। কিন্তু এর অন্তরালে ছিল তার আসল ব্যবসা। নদীর ধারে জঙ্গলের মধ্যে দস্তুরমত কবিরাজের মৃতসঞ্জীবনী চোলাইয়ের পাকা পদ্ধতিতে মদ তৈরি করত। জঙ্গলের মধ্যেই বোতল এবং টিনবন্দি করে পুঁতে রাখত। ওখানেই শেষ নয়, নদীর চরের পলিমাটিতে সে গাঁজার গাছ তৈরি করে গাঁজাও উৎপন্ন করত এবং তার কাটতিও ছিল প্রচুর। দেশটা তান্ত্রিকের দেশ ছিল—মন্ত্র হোক বা না হোক, জানুক বা না জানুক, লোকে কারণ করত। কপালে সিঁদুরের ফোঁটা, মুখে কালী-কালী, তারাতারা রব আর কারণকরণে শতকরা নিরেনব্বই জন ছিল সিদ্ধপুরুষ। সুতরাং হাজার দরুনে সিদ্ধপুরুষের প্রসাদে রামহরির লক্ষ্মীলাভের পথে সিংহদ্বার না হোক বেশ একটা প্রশস্ত ফটক খুলে গিয়েছিল। উদ্যোগী পুরুষ রামহরির সাহস ছিল অপার, নবগ্রামে থানার সামনের রাস্তা দিয়ে কুমড়ো-কাঁকুড়ের বোঝার তলায় অন্তত চার-পাঁচটা বোতল নিয়ে সে। সহাস্য মুখে চলে যেত এবং হাঁটে বসে তাই বিক্রি করত। কুমডোর মুখ কেটে ভিতরের শাস বীজ বের করে নিয়ে তার মধ্যে আনত গাঁজা। বাড়িতে দেব প্রতিষ্ঠা করেছিল সুপবিত্র নিম্ব কাষ্ঠের গৌরহরি। কিন্তু ঠাকুরটির বক্ষপঞ্জর ছিল কঁপা। দস্তুরমত মাথা খাঁটিয়ে বুক এবং পিঠের দুদিক দুখানি স্বতন্ত্র কাঠে গড়ে ভিতরে গর রেখে পাকা মিস্ত্রি দিয়ে এই দৈব গুদামটি সে তৈরি করিয়েছিল। এবং পিঠের দিকের কাঠের নিচে উপরে দুটি ঢাকনিযুক্ত মুখ রেখেছিল। উপরেরটি খুলে গাঁজা পুরত এবং প্রয়োজনমত বের করে তি। এরপর আর-এক ধাপ উপরে উঠে রামহরি রীতিমত দাসজী হয়ে উঠেছিল। তরকারির ব্যবসা তুলে দিয়ে মুদির দোকান এবং ধান কেনার ব্যবসা শুরু করে-ভেক নিয়ে দাস উপাধি নিয়ে গণ্যমান্য হয়ে উঠেছিল কয়েকখানা গ্রামের। মধ্যে। শুধু ভেকই নেয় নাই, নিজের স্বজাতীয়া স্ত্রী এবং পুত্রকে দূর করে দিয়ে একটি উচ্চবর্ণের বিধবাকে ঘরে এনে বৈষ্ণবী করেছিল। ক্ৰমে ক্ৰমে আরও বোধহয় দু-তিনটি। এদের জনদুই পৌঢ় বয়সে দারোয়ানীর মত ঘুঁটে কুড়িয়ে মরে পরিত্রাণ পেয়েছে। একজন পালিয়েছে। শেষেরটি অরুণী—সেইটিই এখন রামহরির সুয়োরানী।
সেই রামহরি সজ্ঞানে মৃত্যু কামনা করে গঙ্গাতীরে চলেছে? মুক্তি চায় সে? বিস্ময় লাগে। বৈকি!
শশী তামাক টেনে শেষ করে কোটা হাতে ধরে নিয়ে বললে-কাল চলুন একবার। আমি বেটাকে বলেছি, ফি পাঁচ টাকা লাগবে। ডাক্তারবাবু তো আর কলে যান না, তবু বলে-কয়ে রাজি করাব। তা তাতেই রাজি।
কথাটা ডাক্তারবাবুর কানে গেল না। তার মনোরথ চলেছিল ছুটে। পলকে যুগান্তর অতিক্রম করে পিছনের পরিক্রমা সেরে বর্তমানে এসে সেই মুহূর্তেই স্থির হল বোধ করি। তিনি হাসলেন।
শশী বললে–হাসছেন যে?
জীবন বললেন– নবগ্রামের কর্তাবাবুর চিকিৎসার জন্যে কলকাতা যাওয়া মনে আছে তোর শশী?
—তা আবার নাই! বাড়ি থেকে পালকি করে বেরিয়ে—সব ঠাকুরবাড়িতে প্রণাম করে—
–সে তো জ্ঞানগঙ্গা যারাই গিয়েছেন—তারা সবাই তো তা করেছেন রে। সে নয়।
–তবে?
—কর্তা কাশী গেলেন না, উদ্ধারণপুর গঙ্গাতীর গেলেন না, গেলেন কলকাতা। কলকাতাও গঙ্গাতীরে। কিন্তু গঙ্গাতীরে দেহ রাখতে ঠিক যান নি। গিয়েছিলেন চিকিৎসা করিয়ে বাঁচতে।
তা হবে না? বিশাল সম্পত্তি, অগাধ ধন, এত কীৰ্ত্তি—এসব ছেড়ে মরতে কেউ চায় নাকি?
–হ্যাঁ রে, তাই তো বলছি। তার হয় নি আর রামহরির সেই বাসনা হল। রামহরি যা করেছে তার পক্ষে তো সেও কম নয় রে! অনেক! তার ওপর তরুণী পত্নী।
এবার হাঁ করে শশী জীবন ডাক্তারের মুখের দিকে চেয়ে রইল।
জীবনমশায় হেসেই বললেন– হাঁ করে আর তাকিয়ে থাকিস নে। বাড়ি যা। রাত্রি অনেক হয়েছে। কাল যাব। দুপুরের পর গাড়ি পাঠাতে বলিস।
শশী বললে—দু রাস্তার মোড় বুঝি এটা?
–হ্যাঁ।
এইখান থেকেই পাকা রাস্তা থেকে কাঁচা রাস্তা ধরে জীবন ডাক্তার যাবেন নিজের গ্রামে। পাকা রাস্তায় শশী যাবে নবগ্রাম।
জীবনমশায় বললেন–নেশাভাঙ একটু কম করিস শশী।
শশী মাথা চুলকে লজ্জা প্রকাশ করে বললে ভাবি তো। পারি না। তারপর অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে বললে—চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়েই যাই। ভারি অন্ধকার আর রাত্রি অনেক হয়েছে।
হতভাগা! আমাকে দাঁড়াতে হবে না। যাবাড়ি যা। আমাকে দাঁড়াবে? তোকে দাঁড়াবে কে? পরক্ষণেই একটা কথা মনে করে জীবন দত্ত সচকিত হয়ে উঠলেন, বললেন––আচ্ছা চল, আমিই তোকে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরব।
মনে পড়ল। মাসকয়েক হল শশীর মা মারা গেছে। শশী হয়ত এত রাত্রে ভয় পাচ্ছে। একলা যেতে। একটু আগেই বলছিলগলাইচণ্ডী থেকে ফিরবার পথে ওর গা ছমছম করেছিল অর্থাৎ ভয় পেয়েছিল শশী। ওঃ! সেই জন্যেই সে দেবস্থানে ঢুকেছিল?
জীবনমশায় বললেন– সত্যি বল তো শশী–কী ব্যাপার? তুই কি ভয় পেয়েছিল?
শশী মাথা চুলকে বললে—মানে—আমার মা–
—তোর মা?
–মনে হয় আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। মনে হয় নয় মশায়, সত্যি।
জীবন মশায় বললেন–চল, ওসব কথা থাক।
শশী বললে–মা আমাকে ভয় দেখায় না—আগলায়। বুয়েছেন না! শশী বকবক করলে। সারা পথটা। তার মধ্যে রামহরির কথাই বেশি। ওই বেটার নিদেন হেঁকে দেখিয়ে দেন একবার ছোকরা ডাক্তারকে!
১৭. শ্রাবণের মেঘাচ্ছন্ন রাত্রি
প্রদ্যোত ডাক্তার বারান্দায় বসে ছিল। শ্রাবণের মেঘাচ্ছন্ন রাত্রি, অসহ্য গুমটের মধ্যে ঘরে ঘুম আসা এক অসাধ্য ব্যাপার; তার ওপর মশারি। মশা এখানে খুব বেশি ছিল। লোকে বলত বিনা মশারিতে শুয়ে থাকলে মশারা সমবেতভাবে তুলে নিয়ে চলে যেতে পারে। আজকাল মশা কমেছে। ডি. ডি. টি. ক্যাম্পেন শুরু হয়েছে গত বছর থেকে। তবুও প্রদ্যোত বিনা মশারিতে শোয় না। একটি মশাও কামড়াতে পারে এবং সেইটিই অ্যানোফলিস হতে পারে এবং তার। বাহিত বিষটুকুতে ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার বীজাণু থাকতে পারে। বাইরে মশারি খাঁটিয়ে শুলে হয়, কিন্তু তাতে মঞ্জ অর্থাৎ ডাক্তারের স্ত্রী ভয় পায়। শহরের মেয়ে, তার ওপর এ অঞ্চল সম্পর্কে ছেলেবেলায় অনেক চোরডাকাত ভূতপ্রেত সাপবিছের গল্প শুনেছে সে। মঞ্জুর মায়ের মাতামহের। বাড়ি ছিল এই দেশে। মায়ের মাতামহ অবশ্য বেঁচে নেই এবং মামাও কোনো কালে ছিল না, অর্থাৎ মঞ্জুর মা ছিল মা-বাপের এক সন্তান; থাকবার মধ্যে মঞ্জুর বৃদ্ধা মাতামহী বেঁচে আছে। কানে কালা, চোখেও খুব কম দেখে। সে-ই গল্প করত। ভূতপ্রেত মঞ্জু বুদ্ধি দিয়ে অবিশ্বাস করে, তর্কও করে, কিন্তু অন্ধকারে কোনো শব্দ উঠলেই চমকে ওঠে। সেই কারণে বন্ধ ঘরে শুতে যাবার আগে যতক্ষণ পারে প্রদ্যোত ডাক্তার বসে থাকে। মধ্যে মধ্যে ফ্লিট স্পে করে দেয়। চারিপাশে বারান্দার নিচে সিঁড়িতে কার্বলিক-অ্যাসিড-ভিজানো খড় ছিটানো থাকে। আর থাকে ডি. ডি. টি. পাউডার এবং ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো। সাপ পোকা বিছে আসতে পারে না।
সকালবেলা থেকেই প্রদ্যোতের মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। রতনবাবুর ছেলে বিপিনবাবুর। কেসে এখানকার হরেন ডাক্তার তাকে কল দিয়েছিল; আকস্মিকভাবে হিকার উপসর্গ এসে জুটেছে। কল দিয়েছিল কাল সকালে। একটা নিষ্ঠুর যন্ত্রণাদায়ক অবস্থা। মনে হয় হয়ত যে-কোনো মুহূর্তে নিষ্ঠুর পরিণতি এসে উপস্থিত হবে। হরেনের সঙ্গে পরামর্শ করে যা করবার করেছে তারা, কিন্তু কোনো ফল হয় নি। আজ সকালে কিশোরবাবু প্রস্তাব করলেন–জীবন মশায়কে ডাকা হোক। প্রস্তাবটা বোধহয় রতনবাবুর, কিশোরকে দিয়ে প্রস্তাবটা তিনিই করিয়েছেন। প্রদ্যোত ডাক্তার কী বলবে? মনে উত্তরটা আপনিই এসে দাঁড়িয়েছিল-বেশ তো দেখান। আমি কিন্তু আর আসব না। কিন্তু কথাটা বের হবার আগেই কিশোরবাবু বলেছিল–আপনি কিন্তু বলতে পাবেন না—আর আসব না। আমার অনুরোধ। আমি শুনেছি আপনি তার উপর অসন্তুষ্ট। কিন্তু তিনি অসন্তোষের লোক নন।
ডাক্তার বলেছিলেন—এর মধ্যে সন্তোষ-অসন্তোষের কথা কী আছে কিশোরবাবু? আপনাদের রোগী, ইচ্ছে হলে ভূতের ওঝাও ডাকতে পারেন।
–আপনি একটু বেশি বলছেন প্রদ্যোতবাবু। বলছেন না? নিজের মর্যাদাটাকে বড় করে বিচার করবেন না। সত্যকে বড় করে খতিয়ে বলুন প্রদ্যোতবাবু। কিশোরবাবু মানুষটি বিচিত্র। তার মধ্যে কোথায় যেন অলঙ্নীয় কিছু আছে। তাকে লঙ্ন করা যায় না। সমগ্র দেশের লোকের প্রীতির পাত্র। আজীবন দেশের সেবাই করে আসছেন। এখানে প্রদ্যোত ডাক্তার এসে অবধি কত ছোটখাটো উপকারে ওঁর কাছে উপকৃত তার আর হিসেব নেই। এখানকার লোকগুলি সহজ নয়। মঞ্জু আধুনিকা, সে বাইসিক্ল চড়ে একা যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়, এর জন্য কুৎসা রটিয়েই ক্ষান্ত হয় নি—উপরে দরখাস্ত করেছিল। প্রদ্যোতের বন্ধু এই জেলারই সদরে ল্যাবরেটরিতে প্র্যাকটিস করে, সে মধ্যে মধ্যে আসে এখানে তার সঙ্গে জড়িয়ে কুৎসিত অভিযোগ এবং হাসপাতালের ওষুধ চুরির অপরাধও ছিল তার সঙ্গে। কয়েকটা কেসে প্রদ্যোত বন্ধুর ল্যাবরেটরিতে রোগীর রক্ত ইত্যাদি পরীক্ষা করিয়েছিল বলে তা নিয়েও অনেক কথা ছিল সে দরখাস্তে। মুখে মুখে এ নিয়ে কথার তো অন্ত ছিল না; বিচিত্র প্রশ্ন সব। ও বাবা, এ যে দুই বঁধুতে মিলে বেশ ফাঁদ পেতেছে! রক্ত পরীক্ষা থুতু পরীক্ষা প্রস্রাব পরীক্ষা-দাও টাকা এখন। চোর চোরাটি আধা ভাগ। এতকাল এসব ছিল না–তা রোগ ভাল হত না?
কিশোরবাবুই এ সমস্ত অপবাদ এবং প্রশ্ন থেকে রক্ষা করেছেন। অযাচিতভাবে তিনি এগিয়ে এসেছিলেন।
এখানে থাকলে দুটি বেলা কিশোরবাবু তাদের খবর নেন। কিশোরবাবুর প্রশ্নে এই কারণেই ডাক্তারকে ভেবে দেখতে হয়েছিল। কিশোরবাবু বলেছিলেন—ভাল করে ভেবে দেখুন ভাই। এখানে প্রশ্ন হল মূল্যবান একটি জীবনের। আর মশায়কে তো আমরা আপনাদের উপরওয়ালা করে ডাকছি না; ডাকছি সাহায্য করবার জন্যে। ওঁকে ডাকছি-উনি নাড়িটা দেখবেন আর হিকাটা থামিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন। তাতে আপনাদের যেসব শর্ত আছে তা বলে দিন তাঁকে। কই হরেন চারুবাবু এঁরা তো আপত্তি করছেন না।
হরেন ডাক্তার চারুবাবু মত দিয়ে গেছেন। চারুবাবু বলে গেছেন—খুব ভাল কথা। ওঁর অনেক মুষ্টিযোগ আছে। অব্যৰ্থ ফল হয়। শুধু আফিংঘটিত কিছু যেন না দেন।
এরপর অগত্যা প্রদ্যোতকে মত দিয়ে আসতে হয়েছে। বলতে সে পারে নিওঁদের মত ওঁদের, আমার মত আমার। আমি আর আসব না। কিন্তু এ নিয়ে একটা অস্বস্তি তার মনে সেই সকাল থেকেই ঘুরছে। উৎকণ্ঠিত হয়ে আছেন জীবন মশায় নামক এই দেশজ ভিষণাচার্যের ভেষজের ফলের জন্য। একটা বিষয়ে সন্তুষ্ট হয়েছে সে। ওই নিদানবিশারদ এক্ষেত্রে নিদান হকে নি। তাদের ভুল ধরে নি। চারুবাবুদের সঙ্গে তার আলোচনার কথা বোধহয় বৃদ্ধ শুনেছে। তবুও অস্বস্তি রয়েছে। ওই ওষুধের ফলের জন্য অস্বস্তি। তার সঙ্গে আরও যেন কিছু আছে। এর ওপর একটি রোগী আজ অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে তার হাতে মারা গিয়েছে।
কী যে হল?
সব থেকে যেটা তাকে পীড়িত করছে সেটা হল তার ভ্রান্তি। সকালবেলা সে দেখে বলে এসেছিল—রোগী বেশ ভাল আছে। জ্বর ছেড়ে গেছে। কাল পথ্য দেব। একটু যেন ড্রাউজি ভাব ছিল—আচ্ছনের মত পড়ে ছিল রোগী, কিন্তু ডাক্তার সেটাকে দুর্বলতা মনে করেছিল। ছেলেমানুষ শিশু রোগী। রোগীর বুড়ি ঠাকুমা বলেছিল-ভাল কী করে বলছ বাবা তুমি? বালা রুগীজ্বর ছেড়েছে, ভাল আছে তো মাথা তুলছে কই, খেতে চাচ্ছে কই?
ডাক্তার তাকে বলে এসেছিল তুলবে মাথা। একটু দুর্বল হয়ে আছে। ওটা কাটলেই তুলবে। আর আমাদের কথায় বিশ্বাস করুন। না করলে তো চিকিৎসা করতে পারব না।
বিকালবেলা ছেলেটা হঠাৎ কোলান্স করলে। ডাক্তার ছুটে গিয়েছিল। ইনজেকশনও দিয়েছিল বার তিনেক, কিন্তু সন্ধের সময় মারা গেছে ছেলেটা।
ডাক্তার ভাবছিল। কোথায় ভুল হল তার? আগাগোড়া? ডায়াগনোসিসে?
হ্যাঁ, তাই। ম্যালেরিয়া বলে ধরেছিল সে। কিন্তু ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া। ভুল হয়ে গিয়েছে। সেইখানে। কুইনিন ইনজেকশনও সে দিয়েছিল।
ফলটা হয়েও স্থায়ী হল না। ইনট্রাভেনাস দেওয়া উচিত ছিল।
ডাক্তার অকস্মাৎ চকিত হয়ে ইজিচেয়ারের উপরেই সোজা হয়ে বসল। কুইনিন অ্যাম্পুলটা? সেটার ভিতর ঠিক কুইনিন ছিল তো? বিনয়ের দোকান থেকে কেনা অ্যাম্পুল। একালের এই ঔষুধ ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস নেই। না—নেই। এরা সব পারে। কলকাতায় জাল ওষুধ তৈরি করার একটা গোপন কিন্তু বিপুল-আয়তন আয়োজনের কথা অজানা নয়। এবং তাদের সঙ্গে ওষুধের দোকানদারদের যোগাযোগের কথাও অপ্ৰকাশ নেই। বিনয়চন্দ্র পাকা ঝানু ব্যবসাদার। মিষ্টি মুখের তুলনা নেই। সাধুতার সততার এমন সুকৌশল প্রচার করতে পারে লোকটি যে মনে সমের উদয় হয়। কিন্তু প্রদ্যোত নিজে ডাক্তার তার কাছে বিনয়ের লাভের প্রবৃত্তির কথাও তো অজ্ঞাত নয়। চার পয়সা যে দাগে ওষুধের খরচ তার দাম চার আনা। এ নিয়ে কথা তার সঙ্গে হয়েছে। কিন্তু বিনয় সবিনয়ে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে—ওর কমে দিলে লোকসান অবশ্যম্ভাবী। বছরের পর বছর বিনয় জমি কিনছে, সঞ্চয় বাড়াচ্ছে। এবার নাকি নতুন একটা বাড়ি করবে। বিনয় সব পারে। প্রদ্যোতের কান দুটো উত্তপ্ত হয়ে উঠল, মনের মধ্যে একটা অসহায় ক্ষোভ জেগে উঠল। ইজিচেয়ার থেকে উঠে নিজের কলবাক্সটা টেনে বের করে বসল। ছোট ছোট কাগজের বাক্সে নানান ইনজেকশন। কুইনিনের বাক্সটা বের করে তার ভিতর থেকে একটা অ্যাম্পুল বের করে সে ভেঙে ফেললে। জিভে চেখে দেখলে। সারা মুখটা তেতো হয়ে গেল।
ডাক্তার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আবার বাইরে এসে বসল। ডাকলে—মঞ্জু মঞ্জু! ডাক্তারের স্ত্রী মঞ্জ, মঞ্জুলা।
মঞ্জ রান্নাঘরে রয়েছে। রান্নার লোকটা কিছুই জানে না। এটা যাকে বলে খাঁটি গাইয়ার দেশ। শাক শুকতো চচ্চড়ি, ঘোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি হোড়, এ ছাড়া কিছু জানে না। আর জানে খেড়ো নামক একটি বস্তু-কাঁচা তরমুজের তরকারি, আর কড়াইয়ের দাল আর টক। অম্বলকে বলে টক। এবং কাঁচা মাছে অম্বল বাঁধে। বড় বড় মাছের মাথা অম্বলে দিয়ে খায়। ভাল রান্না মানে তেলমসলার শ্রাদ্ধ। ডিসপেপসিয়া রোগটি জন্মানোর জন্যে উৎকৃষ্ট সার দিয়ে জমি প্রস্তুত করা। ডাক্তারের রুচি আধুনিক সুপ, সিদ্ধ, সালাদ। এখানকার ওই গ্রাম্য লোকটি আজও পর্যন্ত নামগুলো আয়ত্ত করতে পারে নি। অগত্যা মঞ্জু দাঁড়িয়ে থেকে দেখিয়ে দেয়। তা। ছাড়া একটি কোর্স সে নিজে হাতে রান্না করে নেয়। ওটা মঞ্জুর শখ।
—মঞ্জু! আবার ডাকলে প্ৰদ্যোত।
–আসছি। এবার সাড়া দিলে মঞ্জু।
দীর্ঘাঙ্গী তরুণীটির শ্ৰীটুকু বড় মধুর এবং কোমল, এর ওপরে ওর বর্ণটার মধ্যে একটা দীপ্তি আছে যা সচরাচর নয়, সাধারণ নয়। চোখ জুড়িয়ে যায়, মোহ জাগে মঞ্জুকে দেখে। প্রাণচঞ্চলা আধুনিকা মেয়ে মঞ্জু। গান গাইতে পারে, আই. এ পর্যন্ত পড়েছে; বাইসিক্ল চড়তে শিখিয়েছে ডাক্তার, বন্দুক ছুঁড়তে শিখিয়েছে।
—কী বলছ? আমার রান্না পুড়ে যাবে।
–কী রাঁধছ?
–টক। হাসতে লাগল মঞ্জু। কাঁচা মাছের টক। আমার ভারি ভাল লাগে। আগে বুড়ি দিদিমা বলত—আমরা আসতাম। কিন্তু সত্যি চমৎকার সরষে ফোড়ন দিয়ে আর কাঁচা তেল ছড়িয়ে।
—বোসো তুমি এখানে। একা ভাল লাগছে না। গানটান গাও। মনটা বড় খারাপ হয়ে আছে। ওদের ছেলেটা এমন হঠাৎ মরে গেল–।
—রাঁধুনীটা বলছিল।
–কী বলছিল? ডাক্তার আবার তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল।
–বলছিল—সঁচজনে বলছে পাঁচ রকম।
–তবু ভাল, পাঁচজনে পঞ্চাশ রকম বলে নি। হাসলে প্রদ্যোত।
–তুমি কি সকালে বলে এসেছিলে কাল পথ্য দেবে?
–হ্যাঁ, কেন?
—ওই কথাটাই বেশি বলছে লোকে। তাতে চারুবাবু বলেছেন শুনলামওরে বাবা, মৃত্যুর কথা কি কেউ বলতে পারে? ওর ওপরে ডাক্তারের হাত নেই।
ডাক্তার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে, মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। নিচ্ছিদ্র মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। পৃথিবীর উপরে একটা ছায়া ফেলেছে এই রাত্রিকালেও।
চকিত একটু বিদ্যুতাভাস খেলে গেল সীমাহীন মেঘাচ্ছন্ন আকাশে। মৃদুগম্ভীর গর্জনে মেঘ ডেকে উঠল দূরে অনেক দূরে। ডাক্তার মৃদুস্বরে বললে–শ্রাবণরাত্রির একটা গান গাও।
—আসছি আমি। ওকে বলে আসি-অম্বলটা ওই নামাবে।
–যাক পুড়ে যাক। না নামায় তো কাল ওটাকে দূর করে দিয়ো।
মঞ্জু মৃদু গুনগুনানি সুরে ধরলে–
এসো শ্যামল সুন্দর।
আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা।
বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে।
ডাক্তার চোখ বুজলে। সত্যি বৃষ্টি হলে দেশটা জুড়োয়। প্রাণটা বাঁচে। গান শেষ করে মঞ্জু উঠল, বললে—আমি আসছি। ততক্ষণ রেডিও খুলে দিয়ে যাই। রবীন্দ্রসঙ্গীত আছে। মন তার এখনও পড়ে আছে রান্নাশালে। ছ্যাঁক করে সম্বরা দিতে তার ভারি ভাল লাগে। ডাক্তার চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। তা হলে চারুবাবু তার বিরুদ্ধ সমালোচনা করেন নি; প্রৌঢ় মোটের ওপর লোক ভাল।
রেডিওতে যন্ত্রসঙ্গীত বাজছে। গীটার। সুরটা কাঁপছে, কাঁদছে।।
চারুবাবু কিন্তু ডিফিটেড সোলজার। হার মেনেছেন ভদ্রলোক। যাকে সাধু বাংলায় বলে আত্মসমর্পণ করেছেন। সারেন্ডার করেছেন। মৃত্যুর কথা কেউ বলতে পারে না। ওর ওপর ডাক্তারের হাত নাই।
আছে। হাত আছে। এখানে যদি একটা ক্লিনিক থাকত। গোড়াতেই যদি ব্লাড কালচার করে নেওয়া যেত। এবং ওষুধ যদি খাঁটি হত। কে বলতে পারে বাচত না ছেলেটা?
রেডিওতে গান বেজে উঠল—মরণ রে তুহু মম শ্যামসমান। ডাক্তার ভ্রূ কুঞ্চিত করে উঠে গিয়ে রেডিওটা বন্ধ করে দিলে।
কম্পাউন্ডের ফটকটায় হর্নের শব্দ উঠল। সাইকেল রিকশার হর্ন। কে এল? কেন? কল? ডাক্তার উঠে দাঁড়াল। ঘরের মধ্যে থেকে ছোট স্টোভল্যাম্পটা বের করে নিয়ে এল। দুটো রিকশা। একটি রিকশায় একটি তরুণী, অজ্ঞান অবস্থা বলে মনে হচ্ছে। এ গাঁয়ের দাইটা তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। সর্বাঙ্গ কাপড় দিয়ে ঢাকা। মাথাটা দাইয়ের কাঁধের উপর ঢলে পড়েছে। অব্যক্ত যন্ত্রণায় মধ্যে মধ্যে নীল হয়ে যাচ্ছে, বিকৃত হচ্ছে। কাপড়খানার নিচের দিকে রক্তের দাগ। ডেলিভারি কেস। বোধ করি প্রথম সন্তান আসছে। ডাক্তারের আলোটা হাতে নেমে পড়ল। ডাকলে হরিহরবাবু! মিস দাস!
কম্পাউন্ডার আর মিডওয়াইফ। কিন্তু ও কে? পিছনের রিকশায়?
স্থূলকায় বৃদ্ধ? জীবনমশায়?
জীবনমশায় শশীকে পৌঁছুতে গিয়েছিলেন। শশীর প্রতিবেশী গণেশ ভটচাজের প্রথম সন্তানসম্ভবা কন্যা তখন সূতিকাগারে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। জীবন মশায়কে পেয়ে তারা তাকে ছাড়ে নি। জীবনমশায় এক্ষেত্রে কী করবেন? তবু তারা মানে নি। বলেছিল-হাতটা দেখুন।
–হাত দেখে কী করব? আগে তো প্রসব করানো দরকার। যারা প্রসব করাতে পারে। তাদের ডাক। নয়তো হাসপাতালে নিয়ে যাও।
তাই নিয়ে এসেছে। কিন্তু জীবন মশায়কে ছাড়ে নি।
—আপনি থাকুন মশায়! কণ্ঠস্বরে মেয়ের বাপের সে কী আকুতি!
মশায় উপেক্ষা করতে পারেন নি।
শার্টের আস্তিন গুটিয়ে যথানিয়মে হাত ধুয়ে, বীজাণুনাশক লোশন মেখে ডাক্তার তৈরি হয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল।
–আপনি প্রসবের জন্য কোনো ওষুধ দিয়েছেন?
—গুড। আপনি কি অপেক্ষা করবেন?
–হ্যাঁ। একটু থাকি। হাসলেন মশায়।
–আচ্ছা। বসুন ওই চেয়ারটায়। নাড়ি দেখে কিছু বলেছেন নাকি?
–নাড়ি দেখেছি। কিন্তু—
ঘরের মধ্যে অবরুদ্ধ যন্ত্রণায় জান্তব গোঙানির মত গোঙানি উঠল।
—ডাক্তারবাবু! মিস দাসের কণ্ঠস্বর।
প্রদ্যোত ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। জীবনমশায় শ্রাবণের মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েই রইলেন। একটা অস্বস্তি বোধ করছেন তিনি। কেন তিনি এলেন? ওদের ইচ্ছে প্রসবের পর তিনি একবার নাড়ি দেখেন। কিন্তু প্রসব হতে গিয়েই যদি
—বসুন মশায়। বললে হরিহর কম্পাউন্ডার। হরিহর গরম জল, তুলো, পরিষ্কার ন্যাকড়া ইত্যাদি নিয়ে যাচ্ছে পাশের ঘরে।
–বেশ আছি হে। হাসলেন মশায়। মেয়েটির বয়স হয়েছে। প্রায় তিরিশ। চিন্তা হচ্ছে তাঁর।
চমকে উঠলেন মশায়। মেয়েটি আবার যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে—আরও কিছু। হ্যাঁ ঠিক। নবজাতকের প্রথম কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। জয় পরমাপ্রকৃতি! জয় গোবিন্দ।
—হরিহরবাবু, গরম জল। তুলো। প্রদ্যোত ডাক্তারের ধীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল। আশ্চর্য ধীর এবং শান্ত এবং গম্ভীর।
***
তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে ডাক্তার বেরিয়ে এলেন। মেয়েটির বাবা বললে–ডাক্তারবাবু!
—সেফ ডেলিভারি হয়েছে। খোকা হয়েছে।
–নীহারের জ্ঞান হয়েছে?
–না।
–হয় নি?
–না। আজ বাড়ি যান। যা করবার আমি করব। এখানে থেকে গোলমাল করলে কোনো উপকার হবে না। যান, বাড়ি যান। আপনিও বসে আছেন? মাফ করবেন, এখন নাড়িটাড়ি। দেখতে দেব না আমি। কিছু মনে করবেন না যেন। আমার জ্ঞানমত নাড়ি ভালই আছে, এই পর্যন্ত বলতে পারি।
ডাক্তার চলে গেলেন নিজের বাসায়।
—মঞ্জু!
–চা ছাঁকছি।
—মেনি থ্যাংকস, মেনি মেনি থ্যাংকস, জলদি আন–চা খেয়ে গিয়ে দরকার হলে আবার ইনজেকশন দেব।
–কেস কি?
–নট গুড, আবার খারাপও নয় খুব। বাট শি মাস্ট লিভ, বাঁচাতে হবে।
চায়ে চুমুক দিয়ে বললে—প্রথমটা আমার কিন্তু ভারি রাগ হয়ে গেছল। দ্যাট ও ম্যান, ফেমাস মহাশয় অব্ দি প্লেস–সে সঙ্গে এসেছিল।
—কোনো খারাপ কথা বল নি তো?
–না। তবে এখন ওরা চাইছিল—মশায় একবার নাড়ি দেখে। আমি বলে দিয়েছি, না–তা আমি দেব না।
—ওঁকে চা খেতে ডাকলে না কেন?
—ডাকা উচিত ছিল, না?
–নিশ্চয় ছিল।
চায়ের কাপ নামিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে প্রদ্যোত আবার হাসপাতালের দিকে চলল। আর একটা ইনজেকশন দিতে হবে। মশায় চলে গেছেন। একটু অন্যায় হয়ে গেল। টং টং শব্দে ঘড়ি বাজছে। রাত্রি বারটা। রোগীর ঘর থেকে মৃদু যন্ত্রণার শব্দ শোনা যাচ্ছে। যন্ত্রণা কমে এসেছে। শি মাস্ট লিভ; বাঁচাতে হবে মেয়েটাকে। হরিহর বেরিয়ে এল।
–কেমন আছে এখন?
–ভালই মনে হচ্ছে।
–ভালই থাকবে। ইনজেকশন বের করুন।
ডাক্তার সিরিঞ্জটা উঁচু করে আলোর সামনে ধরলেন। আবার যেন ফটকটা খুলল? কে এল আবার?
এগিয়ে গেল হরিহর। রনবাবুর লোক।
–কী, হিক্কা খুব বেড়েছে?
–আজ্ঞে না। সেই শহর থেকে রেপোর্ট এসেছে, তাই বুড়োবাবু বললেন– ডাক্তারবাবু যদি জেগে থাকেন তো দিয়ে আয়।
বিপিনবাবুর ইউরিন রিপোর্ট।
—হিক্কা কেমন আছে?
–তেমনিই আছে। একটুকু কম বলে লাগছে।
একটা ক্লিনিক যদি এখানে থাকে! এক্স-রেইলেকট্রিসিটি না হলে উপায় নাই। ময়ূরাক্ষী স্কিম হতে আরও কয়েক বছর লাগবে। তার আগে সে আর হবে না। কিন্তু একটা ক্লিনিক। কত লোক যে বাঁচে! আজ কি এই মেয়েটাই বাচত? হাসপাতাল যন্ত্রপাতি—এসব না থাকলে এ মেয়েটাও আজ মরত।
জীবনমশায় হাত দেখে ঘাড় নেড়ে বলত-কী করবে? এ কার হাত? তোমার, না–আমার?
১৮. জীবন দত্ত ডাকে গেলে
জীবন দত্ত ডাকে গেলে আতর-বউ ঘুম পেলে ঘুমকে বলেন-চোখের পাতায় অপেক্ষা কর, এখন চোখে নেমো না। সে আসুক, তারপর। শুয়ে শুয়েও জোর করে জেগে থাকেন। চোখের পাতা ঢুলে নেমে আসে, আতর-বউ জোর করে চোখ মেলেন,পাশ ফেরেন, রাধাগোবিন্দ বলে। ইষ্টনাম করেন; বেশি ঘুম পেলে উঠে বসে পানদোক্তা খান—মধ্যে মধ্যে নন্দকে তিরস্কার করেন; নন্দকে নয়, মন্দর নাকডাকাকে বলেন, নাক মানুষের ডাকে; কিন্তু তাই বলে এমনি করে। ডাকে? শিঙের ডাক হার মানে! শুধু শিঙের ডাক? মনে হচ্ছে কেউ যেন করাত দিয়ে দরজা কাটছে! নন্দ, অ-নন্দ। শুনছি, একটু কম করে নাক ডাকা বাপু। পাশ ফিরে শো।
জীবন দত্ত এলেই এসব সমস্যার সমাধান হয়। তিনি কোনোদিন জিজ্ঞাসা করেন—কেমন। দেখে এলে গো? কোনোদিন কোনো প্রশ্ন করেন না, নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে পড়েন এবং আধ মিনিটের মধ্যেই তাঁর নিজের নাক ডাকতে শুরু করে।
নন্দ উঠে হাতমুখ ধোবার জল দেয়, হাতমুখ ধুয়ে ইষ্ট স্মরণে বসেন, তারপর খাবারের ঢাকা খুলে খেতে বসেন। নন্দ তামাক সাজে, হুঁকো-কন্ধে হাতে দিয়ে নন্দও গিয়ে শুয়ে পড়ে; খেয়ে উঠে মশায় তামাক খান—আর ভাবেন। রোগের কথা। কোনোদিন মৃত্যুর কথা। যেদিন রোগী মারা যায়—সেদিন ফিরে এসে চিকিৎসাপদ্ধতির কথাটা ভেবে দেখেন, ত্ৰুটি মনে হলে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন; না-হলে মৃত্যুর কথাই ভাবেন। তারপর গোবিন্দ স্মরণ করে শুয়ে পড়েন। যেদিন ডাক থাকে না, সেতাবের সঙ্গে দাবা খেলে কাটে, সেদিন ভাবেন-দাবার চালের কথা। একটার আগে কোনোদিন ঘুমানো হয় না। আজ বাজে বোধহয় দুটো—আড়াইটে।
***
পরদিন ঘুম ভাঙতে দেরি হল।
প্রথমেই মনে হল—গণেশ ভটচাজের মেয়েটির কথা। কেমন আছে? ডাকতে গেলেন। নন্দকে জিজ্ঞাসা করবেন গণেশ ভটচাজের বাড়ির কেউ এসেছে কি না। কিন্তু পরক্ষণেই সাধারণের চেয়ে আয়তনে বড় তার মাথাটি বার বার নানা বলে যেন দুলে উঠল। এবং গম্ভীর কণ্ঠে ডেকে উঠলেন–জয় গোবিন্দ পরমানন্দ।
হাত জোড় করে জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন–নমঃ বিবস্বতে ব্ৰহ্মণভাস্বতে বিষ্ণুর্তেজসে জগৎসবিত্রে সূচয়ে সবিত্রে কর্মদায়িনে—নমঃ!
মৃত্যুধ্রুব এই পৃথিবীতে এত চঞ্চল হলে চলবে কেন?
মুখহাত ধুয়ে চা খেতে বসলেন। তামাক সেজে দিয়ে নন্দ কোটি বাড়িয়ে ধরল। বললে–আজকে আট-দশ জন রুগী এসেছে।
হুঁকোয় টান দিয়ে মশায় বললেন– নবগ্রামের কেউ এসেছে? গণেশ ভটচাজ?
—না তো।
–হুঁ। মশায় ক্ষুণ্ণ হলেন একটু। কাল রাত্রি বারটা পর্যন্ত তিনি গণেশের জন্য বসে ছিলেন, ওই প্রদ্যোত ডাক্তারের রূঢ় কথা শুনে এলেন, আর আজ একটা খবরও দিলে না? বেশ বুঝলেন—মেয়ে ভাল আছে। উৎকণ্ঠা কমে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ভুলে গিয়েছে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন তিনি।
নন্দ বললে—চেঁচামেচি করছে সেই বামুন, দাঁতুঠাকুর।
–কেন? কাল তো তাকে এক সপ্তাহের ওষুধ দিয়েছি?
—সে আবার এসেছে। গাঁজা না খেয়ে তার ঘুম হয় নাই। বলছে হয় গাঁজা খেতে বলুক, নয় ঘুমের ওষুধ দিক। এসে থেকে চেঁচাচ্ছে।
—চেঁচাক। পরান খাঁ এসেছে?
–না। এখনও আসে নাই। এইবার আসবে। বার কয়েক হুঁকোয় টান দিয়ে হুঁকোটা নর হাতে দিয়ে মশায় উঠে দাঁড়ালেন, বললেন– রোগীদিকে বসতে বলবি। আমি এখন যাব-—একবার মহাপীঠে মহন্তকে দেখতে।
নন্দ মাথা চলুকে বললে—তা ওদিকে একবার দেখে ওষুধপাতি লিখে দিয়ে গেলেই তো হত। পরান খাঁ গাড়ি নিয়ে আসবে, সেই গাড়িতেই পথে গোঁসাইকে দেখে আসতেন।
মশায় জবাব দিলেন না। শুধু ফতুয়াটা গায়ে দিয়ে পকেটে স্টেথোসকোপটা পুরে পুরনো জুতো জোড়াটা পরতে লাগলেন। নন্দ গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেল—যত বেগারের কাজ; সক্কালে বিনি পয়সায় রুগী দেখা! এমন করলে রুগী আসবে কেন? হুঁ। এই করেই এমন হয়। সেই মিত্তিরিবাবু বলে গিয়েছিল—মহাশয় লোকের কথা—সে কি মিছে হয়?
মোয় হাসলেন। মনে পড়েছে। প্রৌঢ় জমিদার গৌরহরি মিত্তিরের কথা বলছে নন্দ। নন্দ ছিল তখন সেখানে, শুনেছিল।
***
আরোগ্য-নিকেতনে তখন সে কী ভিড়! চল্লিশ পঞ্চাশ ষাট জন রোগী!
জগৎ মশায়ের মৃত্যুর পর আরোগ্য-নিকেতনের দৈন্যদশা এসেছিল। সে দৈন্যদশাকে জীবন দত্ত তখন কাটিয়ে আবার সমৃদ্ধি ফিরিয়ে এনেছেন। রঙলাল ডাক্তারের কাছে শিক্ষা শেষ করে তখন তিনি অ্যালোপ্যাথি, কবিরাজি, মুষ্টিযোগ—তিন ধারার ওষুধ নিয়ে চিকিৎসা করেন। গুরু রঙলাল রহস্য করে বলেছিলেন-ট্রাইসিকেলে চেপে চল তুমি। সে ট্রাইসিকল তার ভাগ্যগুণে এখনকার মোটরগানো তিন চাকার ভ্যান হয়ে উঠেছিল।
আরোগ্য-নিকেতন নাম তখন হয়েছে। তিন-তিন জন লোক খাটত। অ্যালোপ্যাথি ওষুধের কম্পাউন্ডার ছিল শশী। শশী বলত রম্রম্ প্র্যাকটিস।
মদ খেলে বলতে–জীবন মশায়ের প্র্যাকটিস—শা–; পানসী রে বাবা, পানসীর মত চলছে-সন্ সন্ সন্ সন্।
মদ হতভাগা অল্প বয়স থেকেই খায়। নবগ্রামের বামুনবাড়ির ছেলে। ওর দৌরাত্ম্যে ভাইনাম গ্যালাসিয়া, মৃতসঞ্জীবনী লুকিয়ে রাখতে হত। কোনোক্রমে পেলেই বোতলে মুখ লাগিয়ে খেয়ে নিত খানিকটা। বলত–রঙলাল দি সেকেন্ড।
জীবন মশায়ের আকাঙ্ক্ষার কথা না জেনেই বলত।
বাড়িয়ে বলত। সে আকাঙ্ক্ষা তাঁর পূর্ণ হয় নি। রঙলাল ডাক্তারের স্থান পূর্ণ করবার সাধ্য বা ভাগ্য তার নয়; রঙলালের স্থান পূর্ণ হয় না। তবুও কতকটা পূর্ণ করেছিলেন-কীর্নাহারের নবীন ডাক্তার। সদর শহরে অবশ্য তখন একজন প্রতিভাবান ডাক্তার এসেছেন; গোকুল ডাক্তার। মেডিক্যাল কলেজের সোনার মেডেল পাওয়া ছাত্র। আশ্চর্য মানুষের ভাগ্য, এমন ডাক্তারেরও শেষ পর্যন্ত দুর্নাম হয়েছিল। লোকে বলত গোকুল ডাক্তার ছুঁলে রোগী বাঁচে না। গোকুল ডাক্তারও তাঁকে সম্মান করতেন। নাড়িতে কী পেলেন—সে কথা জিজ্ঞাসা করে মন দিয়ে শুনতেন।
নবগ্রাম অঞ্চলে তখন তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
জগৎ মশায়ের মৃত্যুর পর এখানে তিন জন ডাক্তার এসে বসেছিল। দুর্গাদাস কুণ্ডু প্রথম পাসকরা ডাক্তার। দুর্গাদাস তাকে উপহাস করে বলত ঘাসপাতা জড়িবুটির চিকিৎসক।
তারপর হরিশ ডাক্তার। হরিশ তাকে মানত। কিশোরের অসুখের সময় ডায়াগনোসিসে তার কাছে ঠকে তার শিক্ষা হয়েছিল।
আর এসেছিল এক পাগল। খেতু বাড়ুরী। সে নিজে বলতকে. এম. ব্রারোরী, হোমিওপ্যাথ। ভাল লোক, সরল লোক, কিন্তু পাগল। চুরোট খেত, চায়না-কোট পরত। বলত ওদিকে হরিশ ডাক্তার, এদিকে আমি, মাঝখানে দত্তটা চাপা পড়ে মারা গেল। ওকে আর কেউ ডাকবে? নাড়ি দেখে কেমন আছে—এর জন্যে ওকে কে ডাকবে? ফুঃ!
দুর্গাগাস কুণ্ডু সর্বপ্রথম এসেছিল—চলেও গিয়েছিল সর্বপ্রথম। বলে গিয়েছিল—জানতাম না এটা গরুভেড়ার দেশ। ঘাসপাতা জড়িবুটিতে এদের অসুখ সারে। অ্যালোপ্যাথি বিলিতি ওষুধ খাটে না।
এরপর বাড়ুরীও পালাল। ছিল শুধু হরিশ। নবগ্রামের ব্রজলালবাবু চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি স্থাপন করলেন, সেখানে চাকরি পেয়ে থাকতে পেরেছিল। মাইনে ছিল তিরিশ টাকা।
জীবন দত্ত তখনই হলেন মশায়। আয় কত মনে নাই। হিসেব নাই। দিনরাত্রিতে বিশ্রাম ছিল না। আরোগ্য-নিকেতনে রোগী দেখতে বেলা তিনটে বেজে যেত।
হিন্দু, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, শূদ্ৰ, মুসলমান, পুরনো মহুগ্রামের খয়েরা, পশ্চিম পাড়ার শেখেরা, ব্যাপারিপাড়ার ব্যাপারিরা, মীরপাড়ার মিয়ারাও এসেছেন গরুর গাড়ি করে। ড়ুলি এসেছে, গাড়ি এসেছে, পালকি এসেছে। সেদিন পাঁচ ক্ৰোশ উত্তর থেকে এসেছিলেন সম্ভ্রান্ত কায়স্থ বংশের এই গৌরহরী মিত্র মহাশয়। খোলা দরজার ভিতর দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে পালকিতেই শুয়ে ছিলেন।
তিনিই সেদিন আরোগ্য-নিকেতনে প্রথম এসেছিলেন। কিন্তু জীবনমশায় শেষত্রে কলে গিয়েছিলেন নবগ্রামে। ওই নিঃস্ব জমিদার রায়চৌধুরীদের এক শরিকের বাড়ি। বৃদ্ধ গৌরাঙ্গ রায়চৌধুরী অকস্মাৎ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। সন্ন্যাস রোগ। তাকে দেখেই ওঁর কর্তব্য শেষ হয় নি, তার জীবন থাকতে গঙ্গাতীরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাতেও থাকতে হয়েছিল। বৃদ্ধকে পালকিতে গঙ্গাতীরে রওনা করে দিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। এবং প্রথমেই দেখেছিলেন মিত্র মহাশয়কে। তাঁর কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলেন।
–অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে আপনাকে। কিন্তু কী করব? আমাদের এখানকার প্রবীণ জমিদার, প্রাচীন জমিদারবংশ।
সংক্ষেপে বিবরণটুকুও বলতে হয়েছিল।
মিত্র হেসে বলেছিলেন-দত্ত মহাশয়। না, দত্ত আর নয়, আপনি এবার আপনাদের পৈতৃক শুদ্ধ মহাশয়ত্বের অধিকারী হয়েছেন। এ অবশ্য আপনারই যোগ্য কাজ। কিন্তু এদিকেও একটু লক্ষ্য রাখবেন। দূরদূরান্তর থেকে আসে সব, এরাই আপনার লক্ষ্মীর দূত। কষ্ট পেলে অবহেলা করলে ততদিনই আসবে যতদিন আর একজনকে না পাবে।
জীবন মহাশয়ের মনে একটু লেগেছিল। কথাটা লাগবার মতই কথা। তিনি বলেছিলেন অবহেলা আমি করি না। সে করলে আমার পাপ হবে, সে সম্পর্কে আমি অবহিত। কষ্ট লাঘবের চেষ্টাও আমি সাধ্যমত করি।
তাও করতেন। বেলা বেশি হলে—রোগীদের শরবত সাগু বার্লি দিতেন। আরোগ্য নিকেতনের পাশে তখন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সাহায্য নিয়ে কুয়ো করিয়েছিলেন।
বাতাসা পাটালি চিড়ে মণ্ডার দোকানও একটা বসত তখন।
মশায় আরও বলেছিলেন—আর পসারের কথা। সে ভগবানের দয়া, গুরুর শিক্ষা আর আমার নিষ্ঠা। সবচেয়ে বড় কথা-ভাগ্য। যতদিন থাকবার ততদিন থাকবে। এখন বলুন, আপনার কষ্টের কথা বলুন। কী কষ্ট: যিনি দেখেছিলেন তিনি কোনো ব্যাধি বলেছেন?
মিত্র বলেছিলেন—একটু নিরালা হলে ভাল হয়।
ওই নন্দই ছিল ঘরে। মশায় নন্দকে বাইরে যেতে ইশারা করেছিলেন। নিরালায় বলেছিলেন-কন্যার বাড়ি যাচ্ছি। শেষ বয়সে তারই স্কন্ধে ভার হয়ে পড়তে হল। বিষয়-সম্পদ সব গিয়েছে মামলায়। স্ত্রী গিয়েছেন। এটা ওটা করেই চালাচ্ছিলাম, মদ্যপান করি প্রচুর। আত্মহত্যা করতে পারি না ভয়ে। কন্যা নিয়ে যাচ্ছে, আমারও না গিয়ে উপায় নাই। পথে বের হয়ে ভাবলাম আপনাকে একবার দেখিয়ে যাই। কতদিন বাঁচব বলতে পারেন? আপনার নাড়িজ্ঞানের প্রশংসা শুনেছি। দেখুন তো আমার হাতটা।
দমে গিয়েছিলেন ডাক্তার। বলেছিলেন আমার সে শক্তি নাই। সে শক্তি কদাচিৎ কারও শোনা যায়। রোগ নাই
—রোগ আছে। লিভার বেদনা। মাথায় গোলমাল হয়।
–ও মদ্যপানের ফল। মদ্যপান করলে বাড়বে। ছাড়লে কমে যাবে। নীরবে দুটি টাকা রেখে গৌরহরি উঠলেন। জীবন বললে—আমাকে মাফ করবেন। ফি আমি নিতে পারব না। বাড়িতে এই আরোগ্য-নিকেতনে ফি নেওয়া আমাদের পূর্বপুরুষের নিষেধ আছে।
—কোনো গরিব রোগীকে টাকা দুটো সাহায্য হিসেবে দিয়ে দেবেন। আমি তো ফি না দিয়ে দেখাই না। দীর্ঘাকৃতি গৌরবর্ণ ঈষৎ কুজ মানুষটি ধীরে ধীরে চলে গিয়েছিলেন। স্পষ্ট মনে। পড়ছে তার ছবি। এরপরই এসেছিলেন আর এক অভিজাত বংশের সন্তান-ঠাকুরপাড়ার মিঞা।
–আদাব গগা ডাক্তার।
–আদাব আদাব, বসুন। কী ব্যাপার?
এককালে মিঞা সাহেবেরা ছিলেন এ অঞ্চলের অধিপতি–নবাব। খেতাব ছিল ঠাকুর। তারা নাকি যোগী বংশ। মুসলমান সমাজের গুরু। কিন্তু পরবর্তীকালে সম্পদে বৈভবে বিলাসে। হয়েছিলেন ভ্ৰষ্ট। তখন সর্বস্বান্ত। শুধু তাই নয়—বংশধারা পর্যন্ত ব্যাধিগ্রস্ত হয়েছিল।
একটু চুপ করে থেকে মৃদুস্বরে মিঞা বলেছিলেন—গায়ে যে চাকা-চাকা দাগ দেখা দিচ্ছে। মশায়। পিঠে জানতে—এই দেখেন পায়ের ডিমিতে একটা হয়েছে।
পাজামাটা তুলে দেখালেন মিঞা সাহেব।
–হুঁ! সাড় আছে?
–উঁহুঁ।
ডাক্তার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকান। চোখে পড়ে—কানের পেটি নাকের ডগা ঈষৎ লাল হয়েছে। বংশের অভিশাপ! সেই ব্যাধি! তাতেই মৃত্যু হয়েছে কয়েকজনের। দুজন এখনও ভুগছেন।
–ডাক্তার!
–বলুন ঠাকুরসাহেব।
—বলেন?
–কী বলব? বংশের রোগ বলেই মনে হচ্ছে। আপনি সময় থেকে চিকিৎসা করান। আমাদের এখানে ওষুধ নাই। তৈরি করতে অনেক খরচ। আপনি কলকাতা থেকে ওষুধ আনিয়ে। ব্যবহার করুন।
—তাই লিখে দেন ডাক্তার।
উঠলেন মিঞা সাহেব।
ড়ুলি করে এসেছেন নারায়ণপুরের ভটচাজ মশায়। বহুমূত্র হয়েছে। বহুমূত্র, বাত, নবজ্বর, পুরনো জ্বর, গ্ৰহণী, অতিসার। প্ৰহ্লাদ বাণী এসেছে। দুর্ধর্ষ লাঠিয়াল। ডাকাত। জেলখাটা আসামি।
—কী রে, তোর আবার কী?
–আর কী ডাক্তারবাবু–জল-ঘা।
–আবার? জল-ঘা অর্থাৎ উপদংশ। এবার বোধহয় প্রহাদের পঞ্চমবার।
মাথা চুলকে প্ৰহ্লাদ বলে—যে গরু অখাদ্যি খায়, সে কি ভুলতে পারে মশায়?
হাসলেন ডাক্তার।
নবগ্রামের বড়কর্তার বাড়ি যেতে হবে, ডাক আছে। তার ছোট ছেলের চতুর্থবার প্রমেহ দেখা দিয়েছে।
তাঁর বাবার কথা মনে পড়ত। তিনি বলতেন জীবনে আয়ু আর পরমায়ু কথা দুটো শুধু কথার মারপ্যাচ নয় বাবা। ওর অর্থ হল নিগৃঢ়। দীর্ঘ আয়ু হলেই পরমায়ু হয় না, আর আয়ু স্বল্প হলেই সেটা পরমায়ু হয় না এমন নয়। যার জীবন পবিত্র পরমানন্দময়, পরমায়ু হল তার। নইলে বাবা শক্তি চর্চা করেও মানুষ দীর্ঘায়ু হয়। রোগকে সহ্য করে, এমনকি জয় করে।
কথাটা তিনি এই প্রহ্লাদ সম্পর্কেই বলেছিলেন। প্রথমবার উপদংশের আক্রমণে প্রহ্লাদ চিকিৎসা করায় নি। এটা ওটা মলম ব্যবহার করেছিল। দ্বিতীয়বার এসেছিল জগৎ মশায়ের কাছে। সেই উপলক্ষেই বলেছিলেন। প্রহ্লাদ সেবার বলেছিল—লোকে দেখাতে বলছে, তাই। নইলে–ও আপুনিই ভাল হয়।
প্ৰহ্লাদ আজও বেঁচে আছে। আজও লাঠি খেলে বেড়ায়। আজও মাটির উপরে বাহু ঠুকে আছাড় খেয়ে পড়ে।
প্ৰহ্লাদ বলত—তবে চিকিৎসাতে তাড়াতাড়ি সারে। তা ওষুধ দেন।
তখন ইনজেকশন ওঠে নি। ওষুধ নিয়ে টাকা দিয়ে প্রণাম করে চলে যেত প্ৰহ্লাদ। এক টাকা ফি-ও দিত।
ডাক্তার বলতেন—ও কী রে? ফি কেন? বাড়িতে আমি ফি নিই কবে?
—এই দেখেন, বদ্যিপেনামী না দিলে রোগ যে দেহ ছাড়ে না! আর তো দোব না!
এতকালের খাতার মধ্যে প্রদের নামে বাকি হিসাব নেই।
তারপর একের পর এক আসত রোগী। আমাশয়, জ্বর, ম্যালেরিয়া, রেমিটেন্ট, টাইফয়েডও দু-একটা আসত; গ্রহণী, তা ছাড়াও কত রোগ। এক এক রোগীর তিন-চারটে রোগে মিশে সে এক জটপাকানো জটিল ব্যাপার। তাঁর বাবা বলতেন—শাস্ত্ৰে আছে সকল বিকারের অর্থাৎ রোগের আবিষ্কার আজও হয় নি। যদিও কোনো রোগ নতুন মনে হয় তবে তার নাম জান না। বলে সংকুচিত হবে না, লজ্জিত হবে না। লক্ষণ দেখে তার চিকিৎসা করবে। এ যুগে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে ল্যাবরেটরি হয়েছে। সে যুগে তাদের সে সুযোগ ছিল না।
তারপর আরম্ভ হত পাইকিরি দেখা। এ নামটা শশীর আবিষ্কার।
রোগীরা এলে—কার কী অসুখ জেনে কম্পাউন্ডারেরা দুই ভাগে ভাগ করে রাখত। সহজ রোগীদের আলাদা করে একদিকে বসত। অবশ্য অবস্থাপন্ন মান্যগণ্য রোগীদের রোগ সহজই হোক আর কঠিনই যোক তাদের দেখার কাল ছিল প্রথমেই।
পাইকিরি দেখার সময় ডাক্তার এসে বাইরে দাওয়ার উপর বসতেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকত। গোপাল কম্পাউন্ডার। রোগী দেখে ডাক্তার প্রেসক্রিপশন বলতেন—সে লিখত। শশীর উপর। তিনি নির্ভর করতে পারতেন না। অন্যমনস্ক শশী কী লিখতে কী লিখবে কে জানে? তা ছাড়া লেখার পর শশী নিজেই পড়তে পারত না কী লিখেছে। ডাক্তারকেই এসে জিজ্ঞাসা করতকী বলেছেন বলুন তো! লেখাটা ঠিক পড়তে পারছি না।
আরোগ্য-নিকেতনে তখন তিন জন কম্পাউন্ডার। শশী, গোপাল, আর কবিরাজি বিভাগে ছিল বাপের আমলের বুড়া চরণদাস সিং। নীরবে ঘরের মধ্যে বসে শুঠ আমলকী চূর্ণ করত, মোদক পাকাত, পুরিয়া বাঁধত।
ডাক্তার বলে যেতেন-কুইনিন সালফেট ১০ গ্রেন, অ্যাসিড সাইট্রিক ২০ গ্রেন, ম্যাগসালফ ১০ গ্রেন, স্পিরিট এনেসি ৫ ফোঁটা, জল।
–আগে এক ডোজ ক্যাস্টর অয়েল খাইয়ে দাও।
সে যেত। আর একজন আসত। আমাশয়। অনেক দিনের। ডাক্তার ডাকতেন—সিংমশায়। চরণদাস এসে দাঁড়াত।
—একে রেসা খাদ্মে দেবেন তো। ওটা তাদের মুষ্টিযোগ।
–তোমার কী?
–সুয্যিফোড়। সূর্যোদয়ের সঙ্গে মাথা ধরা শুরু হয় সূর্যাস্তের পর ছাড়ে। এর মধ্যে ভীষণ যন্ত্ৰণা।
জীবন দত্ত আবার ডাকতেন—সিংমশায়! সুযিফোড়ের মুষ্টিযোগ বলে দিয়ে নতুন রোগীর দিকে মন দিতেন। হঠাৎ চকিত হয়ে উঠতেন।
তিন দিন অল্প জ্বর, মাথায় যন্ত্রণা। একজুরী। জিভ দেখিজিভ দেখেই ডাক্তার সতর্ক হয়ে বসেনদেখি, নাড়ি দেখি। নাড়ি ধরে চোখ বোজেন। ও হাতটা দেখি।
–হুঁ, এস তো বাপু, টেবিলের উপর শুয়ে পড় তো। পেটটা দেখি। ঝাঁপ আছে কি না?
–হুঁ!।
—তুমি বাপু সাবধানে থাকবে। তোমাকে দুদিন ঘোরাবে বোধহয়। বুঝেছ?
নাড়িতে যেন শক্ত রোগের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। স্পষ্ট বিকাশ এখনও হয় নি। তবে মনে। হচ্ছে। জিভ পেটও তাই সমর্থন করছে। টাইফয়েড।
গোপাল, কাগজ আন। প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতেই ডাক্তার বললেন–দেখো, দুবার জ্বর ওঠানামা করে কি না। লক্ষ্য রেখো।
–আজ্ঞে না। জ্বর তত নাই। ওই একভাবে–সুতোর সঞ্চারে–
—না না! ভাল করে লক্ষ্য কোরো। ভাত–মুড়ি—এসব খেয়ো না। সাগু খাবে। সাগু। দুধ? উঁহুঁ–দুধ খেয়ো না। আর নিজে এমন করে এসো না। বুঝেছ? হ্যাঁ, ঘোরাতে পারে দুদিন।
ব্যস। এইবার গ্রামের কটি রোগীর বাড়ি যেতে হবে। তারপর নবগ্রাম। সাহাদের বাড়িতে একটা নিউমোনিয়া কেস, সুবর্ণবাবুর ছেলের রেমিটেন্ট ফিবার, রমেন্দ্রবাবুর ছোট ছেলের প্রমেহ, নেপালের স্ত্রীর সূতিকা। কেউ ফি দেবে কেউ দেবে না। যারা দেবে, তাদেরও দু-একজনের বাকি থাকবে।
এ ছাড়া পথে আরও কত জন কত বাড়ি থেকে তাকে ডাকত।—মশায়, একবার আমার ছেলেকে দেখুন। ছেলে কোলে নিয়ে পথের ধারেই দাঁড়িয়ে থাকত দু-একজন। কারও কারও বাড়ি যেতে হত। বৃদ্ধ, শয্যাশায়ী যারা—তারা পথের ধারে দাঁড়ায় কী করে?
—মশায়, একবার যদি আমার মাকে দেখে যান!
মনে পড়ছে, সেদিন সেতাব তাকে যোগী বাঁড়ুজ্জেকে দেখতে ডেকেছিল।
জীবন, একবার বাপু যোগী বাড়জ্জেকে দেখে যা। ছেলেপুলে নাই, আমাকেই বললে যোগী–যদি জীবন মশায়ের সঙ্গে দেখা হয় বোলো, একবার যেন দেখে যান আমাকে। চ্যারিটেবল ডিসপেনসারির ওষুধে তো কিছু হল না।
সেতাব নেপাল এরা দুজনে এইসব রোগীদের পৃষ্ঠপোষক ছিল। ওরা তার জন্যে প্রতীক্ষা করে থাকত।
জীবন দত্ত হাসিমুখেই যেতেন। ওদের বলতেন—বলিস বুঝলি, খবর দিয়ে বলিস। আমি দেখে যাব।
নেপাল খবর আনত–হরিহর ডোম খুব ভুগছে। চল একবার যাবি। গোপলা বাউরির মায়ের জ্বর, তাকেও একবার দেখে যাবি চল।
হরিহরের অসুখ ভাল হলে তার কাছে একটা পাঁঠা আদায় করবে নেপাল। সে জীবন দত্ত জানতেন। এবং সেই পাঠাটা নিয়ে চাল ডাল ঘি মসলা তরিতরকারি নেপাল নিজে দিয়ে একদিন ফিস্ট করবে। জীবন দত্তকে দিতে হবে-মাছ-মিষ্টি।
বাড়ি ফিরতে অপরা। পকেটে টাকায় আধুলিতে দশ-বার টাকা। ফি ছিল তখন এক টাকা। দিনান্তে ফি একবার। দ্বিতীয়বারের ফিয়ের রেওয়াজ ছিল না। জামাটা খুলে দিতেন। আতর-বউকে। ছেলে বনবিহারী মেয়ে সুষমা এসে দাঁড়াত।
–বাবা পয়সা!
জীবন দত্ত ফেরবার পথে আধুলি ভাঙিয়ে নিয়ে ফিরতেন। তার মধ্যে পয়সা কিছু থাকতই। বনুর চারটি, সুষমার দুটি। বনু নিত ডবল পয়সা, বলত, বড় পয়সা নোব। সুষমার ছোটবড় বিচার ছিল না; দুটি হলেই সন্তুষ্ট হত। ছেলে আর মেয়ে। নোট-বইটা খুে লিখে রাখতেন–রমেন্দ্রবাবুর বাড়ির ফি বাকি রইল।
বাড়ির বাইরে তখন আরোগ্য-নিকেতনের সম্মুখে বামনি গায়ের শেখেদের গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে আছে। কৃষ্ণপুরের লোক এসেছে। কায়স্থপ্রধান সমাজ কৃষ্ণপুর। মিত্রদের বাড়ির চিঠি নিয়ে এসেছে—দত্ত মহাশয়, একবার দয়া করিয়া আসিবেন। আমার জ্যেষ্ঠ পুত্রের একজ্বরী জ্বর। রাঘবপুরের কবিরাজ দেখিতেছিলেন কিন্তু কিছু হইতেছে না। ইতি সুরেশচন্দ্র মিত্র।
গৌরহরি মিত্তিরের কথাটি নন্দ মনে করে রেখেছে। যখন-তখন বলে। জীবনমশায় হাসলেন; আসলে ওটা নর ক্ষোভ। সেকালের আরোগ্য-নিকেতনের গৌরবের যে ওরাও অংশীদার ছিল। পাওনাও হত অনেক। সেকালে ছিল কাঠের কলবাক্স। যেখানে মশায় পায়ে হেঁটে যেতেন সেখানে নন্দ বা ইন্দির যেত কলবাক্স মাথায় নিয়ে। কারুর বাড়ি দু আনা কারুর বাড়ি চার পয়সা প্রাপ্য হত ওদের। আজ বলতে গেলে সময়মত ওরা মাইনেই পায় না।
দিন যায়, ফেরে না। দিনের সঙ্গে কাল যায়। কালের সঙ্গে গতকালকার নূতনের বয়স বাড়ে, পুরনো হয়, জীৰ্ণ হয়, যা জীর্ণ তা যায়। তাঁর খ্যাতিও গিয়েছে। তাতে আক্ষেপ নেই, কিন্তু দুঃখ একটু হয় বৈকি। উপেক্ষা সহ্য হয় না। তাকে উপেক্ষা করলেও তিনি দুঃখ পেতেন। না। এ যে বিদ্যাকে উপেক্ষা!
–আসুন। তাকে আহ্বান জানালে মোহান্তের শিষ্য ভোলানাথ। পথের উপর দাঁড়িয়ে আছে। মহাপীঠের চারিপাশের বনভূমির একটি বিচিত্ৰ গন্ধ আছে। কত রকমের ফুল এবং বিচিত্রগন্ধা লতা যে আছে এর মধ্যে! অনন্তমূলের রাজ্য বললে হয়।
ভোলানাথ বললে, সকাল থেকে আপনার জন্যে তাগাদা লাগিয়েছে বুড়ো। ডাক মহাশয়কে। নাড়ি দেখুক!
১৯. সন্ন্যাসী
সন্ন্যাসী সকালে সুস্থভাবেই অল্প মাথা তুলে শুয়ে রয়েছেন। যন্ত্রণা নেই। বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। জীবন দত্তকে দেখে বললেন–আইসো রে ভাই মহাশয়, আইসো! কাল রাতে তুমি আসিয়েছিলে ভাই, তখন আমি ঘুমিয়েছি। ওহি শশী বেটা কী একঠো দাওয়াই দিলে—ব্যস, পাঁচ মিনিট কো ভিতর বে-হোঁশ হইয়ে গেলাম।
–আজ তো ভাল আছেন। ওষুধে তো ভাল ফলই হয়েছে। হাসলেন জীবন।
–কে জানে ভাই! ঘাড় নাড়লেন।
–কেন? কোনো যন্ত্রণা রয়েছে এখন? আর অসুখ কী?
–ঠিক সমঝতে পারছি না। হাতটা তুমি দেখ ভাই। দেখ তো দাদা, ছুটি মিলবে কি না।
–ছুটি নিতে ইচ্ছে হলেই মিলবে। ইচ্ছে না-হলে তো আপনাদের ছুটি হয় না।
–সে পুণ্য আমার নাই ভাই।
সে পুণ্য সন্ন্যাসীর নাই তা জীবন দত্ত বুঝেছেন। থাকলে বুঝতে পারতেন—কালকের অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে গাঁজা না খাওয়ার যন্ত্রণাটাই ছিল ষোল আনার মধ্যে বার আনা কি চোদ্দ আনা। সে সূক্ষ্ম অনুভূতি তাঁর গিয়েছে, মন জীর্ণ হয়েছে বেশি। যাদের যোগের সাধনা থাকে তাদের মন অদ্ভুত শক্তিশালী, দেহের জীর্ণতা তাদের স্পর্শ করতে পারে না, মনে তখন বাসনা জাগে জীৰ্ণ দেহ ত্যাগ করে নূতন দেহ লাভের। এ কথা এ দেশের পুরনো কথা-বাবার কাছে শুনেছেন, আরও অনেক প্রবীণের কাছে শুনেছেন। প্রদ্যোতেরা একথা বিশ্বাস করবে না হাসবে; কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন। মশায় সন্ন্যাসীর হাতখানি তুলে নিলেন।
সন্ন্যাসী ক্ষীণকণ্ঠেই বললেন–মনে নিছে ভাই কি ছুটি মিলবে। কাল রাতে যেন মনে হইল। রে ভাই কী-উধার থেকে দশবারটা খড়মকে আওয়াজ উঠছে। আউর মনে হইল রঘুবরজীর আওয়াজ মিলছে। ওহি জঙ্গলের পঞ্চতপার আসনসে হকছে, আও ভাইয়া! আও!
কথাগুলির অৰ্থ বুঝতে জীবন মশায়ের বিলম্ব হল না।
ও–ধারে–জঙ্গলের মধ্যে এখানকার পূর্বতন মহান্তদের সমাধি আছে। সেখান থেকে খড়মের আওয়াজ শুনেছেন সন্ন্যাসী। অর্থাৎ তারা এসেছিলেন একে আহ্বান জানাতে। রঘুবরজী এই সন্ন্যাসীর গুরুস্থানীয় এবং এর ঠিক আগের মহান্ত। তিনি ছিলেন সত্যকারের যোগী। যোগ সাধনায় দেহের ভিতরের যন্ত্রগুলিকে যেমন শক্তিশালী করেছিলেন, বিচিত্র ব্রত পালন করে বাইরে প্রকৃতির প্রভাব সহ্য করবার শক্তিও তিনি তেমনি আয়ত্ত করেছিলেন। বৈশাখে পঞ্চতপ ব্ৰত করতেন—সূর্যোদয়ের সঙ্গে পাঁচটি হোমকুণ্ড জ্বেলে—ঠিক মাঝখানে আসন গ্রহণ করতেন, সারাদিন আসনে বসে পর পর কুণ্ডে কুণ্ডে আহুতি দিয়ে সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের পর সে দিনের মত হোম শেষ করে উঠতেন। আবার শীতে ওই গাছতলায় অনাবৃত দেহে বসে জপ করতেন; প্রথম। পাখির ডাকের পর আসন ছেড়ে হিমশীতল পুষ্করিণীতে নেমে সূর্যোদয় পর্যন্ত অর্থাৎ উত্তাপ সঞ্চয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত জলে গলা ড়ুবিয়ে বসে থাকতেন তিনিও তাঁকে ডেকেছেন, বলছেন।
সাধারণ মানুষ মৃত্যুর পূর্বে মৃত স্বজনকে দেখেন। তাঁরা নাকি নিতে আসেন।
সন্ন্যাসীর স্বজন বিস্মৃতির গহনে হারিয়ে গিয়েছে। এখানকার মহান্তেরাই তাঁর স্বজন, পূর্বপুরুষ—তাদেরই তিনি দেখেছেন।
নাড়ি দেখে হাত নামিয়ে জীবন দত্ত বললেন–বাবা। ছুটি আসছে আপনার। আজ সন্ধ্যার পর। কাল যখন অসুখ খুব বেড়েছিল—সেই সময়। সেই রকম মনে হচ্ছে বাবা।
এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল সন্ন্যাসীর বিশীর্ণ বার্ধক্যশুষ্ক ঠোঁট দুটিতে। আবার একটা দীর্ঘনিশ্বাসও ফেললেন তিনি।
আজ চল্লিশ বৎসর সন্ন্যাসী এখানে আছেন। তিরিশ বৎসরের উপর তিনি এই দেবস্থানের মহান্ত। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বৎসর বয়সে এখানে প্রথম এসেছিলেন তিনি। কিন্তু দেখে মনে হত তিরিশ বছরের জোয়ান। লম্বা-চওড়া কুস্তি-করা পালোয়ানী শরীর। শাস্ত্রটাস্ত্র জানতেন না, গাঢ় বিশ্বাস আর কয়েকটি নীতিবোধ নিয়ে মানুষটির সন্ন্যাস। সন্ত না থোক, সাধু মানুষ ছিলেন।
প্রথম পরিচয় হয়েছিল বিচিত্রভাবে।
দেশের তখন একটি ভয়াবহ অবস্থা। মড়ক চলছে, মহামারী কলেরা লেগেছে দেশে। এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রাম—সেখান থেকে আর এক গ্রাম; বৈশাখের দুপুরে খড়ের চালের আগুনের মত লেলিহান গ্রাস বিস্তার করে ছড়িয়ে পড়ল। সেকালে তখন কলেরার কোনো ওষুধ ছিল না। ক্লোরোডাইন সম্বল। কবিরাজিতে ওলাউঠার ওষুধ তেমন কার্যকরী নয়। ক্লোরোডাইন দেবারও চিকিৎসক নাই। যারা আছে তারা নিজেরাই ভয়ে ত্রস্ত। হরিশ ডাক্তার কলেরায় যেত না। হোমিওপ্যাথ ব্রারোরী তখন পালিয়েছে। থাকলে সেও যেত না। নতুন একজন ডাক্তার এসেছিল নবগ্রামে, সেও একদিন রাত্রে পালিয়ে গেল—কলেরা কেসে ডাকের ভয়ে।
চারদিকে নানা গুজব। সেকালের বিশ্বাসমত ভয়ঙ্কর গুজব। কলেরাকে নাকি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সন্ধ্যার মুখে তাকে দেখা যায়। শীর্ণ কঙ্কালসার শরীর, চোখে আগুনের মত দৃষ্টি, পিঙ্গল রুক্ষ চুল, দন্তুর একটি মেয়ে; পরনে তার একখানা ক্লেদাক্ত জীৰ্ণ কাপড়, বগলে একটা মড়া-বওয়া তালপাতার চাটাই নিয়ে সেই পথ ধরে গ্রামে ঢোকে—যে পথ ধরে গ্রামের শব নিয়ে শ্মশানে যায়। সন্ধ্যায় ঢোকে, যার সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয় সেই হতভাগ্যই সেই রাত্রে কলেরায় আক্রান্ত হয়। মরে। তারপর রোগ ছড়ায় ঘরে ঘরে পাড়ায় পাড়ায়।
লোকে পালাতে লাগল গ্রাম ছেড়ে।
অবস্থাপন্নেরা আগে পালাল। নবগ্রামের বাবুরা তার মধ্যে সর্বপ্রথম। তারপর সাধারণ লোকেরা।
থাকল গরিবেরা আর অসমসাহসী জনকয়েক, তার মধ্যে মাতাল গাঁজালেরা সংখ্যায় বেশি। মদ খেয়ে গাঁজা টেনে ভাম হয়ে বসে থাকত। কালীনাম হরিনাম করে চিৎকার করত।
তিনিও হরিনাম করতেন।
চিরকালই তিনি সংকীর্তনের দলের মূলগায়েন করেন। গলা তার নাই, সুকণ্ঠ তিনি নন, তবে গান তিনি বোঝেন এবং গাইতেও তিনি পারেন। হ্যাঁ, তা পারেন। দশ কুশীতে সংকীর্তন এখনও তিনি গাইতে পারেন। তাঁর সঙ্গে পাল্লা দেবার লোক এখন আর নাই। থাকবে কোথায়? এসব বড় তালের গানের চর্চা উঠে গেল। কতই দেখলেন। হারমোনিয়াম-গ্রামোফোন, এখন রেডিও। নবগ্রামের কয়েকজনের বাড়িতেই রেডিও এসেছে। শুনেছেন তিনি। সে গান আর এ গান! সেই—দেখে এলাম শ্যাম—সাধের ব্ৰজধাম—শুধু নাম আছে। হায় হায়! শুধু নামই আছে আর কিছু নাই শ্যাম! রাধা স্বৰ্ণলতা তমালকে শ্যাম ভেবে জড়িয়ে ধরে ক্ষতবিক্ষত দেহে ধুলায় ধূসরিত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে হতচেতন হয়ে!।
তিনি প্রতি সন্ধ্যায় সংকীর্তনের দল নিয়ে পথে পথে ঘুরতেন। বিশ্বাস করতেন এই নামকীর্তনে অকল্যাণ দূর হয়। গ্রামে গ্রামে মদ্যপায়ীরা রক্ষাকালী পূজা করাত। তাদেরও সে বিশ্বাস ছিল গভীর।
গভীর রাত্রে পথ-কুকুরে চিৎকার করে চিরকাল। সে চিৎকার যেন বেশি হয়েছে। এবং সে চিৎকারের একটি যেন গূঢ় অর্থ পাওয়া যাচ্ছে। চিৎকারের মধ্যে ক্ৰোধ নাই ভয় আছে। তারা রাত্রে ওই পিঙ্গলকেশিনীকে পথে বিচরণ করতে দেখতে পায়। ভয়ার্ত চিৎকার করে তারা। ঘরে ঘরে অর্ধঘুমন্ত মানুষেরা শিউরে ওঠে।
জীবন ডাক্তারের মৃত্যুভয় ছিল না। তিনি ঘুরতেন। কিন্তু কী করবেন ঘুরে?
শেষে ছুটে গিয়েছিলেন রঙলাল ডাক্তারের কাছে। বলুনওষুধ বলে দিন।
দীর্ঘকাল পরে বৃদ্ধ রঙলাল তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। মেডিকেল জার্নাল পেড়ে বসলেন। তারপর প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন-ওয়ান সিক্সথ গ্রেন ক্যালোমেল আর সোডা বাইকার্ব। ঘণ্টায়-ঘণ্টায় খাওয়াও। এ ছাড়া এখানে এ অবস্থায় আর কিছু করবার নাই।
অনেক প্রাণ রক্ষা পেয়েছিল ওই ওষুধে। দিন নাই রাত্রি নাই জীবনমশায় ঘুরতেন। পিতৃবংশের সম্মান! গুরু রঙলালের আদেশ! নিজের প্রাণের বেদনা।
রঙলাল ডাক্তার প্রেসক্রিপশন দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—ভাল কথা, জীবন, তুমি নাকি খুব তারস্বরে চিৎকার করে হরিনাম সংকীর্তন করে কলেরা তাড়াচ্ছ?
অট্টহাস্য করে উঠেছিলেন।
জীবন লজ্জিত যে একেবারে হন নি তা নয়। তা হলেও অপ্রতিভ হন নি। বলেছিলেন কী করব? লোকেরা বিশ্বাস করে ভরসা পায়।
—তুমি নিজে?
জীবন একটু বাঁকা উত্তর দিয়েছিলেন–সবিনয়ে বলেছিলেন-আপনি তো জানেন আমি কোনোদিনই নাস্তিক নই।
–তাতে আমি অসন্তুষ্ট নই, আপত্তিও করি না জীবন। নাম-সংকীর্তন করলেও আপত্তি করব না, তবে সে সংকীর্তন শুধু সপ্ৰেমে কীর্তনের জন্য হওয়া উচিত। আমাকে দাও, আমাকে বাঁচাও, আমার শত্ৰু নাশ কর, এই কামনায় সংকীর্তন আমি পছন্দ করি না। ওতে ফলও হয় না।
জীবন বলেছিলেন—আগুন-লাগা বনের পশুর মত মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছে। জানেন, আমি যেন চোখে দেখছি।-উত্তেজিত হয়ে আবেগের সঙ্গেই জীবন সেদিন রঙলাল ডাক্তারের সামনে দার্শনিকতা করে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন—মরণ তেড়ে নিয়ে চলেছে জীবনকে। একেবারে এলোকেশী এক ভয়ঙ্করী-হাত বাড়িয়ে ছুটেছে, গ্রাস করবে, অনন্ত ক্ষুধা! আর পৃথিবীর জীবকুল ভয়ে পাগলের মত ছুটছে। ছুটতে ছুটতে এলিয়ে পড়েছে, মৃত্যু তাকে গ্রাস করছে। অহরহই ওই তাড়ায় তেড়ে নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যু। এখানে ভগবানের নাম করে তাকে ডেকে ভরসা সঞ্চয় করা ছাড়া করবে কী মানুষ?
রঙলাল ডাক্তার এর উত্তরে সেদিন ব্যঙ্গ করেন নি। প্রসন্ন হেসে বলেছিলেন, ব্যাপারটা তাই বটে জীবন। হারজিতের একটা লড়াই-ই বটে। কিন্তু ওইটেই যেমন চোখে পড়েছে তেমনি চোখ যদি আরও তীক্ষ্ণ হত তবে দেখতে পেতে, এক-একটা মানুষ কেমন করে ঘুরে দাঁড়ায়, বলে,—এস! তুমি যে ওই ভয়ঙ্কর বেশে আসছ, তোমার আসল রূপটা দেখি। কিংবা বলে–তোমাকে আমি ধরা দিচ্ছি, কিন্তু যারা পালাচ্ছে বাঁচতে দাও। তখন মরণের ভয়ঙ্কর মুখোটা খসে যায়। দেখা যায় সে বিশ্ববিমোহিনী। তা ছাড়া তুমি জান না, মরণ যত গ্রাস করছে তার দ্বিগুণ জীবন জন্ম নিয়ে চারদিক থেকে কুক দিয়ে বলছে—কই ধর তোে! হারছে না তারা। আরও একটা কথা বলি। মানুষ হারে নি। মহামারীতে কতবার কত জনপদ নষ্ট হয়েছে। আবার কত জনপদ গড়েছে। শুধু গড়েই ক্ষান্ত হয় নি। সে রোগের প্রতিষেধক বার করে চলেছে। ওখানেই তাকে হারানো যায় নি। সে হারে নি। মরবে সে। কিন্তু এইভাবে সে মরবে না। মহাগজের মত মরবে না। যেদিন বৃদ্ধ হবে, জীবনের আস্বাদের চেয়ে মৃত্যুর আস্বাদ ভাল লাগবে, সেইদিন মহাগজ যেমন নিবিড় অরণ্যে গিয়ে শত বৎসরের এক খাদের মধ্যে আকাশ বিদীর্ণ করে ধ্বনি। তুলে আমি চললাম বলে দেহত্যাগ করে, তেমনি করে মরবে। হাতিরা এইভাবে পুরুষানুক্রমিক শ্মশানভূমিতে গিয়ে দেহত্যাগ করে থাকে। কেন জান? পাছে তার রোগ বা পচনশীল দেহ থেকে রোগ উৎপন্ন হয়ে অন্য হাতিদের আক্রমণ করে।
এই মহামারী থামবার পর সন্ন্যাসীর সঙ্গে আলাপ। এই মহামারীর পর এখানে তিনি সমাজের প্রধান হয়ে উঠেছিলেন। নবগ্রামের বাবুদের উপেক্ষা করে সরকার তাকে প্রেসিডেন্ট পঞ্চায়েত মনোনীত করছিলেন। সেই প্রেসিডেন্ট পঞ্চায়েত হিসেবে একটি কলহের মীমাংসায় তিনি এসেছিলেন এই মহাপীঠে।
সন্ন্যাসী এসে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল—আরে ভাইয়া, তুমহারা নাম জীওন মহাশা। তুমি নাকি বড়া ভারি বীর? আও তো ভাই পাঞ্জা লঢ়ে এক হাত।
পাঞ্জার লড়াইয়ে তিনি হেরেছিলেন, কিন্তু সহজে হারাতে পারে নি সন্ন্যাসী। বেশ খানিকটা বেগ পেতে হয়েছিল।
তারপর কতদিন কত কথা আলাপ হয়েছে।
একদিনের কথা মনে পড়ছে। এই চণ্ডীতলার মেলায় জুয়া খেলার আসরে শেষ কপদক হেরে সন্ন্যাসীর কাছে এসে বলেছিলেন আমায় একশো টাকা দিতে হবে গোঁসাইজী। কাল পাঠিয়ে দেব।
তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে গোঁসাই টাকাটা তাকে দিয়েছিলেন এই দেবস্থলের তহবিলের টাকা। ডাক্তার এসে আবার বসেছিলেন জুয়ার তক্তপোশে। ঘণ্টাখানেক পরেই গোঁসাই এসে তাকে হাত ধরে টেনে বলেছিলেন-আব উঠো ভাই। বহুত হুয়া।
জুয়াড়ীকে বলেছিলেন–জানতা হ্যায় ইন্ কোন হ্যায়? হিয়াকে বড়া ডাগরবাবু আওর প্রেসিডেন্ট পঞ্চায়েত। ইনকা রুপেয়া যো লিয়া—দে দেও ইনকে।
ডাক্তার বলেছিলেন না। আর মাত্র কুড়ি টাকা হেরে আছি। ওটা ওর প্রাপ্য। চলুন।
পথে সন্ন্যাসী বলেছিলেন-কথাটা তার অন্তরে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে বলেছিলেন-কাহে ভাই মহাশা-তুম মহাশা বন্শের সন্তান মহাশা-তুম ভাই জুয়া খেলো, রাতভর দাবা খেলো, খানাপিনামে এই হল্লা করো–এ কেয়া ভাই? ভগবান তুমকো কেয়া নেহি দিয়া, বোলো? কেঁও, তুমহারা ঘরকে মতি নেহি?
ওঃ! সে একটা সময়! দেহে অফুরন্ত সামৰ্থ, মনে দুরন্ত সাহস, বিপুল পসার, মানসম্মান, ঘরকা সংসার কোনো কিছুই মনে থাকত না। তবে কোনো অন্যায় করতেন না। জুয়ো খেলাটা ছিল শখ। ওটা সে আমলের ধারা। তবে সংসারে যদি–।
অকস্মাৎ তাঁর চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল।
একটা প্রশ্ন জেগে উঠল মনের মধ্যে। বিপিনরতনবাবুর ছেলে বিপিনের জীবনে কি? সংসারজীবনে বিপিনের গোপন দুঃখ ছিল? অশান্তি? বাইরে ছুটে বেড়াত প্ৰতিষ্ঠা যশ কুড়িয়ে বেড়াত কিন্তু তবু তৃষ্ণা মিটত না, ক্ষুধা মিটত না। ছুটত ছুটত ছুটত। অথবা রিপু? মানুষের সাধনার পথে আসে সিদ্ধি। সে আসার আগে আসে প্রতিষ্ঠা। জাগিয়ে তোলে লালসা। আরও চাই। ওই তো রিপু। ওর তাড়নায় ছুটতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে মানুষ। সামনে এসে দাঁড়ায় সেই পিঙ্গলকেশিনী।
***
রতনবাবুর ছেলে বিপিনের হেঁচকি থামে নি, তবে কমেছে। রক্তের চাপও খানিকটা নেমেছে। রতনবাবু প্রসন্ন হাস্যের সঙ্গেই বলছেন—তোমার ওষুধে ফল হয়েছে জীবন। তুমি একবার নাড়িটা দেখ। আমার তো ভালই লাগছে।
জীবনমশায়ও একটু হাসলেন। হাসির কারণ খানিকটা কথাগুলি ভাল লাগার জন্য; খানিকটা কিন্তু ঠিক বিপরীত হেতুতে। হায় রে, সংসারে ব্যাধিমুক্তি যদি সহজে সম্ভবপর হত! এত সহজে যদি ভাল হয়ে উঠত মানুষ!
হাসির কারণ আরও খানিকটা আছে। রতনবাবুর মত মানুষ। পণ্ডিত মানুষ, জ্ঞানী ব্যক্তি, একমাত্র সন্তানের এই ব্যাধি হওয়ার পর তিনি ডাক্তারি বই আনিয়ে এই ব্যাধিটি সম্পর্কে পড়াশুনা করে সব বুঝতে চেয়েছেন, বুঝেছেনও; এবং পৃথিবীতে মানুষের জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বের মর্মান্তিক তত্ত্বও তিনি ভাল করেই জানেন—তাকেও এইটুকুতে আশান্বিত হয়ে উঠতে দেখে হাসলেন।
রতনবাবু আবার বললেন–দেখ, আমার অনেকদিন থেকেই ইচ্ছা ছিল যে, কবিরাজি মতেই চিকিৎসা করাই। বিলাতি চিকিৎসার অদ্ভুত উন্নতি হয়েছে, কিন্তু ওদের ওষুধগুলো আমাদের দেশের মানুষের ধাতুর পক্ষে উদ্র। আমাদের ঠিক সহ্য হয় না। ক্রিয়ার চেয়ে প্রতিক্রিয়ার ফল গুরুতর হয়।
বৃদ্ধ এই নৈরাশ্যের তুফানের মধ্যে একগাছি তৃণের মত ক্ষীণ আশার আশ্রয় পেয়ে উল্লসিত হয়ে উঠেছেন, কথা বলতে তার ভাল লাগছে।
—তবে আমার মনের কথা আমি কাউকে বলি না। বুঝেছ ভাই। ওটা আমার প্রকৃতিধর্ম নয়। বিপিনের নিজের বিশ্বাস নাই। বউমার নাই। বিপিনের বড় ছেলে এম. এ. পড়ছে, সে তো একটু বেশি রকমের আধুনিকপন্থী। তাদেরও বিশ্বাস নাই। আমি বললে তারা কেউ আপত্তি করবে না, সে আমি জানি; মুখ ফুটে কেউ কোনো কথা বলবে না কিন্তু অন্তরে অন্তরে তো তাতে সায় দেবে না; মনের খুঁতখুঁতুনি তো থাকবে। সেক্ষেত্রে আমি বলি না, বলব না। তবে কাল যখন ডাক্তারেরা সকলেই বললেন– যে, হেঁচকি থামাবার আর কোনো ওষুধ আমাদের নাই, তখন। আমি তোমার কথা বললাম। আজ সকালে ডাক্তারদেরও ডেকেছি, তারাও আসবেন, হাসপাতালের প্রদ্যোত ডাক্তার, হরেন সবাই আসবেন। সকলে মিলে পরামর্শ করে একটা ব্যবস্থা কর ভাই।
গম্ভীর হয়ে উঠলেন জীবনমশায়। বললেন–দেখ রতন, শুধু হেঁচকি বন্ধ করবার জন্য আমাকে তোমরা ডেকেচ্ছ। আমি ভাই তার ব্যবস্থাই করেছি। তা কমে এসেছে, হয়ত আজ ওবেলা পর্যন্ত হেঁচকি বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর একটা পথ ধরতে হবে। আমি কবিরাজিও জানি অ্যালোপ্যাথিও করি। আমি বলছি ভাই-দু নৌকায় দু পা রেখে চলা তো চলবে না। হয় কবিরাজি নয় অ্যালোপ্যাথি দুটোর একটা করতে হবে। ওঁরাও ঠিক এই কথাই বলবেন।
একটু চুপ করে থেকে বললেন–আর আজ এখন তো আমি অপেক্ষা করতে পারব না। আমার বাড়িতে কয়েকজন রোগীই বসে আছে। ভোরবেলা চণ্ডীতলার মোহান্তকে দেখতে গিয়েছিলাম। পথে বিপিনকে দেখে যাচ্ছি। হেঁচকি কমেছে, আমি নিশ্চিন্ত। আমি বিপিনকে দেখে যাই, তারপর ওঁরা আসবেন দেখবেন, পরামর্শ করে যা ঠিক হবে আমি ওবেলা এসে। শুনব।
বৃদ্ধ রতনবাবু বিষণ্ণ হলেন, তবুও যথাসম্ভব নিজেকে সংযত করে প্রসন্নভাবেই বললেন– বেশ! তাই দেখে যাও তুমি। তুমি যা বলবে ওঁদের বলব।
বিপিন সত্যই একটু ভাল আছে। নাড়িতে ভাল থাকার আভাস পেলেন জীবন দত্ত। কিন্তু ভাল থাকার উপর নির্ভর করে আশান্বিত হয়ে উঠবার মত বয়স তার চলে গেছে। বললেন, ভালই যেন মনে হচ্ছে। তবে ভাল থাকাটা স্থায়ী হওয়া চাই রতন।
–নাড়ি কেমন দেখলে, বল।
—যা দেখলাম তাই বলেছি রতনবাবু! তোমার মত লোকের কাছে রেখেঢেকে তো বলার প্রয়োজন নাই এবং তা আমি বলব না। তোমাকে আমি জানি।
রতনবাবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।
জীবনমশায় হেসে বললেন–আমি কিন্তু নৈরাশ্যের কথা কিছু বলি নি রতন। এই ভাবটা যদি স্থায়ী হয় তা হলে ধীরে ধীরে বিপিন সেরে উঠবে। হেঁচকি আজই থামবে। তারপর আর যদি কোনো উপসর্গ না বাড়ে তা হলে দশ-বার দিনের মধ্যে যথেষ্ট উন্নতি হবে। ভাল থাকাটাকে স্থায়ী ভাব বলব, বুঝেছ? বলব হ্যাঁ আর ভয় নাই। সাবধানে থাকতে হবে। আর এখান ওখান প্র্যাকটিস করে বেড়ানো চলবে না। ওই বাড়িতে বসে যা হয়, তাও বেশি পরিশ্রম চলবে না।
–ওই তো! ওই তো রোগের কারণ। বার বার বারণ করেছি। বার বার। কিন্তু শোনে কি? কী বলব? কী করব? উপযুক্ত ছেলে। গণ্যমান্য ব্যক্তি। জীবনের কোনোখানে কোথাও কোনো দোষ নাই, অমিতাচার নাই, অন্যায় নাই, আহারে লোভ নাই, অন্যায় পথে অর্থোপার্জনের মতি নাই, কোনো নেশা নাই; সিগারেট পান পর্যন্ত খায় না; ক্রোধ নাই; বিলাসী নয়; শুধু ওই প্র্যাকটিস। প্র্যাকটিস আর প্র্যাকটিস। তাও তোমাকে বলছি ভাই, প্র্যাকটিস যে অর্থের জন্যে তাও নয়। ওই মামলা জেতার নেশা। এ জেলা ও জেলা, এ কোর্ট ও কোর্ট সে কোর্ট। তারপর মাসে দুবার তিনবার হাইকোর্টে কেস নিয়ে গিয়েছে। ওই মামলা জেতার নেশা, যে মামলায় হার হয়েছে, হাইকোর্টে তাই ফিরিয়ে আনতে হবে। তা এনেছে। ও নেশা কিছুতেই গেল না। ঘর দেখে নি, সংসার দেখে নি, ছেলেপুলে স্ত্রী নিয়ে আনন্দ করে নি, আমার ঘাড়ে সব ফেলে দিয়ে ওই নিয়ে থেকেছে। আমি কতবার বলেছি–বিপিন, এও তোমার রিপু। রিপুকে প্রশ্রয় দিয়ো না। প্রশ্রয় পেলে রিপুই ব্যাধি হয়ে দেহ-মনকে আক্রমণ করে হয়ত–। বাপ হয়ে কথাটা তো উচ্চারণ করতে পারতাম না ভাই।
জীবন দত্ত বললেন– যাক এবার সেরে উঠুক। সাবধান আপনিই হবে।
একটি কিশোর ছেলে এসে দাঁড়াল, আপনার ফি। এইটিই বিপিনের বড় ছেলে। চমৎকার ছেলে।
—এ কী? চার টাকা কেন? আমার ফি দু টাকা!
দুটি টাকা তুলে নিয়ে জীবনমশায় পকেটে ফেলে বেরিয়ে পড়লেন। ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল। বলল—আপনি কি ডাক্তাররা যখন আসবেন তখন থাকবেন না?
–আমি? আমি থেকে কী করব?
–আপনার মতামত বলবেন।
–আমি তো শুধু হিকার জন্য ওষুধ দিয়েছি। ওটা একটা উপসর্গ। মূল চিকিৎসা তো ওঁরাই করছেন। হাসলেন জীবন ডাক্তার।
ছেলেটি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ বললে—ওবেলা একবার আসবেন না?
—আসব? আচ্ছা আসব।
ডাক্তার চলে গেলেন।
বিপিন বোধহয় বাঁচবে না। ভাল খানিকটা মনে হল বটে কিন্তু আজ যেন স্পষ্টই তিনি নাড়ি দেখে অনুভব করেছেন—মৃত্যু আসছে। আসছে কেন ইতিমধ্যেই এসে দাঁড়িয়েছে। ছায়া পড়ছে তার। রনবাবুর কথা ভাবলেন। বড় আঘাত পাবে রতন। নিজের কথা মনে পড়ল। তার ছেলে বনবিহারী মারা গেছে। বিপিনেরই বয়সী সে। একান্ত তরুণ বয়সে বনবিহারী মারা গেছে; নিজের অমিতাচারে, মদ্যপান এবং তার আনুষঙ্গিক অনাচার করে নিজেকে জীৰ্ণ করেছিল, তার উপর ম্যালেরিয়ায় ভুগে নিজেকে ক্ষয় করেছিল সে। বিপিন নিজেকে অতিরিক্ত কৰ্মভারে পীড়িত করে ক্ষয় করেছে।
রতনবাবুর কথাগুলি মনে পড়ল। ঘর দেখে নি, সংসার দেখে নি, ছেলেপুলে স্ত্রী নিয়ে আনন্দ করে নি। শুধু কাজ, কাজ, মামলা মামলা মামলা। কতবার রতনবাবু বলেছেন–বিপিন, এও তোমার রিপু–!
রিপুই বটে। বড় ভয়ঙ্কর রিপু। বড় ভয়ঙ্কর। তিনি নিজে ভুগেছেন যে! জীবন্তে মৃত্যু ঘটেছে বলে তিনি তার হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়েছেন। বনবিহারীর মৃত্যুর পর তিনি চিকিৎসায় অমনোযোগী হয়েছেন এবং কাল অগ্রসর হয়ে তাকে পুরনো জীর্ণ বলে ঘোষণা করেছে। আজ তাঁর অবস্থা গজভুক্ত কপিথের মত। সত্য বলতে গেলে এ তো তার মৃত্যু।
–কেমন দেখে এলি? রতনবাবুর ছেলেকে?
–সেতাব?
সেতাবের বাড়ি এসে পড়েছেন, খেয়াল ছিল না।
—কী দেখলি?
—দেখব আর কী? আমি তো দেখছি না। দেখছে ডাক্তাররা। আমাকে ডেকেছিল হিষ্কা বন্ধের জন্যে। তা কমেছে। বোধহয় সন্ধ্যা পর্যন্ত হিক্কা থেমে যাবে।
–কিন্তু নাড়ি দেখলি তো?
–দেখেছি।
–কী দেখলি তাই তো শুধাচ্ছি রে!
–প্রদ্যোত ডাক্তারসুদ্ধ যখন দেখছে তখন কী দেখলাম তা বলা তো ঠিক হবে না সেতাব। একালে ওদের ওষুধপত্রের খবর তো সব জানি না ভাই, কী করে বলব?
—হুঁ। তা তুই ঠিক বলেছিস। তবে রতনবাবু তো আমাদের গায়ের লোক, ঘরের লোক সেই জন্যে। বুঝলি না, অবস্থা আছে, চিকিৎসা করাতে পারেন। কলকাতা নিয়ে যেতে পারেন।
–কলকাতা থেকে আসাটাই ভুল হয়েছে। কলকাতায় থাকলেই ভাল করতেন। এলেন। বিশ্রাম হবে বলে। কিন্তু হঠাৎ রোগ বাড়লে কী হবে সেটা ভাবলেন না। ওই হয় রে। সংসারে দীর্ঘকাল চিকিৎসা করে এইটেই দেখলাম যে, ভ্ৰম হয়, সেবার ত্রুটি হয়, এটা-ওটা হয়। কলকাতা নিয়ে যাওয়া আর চলবে না। মানে
—তা হলে? কথার মাঝখানেই বাধা দিয়ে সেতাব কথা বলে উঠল; কিন্তু নিজেও কথাটা শেষ করতে পারলে না, নিজেই থেমে গেল।
—না-না সে বলি নি, বলবার মত কিছু পাই নি। তবে বুঝলি না? তবু যেন ভরসা। পাচ্ছি না।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন ডাক্তার। এরপর দুজনেই চুপ করে বসে রইলেন।
ডাক্তার হঠাৎ উঠে বললেন– চললাম, রোগী বসে আছে বাড়িতে। চণ্ডীতলা হয়ে যাব। গোঁসাই এখনতখন, জানিস?
–শুনেছি কাল। আজ বোধহয় ভাল আছেন একটু। নিশি ঠাকরুন গিয়েছিল চণ্ডীতলা মায়ের স্থানে জল দিতে; সে বলছিল। শশী নাকি ভাল করেছে গোঁসাইকে একদাগ ওষুধে। বলছিল—কাল জীবনমশায় ভাইঝিটাকে দেখে বললে, জলবারণ খাওয়াতে হবে। তা—শশীকেই দেখাব আমি।
চমকে উঠলেন জীবন দত্ত। শশীকে দেখাবে? হতভাগিনী মেয়েটার মুখ মনে পড়ল। কচি মেয়ে। কত সাধ কত আকাঙ্ক্ষা মনে। মেয়েটাকে হত্যা করবে। শশী একটা পাপ হয়ে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে আর-একটি তরুণীর মুখ মনে পড়ল।
সেতাব বললে–তুই কাল নিশির ভাইঝিকে দেখেছিলি নাকি? জলবারণের কথা বলেছিলি?
–বলেছিলাম। আমার বিদ্যেতে ওই একমাত্র ওষুধ। কিন্তু ও কথা থাক। কী বলে–গণেশ ভটচাজের মেয়ের খবর কিছু জানিস? কাল রাত্রে–
–খুব কাহিল। এখন-তখন অবস্থা শুনছি। কাল তো তুই শুনলাম বলে দিয়েছিলি নাড়ি দেখে।
—না তো? জীবনমশায় চমকে উঠলেন।–আমি তো নাড়ি দেখি নি প্রসবের পর। হাসপাতালের ডাক্তার
কথার উপর কথা দিয়ে সেতাব বললে–হাসপাতালের ডাক্তার শুনলাম কোমর বেঁধে লেগেছে। শুনলাম খুব ইনজেকশন দিচ্ছে। অক্সিজেন দিয়ে রেখেছে। গণেশকে বলেছে আর-একটা অক্সিজেন আনতে হবে।
চললাম। জীবনমশায় অকস্মাৎ চলতে শুরু করলেন যেন। তরুণ ছোকরাটি বাহাদুর বটে, বীর বটে। শক্তিও আছে, নিজের উপর বিশ্বাসও আছে। যুদ্ধ করছে বলতে গেলে। একবার দেখে যাবেন।
প্রদ্যোত গম্ভীর মুখে বসে আছে আপিসে। গণেশ নই, গণেশের স্ত্রী আধ-ঘোমটা দিয়ে বসে আছে বারান্দায়। মশায়কে দেখে সে মৃদুস্বরে কেঁদে উঠল।—ওগো মশাই, আমার অৰ্চনার কী হবে গো? একবার
–কাঁদবেন না। গম্ভীর স্বরে প্রদ্যোত বললে।
মশায় বললেন–কেঁদো না মা। দেখ, ভগবান কী করেন। এতে তার হাত মা। প্রদ্যোত কুঞ্চিত করে বললে–আপনি কি নাড়ি দেখতে চান নাকি?
মশায় বললেন–না-না। আমি যাচ্ছিলাম পথে, ভাবলাম একবার খবর নিয়ে যাই। বলেই তিনি ফিরলেন।
–একটু বসবেন না?
–না। দু-চারটে রোগী এখনও আসে তো। তারা বসে আছে।
প্রদ্যোত বললে—মতির মায়ের এক্স-রের রিপোর্ট এসেছে। দেখবেন? বিশেষ কিছু হয়। নি। এতক্ষণে একটু হাসলে প্রদ্যোত।
—ভালই তো। আপনার দয়াতেই বুড়ি বাঁচল। মশায় গতি দ্রুততর করলেন। একবার মনে হল—বলেন–বিপিনের হিকা থেমে এসেছে। কিন্তু তা তিনি বলতে পারলেন না।
২০. দাঁতু ঘোষাল চিৎকার করছিল
দাঁতু ঘোষাল চিৎকার করছিল।
এসেছে সকালবেলা আটটা না-বাজতে। এখন সাড়ে দশটা। নবগ্রাম ইস্টিশানে সাড়ে দশটার গাড়ি চলে গেল, এখনও বসে থাকতে হয়েছে। কেন? এত গুমোর কেন জীবন মশায়ের? কী মনে করে মশায়? দেশে ডাক্তারের অভাব? না—দাঁতু ঘোষাল এতই অবহেলার মানুষ?
নবগ্রামে চারটে ডাক্তার বসে ফ্যা-ফ্যা করছে। চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি ছিলচার বিছানার হাসপাতাল—তারপর যুদ্ধের সময় দেশে মন্বন্তর হলে দশ বিছানার হাসপাতাল হয়েছিল—এখন পঞ্চাশ বিছানার হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে। একজন ছোট ডাক্তার ছিল—এখন দুজন ডাক্তার হয়েছে—নার্স এসেছে। সেখানে গিয়ে এলাম বলে একটা বিছানায় শুয়ে পড়লেই হল। সময়ে খাওয়া—সময়ে ওষুধ-য-বার খুশি ডাকলেই ডাক্তার। কেবল জাত থাকবে না। আর মান থাকবে না বলে যায় না। এ ছাড়া কবরেজ দুজন, তার মধ্যে ভূদেব কবরেজ দস্তুরমত পাসকরা, হোমিওপ্যাথ দুজন-আলি মহম্মদ আর বাঙাল ডাক্তার। দোকানে গেলে কেউ পয়সা নেয় না। জীবন মশায়ের মতিভ্ৰম হয়েছে, নইলে রোগীদের এমন অবহেলা কখনও করত না। কেবল পুরনো লোক-ধাত চেনে, মশার বংশের বংশধর—তাই আসে। আর আসবে না। কালই হয় ভূদেব কবরেজের কাছে নয় হরেন ডাক্তারের কাছে যাবে। যে দেশে গাছ থাকে না–সে দেশের ভেরে গাছই বিরিক্ষি। সেকালে ডাক্তার-বৈদ্যের অভাব ছিল, তাই জীবনমশায় ছিল ধন্বন্তরিনিদান হাকত। যেটা ফলত, সেটাই জাহির করত; যেটা ফলত না—সেটার বেলা চুপচাপ থাকত। মরার বদলে বাঁচলে, কে আর তা নিয়ে ঝগড়া করে? এবার এই বাঘা প্রদ্যোত ডাক্তারের হাতে পড়েছে; এইবার মজাটা বুঝবে। এই তো মতি কর্মকার বর্ধমান হাসপাতালে মাকে ভর্তি করে দিয়েছে। পায়ের ফটো নিয়েছে, ভিতরে হাড়ের কুচি আছে, কেটে বার করবে–বাস, ভাল হয়ে যাবে। প্রদ্যোত ডাক্তার বলেছে, আসুক ফিরে মতির মা। তারপর নাড়ি দেখার নিদান হকার ফাঁপা বেলুন ফুটিয়ে দেব।
ঘরে এদিকে রোজগারের অভাবে হাঁড়ি ঢনন—আর রোগীদের অবহেলা! বকেই চলেছে দাঁতু।
নন্দ বার কয়েকই বলেছে—এই দেখ ঠাকুর, ভাল হবে না। যা-তা বোলো না বলছি। কিন্তু দাঁতু ঘোষাল গ্রাহ্য করে নি। বলেছে—তুই বেটা বাঁশ চেয়ে কঞ্চি দড়, পীর চেয়ে খাদিম জিলে—সকাল থেকে পাঁচবার বলেছি তামাক দিতে। গ্রাহ্যই করলি না! তোর কি, মাস পোহলেই মাইনে নিবি। চুরি করে মশায়বাড়ির যাও ছিল শেষ করলি। এইবার রোগী তাড়িয়ে লক্ষ্মী ছাড়িয়ে তুই ছাড়বি।
পরান খাঁও প্রতিবাদ করেছিল—দেখ ঘোষাল, কথাগুলান তুমি অন্যায় বলছ। কঠিন রোগী দেখতে গেছেন মশায়, তাতে দেরি যদি হয়ে থাকে তবে ই সব কথা তুমি কী বলছ? ছিঃ আর কারে কী বলছ?
বলুক খা, ওকে বলতে দাও। ওই কথা ছাড়া অন্য কথা এখন ওর মুখে আসবে না। ওর বুদ্ধিই এখন বিপরীত বুদ্ধি। সর্বনাশকালে মানুষের বিপরীত হয়। আর মৃত্যুকালের চেয়ে সর্বনাশের কাল তো মানুষের আর হয় না। ঘোষাল যাবে। যাবার কাল যত কাছে আসবে তত এটাই ওর বাড়বে।
হেসেই কথাগুলি বললেন– জীবনমশায়। তিনি আরোগ্য-নিকেতনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন। চণ্ডীতলা থেকে গ্রামে ঢুকবার পথটাই সদর-রাস্তার উলটো দিকে। সেই পথে কবিরাজখানার পিছন থেকে ঢুকে তিনি বেরিয়ে এলেন সামনে।
দাঁতু ঘোষাল এক মুহূর্তে যেন জমে পাথর হয়ে গেল। ভয়ার্ত বিস্ময়ে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল জীবন মশায়ের দিকে। হতবাক হয়ে গিয়েছে সে। হাত দুটো শিথিল হয়ে ঝুলে পড়েছে।
জীবনমশায় চেয়ারখানা টেনে নিয়ে বসলেন, বললেন–দেরি একটু হয়ে গেল আজ। চণ্ডী মায়ের স্থানের গোঁসাইজীর অসুখ। হয়তবা যাচ্ছেন গোঁসাই। সেখানে যেতে হয়েছিল সকালে উঠেই। নবগ্রামের রতনবাবুর ছেলে বিপিনবাবুর কঠিন অসুখ, সেখানেও যেতে হয়েছিল। যারা এতদূর দেখাতে এসেছে তাদের তো এমন জরুরি অবস্থা নয়।
দাড়িতে হাত বোলাতে লাগলেন জীবনমশায়। রোগীর দল তবু কেউ কোনো কথা বলতে পারলে না। দাঁতু ঘোষালের দিকেই তারা তাকিয়ে ছিল। দাঁতু দাঁড়িয়ে ছিল মৃত্যু দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত আসামির মত।
অকস্মাৎ সে ভাঙা গলায় বলে উঠল—কী বললে মশায়? আমি বাঁচব না? আমি মরব?
জীবনমশায় নিস্পৃহ নিরাসক্তের মত বললেন–এ রোগ তোমার ভাল হবে না ঘোষাল। এই রোগেই তোমাকে যেতে হবে। এ তোমার ভাল হবার রোগ নয়। তবে দু মাস কি ছ মাস কি দু বছর পাঁচ বছর—তা কিছু বলছি না আমি।
দাঁতু এবার চিৎকার করে বলে উঠল—তুই গো-বদ্যিতুই গো-বদ্যি হাতুড়ে, মানষুড়ে।
জীবনমশায় বলেই গেলেন—এ যদি তোমার ভাল হবার হত ঘোষাল তবে দুদিন যেতে না যেতেই তুমি কী খুব কী খাব করে ছুটে আসতে না, তামাক গাঁজার জন্যে তুমি ক্ষেপে উঠতে না। মৃত্যু-রোগের এ হল একটা বড় লক্ষণ। রাগের সঙ্গে রিপুর যোগাযোগ হলে আর রক্ষে থাকে না। তোমার তাই হয়েছে।
দাঁতু এবার পট করে তার পৈতেগাছটা ছিঁড়ে ফেলে চিৎকার করে উঠল—আমি যদি বামুন হই তবে ছ মাস যেতে-না-যেতে তোর সর্বনাশ হবে। বামুনের মেয়ের অভিশাপে তোর ব্যাটা মরেছে এবার ব্ৰহ্মশাপে তোর সর্বনাশ হবে।
বলেই সে হনহন করে নেমে পড়ল, আরোগ্য-নিকেতনের দাওয়ার উপর খানিকটা গিয়েই সে থমকে দাঁড়াল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে–চললাম আমি হাসপাতালে বড় ডাক্তারের কাছে। আজই আমি হাসপাতালে ভর্তি হব। বাঁচি কি না দেখ।
মশায় হাসলেন। তারপর বললেন–কার কী বল?
এসে দাঁড়াল একটি লোক। কালাজণ্ডিস হয়েছে। মানুষটা যেন হলুদ মেখে এসেছে। প্রতিবিধান অনেক করেছে। কামলার মালা নিয়েছে মালাটা হাঁটু পর্যন্ত লম্বা হয়েছে; তাতে সারে নি। হাসপাতালে গিয়েছে—তাতেও বিশেষ কিছু হয় নি। অবশেষে মশায়ের কাছে এসেছে।
জীবন দত্ত বললেন–তাই তো বাবা। হাসপাতালে যখন কিছু হয় নি তখন সময় নেবে। আর ওষুধ যদি কবিরাজি মতে খাও—বোধহয় তাই ইচ্ছে, নইলে আমার কাছে আসতে না, মুশকিল হচ্ছে আমি তো ওষুধের কারবার তুলে দিয়েছি।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন–আমি মোটামুটি চিকিৎসা করাই ছেড়ে দিয়েছি। নতুন কাল, নতুন চিকিৎসা, নতুন রুচি এ তো আমার কাছে নাই। তা ছাড়া আমার নিজেরও আর ভাল লাগে না। তবু এককালে চিকিৎসা করতাম; দু-চার জন পুরনো লোক আজও ছাড়ে না, তাই তাদের দেখি। বুঝেছ না?
একটু হাসলেন। বোধহয় দাঁতু ঘোষালের প্রসঙ্গটা তার মনের মধ্যে তখনও ঘুরছিল।
—তুমি বরং ভূদেব কবরেজের কাছে যাও। সে ওষুধপত্র রাখে। আর নতুন কালে কবিরাজি শিক্ষার কলেজ হয়েছে, সেখানে পাস করেও এসেছে। বুঝেছ না? কবিরাজিতে নিজের ওষুধ ছাড়া চিকিৎসা করে ফল হয় না।
—আজ্ঞে না ডাক্তারবাবু, আপনি দেখুন আমাকে। নইলে আমি হয়ত বাঁচব না। আমার বাবা দাদা সবাই ঠিক এই বয়সে মারা গিয়েছে। পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের ভিতর। আমাকে বাঁচান।
–না-না। না-বাচবার মত তোমার কিছু হয় নি বাপু। আর বাঁচা মরার ব্যাপারটাই একটা আশ্চর্য ব্যাপার। ওর উপরে যদি মানুষের হাত থাকত! হাসলেন ডাক্তার। শুনলে না, দাঁতু বলে গেল—আমার ছেলের কথা! সে নিজেও ডাক্তার ছিল। এ কী, কাঁদছ কেন তুমি? আচ্ছা আচ্ছা। আমিই দেখব। তুমি বস। আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি, ভূদেবের কাছে কিনে নিয়ে যাও। তারপর আমি ঘরে তৈরি করে দেব। বুঝেছ! ভয় নেই। ভাল হয়ে যাবে। এত ভয় পেয়েছ কেন?
দাড়িতে হাত বোলাতে লাগলেন ডাক্তার। লোকটি বড় ভয় পেয়েছে। ভয় রোগের জন্য নয়। বাবা দাদা ঠিক এই বয়সে মরেছে বলে ও বেচারিও ভয় পেয়েছে। ভয়টা খুব অহেতুকও নয়। এমন হয়। বিচিত্রভাবে হয়।
পরান হেসে লোকটিকে বললে—আর কিছু ভয় তুমি করিয়ো না বেটা। মশায় বলেছেন ভয় নাই। উ একেবারে বেদবাক্যি!
পরান তার মন রাখছে সে জীবনমশায় জানেন কিন্তু এ মন রাখাটুকু তার ভাল লাগে। পরান লোক ভাল। কৃতজ্ঞতা আছে। সেই তার প্রথম জীবনে জীবন দত্ত তাকে টাইফয়েড থেকে বাঁচিয়েছিলেন, তখন পরানের অবস্থা সচ্ছল ছিল না, দিনমজুরি করত। জীবন দত্তের বাড়িতেই মজুরি খেটেছে, তখন তিনি তার বিনা পয়সায় চিকিৎসা করেছিলেন—সে কথা পরান আজও ভুলে যায় নি। সে এখন বড় ডাক্তার ডাকতে পারে। দৈনিক চার টাকা ফি দিতেও তার গায়ে লাগে না, তবু সে জীবন দত্ত ছাড়া কাউকে দেখায় না। শুধু কৃতজ্ঞতাই নয়—জীবনমরণ প্রশ্ন নিয়ে রোগ আসে মানুষের শরীরে, সেখানে কৃতজ্ঞতার ক্ষেত্র খুব বড় নয়, বড় বিশ্বাসের কথা সেই বিশ্বাস আছে পরানের। যে তাকে এত বড় বিশ্বাস করে, তাকে স্নেহ না করে কি পারেন। তিনি? তবে বিবির জন্য পরানের ভাবনায় ডাক্তার কিঞ্চিৎ কৌতুক না করে পারেন না। একবার তিনি নিজেই বলেছিলেন, পরান বিবিকে একবার না হয় কলকাতা নিয়ে যাও। এখন সব নানা রকম পরীক্ষা হয়েছে—পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে এস। ডাক্তার কথাটা গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন। কৌতুক করেন নি।
ডাক্তার বলেছিলেন—তা হলে এক কাজ কর, হাসপাতালের ওই বড় ডাক্তারকে একদিন কল দাও। ওঁকে দেখাও। উনি বলে দেবেনচিঠি দিয়ে দেবেন কোথায় কার কাছে দেখাতে হবে।
প্রদ্যোত ডাক্তার রোগিণীকে দেখে একটু হেসেছিলেন। বলেছিলেন—অসুখ মনের, শরীরের নয়। এবং—হুঁ। একটু থেমে বলেছিলেন—কোনো মনস্তাত্ত্বিক ডাক্তারকে দেখালে ফল হতে পারে।
মশায় কথাটা বুঝেছিলেন, পরান বুঝতে পারে নি; কিন্তু তবু পরান ওই নতুন ডাক্তারের উপর বিরক্ত হয়েছিল। তার বিবি তার চোখের সামনে রোগে ভুগছে—সে তার সেবা করছে, চোখে দেখে স্পৰ্শ দিয়ে সে অসুখ অনুভব করছে—আর ডাক্তার বলছে অসুখ নয়!
সে শুধু প্রদ্যোত ডাক্তারকেই বাতিল করে নি—কলকাতায় যাওয়ার কথাও বাতিল করে দিয়েছিল। শুধু প্রশ্ন করেছিল—আপুনি কী বুঝছেন বলেন যদি, বুঝেন কি পরানের ভয় আছে মিত্যু হতে পারে—তা হলে না হয়
—না, সে ভয় নেই। তবে ভুগতে পারে। বুঝছ না?
–তা ভুগুক। না হয় ভুগবে কিছুদিন। আপুনি ছাড়া কারুর দাওয়াই আমি খাওয়াব না।
সে অবধি এই চলছে। ডাক্তার তিন দিন অন্তর যান। কিন্তু পরানের ইচ্ছা রোজ যান তিনি। ডাক্তার তা যান না। পরান রোজ আসে। খবর বলে যায়, বলে—কিছু বদল করবেন নাকি?
–না—না। ওই যা চলছে—চলুক।
–এই পোস্টাই যদি কিছু দিতেন! আর এই ঘুম হবার ওষুধ! রাতে একবারও চোখ বোজে না, ছটফট করে। এ পাশ আর ও পাশ। আর টুকটুক করে জল খাবে।
একটা কিছু দিলেই পরান খুশি।
আজও পরানের একটা ওষুধ চাই। সে ভয়ার্ত জোয়ানটিকে জীবন মশায়ের অদ্ভুত চিকিৎসা পারঙ্গমতার কথা বোঝাতে বসেছে সেই উদ্দেশ্যেই।
ডাক্তার রোগীর পর রোগী দেখে চলেছেন। এই সময়ে এসে দাঁড়াল এক ছফুট লম্বা মানুষ—মশায়, একবার যে দেখতে হবে। গম্ভীর ভরাট গলা।
–কী? তোমার কী হল?
–কী হল বুঝতে তো পারছি না। কাশি সর্দি—মধ্যে মধ্যে জ্বর; কিছুতেই ছাড়ছে না। হাতখানা বাড়িয়ে দিলে—ছ-ফুট লম্বা—তেমনি কাঠামো—এক পরিণত বয়সের জোয়ান। ঘাট মহেশপুরের রানা পাঠক। এ অঞ্চলে রানা পাঠক শক্তিশালী জোয়ান; লাঠি খেলা, কুস্তি করা, নদীর ঘাটে নৌকা খেয়া দেওয়া, দেবস্থানে বলিদান করা তার কাজ। বছর কয়েক আগে পর্যন্ত প্রতি বৎসর অম্বুবাচীতে কুস্তি প্রতিযোগিতায় রানা পাঠকের নাম একবার কয়েক দিনের জন্য মুখে। মুখে ফিরত। আর-একবার রানার নাম শোনা যেত কালীপূজার সময়। রানার মহিষবলির কৃতিত্ব লোকের মুখে গল্পের কথা। বাড়িতে কিছু জমিজেরাত আছে—তার ধানে ফসলে আর খেয়াঘাটের নৌকার আয়ে রানা পাঠকের বেশ ভালই চলে যায়। মহেশপুরের ঘাটের ডাক তার একচেটে। ও ঘাটে অন্য কেউ ডাক নিয়ে নৌকা পার করতে পারে না। রানা পাঠকের অসুখ কখনও শোনেন নি মশায়। কিন্তু আজ রানাকে দেখে জীবনমশায় বিস্মিত হলেন। এ কী চেহারা হয়েছে রানার? চোখের কোলে কালি পড়েছে, শক্ত বাঁশের গোড়ার দিকের মত মোটা কবৃজির হাড় বেরিয়ে পড়েছে—জামার ফাঁক দিয়ে কণ্ঠ দেখা যাচ্ছে।
–রানা, বাবা এ তুমি ভাল করে দেখাও। তুমি বরং বর্ধমানে গিয়ে দেখিয়ে এস। নয়তো এখানেই আজকালকার ভাল ডাক্তারদের দেখাও। এ তোমার টোটকাতে কি মুষ্টিযোগে যাবে না।
রানা মাথাটা ঝাঁকি দিয়ে বললে—উঁহুঁ! ওরা গেলেই বলবে যক্ষ্মা হয়েছে। বুঝলেন না–ওদের এইটে বাতিক। তারপর ফর্দ দেবে ইয়া লম্বা। বুকের ফটো তোলাও, চায়ের থুতু পরীক্ষা করাও-এই কর—তা কর। চিকিৎসা তারপর! যক্ষ্মা হয়ত আমার হয়েছে। বুঝেছেন…একটা মেয়েছেলের কাছ থেকে ধরার কথাই বটে। তার আবার পরীক্ষা কিসের? এত পরীক্ষাই যদি করতে হবে তো—ডাক্তারি কিসের? আপনি হাত দেখুন। বলে দেন কী করতে হবে। ওষুধ দেন। আমি সব ঠিক ঠিক করব। তারপরে আমার পেরমায়ু আর আপনার হাতযশ! আর ওইসব ফোঁড়া-যুঁড়ি আমার ধাতে সইবে না মশায়। যক্ষ্মার ওষুধ তো আপনাদেরও আছে।
–আছে। কিন্তু এখন যেসব ওষুধ বেরিয়েছে সেসব অনেক ভাল ওষুধ রানা। অনেক ভাল।
–আপনি বলছেন?
–বলছি রানা। তাতে তো লজ্জা নাই বাবা। তুমি বরং হরেন ডাক্তারের কাছে যাও। আর ওই বুকের ফটো তোলানোর কথা বললে না বাবা, ওটা করানো ভাল। এক্স-রে করলে বোঝা যাবে, চোখে দেখা যাবে কতখানি রোগ হয়েছে। আবার ভাল হলে একবার এক্স-রে করলে বুঝতে পারবে—একেবারে নির্দোষ হল কি না। এখন ধরহয়ত একটু থেকে গেল। শরীর ভাল হয়েছে—সেটা ধরা গেল না। সেই একটুই আবার বাড়বে—কিছুদিন পর।
রানা ঘাড় নাড়লে।
বার কয়েক ঘাড় নেড়ে বললে–উঁহুঁ। তা হলে আমি ভূদেব কবরেজের কাছে যাই। উ সব কড়া ডাক্তারি ওষুধ আমার ধাতে সইবে না। তা ছাড়া মশায়, ডাক্তারদের কথা বড় চ্যাটাং চ্যাটাং। বুঝেছেন—আমাদিগে যেন মানুষই মনে করে না। আপনি দেখতেন সেকালে—সে পসার তো দেখেছি আমি।—এরা টাকা রোজগার করে অনেক, ফি বেশি। ফি ছাড়ে না। কিন্তু সে পসার নাই। আপনারা রোগীর সঙ্গে আপনার লোকের মত কথা বলতেন। ঘরের লোকের মত। আমার আবার মেজাজ খারাপ। কে জানে ঝগড়া হয়ে যাবে কবে। তার চেয়ে কবরেজি ভাল। লোহাতে মাথা বাঁধিয়ে তো কেউ আসে নাই সংসারে, মরতে তো হবেই। আজ নয় কাল। তা কড়া কথা শুনে-খারাপ কথা শুনে মরি কেন?
রানা উঠে চলে গেল।
–রানা! অ–রানা!
–আজ্ঞে?
–কবিরাজিই যদি করবে বাবা তবে পাকুড়িয়া যাও। সেন মশায়দের বংশ বড় বংশ বড় আটন। বিচক্ষণ বৈদ্য আছেন—ভাল ওষুধ রাখেন—সেখানে যাও। বুঝেছ? এ অবহেলার। রোগ নয়।
–পাকুড়ে যাব বলছেন?
–হ্যঁ তাই যাও। ভূদেব এখনও ছেলেমানুষ! বুঝেছ? ইচ্ছে কর তো ভূদেবকে সঙ্গে নিয়ে যাও।
—দেখি! টাকাতে কুলানো চাই তো! হাসল রানা। আপনার কাছে আসা—সেজন্যেও বটে যে! কম টাকায় চিকিৎসা—এ আর কোথায় হবে?
চলে গেল রানা পাঠক। শক্তিশালী বিপুলদেহ অকুতোভয় রানা বন্যার সঙ্গে ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে; কিন্তু অসহায় হয়ে পড়েছে আজ। মৃত্যুর কাছে মানুষ নিতান্ত অসহায়।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন জীবনমশায়। রানার কথাই ভাবছিলেন। কথাটা মিথ্যা বলে নি রানা। দরিদ্র দেশ, দরিদ্র মানুষ, টাকা পাবে কোথায়? ডাক্তারেরাই বা করবে কী? তারাই বা। খাবে কী? নিজের অবস্থা ভেবেই কথা বলছেন জীবনমশায়। আজ সকাল থেকে চারটি টাকা ফি পেয়েছেন। তাঁর পিতামহ, পিতা, তিনি—এতকাল পর্যন্ত যে সম্পত্তি করেছিলেন তার অনেক। চলে গিয়েছে এই পনের-কুড়ি বছরের মধ্যে। আজ তিনি প্রায় নিঃস্ব। লোকে বলে ভাগ্য। আতর-বউ নিজের কপালে করাঘাত করে। কিন্তু তিনি তো জানেন-দায়ী তিনি নিজে। তা ছাড়া আর কে দায়ী?
সশব্দে একখানা গরুর গাড়ি এসে দাঁড়াল।
–কই, গুরুদেব কই?
নামল শশী। শশীর চোখ লাল। মদ খেয়েছে এই দিনে-দুপুরে। রামহরিকে দেখবার জন্য নিতে এসেছে। রামহরি মৃত্যু-কামনায় জ্ঞানগঙ্গা যাবে। গত রাত্রের কথাগুলি আবার সব মনে হল মশায়ের। রামহরি যাবে মৃত্যুবরণ করতে?
চারটি টাকা নামিয়ে দিলে শশী।
–আমি বলেছি চার টাকা দিয়ে সারলে হবে না রামহরি। জীবন মশাকে শেষ দেখা দেখাবে, আরও লাগবে বাবা। আমাদিকে বরং সেকালে চোলাই মদ খাইয়েছ-পাটা খাইয়েছ, জীবন মশায়কে তো কিছু খাওয়াও নি। খাইয়ে থাকলে বড়জোর লাউ-কুমড়ো। বেটা উইলটুইল করছে। বললে, মশায়কে সাক্ষী করব। পেনামী দোব তখন। নিশ্চয় দোব।
হঠাৎ হাসি থামিয়ে বললে—দাঁতু ঘোষাল বেটা মরত, ও বেটার নিদান অ্যাঁকলেন কেন? বেটা কাঁদছে—প্রদ্যোত ডাক্তার তড়পাচ্ছে।
মশায় সেকথা গ্ৰাহ্য করলেন না। দাঁতু মরবে, এই রোগেই মরবে, প্রবৃত্তিকে এমন প্রবল রিপু হয়ে উঠতে কদাচিৎ দেখা যায়। কোনোমতেই বাঁচাতে পারবে না প্রদ্যোত। বাড়ির দিকে অগ্রসর হলেন তিনি, বললেন– দাঁড়া, গিনি বকছে কেন দেখি। আতর-বউয়ের তীক্ষ তিরস্কার তিনি শুনতে পেয়েছেন।
আতর-বউ তিরস্কার করছেন তাকেই যাকে আজীবন তিরস্কার করে আসছেন নিজের অদৃষ্টকে। হায়রে অদৃষ্ট, হায়রে পোড়াকপাল!
নন্দ ও-পাশে চুপ করে বসে আছে, মাথা হেঁট করে মাটি খুঁটছে। নন্দ জড়িত আছে, তাতে সন্দেহ রইল না তাঁর।
মশায় দুজনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন–কী হল?
–কিছু না।
নন্দ বললে—দাঁতুকে উব বলবার আপনার কী দরকার ছিল? হাসপাতালের ডাক্তার যাতা বলছে—আমি শুনে এলাম। নিজের কানে।
–নিদান হাকবে তো আমার নিদান হক। দেখ হাত দেখ।
–তোমার নিদান হাত না-দেখেই আমি হাকতে পারি।
–বল, বল—তাই বল, কবে মরব আমি? এ জ্বালা আমি আর সইতে পারছি না। শুধু নাই। শুধু নাই আর নাই। আর তুমি ন্যায়ের অবতার সেজে বসে আছ। রতনবাবুরা চার টাকা ফি দিতে এসেছিল—তুমি দু টাকা নিয়ে দু টাকা ফেরত দিয়ে এসেছ। তুমি যাকে দেখছ তাকেই বলে আসছ—মরবে তুমি মরবে।
জীবনমশায় হা-হা করে হেসে উঠলেন এবার। সে হাসিতে স্তব্ধ হয়ে গেলেন আতর-বউ। জীবনমশায় বললেন–মরবার জন্যেই জন্ম আতর-বউ। সবাই মরবে, সবাই মরবে, কেউ অমর নয়।
ঘোরটা কাটিয়ে আতর-বউ অকস্মাৎ চিৎকার করে উঠলেন—পৃথিবীর কথা আমি জানতে চাই না। আমি কবে মরব তাই বল।
—আমার মৃত্যুর পর।
নিষ্ঠুর বজের মত কঠোর কথা! আতর-বউ নির্বাক বিমূঢ় হয়ে গেলেন।
–আমার মৃত্যু কবে হবে সেইটেই বুঝতে পারছি না। পারলে দিন-তারিখ বলে দিতাম! বনবিহারীর মৃত্যু জানতে পেরেছিলাম। তোমাকে বলেছিলাম, তুমি বিশ্বাস কর নি। এটা বিশ্বাস কোরো।
জীবনমশায় বেরিয়ে এলেন। শশী রাঙা চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
–চল। শশী!
শশীর যেন এতক্ষণে চেতনা ফিরে এল। বললে–চলুন। হঠাৎ হেসে বললে–ঠিক বলেছেন। মরবে না কে? সবাই মরবে। ওই হাসপাতালের ডাক্তার, ও বেটা কি অমর নাকি?
ডাক্তার বললেন–চুপ কর। ওসব কথা থাক।
হায়রে মানুষ! নানা, হায় কেন? এই তো রামহরি, হাসতে হাসতে মরতে চলেছে।
সত্য সত্যই প্রদ্যোত ডাক্তার কঠিন ক্রোধে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে। গণেশ ভট্টাচার্যের মেয়েকে আর-একবার দেখে একটু আশান্বিত হয়েই এসে আপিসে বসেছে ঠিক এমনই মুহূর্তেই দাঁতু এসে হাউ হাউ করে কেঁদে পড়ল।
প্রদ্যোত ডাক্তারের প্রায় পা চেপে ধরে বললে—ডাক্তারবাবু গো! আমাকে বাঁচান আপনি!
–কী হয়েছে? উঠুন। ভাল করে বলুন। চেঁচাবেন না মেলা।
–ওগো আমাকে বাঁচান গো। আমি আর বাঁচব না।
–কী হয়েছে যে তাই বাঁচবেন না?
–মশায় বললে গো! জীবনমশায়!
–কে? জীবন দত্ত?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। বললে এই তোর মৃত্যুরোগ। শিবের বাবা এলেও বাঁচাতে পারবে না।
–জীবন ডাক্তারের সঙ্গে শিবের বাবার আলাপ-পরিচয় আছে তা হলে? না-মাথা খারাপ হয়েছে লোকটার।
–আজ্ঞে? ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল দাঁতু ঘোষাল।
–উঠুন, কী হয়েছে দেখি। চলুন ওই ঘরে, টেবিলের উপর শুয়ে পড়ুন। বলুন কী হয়েছে। সমস্ত শুনে ডাক্তার ভ্রূ কুঞ্চিত করে বললেন–এই সমস্ত লিখে আপনি আমাকে দিতে পারবেন?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। হাজার বার। এখুনি লিখে দিতে পারি। বেটা কায়েত—
ডাক্তার ধমক দিয়ে বললও সব কী বলছেন? বেটা কায়েত কী? জানেন আমিও কায়স্থ?
জিভ কেটে দাঁতু বললে–আপনাকে তাই বলতে পারি? আমি বলছি ওই জীবনকে। বেটা হাতুড়েকে। কিন্তু আমি বাঁচব তো? ঝরঝর করে কেঁদে ফেললে দাঁতু।
–কী হয়েছে তাই বাঁচবেন না। ওষুধ খান–নিয়ম করে চলুন–
কম্পাউন্ডার হরিহর পাশের ঘরে ওষুধ তৈরি করছিল। সে বললে–তা দাঁতু পারবে না। রোগ তো ওর ডেকে আনা। খেয়ে খেয়ে করেছে। দুদিন ভাল থাকলেই ব্যস ছুটবে কারুর বাড়ি—আজ তোমাদের বাড়ি দুটো খাব। হাসতে লাগল সে।
ডাক্তার বলল-হাসপাতালে থাকতে হবে আপনাকে। থাকবেন?
—তাই থাকব। দাঁতু বাঁচতে চায়। সে মরতে পারবে না।
–ওকে ভর্তি করে নিন। বলেই ডাক্তার একটা কাগজ টেনে নিল—ম্যাজিস্ট্রেটকে লিখবে এই কথা। এই ধরনের নিদান হেঁকে মানুষের উপর মর্মান্তিক পীড়ন—এ যুগে এটা অসহনীয় ব্যাপার। এর প্রতিকার করা প্রয়োজন।
কিছুক্ষণ পরে আধলেখা দরখাস্তখানা টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিলে। থাক।
লোকটিকে যেন একটা বাতিকে পেয়েছে। মৃত্যু ঘোষণা করে আনন্দ পাচ্ছে। আশ্চর্য! মৃত্যু পৃথিবীতে নিশ্চিতই বটে, সে কে না জানে? তাকে জয় করবার জন্য মানুষের চেষ্টার অন্ত নাই। সে সাধনা অব্যাহত চলে আসছে। আবিষ্কারের পর আবিষ্কার হয়ে চলেছে। আজও তাকে রোধ করা যায় নি। আজও সে ধ্রুব—তবু তো মর্মান্তিক, বিয়োগান্ত ব্যাপার। তার মধ্যে যেন একটা আধ্যাত্মিক কিছু আরোপ করে এই মৃত্যুদিন ঘোষণা চমকপ্রদ বটে, রোমান্টিকও বটে কিন্তু নিষ্ঠুর। ঠিক পশুকে বলি দেওয়ার মত। পূজা-অৰ্চনার আড়ম্বরে আধ্যাত্মিকতার ধূম্ৰজালে আচ্ছন্ন। এক কল্পলোক সৃষ্টি করে মৃত্যুকে মুক্তি বলে ঘোষণা করে খাঘাত করার মতই নিষ্ঠুর প্রথা। জীবন দত্ত তারই পুরোহিত সেজে বসে আছে।
হি মাস্ট স্টপ থামতে হবে তাকে। না থামে—থামাতে হবে, হি মাস্ট বি স্টপ্ড্।
এই অৰ্চনা মেয়েটির হাত দেখলেও ও নিদান হেঁকে যেত। ওকে তা না দেখতে দিয়ে ভাল করেছেন তিনি। অদৃষ্টবাদী এই দেশের এই নিদান-হাকিয়েরাই যোগ্য চিকিৎসক ছিল। কবচ মাদুলি জড়িবুটি চরণামৃত কিছু দিতে বাধে না এদের।
লোকটা নিজের ছেলেরও নাকি মৃত্যু ঘোষণা করেছিল এবং করেছিল মায়ের অর্থাৎ নিজের স্ত্রীর সম্মুখে। উঃ, কী নিষ্ঠুর! কল্পনা করা যায় না।
প্রদ্যোত ডাক্তার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সিগারেট ধরিয়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে নার্সদের অফিসের দিকে গেল। নার্সকে ডাকল—বলল—ওই পেশেন্ট ওই বুড়ো বামুনকে ভর্তি করা হয়েছে। ভাল করে নজর রাখবে। ওর স্ট্রল একজামিনেশন দরকার। আজই করে রাখবে।
তারপর সমস্ত ওয়ার্ডটা ঘুরে বেড়িয়ে এসে দাঁড়াল ফাঁকা মাঠে–নতুন বাড়িটার সামনে। সুন্দর হচ্ছে বাড়িখানা। ডিসেন্ট বিল্ডিং। চারিদিকে চারটে উইং থাকলে আরও সুন্দর হত। হবে, স্কিম আছে। পরে হবে।
নতুন কাল। বিজ্ঞানের যুগ। অদৃষ্ট নিয়তি নির্বাসনের যুগ। ব্যাধিকে জয় করবে মানুষ। মৃত্যুর সঙ্গে সে যুদ্ধ করবে। মৃত্যুর মধ্যে অমৃত খুঁজেছে মানুষ—অসহায় হয়ে। এবার জীবনের মধ্যে অমৃত সন্ধানের কাল এসেছে। একালে অনেক আয়োজন চাই। অনেক কিছুর আয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন—এই লোকগুলির নির্বাসন। এই জীবন মশায়দের। নিদান! নিদান! মৃত্যুর সঙ্গে যেন একটা প্রেম করে বসে আছে এদেশ! গঙ্গার ঘাটে গিয়ে জলে দেহ ড়ুবিয়ে মরাই এখানে জীবনের কাম্য। মতির মায়ের এক্স-রের রিপোর্ট পেয়ে প্রদ্যোত যেন প্রেরণা পেয়েছে। একটা। এক্স-রে রিপোর্ট নিয়ে মতি আজ সকালে বর্ধমান থেকে ফিরে এসেছে। বর্ধমানের হাসপাতালের ডাক্তার প্রদ্যোতের চেয়ে সিনিয়র হলেও তার সঙ্গে প্রদ্যোত ডাক্তারের বেশ একটি সম্প্ৰীতি আছে। সে তাকে লিখেছিল—আমাকে যেন সমস্ত রিপোর্ট অনুগ্রহ করে জানাবেন। কারণ এই কেসটিতে আমি খুবই ইন্টারেস্টেড; এই বুড়িকে মরণ ধ্রুব বলে খোল করতাল সহযোগে নাম সংকীর্তন করে জ্ঞানগঙ্গা পাঠাবার ব্যবস্থা হচ্ছিল এখানকার সে আমলের এক জ্ঞানবৃদ্ধ বৈদ্য মহাপ্রভু নিদান হেঁকেছিল—কয় মাস, কয় দিন, কয় দণ্ড, কয় পলে যেন বৃদ্ধার প্ৰাণ-বিহঙ্গ পিঞ্জর ত্যাগ করবে; এই পায়ের-ব্যথা রোগেই মরবে; সেই কেস আমি জোর করেই হাসপাতালে পাঠাচ্ছি। এখানকার লোকেরা নাকি মনে মনে হাস্য করছে এবং বলাবলি করছে—জীবন দত্ত যখন নাড়ি দেখে বলেছে বুড়ি মরবে তখন ওকে বাঁচায় কে?
এই কারণেই সেখানকার ডাক্তার রিপোর্টের পুরো নকল মতির হাতে পাঠিয়েছেন। সেই রিপোর্ট পড়ে প্রদ্যোতের মুখে ব্যঙ্গহাস্য ফুটে উঠেছিল—তার সঙ্গে বিরক্তিও জমা হয়েছিল। পড়ে গিয়ে বুড়ির একটা পায়ের গাঁঠে আঘাত লেগেছে, খানিকটা হাড়ের কুচি ভেঙে সেখানে থেকে গিয়েছে, সেই হেতুই বৃদ্ধার এই অবস্থা। ওই জায়গাটা কেটে হাড়ের কুচিটাকে বের করে দিতে হবে এবং হাড়ের যদি আর কোনো অংশ বাদ দিতে হয় দিতে হবে, দিলেই বুড়ি সেরে উঠবে। এতে আশঙ্কার কোনো কারণ নাই।
নিদান! নিদান! নিদান!
কাল সন্ধ্যাতেও এই নিদানের কথা একদফা শুনে এসেছেন। এই বি কে মেডিক্যাল। স্টোর্সের মালিক বিনয়দের ওখানে। ওইওই একটি রক্তশোষণকারী রোগের সুযোগে মানুষকে সর্বস্বান্ত করে। জাল ওষুধ বিক্রি করে। মুখে বড় কথা বলে। বাধ্য হয়ে প্রদ্যোতকে ওখানে যেতে হয়, নইলে ওকে ঘৃণা করে প্রদ্যোত।
প্রদ্যোত ডাক্তার ওখানে গিয়েছিল একটা বিশেষ জরুরি ইনজেকশনের অর্ডার দিতে। কাল সন্ধে পর্যন্ত পাওয়া চাই-ই। তার সঙ্গে আরও দু-চারটে ওষুধ। বিনয়ের দোকানের একটি। বিশেষ ব্যবস্থা আছে যে, প্রতিদিন রাত্রি দশটার ট্রেনে তার লোক কলকাতা যায়, সকালে পৌঁছে বরাতী জিনিস কিনে আবার দুপুরেই রওনা হয়ে সন্ধ্যার সময় নবগ্রাম ফিরে আসে। পুরো চব্বিশ ঘণ্টাও লাগে না। এর জন্য হাওড়া পর্যন্ত মান্থলি টিকিট করেছে।
ওদের ওখানে মজলিসের মাঝখানেই এই কথা হচ্ছিল। এই মতির মায়ের কথা। কাল যে ছেলেটি তার হাতে মারা গেছে তার কথা। বিপিনবাবুর হিষ্কার কথা। বিনয় নিজে ওষুধের দোকান করে, লাভও করে প্রচুর কিন্তু নিজে অ্যালোপ্যাথিতে খুব বিশ্বাসী নয়, কবিরাজিতেই তার নিজের রুচি এবং মধ্যে মধ্যে ডাক্তারদের বলে আপনাদের এ আমলের চিকিৎসা, ও তো কানাতেও পারে মশায়। রক্ত পরীক্ষা, মল মূত্র ও থুতু গরের পরীক্ষা, এক্স-রে, এসব হবে, তারপর আপনারা চিকিৎসা করবেন। সে আমলে নাড়ি টিপে ধরেই বলে দিত এই হয়েছে! বলে দিত-আঠার মাস কি ছ মাস কি সাত দিন মেয়াদ। এই আমাদের জীবনমশায়—
জীবন মশায়ের নিদান হকার গল্প বলেছে। শেষে বলেছে—মতির মাকে মশায় যখন বলেছেন ডাক্তারবাবু তখন–
এক্স-রে রিপোর্ট এবং চিঠিখানা পেয়ে প্রদ্যোত মনে বল পেয়েছে, প্রেরণা পেয়েছে। এখানকার লোকে এমনভাবে বলে যে মধ্যে মধ্যে নিজেকে যেন দুর্বল মনে হয়। চারুবাবুসুদ্ধ। ওদের সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলেন। হরেন ডাক্তার তরুণ। কিন্তু সে এখানকার ছেলে। সে বিশ্বাস হয়ত করে না, কিন্তু অবিশ্বাস করার মত দৃঢ়তাও তার নেই। বাল্যস্মৃতি তাকে নাড়া দিয়ে দুর্বল করে দেয়। মশায় নাকি তাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। এবং তার গল্প নাকি আশ্চর্য। তার বাল্যজীবনের আরও অনেক আশ্চর্য স্মৃতি আছে।
এবার সে প্রমাণ করবে।
মতির মা বাঁচবে, দাঁতু বাঁচবে।
ডাক্তার বাসার দিকে চলল।
গানের সুর এসে কানে ঢুকল। মঞ্জু গান গাইছে। বেলা প্রায় একটা। রান্নাবান্না হয়ে গেছে—কাজ নাই—গান গাইছে মঞ্জু। আশ্চর্য জীবনময়ী মেয়ে মঞ্জু। মূর্তিমতী জীবনের ঝরনা। উচ্ছ্বসিত আবেগে সম্মুখের পানে বেয়ে চলেছে। বহু যুদ্ধ করে ডাক্তার তাকে জয় করেছেন।
তার বাড়িতে এই কারণেই মঞ্জুকে পছন্দ করে না। বলে—দুলালীপনা কি ভাল!
ডাক্তারের ভাল লাগে। মঞ্জুকে ডাক্তার সাইকেল চড়া শিখিয়েছেন। বন্দুক ছুঁড়তে শিখিয়েছেন। মোটর ড্রাইভিং শেখাবেন। বাধা তিনি দেবেন না।
এই তো—এই তো জীবন! গতিশীল, উল্লাসময়, ওইখানেই তো আছে সবল জীবনের আনন্দ! দি ইজ লাইফ।
সিঁড়ির উপর ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো আছে। তাই মাড়িয়ে ডাক্তার তোর তলা পরিশুদ্ধ করে নিয়ে উপরে উঠলেন। ওদিকে সাবান, জল, লোশন, ভোয়ালে সাজানো রয়েছে।
মন্থর গতিতে ক্যাঁ ক্যাঁ শব্দ তুলে একখানা ছইওয়ালা গাছ আসছে। হাসপাতালের পাশ দিয়েই রাস্তা। শ্ৰাবণের আকাশে মেঘ ঘুরছে ছায়াচ্ছন্ন ম্লান দ্বিং হরটিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে মধ্যে মধ্যে। গাড়িখানার ছইয়ের ভিতর ঠিক সামনেই বসে কে? পাকা দাড়ি, পাকা চুল, স্কুল স্থবির–মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে চেয়ে রয়েছে, গাড়ির চাকা খালে পড়ছে, ইটে হোঁচট খাচ্ছে, তার সঙ্গে দেহখানা ঝাঁকি খাচ্ছে—ভ্রূক্ষেপ নাই।
জীবন মশায় তো! ডাকে চলেছেন কোথাও।
২১. জীবনমশায়ই বটে
জীবনমশায়ই বটে। গলাইচী গ্রামে ডাকেই চলেছেন। শশীর রোগী রামহরি লেটকে দেখতে চলেছেন। আকাশের দিকেই চেয়ে আছেন। গাড়ির ঝকি খাচ্ছেনক্ষেপ নাই। এই ধারাই জীবন দত্তের চিরকালের ধারা। গরুর গাড়িতে চড়লেই এমনিভাবেই গভীর চিন্তামগ্ন বা শূন্য। মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
পিছনে বসে শশী বকেই চলেছে। সে বলছিল, মেয়েছেলেদের ওই বটে গো। টাকা লোকসান সয় না।
জীবনমশায় স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। বের হবার আগে আতর-বউকে যে কথা তিনি বলেছেন—শশী তা শুনেছে। তারই জের টেনে চলেছে সে। আরম্ভ করেছে প্রদ্যোত ডাক্তারও একদিন মরবে—এই কথা বলে। মশায়ের কাছে ধমক খেয়ে এখন এসেছে ফিয়ের কথায়।
শশী একটু চুপ করে থেকে আবার বললে, তা ওরা যখন নিজে থেকেই দিতে এল তখন নিলেন না কেন? তাতে কি দোষ হত?
জীবনমশায় এতেও সাড়া দিলেন না।
শশী আবার বললে–রাগলে আর বউঠাকরুনের মুখের আগল থাকে না। ওই দোষটা ওঁর আর গেল না!
জীবনমশায় আকাশের দিকেই তাকিয়ে আছেন। আতর-বউয়ের কথাগুলি মনে ঘুরছে। কথা নয় বাক্যবাণ; কিন্তু জীবনমশায় ও বাণে বিদ্ধ হয়েও আহত হন না। স্থবির হাতির মত চলেন-বাণগুলি গায়ে বিঁধে থাকে, কিন্তু কোনো স্পৰ্শানুভূতি অনুভব করেন না, তারপর কখন। খসে পড়ে যায়। সমস্ত দেহই তো কিছু কিছু ক্ষতচিহ্নে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে।
শশী কিন্তু বিরক্ত হয়। এই বুড়োর মেজাজটা চিরকাল একরকম গেল। একশোেটা কথা। কইলে একটা উত্তর দেয়। বুঝতে পারা যায় না কোন কথায় লোকটার মন নাড়া খাবে সাড়া দেবে। বউঠাকরুন মুখরা বটেন; কিন্তু সে ওই স্বামীর কারণেই মুখরা। ঝগড়া কলহ সবই জীবন মশায়ের সঙ্গে। বাইরের লোকের সঙ্গে ব্যবহারে বউঠাকরুন অন্য মানুষ। শশীর প্রথম জীবনটা কেটেছে এই বাড়িতে; সে তো জানে! পুরো তিন বছর ওই বাড়িতে কেটেছে। বউঠাকরুন সে সময় যে আত্মীয়তা করেছেন সে তো তার মনে আছে। ডেকে জল খাইয়েছেন, না খেলে তিরস্কার করেছেন। কথাটি বড় ভাল বলতেন—রোজার ঘাড়েও ভূতের বোঝা চাপে শশী, ডাক্তার কবরেজেরও অসুখ করে। সময়ে খা। পিত্তি পড়াস নে।
শুধু এই নয়, বাড়িতে যখন যে জিনিস তৈরি করেছেন, ডেকে খাইয়েছেন। বলতেন—খা তো শশী। দেখ তো ভাই কেমন হল!
ভাল জিনিস ন্যাকড়ায় বেঁধে দিয়েছেন শশী নিয়ে যা বাড়ি। বউকে খাওয়াবি।
শশীর তখন নতুন বিয়ে হয়েছে। শশীর বউয়ের মুখ দেখে একটি আংটি দিয়েছিলেন বউঠাকরুন।
বউঠাকরুনকে তেতো করে দিয়েছে এই বৃদ্ধ! এই মত্ত হস্তী! মত্ত হস্তীই বটে। কোনো কিছুতেই ক্ৰক্ষেপ নাই। বসে আছে দেখ তো? যেন একটা পাথর।
কী বলবে শশী! শশীর আজ নিজের গরজ! গা চুলকাতে চুলকাতে শশী আবার স্তাবকতা শুরু করলে, বউঠাকরুনের দোষ নাই মশায়। সে আমল মনে পড়লে দুঃখ হয়, আফসোস হয় হবার কথাই বটে। ওঃ, সে কী পসার, কী ডাক, দিনে রাত্রে খাবার শোবার অবসর নাই। সেই সাদা ঘোড়াটা, এত বড় ঘোড়া দু বছরের মধ্যেই কুমরে ধরে গেল! আর দেশেও কী জ্বর। হো-হো করে কাপুনি কেঁকো করে জ্বর। তার ওপর প্রেসিডেন্ট পঞ্চায়েত। ওরে বাবা রে বাবা! সে একটা আমল বটে। গঙ্গায় নৌকা চলা যাকে বলে। সেই হরিশ ডাক্তারের ছেলের মৃত্যু মনে আছে আপনার? এদিকে ঘরে ছেলের এখনতখন। ওদিকে মনের ভুলে মালিশের শিশিতে খাবার ওষুধ লিখে দিয়েছিল হরিশ–তাই খেয়ে নোটন গড়াঞ্চীর পুত্রবধূ যায় যায়, রাত্রি বারটায়। খোকা চাটুজ্জে ছুটে এসে পড়ল—তার বোন গলায় দড়ি দিয়েছে। দারোগা পুলিশ উঁক ঘুক করছে। ঘুষ খাবার জন্যে আপনি ওদিকে মেলায় পাঞ্জাবি খেলোয়াড়ের ছকের সামনে বসেছেন ক্টোচার খুঁটে টাকা নিয়ে, বাপরে বাপরে! সে কী রাত্ৰি! মনে আছে।
জীবন ডাক্তার একটা লম্বা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। একটু নড়ে বসলেন।
না। সেদিনের কথা ঠিক মনে নাই, স্পষ্ট মনে পড়ে না। মনে পড়িয়ে দিলে মনে পড়ে। মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এমনি একটা অস্বস্তি জেগে ওঠে। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন। কেন এমন হয়েছিল? কেন?
চঞ্চল হয়ে উঠলেন বৃদ্ধ। মনে পড়ে গেল সেই গোপন সংকল্পের কথা ঘোড়া কিনে ঘোড়ায় চড়ে আতর-বউকে পালকিতে ছড়িয়ে একদিন কাঁদী যাবেন। ঘোড়া তিনি কিনেছিলেন। বড় সাদা ঘোড়া। আতর-বউকে অলঙ্কার দিয়েছিলেন অনেক। কিন্তু কাঁদী যাওয়া হয় নি। কেন যে যান নি তা আজও বুঝতে পারলেন না। সংকোচ না ভয়, কে জানে? হয়ত বা দুই-ই। যে কারণেই হোক, পারেন নি। শুধু প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের মাদকতায় অঞ্চলটাতেই প্রমত্তের মত ঘুরে বেড়িয়েছেন। প্রতিষ্ঠার সেই বোধ করি শ্রেষ্ঠ সময়! চিকিৎসার খ্যাতি তাকে সর্বজনমান্য। করে তুলেছিল। সরকার পর্যন্ত তাকে খাতির করে—এখানকার প্রেসিডেন্ট পঞ্চায়েত করেছিল। কিন্তু কিছুতেই মন ভরে নি। যা পেয়েছেন তা দু হাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন। মনই তৃপ্তি পায় নি তো সঞ্চয় করবেন কোন্ আনন্দে? যদি বল প্রতিষ্ঠার আনন্দে, বলতে পার, কিন্তু সেও ফাঁকিতে পরিণত হয়েছে। তাই তো হয়। বাবা বলতেন রঙলাল ডাক্তারও বলতেন প্রতিষ্ঠা যদি সত্যকারের আনন্দ না হয়, মনকে যদি ভরপুর করে না দেয়, তবে সে জেনো মিথ্যেতার আয়ু সামান্য কয়েকটা দিনের, সে দিন কটা গেলেই সে প্রতিষ্ঠা হয়ে যায় ভুয়ো মিথ্যে। রঙলাল ডাক্তার হেসে ব্রান্ডির গ্লাস হাতে নিয়ে বলতেন—এই এর নেশার মত। একদিন বলেছিলেন নবদম্পতির আকর্ষণের মত। সেটা যদি নিতান্তই রূপ যৌবন ভোগের আনন্দের মত আনন্দ হয়—তবে রূপ যৌবন যাবার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ বিস্বাদ হয়ে তেতো হয়, মিথ্যে হয়। কিন্তু সে যদি ভালবাসা হয়, তবে সে কখনও যায় না জীবন! যদিও আমি ও দুটোর স্বাদ জানি না। বলে হা-হা করে হেসেছিলেন।
বাবা বলতেন পরমানন্দ মাধবের কথা। তাঁকে না পেলে কিছুই পাওয়া হয় না। তাকে পাওয়া যায় কি না জীবনমশায় ঠিক জানেন না। তবে তিনি পান নি। সম্পদের মধ্যে পান নি, প্রতিষ্ঠার মধ্যে পান নি, সংসারে আতর-বউ ছেলে-মেয়ে সুষমা সুরমা নিরুপমা বনবিহারী কারুর মধ্যে না।
নেশা তিনি করতেন না। নেশা ছিল রোগ সারানোর, রোগীকে বাঁচানোর। আর ছিল দাবা এবং মেলায় জুয়ো খেলা। মনে আছে, হাতের কঠিন রোগী বাঁচবে কি মরবে অন্তরে অন্তরে তাই বাজি রেখে জুয়োর ছকে দান ধরতেন। জিতলে বাঁচবে, হারলে মরবে। মেলে না। তবুও ধরতেন।
সে আমলে জুয়া খেলাটা দোষের ছিল না, অন্তত বড়লোকের ছেলের দোষের ছিল না। ছেলেবয়স থেকেই অভ্যাস ছিল কিছু কিছু। তারপর প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে উঠেছিল। সেটাকে বাড়িয়ে দিলে আবার আতর-বউ।
শশী বলছে সেই এক রাত্রির কথা। মনে পড়ছে বৈকি! সব মনে পড়ছে। রাত্রি শুধু নয়–রাত্রি দিন, সেকাল, সেকালের মানুষজন সকলকে মনে পড়েছে। সেকালের জলটলমল দিঘি, ধানভরা ক্ষেত-খামার, শান্ত পরিচ্ছন্ন ছায়াঘন গ্রামগুলি, লম্বা-চওড়া দশাসই মানুষ, মুখে মিষ্ট কথা, গোয়ালে গাই, পুকুরে মাছ, উঠানে মরাইয়ে ধান, ভাঁড়ারে জালায় জালায় চাল, কলাই মুগ মসুর ডোলা অড়হর মাষকলাই, মন মন গুড়—সে কাল—সে দেশ দেখতে দেখতে যেন পাটে গেল।
ম্যালেরিয়া ছিল না তা নয়। ছিল। পুরনো জ্বর দু-চার জনের হত। শিউলিপাতার রস আর তাদের বাড়ির পাঁচনে তারা সেরে উঠত। হঠাৎ ম্যালেরিয়া এল সংক্রামক ব্যাধির মত।
শশী হি-হি করে হাসছে। বলছে—হো-হো করে কেঁকে করে জ্বর। শশীর প্রকৃতি অনুযায়ী ঠিকই বলেছে শশী। জীবন ডাক্তারের সে স্মৃতি মনে পড়লে সমস্ত অন্তরটা কাতর আর্তনাদ করে ওঠে। উঃ, কত যে শিশুর মৃত্যু হয়েছিল সেবার, তার সংখ্যা নাই। শিশুমড়ক বলা চলে। মায়ের কান্নায় আকাশ ভরে উঠেছিল।
এ অঞ্চলে তখন তার বিপুল পসার। তিনি ছাড়া ছিলেন হরিশ ডাক্তার। কিশোরের বাবা কৃষ্ণদাসবাবু যাকে প্রথম স্থান দিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে। সে তখন ব্রজলালবাবুর দাতব্য চিকিৎসালয়ে কম্পাউন্ডার হয়েছে। দেখতে দেখতে আর দুজন ডাক্তার এসে বসল। পাসকরা ডাক্তার নয়, কম্পাউন্ডারি করত—রোগের মরসুমে ডাক্তার হয়ে এসে বসল। এই নবগ্রামের নরপতি রায়চৌধুরী একখানা হোমিওপ্যাথিক বই কিনে আর ওষুধ কিনে এক পাড়াগাঁয়ে গেল চিকিৎসা করতে। বরদা রায়চৌধুরীর ছোট ছেলে স্কুলের পড়া ছেড়ে চলে গেল কলকাতা—আর. জি. কর মেডিক্যাল স্কুলে পড়তে। পাগলা নেপালের ছোট ভাই-সেও খানিকটা পাগল ছিলপাগলা সীতারাম, সে খুলে বসল ওষুধের দোকান। নবগ্রাম মেডিক্যাল হল। খুচরা ও পাইকারি ওষুধের দোকান।
এই মড়ক মহামারীর মধ্যে মানুষ চিকিৎসা ব্যবসায়ে উপার্জনের প্রশস্ত পথ দেখতে পেলে।
ঘরে ঘরে মানুষ নিলে শয্যা। তাকে ঘুরতে হত সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। বাবুপাড়া, বণিকপাড়া, শেখপাড়া, মিয়াপাড়া, জেলেপাড়া, ডোমপাড়া, কাহারপাড়া, বাউরিপাড়া। হরিশ ডাক্তারের দু পকেট বোঝাই হত টাকায়। তার হত তিন পকেটচার পকেটও হতে পারত। কিন্তু তিনি তা করেন নি। তার বংশের ধারা তিনি ক্ষুণ্ণ করেন নি। অর্থ কাম্য ছিল না তা নয়–কিন্তু তার সঙ্গে পরমার্থও ছিল কামনা। ওরই ওপর তো মহাশয়দের মহাশয়ত্ব। হায় আতরবউ, আজ সেই তিনি কি রতনবাবুরা চার টাকা দিতে এসেছিল বলেই চার টাকা নিতে পারেন? ছি–ছি!
তিনি ডাকে বের হতেন-পথে যে তাকে ডেকেছে তার বাড়িই গিয়েছেন, যে যা দিয়েছে। তাই না দেখেই পকেটে ফেলেছেন। ক্ষেত্রবিশেষে সাহায্য করে এসেছেন। হরিশ এখানে আগন্তুক, সে রোজগার করতেই এসেছিল। জীবন দত্ত, এখানকার তিনপুরুষের চিকিৎসক, মশায়ের বংশ, শুধু তাই নয়—নিজের গ্রামের তিনি শরিক জমিদার, তাঁর কাছে কি উপাৰ্জন বড় হতে পারে? কখনও কোনোদিন মনেও হয় নি। বরং পকেট থেকে মেকি এবং খারাপ আওয়াজ টাকা আধুলি সিকি বের করে আতর-বউ বকাকি করলে তিনি কৌতুক অনুভব করতেন।
আতর-বউ বলতেন—হেসো না! আমার গা জ্বালা করে।
জীবনমশায় তাতেও হাসতেন। কারণ আতর-বউয়ের গাত্রজ্বালা স্থায়ী ব্যাধি। ওই জ্বালা চিতাকাষ্ঠে সঞ্চারিত হয়ে দাউদাউ করে জ্বলে তবে নিৰ্বাপিত হবে।
সে সময়ে পর পর দুটো ঘোড়া কিনেছিলেন তিনি। একটা বড় একটা মাঝারি। পায়ে হেঁটে ঘুরে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। বছর তিনেকের মধ্যেই দুটো ঘোড়াই অকৰ্মণ্য হয়ে গেল। কুমরি রোগ অর্থাৎ কোমরে বাত হল। জীবন ডাক্তারের বিপুল ভার বয়ে দুটো জীব প্রায় অক্ষম হয়ে গেল। জানোয়ার দুটোর শেষ জীবন হাঁটের মাক-ব্যবসায়ীর তামাক বয়ে অতিবাহিত হয়েছে। এরপর আর ঘোড়া কেনেন নি জীবন ডাক্তার। তাঁর শক্তির তো অভাব হয় নি, অভাব হত সময়ের, তা হোক, চারটেয় পাঁচটায় খাওয়া-তাই খেয়েছেন। মাঠের পথ ভেঙে ডাক্তার। হাটতেন। লোকে বলত—হাতি চলছে। হাতিই বটে। একদিন সকালে জুতোর কাদা ঘোচাতে গিয়ে ইন্দির লাফিয়ে উঠেছিল—বাপরে! সাপ! একটা মাঝারি কেউটে সাপের মাথা উঁর জুতোর তলায় চেপটে লেগেছিল। ঠিক জুতোর তলায় কে নিপুণ হাতে কেউটের মাথা একে দিয়েছে। ভাগ্যক্রমে অন্ধকারে ক্ৰক্ষেপহীন মাতঙ্গপদপাতটি ঠিক সাপটির মাথার উপরেই হয়েছিল! ইন্দির জুতোটা এনে তাকে দেখাতে তিনি হেসেছিলেন। আতর-বউ শিউরে উঠে মনসার কাছে মানত করেছিলেন তাঁকে তিরস্কার করেছিলেন। এমনই কি মানুষের উপার্জনের নেশা! দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটে টাকার জন্যে। তাতেও তিনি হেসেছিলেন এই কদিন আগেই আতর-বউ যে যা দেয়, ফি নেওয়ার জন্য বলেছিলেন, দাতাকৰ্ণদের ছেলের গলায় ছুরি দিতে হয় তা জান? তুমি তাই দেবে। সে আমি জানি।
বন্ধুরা তাঁদের রহস্য করে বলত দেশের লোকের সর্বনাশ আর ডাক্তারদের পৌষ মাস।
তাতেও তিনি হাসতেন। বুঝতেন বন্ধুদের ফিস্ট খাবার অভিপ্রায় হয়েছে। বলতেন—তা হলে পৌষ মাসে তো কিছু খেতে হয়। ফিষ্টি-টিষ্টি কিছু কর তা হলে।
—দে টাকা দেয়!
সেতাব সুরেন্দ্ৰ নেপাল ফিস্টের আয়োজনে লেগে যেত। গন্ধে গন্ধে শশীও জুটত। হরিশ ডাক্তারকেও নিমন্ত্রণ পাঠাতেন।
এসব হত রাত্রে। দিনে অবকাশ কোথায়? ভোরে উঠে আরোগ্য-নিকেতনে রোগী দেখে ডাক থেকে ফিরতেই হয়ে যেত অপরাহু, বেলা চারটে। চারটের পর খাওয়াদাওয়া সেরে দূরান্তের ডাক। সেখান থেকে ফিরতে নটা, দশটা, বারটা। তিনটেও হত। বারটা পর্যন্ত সেতাব সুরেন নেপাল তার অপেক্ষায় থাকত। আরোগ্য-নিকেতনের দাওয়ায় আলো জ্বলত, ইন্দির যোগাত চা আর তামাক, তারা খেলত দাবা। আর বসে থাকত চৌকিদারেরা। জীবনমশায় তখন প্রেসিডেন্ট পঞ্চায়েত। জীবনমশায় ফিরে এসে অন্তত একহাত দাবা খেলে চৌকিদারের হাজিরার খাতায় সই করে তবে বিশ্রাম করতেন। কতদিন রাত্রি প্রভাতও হয়ে যেত। খাওয়াদাওয়ার দিনে ইন্দির আর শশী যেত নবগ্রামের বাজারে। ডাক্তার চিট দিতেন। তেল ঘি নুন মসলা এমনকি সাহাদের দোকান থেকে আসত মদ। সুরেন নেপাল হরিশ ডাক্তার শশী এদের মদ নইলে তৃপ্তি হত না। নেপাল সুরেন যেত পাঠার খোঁজে। চৌকিদার যেত, জেলে ডেকে আনত, সে পুকুর থেকে মাছ। ধরে দিত। ডাক্তার আত্মবিস্মৃতই হয়েছিলেন। সে যেন একটা নেশার ঘোর।
মনে পড়ছে সে রাত্রির কথা। হ্যাঁ, জীবনের একটা স্মরণীয় রাত্রি বটে। বাড়ি, সেদিন বিকেলে বাড়ি থেকে বের হবেন প্রথমে যাবেন হরিশ ডাক্তারের বাড়ি, হরিশের ছেলের অসুখ শুনেছেন। তারপর যাবেন মেলায়। মেলা চলছে সে সময়। ভাদ্র মাসে, নাগ পঞ্চমীতে মনসা পুজোর মেলা। মেলার কর্তারা এসে নিমন্ত্রণও করে গেছে। জীবনমশায় গিয়ে পুলিশের সঙ্গে একটা রক্ষা করে জুয়ো খেলার বন্দোবস্ত করে দেবেন। এবং সেখানে জুয়া খেলে জীবনমশায়। দশ-বিশ টাকা জুয়াড়ীকে দিয়েও আসবেন। ঘরের মধ্যে জামা পরবার জন্যে ঢুকেই দেখলেন আতর-বউ জামার পকেট থেকে টাকা বের করে নিচ্ছেন। স্বামীর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আতর-বউয়ের মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। কোনো কথা বলবার আগেই আতর-বউ বলেছিলেন জুয়ো খেলে তুমি টাকা দিয়ে আসবে, সে হবে না। তোমার লজ্জা হয় না জুয়ো খেলতে? জীবন মশায় বলছিলেন–জুয়ো খেলব না; টাকা বের করে নিয়ো না। ছেলেদের দেব, চাকরদের দেব-ওরা সব মেলা দেখতে যাবে; মেলার মধ্যে দু-চার জন হাত পাতে; দিতে হয়। টাকা রাখ।
–রইল পাঁচ টাকা।
–পাঁচ টাকায় কী হবে?
–না। আর দেব না। কিছুতেই দেব না।
–ভাল।
জামাটা টেনে নিয়ে পাঁচটা টাকার নোটটাও ফেলে দিলেন। তারপর জামাটা গায়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল ছেলে বনবিহারী, নতুন বাইসিক্ল হাতে নিয়ে বাপের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে, মেলা দেখতে যাবে, টাকা চাই। গায়ে ডবলব্ৰেস্ট কোট, পায়ে পাম্পসু। বনবিহারী বাবুদের ছেলেদের সমান বিলাসী। চাকর ইন্দির দাঁড়িয়ে, নন্দ তখন ছেলেমানুষ, সেও দাঁড়িয়ে, তারা জানে—মশায় মেলার সময় বকশিশ দেবেন। সকলের দিকে তাকিয়ে যেন আগুন জ্বলে গেল। আতর-বউ পাঁচ টাকার নোটখানা কুড়িয়ে নিয়ে ছেলের হাতে দিলেন। জীবনমশায় বললেন–ইন্দির, আমার সঙ্গে আয়।
তিনি ভুলে গেলেন–হরিশের ছেলের অসুখের কথা। শুনেছিলেন, ছেলেটির অসুখ করেছে। গত রাত্রে হরিশকে নিমন্ত্ৰণ পাঠিয়েছিলেন খাওয়ার জন্য; হরিশ আসতে পারে নি, লিখেছিল–ছেলেটার হঠাৎ কম্প দিয়া জ্বর আসিয়াছে। মেয়েরা ভয় পাইতেছে, যাইতে পারিলাম না। জীবনমশায় ভেবেছিলেন একবার খোঁজ নেবেন। কিন্তু উদ্ভ্রান্ত হয়ে ভুলে গেলেন। নবগ্রামে সাহাদের মদের দোকানে এসে সাহাকে ডেকে বললেন–পঞ্চাশটা টাকা চাই সাহা।
সাহা শুধু মদের দোকানই করত না, টাকা দাদনেরও কারবার করত, সাধারণকে টাকা দিত গহনার উপর, সম্মানী ব্যক্তিকে হ্যান্ডনোট।
অবাক হয়ে গেল সাহা—মশায়ের টাকা চাই।
চাই। কাল-পরশু চেয়ে নিস। আন টাকা। বিনা বাক্যব্যয়ে সাহা টাকা এনে তার হাতে তুলে দিলে। কোনো স্মরণচিহ্ন চাইলে না।
টাকা নিয়ে ইন্দিরকে দুটো টাকা দিয়ে বাকি টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন—মেলা। মেলা ঘুরে গিয়ে বসেছিলেন জুয়োর আসরে। রাত্রি তখন আটটা। বসে গেলেন জুয়োর আসরে। মনে। মনে সেদিন কী বাজি রেখেছিলেন মনে নেই। বোধহয় এক বছরের মধ্যে তিনি যদি মরেন, তবে তিনি জিতবেন।
দশটার সময় ছুটে এসেছিল—এই শশী। শশী তখন হরিশের অধীনে চ্যারিটেবল ডিসপেনসারির কম্পাউন্ডার। তার মেলাতে থাকারই কথা, কিন্তু হরিশের ছেলের অসুখের জন্য। আসতে পারে নি। ছেলের অবস্থা সংশয়াপন্ন; ওদিকে হরিশের হাতের রোগী নোটন গড়াঞীর। পুত্রবধূ মালিশ খেয়ে বসে আছে। ভুল হরিশের। ছেলের অসুখ; বিভ্রান্তমস্তিষ্ক হরিশ মালিশের শিশি দিয়ে বলেছে—এইটে খাবার।
–এখুনি চলুন আপনি।
উঠেছিলেন তাই, তখন কেঁচার খুঁটে গোটা বিশেক টাকা অবশিষ্ট, ডাক্তার উঠেই টাকা। কটা গোছ করে জাহাজের ঘরে বসিয়ে দিয়ে বলেছিলেন সই! জাহাজ ডোবে তো গেল, ওঠে। তোে রেখে দিয়ো-কাল নেব।
জাহাজ ড়ুববে, অর্থাৎ তিনি হারবেন সে তিনি জানতেন। অর্থাৎ তিনি মরবেন না এক বছরের মধ্যে। অনেক দেখতে হবে তাঁকে। এখন হরিশের ছেলেকে দেখতে হবে, চল।
যেতে যেতে হরিশের ছেলে শেষ হয়ে গিয়েছিল। জীবন মশায়কে দেখে বুক চাপড়ে কেঁদে উঠেছিল হরিশ।জীবন! এ কী হল আমার! জীবন! তুমি যদি সকালে একবার আসতে ভাই, তবে হয়ত বাচত আমার ছেলে।
জীবনমশায় মৃদু তিরস্কার করেছিলেন হরিশকে—তুমি না ডাক্তার হরিশ! ছি! তোমার তো এমন অধীর হওয়া সাজে না। অন্যহনি ভূতানি গচ্ছন্তি যমমন্দির এ কথা জানেন যিনি নিয়ন্তা তিনি, আর জানেন তত্ত্বজ্ঞানী—আর এ সমস্ত না বুঝেও এ কথা তো ডাক্তারের অজানা নয়। চুপ কর। মেয়েদের সান্ত্বনা দাও। আমি যাই গড়ীর বাড়ি।
মুহূর্তে হরিশের শোকের উচ্ছ্বাস স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
গড়াঞীর বাড়ির সামনে তখন নানা গবেষণা চলছে। হরিশের ভাগ্য ভাল; সময়টা মেলার। লোকজন সবই গিয়েছে মেলায়। নইলে এতক্ষণ হরিশের বিরুদ্ধে থানায় ডায়রি হয়ে যেত। জীবনমশায় এসে বসলেন। প্রথমেই শিশিটা হস্তগত করে পকেটে পুরলেন। তারপর নাড়ি। ধরলেন। বিষের ক্রিয়ার লক্ষণ রয়েছে, কিন্তু প্রশ্ন করলেন-ওষুধটা সবটা খেয়েছে? পেটে গিয়েছে? যায় নি। ঋজালো ওষুধ রোগী বমি করে ফেলে দিয়েছে। ভয় নাই। শশীকে। বললেন––ডিসপেনসারিতে স্টমাক-পাম্প আছে—নিয়ে আয়।
সেই রাতেই রাত বারটায় খোকা চাটুজ্জে এসে পড়ল—মশায় রক্ষা করুন। আমার বোন নলিনী গলায় দড়ি দিয়েছে।
চিকিৎসার জন্য খোকা চাটুজ্জে তাকে ডাকে নি। অন্য কারণে ডেকেছিল।
জীবনমশায় প্রেসিডেন্ট পঞ্চায়েত। তিনিই পারেন পুলিশ-লাঞ্ছনার হাত হতে বাঁচাতে। তা তিনি বাঁচিয়েছিলেন। গড়াঞীর পুত্রবধূর পেটের মালিশ বমি করিয়ে বের করে মরণের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নতুন ওষুধ দিয়ে রাত্রি আড়াইটার সময় থোকা চাটুজ্জের বাড়ি এসে বাইরের দাওয়ার উপর বসলেন। রিপোর্ট লিখে বললেন, শ্মশানে নেবার ব্যবস্থা কর। আমি রয়েছি।
সেতাবকে বললেন–দাবার ছক খুঁটি আন সেতাব। শুধু তো বসে থাকা যায় না। পাত, ছক পাত।
সব মনে পড়ছে। মনে আছে সবই; মনে পড়ালেই মনে পড়ে। সেদিন রাত্রি চারটে পর্যন্ত দাবা খেলেছিলেন-বাজির পর বাজি জিতেছিলেন। সেতাব বলেছিল—তোর এখন চরম ভাল সময় রে জীবন! ডাঙায় নৌকো চলছে।
তাঁরই তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু–!
হঠাৎ আটকে গেল নৌকো।
এই মেলার পরই কিন্তু বনবিহারী প্রমেহ রোগে আক্রান্ত হল। শুনলেন মেলায় সে নাকি মদও খেয়েছিল।
ডাঙায় চলমান নৌকাটা আটকেই শেষ হয় নি, অকস্মাৎ মাটির বুকের মধ্যেই ড়ুবে গেল।
জীবনমশায় ছেলে বনবিহারীকে ডেকে বলেছিলেন, ছিছিছি। বনবিহারী মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু সে নতমুখে তার কঠিন ক্রোধ ফুটে উঠেছিল। জীবনমশায় বলেছিলেন বংশের ধারাকে যে কলুষিত করে সে কুলাঙ্গার। বাপ লজ্জা পায়, মা লজ্জা পায়, ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষ শিউরে ওঠেন পরলোকের সমাজে তাদের মাথা হেট হয়! জানতে পারেন নি, দরজার ওপাশে কখন আতর-বউ এসে কান পেতে দাঁড়িয়েছেন। তিনি সেই মুহূর্তেই ঘরে ঢুকে বলেছিলেন—একটা ভুলের জন্য এত বড় কথা বললে তুমি ওকে? আমার গর্ভের দোষ দিলে! চৌদ্দ পুরুষের মাথা হেঁট করেছে বললে? তুমি লজ্জা পেয়েছ বললে! তুমি নিজের কথা ভেবে দেখে কথাটা বলেছ? নিজে তুমি কর নি? ও হয়ত সঙ্গদোষে কোনো ভ্ৰষ্টার পাল্লায় পড়ে একটা ভুল করে ফেলেছে। কিন্তু তুমি? মঞ্জরীর জন্যে তুমি কী কাণ্ডটা করেছিলে—মনে পড়ে না?
স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন জীবনমশায়।
আতর-বউ ছেলের সামনে মঞ্জরীর কথা বৰ্ণনা শেষ করে ছেলের হাত ধরে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।–উঠে আয়!
জীবনমশায় বসে রইলেন অপরাধীর মত। এবং যে মঞ্জরীকে তিনি অপরাধিনীর মত জীবন থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন-আতর-বউ সেই মঞ্জরীকেই তার সামনে মাথা তুলিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেল; পাওনাদারের মত।
প্রতিষ্ঠার এই উৎসবমুখরিত কালে দীর্ঘদিন মঞ্জরীকে তার বারেকের জন্যও মনে পড়ে নি। সেদিন মনে পড়িয়ে দিয়েছিল আতর-বউ। মদ্যপানের ফলে, ব্যভিচারের পাপে ভূপী বোসের ব্যাধি মঞ্জরীর ভাগ্যকে করেছিল মন্দ; তাতে কি তিনি মনে মনে আনন্দ পেয়েছিলেন? তারই জন্যই কি তিনি পেলেন এই আঘাত? সেইদিনই তিনি বুঝেছিলেন বনবিহারীর জীবনে মৃত্যুবীজ বপন হয়ে গেল। মানুষের জীবনে মৃত্যু ধ্রুব, জন্মের মুহূর্ত থেকে ক্ষণে ক্ষণেই সে তার দিকে চলে; মৃত্যু থাকে স্থির, হঠাৎ একদিন মানুষ রিপুর হাত দিয়ে তাকে নিমন্ত্ৰণ পাঠায়; তখন মৃত্যুও তার দিকে এগিয়ে আসে। এক-একজন অহরহ ডাকে। ওই দাঁতুর মত। দতু মরবে। বনবিহারীর মতই মরবে। প্রদ্যোত ডাক্তার ওকে বাঁচাতে পারবে না।
হঠাৎ জীবনমশায় সচেতন হয়ে উঠলেন। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলেন।
শশী এতক্ষণ পিছনে বসে বৃদ্ধ হস্তীকে আপন মনেই গালাগাল দিয়ে চলেছিল। এর মধ্যেই পকেট থেকে ক্যানাবিসিন্ডিকা-মেশানো পানীয়ের শিশি বের করে সে এক ঢোক খেয়ে নিয়েছে। গাড়িতে তামাক সেজে খাওয়ায় বিপদ আছে। খড়ের বিছানায় আগুন লাগতে পারে। সেই ভয়েই। ও ইচ্ছা সংবরণ করে দুটো বিড়ি, চার পয়সায় দশটা গোল্ডফ্লেক সিগারেটের একটা সিগারেট শেষ করেছে। এবং মধ্যে মধ্যে দাঁতে দাঁত ঘষে ভেবেছে—বুড়োর পিঠে গোটাদুয়েক কিল বসিয়ে দিলে কী হয়? না-হয় তো—জ্বলন্ত সিগারেটের ডগাটা পিঠে টিপে ধরলে কী হয়? চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে?
মশায়কে নড়েচড়ে বসতে দেখে, ছাইয়ের বাইরে মুখ বের করে তাকাতে দেখে শশী বললে—নেমে একবার দেখব নাকি?
–কী?
–ব্যাটা দাঁতু সত্যিই ভর্তি হল কি না হাসপাতালে?
ঠিক হাসপাতালের সামনে এসে পড়েছে গাড়িখানা।
–না। কে বল তো? গলাখানি বড় মিঠে। গাইছেও ভাল। গানখানিও চমৎকার! ওই বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে–ডাক্তার ছোকরা নয়?
উৎসাহিত হয়ে শশী ছইয়ের পিছন দিক থেকে ঝপ করে লাফিয়ে নেমে পড়ল। বললে–হা ডাক্তারই বটে। ডাক্তারের পরিবার গান করছে। যেমন স্বামী তেমনি স্ত্রী। সে একেবারে ঋটি মেমসাহেব। বাইসিকিলে চড়ে গো। আর চলে যেন নেচে নেচে। গান তা যখন তখন। অই। অঃই, দেখুন না।
সামনের বারান্দাতেই স্বামী-স্ত্রী প্রায় ছোট ছেলেমেয়েদের মত খেলায় মেতেছে। তরুণী স্ত্রী ডাক্তারের হাত চেপে ধরেছে, হাত থেকে জলের মগটা কেড়ে নেবে। সে নিজে জল দেবে। ডাক্তার বোধ করি হাত-পা ধুচ্ছিল।
ডাক্তার দেবে না। সে তাকে নিরস্ত করতে বালতি থেকে জল নিয়ে তার মুখে ছিটিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটি ছুটে চলে গেল ঘরের মধ্যে। আবার ছুটে বেরিয়ে এসে কিছু যেন ছুঁড়ে মারল ডাক্তারের মুখে। ডাক্তারের মুখ সাদা হয়ে গেল। পাউডার। পাউডার ছুঁড়ে মেরেছে।
শশী খুখুক করে হাসতে লাগল।
মশায়ের মুখেও একটি মৃদু হাস্যরেখা ফুটে উঠল। গাড়ি মন্থর গমনে চলতে লাগল। গণেশ ভটচাজের মেয়ে তা হলে ভাল আছে। আশা হয়েছে। পরমানন্দ মাধব! না হলে ডাক্তার এমন আনন্দের খেলায় মাততে পারত না। ছোকরার সাহস আছে, ধৈর্য আছে। জেদ আছে। বড় হবার অনেক লক্ষণ আছে। শুধু একটা জিনিস নাই। অন্য মতকে মানতে পারে না। অবিশ্বাস করতে হলে আগে বিশ্বাস করে দেখা ভাল। বিশ্বাস করে না-ঠকে অবিশ্বাস করলে যে ঠকা মানুষ তাঁকে সেইটেই হল সবচেয়ে বড় ঠকা। তাতেই মানুষ নিজেকে নিজে ঠকায়। আর বড় কটুভাষী! একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন মশায়। আবার নড়ে বসলেন। কিন্তু দাঁতু বাঁচবে না। দাঁতু নিজেকে। নিজে মারছে, তাকে কোন্ চিকিৎসক বাঁচাবে? অবশ্য পরিবর্তন মানুষের হয়।
এই তো নবগ্রামের কানাইবাবু। তিনি আজ নাই, অনেকদিন মারা গেছেন। জীবন দত্ত তাকে দেখেছেন। মাতাল, চরিত্ৰহীন, দুর্দান্ত রাগী, কটুভাষী লোক ছিলেন তিনি। প্রথম পক্ষ বিয়োগের পর আবার বিবাহ করলেন দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর স্পর্শে লোহা থেকে সোনা হয়ে যাওয়ার মত আর এক মানুষ হয়ে গেলেন। মদ ছাড়লেন, ব্যভিচার ছাড়লেন, কথাবার্তার ধারা পাল্টালেন, সে রাগ যেন জল হয়ে গেল; শুধু তাই নয়, মানুষটি শুধু সদাচারেই শুদ্ধ হলেন না, পড়াশুনা শাস্ত্রচর্চা করে উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন জীবনে। তাও হয়। কিন্তু বনবিহারীর হয় নি। দাঁতুরও হবে না। আবার মনে হল রামহরির কথা। বার বার প্রশ্নটা ঘুরে ঘুরে জাগছে মনের মধ্যে। কী আর হল? তবে কি এই নতুন স্ত্রীটি তার জীবনে এমন মধুর আস্বাদ দিয়েছে যার মধ্যে সে মাধবের মাধুর্যের আভাস পেয়েছে?
হঠাৎ তার একটা কথা মনে হল। তিনি মুখ বাড়িয়ে শশীকে ডাকলেন লিউকিস!
শশী ইতিমধ্যে রাস্তায় নেমে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে—তামাক সেজে হুঁকো টানছে। হুঁকোটা নামিয়ে সে সবিস্ময়েই জীবন মশায়ের মুখের দিকে তাকালে। হঠাৎ বুড়োর হল কী? লিউকিস বলে ডাকে যে!
এ নাম তার সে আমলের নাম। ম্যালেরিয়ার আবির্ভাবের সময় পাগলা নেপালের ভাই সীতারাম, যে নগ্রাম মেডিক্যাল হল খুলেছিল—সেই সীতারামের দেওয়া নাম। সেও ছিল আধপাগলা। সত্তর বছরের বৃদ্ধ থেকে ষোল বছরের ছেলে পর্যন্ত সবাই ছিল তার ইয়ার। সকলের সঙ্গেই সে তামাক খেত। অথচ তার চরিত্রের মধ্যে কোথায় ছিল একটি মাধুর্য যে এতটুকু বিরক্ত হত না কেউ।
সে কলকাতার বড় বড় সাহেব-ডাক্তারের নাম নিয়ে এ অঞ্চলের ডাক্তারদের নামকরণ করেছিল।
জীবন দত্তের নাম দিয়েছিল—ডাক্তার বার্ড।
হরিশ ডাক্তারকে বলত ডাক্তার ম্যানার্ড।
শশীকে বলত–লিউকিস।
নতুন ডাক্তার এসেছিল হাসপাতালে কলকাতার মিত্তিরবাড়ির ছেলে, তাকে বলত-ডাঃ ব্রাউন!
সীতারামের এই রসিকতা সেকালে ভারি পছন্দ হয়েছিল লোকের। ডাক্তারেরা নিজেরাও হাসতেন এবং মেজাজ খুশি থাকলে পরস্পরকে এই নামে ডেকে রসিকতা করতেন।
এতকাল পরে সেই নাম? বিস্মিত হল শশী। কিন্তু এই নামে সেকালে ডাকলে যে উত্তর সে দিত সেই উত্তরটি দিতে ভুল হল না তার। ঘাড়টা একটু ঘেঁট করে সায়েবি ভঙ্গিতে সে বললে–ইয়েস স্যার!
জীবনমশায় বললেন–সে আমলটা বড় সুখেই গিয়েছে, কী বলিস শশী?
—ওঃ, তার আর কথা আছে গো! সে একেবারে সত্যযুগ।
হেসে ফেললেন ডাক্তার। শশীর সবই একেবারে চরম এবং চূড়ান্ত। ভাল তো তার থেকে। ভাল হয় না, মন্দ তো–একেবারে মন্দ। হয় বৈকুণ্ঠ নয় নরক।
তারপরই শশী বললে–সীতারাম বেটা শাপভ্রষ্ট দেবতা ছিল, বুঝলেন? তাহঠাৎ সীতারামকে মনে পড়ল ডাক্তারবাবু?
–নাঃ। তার নামটা মনে পড়ে গেল। আমি জিজ্ঞেস করছিলাম রামহরির কথা।
–বললাম তো বেটার অবস্থা আজকে খারাপ, বোধহয় অনিয়ম-টনিয়ম করেছে। তা শুধাবার তো উপায় নাই। মারতে আসবে বেটা। বলে মারার চেয়ে তো গাল নাই, মরতে তো বসেইছি, না খেয়ে মরব কেন, খেয়েই মরব।
—সে তো গিয়েই দেখব রে। আমি শুধাচ্ছি ব্যাপারটা কী বল দেখি, মানে নতুন বিয়ে করে
মশায়ের কথার মাঝখানে তাচ্ছিল্যভরে শশী বলে উঠল—বেটার মতিগতি কী রকম পালটেছে আর কি!
—হুঁ। রামহরির এই স্ত্রীটি বোধহয় খুব ধার্মিক মেয়ে, দেখতেও বোধহয় খুব সুন্দরী?
শশী একটু ভেবেচিন্তে বললে—তাই বোধহয় হবে।
–হুঁ! ডাক্তার স্মিতহাস্য প্রসন্ন মুখে আবার আকাশের দিকে চোখ তুললেন।
নবগ্রামের বাজার সম্মুখে।
ডাক্তার বললেন–বাইরে বাইরে চল বাবা মাঠের পথে। ভিড় ভাল লাগে না।
২২. মাঠের পথেই গাড়ি ভাল
মাঠের পথেই গাড়ি ভাল।
জীবনমশায় এবার একটু দেহ এলিয়ে শুয়ে পড়লেন। শশী বললে—তাই গড়ান একটু। আমি হেঁটেই চলি। আঃ! এ সময় একটু বিশ্রাম না করলে চলবে না। এ সময়টায় জীবনে বোধ করি কখনই তিনি বের হন নি। কোনো ডাক্তারই যায় না। ডাক্তারেরাও তো মানুষ।
অনাবৃষ্টির শেষ শ্রাবণের দুপুরবেলা; মেঘাচ্ছন্নতা রয়েছে, বৃষ্টি নাই। মাঠ শুকনো না হোক, অনাবাদি পড়ে রয়েছে। ফসল নাই কিন্তু আগাছা বেড়েছে। মাঠের এখানে ওখানে বাঁশ উঁচু হয়ে রয়েছে। পুকুর থেকে দুনি করে জল তুলে চাষ করছে উদ্যোগী চাষীরা। একেবারে সব থেকে নিচু মাঠে চাষ চলছে। সেখানে মানুষ গরুর মেলা বসে গেছে, গাড়িখানা চলেছে উঁচু মাঠের মাঝখান দিয়ে, দু-চার জন চাষী এখানে কায়ক্লেশে কাজ চালাচ্ছে। দেশে শস্য নাই, আকাশে মেঘ দুর্লভ, মেঘ যদি আসে তাতে বৃষ্টি আরও সুদুর্লভ। বৃষ্টি হলে রোগটা কম হয়। এ তিনি ভাল করে লক্ষ্য করেছেন—যেবার বৃষ্টি ভাল হয়—সেবার ম্যালেরিয়া অন্তত কম হবেই। কত আবিষ্কার হল; মশা ম্যালেরিয়ার বীজ বয়ে নিয়ে বেড়ায়; কলেরার বীজাণু জলের মধ্যে বাড়ে, খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মানুষকে আক্রমণ করে মাছিতে বয়ে নিয়ে বেড়ায়, ছড়ায়; কলেরার টিকা আবিষ্কার হল; কালাজ্বরের চেহারা ধরা পড়ল; কত কত রোগ আবিষ্কার। হ্যাঁ, দেখে গেলেন। বটে। সাধ অবশ্য মিটল না; বড় একজন চিকিৎসক হয়ে এর তত্ত্ব-তথ্য পুরো দেখা এবং বুঝে ওঠা ঘটল না, শুনলেন বিশ্বাস করে গেলেন—কার্য-কারণের রহস্য দেখবার দিব্যদৃষ্টি লাভ হল না এ জন্মে—তবুও অনেক, অনেক দেখে গেলেন। একটি সাধ হয় মধ্যে মধ্যে—অণুবীক্ষণ যন্ত্রে বীজাণুগুলিকে চোখে দেখা যায় তাদের বিচিত্র চেহারা বিচিত্র ভঙ্গি—সেই দেখবার ইচ্ছা হয়, আর ইচ্ছে হয় এক্স-রে করানো যখন হয় তখনকার ব্যাপারটা। মানুষের রূপময় দেহ অদৃশ্য হয়ে যায় দেখা যায় কঙ্কাল-অন্ত্রপাতির ক্ষত। মতির মায়ের পায়ের এক্স-রের প্লেটটা একবার দেখতে তার ইচ্ছে হয়।
হঠাৎ জীবন মশায়ের চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল। শশী হাত নেড়ে ও কী করছে?
কাকে ও যেন ইশারা করছে। কে? কাকে?
—কে রে শশী?
–আজ্ঞে?
–কাকে কী বলছিস হাত নেড়ে?
–পুতকী আর মাছির বাচ্ছা গো। অ্যাঁকের মত উড়ছে মুখের চারিপাশে। বর্ষাতে বৃষ্টিবাদলের নাম নাই, এ বেটাদের পঙ্গপাল ঠিক আছে, বেড়েছে—এ বছর বেড়েছে। শশী বার বার শূন্যমণ্ডলে হস্ততাড়না শুরু করলে।
—গাড়িতে উঠে আয়।
–এই তো—আর এসে পড়েছি। সামনেই তো ডাঙাটা। ডাঙাতে এ আপদ থাকবে না।
সামনেই মস্ত বড় উঁচু টিলা। টিলার ওপারেই ঢালের উপর গলাইচণ্ডী ঢুকবার মুখেই রামহরির বাড়ি। এখন আখড়া। সিধে লাল রাস্তা চলে গিয়ে বেঁকেছে। একজন সাইকেল আরোহী চলেছে। পাড়ার্গায়েও আজ সাইকেল হয়েছে। দু-চারখানা পাওয়া যাবেই; মশায়ের জীবনে একসময় দুটো ঘোড়া এসেছিল—তারপর গরুরগাড়িতেই যাত্রা শেষ করলেন।
প্রদ্যোতের সঙ্গে পারবার তাঁর কথা নয়। হাসলেন ডাক্তার। প্রদ্যোত ডাক্তার নাকি মোটর কিনবে। অন্ততপক্ষে মোটর সাইকেল। চার ঘণ্টায় বিশ মাইল পথ সদর গিয়ে আবার ঘুরে আসবে।
লোক ছুটে আসছে। গাড়ি দেখে থমকে দাঁড়িয়ে বললে—শিগগির আসুন।
***
রামহরির বাড়ির দরজায় কজন শুকমুখে দাঁড়িয়ে আছে।
জীবন ডাক্তার দেখে বা শুনে চকিত হন নি। হার্টফেল করে মৃত্যু হয়ে থাকবে। বিস্মিত হবার কী আছে? ভিতরে শশী তার পিছনে বসে ছিল; সে সচকিত হয়ে প্রশ্ন করলে–কী হল? বলি–হ্যাঁ হে?
–আপনি যাওয়ার পর বার দুই দাস্ত করে কেমন করছে ডাক্তারবাবু।
মশায় উঠে বসলেন। তাঁর কলবাক্সটায় হাত দিয়ে ভেবে নিলেন। এ অবস্থায় রোগীর একটা দুটো ইনজেকশন হলে ভাল হয়। তাঁর মকরধ্বজ, মৃগণাভি আছে, কিন্তু ইনজেকশন বেশি ফলপ্রদ, শশী এসব বিষয়ে নিধিরাম সর্দার। ইনজেকশন দেয় বটে, একটা সিরিঞ্জ তার আছে, কিন্তু সুচগুলো তার নিজের বেশভূষা শরীরের মতই অপরিচ্ছন্ন। যে পকেটে তামাক-টিকা থাকে—সে পকেটেও সময়ে সময়ে বাক্স রাখতে শশী দ্বিধা করে না। তার ওপর ওষুধ শশীর থাকে না। ওষুধ না থাকলে শশী একটা শিশি থেকে অ্যাকোয়া নিয়ে অম্লান বদনে ইনজেকশন দিয়ে দেয়।
থাক ইনজেকশন। যা হয় মকরধ্বজেই হবে। রামহরি যখন এতটাই প্রস্তুত তখন ইনজেকশন দিয়ে মৃত্যু খানিকটা বিলম্বিত করেই বা হবে কী? জ্ঞানগঙ্গা? নাই বা হল।
মৃত্যু স্থির জেনে তাকে বরণ করতে চাওয়ার মত মনটাই সবচেয়ে বড়! নেহাতই যদি আয়োজন হয়, তবে মধুর অভাবে গুড় দিয়েই কাজ চলবে। তীর্থপুণ্য-বিশ্বাসী, নামপুণ্য-বিশ্বাসী রামহরির চোখের সামনে দেবতার মূর্তি এবং নাম-কীৰ্তন তীর্থের অভাব অনেকটা পূরণ করবে। তা ছাড়া জ্ঞানগঙ্গায় মুক্তির কথা মানতে গেলে ভাগ্যের কথাটাও তো ভাবতে হবে, মানতে হবে। রামহরির সে ভাগ্য হবে কী করে?
সঙ্কল্প প্রায় স্থির করেই ঘরে ঢুকলেন জীবন ডাক্তার। রামহরিকে কী বলবেন তার খসড়াও মনে মনে করে নিলেন। কিন্তু ঘরে ঢুকে রোগীকে দেখেই তিনি ভ্র কুঞ্চিত করে উঠলেন। এ কী? একখানা তক্তাপোশের উপর রামহরি শুয়ে আছে—নিস্পন্দের মত। বিবর্ণ পাণ্ডুর দেহবর্ণ। চোখের পাতায় যেন আকাশ-ভাঙা মোহ। দুৰ্বলতার ঘোর তার পাণ্ডুর দৃষ্টিতে। ক্ষণে ক্ষণে চোখের পাতা নেমে আসছে। আবার সে মেলছে। মেললেও সে দৃষ্টিতে ঔৎসুক্য নাই, প্রশ্ন নাই, কিছু চাওয়া নাই। এ কী অবস্থা? সমস্ত মিলিয়ে এই অবস্থা তো কয়েকটা দাস্তের ফলে সম্ভবপর নয়। তাঁর বহু-অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে এক নজরেই যে বুঝতে পারছেন—এ রোগী তিলে তিলে এই অবস্থায় উপনীত হয়েছে। ঘরের গন্ধে, রোগীর আকৃতিতে এবং লক্ষণে রোগ যে পুরাতন অজীর্ণ অতিসার—তাতে আর তার সন্দেহ নাই। অ্যালোপ্যাথরা আজকাল একে বলবেন ইনটেস্টাইন্যাল টিউবারকিউলোসিস্। অণুবীক্ষণিক পরীক্ষায় ক্ষয়রোগের বীজও পাওয়া যাবে। ক্ষয়রোগধীরে ধীরে ক্ষয় করে মানুষকে। এ অবস্থা আকস্মিক নয়। অন্তত দুদিন-তিন দিন থেকে এই অবস্থাতেই আছে, তিলে তিলে বেড়ে আজ এই অবস্থায় এসেছে।
শশী নিজেই একটা মোড়া বিছানার পাশে রেখে রামহরির মুখের কাছে ঝুঁকে ডেকে বললরাম, রাম! ডাক্তারবাবু এসেছেন। রাম!
—থাক, শশী। ওর সাড়া দিতে কষ্ট হবে। সরে আয়-আমি দেখি।
শশী উঠল—উঠেই আবার হেঁট হয়ে বললে—এখন আবার দলিলপত্র কেন রে বাপু। একখানা দলিল সে তুলে নিলে বিছানা থেকে। দলিলটা বিছানায় পড়ে ছিল।
এবার এগিয়ে এল রামহরির তরুণী পত্নীর ভাইটি। উচ্চবর্ণের বিধবা ভগ্নী রামহরিকে বরণ করে তাদের সঙ্গে সকল সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে থাকলেও রামহরির এই অসুখে ভগ্নীর বিপদের সময় না এসে পারে নাই। পনের-কুড়ি দিন হল এখানে এসে রয়েছে। সে বললে—উইল ওটা। ওর ইচ্ছে ছিল ডাক্তারবাবু এলে তার সামনে টিপছাপ দেবে, ডাক্তারবাবুকে সাক্ষী করবে, তা হঠাৎ এই রকম অবস্থা হলে বললে—কী জানি, যদি ডাক্তারবাবু আসবার আগেই কিছু হয়! বলা তো যায় না! বলে নিজে উইল নিয়ে বুড়ো আঙুলের টিপ দিলে, সাক্ষীদের সই করালে; তারপর দেখতে দেখতে এই রকম।
মাথার কাছে একটি তরুণী মেয়ে বেশ ঘোমটা টেনে বসে ছিল। সে গুনগুন করে কেঁদে উঠল। ডাক্তার তার দিকে চাইলেন একবার, তারপর নাড়ি ধরে চোখ দুটি বন্ধ করলেন। ক্ষীণ নাড়ি, রোগীর মতই দুর্বল—মন্দ গতিতে বয়ে চলেছে, যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ ওকে চলতেই হবে। থামবার অবকাশ নাই, অধিকার নাই, উপায় নাই। মধ্যে মধ্যে যেন কাঁপছে; চন্দ্ৰে গ্ৰহণ লাগলে চাঁদ যেমন কাপে—তেমনি কম্পন। মৃদু এবং অতি সূক্ষ্ম অনুভূতিসাপেক্ষ। অন্ত্রের মধ্যে যে ক্ষয়রোগের কীট গ্রাস করে চলেছে, রেশমকীটের উঁত পাতা খাওয়ার মত—তাতে আর সন্দেহ নেই। তবে আপাত মৃত্যুলক্ষণ তিনি অনুভব করতে পারলেন না।
স্টেথোসকোপ দিয়ে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন অনুভব করলেন। এ অবস্থায় কোনোমতেই আকস্মিক পরিণতি হতে পারে না। নাড়ির গতির সঙ্গে হৃৎপিণ্ডের সঙ্গতি—ঠিক যেন মিত্ৰভাবাপন্ন যন্ত্রী ও বাদকের মত! দুর্বল হলেও সঙ্গত তো ব্যাহত হচ্ছে না!
ওদিকে শশী অনর্গল বকছিল, এসব হল খলব্যাধি! হঠাৎ দাস্ত হল, বাস্ নাড়ি গেল। রোগী চোখ মুদল। আমি আজ সাত দিন থেকে বলছিওরে বাপু, যা ব্যবস্থা করবার করে ফেল। গঙ্গাতীর যাবি তো চলে যা। ডাক্তারবাবুকে দেখাবি তো ডাকি। তা রোজই বলে—কাল। নিত্য কালের মরণ নাই, ও আর আসে না। ভদ্রলোকের এক কথা-কাল। নে, হল তো?
মেয়েটি আবার কাঁদতে লাগল।
শশী আবার বকতে শুরু করলে হবে কেন? ভাগ্যে থাকলে তো হবে। কর্মফল কেমন দেখতে হবে! গঙ্গায় সজ্ঞানে মৃত্যু, এর জন্যে তেমনি কর্ম চাই। আমাদের শাস্ত্রে বলে–চিকিৎসকেই বা কী করবে—হোক না কেন ধন্বন্তরিনীলরতনবাবু কি ডাক্তার রায়; আর ওষুধই বা কী করবেসে হোক না কেন সুধা-আর দশ-বিশ টাকা দামের টাটকা তাজা ওষুধ; আয়ু। না থাকলে কিছুতেই কিছু না। এও তেমনি ভাগ্যকর্ম। সুমতি হলে কী হবে, মতিভ্ৰম ঠিক। সময়ে এসে সুমতির ব্যবস্থা সব পালটে দেবে।
মশায় উঠলেন। দেখা তাঁর শেষ হয়েছে।
এবার মেয়েটি এসে পায়ে আছড়ে পড়লওগো ডাক্তারবাবু গো! আমার কী হবে গো!
মশায় একবার সবারই মুখের দিকে চাইলেন। তারপর বললেন– ভয় নাই, ওঠ তুমি, ওঠ; ওঠ।
শশী ব্যস্ত হয়ে বলল–ওঠ, ওঠ। উনি যখন বলছেন ভয় নাই তখন কাঁদছ কেন? উনি দু কথার মানুষ নন! ওই হয়েছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। সর সর। ওঠ!
বাইরে এলেন মশায়। এবার তাঁর সর্বাগ্রে চোখে পড়ল—সাইকেলখানা।
মশায় ডাকলেন শশী।
শশী বকছিল–হ্যাঁ, হ্যাঁ। তাই হবে, ওঁর মত মানুষ, উনি কি দেখবেন যে ওই অবলাটা ভেসে যাবে? ভাল ঘরের মেয়ে, সৎ জাতের কন্যা, মুনিনাঞ্চ মতিভ্ৰম—মতিভ্রমের বশে যা করেছে তার ফল শাস্তি সে ভগবান দেবেন। আমরা মানুষ—আমরা ওকে ভেসে যেতে দেব না। ব্যস্।
ডাকবার আগেই ক্রমশ তার স্বর নিস্তেজ হয়ে আসছিল। এবার স্তব্ধ হয়ে গেল।
–ওকে মেরেই ফেলেছিস শশী? ইচ্ছে করে? না জানিস নে, বুঝতে পারিস নি?
–আজ্ঞে?
–এ অবস্থা তো আজ তিন দিন থেকে হয়েছে। বুঝতে পারলি নে তো ডাকলি নে কেন?
–আজ্ঞে না। মা-কালীর দিব্যি!
–শশী! ধমক দিয়ে উঠলেন জীবন ডাক্তার।
–মাইরি বলছি, ঈশ্বরের দিব্যি, গুরুর দিব্যি—
এবার মৃদুস্বরে মশায় বললেন– তোদর কজনকে পুলিশে দেওয়া উচিত। থাম-চেঁচাস। নে। যাক এখন শোন, ওই যে ছোকরা সাইকেল চেপে আমাদের গাড়ি দেখতে গিয়েছিল, সে কই? এই যে! ওহে ছোকরা, শোন। কই দোয়াত-কলম দেখি। আমি লিখে দিচ্ছি ওষুধ। যাও। নিয়ে এস বিনয়ের দোকান থেকে। আর বাজারের ডাক্তার হরেনবাবুকে এই চিঠি দেবে। বুঝেছ? জলদি যাবে আর আসবে।
শশীকে দমানো যায় না। শশী ওই শক্তিতেই বেঁচে আছে। সে ছোকরার হাত থেকে প্রেসক্রিপশন এবং চিঠি দুই নিয়ে দেখলে। বললে, গ্লুকোজ ইনজেকশন দেবেন? ইনট্রাভেনাস?
–হ্যাঁ। হলেই কিছুটা ঘোর কাটবে। তার আগে মকরধ্বজ দেব আমি।
–ঘোর কাটবে?
–হ্যাঁ। রামহরির রোগটা মৃত্যু-রোগই বটে। এতেই যাবে। তবে মৃত্যুলক্ষণ এখনও হয় নি।
–হয় নি? আপনি ইনজেকশন দেবেন তো?
–হরেন ডাক্তারকে আসতে লিখলাম। সে দেবে। না আসে আমিই দেব।
–যদি মরে যায়?
—সে আমি বুঝব শশী। আমার মনে হচ্ছে রামহরি এখন বাঁচবে। অন্তত মাস কয়েক। তখন উইলটুইল যা করবার করবে। আমি বরং সাক্ষী হব। উইলটার জন্যেই রামহরির মাথা তুলে দাঁড়ানো দরকার।
শশী চুপ করলে এবার।
মশায় আবার বললেন–উইলে কী আছে জানি না। এই শেষ পরিবারকেই এক রকম দানপত্র করেছে সব—এই তো?
একটু চুপ করে ঘাড় নেড়ে বললেন–সে তো হবে না শশী। রামহরির অভিপ্রায় জানতে হবে আমাকে। তার প্রথম পক্ষের ছেলে ছিল—সে মারা গেছে। কিন্তু তার ছেলে রামহরির নাতি আছে, পুত্রবধূ আছে। সে তো হবে না। বাঁচবেই মনে হচ্ছে। কিন্তু তার জন্যও চিকিৎসা প্রয়োজন। চেষ্টা করতে হবে। সে আমি করব।
রামহরি এই জ্ঞানগঙ্গা যেতে চেয়েছিল? রামহরির ছটা রিপুই বোধ করি ঐকতান তুলে মৃত্যুকে ডাক দিচ্ছে আজীবন। স্থির মৃত্যুর দিকে সহজ ছন্দে এগিয়ে যেতে জীবন ভয় পায় না। ভয় পায় মৃত্যু যখন নিজে এগিয়ে আসে। তখন সে ভয়ে আর্তনাদ করে। সে কি জ্ঞানগঙ্গা যেতে পারে? বনবিহারী পারে নি। দাঁতু পারবে না। রামহরিও পারে না। রামহরির ক্লান্ত জীর্ণ দেহ, ক্ষীণ কণ্ঠ, মুহূৰ্তে মুহূর্তে চোখে আচ্ছন্নতার ঘোর নেমে আসছে; দু-একবার চোখ মেলছে, তার মধ্যেই দৃষ্টিতে কী আতঙ্ক কী আকুতি!
হরেন ডাক্তার আসা পর্যন্ত বসে রইলেন মশায়। মাঝখানে আর-একবার নাড়ি দেখলেন। নাড়ির গতি ঈষৎ সবল হয়েছে; ছন্দ এসেছে। মুখ প্ৰসন্ন হয়ে উঠল। হরেন এসে পৌঁছতেই তিনি তাকে সব বলে বললেন–একটা গ্লুকোজ ইনজেকশন তুমি দাও। আমি বলছি—তুমি দাও। আমি দায়ী হব হে। ভয় নাই তোমার।
হাতখানা আর-একবার দেখেছিলেন মকরধ্বজের উষ্ণতা এবং শক্তি তখন নাড়িতে এবং শরীরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। হাত নামিয়ে বললেন–দাও তুমি।
ইনজেকশন শেষ করে হরেন হাত ধুয়ে রোগীর অবস্থা দেখে হাসিমুখেই বললে–এটি আপনার অদ্ভুত মশায়! অদ্ভুত!
জীবনমশায় হাসলেন। আর কী করবেন? এ কথার উত্তরই বা কী দেবেন।
হরেন বললে—আর একটা সুখবর দিই, বিপিনবাবুর হিক্কা থেমে গেছে। এই আসবার আগে খবর পেলাম। উঃ, ভদ্রলোকের হিক্কা দেখে আমি তো আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আজ চার রাত্রি ঘুমুতে পারেন নি, পেটে খাদ্য থাকে নি। আমি আসবার আগে দেখে এলাম ভদ্ৰলোক ঘুমুচ্ছেন। আপনাকে ওরা ডেকেছিল সকলের আগে, খবর দিয়েছিল কিন্তু তখন আপনি বেরিয়ে এসেছেন। বুড়ো রতনবাবু যে কী কৃতজ্ঞ হয়েছেন সে কী বলব! প্রদ্যোত ডাক্তারও এসেছিল। সে বেশ একটু আশ্চর্য হয়েছে। গম্ভীর হয়ে বললে—এ বিষয়ে এখনি কিছু বলতে পারি নে। আবার আরম্ভ হতে পারে, এবং এ ওষুধের রিঅ্যাকশনও আছে; তবে এখন অবশ্য ক্রাইসিসটা কাটল বটে। বেশ আশ্চর্য হয়েছে প্রদ্যোত ডাক্তার। আসতে আসতে পথে বললে—বৃদ্ধের ব্যাপার ঠিক আমি বুঝি নে। এ ব্যাপারটায় আমার সন্দেহ হচ্ছে কেন জানেন? আজ আবার একটা ডিসপেপসিয়ার রোগী অবশ্য একটু শক্ত ধরনের বটে—তাকে বলেছে তুই আর বাঁচবি নে। কত দিনের মধ্যে যেন মরবে বলেছে। হরেন এবার মশায়ের দিকে তাকিয়ে তাকেই প্রশ্ন করলে–তাই বলেছেন নাকি?
জীবনমশায় হরেনের দিকে তাকিয়ে দৃঢ়স্বরেই বললেন–আমি ভুল বলি নি বাবা হরেন। দাঁতু এই রোগেই মরবে। তবে কোনো সময় আমি নির্দিষ্ট করে বলি নি। এই রোগই ওর মৃত্যুরোগ হয়ে উঠবে। এতে আমি নিশ্চিত। গম্ভীর এবং গভীর স্বরে বললেন–তুর এ রোগের সঙ্গে ওর প্রধান রিপুর যোগাযোগ হয়েছে। ঘরে আগুন লাগলেই সব ঘরটা পুড়বে, তার মানে নাই, জল ঢাললে নিভতে পারে, নেভেও। কিন্তু আগুনের সঙ্গে বাতাস যদি সহায় হয় বাবা, তবে জলের কলসি ঢাললে নেভে না, বাতাসের সাহায্যে আগুন অ্যাঁচের ঝাপটায় ভিজে চাল শুকিয়ে নিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে ছাড়ে। দতুর রোগ উদরাময়তার সঙ্গে ওর লোভ রিপু হয়েছে। সহায় সহায় কেন? ওটা এখন রোগের অঙ্গ উপসর্গে পরিণত হয়েছে। আমার বাবা বলতেন—
জগৎমশায় বলতেন-বাবা, সংসারে মানুষ সন্ন্যাসীদের মত শক্তি না পেলেও, সব রিপুগুলিকে জয় করতে না পারলেও গোটা কয়েককে জয় করে। কেউ দুটো কেউ তিনটে কেউ কেউ পাঁচটা পর্যন্তও জয় করে। কিন্তু একটা–।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন—পারে না। একটা থেকে যায়! ওইটেই হল দুর্বল প্রবেশপথ। মৃত্যুবাহিনী ওই দ্বারপথেই মানুষের দেহে প্রবেশ করে। তার ওপর বাবা যে দরজার রক্ষক সে যদি সেধে দরজা খুলে ডাকে তবে কি আর রক্ষা থাকে হরেন? রক্ষক তখন রিপু। প্রবৃত্তি তো খারাপ নয় বাবা। সংসারে প্রবৃত্তিই তো রুচি। প্রবৃত্তি যতক্ষণ সুরুচি-ততক্ষণ কুখাদ্য খায় না, পেট ভরে গেলে সুরুচি তখন বলে—আর না। তৃপ্তিতে তার নিবৃত্তি আসে। আর প্রবৃত্তি যখন কুরুচি হয়—তখন সে-ই শক্ত, সে-ই রিপু। তখন তৃপ্তি তার হয় না; নিবৃত্তি তখন পালায়। তাই রিপুর যোগাযোগে যে রোগ হয়, সে রোগ অনিবার্যরূপে মৃত্যুরোগ।
কথা হচ্ছিল ফেরবার পথে। মশায় পায়ে হেঁটেই ফিরছিলেন। শশী অদৃশ্য হয়েছে। গাড়িখানাও আর পান নি। হরেনও অগত্যা সাইকেল ধরে তাঁর সঙ্গেই হাঁটছিল। হরেন ডাক্তার চুপ করে শুনেই যাচ্ছিল। মাটির দিকে চোখ রেখে পথ চলছিল। কথাগুলি শুনতে মন্দ নয়। অস্পষ্ট বা ভাবালু-মেশানো যুক্তি হলেও অসঙ্গত মনে হচ্ছিল না। কিন্তু এত বড় বিজ্ঞান পড়ে এসে এসব কি পুরো মানা যায়? তবুও পাড়াগাঁয়ের ছেলে সে, বাল্যকালের সংস্কারে ঠিক এরই একটা চাপাপড়া স্রোত ভিতরে ভিতরে আছে; সেই মজাখাতের চোরাবালিতে এই ভাবধারা। বেমালুম শুষে যাচ্ছিল মিশে যাচ্ছিল। এবং জীবন মশায়ের মত প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে তর্ক করতেও তার অভিপ্রায় ছিল না।
হরেনের নীরবতায় কিন্তু জীবনমশায় উৎসাহিত বোধ করছিলেন। তিনি বলে চললেন ওই দেখ না বাবা, রানা পাঠককে। এত বড় শক্তি! একটা দৈত্য। রিপু হল কাম। বুঝেছ, ওর প্রমেহে চিকিৎসা করেছি, উপদংশ হয়েছে কয়েকবার, আমি কাটোয়ায় মণিবাবু ডাক্তারের কাছে। পাঠিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছি—এবার যক্ষ্মা হয়েছে। বললে, একটি মেয়েছেলের কাছ থেকে ধরিয়েছে। তার মানে মেয়েটাকে যক্ষ্মারোগী জেনেও নিজেকে সংবরণ করতে পারে নি।
এবার হরেন মৃদু হাসলে।
জীবনমশায় কিন্তু বলেই চললেন—তোমরা দেখ নি–নাম নিশ্চয় শুনেছ। মস্ত বড় কীৰ্তন-গাইয়ে। সুন্দর দাস গো! নামেও সুন্দর, কাজেও সুন্দর, রূপে সুন্দর, গানে সুন্দর লোকটিকে দেখলে মানুষের চোখ জুড়োত, মন সুন্দর হয়ে উঠত। লোকে বলত–সাধক। তা সাধনা লোকটার ছিল। নির্লোভ, অক্ৰোধ, মিষ্টভাষী, বিনয়ী—মোহ মাৎস এও ছিল না; শুধু কাম। কামকে জয় করতে পারেন নি। শেষ জীবনে তিনি উন্মাদ হয়ে গেলেন পঙ্গু হলেন। লোকে বললে—কোনো সাধনা করতে গিয়ে এমনটা হয়েছে। আমাদের বিশ্বাস ছিল তাই। কিন্তু গুরু রঙলাল ডাক্তারের কাছে যখন ডাক্তারি শিখছি তখন একদিন যে কথা তোমাকে বললাম সেই কথাই বললেন– রঙলাল ডাক্তার। যেন আমার পিতৃপুরুষের কথার প্রতিধ্বনি করেই বললেন––জীবন, কথাটা তুমি হয়ত সত্যিই বলেছ হে। সুন্দর দাসকে দেখতে গিয়েছিলাম। মারা গেছে এই তো কিছুদিন। কিন্তু কথাটা প্রায়ই মনে হয়। কখনও ওই বোষ্টম-কীৰ্তনীয়দের উপর রাগ হয়—কখনও কিছু। লোকটা অসহায়ভাবে রিপুর হাতে মরেছে হে। ও পাগল। হয়েছিল—উপদংশ-বিষে, প্রমেহ-বিষে।
মশায় আবার একটু থেমে বলেছিলেনদেখ না বাবা, রতনবাবুর ছেলে বিপিনের কেস। বাবা, এখানেও সেই রিপুর যোগাযোগ। প্রতিষ্ঠার মদও এক রিপু বাবা। আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রবৃত্তি যার নাই সে কি মানুষ? কিন্তু সে যখন রিপু হয় তখন কী হয় দেখ!
চকিত হয়ে হরেন প্রশ্ন করেছিল—তা হলে বিপিনবাবু সম্পর্কে আপনি–?
প্রশ্নটা সে সম্পূর্ণ উচ্চারণ করতে পারে নি।
—না। সেকথা ঠিক বলি নি আমি। তবে বাবা, অত্যন্ত কঠিন—অত্যন্ত কঠিন।
–আজ তো ভালই আছেন। আমার ভালই লাগল। হিকাটা থেমে গেছে। সুস্থ হয়েছেন ঘুমুচ্ছেন।
—ভালই থাক। ভাল হয়েই উঠুক। কিন্তু ভাল হয়ে উঠেও তো ভাল থাকতে পারবে না। ও, হরেন। আবার পড়বে। প্রবৃত্তি রিপু হয়ে দাঁড়ালে তাকে সংবরণ করা বড় কঠিন।
–এ যাত্রা তা হলে উঠতে পারেন বলছেন?
—তাও বলতে পারছি না বাবা। মাত্র তো দুদিন দেখছি। তার উপর মন চঞ্চল হচ্ছে। রতনকে দেখছি। বিপিনের ছেলেকে দেখছি, বুঝেছ, ওই ছেলেটিকে দেখে বনবিহারীর ছেলেকে। মনে পড়ে গেল।
মশায় দীর্ঘনিশ্বাসও ফেললেন আবার হাসলেনও। এবং হঠাৎ বললেন–চণ্ডীতলায় যাব একবার। আসবে নাকি? মহান্ত আজ যাবেন। একবার দেখে যাই। আজ রাত্রেই যাবেন।
মহান্ত তখন আবার বার তিনেক দাস্ত গিয়ে অবসন্ন হয়ে পড়েছেন, আঙুলের ডগাগুলি ঠাণ্ডা হয়েছে, চোখের পাতা নেমে এসেছে একটা গভীর আচ্ছন্নতার ভাবে। মধ্যে মধ্যে মুখ বিকৃত করছেন—একটা যেন যন্ত্রণা হচ্ছে, নিষ্ঠুর যন্ত্ৰণা।
হরেন বললে—বলেন তো একটা ইনজেকশন দিই।
মশায় বললেন– চিকিৎসক হয়ে আমি নিষেধ করতে পারি? দেবে, দাও।
মহান্তের শিষ্য বললে—বাবার নিষেধ আছে। তিনি বার বার নিষেধ করেছেন—সুই কি কোনো ইলাজ যেন না দেওয়া হয়। মশায় বলেছে আজ ছুটি মিলবে। ছুটি চাই আমার। ইয়ে শরীর বিলকুল রদ্দি হো গয়া!
শ্রদ্ধার প্রসন্নতায় মশায়ের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি এবার হরেনের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন–থাক হরেন।
হরেন স্তব্ধ হয়ে মহান্তের প্রায়-নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে রইল। হরেন এই গ্রামের ছেলে। ডাক্তার সে হয়েছে, কিন্তু এই ধরনের মৃত্যুর অনেক গল্প সে শুনেছে। আজও এখানে মৃত্যুকালে ওষুধ পাশে সরিয়ে রেখে মুখে দুধ গঙ্গাজল দেয়। আগেকার কালের আরও অনেক বিচিত্র গল্প সে শুনেছে। তবু আজকের এ মৃত্যুদৃশ্য তার কাছে নতুন এবং বিস্ময়কর।
দীর্ঘকায় কঙ্কালসার মানুষটি নিথর হয়ে পড়ে আছে। শ্বাস হচ্ছে যেন। তার গতি অবশ্য মৃদু। হঠাৎ মনে হল অত্যন্ত ক্ষীণভাবে ঠোঁট দুটি নড়ছে।
ইঙ্গিত করে সে মশায়কে দেখালে।
মশায় বললেন– ইষ্টমন্ত্র জপ করছেন। ভিতরে জ্ঞান রয়েছে। গ্ৰহণীর রোগীর জ্ঞান শেষ, পর্যন্ত থাকে।
হরেন তর্ক করলে না। কিন্তু তর্ক আছে।
মশায় বললেন– হাতের দিকে দেখ।
মহান্তের হাতের আঙুল করপের ভঙ্গিতে ধরা রয়েছে।
শিষ্য ভোলানাথ এসে বললে—তা হলে বের করি মশায়?
–হ্যাঁ বের করবে বৈকি। দেহ ছাড়বেন, এখন ঘর কেন?—আকাশের তলায়, মায়ের আঙিনায়।
বাইরে তখন অনেক লোক। সকালবেলা মশায়ের নিদান কথা শুনে মহান্ত শিষ্য ভোলাকে বলেছিলেন দু-তিন গাঁওয়ের হরিনামকে দলকে খবর ভেজো রে ভোলা। বহেমকো আজ ছুটি মিলবে। যায়েগা হম। তুম লোক ভাই, দল লেকে আও। নাম করো। ওহি শুনতে শুনতে হম যায়েগা। বন্ধন টুটেগা। ভরোসা মিলেগা।
মশাই নিজেই বেরিয়ে এসে বললেন– হরিবোল, হরিবোল! ধর, ধর নাম ধর। জয় গোবিন্দ।
বেজে উঠল খোল করতাল। মশায় নিজেই এসে দাঁড়ালেন সর্বাগ্ৰে—নামের তরী বাধা ঘাটে-হরি বলে ভাসাও তরী।
সন্তৰ্পণে বহন করে এনে আকাশের তলায় দেবীর পাটঅঙ্গনে মহান্তকে শুইয়ে দিলে সকলে। শ্বাস ঘন হয়ে উঠেছে।
হরেন অভিভূতের মত দাঁড়িয়ে রইল। চিকিৎসক হিসেবে তার চলে আসবার কথা মনে হল না। মনটা যেন কেমন হয়ে গিয়েছে। বিচিত্র।
২৩. মশায় এবং সেতাব দাবায় বসেছেন
মাস দেড়েক পর।
মশায় এবং সেতাব দাবায় বসেছেন। ভাদ্র মাস-আকাশ এরই মধ্যে এবার নির্মেঘ নীল; অনাবৃষ্টির বর্ষা শেষ হয়েছে প্রায় সপ্তাহখানেক আগে এবং এই এক সপ্তাহের মধ্যেই মাঝশরতের আবহাওয়া ফুটে উঠেছে আকাশে মাটিতে। আজ দাবা খেলার আসরও জমজমাট। শতরঞ্জির পাশে দুখানা থালা নামানো রয়েছে, চায়ের বাটি রয়েছে। জন্মাষ্টমী গিয়েছে—আতরবউ আজ তালের বড়া করেছেন, একটু ক্ষীরও করেছেন—সেইসব সহযোগে চা পান করে দাবায় বসেছেন। মশায় অবশ্য খান নি। অসময়ে তিনি কোনো কালেই এক চা ছাড়া কিছু খান না। ডাক্তারি শেখার সময় রঙলাল ডাক্তারের ওখানে ওটা অভ্যাস করেছিলেন। লোককে কিছু খেয়ে চা খেতে উপদেশ দিলেও নিজে বিকেলবেলা খালি পেটেই চা খেয়ে থাকেন। খেতে তার বেলা যায়, ক্ষিদে থাকে না—এ একটা কারণ বটে, কিন্তু আসল কারণ অন্য। সন্ধ্যার পর অর্থাৎ দাবা খেলা অন্তেসে সাতটাই হোক আর আটটাই হোক আর বারটাই হোক, মুখহাত ধুয়ে কাপড়চোপড় ছেড়ে ইষ্ট স্মরণ করে তবে আহার করেন। পরমানন্দ মাধব!
আতর-বউয়ের মেজাজ আজ ভাল আছে। গতকাল জন্মাষ্টমীর উপবাস করেছিল—আজ সেতাবকে নিমন্ত্রণ করে দুপুরে ব্রাহ্মণভোজন করিয়েছে; বিকেলে জলযোগ করিয়েছে। এবং সেতাবের ভোজন-বিলাসিনী স্ত্রীর জন্য তালের বড়া ক্ষীর বেঁধে দিয়ে খুব খুশিমনেই আছে। শুধু ব্রাহ্মণভোজন নয়, দম্পতিভোজন করানো হয়ে গেল। ব্ৰত উপবাস করলে আতর-বউ ভাল থাকে। বোধ করি, পরলোকের কল্পনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আয়োজনও ভাল ছিল। অভিযোগ। করতে পায় নি আতর-বউ। মশায়ের পরমভক্ত পরান খাঁকে ডাক্তার কয়েকটি ভাল তালের কথা বলেছিলেন, খা একঝুড়ি খুব ভাল এবং বড় তাল পাঠিয়ে দিয়েছিল। এবং রামহরি লেটের বাড়ি থেকে এসেছিল একটি ভাল সিধে—মিহি চাল, ময়দা, কিছু গাওয়া ঘি, কিছু দালদা, তেল, তরিতরকারি এবং একটা মাছ। রামহরি সেই মরণাপন্ন অবস্থা থেকে বেশ একটু সেরে উঠেছে। এবং রামহরির পুত্রবধূ পৌত্র ফিরে এসেছে, তারাই এখন সেবা-শুশ্ৰুষা করছে। মশায়ের কাছে তাদের আর কৃতজ্ঞতার অন্ত নাই। রামহরির নতুন বউ তার ভাইকে নিয়ে পালিয়েছে। রামহরির মেজাজ অবশ্য খুবই খিটখিটে—শশীর উপরে শব্দভেদী বাণের মত কটুবাক্য প্রয়োগ করে। পুত্রবধূ পৌত্রক