গল্প আছে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস নবপ্রতিষ্ঠিত রয়্যাল সোসাইটির মুরুকিব হয়ে তার সভ্যদের প্রশ্ন করেছিলেন–বাঁচা মাছের চেয়ে মরা মাছ ওজনে ভারী কেন? সমিতির পণ্ডিতেরা ভেবে চিন্তে নানা জনে নানা কারণ দর্শালেন, কিন্তু কোনও ব্যাখ্যাই সকলের তেমন মনঃপূত হল না। শেষে একজন পণ্ডিত একটা বাঁচা মাছ এনে ওজন করে, মেরে তাকে আবার ওজন করলেন; ওজন বেশি দেখা গেল না। প্রাচীন হিন্দুকে নিয়ে পশ্চিমের পণ্ডিতের সঙ্গে নবাহিন্দুর যে বিচার বিতর্ক, সেও এই ধরনের। প্রাচীন হিন্দুসভ্যতা সম্বন্ধে পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা যে-সব তথ্য প্রচার করেন, সেগুলি সত্য কি মিথ্যা, তা পরখ করে দেখা আমরা দরকার মনে করিনে। মনে মনে বিশ্বাস আছে, এ সম্বন্ধে তাদের বাক্য আপ্তবাক্য। আমরা বুদ্ধি খাটিয়ে সেই সব তথ্য থেকেই নানা তত্ত্ব বের করি, এবং তার বলে প্রমাণ করি, যে-সব কারণে তাঁরা হিন্দুসভ্যতাকে বলেন খাটো, ঠিক সেই কারণেই হিন্দুসভ্যতা সবচেয়ে উচু। তাঁরা বলেন প্রাচীন হিন্দু যে ধর্ম থেকে আইনকে তফাত করতে পারেনি, তাতেই প্রমাণ এ বিষয়ে তাদের সভ্যতা আদিম অবস্থা ছাড়িয়ে বড় বেশি দূর এগুতে পারেনি; কারণ সভ্যতার প্রথম অবস্থায় ও-দুই জিনিস একসঙ্গেই মিশে থাকে, সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে মানুষ ক্রমে তাদের পৃথক করে নেয়। আমরা বলি প্রাচীন হিন্দুরা যে ধর্ম থেকে আইনকে তফাত করেনি, তাতেই প্ৰমাণ এ বিষয়ে তাঁরা সভ্যতার একেবারে শেষ সীমায় পৌঁছেছিলেন; কারণ সভ্যতার চরম অবস্থায় মানুষ আইনের ধারা মানবে ধর্মবুদ্ধিতে, ‘ল’ যাবে মর্যালিটিতে মিশে। এখন যদি প্রমাণ হয় যে, প্রাচীন হিন্দুরা ধর্ম ও আইন মোটেই মিশিয়ে ফেলেনি, ওদু’জিনিসকে খুবই তফাত করে দেখেছে, এমনকী, এত তফাত করে যে বিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের আইনেও ধর্ম ও আইনের তফাত তত বেশি নয়,(১) তবে মুশকিল হয় এই যে, তাতে কেবল পাশ্চাত্য পণ্ডিতের পাণ্ডিত্য আঘাত পায় না, নব্যহিন্দুর হিন্দুয়ানিতেও ঘা লাগে।
হিন্দুর আইন যে হিন্দুর ধর্ম থেকে পৃথক ছিল না, আর দন্তধাবন ও সত্যভাষণ দুই-ই যে তার ধর্ম— পাশ্চাত্য পণ্ডিত ও নব্যহিন্দুর এই বিশ্বাসের মূল একটি প্রত্যক্ষ-প্রমাণ। সে প্রমাণ হচ্ছে, প্রাচীন হিন্দু একই শাস্ত্ৰে আইন, দস্তধাবন ও সত্যভাষণের ব্যবস্থা দিয়েছে; এবং সে শাস্ত্রের নাম ধর্মশাস্ত্ৰ। হিন্দুর ধর্মশাস্ত্রে যা আছে তাই যে হিন্দুর ধর্ম, এতে আর কথা চলে না। এবং গর্ভাধান থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের এমন কোনও অবস্থা নেই, যার ব্যবস্থা ধর্মশাস্ত্রে নেই। সুতরাং হিন্দুর জীবনের প্রতি কাজ যে ধর্ম এতে আর সন্দেহ কী। তাই বঙ্কিমবাবু অনেক আগেই বলেছেন হিন্দুর ‘ধর্ম’ খ্রিস্টানের রিলিজিয়ন’ নয়। হিন্দুর ধর্ম বড় ব্যাপক জিনিস। এবং তিনি সিদ্ধান্ত করেছেন ‘ধৰ্ম’ মানে কালচার’ অর্থাৎ হিন্দুধৰ্ম মানে ‘হিন্দু কালচার’। কিন্তু ‘ধর্ম’ কথাটা রিলিজিয়ন’-এর প্রতিশব্দ নয়, ‘কালচার’-এর প্রতিশব্দ, এই আভিধানিক তথ্য নিয়ে তো হিন্দু-সভ্যতার ভালমন্দ বিচারের কোনও তর্ক ওঠে না। তর্ক যে উঠেছে তার কারণ, এ কথার মধ্যে একটু ইঙ্গিত আছে; এর অভিধা ছাড়িয়ে একটা ব্যঞ্জনা রয়েছে। হিন্দুর ‘ধর্ম’ ‘রিলিজিয়ন’ নয়, ‘কালচার’; কিন্তু তার সমস্ত কালচারটািই তার ‘রিলিজিয়ন’। অর্থাৎ খ্রিস্টানের গির্জায় গিয়ে হাঁটুগাড়ার সঙ্গে যে মনোভাব রয়েছে, হিন্দুর শৌচাচারের সঙ্গে সেই মনোভাবেরই যোগ রয়েছে। হিন্দুর রিলিজিয়াস’ ও ‘সেকুলার’-এর মধ্যে ভেদ নেই, কারণ সমস্ত সাংসারিক কাজও তাকে করতে হবে ‘রিলিজিয়াস’ মনোভাব নিয়ে। হিন্দু-সভ্যতার যদি এই আদর্শ হয়, তবে সেটা ভাল কি মন্দ তা নিশ্চয়ই তর্কের বিষয়।
কিন্তু কথাটা একেবারেই মিথ্যা। প্রাচীন হিন্দু ‘সেকুলার’ ও রিলিজিয়াস’ ঐহিক ও পারিত্রিক–এর মধ্যে প্রভেদ করেনি, এ তথ্য সম্পূর্ণ অমূলক, টীকাকারদের ভাষায় শশবিষাণের মতো অলীক’ ও দুয়ের মধ্যে যে ভেদের গণ্ডি তাঁরা টেনেছেন তা গভীর, যে প্রাচীর তুলেছেন তা দুর্লঙ্ঘ্য। আমাদের নব্যহিন্দুদের যদি তা চোখে না পড়ে, সে আমরা চোখ বুজে আছি বলে। এবং চোখ চেয়ে দেখলে হয়তো বা মনঃক্ষুন্ন হব।
ধৰ্মশান্ত্রে ‘ধর্ম’ কথার অর্থ কী, এ আমাদের মাথা ঘামিয়ে বের করতে হবে না। ধর্মশাস্ত্রের প্রাচীন ভাষ্য ও টীকাকারেরা তা খোলাখুলিই বলে গেছেন। তাঁরা বলেছেন, ‘ধৰ্ম শব্দঃ কৰ্ত্তব্যতাবাচনঃ’(২), যা কর্তব্য, ‘ধর্ম’ শব্দ তারই বাচক। ‘ধর্ম শব্দঃ কৰ্ত্তব্যাকৰ্ত্তব্যয়োবিধি প্ৰতিষেধয়োঃ…দুষ্টপ্রয়োগঃ’(৩) যা কর্তব্য এবং যা অকর্তব্য তার বিধি ও তার নিষেধ অর্থেই ‘ধর্ম’ শব্দের প্রয়োগ হয়। অর্থাৎ ধর্ম মানে কর্তব্য। মানুষের যত কিছু কর্তব্য— পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক, ব্যক্তিগত ও রিলিজিয়াস’–এ সকলের সাধারণ নাম ‘ধৰ্ম’। এ সব বিভিন্ন কর্তব্যের যে এক নাম, এবং এক শাস্ত্ৰে যে তাদের ব্যবস্থা, তার কারণ, ভিন্ন হলেও একই মানুষের ব্যক্তিত্বের অদ্বয় যোগ-সূত্রে তাঁরা একসঙ্গে বাধা আছে। এ-সব কর্তব্যই একই মানুষের নানা সম্বন্ধ ও নানা সম্পর্কের কর্তব্য। কিন্তু যেমন তাদের ঐক্য আছে, তেমনি ভেদও আছে। সব কর্তব্যের মূল এক নয়, প্রমাণ এক নয়। সব কর্তব্যই রিলিজিয়াস’ নয়, কারণ ‘রিলিজিয়াস’ কর্তব্য নানারকম কর্তব্যের মধ্যে একরকমের কর্তব্য মাত্র।