মোট কথা, ধনতন্ত্রের যেমন দুই দিক–ধনসৃষ্টি ও ধনবিভাগ; সভ্যতার ও তেমনি দুই দিক-সৃষ্টি ও বিভাগ। শরীর ও মনের যা পুষ্টি ও সম্পদ, তার সৃষ্টির কাজে নানা সভ্যতার মধ্যে বড় ছোট, ভালমন্দ ভেদ আছে; কিন্তু বিভাগের কাজে সব সভ্যতার এক চাল। সভ্যতার সৃষ্টির বড় ও শ্রেষ্ঠ অংশ ভাগ হয় অল্প ক’জনার মধ্যে, যা অবশিষ্ট তাই থাকে বাকি সকলের জন্যে, যদিও শ্রমের ভাগটা তাদেরই বেশি।
যে সভ্যতা নিজেকে আধুনিক বলে গর্ব করে, তার শ্রেষ্ঠত্বের প্রধান দাবি এই যে, বিভাগের এই উৎকট বৈষম্য সে ক্রমে কমিয়ে আনছে। জ্ঞান ও রসের সৃষ্টিকে অল্প ক’জনার জন্যে তুলে না রেখে, যার শক্তি আছে তারই আয়ত্তের মধ্যে এনে দেবার সেনানা পথ কেটে দিচ্ছে। শরীরের জন্য যে বস্তুসম্ভার, তাকে ভাগ্যবান ও বুদ্ধিমান এবং স্বল্পভাগ্য ও সাধারণ বুদ্ধি লোকের মধ্যে কেবল প্রয়োজনের মাপে বেঁটে দেওয়া সম্ভব না হলেও, সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য যা প্রয়োজন তা থেকে যাতে কেউ না বঞ্চিত হয়, সেদিকে তার চেষ্টার বিরাম সেই, এবং সাধারণ সুখস্বচ্ছন্দ্যের আদর্শকেও সে ক্রমে উচু দিকেই টেনে তুলছে। পূর্বে যা ধনীর বিলাস ছিল, তাকে সে অল্পবিত্তের নিত্য ব্যবহার্য করেছে। তার জন্যে ধনীর ব্যসনের আয়োজনও পরিমাণ কমাতে হয়নি, তা বরং বেড়েই চলেছে। তবুও যে এ কাজ সম্ভব হয়েছে, সে হচ্ছে বস্তুসৃষ্টির যে অভিনব কৌশল সে আবিষ্কার করেছে, তারই প্রয়োগে। এই কৌশলের বলে স্বল্পপরিসর স্থানের মধ্যে, অল্প লোকে, অতি সামান্য সময়ে প্রয়োজন ও বিলাসের যে বৃহৎ সামগ্ৰীসম্ভার উৎপন্ন করতে পারে, ইতিপূর্বে সমস্ত দেশব্যাপী লোকের বহুদিনের চেষ্টাতেও তা সম্ভব ছিল না। এই কৌশলের নাম ‘ইনডাস্ট্রিয়্যালিজম’।
আধুনিক ইনডাস্ট্রিয়্যাল’ সভ্যতার এই দাবি, তার জন্ম ও লীলাভূমি পশ্চিম ইউরোপে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলে সত্য বলেই স্বীকার করতে হবে। সেখানে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে এখনও যতই পার্থক্য থাকক, ধনিকের তুলনায় শ্রমিকের প্রয়োজন ও বিলাসের উপকরণের জোগান যতই নগণ্য হোক, এ কথা অস্বীকার করা চলে না যে, পূর্ব পূর্ব যুগের তুলনায় ইনডাস্ট্রিয়্যাল’ যুগের সভ্যতার ভারবাহীরা অনেক বেশি পরিমাণে সে-সভ্যতার ফলভোগী হয়েছে। এ সভ্যতার যাঁরা মাথায় রয়েছে, এ যে তাদের উদারতায় ঘটেছে তা নয়। যাঁরা ধনে ও বুদ্ধিতে প্রবল, তাঁরা নিজেদের লাভের লোভেই ‘ইনডাস্ট্রিয়্যালিজম’-এর গোড়াপত্তন করেছে। কিন্তু তার ফলে যে সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তাতে ভারবাহীদের দল বঁধবার সুযোগ ঘটেছে, এবং দলের চাপেই তাঁরা ও-ফল আদায় করেছে। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এর সম্ভাবনা ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। নূতন সৃষ্টিকৌশলে জোগানের পরিমাণ যদি না বেড়ে যেত, তবে ধনিকের ভাণ্ডার খালি না করে শ্রমিকের থলি ভরানো কিছুতেই চলত না।
কিন্তু ‘ইনডাস্ট্রিয়্যাল’ দেশগুলিতে দৃষ্টি আবদ্ধ না রেখে গোটা পৃথিবীর দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে, চাষিকে নিয়ে প্ৰাক-‘ইনডাস্ট্রিয়্যাল’ সভ্যতার যা সমস্যা, ‘ইনডাস্ট্রিয়্যালিজম’–তার কোনওই সমাধান করতে পারেনি; সমস্যাটিকে এক পা দূরে হটিয়ে রেখেছে মাত্র। পূর্ব যুগের সভ্যতা যে গোঁজামিল দিয়ে এর মীমাংসার চেষ্টা করত, ইনডাস্ট্রিয়্যাল’-সভ্যতা খুব ব্যাপকভাবে সেই গোঁজামিলই চালাতে চাচ্ছে।
সভ্যতার নিত্য সমস্যা হচ্ছে, জীবনের পুষ্টি ও আনন্দের যা উপকরণ আবিষ্কার হয়েছে, কী করে তা যথেষ্ট উৎপন্ন করে সমাজের মধ্যে এমন করে বেঁটে দেওয়া যায়, যাতে প্রয়োজনের পরিমাণ থেকে কেউ বাদ না পড়ে, অথচ উৎপাদনের কাজে বুদ্ধি ও পরিশ্রম নিয়োগের আকর্ষণেরও অভাব না হয়; আর প্রকৃতি যাদের নূতন সৃষ্টির ক্ষমতা দিয়ে জন্ম দিয়েছে, তাদের সেই শক্তিপ্রয়োগের শিক্ষা, সুযোগ ও অবসরের কী করে ব্যবস্থা করা যায়। এর একটির উপর নির্ভর করে সভ্যতার স্থিতি, অন্যটির উপর তার বৃদ্ধি। এ পর্যন্ত কোনও সভ্যতা এ সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। সভ্যতাকে বঁচিয়ে রাখার জন্য যে গুরুতর শারীরিক পরিশ্রমের প্রয়োজন, সব সভ্যতা তার বোঝা চাপিয়েছে সমাজের একটা অংশের উপর, যাতে বাকি অংশটা ওই পরিশ্রম থেকে মুক্ত হয়ে সভ্যতার ভোগ ও বৃদ্ধির যথেষ্ট উপকরণ ও অবসর পায়। সব সভ্যতার অস্তরেই এই ভয় যে, ওই পরিশ্রমের ভার সমাজের এক অংশের মাথা থেকে লাঘবের জন্য সকলের উপর ভাগ করে দিলে, সভ্যতা সমাজের সকলের পক্ষেই বোঝা হয়ে উঠবে। ওর ভোগের উপাদান কারও ভাগ্যে জুটবে না, ওর বৃদ্ধির সুযোগ ও অবসর কারও ঘটবে না। কাজেই সভ্যতার স্থিতি ও বৃদ্ধির জন্য বলে হোক, ছলে হোক, সমাজের একদল লোককে তার ভারবাহী করতেই হবে, এবং খুব সম্ভব সে-দল লোক হবে সংখ্যায় সবচেয়ে বড় দল।
‘ইনডাস্ট্রিয়্যাল’-যুগের পূর্ব পর্যন্ত প্রত্যেক সভ্যসমাজে সভ্যতার এই ভারবাহীর দল ছিল চাষি। কারণ কৃষিই ছিল প্রতি সমাজের জীবিকার মূল উৎস। ‘ইনডাস্ট্রিয়্যালিজম’ হঠাৎ আবিষ্কার করল যে, কৃষিকে বাদ দিয়ে এক নূতন ধরনের কারুশিল্পে সমাজের বুদ্ধি ও পরিশ্রম নিয়োগ করলে তার ফল ফলে বেশি। কৃষি জীবিকার যে উপকরণ উৎপন্ন করে, সমান পরিশ্রমে এতে তার অনেক গুণ বেশি পাওয়া যায়। পশ্চিম ইউরোপে এই ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত হলে দেখা গেল যে, এই সমাজব্যবস্থায় সভ্যতার ভারবাহীদেরও অনেক পরিমাণে তার ফলভোগী করা কৃষিসভ্যতার তুলনায় সহজসাধ্য। কারণ এতে যে অল্প সময়ের পরিশ্রমে অনেক বেশি ফল লাণ্ড হয় কেবল তাই নয়, এ ব্যবস্থায় কৃষির জন্য দেশের অধিকাংশ লোককে দেশময় বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে থাকতে হয় না, স্থানে স্থানে অল্প জায়গার মধ্যে তাদের সংঘবদ্ধ হতে হয়। অর্থাৎ দেশের অধিকাংশ লোক গ্রামবাসী না থেকে নগরবাসী হয়; এবং গ্রাম্য হল সভ্যতার বোঝাবাহী বর্বর, আর নাগরিক তার ফলভোগী বিদগ্ধজন। শহরের দলবদ্ধ লোকের শিক্ষা, দীক্ষা, স্বাস্থ্য ও মঙ্গলের জন্য যা সহজসাধ্য, সারা দেশে ছড়ানো চাষির জন্য সে ব্যবস্থা অতি দুঃসাধ্য।