- বইয়ের নামঃ প্রবন্ধাবলী
- লেখকের নামঃ অতুলচন্দ্র গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
আমাদের ছাত্রাবস্থা ও রবীন্দ্রনাথ
চল্লিশ বছর পূর্বে যখন প্রবেশিকার দরোজা পার হয়ে কলিকাতায় এসে কলেজে ভর্তি হয়েছি। তখন ছাত্রমহলে রবীন্দ্রনাথের প্রতি মনোভাবের মধ্যে কৌতুহল সবচেয়ে প্রবল। ‘ক্ষণিকা’ পর্যন্ত প্রকাশ হয়েছে। নবপর্যায়ের বঙ্গদর্শনে ‘চোখের বালি’ চলছে। ভারতীতে ‘চিরকুমার সভা’ বেরিয়েছে। ছোটগল্পের অনেকগুলি বিখ্যাত গল্পই লেখা হয়েছে। প্রদীপে ‘কাদম্বরী-চিত্ৰ ভারতীতে ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’ বের হয়েছে। কালিদাসের কাব্য-সমালোচনার প্রবন্ধগুলি প্ৰকাশ্য সভায় পড়া হয়ে বঙ্গদর্শনে ছাপা হচ্ছে। বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণের আলোচনা শুরু হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গান বাঙালির কণ্ঠ একচেটে করার উদ্যোগ করছে। এ কবি ও লেখক যে নূতন ধরনের এবং সম্ভব জীবিতদের মধ্যে সবচেয়ে বড় এ ধারণা দেশে, সুতরাং ছাত্রদের মধ্যে এসেছে। কিন্তু আমাদের চোখের সামনে যে এই বাংলাদেশে এক আশ্চর্য উৎকর্ষের বহুমুখী প্ৰতিভা এমন সৃষ্টি করে চলেছে যার তুলনা পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে কদাচিৎ মেলে সে জ্ঞান জন্মেনি এবং সে কথা ভাবার সাহসও মনে ছিল না। রবীন্দ্রনাথের কাব্য যে অস্পষ্ট, ওর মধ্যে যে শক্ত কিছুকে আঁকড়ে ধরে পেয়েছি বলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না (যে অভিযোগ আমাদের ছাত্রজীবনের শেষ সময়ে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এনেছিলেন), সে নালিশ আমাদের মধ্যে একদলের মনে ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাব্যসৃষ্টি তো একরকমের নয়। অল্পদিন পূর্বে প্রকাশিত ‘কথা’ ও ‘কাহিনী’র কবিতাগুলি আমাদেব সকলের মন লুট করে নিয়েছিল, ‘সন্ন্যাসী উপগুপ্ত’ কি ‘পঞ্চ নদীর তীরে বেণী পাকাইয়া শিরে’ আমাদের অনেকেরই মুখস্থ ছিল। পুরানো University Institute-এর হলে সত্যেন্দ্ৰনাথ ঠাকুর ‘বন্দী বীর’ যেমন আবৃত্তি করেছিলেন ঠিক তেমনি গলায় সেইরকম আবৃত্তির চেষ্টা তখন অনেকেই করেছি। কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে উঠত রবীন্দ্রনাথকে দেখার আগ্রহ ও তাঁর গান শোনার লোভ। এ কবির আকৃতি ও প্রকৃতি, স্বর ও সুর যে আর পাঁচজনার মতো নয়, অভিনব জিনিস, এ ছিল প্ৰকাণ্ড আকর্ষণ। রবীন্দ্রনাথ যে সভায় কোনও প্ৰবন্ধ পড়তেন সেখানে ছাত্রদের ভিড় হত অসম্ভব রকম। কিন্তু সে ভিড় কেবল তার প্রবন্ধ শুনতে নয়, তাকে দেখতে ও তার পড়া শুনতে। এবং সভায় রবীন্দ্রনাথ প্ৰবন্ধ-পাঠকই থাকুন, আর সভাপতিই থাকুন সভার শেষে তাঁর গান শোনার দাবি ঐকতান চিৎকারে আমরা বরাবর জানিয়েছি, আর এ কাজে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লোককেও মাঝে মাঝে abetitor পাওয়া যেত। তার সাহিত্যে ও তার জীবনে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন। আমাদের পরম বিস্ময়ের বস্তু।
২
এরপর যখন কলেজের উচু শ্রেণিতে উঠেছি তখন এল বঙ্গভঙ্গের আন্দোলন। যে আবেগ ও উত্তেজনা বাঙালি শিক্ষিত সম্প্রদায়ে, বিশেষ আমাদের ছাত্র সম্প্রদায়ে জেগে উঠল তার অনুরূপ কিছু এ সম্প্রদায়ের জীবনে পূর্বে কখনও ঘটেনি এবং পরেও আজ পর্যন্ত ঘটেনি। এই দেশব্যাপী উন্মাদনার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তার দূরত্ব ঘুচিয়ে আমাদের মধ্যে এলেন, হয়ে উঠলেন ছাত্রদের অন্তরঙ্গ। প্রথম রাখীবন্ধনের দিনের গান চাই। ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ প্রস্তুত। টাউন হলের বিরাট জনসভায় গাওয়ার জন্য গান দরকার। এল ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।’ তার সুরের সঙ্গে আমাদের বেসুর মিশিয়ে সে গান আমরা সে সভায় গেয়েছি। দিনের পর দিন তার প্রবন্ধে, কবিতায়, গানে আমাদের অনুভূতির তন্ত্রী ঝনঝনি করে কেঁপে উঠতে লাগল।
‘মোদের যাত্রা হলো শুরু এখন ওগো কৰ্ণধার।’
‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান।’
‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে। তবে একলা চল রে।’
‘যদি তোর ভাবনা থাকে ফিরে যা না।
ভয় থাকে ত করি মানা।’
সেদিনকার কতক গান কাব্য-ভাণ্ডারে অক্ষয় হয়ে থাকবে। কিন্তু সেদিনের তরুণ যুবকদের পক্ষে বৃদ্ধ বয়সেও বিশুদ্ধ সাহিত্যিক বোধ দিয়ে এসব গান যাচাই করা অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথের গান কণ্ঠে নিয়ে নিৰ্ভয়ে ফাসিকাঠে উঠতে পারে তার সংখ্যা আমাদের মধ্যে কম ছিল না। সে মোহের অবশেষ মনের মধ্যে আজও আছে।
এই রাষ্ট্ৰীয় আন্দোলনের সঙ্গে এবং তারই ফলে, যখন শিক্ষার আন্দোলন এসে মিশল তখন দেশের ছাত্রসমাজ এল রবীন্দ্ৰনাথের মনের আরও কাছে। আর আমরা তার মন জয় করে নিলুম দেশের দরিদ্র ও অসহায়দের সেবাতে সংঘবদ্ধ কর্মকুশল নিষ্ঠায়। সুরাটে কংগ্রেসি যজ্ঞভঙ্গের পর দেশের নরমপন্থী ও চরমপন্থী politics-এর ফাটল ঢাকার চেষ্টায় রবীন্দ্রনাথকে করা হল ‘পাবনা প্রাদেশিক সম্মিলনী’র সভাপতি। এর অল্পদিন পূর্বে বাংলার তরুণ সম্প্রদায় এই নিষ্ঠা ও কর্মকুশলতার একটা বড় পরিচয় দিয়ে দেশকে চমৎকৃত করেছিল অধোদয় যোগ উপলক্ষে। তার অভিভাষণের শেষদিকে এই তরুণদের সম্বোধন করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অপরূপ কষ্ঠে পড়লেন–’রক্তবর্ণ প্ৰত্যুষে তোমরাই সর্বাগ্রে জাগিয়া উঠিয়া অনেক দ্বন্দ্ৰসংঘাত এবং অনেক দুঃখ সহ্য করিলে, তোমাদের সেই পৌরুষের উদ্বোধন কেবলমাত্র বজ্রঝংকারে ঘোষিত হইয়া উঠে নাই, আজ করুণাবর্ষণে তৃষ্ণাতুর দেশে প্রেমের বাদল আনিয়া দিয়াছে। সকলে যাহাদিগকে অবজ্ঞা করিয়াছে, অপমানে যাহারা অভ্যস্ত, যাহাদের সুবিধার জন্য কেহ কোনোদিন এতটুকু স্থান ছাড়িয়া দেয় নাই, গৃহের বাহিরে যাহারা কাহারো কাছে কোনো সহায় প্রত্যাশা করিতেও জানে না তোমাদের কল্যাণে আজ তাহারা দেশের ছেলেদিগকে ভাই বলিতে শিখিল। তোমরা ভগীরথের ন্যায় তপস্যা করিয়া রুদ্রদেবের জটা হইতে এবার প্রেমের গঙ্গা আনিয়াছ; ইহার প্রবল পুণ্যস্রোতকে ইন্দ্রের ঐরাবতও বাধা দিতে পরিবে না, এবং ইহার স্পৰ্শমাত্রেই পূৰ্বপুরুষের ভস্মরাশি সঞ্জীবিত হইয়া উঠিবো! হে তরুণতেজে উদ্দীপ্ত, ভারতবিধাতার প্রেমের দূতগুলি, আমি আজ তোমাদের জয়ধ্বনি উচ্চারণ করিয়া এই নিবেদন করিতেছি যে, দেশে অধোদয় যোগ কেবল এক দিনের নহে।’