সভ্যতার এই ফলগুলি শিক্ষার দ্বারা মানুষকে আয়ত্ত করানো যায়, কেননা যে শক্তির প্রয়োগে ইহাদের সৃষ্টি সে শক্তি অল্প-বিস্তর মানুষ জন্ম হইতেই লাভ করে। সেই জন্য অসভ্য সমাজের শিশুও শিক্ষা পাইলে সভ্যসমাজের ছেলের মতোই সভ্যতার বিদ্যাগুলিকে আয়ত্ত করিতে পারে। ইহার পরীক্ষা অনেকবার হইয়া গিয়াছে। অন্যদিকে সভ্যসমাজের ছেলেকেও শিক্ষা পাইয়াই এই বিদ্যাগুলির সহিত পরিচিত হইতে হয়। কেননা বিদ্যা তো মানসিক শক্তি নয়, উহা মানসিক শক্তির সৃষ্টি এবং সহস্ৰ যুগের মানব-প্রতিভার সমবেত সৃষ্টি। প্রকৃতি যাহার কপালে প্রতিভার তিলক পরাইয়াছেন, যে কেবল সভ্যতার সৃষ্টিগুলিকে নিজস্ব করিতে পারে তাহা নয়, তাহার উপর নিজের সৃষ্টিও যোগ করিতে পারে, তাহাকেও এই শিক্ষার দ্বারা দিয়াই সভ্যতার রাজ্যে প্রবেশ করিতে হয়। কেননা এমন প্রতিভার কল্পনা করা যায় না, যাহা সভ্যতার কোনও সৃষ্টিকে আবার প্রথম হইতে একাই গড়িয়া তুলিতে পারে। প্রাচীন সৃষ্টির উপর দাড়াইয়াই তবে নূতন সৃষ্টি করা সম্ভব।
শিক্ষার লক্ষ্য সম্বন্ধে বর্তমান যুগে আর একটি মত প্রচলিত হইয়াছে যাহা বিজ্ঞলোকের পাণ্ডিত্যের ফল নয়। সংসারের চাকা বর্তমান যুগের মানুষ ও জাতির হৃদয় পিষিয়া এই মতটা নিংড়াইয়া বাহির করিয়াছে। মতটি হইল। এই যে, শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য মানুষকে জীবন-যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা। অর্থাৎ শিক্ষার উদ্দেশ্য–মানুষকে এমনভাবে গড়িয়া তোলা, যেন সে টিকিয়া থাকিয়া বংশরক্ষা করিয়া যাইতে পারে! এই মতটির আবির্ভাব মানবসভ্যতার একটা tragedy। ইহা মনের উপর প্রাণের প্রতিশোধ। প্ৰাণের ঘরে ডাকাতি করিয়া মানুষ মনের ভোগের জন্য সভ্যতা গড়িয়াছে। কিন্তু ইহার দু’-একটি সৃষ্টিকে আবাবা প্ৰাণের কাজে লাগাইতে গিয়া জীবনযাত্ৰাটা এমনই জটিল ও কঠিন হইয়া উঠিয়াছে যে, মানুষ প্রাণ রাখিতে যা কেবল প্ৰাণান্ত হইতেছে তাহা নয়, একেবারে মনান্ত হইতেছে। মনের যা কিছু শক্তি ও ক্ষমতা এক প্রাণ রাখার কাজেই ব্যয় করিতে হইতেছে। ইহার বিরুদ্ধে ওজস্বিনী বক্তৃতা করিয়া কোনও লাভ নাই। যাহা জীবন হইতে ঠেলিয়া উঠিতেছে কেবল মত দিয়া তাহাকে চাপা দেওয়া চলে না। এ হইল ভিড়ের ভিতর ঠেলাব মতো; ব্যাপারটা কেহ পছন্দ কবে না, কিন্তু পিছু হটবারও কাহারও সাধ্য নাই।
বর্তমান যুগের মানুষের পক্ষে হয়তো এই জটিলতার হাত এড়ানো অসাধ্য। এবং হয়তো বাধ হইয়াই বর্তমান যুগের শিক্ষার্থীকে জীবন-যুদ্ধেব জন্য তৈরি করাটাই শিক্ষার একটা প্রধান লক্ষা করিতে হইবে। প্ৰাণের দাবির সুর যখন খুব চড়া হইয়া ওঠে তখন আর সব ফেলিয়া সেই দিকেই কান দেওয়া ছাড়া গতি নাই। কিন্তু আমরা যেন ভুলিয়াও না মনে করি যে এই বিসদৃশ ব্যাপারটাই হইল সভ্যতার উন্নতি। এ ভুলের আশঙ্কা আছে। কেননা মন আব ইন্দ্ৰিয়ের যে শক্তির প্রযোগে মানুষ সভ্যতা গড়িয়াছে, আজ জীবনযাত্রার জটিলতায় সেই সব শক্তির উপরেই প্ৰাণ তাহার একাধিপত্যের দাবি পেশ করিয়াছে। ফলে মানুষের বুদ্ধি, কল্পনা, প্রতিভা ব্যয় হইতেছে অনেক, কিন্তু সকলেরই লক্ষ্য কেবল প্ৰাণ বাঁচানো ও জাত বাঁচানো। ইহা সভ্যতা নয়, এ হইল সভ্যতা যে পথে চলে তাহার একবারে বিপরীত পথ। প্ৰাণের কাজে যাদের প্রথম প্ৰকাশ, মনের ভোগে তাদের শেষ পবিণতি হইল সভ্যতা। প্ৰাণের ব্যাগারে সমস্ত মনটাকেই নিঃশেষ করিয়া দেওয়া অসভ্যতা না হইতে পারে। কিন্তু সভ্যতা না।
অন্নচিন্তা
আমাদের বৈশেষিকেরা বলেছেন অভাব একটি পদার্থ। এমন সূক্ষ্মদৃষ্টি না থাকলে কি আর তাদের চোখে পরমাণু ধরা পড়ে! আজি এই ঘোরতর অন্নাভাবের দিনে, অভাব যে একটা অতি কঠিন পদার্থ তাতে কে সন্দেহ করে? অথচ এই তত্ত্বটি প্রাচীন আচার্যেরা জেনেছিলেন যোগবলে। কেননা সেকালের ব্ৰাহ্মণ-পণ্ডিতের ঘরে যে অন্নাভাব ছিল না। সে বিষয়ে একালের ব্ৰাহ্মণ-পণ্ডিতেরা একমত, আর বিলাতি সভ্যতাই যে দেশের সমস্ত রকম অভাবের মূল, অর্থাৎ ওই সভ্যতার আমদানির পূর্বে যে দেশে কোনও কিছুরই অভাব ছিল না, এ তো আমাদের সকলেরই জানা কথা। সুতরাং কি ঘরে কি বাইরে, কোনও স্থানেই বৈশেষিক আচার্যের অভাবকে প্রত্যক্ষ করেন নাই। কাজেই সে সম্বন্ধে আঁরা যে তত্ত্বটি প্রচার করেছেন সেটি পুরাণের ভবিষ্যৎরাজবংশাবলির মতো, আর সুশ্রুতের শারীর-স্থান-বিদ্যার মতো সম্পূর্ণ ধ্যানলব্ধ সামগ্ৰী।
কুতার্কিক লোকে হয়তো এইখানে তর্ক তুলবেন যে, বৈশেষিকেরা যে অভাবকে পদার্থ বলেছেন সে অভাবের অর্থ কেবল negation। আর পদার্থ মানে বস্তু নয়, বিলাতি দর্শনে যাকে বলে category তাই। এবং এই তত্ত্বটির অর্থ মাত্র এই যে অভাব বা negation মনন-ব্যাপারের অর্থাৎ thought-এর একটা necessary ক্যাটিগরি। কিন্তু এই তর্ক আর কিছুই নয়, এ হল হিন্দু-দর্শনের পবিত্র মন্দিরেও স্লেচ্ছ সংস্পৰ্শ ঘটিয়ে তার জাত মারবার চেষ্টা। নিশ্চয় জানি, কোনও খাঁটি হিন্দু এ-সব তর্কে কান দেবেন না। সুতরাং এ তর্কের উত্তর দেওয়া নিম্প্রয়োজন।
প্রাচীনকালে যে ভারতবর্ষে অন্নাভাব ছিল না তার একটি অতি নিঃসংশয় প্রমাণ আছে। মাধবাচাৰ্য তার সর্বদর্শন-সংগ্রহে ছোট-বড় সমস্ত রকম দর্শনের বিবরণ দিয়েছেন। একটি পাণিনিদর্শনের বর্ণনা আছে, যাতে প্রমাণ করা হয়েছে যে ব্যাকরণশাস্ত্ৰই পরম পুরুষার্থের সাধন, ওই শাস্ত্রে পারদশী না হলে সংসার-সাগর পারের আশা দুরাশা এবং ওই শাস্ত্ৰই মোক্ষমার্গের অতি সরল রাজপথ। এমনকী একটি রসেশ্বর-দর্শন আছে, যাতে যুক্তি এবং শ্রুতি উভয় প্রমাণেই প্ৰতিপাদিত হয়েছে যে রস বা পারদই পরব্রহ্ম। রসার্ণব, রাসহাদয় প্রভৃতি প্রামাণিক দার্শনিক গ্ৰন্থ থেকে যুক্তি-প্রমাণ উদ্ধৃত হয়েছে; এবং রসজ্ঞেরা শুনে খুশি হবেন, যে শ্রুতি-প্রমাণটি আহত হয়েছে সেটি তাদের সুপরিচিত ‘রসো বৈ সঃ রসো হোবায়ং লব্ধানন্দী ভবতি’ এই শ্রুতিবাক্য। এমন পুথিতেও অন্নদর্শন বলে কোনও দর্শনের বিবরণ দূরে থাক নাম পর্যন্ত নেই। এ থেকে কেবল এই অনুমানই সম্ভব যে, প্রাচীনকালে এদেশে আন্নাভাব না থাকায় অন্নচিন্তাও ছিল না, এবং বিষয়টা সম্বন্ধে একবারে চিন্তার অভাবেই এ বিষয়ে কোনও দর্শনের উদ্ভব হয়নি। কেননা ও-বিষয়ে কিছুমাত্র চিন্তা থাকলে যে তার একটা দর্শনও থাকত, তাতে বোধ হয় যে প্রমাণ দেখিয়েছি তারপর আব্ব কোনও বুদ্ধিমান লোকে সন্দেহ করবেন না। এবং আমার এই যুক্তিটি যে সম্পূর্ণরূপে ‘বিজ্ঞানানুমোদিত ঐতিহাসিক প্রণালী সম্মত তাও নিশ্চয়ই সকলেই স্বীকার করবেন।