কার্তিক ১৩৩২
—————-
(১) জুলাই মাসের The Visva Bharati Quarterly পত্রিকায় The Spirit of Hindu Law প্রবন্ধে এ কথা প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছি।
(২) মেধাতিথি, ৭/১
(৩) মেধাতিথি, ১/২
(৪) বিদন্ত্যনন্য প্রমাণবেদ্যং ধৰ্ম্মলক্ষণমৰ্থমস্মাদিতি বেদঃ। …যৎ পুরুষস্য কৰ্ত্তব্যং প্রত্যক্ষাদাবগম্য বিলক্ষণ স্বভাবেন। শ্ৰেয়ঃসাধনং কৃষিসেবাদি ভবতি পুরুষস্য কৰ্ত্তব্যত্বস্য চ তৎসাধনস্বভাবোহন্বয়ব্যতিরেকাভ্যামবগম্যতে। যাদৃশেন ব্যাপারেণ কৃষ্যাদেব্রীহ্যাদিসিদ্ধিঃ সাপি প্রত্যক্ষাদ্যবাগম্যৈব। যাগাদেন্তু সাধনাত্বং যেন চ রূপেণাপূৰ্ব্বোৎপত্তিব্যবধনাদিন তন্ন প্রত্যক্ষাদ্যাবগম্যম।… অয়ং ধৰ্ম্মে ব্ৰাহ্মণবাক্যোভ্যোহবিগম্যাতে লিঙাদিযুক্তেভ্যঃ, ক্বচিচ্চ মন্ত্রেভ্যোহপি। (মেধাতিথি–মনুভাষ্য, ২/৬
(৫) প্রমাণাস্তবমুলা হ্যত্র ধৰ্ম্মা উচ্চ্যন্তে ন সৰ্ব্বে বেদমুলাঃ।। (মেধাতিথি -মনুভাষ্য, ৭/১)
(৬) অন্যত্ৰাপি ব্যবহাবস্মৃত্যান্দেী যাত্র নায়মূলত তত্র যথাবসবং দর্শযিযামঃ। (মেধাতিথি, ২/৬)
চাষি
আমরা যাকে সভ্যতা বলি, তার ভিত খোঁড়া হয়েছে। লাঙলের ফলায়। মানুষ যে আদিতে অসভ্য যাযাবর ছিল, তার কারণ স্থিতিশীল সভ্য হয়ে তার প্রাণে বঁচবার উপায় ছিল না। অন্নের পশু ও পালিত পশুর অন্নের সন্ধানে তাকে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড পরিক্রম করতে হত। পরিচিত ভূভাগ স্বল্পপশু ও তৃণবিরল হয়ে উঠলে, অজ্ঞাত দেশের দিকে পা বাড়াতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা চলত না। কৃষির রহস্য আয়ত্ত করে তবেই মানুষ এ ভবঘুরে অস্থিরতার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। চাষের ক্ষেতকে কেন্দ্র করে তারই চারপাশে গ্রাম, নগর, স্বদেশ, স্বরাজ্য গড়ে উঠেছে। এইসব স্থায়ী আবাসে চাষের অন্নের কৃপায় মানুষের মন, শরীরের একান্ত দাসত্ব থেকে নিস্কৃতি পেয়ে, শিল্প ও সৌন্দৰ্য, ভাব ও জ্ঞানের বিচিত্র সৃষ্টিতে রত হয়েছে। তার কর্মকুশলতা অজস্রধারায় সহস্ৰ পথ কেটে চলেছে। এই সভ্যতার জন্মের সন তারিখ ঠিক জানা নেই। কিন্তু মানুষ যেদিন চাষের ক্ষেতের কারখানায় দ্যাবা-পৃথিবী থেকে অন্ন চুইয়ে নেবার সজীব কলের সৃষ্টিকৌশল আবিষ্কার করেছে সেই দিনই এর জন্মদিন।
মাটির চাষ সভ্যতাকে বহন করে এনেছে, কিন্তু সে সভ্যতা চাষিকে বহন করতে পারেনি। চাষি চিরদিনই সভ্যতার ভারবাহী মাত্র হয়ে আছে। সে হচ্ছে সভ্যতার মূল। মাটির নীচে থেকে রস টেনে সে সভ্যতার ফুল ফোটাবে, ফল ধরাবে, কিন্তু তার বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ সে কখনও জানবে না।
এর কারণ সভ্যতার জন্মকথার সঙ্গেই জড়ানো রয়েছে। মানুষের যাযাবর জীবন ছিল সাম্য ও স্বাধীনতার স্বৰ্গরাজ্য। জমিয়ে জমিয়ে অবাধে বাড়িয়ে তোলা যায়—-ধনের এমন আকার ছিল না বলে, ধনী ও নির্ধনের উৎকট প্ৰভেদ তখন সম্ভব ছিল না। সমাজের এক ভাগ অন্য সকলের পরিশ্রমের ফলের মোটা অংশ ভোগ করবে, এ ব্যবস্থার উপায় ও অবসর অতি সামান্য ছিল, এ জন্য সমাজের মধ্যে দাস-প্ৰভু সম্বন্ধ গড়ে উঠতে পারেনি। বহিঃপ্রকৃতির দাসত্ব সকলকেই এমন নিরবচ্ছিন্ন করতে হত যে, সে দাসের দলের এক ভাগের আর প্রভু হয়ে ওঠার সুযোগ ছিল না। চাষের জ্ঞানের ফলে মানুষ সে-স্বৰ্গরাজ্য থেকে চু্যত হয়েছে। মাটি যেদিন ধন হয়েছে, ও-স্বৰ্গরাজ্যও সেদিন মাটি হয়েছে। চাষের ফসলকে জীবনোপায় করার সঙ্গে সেই কৌশল মানুষের করায়ত্ত হয়েছে, যাতে একজন বহুজনকে অনাহারের ভয় দেখিয়ে বাধ্য করে খাটিয়ে নিতে পারে। আর তার ফল ক্ৰমে জমা করে সে ক্ষমতাকে ক্রমে বাড়িয়ে চলতে পারে। যাঁরা বলী ও কৌশলী, এ চেষ্টায় তাদের প্রলোভনও ছিল প্রচুর। যাযাবর জীবনে যাঁরা অভ্যস্ত, চাষের পরিশ্রম তাদের কাছে বিস্বাদ ও অতিমাত্রায় ক্লেশকর। ক্ষুধার তাড়নায় গুরু শ্রম, আর তার শাস্তিতে অখণ্ড আলস্য, এই ছিল যাযাবর জীবনযাত্রার সাধারণ ধারা। এর তুলনায় চাষির শ্রম কঠোরতায় লঘু, কিন্তু সে শ্রম প্ৰতিদিনের নিয়মিত পরিশ্রম, অনভ্যাস্তের কাছে যা সবচেয়ে পীড়াকর। সে পরিশ্রম করতে হয়। বর্তমানের ক্ষুধার তাড়নায় নয়, ভবিষ্যতের অনাহারের আশঙ্কায়। কারণ সে পরিশ্রমে বর্তমানের ক্ষুধানিবৃত্তির কোনও সম্ভাবনা নেই। কিছুই আশ্চর্য নয় যে, এই চিরফলপ্ৰসূ, নিয়ত পরিশ্রমের গুরুভার বলবান ও বুদ্ধিমান লোকেরা চিরদিনই দুর্বল ও হীনবুদ্ধিদের কাঁধেই চাপিয়ে এসেছে।
সভ্যতার ইতিহাসের প্রতি অধ্যায়ে এই উদাহরণ ছড়ানো রয়েছে। সভ্য গ্রিসের রাজ্যগুলিতে চাষি ছিল ক্রীতদাস, আর এ ব্যবস্থা ভিন্ন সভ্যতা কী করে টিকে থাকতে পারে, গ্রিক পণ্ডিতেরা তা ভেবে পাননি। রোমান সভ্যতা সাম্রাজ্যের পথে পা দিতেই হাতের লাঙল তুলে দিয়েছিল দাসদের হাতে। ইউরোপের মধ্যযুগে ও রুশিয়াতে সেদিন পর্যন্ত চাষি ছিল নামে ও কাজে দাসেরই রূপান্তর। হিন্দুর শাস্ত্ৰে চাষের কাজ বৈশ্যের, অর্থাৎ আর্যের— যার বেদে অর্থাৎ বিদ্যায় অধিকার আছে। শাস্ত্রের কথা শাস্ত্রের পুথিতেই লেখা আছে, কিন্তু সুদূর অতীত থেকে চাষের লাঙল ঠেলছে। শূদ্রে, যে শূদ্ৰকে ‘দাস্যায়ৈব হি সৃষ্টোহসৌ ব্ৰাহ্মণস্য স্বয়ংভুবা’— স্বয়ম্বু সৃষ্টিকর্তা দাসত্বের জন্যই সৃষ্টি করেছেন।