কৃষি আরম্ভ হল। প্ৰাণের ধাপ থেকে মনের ধাপে উঠে মানুষ দেখল যে এখানে দাড়ালে অন্ন এসে আপনিই হাতে ধরা দেয়, তাকে পৃথিবীময় খুঁজে বেড়াতে হয় না। এখানে বসে তপস্যা করলে কালো মাটির বুক চিরে সোনার ফসল বাইরে এসে পৃথিবী ঢেকে ফেলে; দিনের অন্ন দিন খুঁজে প্ৰাণাস্ত হতে হয় না। মানুষ জানল, ‘পৃথিবী বা অন্নম, পৃথিবীই অন্ন। মাটির তলে জলের অফুরন্ত ধারার মতো মাটির মধ্যে অন্নেরও অফুরন্ত ভাণ্ডার লুকানো আছে, লাঙলের ফালে তাকে তুলে আনতে জানলে অন্নের দৈন্য দূর হয়; যে মন্ত্র ডারউইন জলে, স্থলে, অন্তরিক্ষে প্ৰত্যক্ষ করেছিলেন তার শক্তিকে ব্যর্থ করা যায়। মাটির সঙ্গে মানুষের হৃদয়ের সম্বন্ধ স্থাপন হল। মাটির টানে উদ্রান্ত বনাচারী গৃহী হল। সেইদিন মানুষের স্বদেশ, সমাজের প্রতিষ্ঠা হল, মানুষের গ্রাম নগর গড়ে উঠল, শিল্প বাণিজ্যের শুরু হল। পৃথিবীর আদিম অরণ্য কেটে সভ্যতার সোনার মন্দিরে মানুষের প্রতিষ্ঠা হল।
কিন্তু প্ৰাণের ভূমি থেকে আরম্ভ করে মানুষের এই যে যাত্রা, এখানেই তার শেষ হয় নাই। মন যখন সৃষ্টির ক্ষমতায় পরিমিত অন্নকে বহু করে অন্নের দাসত্বের লোহার বেড়ি মানুষের পা থেকে খুলে নিল, বিরামহীন অন্নচেষ্টা থেকে তাকে মুক্তি দিল, তখনই মানুষের স্বভাবের যেটি পরমাশ্চর্য অংশ, সেটির বিকাশ হল। মানুষ দেখল যে কেবল অন্নে তার তৃপ্তি নাই, তার পরিমাণ যতই অপৰ্যাপ্ত হোক, তার প্রকার যতই বিবিধ হোক। প্ৰাণের তাড়নায় অন্নের খোঁজে আকাশ, বাতাস, পৃথিবীকে জানতে আরম্ভ করে মানুষ বুঝল যে তার স্বভাবে একটা কী আছে যেটা কেবল জানার দিকে তাকে ঠেলে দেয়। অন্নের সৃষ্টি আরম্ভ করে সে জানল যে তার প্রকৃতির যেটা অন্তরতম অংশ, সেটা কেবল সৃষ্টির আনন্দেই সৃষ্টি করে যেতে চায়। মানুষ যেন প্রাণীরাজ্যের রাজা হলেও অপ্ৰাণ-লোকেরই অধিবাসী। সে যেন বিদেশি রাজপুত্ৰ পরদেশে এসে রাজত্ব পেয়েছে, কিন্তু তার অন্তরাত্মার নাড়ির টান স্বদেশের দিকেই। প্রাণের জগতে মানুষের এই যে উদ্দেশ্যহীন জানা আর অনাবশ্যক সৃষ্টি তাই হল তার বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, কাব্য, কলা, শিল্প। মানুষের প্রাণ বলে এদের মূল্য এক কানা কড়িও নয়; তার অন্তর জানে এরাই তার যথাসর্বস্ব, অন্নের চেয়েও কাম্য, প্ৰাণের চেয়েও প্রিয়।
এই হল মানুষের সভ্যতার অন্ন আর প্রাণের ভূমি থেকে মনের সিঁড়ি দিয়ে বিজ্ঞান আর আনন্দলোকে যাত্রার ভ্রমণ-কাহিনি। এই লোকে পৌছিলেই অন্নের দাসত্ব থেকে মানুষের যথার্থ মুক্তি। মানুষ যদি কেবল অন্নকে আয়ত্ত করেই নিশ্চিন্ত থাকতে পারত তা হলে অন্নদাস হলেও মানুষের জীবনে তার সর্বব্যাপী প্রভুত্বের কোনও অপচয় হত না। সোনাব শিকলে অন্নকে বাধলেও শিকলের অন্য দিকটা মানুষের গলাতেই পরানো থাকত, অন্নের টানে পৃথিবীময় না ঘুরতে হলেও সারাক্ষণ অন্নকে টেনেই পৃথিবীতে চলতে হত। এই বিজ্ঞান আর আনন্দলোকে পৌছিতে জানলেই মানুষের গলা থেকে এই অন্নের শিকল খোলার উপায় হয়। আমাদের ঋষিরা সংসারচক্র থেকে জীবের মুক্তির কথা বলেছেন। এই হল মানুষের সভ্যতার অন্নচক্র থেকে মুক্তির পথ।
৩
যদি কারু মনে হয় যে মনের বলে মানুষের আয়ত্ত হয়ে, তাকে বিজ্ঞান আর আনন্দোব পথেব যাত্রী দেখে, মানবজীবনের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করে, অন্ন চিবদিনের জন্য নিশ্চেষ্ট হয়ে গেছে, তবে তিনি অন্নের প্রভাব এবং মাহান্ত্র্যের কথা কিছুই জানেন না। মানুষেব সভ্যতার যে যে মুক্তির কথা বলেছি সে হল শাস্ত্রে যাকে বলে জীবন্মুক্তি, অর্থাৎ দেহও আছে, মুক্তিও হয়েছে। সুতরাং মানুষের দেহ আর প্রাণ যখন আছে তখন তার অন্নের উপর একান্ত নির্ভর আছেই আছে। এই ছিদ্র ধরে অন্ন অতি নিপুণ সেনাপতির মতো এক নূতন পথ দিয়ে তার বল চালনা করে মানুষকে বন্দি করবার চেষ্টা করেছে। প্রাচীন দ্বন্দ্বটা চলেছে, কেবল অবস্থার পরিবর্তনে ‘ষ্ট্র্যাটেজি’র প্রভেদ ঘটেছে মাত্র।
যতদিন মানুষ কেবল প্ৰাণী ছিল, তার মনের পূর্ণ বিকাশ হয়নি, বিজ্ঞান ও আনন্দলোকের বার্তা তার অজ্ঞাত ছিল, ততদিন অন্নের দৃষ্টি ছিল মানুষের প্রাণের উপর। যেমন ইত্যর প্রাণীকে তেমনি মানুষকেও নিজের রথের চাকায় বেঁধে, অন্ন তার জীবন-মৃত্যুর উপব কর্তৃত্ব করত। এই যুদ্ধে অন্ন জয়ী হয়েছিল নিজেকে বিরল করে, আপনাকে দুর্লভ করে। মানুষের মন যখন অন্নকে বহু ও সুলভ করে এই উপায়টা ব্যর্থ করল সেইদিন থেকে অন্নের দৃষ্টি পড়েছে মানুষের বিজ্ঞান ও আনন্দলোকের দিকে। অন্ন জানে যে ওরাই তার প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী মানুষের জীবনে যদি ওদের আবির্ভাব না হত, তা হলে নামে প্ৰভু হলেও রোমের শেষ সম্রাটদের মতো মানুষ দাস অন্নের দাসত্বই করত। কাজেই অন্নেরা এখন চেষ্টার বিষয় হয়েছে মানুষের সভ্যতার ওই বিজ্ঞান আর আনন্দের লোকটা ধ্বংস করা। আর প্রাণকে আয়ত্ত করার প্রাচীন চেষ্টার ব্যর্থতার মধ্যেই অন্ন এই নূতন যুদ্ধের অস্ত্ৰ খুঁজে পেয়েছে। দুর্লভ অন্নকে বহু করে মানুষ সভ্যতা গড়েছে। এই বহু অন্ন অসংখ্য মােহিনী মূর্তিতে মানুষকে ঘিরে তার বিজ্ঞান আর আনন্দলোকের পথরোধের চেষ্টা করছে। বিরলতার ক্ষয়রোগে মানুষের সভ্যতাকে ধবংস করতে না পেরে বাহুল্যের মেদরোগে তার হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়াটা বন্ধ করবার চেষ্টা দেখছে। অন্ন এখন মহাকালের মূর্তি ছেড়ে কুবেরের মূর্তি ধরেছে। মানুষের কত সভ্যতা মহাকালের করােল দংষ্ট্রা হতে উদ্ধার পেয়ে স্কুলোদর ভোগপ্ৰসন্নমুখ কুবেরের মেদপুষ্ট বাহুর আলিঙ্গনের মধ্যে নিশ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরেছে!