মানুষের সভ্যতার সঙ্গে অন্নের এই দ্বন্দ্ব নূতন নয়, এ দ্বন্দ্ব অতি প্রাচীন। সভ্যতার সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই এ দ্বন্দ্বেরও আরম্ভ হয়েছে এবং বোধ হয় শেষ পর্যন্তই চলবে। কখনও সভ্যতা জয়ী হয়েছে, কখনও বা অন্নেরই জয় হয়েছে। মানুষে মানুষে শেষ যুদ্ধের বর্তমান কল্পনার মতো এ যুদ্ধের শেষ কল্পনাও হয়তো কেবল স্বপ্ন। হয়তো মানুষের সভ্যতাকে চিরদিনই এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে উঠে পড়ে চলতে হবে।
এই চিরন্তন দ্বন্দ্বের মধ্যে মানুষের সভ্যতা রক্ষা পেয়েছে, কেননা যুগে যুগে এমন সব জাতি উঠেছে। যাঁরা অন্নের মায়াকে অতিক্রম করে আনন্দের পথে চলতে পেরেছে। ভুল হতে পারে, কিন্তু আমার বিশ্বাস আধুনিক বাঙালি সেই সব জাতির অন্যতম। সভ্যতার এই প্রাচীন যুদ্ধে নবীন সেনাপতি হবার যোগ্যতা এদের মধ্যে আছে। অন্নের মহাকাল-মূর্তিতে ভয় পেয়ে যাঁরা এই জাতিকে কুবেরের কোলে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান, তাদের মাথায় বুদ্ধি থাকতে পারে, কিন্তু চোখে দৃষ্টির অভাব। আনন্দলোকের সূর্যরশ্মি বিজয়মাল্যের মতো এদের মাথায় এসে পড়েছে; হিতৈষীদের শত চেষ্টাতেও সে বরণকে উপেক্ষা কবে কেবল অন্নকে বহু করার চেষ্টাতেই এ জাতি কখনও জীবন উৎসর্গ করতে পারবে না।
‘অন্নং ন নিন্দ্যাৎ’, অন্নেব নিন্দা করিনে। অন্নং বহুকুর্বীত’; অন্নকে বহু করার যে কত প্রয়োজন তাও জানি। সেই ভিত্তির উপরেই মানুষের সভাতা দাঁড়িয়ে আছে। সমস্যা এই, কেমন করে অন্নকেও বহু করা যায় আবার তার বাহুল্যকেও বর্জন করা যায়। মহাকালের দর্শনেও ছিন্ন হতে না হয়, কুবেরের গদাও চূর্ণ না করে।
এস নুতন যুগের নবীন বাদরায়ণ! ‘অথাতোহান্ন জিজ্ঞাসা’ বলে তোমার অন্নসূত্র আরম্ভ করে এই সংশয়ের সমাধান কর। কোন মধ্যযান পথের পথিক হলে মানুষের সভ্যতাকে আর আনন্দের ব্ৰহ্মলোক হতে ফিরে আসতে না হয় তার নির্ধারণ করা।
আশ্বিন ১৩২৪
রোম
জোর করে লেগে থাকলে দেখছি অসাধ্যও সাধন করা যায়। এভরিম্যানের অনুবাদে চার ভ্যালুম মমসেনের রোমের ইতিহাস শেষ হয়ে গেল। অবশ্য এ পুথির শেষে পৌঁছে দেখি গোড়ার দিককার অনেক কথা, মনের মধ্যে ঝাপসা হয়ে এসেছে। কেল্টজাতির স্বাধীনতা রক্ষার নিস্ফল চেষ্টার করুণ কাহিনি, স্যামনাইটদের রোমের নাগপাশ থেকে মুক্তির বৃথা প্ৰয়াসের ইতিহাসকে একরকম ঢেকে ফেলেছে। সিজারের জয়ধ্বনিতে, হ্যানিবালের তুতিগানও প্রায় ডুবে গেছে। সন তারিখের তো কথাই নাই। প্রথম থেকেই তার গোলযোগ শুরু হয়েছে, এবং শেষ পর্যন্ত সব একাকার হয়ে গোলযোগের সম্ভাবনারও লোপ ঘটেছে। মোট কথা, রোমের ইতিহাসে পরীক্ষা দিতে বসলে যে, সে পরীক্ষাতে ফেল হব। এটা নিশ্চয়। তবুও ল্যাটিন জাতির বিজয়যাত্রার এই অধ্যায়গুলি, মমসেনের বর্ণনায় মনের মধ্যে যে দাগ কেটে গেছে, তা সহসা মুছে যাবে না। ভূমধ্যসাগরের চার পাশের যে ভুখণ্ডকে আধুনিক যুগের রোমের ঐতিহাসিকেরাও পৃথিবী বলেই উল্লেখ করেন, তার বহু রাজ্য ও বিচিত্ৰ জাতিগুলির রোমের এক-রাট ও একছত্ৰ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, মনকে যে দোলা দিয়েছে, তার বেগ শেষ হতে কিছু সময় লাগবে।
পাঠকেরা শঙ্কিত হবেন না। মমসেন থেকে দুটো অধ্যায় ইংবেজি অনুবাদের বাংলা তর্জমা করে দিয়ে লব্ধ-প্ৰতিষ্ঠ ঐতিহাসিকপদ লাভের কোনও চেষ্টাই করব না। রোম সম্বন্ধে এখানে যা কিছু বলতে যাচ্ছি তা নিতান্তই এলোমেলো রকমের। তাতে প্রত্নতত্ত্বের পাণ্ডিত্য এবং ইতিহাসের গাম্ভীর্য—এ দুয়েব অত্যন্ত অভাব। সুতরাং যাঁরা প্রবন্ধের নাম দেখে পড়তে শুরু করেছেন তাঁরা হয়তো আর অগ্রসর না হলেই ভাল করবেন। আর যাঁরা নাম দেখেই পাতা উলটে যেতে চাচ্ছেন, তাঁরা ধ্রুস্কার শেষ পর্যন্ত পড়বার চেষ্টা কবলেও করতে পারেন।
২
প্রাচীন হিন্দুজাতি এবং তাদের সভ্যতা আমাদের পশ্চিমের মাস্টারমশায়দের কাছে অনেক রকম গঞ্জনা শুনেছে। তিরস্কারের একটা প্রধান বিষয় এই যে বংশপরিচয়ে তাঁরাও ছিলেন রোমানদেরই জ্ঞাতি। সুতরাং সেই একই রক্ত শরীরে থাকতে তাঁরা যে কেমন কবে হিন্দুসভ্যতার মতো এমন দুর্বল ও বিকৃত সভ্যতা গড়ে বসলেন, এটা পণ্ডিতদের মনে যেমন বিরাগেরও সঞ্চার করেছে তেমনি জিজ্ঞাসারও জন্ম দিয়েছে। এবং এই সংশয়ের সমাধানে তাঁরা নানারকম সম্ভব-অসম্ভব, অবশ্য সকলগুলিই ‘বৈজ্ঞানিক’, মতবাদের প্রচার করেছেন। গল্প আছে, ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় চার্লস রয়েল সোসাইটির নতুন প্রতিষ্ঠা করে পণ্ডিতদের এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন যে, মাছ মরলেই ঠিক সেই সময়টা তার ওজন বেড়ে যায় কেন? পণ্ডিতেরা উত্তর খুঁজে গলদঘর্ম হয়ে গেলেন। অবশেষে একজন বললেন, আচ্ছা দেখাই যাক না ওজন করে, মাছটা মরলেই তা যথার্থ বেশি ভারী হয়ে ওঠে কি না। মমসেনের বিপুলায়তন পুথি শেষ করে এই কথাটাই বারবার মনে হয়েছে, যে যাঁরা এই রোমানসভ্যতার তুলনায় প্রাচীন হিন্দু-সভ্যতাকে অতি খাটো ও নিতান্ত হালকা বলেছেন, ‘সভ্যতা’ বলতে তাঁরা কী বোঝেন? সভ্যতার কোন মাপকাঠিতে তাঁরা এই দুই সভ্যতাকে মাপ করেছেন? কোন তৌলে এদের ওজনে তুলেছেন? এই যে রোমানসভ্যতা, যার গৌরবের দীপ্তিতে পণ্ডিতদের চোখ ঝলসে গেছে, এ তো একটা একটানা পরের দেশ জয় ও অন্য জাতির উপর আধিপত্য স্থাপনের ইতিহাস। প্রথম ‘লেশিয়ামের’ উপর রোমের প্রভুত্ব বিস্তার, তারপর তারই সাহায্যে উত্তরের ইট্রাসকানদের ধবংস করে ইতালির আর সকল জাতিগুলোকে পিষে ফেলে গোটা দেশটায় নিজের আধিপত্য স্থাপন। আবার মেডিটারেনিয়নের ওপারের প্রবল রাজ্যটি, সিসিলির সেতু পার হয়ে এই আধিপত্যের কোনও বিঘ্ন ঘটায়, এই আশঙ্কাতেই কার্থেজের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে বিজিত ইতালির সাহায্যে তাকে সমুলে উচ্ছেদ; এবং কার্থেজের অধিনায়ক ‘হ্যামিলকার বারকা’ বা বিদ্যুতের বংশধর, স্পেন থেকেই যাত্রা শুরু করে বাজ হয়ে রোমের মাথায় ভেঙে পড়েছিল বলে, শত্রুর শেষ রাখতে নাই এই নীতি অনুসারে স্পেনেও রাজ্যবিস্তার। এমনি করে দক্ষিণ আর পশ্চিমের ভাবনা যখন ঘুচল তখন স্বভাবতই দৃষ্টি গেল পুবের দিকে। গায়ে জোর থাকলে এ আশঙ্কার তো আর শেষ নাই! পুবে তখন ছিল আলেকজেন্ডারের ভাঙা সাম্রাজ্যের গোটা কয়েক বিচ্ছিন্ন টুকরো। ওরই মধ্যে যে দুটি একটু প্রবল–ম্যাসিডন আর এশিয়া, তাঁরা তখন রোমেরই মতো আশপাশের রাজ্যগুলিকে গ্ৰাস করে নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টায় ছিল। এ ব্যাপারকে অবশ্য উপেক্ষা কি মার্জনা কিছুই করা চলে না। কেননা পরের দেশ জয় করে রাজা ও বলবুদ্ধি জিনিসটি মানুষের ইতিহাসের আদিযুগ থেকে আজ পর্যন্ত প্রত্যেক জাতিরই নিজের পক্ষে খুব সুসঙ্গত ও অত্যাবশ্যকীয় এবং অন্য সকলের বেলাই নিতান্ত বিসদৃশ ও অত্যন্ত আশঙ্কাজনক বলে মনে হয়েছে। সুতরাং বাধ্য হয়েই রোমকে এ দুটি রাজ্য আক্রমণ করতে হল; এবং এদের বাহুল্য অংশগুলি ছেটে ফেলে যাতে এরা অতঃপর বেশি। নড়াচাড়া না করে ভদ্রভাবে জীবন যাপন করতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হল। এমনকী সঙ্গে সঙ্গে রোম একটা মহানুভবতার পরিচয় দিতেও কসুর করলে না। ইতালিতে তখন হেলেনিক সভ্যতার স্রোত বইতে আরম্ভ করেছে। তারই গুরুদক্ষিণা হিসাবে গ্রিসের ছোট ছোট নখদন্তহীন নাগরিক রাজ্যগুলিকে ম্যাসিডনের প্রভুত্ব থেকে মুক্ত করে রোম তাদের একবারে স্বাধীনতা দিয়ে দিল। কিন্তু দুঃখের কথা মহানুভবতার এ খেলাও রোম বেশিদিন খেলতে পারল না। কারণ দানে পাওয়া স্বাধীনতার মানেই হল–স্বাধীন ইচ্ছার প্রয়োগটা করতে হবে দাতারই ইচ্ছা অনুসারে। সুতরাং গ্রিসের চপল প্রকৃতির লোকগুলি যখন নিয়মের ব্যতিক্রম করে, ম্যাসিডনের আবার মাথা তুলবার চেষ্টা দেখে, তাকেই নায়ক ভেবে কিঞ্চিৎ চাঞ্চল্যের লক্ষণ প্রকাশ করল, তখন এই পুবের দেশগুলির আধা স্বাধীনতা আধা অধীনতার বিশ্ৰী অবস্থাটা ঘুচিয়ে সোজাসুজি এদের করায়ত্ত করে নেওয়া ছাড়া রোমের আর গত্যন্তর থাকল না। এর পর রোমান চোখের দিকচক্রবালে যে দুটি রাজ্য বাকি থাকল, সিরিয়া আর মিশর, তাদের নিয়ে অবশ্য বেশি বেগ পেতে হল না। অবস্থা দেখে তাঁরা আপনারাই এসে রোমের পায়ে মাথা ঠেকালে। সাম্রাজ্য যখন গড়ে উঠল তখন কাজে কাজেই তার বৈজ্ঞানিক চৌহদি’রও খোজ পড়ল। কৃষ্ণসাগরতীরের মিথরেডেটিস-এর রোমের শিকল ভেঙে হাত পা ছড়াবার দুরাকাঙক্ষা দমন উপলক্ষে, রাজ্যের পুব-সীমা ইউফ্রেটিসে গিয়ে ঠেকাল এবং স্বয়ং জুলিয়াস কেল্টদের মৃতদেহের উপর দিয়ে রোম সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমা আটলান্টিক পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেলেন। সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্রাটেরও আবির্ভাব হতে খুব বেশি বিলম্ব ঘটল না। কেননা তিনশো বছর রাজ্যজয়ে আর রাজ্যভোগে প্রাচীন রোমান বল-বীৰ্য-ঐক্য সকলেরই তখন লোপ হয়েছে। প্রকৃতির পরিশোধা! আর পররাজ্যজয়ে যে সাম্রাজ্য ও সভ্যতার প্রতিষ্ঠা, যুদ্ধজয়ী সেনাপতি তার নায়কত্ব না পেলেই বরং বিস্ময়ের কারণ হত। সিজারের উত্তরাধিকারীরা আরও তিনশো। বছর ধরে এই রোম-সাম্রাজ্য, যাকে কোনওরকমেই আর রোমাঞ্চন সাম্রাজ্য বলা চলে না, শাসন ও রক্ষা করলেন। রাজ্যের সকল জাতির লোকের মধ্যে রোম-নাগরিকের অধিকার ছড়িয়ে দেওয়া হল, কেননা তখন সকলেই রোম-সম্রাটের সমান প্ৰজা, ‘ফেলো সিটিজেনের অর্থ দাঁড়িয়েছে ‘ফেলো সাবজেক্ট’। উচু আশা ও বড় আকাঙক্ষার তাড়না না থাকলে যে শান্তি আপনিই আসে, রাজ্যজুড়ে সে শান্তি বিরাজ করতে লাগল। ঘরকন্নার ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের উপযোগী পাকা আইন-কানুন এই বহুজাতি ভূয়িষ্ঠ রাজ্যের মধ্যে গড়ে উঠল। তারপর মানুষের গড়া অপর সকল রাজ্যের মতো রোম-সাম্রাজ্যও ভেঙে পড়ল। ইউরোপের সভ্যতার কেন্দ্ৰ ভূমধ্যসাগর ছেড়ে আটলান্টিক মহাসাগরকে আশ্রয় করল। তারই তীরে তীরে নবীন সব জাতির মধ্যে মানুষের সভ্যতার চির-পুরাতন ও চির-নূতন খেলার আরম্ভ হল।