এই ভেদ সম্বন্ধে ধর্মশাস্ত্রকারদের ‘থিয়োরি’ সংক্ষেপে এই— মানুষের যা সব কর্তব্য, তার দুটো ভাগ। একভাগ বেদমূল, অন্যভাগ ন্যায়মূল। যে কর্তব্যের মূল বেদ, তা অন্য কোনও প্রমাণে জানা যায় না। বেদের বাক্যই তা জানার একমাত্র উপায়। স্মৃতি বা সদাচার থেকে যে এরকম কর্তব্য জানা যায়, তারও মূল বেদ, কারণ স্মৃতির বচন থেকে বা সাধুদের আচার দেখে সেইরূপ বেদবাক্যের বা বিধির অনুমান করা যায়। কিন্তু মানুষের যে-সব কর্তব্য প্রত্যক্ষ বা অনুমান প্রভৃতি লৌকিক প্রমাণে জানা যায়, যে-সব কর্তব্য বেদমূল নয়, ন্যায়মূল। সেখানে বেদের প্রসার নেই, কারণ তাঁরা বেদের বিষয় নয়। মনুর ভাষ্যকার মেধাতিথি বলছেন—‘ধৰ্ম নামে মানুষের যে পুরুষাৰ্থ অন্য কোনও প্রমাণ থেকে জানা যায না, তাদের জানিয়ে দেয় বলেই বেদের নাম বেদ। এই ধর্ম শ্ৰেয়ঃসাধন করে বলেই মানুষের কর্তব্য, কিন্তু কেমন করে যে সে শ্ৰেয়ঃসাধন করে, তা প্রত্যক্ষ কি অনুমান কোনও লৌকিক প্রমাণেই জানা যায় না। আরও সব কাজ আছে যা শ্ৰেয়ঃসাধন করে বলে মানুষের কর্তব্য, যেমন কৃষি৷ কৃষি যে কেমন করে মানুষের শ্রেয়ঃসাধন করে, তা সাধারণ অন্বয়ব্যতিরেক প্রমাণেই (induction by agreement and difference) জানা যায়। এবং কেমন করে কৃষিসাধন করলে যে ফসল পাওয়া যাবে, তাও প্রত্যক্ষ ও অনুমানেই জানা যায়। কিন্তু যাগযজ্ঞ কেমন করে সাধন করতে হবে, এবং তার সাধনফলে পরকালে কী করে যজমানের সুখ কি স্বৰ্গলাভ হবে, সে জ্ঞান প্রত্যক্ষ কি অনুমান কোনও লৌকিক জ্ঞানের প্রণালী দিয়েই পাওয়া যায় না। এ ধর্ম কেবল জানা যায় বেদের ব্রাহ্মণ অংশের বিধিবাক্য থেকে, এবং কচিৎ মন্ত্র অংশ থেকে।(৪)
এই থিয়োরি’ অনুসারে ধর্মশাস্ত্রকারেরা বলেছেন, রাজধৰ্ম বা ‘পলিটিকস’ বেদমূল নয়, ন্যায়মূল।(৫)’ আইন বা ব্যবহার স্মৃতি, তাও বেদমূল নয়—ন্যায়মূল্য।(৫) পশ্চিমের পণ্ডিতেরা যদি অন্য কথা বলেন, এবং আমরা যদি সেই কথাকে আমাদের পূর্বপুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বলে চালাই, তার দায়ী প্রাচীন হিন্দু নয়।
প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রকারদের এই ‘থিয়োরিতে অনেক নবীন হিন্দু খুব সম্ভব বোজার হবেন। কারণ এ ‘থিয়োরিতে হিন্দুধর্মের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, এবং বিজ্ঞানের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা, এ দুয়েরই পথ বন্ধ। শাস্ত্রকারেরা বলেন, যা অলৌকিক তা লৌকিক যুক্তি ও বিচার দিয়ে বুঝবার চেষ্টা পণ্ডশ্ৰম; আর যা লৌকিক, তা লৌকিক যুক্তি বিচারেই বুঝতে হবে, তার মধ্যে অলৌকিককে টেনে আনা মূর্থিতা। কিন্তু হিন্দুধর্মের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হল অলৌকিককে লৌকিক দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা; আর বিজ্ঞানের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা হল লৌকিকের মধ্যে অলৌকিককে এনে ফেলা। হিন্দুধর্মের কোনও অংশের যদি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকে, তবে ধর্মশাস্ত্রকারদের ‘থিয়োরি’ মতে সে অংশটা বেদমূল ধৰ্ম অর্থাৎ ‘রিলিজিয়ন’ নয়, ন্যায়মূল লৌকিক কর্তব্য মাত্র। তার ভালমন্দ যুক্তি দিয়ে বিচার করতে হবে, কারণ শাস্ত্রবাক্যের সেখানে প্রসার নেই। অর্থাৎ প্রত্যুষে ফুলতোলা ও একাদশীতে উপবাস যদি স্বাস্থ্যের জন্য হয়, তবে তার ব্যবস্থা নিতে হবে ভট্টচায্যের কাছে নয়, কবিরাজের কাছে। এবং এতে যার স্বাস্থ্য ভাল না। থাকে, তার পক্ষে এ সব কর্তব্য নয়; এ নিয়ে শাস্ত্রের বচন তুলে ধর্মের দোহাই দেওয়া বৃথা। আর যাগযজ্ঞে মানুষের মঙ্গল হয়, শাস্ত্রের বচনে যদি এতে বিশ্বাস জন্মে— ভাল কথা। যদি না হয় তো ফুরিয়ে গেল। লৌকিক যুক্তি তর্ক দিয়ে তা আর প্রমাণ করা যাবে না।
যে মনোভাবের বশে ধর্মশাস্ত্রকারেরা অলৌকিককে লৌকিক থেকে একেবারে পৃথক করে দেখেছিলেন, সে ‘র্যাশন্যালিজম’ বা যুক্তিতন্ত্রতা প্রাচীন আৰ্যমনোভাবের একটা প্রধান লক্ষণ। যা চোখ মেললে স্পষ্ট দেখা যায়, চোখ অর্ধেক বুজে তাকে ঝাপসা করে দেখা তাদের স্বভাববিরুদ্ধ ছিল। যেটা যুক্তি ও বিচারের ক্ষেত্র, তাকে আধ্যাত্মিকতার মোহ, কি হৃদয়াবেগের কুয়াশার মধ্য দিয়ে তাঁরা দেখতে রাজি ছিলেন না; বৃদ্ধির উজ্জ্বল সূৰ্যালোক সেখানে ছিল তাদের একমাত্ৰ কাম্য। ধর্মশাস্ত্রকার ও তার টীকাকারদের লেখার প্রতি পাতায় এই র্যাশনালিজম’-এর পরিচয় রয়েছে। যা বিচার ও যুক্তির ব্যাপার, সেখানে যুক্তি ও বিচার যেখানে নিয়ে যাবে সেখানে পৌঁছতে তাদের বিন্দুমাত্র ভয় কি দ্বিধা ছিল না। বিচার-বিতর্ক আমরাও কিছু কম করিনে। কিন্তু তর্কে হেরে কে কবে নিজের ধর্ম ছেড়ে প্রতিবাদীর ধর্ম নিয়েছি, নিজের মতকে প্রকাশ্যে মিথ্যা স্বীকার করে প্রতিদ্বন্দ্বীর শিষ্য হয়েছি? বরং এ কাজ যে করে, তাকে বলি কাণ্ডজ্ঞানহীন। কিন্তু প্ৰাচীন হিন্দুর পণ্ডিতসমাজে এ ঘটনা যে নিত্য ঘটত, জনশ্রুতি তার সাক্ষী দিচ্ছে। প্রাচীন আর্যেরা যুক্তিকে কেবল মুখে নয়, জীবনে স্বীকার করতেন।
কিন্তু যুক্তিতন্ত্ৰতা ধর্মশাস্ত্রের প্রধান কথা নয়। আৰ্য-মন-যুক্তিতন্ত্রী বলে ধর্মশাস্ত্রেও তার ছাপ লেগেছে। ধর্মশাস্ত্র হচ্ছে গঠন ও শাসনের শাস্ত্র। এখানে যে মনোভাবের মুখ্য পরিচয়, সে হচ্ছে শিল্পী ও শাসকের, organiser ও administrator-এর মনোভাব। ধর্মশাস্ত্রকারদের চোখের সামনে ব্যক্তি ও সমাজের একটি স্পষ্ট ও পূর্ণ আদর্শমূর্তি ছিল। তঁহাদের বিধিব্যবস্থার লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তি ও সমাজকে ঠিক সেই আদর্শের মতো মূর্তি দিয়ে গড়ে তোলা। এবং এ কাজে তাদের সাহসের অন্ত ছিল না। মানুষের জীবনকে তাঁরা মনে করতেন শিল্পীর মূর্তিগড়ার উপাদান। সহস্ৰ বিধিনিষেধের অস্ত্ৰে কেটে যে একে মনের আদর্শমূর্তির সঙ্গে সূক্ষ্মানুসূক্ষ্মভাবে মিলিয়ে দেওয়া যায়, তাতে তাদের সন্দেহ ছিল না। এবং ব্যক্তি ও সমাজের জীবনের কোনও অংশ অনিয়ন্ত্রিত অর্থাৎ অগঠিত থাকবে, তাদের মন ছিল এ মনোভাবের বিরুদ্ধ। এ বিষয়ে প্রাচীন আৰ্য-মন ছিল যাকে এখন আমরা বলি। ‘বুরোক্র্যাটিক’ মন। ধর্মশাস্ত্রকারদের চেষ্টার ফলে প্রাচীন হিন্দুসভ্যতার হিত হয়েছে বেশি, না অহিত হয়েছে বেশি, এ অবশ্য তর্কের কথা। মানুষের জীবনকে কতটা হাতে গড়ে তোলা যায়, আর প্রাণবন্ত বলে কতটা ছাড়া রাখলে তবে সে নিজে গড়ে ওঠে–এ বিচারের হয়তো কোনও চরম মীমাংসা নেই। বাঁধনের বাধায়, ক্লিষ্ট হয়ে একবার সে চাবে মুক্তি, আবার ছন্দহীন মুক্তিতে হাঁপিয়ে উঠে খুঁজবে নতুন বন্ধন। সে যাহোক, জীবনের প্রাণপন্থা ও শিল্পপস্থার বিচারে প্রাচীন অর্যেরা ছিলেন শিল্পপহী। যাঁরা সাধারণ মানুষের মধ্যে অসাধারণ, তাঁরা যে বিধিনিষেধের এত শাসন মানবে না, ধর্মশাস্ত্রকারদের তা অজ্ঞাত ছিল না। প্রাচীন আচাৰ্য গৌতম বলেছেন, ‘দৃষ্টো ধৰ্ম্ম-ব্যতিক্রমঃ সাহসঞ্চ মহতাম, যাঁরা মহৎ তাদের সাহস আছে, তাঁরা ধর্মবিধিকে অতিক্রম করে থাকেন। কিন্তু বুদ্ধি ও মনে যাঁরা মধ্যবিত্ত, বিধিনিষেধ অতিক্রম করে চলার অধিকার তাদের দিতে ধর্মশাস্ত্রকারদের সাহস ছিল না। প্রাচীন হিন্দুরা ব্যাকরণের জটিল বন্ধনে ভাষাকে বেঁধেছিলেন। ঋষিদের বাক্য এ জটিলতাকে মানবে না, মহাকবিরা যে এ বন্ধন ছাড়িয়ে যাবেন, তা তাঁরা জানতেন। কিন্তু যাঁরা ঋষিও নয়, কবিও নয়, তাদের স্বেচ্ছাচারকে তাঁরা অত্যাচার বলেই মনে করতেন।