আমরা বাংলাদেশের ছেলে বুড়ো অন্নচিন্তার ব্যাপারে সবাই যে এই সব আশ্চর্য ও অস্বাভাবিক কাণ্ড করি, পূর্বেই বলেছি। এতে আমাদের দোষ কিছু নেই। দোষ পূৰ্বপুরুষদের যাবা ও-সম্বন্ধে সুচিস্তা ও মনের কোনও স্বাভাবিক ঝোক রক্ত-মাংসের সঙ্গে আমাদের দিয়ে যেতে পারেননি। এই দায়িত্বহীনতার সাহসেই এই প্ৰবন্ধও শুরু করেছি। কেননা জানি, বেফাঁস কথা যা কিছু বলব তাতে আমার নিজের দায়িত্ব কিছুই নেই। দায়ী সেই পিতৃপুরুষেরা যাঁরা পিণ্ডের আশা করেন। কিন্তু পিণ্ডের অন্ন সম্বন্ধে একনিষ্ঠ হয়ে চিন্তা করবার মতন মনের বা মগজের অবস্থা নিজেদের না থাকায় আমাদেরও দিয়ে যেতে পারেননি।
২
দেশের প্রাচীন আচার্যেরা যখন অন্ন সম্বন্ধে চিস্তাই করেননি, তখন সে চিস্তায় কিছু সাহায্য পেতে হলে পশ্চিমের আধুনিক যবনাচাৰ্যদের কাছেই যেতে হয়। এঁদের মধ্যে একদল আছেন যাঁরা অন্ন-জিজ্ঞাসারই একটা স্বতন্ত্র শাস্ত্র গড়ে তুলেছেন। কিন্তু অন্ন সম্বন্ধে যিনি সবচেয়ে ব্যাপক অথচ গভীরভাবে চিস্তা করেছেন তিনি এই অন্নশাস্ত্রের শাস্ত্রী নন, তিনি একজন প্ৰাণতত্ত্ববিদ আচাৰ্য, নাম চার্লস ডারউইন। ভূগু-বরুণ প্রসঙ্গের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে অন্নতত্ত্বের এক ধাপ উপরে উঠলে পাই প্ৰাণতত্ত্ব। সুতরাং প্রাণতত্ত্বজ্ঞ ডারউইন যে তার উপরের ধাপ থেকে অন্নের লীলা ব্যাপকতর ও স্পষ্টতরভাবে প্ৰত্যক্ষ করবেন তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।
ডারউইন পূর্বাচার্যদের কাছ থেকেই অন্নপ্ৰাণ-বিদ্যার এই বীজমন্ত্রটি পেয়েছিলেন যে পৃথিবীতে যত প্ৰাণী জন্মে তাদের সকলের প্রাণরক্ষার উপযোগী পৰ্যাপ্ত অন্ন বসুমতী জোগাতে পারেন না। কিন্তু এই প্রাচীন মন্ত্রই বহু বৎসর ধরে একান্ত নিষ্ঠা ও কঠোর সংযমেব সঙ্গে জপ করতে করতে পূর্বে যা কারও ভাগ্যে ঘটেনি তার সেই সিদ্ধি লাভ হল। অন্ন তার অদৃষ্টপূর্ব বিশ্বরূপ ডারউইনকে দেখালেন। তিনি দেখলেন স্থলে, জলে, আকাশে—-অরণ্যের ছায়ায়, মরুভূমির প্রান্তে, গাছের শাখায়, পর্বতের গহ্বরে, সমুদ্রের তলে, হ্রদের বুকে–অন্নের জন্য প্ৰাণের এক অবিশ্রান্ত দ্বন্দ্ব চলেছে। অন্ন পরিমিত, তার আকাঙ্ক্ষী জীব সংখ্যাহীন। এই পরিমিত অন্নকে আয়ত্ত করার জন্য প্ৰাণীতে প্ৰাণীতে, উদ্ভিদে উদ্ভিদে, উদ্ভিদে প্ৰাণীতে যে দ্বন্দ্ব, তা যেমন বিরামহীন তেমনি মমতাহীন। এ দ্বন্দ্বে কেহ কারও সহায় নয়। এ হল সকলের সঙ্গে প্ৰত্যেকের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব কখনও প্রকাশ হচ্ছে প্ৰকাশ্য যুদ্ধের রক্তোচ্ছাসে, কখনও নিঃশব্দে চলেছে। নীরব রক্তশোষী প্ৰতিযোগিতার আকারে। কোনটা বেশি ভয়ানক বলা কঠিন। অন্ন তার মোহিনী মূর্তিতে প্ৰাণকে আকর্ষণ করেছেন, আর আকৃষ্ট প্রাণীকে মহাকালের মূর্তিতে সংহার করছেন। শেষ পর্যন্তও যাদের উপর প্রসন্ন দৃষ্টি রাখছেন সেই ভাগ্যবানদের সংখ্যা অতি সামান্য। মৃত্যুর মরুভূমির উপর দিয়ে অন্ন তার সম্মোহন শঙ্খ বাজিয়ে চলেছেন। প্রতি মুহূর্তে প্ৰাণের জোয়ারে দুকুল ছাপিয়ে উঠছে, কিন্তু সে উচ্ছাস দু’পাশের তপ্ত বালুতেই শুষে নিচ্ছে। প্ৰাণের একটা অতি ক্ষীণ ধারা কোনওরকমে শেষ পর্যন্ত অন্নের পিছনে পিছনে চলেছে।
অন্নের এই মোহিনীমহাকালের যুগলমূর্তি দর্শন করে ডারউইন কাল জয় করে আমর হয়েছেন। কিন্তু প্ৰাণের সঙ্গে অন্নের লীলার এখানেই শেষ নয়। প্ৰাণের ধারা চলতে চলতে একদিন মানুষে এসে ঠেকল। পৃথিবীতে প্ৰাণের ক্রমবিকাশ হতে হতে একদিন তা মানুষের মূর্তি নিয়ে প্রকাশ হল। কেমন করে হল সে কথা পণ্ডিতদের তর্ক-কোলাহলে অপণ্ডিত সাধারণের কানে আসা দুঃসাধ্য; তাতে আমাদের প্রয়োজন নেই। কিন্তু এবার যে বিগ্রহে প্ৰাণের প্রতিষ্ঠা হল, সে বিগ্ৰহ অতি মনোরম, অতি বিস্ময়কর। তার সুঠাম, সরল, উন্নত দেহ, তার বন্ধনহীন মুক্ত বাহু, তার সতেজ ইন্দ্ৰিয়, তার সবল, অনাড়ষ্ট মাংসপেশি সবই যেন স্পষ্ট করে বলে দিল যে এ বিগ্রহ অরণ্যে পড়ে থাকবার নয়, এর জন্য একদিন সোনার দেউল গড়া হবেই হবে। তবুও প্রাণের এই প্রকাশের সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার তার এই মূর্তি নয়। তার চেয়েও লক্ষগুণে আশ্চর্য এক ব্যাপার সংঘটিত হল। যেমন বোধ হয় পৃথিবীতে প্রাণের যাত্রারম্ভের সঙ্গেই তার সাথে ছিল, অতি ক্ষীণ অদৃশ্যপ্রায় অবস্থা থেকে নানা মূর্তির মধ্য দিয়ে অতি ধীরে ধীরে ক্রমে উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল, মানুষের মূর্তিতে পৌঁছে সে একবারে দীপ্ত সূর্যের মতন জ্বলে উঠল। তার উজ্জল দীপ্তিতে মানুষ পৃথিবীর দিকে চেয়ে দেখল যে এ বিপুল ধরিত্রী তারই রাজত্ব।
অন্ন তাঁর নিজের শক্তি সেইদিন পূর্ণরূপে উপলব্ধি করলেন যেদিন এই মানুষও, রাজটীকা ললাটে নিয়ে, কঙালের মতো তাঁর পিছু পিছু পৃথিবীময় ছুটে বেড়াতে লাগল। একটা ফলের জন্য দশটা গাছের তলায়, একটা শিকারের খোঁজে এক অরণ্য হতে আর এক অরণ্যে ঘুরে ঘুরে, পরে অন্নকে কিছু সুলভ করে একটু সুস্থির হওযার চেষ্টায় গোটাকয়েক প্রাণীকে যদি পোষ মানােল, তবে সেই প্রাণীরূপ অন্নের অন্ন খুঁজতে এক দেশ হতে আর এক দেশে চলতে চলতে তার পায়ে ব্যথা ধরে উঠল। এই অজ্ঞাতবাসের দুঃসহ দৈন্যে মানুষের বহুযুগ কেটে গেল। শেষে এক দিন পরম শুভক্ষণে ক্লান্তদেহ, ক্ষুব্ধ চিত্ত মানুষ বলে উঠল। আর অন্নের আশায় তার পিছু পিছু ঘুরে বেড়াব না, অন্নকে সৃষ্টি করব, স্বল্প অন্নকে বহু করব। সেদিন নিশ্চয়ই স্বর্গের তোরণে মঙ্গলশঙ্খ বেজে উঠেছিল; দিব্যাঙ্গনারা মর্ত্যচক্ষুর অদৃশ্য হেমঘটে অভিষেকবারি এনে মানুষের মাথায় ঢেলেছিলেন; ইন্দ্ৰদেব এসে সোনার রাজমুকুট তার মাথায় পরিয়েছিলেন; আর সমস্ত আকাশ ঘিরে দেবতারা প্ৰসন্ন নোত্রে দীর্ঘ বনবাসের পরে মানুষের নিজ রাজ্যে অভিষেক চেয়ে দেখেছিলেন।