‘গৃহস্থস্তু যদা পশ্যেদ্বলীপালিতমাত্মনঃ।
অপত্যস্যৈব চাপত্যং তদারণ্যং সমাশ্রয়েৎ ।৷’ (মনুঃ, ৬/২)
‘গৃহস্থ যখন দেখবে গায়ের চামড়া শিথিল হয়ে আসছে, চুলে পাক ধরেছে, ও পুত্রের পুত্র জন্মেছে, অর্থাৎ বার্ধক্যের অপটু শরীরে গৃহের ছোটখাটো সুখস্বাচ্ছন্দ্য, পুত্র পৌত্রের সেবা ও শ্রদ্ধা সবচেয়ে কাম্য হয়ে এসেছে, তখন ঘর ছেড়ে বনে প্রস্থান করবে।’ হতে পারে সে বন খুব বন্য ছিল না। কিন্তু পুরাতন প্রিয় গৃহ ও সমাজের সঙ্গে সমস্তরকম সম্বন্ধচ্ছেদের নির্মমতাতেই তা ভীষণ।
‘ন ফালকৃষ্টমশ্ৰীয়াদুৎসৃষ্টমপি কেনচিৎ।
ন গ্রামজাতন্যাৰ্ত্তোহপি মুলানি চ ফলানি চ ৷।’ (মনুঃ, ৬/১৬)
‘ভূমিকৰ্ষণে যা জন্মেছে, পড়ে পেলেও তা আহার করবে না। আর্ত হলেও গ্রামজাত ফলমূল গ্ৰহণ করবে না।’ এই বনবাসে উগ্ৰ তপস্যায় নিজের দেহ শোষণ করাই ছিল বিধি।
‘তপশ্চরংশ্চোগ্রতরাং শোষয়েদেহমাত্মনঃ।।’ (মনুঃ, ৬/২৪)
কিন্তু মৃত্যুকে অভিনন্দন করে এ জীবনেরও সংক্ষেপ কামনা করা নিষিদ্ধ ছিল।
‘নাভিনন্দেত মরণং নাভিনন্দেত জীবিতম্।
কালমেব প্রতীক্ষেত নির্দেশং ভৃতকো যথা ।।’ (মনুঃ, ৬/৪৫)
‘মরণকেও কামনা করবে না, জীবনকেও কামনা করবে না। ভৃত্য যেমন ভৃতিপরিশোধের অপেক্ষা করে, তেমনি কালের অপেক্ষা করবে।’
বানপ্রস্থের উপর শ্ৰীযুক্ত প্রমথ চৌধুরী মহাশয়ের কতটা অনুরাগ আছে জানিনে, কিন্তু মনের যে বীৰ্য নিজের বার্ধক্যদশার জন্য এই বানপ্রস্থের বিধান করেছিল, সেই বীর্য তার মনকে মুগ্ধ করেছে। তিনি আধুনিক হিন্দুর মনে প্রাচীন আৰ্যমনের এই বীৰ্য ফিরিয়ে আনতে চান। এবং বর্তমানের মধ্যে অতীতকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা যদি reactionary হয়, তবে চৌধুরী মহাশয়কেও reactionary বলতে হবে।
হিন্দুমনের কাঠিন্য ও বীৰ্য কালবশে কমে আসছিল, এবং মুসলমান-বিজয়ের পর থেকে কমার বেগ ক্ৰমে দ্রুত হয়ে এখন প্ৰায় লোপের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। মনের একটা কোমলতা, গুটিকয়েক রসে আবিষ্টতা ও ভাবে বিহ্বলতা, তার খালি জায়গা অনেকটা জুড়ে বসেছে। হিন্দুর সচল মন নিশ্চেষ্ট থাকেনি। এই নতুন মনোভাবের উপযোগী ধর্মসাপনা, কাব্য ও দর্শন গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে এর সাধক শ্রীচৈতন্য, কবি চণ্ডীদাস, দার্শনিক শ্ৰীজীব গোস্বামী। প্রমথবাবু যদি সবুজপত্রে’ প্রাচীন হিন্দুয়ানি প্রচারও করতে চান, তবে এই নবীন হিন্দুয়ানির সঙ্গে তাঁকে লড়তে হবে। কারণ ‘পুরুষ ব্যাঘ বনাম মানুষ মেষ’-এর মামলায় তিনি যে বেদখল বাদীর পক্ষে সরাসরি একতরফা ডিক্রি পাবেন, এমন মনে হয় না। প্ৰথম তো তামাদি দোষ কাটাতে বেগ পেতে হবে। তারপর সভ্যতার ইতিহাসে বাঘের চেয়ে মেষ হয়তো সভ্যতার জীব। এবং ‘দাসমনোভাবের চেয়ে যে, ‘প্ৰভুমনোভাব’ শ্রেষ্ঠ, তাও বিচার সাপেক্ষ। যাহোক, এ-তর্ক যদি প্রমথবাবু সত্য সত্যই তুলতে পারেন, তবে বাংলাসাহিত্যে শাক্ত-বৈষ্ণবের দ্বন্দ্বের একটা নতুন সংস্করণ অভিনয় হবে। কারণ অসম্ভব নয় যে, বাংলার তান্ত্রিক সাধনার মধ্যে প্রাচীন হিন্দুর কতকটা কাঠিন্য ও বীর্য বিকট ছদ্মবেশে লুকানো আছে।
কিন্তু গৌড়ীয় বৈষ্ণবত্বই প্রমথবাবুর একমাত্র প্রতিমাল্ল হবে না। বাঙালির ইংরাজি-শিক্ষিত মন আজকার দিনে অনেক রকম সমন্বয়’ সাধন করেছে। বৈষ্ণব আচার্যেরা যে রসতত্ত্ব প্রচার করেছিলেন, সে রস ইক্ষুরস। সাংসারিক ভোগসুখ, গাৰ্হস্থ্য ও সামাজিক জীবন সমস্ত পিষে ফেলে তবে সে রস নিঙড়ে নিতে হয়। কিন্তু আমাদের ইংরেজি শিক্ষায় ‘একলেকটিক’ মন ইউরোপীয় বৈশ্যত্বের সঙ্গেও রসাতত্ত্বের সমন্বয় ঘটিয়েছে। অফিস, আদালত, শেয়ার মার্কেট, খবরের কাগজ, এ সব বাহাল রেখেই আমরা ও-রস ভোগ করছি। অর্থাৎ ও-রস এখন আর ইক্ষুদণ্ডে বন্ধ নেই, পেটেন্ট করে বোতলে পোরা হয়েছে। দিনের কাজের শেষে, কি ছুটির দিনে, খুব সুখে ও সহজে ওকে ঢেলে সম্ভোগ করা চলে। প্রাচীন হিন্দুর পক্ষ নিলে এ সমন্বয়ের সঙ্গে প্রমথবাবুকে যুদ্ধ করতে হবে। এবং ধর্মশাস্ত্রকারেরা বর্ণসংকরের বিরুদ্ধ হলেও আধুনিক বিজ্ঞান নাকি তার সপক্ষ। সুতরাং এ যুদ্ধ জেতাও সহজ হবে না। মোট কথা প্রাচীন হিন্দুয়ানির যুদ্ধে লড়তে হলে, প্রাচীন হিন্দুমনের কাঠিন্য ও বীর্যের প্রয়োজন হবে। শ্ৰীযুক্ত প্রমথ চৌধুরীর মনে ও-গুণ আছে বলেই জানি। সুতরাং তিনি এতে সাহসী হলেও হতে পারেন।
ভাদ্র ১৩৩২
———————-
(১) বাৰ্ত্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি বার্তম্পত্যাঃ, সংবরণ মাত্ৰং হি ঐয়ী লোকযাত্ৰাবিদ ইতি।’ (কৌটিল্য, ১/২)
(২) শূদ্ৰস্য দ্বিজাতি শুশ্ৰষা বাৰ্ত্তী কারুকুশীলবকৰ্ম্ম চ’-(কৌটিল্য, ১/৩)
ধর্ম-শাস্ত্ৰ
পশ্চিমের পণ্ডিতেরা বলেন প্রাচীন হিন্দুর বুদ্ধিটা ছিল ঘোলাটে। যে-সব জিনিস পরস্পর থেকে অতি স্পষ্ট তফাত, এরা তাদেরও ঘুলিয়ে এক করে ফেলেছে। যেমন ধর্ম আর আইন। এর একের সঙ্গে অন্যের কিছু সম্পর্ক নেই। এর একটি হল ইহলোকের, অন্যটি পরকালের। একটির স্থান ধর্মমন্দির, অন্যটির আদালত। একটির কর্মকর্তা পুরোহিত, ধর্মযাজক, অন্যটির জজ কৌঁসুলি। অথচ প্রাচীন হিন্দু বলে, তার আইন তার ধর্মেরই অঙ্গ। তার আদালত হচ্ছে ধর্মাধিকরণ, তার জজ-জুরি হল ধর্মপ্রবক্তা। উত্তরে আমরা নব্যহিন্দুরা বলি–ওই তো ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের বিশেষত্ব। ওইখানেই হিন্দুর হিন্দুয়ানি। অন্য সব জাতির স্বৰ্গ ও মর্ত্য, ধর্ম ও সংসারের মধ্যে ভেদ আছে—কিন্তু হিন্দুর নেই। হিন্দুর যা ‘অমূত্র’ তাই ‘ইহ’। তার সংসারযাত্রার প্রতি খুঁটিনাটি ধর্মশাসিত। দাঁতমােজা থেকে ব্ৰহ্মধ্যান, সবই তাব ধৰ্মাচরণ। হিন্দু ধৰ্মৈকপ্ৰাণ, ধর্মসর্বস্ব।