এতে আশ্চর্য কিছু নেই, বিশেষত্বও কিছু নেই। যে-কোনও বড় সভ্যতার মধ্যেই এই বিরোধ ও ভেদ দেখতে পাওয়া যাবে। সভ্যতা হল মনের স্বচ্ছন্দ লীলার সৃষ্টি। বহু মনের লীলাভঙ্গি বিচিত্র না হয়ে যদি সৈন্যের কুচের মতো একেবারে একতন্ত্র হত, তবে সেইটেই হত অতি আশ্চর্য ব্যাপার। কিন্তু তবুও যদি জাতি-বিশেষের নামে কোনও সভ্যতার নামকরণ করি, যেমন হিন্দুসভ্যতা-তখন যে কেবল এই খবর জানাতে চাই যে, কতকগুলি বস্তুজগতের ও মনােরাজ্যের সৃষ্টি বংশপরম্পরাক্রমে মোটামুটি এক জাতির লোকের কাজ, তা নয়। প্রকাশ্য বা নিগৃঢ়ভাবে এই ইঙ্গিত প্রায় সকল সময়ে থাকে যে, ওই সব বিচিত্র, বিভিন্ন, এমনকী বিরোধী সৃষ্টিগুলির মধ্যে একটা ঐক্যের বাঁধন আছে, যে ঐক্য কেবল জন্মস্থান-সমতার ঐক্য নয়, ভাবগত ও রুচিগত ঐক্য। খুব সম্ভব। এ ঐক্যের মূল ওই জন্মগত ঐক্য। কারণ ওই সৃষ্টিগুলির যাঁরা কর্তা, তাদের শিরার রক্ত ও মাথার মগজের এক মূল জীব থেকে উৎপত্তি, এবং তাদের প্রাকৃতিক ও মানসিক পারিপার্শ্বিকও অনেক অংশে এক৷ অতিবড় প্রতিভাশালী স্রষ্টাও এর প্রভাব এড়াতে পারে না ও এড়াতে চায় না। ফলে তাদের সৃষ্ট সভ্যতা তার বহুমুখী বৈচিত্র্য ও নানা পরিবর্তন ও বিপ্লবের মধ্যেও ভিতরের কাঠামোখনি প্ৰায় বাহাল রাখে। ঘরের চাল বদলে যায়, দরজা জানালার পরিবর্তন হয়, পুরনো বেড়া তুলে ফেলে নতুন বেড়া বসানো হয়, কিন্তু মাঝের ‘ফ্রেমটি বজায় থাকে। আৰ্যমনোভাব হিন্দু-সভ্যতার এই ‘স্টিলফ্রেম’।
বলা বাহুল্য এ ‘স্টিলফ্রেমে’র শলাকা চোখে দেখা যায় না। চুম্বকের ‘লাইনস অব ফোর্সেস’ শক্তিসঞ্চার পথের মতো সেগুলি অদৃশ্য। তাদের উপাদান কোনও বস্তুসমষ্টি নয়, এমনকী রাষ্টিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানও নয়। চিন্তা বা মননের কতকগুলি বিশেষ ভঙ্গি, ভাব ও অনুভূতির কয়েকটি বিশেষ্যমুখী প্রবণতা দিয়ে এ ‘ফ্রেম’ তৈরি। সুতরাং আৰ্যমনোভাব জিনিসটিকে রূপরেখায় চোখের সুমুখে ফুটিয়ে তোলা সহজ নয়। প্রাচীন হিন্দুসভ্যতার সৃষ্টিগুলির সঙ্গে কিঞ্চিম্মাত্রও প্রত্যক্ষ পরিচয় হলে এ মনোভাবের যে সুস্পষ্ট ছবি মনে একে যায়, ভাষায় তার মূর্তি গড়া সুদক্ষ শিল্পীর কাজ। সে অনধিকার চেষ্টায় উদ্ধাহু না হয়ে সাদা কথায় তার দু’-একটা লক্ষণের কিছু আলোচনা ও বিশ্লেষণের চেষ্টা মাত্র করব। ইংরেজিতে যাকে ‘সেন্টিমেন্টালিজম’ বলে, আমরা তার বাংলা নাম দিয়েছি ভাবালুতা। ইংরেজিশিক্ষিত বাঙালি সমাজে বিগত শতাব্দীর শেষ ত্ৰিশ বছর ছিল এই ভাবালুতার পুরো জোয়ারের সময়। উনবিংশ শতাব্দীর যে ইংরেজি কাব্য ও সাহিত্যে তখন শিক্ষিত বাঙালির মন পুষ্ট হচ্ছিল, সে কাব্য সাহিত্য ‘সেন্টিমেন্টালিজম’-এর রসে ভরা; সুতরাং তার প্রেরণায় বাঙালি যে সাহিত্য সৃষ্টি করছিল, তা ভাবালুতায় ভরপুর। এবং প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের মাত্র যে অংশের তখন শিক্ষিত বাঙালির উপর প্রভাব ছিল, সেই বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যও এই ভাবালুতার অনুকূল। এই মানসিক আবেষ্টনের মধ্যে বর্ধিত হয়ে প্রাচীন আৰ্যমনোভাবের যে লক্ষণ শ্ৰীযুক্ত প্রমথ চৌধুরী মহাশয়ের চোখ ও মন সবচেয়ে সহজে ও সবলে আকর্ষণ করেছে, সে হচ্ছে ‘সেন্টিমেন্টালিজম’ বা ভাবালুতার অভাব; এবং কেবল অভাব নয়, বিরোধী ভাবের আধিপত্য। কারণ প্রাচীন হিন্দুর মনোভাবের এমন একটা ঋজু কাঠিন্য ছিল, যা কি শরীর কি মনের সমস্ত রকম নুইয়ে-পড়া ও লতিয়ে-চলার বিরুদ্ধ। কালিদাস আৰ্যরাজার মৃগয়াকৰ্ষিত শরীরের যে ছবি এঁকেছেন, সেটা প্রাচীন আৰ্যমনেরও ছবি।
‘অপচিতমপি গাত্ৰং ব্যায়তত্বাব্দলক্ষ্যং
গিরিচর ইব নাগঃ প্ৰাণসারং বিভৰ্ত্তি।’
‘মোদহীন কৃশতা ঋজু দীর্ঘতায় কৃশ বলে লক্ষ্য হয় না। পর্বতচারী গজের মতো দেহ যেন কেবল প্ৰাণের উপাদানেই গড়া।’ অথচ এই মেদশূন্য কৃশতা কল্পনা-অকুশল মনের বস্তৃতান্ত্রিক রিক্ততা নয়। হিন্দুর বিরাট পুরাণ ও কথাসাহিত্য, বৌদ্ধ ও জৈন গাথার বিপুলতা ভারতীয় আৰ্যমানের অফুরন্ত কল্পনালীলার পরিচয় দিচ্ছে। এ কাঠিন্যও শুষ্কপেশি কঙ্কালসার কাঠিন্য নয়। ভাবের দীনতা, রসবোধ ও রসসৃষ্টির অক্ষমতা জাতির মনকে বিধিনিষেধ-সর্বস্ব যে শুষ্ক কঠিনতা দেয়, সে কাঠিন্য হিন্দুর কখনও ছিল না। বেদসূক্তের উষার বন্দনা থেকে ভর্তৃহরির শতক ত্রয় পর্যন্ত ভাব ও রসের সহস্র ধারা তাকে পাকে পাকে ঘিরেছে। তার ভৌগকে শোভন ও জীবনযাত্রাকে মণ্ডনের জন্য চৌষট্টি কলার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সমস্ত ভাব ও কল্পনা, রস ও কলাবিলাসের মধ্যে একটা সরল, কঠিন মেরুদণ্ড সব সময়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। প্রাচীন আৰ্যমনে ভাবের অভাব ছিল না। কিন্তু আমরা যাকে বলি ‘ভাবে গলে যাওয়া’, তার মাধুর্য সে মনের রসনা আস্বাদ করেনি। ভগবান বুদ্ধ লোকের জন্মজরামরণের দুঃখে স্ত্রী, পুত্র, রাজ্য, সম্পদ ছেড়েছিলেন, কিন্তু চোখের জল ছাড়েননি।
পণ্ডিত লোকে এমনও বলেছেন যে, প্রাচীন আর্যজাতি মূলে ছিল যাযাবর লুঠতরাজের দল-’প্ৰিডেটারি নোমাডস’। অন্য ধ্রুবশীল সভ্যজাতির ঘাড়ে চেপে তাদের পরিশ্রমের অন্ন খেতে খেতে তাদেরই সংস্পর্শে তাঁরা ক্ৰমে সভা হয়েছে। এই ধার-করা সভ্যতার বীজ উর্বরা জমিতে খুবই ফলেছে বটে, কিন্তু তার শিকড় আদিম যাযাবরত্বের প্রস্তরকঠিন অন্তর ভেঙে মাটি করতে পারেনি, ফুলপাতায় ঢেকে রেখেছে মাত্র। এ মতের ঐতিহাসিক মূল্য যতটা থাক না থাক, এটি স্পষ্টই প্রাচীন আৰ্যমনোভাবের একটা পৌরাণিক অর্থাৎ ইভলিউশনারি’ ব্যাখ্যা। একটি ছোট উদাহরণ দিই। নাটক ও নাট্যাভিনয় প্রাচীন হিন্দুর প্রিয়বস্তু ছিল। হিন্দু আলংকারিকেরা কাব্যের মধ্যে নাটককেই সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান দিয়েছেন। তাদের শিল্পকলার সংখ্যাও গণনায় চৌষট্টি পর্যন্ত পৌঁছেছিল। কিন্তু হিন্দুর ধর্মশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্ৰ একযোগে বিধান দিয়েছে–কারুকর্ম ও কুশীলবের কর্ম শূদ্রের কাজ, আর্যের নয়।’(২) উদাহরণে পুথি বেড়ে যায়। কিন্তু আৰ্যমনের এই কাঠিন্য যে কত কঠোর, তা তাঁরা নিজেদের জীবনে অপরাহ্নকালের জন্য যে দুটি আশ্রমের ব্যবস্থা করেছিলেন, তার কথা একটু কল্পনা করলেই উপলব্ধি হয়।