মানুষের এই সুপ্রাচীন সুপরিণত সভ্যতা মানুষ যে সম্পূর্ণ অসভ্যতার হাত হইতে ক্রমশ উদ্ধার করিয়াছে তাহাতে সংশয় নাই, এবং বর্তমানের অতি সুসভ্য মানুষ যে অতীতের নিতান্ত অসভ্য আদিম মানুষেরই বংশধর তাহাতেও সন্দেহ করিবাব কোনও কারণ দেখি না। মানুষ যে অসভ্যতা হইতে ক্রমশ সুসভ্যতায় উপনীত হইয়াছে, সে সম্বন্ধে বর্তমান যুগের শিক্ষিত জনসাধারণের মনে বড় একটা সংশয় নাই। তাহারা জানিয়া রাখিয়াছেন যে, ইহা ইভলিউশনের ফল। ইহার অর্থ কেবলমাত্র এই নয় যে, মানুষের সভ্যতা ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করিয়াছে; কেননা এই ক্ৰমবিকাশের কথা তো অল্প-বিস্তর ঘটনারই বিবৃতি, তাহার ব্যাখ্যা নয়। এই ইভলিউশন্যবাদের সম্পূর্ণ অর্থটা এই যে, যে নিয়মে অতি নিম্নশ্রেণির জীবদেহ হইতে পৃথিবীতে অতি উচ্চশ্রেণির জীবশরীর এমশ উদ্ভূত হইয়াছে বলিয়া প্রাণতত্ত্ববিদ পণ্ডিতেরা স্থির করিয়াছেন, ঠিক সেই নিয়মেই মানুষের সভ্যতা অতি নীচ অবস্থা হইতে ক্রমশ উচ্চ অবস্থায় আসিযা পৌঁছিয়াছে। প্ৰসিদ্ধ ইংরাজ দার্শনিক হাৰ্বাট স্পেন্সার এই মতটা খুব জোরের সহিত প্রচার করিয়াছেন এবং সেই প্রচারের কাজটা এতই সাফল্য লাভ করিয়াছে যে, যাঁহাদের সাক্ষাৎ সম্বন্ধে স্পেন্সারের লেখার সহিত কোনও পরিচয় নাই, তাহাদেরও এই মতের সত্যতা সম্বন্ধে বিন্দুমাত্ৰ সংশয় নাই। এবং বোধ হয় এই মতটা পোষণ করা আধুনিকতা ও বৈজ্ঞানিকবুদ্ধির লক্ষণ বলিয়াই শিক্ষিত-সমাজে গণ্য ও মান্য। কিন্তু মতটা আগাগোড়া মিথ্যা। পৃথিবীতে জীবশরীরের ক্রমবিকাশের নিয়মের সহিত মানুষের সভ্যতার ক্রমোন্নতির কোনও সম্পর্ক নাই। এই দুই ব্যাপারের নিয়ম ও প্রণালী সম্পূর্ণ পৃথক, এবং পৃথক বলিয়াই অসভ্য শিশুকে শিক্ষা দিয়া সুসভ্য মানুষ করা সম্ভব হয়, এবং পৃথক বলিয়াই সভ্য মানুষের সমাজে শিক্ষা এতটা স্থান জুড়িয়া আছে। যদি, সত্যই Organc Evolution-এর নিয়মে মানবসভ্যতার বিকাশ হইত। তাহা হইলে মানুষের জীবনে শিক্ষার কোনও স্থান থাকিত না; বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সভ্যতালব্ধ সমস্ত বিদ্যা শিশুর মনে আপনিই স্ফরিত হইত এবং যে হতভাগ্যের হইত না স্বয়ং ফ্রোবেলও সারাজীবন শিক্ষা দিয়া তাহাকে বর্ণ পরিচয় করাইতে পারিতেন না।
Organic Evolution-এর মূলে আছে Heredity অঙ্গ-প্রত্যঙ্গহীন, উদর সর্বস্ব জীবাণু হইতে যে পৃথিবীতে ক্ৰমে মানুষের জন্ম হইয়াছে ইহার গোড়ার কথা এই যে, জনক জননীর দেহের ও মনের ধর্ম সন্তানে সংক্রমিত হয়। ফলে যখন জনক জননীর শরীরে বা মনে নুতন কিছুর আবির্ভাব হয় তখন তাহাদের সন্তান, অন্বয়ানুসারে সেই নূতনত্ব লাভ করে। যদি জীবন-সংগ্রামে এই নূতন কিছুর দ্বারা কোনও সুবিধা হয় তবে যাহাদের সেটা আছে তাহার সাহায্যে সেই শ্রেণির প্রাণীর মধ্যে তাহারাই বাঁচিয়া থাকে এবং বংশ রাখিয়া যায়, বাকিগুলি নির্বংশ হইয়া মরে। এবং এইরূপে যুগের পর যুগ নানা বিভিন্ন অবস্থায় নূতনত্বের উপর নূতনত্ব পুঞ্জীভূত হইয়া সৰ্বেন্দ্রিয়হীন এক Cell-এর জীব হইতে পশুপক্ষী ও মানুষের উদ্ভব হইয়াছে। এই হইল Organic Evolution সম্বন্ধে পণ্ডিতদের আধুনিক মত।
কেমন করিয়া জীবশরীরে এই নূতনত্বের আবির্ভাব হয় এবং কোন জাতীয় নূতনত্ব Organic Evolution-এর প্রধান ভিত্তি, এ সম্বন্ধে ত্ৰিশ বছর পূর্বে পণ্ডিতেরা যতটা একমত ও নিঃসংশয় ছিলেন এখন আর তেমন নহেন। তখনও ডারউইনের প্রচারিত ব্যাখ্যাই সকলে মান্য করিতেন। ওই ব্যাখ্যা অনুসারে জনক জননীর সহিত সন্তানের যে-সব ছোটখাটো জন্মগত বিভিন্নতা প্ৰতিদিনই দেখা যায়, যাহার ফলে ছেলেটা বাপের মতো হইয়াও ঠিক তাহার মতো হয় না, সেই নিত্যসিদ্ধ নূতনত্বই ইভলিউশনের প্রধান সহায়। আর এক সহায, প্ৰত্যেক প্রাণীর জীবনকালের মধ্যে বাহিরের চাপে ও ভিতরের চেষ্টায় তাহার মধ্যে যে পরিবর্তন উপস্থিত হয়। কিন্তু ডারউইনের এই মতের আসন এখন টলিয়াছে। এখন পণ্ডিতেরা বলিতেছেন, যে নূতনত্বের উপর ভর করিয়া unicellular জীব মানুষে আসিয়া পৌঁছিয়াছে তাহা প্রতিদিনকার আটপৌরে নূতনত্ব নয়। প্রাণীর শরীরে মাঝে মাঝে অতি দুৰ্জেয় কারণে হঠাৎ এক-একটা বড় রকমের পরিবর্তন উপস্থিত হয়। যদি তাহাতে জীবনযুদ্ধের কোনও সহায়তা হয় তবে তো কথাই নাই, অন্ততপক্ষে যদি নিতান্ত বিপত্তিকর না হয় তাহা হইলেই ওই পরিবর্তনটি স্থায়ী হইয়া বংশানুক্ৰমে চলিতে থাকে। বর্তমানে অধিকাংশ প্ৰাণীতত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতেরই মত যে এই সকল হঠাৎ-উপস্থিত বড় রকমের নূতনত্বই Organic Evolution-এর প্রধান কারণ। প্রতি প্রাণীর জীবদ্দশায় বাহিরের প্রকৃতির 5८° ७3 ভিতরের শক্তির প্রয়োগে তাহার মধ্যে যে পরিবর্তন হয়। সে সম্বন্ধে পণ্ডিতেরা এখন বলিতেছেন যে, ওই-জাতীয় পরিবর্তন সন্তান-সন্ততিতে মোটেই সংক্ৰমিত হয় না। প্রাণীর শরীরে দুই রকমের মালমশলা আছে। এক শ্রেণির মালমশলায় তাহার শরীর গঠিত হয়, দ্বিতীয় রকমের মালমশলা বংশরক্ষার জন্য সঞ্চিত থাকে। বাহিরের চাপে বা ভিতরের চেষ্টায় যে পরিবর্তন তাহা ওই প্রথম শ্রেণির মালমশলাতেই আবদ্ধ থাকে, দ্বিতীয় শ্রেণির মালমশলা সম্পূর্ণ অবিকৃত থাকিয়া যায়। ফলে ওই স্বেপার্জিত পরিবর্তন সন্তান-সন্ততির নিকট পৌছে না। যখন দ্বিতীয় শ্রেণির মালমশলায় পরিবর্তন উপস্থিত হয়, সেই পরিবর্তনই বংশানুক্ৰমে চলে। এই পরিবর্তনের কারণ এখন পর্যন্তও একেবারেই অজ্ঞাত। এবং জীবশরীরে যে-সকল হঠাৎ বড় বড় পরিবর্তন উপস্থিত হইয়া Organic Evolution-G ধাপে ধাপে টানিয়া তুলিয়াছে তাহার কারণ এই দ্বিতীয় রকমের মালমশলায় পরিবর্তন।