‘ইনডাস্ট্রিয়্যালিজম’-এর এই পরিণতিতে ইউরোপের অনেক সমাজহিতৈষী ভাবুক স্বভাবতই উৎফুল্প হয়েছেন। তাঁরা বলছেন এখন যদি ধনীর লাভের লোভ ও বিলাসের দাবি কমানো যায়, এবং কাউকেও অলস থেকে পরের পরিশ্রমের ফলভোগ করতে না দিয়ে পরিশ্রমের ভার সকলের মধ্যে ভাগ করা যায়, তবে প্রত্যেক লোকের প্রতিদিন অল্প সময়ের পরিশ্রমেই সমাজের সকলের প্রয়োজন ও অল্পস্বল্প বিলাসের উপযোগী ধন উৎপন্ন হতে পারে। আর সভ্যতার যা শ্রেষ্ঠ ফল, সৃষ্টি-কৌশলীদের তার সৃষ্টির এবং অন্য সকলের তার রসগ্রহণের শিক্ষা, সুযোগ ও অবসরের ব্যবস্থা হয়। সভ্যতার ভারবাহী হতভাগ্যের দল সমাজ থেকে লোপ পায়।
বিনা আগুনে এই অন্নপাক কী করে সম্ভব হবে? উত্তর অতি সহজ, পরের আগুনের উপর পাকপাত্ৰ চাপিয়ে। ইনডাস্ট্রিয়্যাল-সমাজ চায় কৃষির পরিশ্রম ও তার আনুষঙ্গিক সমাজব্যবস্থার অসুবিধা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে। অথচ ইনডাস্ট্রিয়্যালিজমের আদি ও অন্ত চাষির পরিশ্রমের উপর নির্ভর করছে। তার শিল্পের উপাদানও জোগাবে কৃষি, বিনিময়ও জোগাবে কৃষি। সুতরাং ইনডাস্ট্রিয়্যাল’ সমাজ থেকে কৃষির পরিশ্রম দূর করার অর্থ–অন্য সমাজের উপর সেই পরিশ্রম দ্বিগুণ করে চাপানো, প্রতি সমাজে চাষির যে সমস্যা ছিল, কতকগুলি সমাজ থেকে তা সরিয়ে অন্য কতকগুলি সমাজের ঘাড়ে তুলে দেওয়া; পৃথিবীর প্রতি সভ্যদেশের একদল লোককে তার সভ্যতার ভারবাহী না করে, কতকগুলি সভ্যদেশের সভ্যতার ভার অন্য কতকগুলি দেশকে দিয়ে বহন করানো; যে ছল ও বল প্ৰত্যেক সভাসমাজের এক ভাগ লোক অন্য ভাগের উপর প্রয়োগ করত, সেই ছল ও বল আত্মীয়তার বাধা নিরপেক্ষ হয়ে মনুষ্যসমাজের একভাগের উপর প্রয়োগ করা।
যাযাবর মানুষের সঙ্গে স্থিতিশীল কৃষিসভ্যতার সংঘর্ষের কাহিনি মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে একটা বড় অধ্যায় জুড়ে রয়েছে। এই সংঘর্ষেই বোমান সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে, গুপ্ত সাম্রাজ্য ভেঙে পড়েছে, বোগদাদের মুসলিম সভ্যতার বিলোপ ঘটেছে। ইনডাস্ট্রিয়্যালিজম’ সেই সংঘর্ষেরই আর এক মূর্তি। চায্যের পরিশ্রম অস্বীকার করে এও চাষির পরিশ্রমের ফল লুটিতে চায়। যে ধন ও ধনী একে চালনা করছে, তাঁরাও মুখ্যত যাযাবর। এক দেশ থেকে অন্য দেশে, পৃথিবীর এক ভাগ থেকে অন্য ভাগে প্রয়োজনমতো চলে বেড়াতে তাদের কিছুতেই বাধা নেই। এবং এর হাতে বিনিময়েব বাটখাবা থাকলেও, অন্য হাতে যাযাবরের শাণিত অস্ত্ৰ বহাল রয়েছে।
সভ্যতার যা সমস্যা, ইনডাস্ট্রিয়্যালিজম’ তার মীমাংসা নয়; কাবণ ও ব্যবস্থা মানুষের সমাজকে এক করে দেখে না এবং দেখতে পারে না। মানুষের এক অংশকে ভাববাহীতে পরিণত না করে, সভ্যতাকে কেমন কবে বাচানো ও বাড়ানো যায়, সমস্ত মানবসমাজেৰে পক্ষ থেকে ‘ইনডাস্ট্রিীয্যালিজমের এর কোনও উত্তব নেই। মানুষের সভ্যতার চরম সমস্যা হচ্ছে চাষি। যেদিন চাষিকে সভ্যতার ভারবাহীমাত্র না রেখে ফলভোগী করা সম্ভব হবে, কেবল সেইদিন সভ্যতার সমস্যার যথার্থ মীমাংসা হবে। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে প্রমাণ হবে গ্রিক পাণ্ডিত্যের কথাই সত্য, দাসের শ্রম ভিন্ন সভ্যতার চাকা অচল।
ফাল্গুন ১৩৩২
ভারতবর্ষ
হালের ভারতবর্ষ নিয়ে আমাদের ইংরেজ সরকারের যে মুশকিল হয়েছে তার বিশগুণ বিপদে পড়েছি আমরা ভারতবাসীরা প্ৰাচীন ভারতবর্ষকে নিয়ে।
বর্তমান যাহোক অনেকটা চোখের সামনে রয়েছে। ওর ভিতরে কি আছে না আছে আশঙ্কা হলে সঙিন দিয়ে খুঁচিয়ে দেখা যায়; ওর ধড়ফড়ানি লাঠি পিঠে ঠান্ড করা চলে; ওর মুখরতার মুখ বন্ধের জন্য মােয়া লাড়ু, রাহা খরচ আছে। কিন্তু অতীতকে নিয়ে কী করা যায়। ওকে না যায় চোখে দেখা, না চলে চেপে ধরা। অথচ অবস্থার গতিকে এমনি দাঁড়িয়েছে যে, আজকার দিনে ভারতবর্ষের অতীত ছাড়া অন্য দিকে চোখ ফিরাতে গেলেই গালে চড় পড়ে; ওর বোঝার চাপে পিঠ বঁকা হওয়ার নামই মুক্তি নয়। এ বলার জোট নেই। কারণ আমরা দশে মিলে ভোটে প্রায় ঠিক করে ফেলেছি যে ভারতবর্ষের অতীতই তার বর্তমানের পথের আলো; ও-আলো আমাদের পেছন থেকে সামনে ছায়া না ফেলে কেবল আলোই ছড়াচ্ছে। আর এতেও আমাদের সন্দেহ নেই যে ওই অতীতকে পিঠে সোয়ার করতে পারলেই সে আমাদের সোজা গম্য অর্থাৎ কাম্য স্থানে পৌছে দেবে। জাতি যখন তার বর্তমানের হীনতা থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়, পঙ্গুতা পরিহার করে এগিয়ে চলার বল সংগ্রহ করে, তখন নিজের অতীত থেকে শক্তি লাভের চেষ্টা কিছু নূতন নয়। সামনে এগিয়ে চলাকে পিছনে ফিরে যাওয়া বলে কল্পনার মধ্যেও নূতনত্ব কিছু নেই। এ-সব ঘটনা মানুষের ইতিহাসে নানা জাতির মধ্যে বার বার ঘটেছে। এর কারণ কোনও সভ্যতার গতিই একটানা নয়। দৌড়ে বসে জেগে ঘুমিয়ে, উঠে পড়ে এমনি করেই সভ্যতা চলছেও চলবে। সেই জন্য কোনও আপাত-স্থবির জাতির মধ্যে যখন নব-জীবনের স্পন্দন আসে এক অর্থে সেটা তার পুনর্জন্ম। তার অতীতের যে-সব অংশে প্রাণের প্রাচুর্য ছিল তার সঙ্গে এর যোগ রয়েছে। নবজাগ্ৰত জাতির চোখের সম্মুখে প্ৰাণে ভরপুর ভবিষ্যতের যে ছবি থাকে প্রাণহীন বর্তমানের চেয়ে প্ৰাণবন্ত অতীতের সঙ্গে তার মিল ঢের বেশি। এই জন্য ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়াকে মনে হয়। অতীতের দিকে ফিরে চলা। কিন্তু মুখে যাই বলুক, জাতির অন্তরাত্মা যা’ চায় তা’ অতীতকে মকসো করতে নয়, নিজের প্রাণে অতীতের প্রাণের সেই স্পর্শ পেতে যার বেগে অতীত তার বর্তমানকে ছাড়িয়ে সম্মুখের দিকে এগিয়ে চলেছিল।