এই তো গেল। সংক্ষেপে Organic Evolution-এর নিয়ম-সম্বন্ধে পণ্ডিতদের বর্তমান মত। এখন ইহার সহিত মানুষের সভ্যতার ক্রমোন্নতির সম্পর্কটা কী? মানুষের কাব্য, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প, সংগীত কিছুই তো মানুষের শরীরে দাগ কাটে না, বিশেষত শরীরের সেই মালমশলাগুলিতে যাহার উপর বংশানুক্রম নির্ভর করে। এগুলি বাহিরের বস্তু। মানুষ এগুলিকে আবিষ্কার করিয়াছে, সৃষ্টি করিয়াছে। ইহারা এক পুরুষের শরীর হইতে আর এক পুরুষের শরীরে সঞ্চারিত হয় না। এক পুরুষের মানুষ পরের পুরুষের মানুষকে এগুলি সঞ্চিত ধনের মতো দান করিয়া যায়। ইহারা মানুষের heredity নয়, inheritance। এগুলির বংশানুক্রম নাই, আছে উত্তরাধিকার। এবং এ ধানের উত্তরাধিকারী একমাত্র অঙ্গজ নয়, সমগ্ৰ মানবসমাজ।
তারপর ডারউইনের Survival of the fittest নিয়মেরও এখানে কোনও প্রভাব নাই। সভ্যতার যাহা শ্রেষ্ঠ ফল তাহার দ্বারা জীবনসংগ্রামে কোনও কাজই হয় না। Binomial theorem আবিষ্কার করিয়া Newton-এর জীবনযাত্রার এবং বংশরক্ষার যে কোন সুবিধা হইয়াছিল, ইহা তাহার জীবনচরিত লেখকেরা বলেন না, এবং যাহারা ওই তত্ত্বটি আবিষ্কার করিতে পারেন নাই তাঁহারা যে নির্বংশ হন নাই। ইহাও নিশ্চিত। কাব্য রচনার ফলে ‘জীবনযুদ্ধে জয়লাভের কতটা সুবিধা হয় সে সম্বন্ধে দেশি বিদেশি ভুক্তিভোগী কবিদের আত্মোক্তির অভাব নাই, এবং অকবি লোকও যে সংসারে টিকিয়া থাকে এবং বংশরক্ষা করিয়া। তবে মরে তাহাও অস্বীকার করা চলে না।
এ কথা সত্য যে, মন ও ইন্দ্ৰিয়ের যে-সব শক্তির প্রয়োগে মানুষ সভ্যতা গড়িয়া তুলিয়াছে ও তুলিতেছে, ওই শক্তিগুলি Organic Evolution-এরই ফল। মানুষের বুদ্ধি, প্রতিভা, কল্পনা, ইন্দ্ৰিয়ের সূক্ষ্মানুভূতি এগুলি যে জন্মগত ইহা তো প্রতিদিন চোখেই দেখা যায়। এবং ওই শক্তিগুলিই যে জীবনযুদ্ধে মানুষের সহায় হইয়া তাহাকে পৃথিবীর রাজাসনে বসাইয়াছে তাহাও স্থিরনিশ্চিত। কিন্তু ওই শক্তিগুলিকে যে-সব কাজে লাগাইয়া মানুষ সভ্যতার সৃষ্টি করিয়াছে তাহা Organic Evolution-এর চোখে একবারে বাজে খরচ, সম্পূর্ণ অপব্যবহার। Organic Evolution-এর ফলে মানুষ লাভ করিল তীক্ষ শ্রবণশক্তি, যেন শিকারের ও শিকারির মৃদু পদশব্দটিও কানে না এড়ায়, মানুষ সেই সুযোগে গড়িল সংগীতবিদ্যা। ইভলিউশনে মানুষ পাইল দশ আঙুলের সূক্ষ্ম স্পর্শানুভূতি, যেন তাহার তিরের লক্ষ্যটা একেবারে অব্যৰ্থ হয়; সে বসিয়া গেল তাত পাতিয়া মলমল বুনিতে, আর তুলি ধরিয়া ছবি আঁকিতে। ইভলিউশন মানুষকে দিল তীক্ষ্ণবুদ্ধি আর কল্পনা যেন সেনানা ফিকিরে শরীরটাকে ভাল রকম বাঁচাইয়া বংশটা রাখিয়া যাইতে পারে, মানুষ গড়িয়া তুলিল কাব্য, বিজ্ঞান, দর্শন। ইভলিউশনে মানুষের কণ্ঠে আসিল ভাষা— যাহাতে তাহার পক্ষে দলবদ্ধ হওয়া সহজ হয়, মানুষ সৃষ্টি করিয়া বসিল— ব্যাকরণ আর অলংকার। মোট কথা মানুষ সভ্যতার সৃষ্টি করিয়াছে প্ৰাণেব ঘরের চোরাই মাল মনের কাজে খরচ করিয়া। প্ৰাণের ঘরকন্নার জিনিস মনের বিলাসে ব্যয় করার নাম সভ্যতা।
মানুষের এই তহবিল তছরুপের একটা ফল এই যে, মানুষের ইন্দ্ৰিয়ের ও মনের শক্তি Organic Evolution-এ যেখানে আসিয়া পৌঁছিয়ছিল সেইখানেই থামিয়া আছে। ঐতিহাসিক কালের মধ্যে যে এই সকল শক্তির কিছু বৃদ্ধি হইয়াছে তাহা বোধ হয় না। প্রাচীন গ্রিক অপেক্ষা যে নবীন ফরাসির বুদ্ধি ও রূপজ্ঞান অধিক তাহার কোনও প্রমাণ নাই, এবং বৈদিক যুগের হিন্দুর অপেক্ষা আমাদের মানসিক শক্তি যে উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে এমন কথা কি সবুজপন্থী কি সনাতনপন্থী কেহই বলিবেন না। তবে প্রাচীন কালের তুলনায় বর্তমান সভ্যতার অনেক বিষয়ে আশ্চৰ্যজনক বৃদ্ধি হইয়াছে। প্রাচীন পণ্ডিতের যাহা স্বপ্নেরও অতীত ছিল বর্তমানের শিশুরাও তাহা হাতেখড়ির পরেই শেখে। তাহার কারণ সভ্যতা বাড়ে টাকার সুদের মতো। এক যুগের মানুষ যাহা সৃষ্টি করে, পরের যুগের মানুষ শিক্ষার সাহায্যে তাহাকে আয়ত্ত করিয়া আবার তাহার উপর নূতন সৃষ্টির আমদানি করে, এইরকমে প্রাচীন সৃষ্টির উপর নবীন সৃষ্টি জমা হইয়া মানুষের সভ্যতা বাড়িয়া চলে। প্রাচীন যুগে যাহারা সভ্যতার গোড়াপত্তন করিয়াছিলেন তীহাদের মানসিক শক্তি যে আমাদের চেয়ে কিছু কম ছিল তাহা নয়, কিন্তু তাঁহাদের চেষ্টার ফল যে অনেক বিষয়ে আমাদের কাছে খুব সামান্য বোধ হয় তাহার কারণ আমরা পাইয়াছি তাহার পরের শত যুগের চেষ্টার পুঞ্জীভূত ফল। এবং আমরা যে নূতন সৃষ্টি করি তাহা এই বহুযুগের সৃষ্টিকে ভিত্তি করিয়া। এই জমানো সভ্যতার পুঁজি যে মাঝে মাঝে অল্প-বিস্তর খোয়া যায় না। তাহা নয়; তখন আবার মানুষকে কঁচিয়া আরম্ভ করিতে হয়। এবং বুনিয়াদি ঘরের জমানে টাকার মতোই ইচ্ছা করিলে কিছুমাত্র না বাড়াইয়া দুই-এক পুরুষেই ইহাকে ফুকিয়া নিঃশেষ করিয়াও দেওয়া যায়। ইহার দৃষ্টাস্তের জন্য আমাদের বেশি দূরে যাইতে হইবে না।
৫
Organic Evolution-এর রাজ্যে বিদ্রোহী হইয়া তাহার রাজ্য লুটিয়া আনিয়া, মানুষ যে সভ্যতার সৃষ্টি করিয়াছে তাহার ফল সঞ্চিত হইয়াছে সাহিত্যে, কলায় এবং বিবিধ বিদ্যায়। শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য এইগুলির সহিত মানুষের পরিচয় করাইয়া দেওয়া। এই সকল বিদ্যা ও কলা অতীতের নিকট হইতে বর্তমানের উত্তরাধিকার। শিক্ষার লক্ষ্য এই উত্তরাধিকারে মানুষকে অধিকারী করা। কেননা এ তো কোম্পানির কাগজের দান নয় যে ঘরে বসিয়া সুদ পাওয়া যাইবে। এ হইল কষ্টে গড়া ব্যবসায়ের উত্তরাধিকার। কাজ শিখিয়া চলাইতে পারিলে তবেই লাভের সম্ভাবনা।