- বইয়ের নামঃ নদীপথে
- লেখকের নামঃ অতুলচন্দ্র গুপ্ত
- প্রকাশনাঃ আনন্দ প্রকাশক
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
মিঙ্গিন স্টিমার
২৪ ডিসেম্বর ১৯৩৪
সোমবার। সন্ধ্যা
শনিবার রাত দশটায় ছেলেরা স্টিমার থেকে নেমে গেলে অল্পক্ষণ পরেই শুয়ে পড়া গেল। রাত দুটোয় একবার উঠেছিলাম। চার দিকে আলো। স্টিমার পুল খোলার প্রতীক্ষা করছে।
রবিবার প্রাতে উঠে স্টিমার কতদূর এল খোেজ নেবার জন্য বাইরে এসে দেখি, সামনেই জগন্নাথ ঘাটৈর সিন্টমারের গুদাম ও আপিস। ব্যাপার কী? সারেং এসে খবর দিল যে, শনিবার শেষরাত্রে পুল খোলার সময় বিলাতি ডাক এসে পড়ায় তখন পুল খোলা যায়নি, এবং পরে আর খোলা সম্ভব ছিল না, সুতরাং রবিবার শেষরাত্রের পূর্বে স্টিমার ছাড়বে না। আবার বাড়ি যাওয়া ও ফিরে আসার হাঙ্গামা মনে করে রবিবার সমস্ত দিন ও রাত জগন্নাথ ঘাটের সামনে গঙ্গার মাঝে কাটিয়ে দেওয়া গেল–যখন তোমরা মনে করছিলে যে আমি বহু দূর চলে গেছি। কলকাতার নীচের গঙ্গার উপর যে একটা বিচিত্র জীবনযাত্রা প্রতিদিন চলে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হল। ভোর হতেই নদী জুড়ে নানারকম নৌকার ও নানা চেহারার বাষ্পপীয় জলযানের ব্যস্ত গতায়াত আরম্ভ হয়–লোক নিয়ে, মাল নিয়ে এবং বাহ্যিদৃষ্টিতে অকারণে। দুপুরের পর এ গতি কিছু মন্দা হয়ে আসে; আবার বিকাল হতে-না-হতেই নদী যেন গা-মোড়ামুড়ি দিয়ে আলস্য ভেঙে ওঠে। নৌকার দলের গতি দ্রুত হয়, বাষ্পীয় যানগুলি গম্ভীর ও তীক্ষু আওয়াজ করতে করতে জলচর প্রাণীর মতো উজান ভাটিতে ছুটতে থাকে। মধ্যাহ্নের জনবিরল নদী লোকসমাগমে ভরে ওঠে। একটা দিন এই দেখে কাটল।
রবিবার রাত সাড়ে চারটেয় হাওড়া-পুল খোলার সঙ্গে সঙ্গে স্টিমার ছেড়েছে। একখানা ফ্ল্যাট বা পাশে প্রথম থেকেই বাধা ছিল। সোমরা সকাল ছাঁটায় বজবজে ডান দিকেও আর-একখানা ফ্ল্যাট বাঁধা হয়েছে। দু’দিকে দুই ফ্ল্যাট নিয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে আমাপের স্টিমার চলেছে। স্টিমারখানি ভাল ও নূতন। খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। জল ও পাট দিয়ে প্রতিদিন ডেক মাজা হচ্ছে। আমিই একমাত্র যাত্রী। সুতরাং সবগুলি কেবিন যাদৃচ্ছি ব্যবহার করছি।
সারেংটির বাড়ি নোয়াখালি। মাথায় একটু ছিট আছে। পয়ত্ৰিশ বছর স্টিমারে কাজ করছে, এখন মাইনে একশো আশি টাকা। আমাকে জানালে যে, চামড়া কালো বলে মাইনে এত কম; সাদা চামড়া হলে পাঁচ-ছাঁশো হত। এবং এই চামড়ার তফাতের জন্যই নাকি, যদিও তার স্টিমারে একজন ভারী বাবু যাচ্ছে, তবুও স্টিমার-কোম্পানি সামনের ডেকে একটাও ইজিচেয়ার দেয়নি, দুটো বেতের কুর্সি দিয়েই সেরেছে। আগের বছর এই স্টিমারেই এক সাহেব গিয়েছিল, বিশেষ ভারী নয়; তখন ইজিচেয়ার, পারদা এবং পাঁচ মন বরফ ছিল। পাঁচ মন না হলেও বরফ এবারও আছে। সেই বরফে তরিতরকারি তাজা রাখা হচ্ছে। এই যে দুদিকে দুই ফ্ল্যাট বেঁধে দেওয়া, সারেঙের মতে এও একটা সাদা-কালোর ভেদবুদ্ধির ব্যাপার। আমাদের স্টিমারের সঙ্গে আরও একখানা সুন্দরবনগামী স্টিমার ছেড়েছে। বজবজের ফ্ল্যাটখানি নাকি তারই নেবার কথা। কিন্তু তাতে তিন-চারটি সাহেব যাচ্ছে বলে এই উলটো ব্যবস্থা হয়েছে।
বেলা সাড়ে দশটায় ডায়মন্ড হারবার ছড়িয়েছি। সেখান থেকেই নদী বেশ প্রশস্ত। স্টিমার বা পাড় ঘেঁষে এসেছে। ঢালু পাড়; অনেক জায়গায় প্রায় জল পর্যন্ত ঘাস ও ছোট ছোট গাছ-গাছড়া কোথাও কাছে, কোথাও দূরে লোকের বসতি। অন্য পাড়ে গাছের ঘন সবুজ সরু রেখা ছাড়া কিছু দেখা যায় না।
বেলা প্রায় চারটেয় স্টিমার বড় নদী ছেড়ে একটি সরু খালে ঢুকেছে৷ খালের নাম ‘নামকানা’ খাল। এত সরু যে, দুই ফ্ল্যাটসমেত আমাদের স্টিমার তার প্রায় সবটাই জুড়ে থাকে। এই খাল দিয়ে অতি আস্তে আস্তে চলে ঘণ্টাখানেক পরে একটি মোটের উপর প্রশস্ত নদীতে পড়া গেল, নাম সপ্তমুখী’। কিন্তু এমন অগভীর যে সূৰ্যান্তের সঙ্গে সঙ্গে স্টিমার নোঙর করতে হল। জোয়ার এলে তবে চলবে। নামকানা খােলই সুন্দরবনের আরম্ভ। কিন্তু খালের দুই পাশে এবং সপ্তমুখী নদী যতটা এসেছি তার পড়ে এখন আর বন নেই। চাষ-আবাদ ও লোকালয়। সারেং বললে, আরও চার ঘণ্টা চলার পর সুন্দরবনের বন আরম্ভ হবে।
শীত যেমন ভাবা গিয়েছিল তেমন কিছু নয়। আজ সমস্ত দিন স্টিমার দক্ষিণে চলেছে, সুতরাং উত্তরের হাওয়া লাগেনি। সামনের ডেকে সারাদিন রোদ। আরামে চলে এসেছি।
জোয়ার এসেছে। নোঙর তুলে স্টিমার চলতে আরম্ভ করল। রাত প্রায় আটটা। খুলনা পৌঁছনো পর্যন্ত রাতদিন স্টিমার চলবে, কোথাও থামবে না।
২৫ ডিসেম্বর ১৯৩৪
মঙ্গলবার। সন্ধ্যা
আজ ভোর থেকে এবং কাল রাত্রে যখন ঘুমিয়ে ছিলুম তখন থেকেই স্টিমার চলেছে আঁকাবাঁকা সব ছোট ছোট নদী দিয়ে। মাঝে মাঝে বেশ প্রশস্ত নদী পাওয়া যাচ্ছে। … … চোখ চলে ডালপালা-বিরল সোজা সরু গাছ ও আগাছার ঘন জঙ্গল। … … ও জনমানবের চিহ্ন নেই। আকাশে পাখি নেই, কাকও নয়। মাঝে … … গাঙচিল উড়ে যাচ্ছেল আর দুটো-একটা বক জলের ধারে স্তব্ধ তন্ময় … … মৎস্যচিন্তা করছে। বনের মধ্য দিয়ে ছোট ছোট সব খাল এসে নদীতে পড়েছে। আমরা যে-সব নদী দিয়ে যাচ্ছি তা ছাড়া বহু ছোট-বড় নদী চারদিকে বয়ে চলেছে। কোনও জায়গায় একখণ্ড বনে ঢাকা জমির তিন দিকেই নদী–দেখতে চমৎকার। এ-সব নদী-নালার মধ্য দিয়ে পথ চিনে স্টিমার চালানো অভ্যাসের কাজ। সারেং বললে যে, এ পথ সম্বন্ধে সারেংদের পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে হয়। বনের ধারে ধারে টিনে সাদা রং দিয়ে পথের চিহ্নও অনেক জায়গায় দেওয়া আছে।