বাঙালিকে অবশ্য আগে বাঁচতে হবে। কিন্তু সেজন্য চাই নূতন ধন সৃষ্টি করা, দেশের অন্নকে বহু করা। বেদের ঋষি অন্নের সৃষ্টির জন্য নিজের হাতে হাল ধরেছেন। আজ পৃথিবীর সেই দিন এসেছে। যখন অন্নসৃষ্টির ভার কেবল বৈশ্য বহন করতে পারে না। তার ব্ৰাহ্মণের সাহায্য চাই। এই সাহায্য বাঙালির জ্ঞান-বিজ্ঞান ভারতবর্ষকে দান করবে। যার চোখ আছে তিনিই এর আরম্ভ দেখতে পেয়েছেন। বৈশ্যত্বের নামে নয়, এই ব্ৰাহ্মণত্বের নামে ডাক দিলে তবেই নবীন বাঙালির সাড়া পাওয়া যাবে। এই ব্ৰাহ্মণত্বের ছায়ায় বাংলাদেশে এমন বৈশ্যত্ব গড়ে উঠুক। যার হাতে ধন দেখে কি শাস্ত্রকার কি দেশের লোক কেউ ভীত হবে না। যে বৈশ্য প্রাচীন সংহিতার অনুশাসন মত ‘ধৰ্ম্মেণ চ দ্রব্যবৃদ্ধাবাতিষ্ঠেদ যত্নমুত্তমম্, ধর্মানুসারে দ্রব্যবৃদ্ধির জন্য উত্তম যত্ন করবে; দদ্যাচ্চ সৰ্ব্বভূতানামন্নমেব প্ৰযত্নতঃ, এবং অতি যত্নে সৰ্বভুতকে পর্যাপ্ত অন্ন দান করবে।
শ্রাবণ ১৩২৭
সবুজের হিন্দুয়ানি
সম্পাদক মহাশয় শুনেছেন অনেকের আশঙ্কা, নবপর্যায়ের ‘সবুজপত্র’ নাকি হবে জীর্ণ হিন্দুয়ানির আতপত্র। কথা কী করে রটলো বলা যায় না, তবে এ কথা বলা যায় যে, ভয় একেবারে অমূলক নয়। শ্ৰীযুক্ত প্রমথ চৌধুরী মহাশয়ের বয়স হয়ে আসছে; আর প্রথম বয়সের ইংরাজি-পড়া তার্কিক যে শেষ বয়সে শাস্ত্ৰভক্ত গোঁড়া হিন্দু–এই হচ্ছে সাধারণ নিয়ম। কাজেই যাদের ভাবনা হয়েছে পুনরুদগত ‘সবুজপত্র’ আধুনিকতার প্রখর রশ্মি থেকে প্রাচীন হিন্দুত্বকে ঢেকে রাখবে, তাদের ভয়কে অহেতুক বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না।
কেউ কেউ হয়তো বলবেন যে, শ্ৰীযুক্ত প্রমথ চৌধুরীর সম্বন্ধে সাধারণ নিয়মটা খাটে না। কারণ তিনি কেবল ইংরেজিনবিশ নন, ইউরোপের আরও দু-একটা আধুনিক ভাষা ও সাহিত্যনবিশ; যার ফলে ইংরেজি মদের নেশা কোনওদিনই তাকে বেসামাল করতে পারেনি। আর হিন্দুশাস্ত্রচর্চাও তিনি শেষ বয়সে ‘বঙ্গবাসী’র অনুবাদ মারফত আরম্ভ করেননি, তরুণ বয়স থেকেই শাস্ত্রকারদের নিজ হাতের তৈরি খাঁটি জিনিসে নিজেকে অভ্যস্ত করে এসেছেন। এখন আর ওর প্রভাবে ঝিমিয়ে পড়বার তাঁর কোনও সম্ভাবনা নেই।
এ কথার মধ্যে কিছু সত্য আছে। কিন্তু হিন্দুত্ব ও হিন্দুশাস্ত্রের উপর চৌধুরী মহাশয়ের ভক্তি যে গোঁড়া গদগদ ভক্তি নয়, তার যথার্থ কারণ এ দুয়ের উপর তাঁর অসীম প্রীতি, কেননা ওখানে তার নিগূঢ় মমত্ববোধ রয়েছে। জাতিতে ব্ৰাহ্মণ হলেও চৌধুরী মহাশয়ের শরীরে প্রাচীন শাস্ত্রকারদের রক্তের ধারা কতটা অক্ষুন্ন আছে, এ নিয়ে হয়তো শ্ৰীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ তর্ক তুলতে পারেন, কিন্তু তাঁর বুদ্ধি ও মনোভাব যে প্রাচীন আৰ্য শাস্ত্রকারদের বুদ্ধি ও মনোভাবের অক্ষুন্ন ধারা, এতে আর তর্ক চলে না। শাস্ত্রকার মনু কি ভাষ্যকার মেধাতিথি, এঁদের সঙ্গে আজ মুখোমুখি সাক্ষাৎ হলে তাঁরা অবশ্য চৌধুরী মহাশয়কে নিজেদের বংশধর বলে চিনতে পারতেন না; বরং পোশাক পরিচ্ছদ, চাল-চলনে প্রত্যন্তবাসী কশ্চিৎ ম্লেচ্ছ বলেই মনে করতেন। কিন্তু দু’-চার কথার আদানপ্রদানে টপ হ্যাট ও ফ্রক কোটের নীচে যে মগজ ও মন রয়েছে, তার সঙ্গে পরিচয় হবামাত্র তাঁরা নিশ্চয়ই চৌধুরী মহাশয়কে এই বলে আশীৰ্বাদ করতেন–
‘আত্মা বৈ পুত্রনামাসি সজীব শরদাং শতম্।’
‘হে পুত্র! আমাদের আত্মাই তোমাতে জন্ম পরিগ্রহ করেছে। তুমি শত বৎসর পরমায়ু নিয়ে অযজ্ঞীয় ম্লেচ্ছপ্রায় বঙ্গদেশে ইস্পাতের লেখনীমুখে আৰ্যমনোভাব প্রচার ও তার গুণ কীর্তন কর।’
এই আর্যমনোভাব বস্তুটি কী, একটু নেড়েচেড়ে দেখা যাক। কারণ প্রমথবাবু যদি ‘সবুজপত্রে’ হিন্দুয়ানি প্রচার করেন, তবে এই মনোভাবেরই প্রচার করবেন।
যে প্রাচীন আর্যেরা হিন্দুসভ্যতা গড়েছে, তাদের সকলের মনোভাব কিছু একরকম ছিল না। হিন্দুসভ্যতার জটিল বৈচিত্র্য দেখলেই তা বোঝা যায়। যাঁরা উপনিষদ রচেছে ও যাঁরা ভক্তিশাস্ত্র লিখেছে; পুরুষাৰ্থ সাধন বলে যাঁরা যাগযজ্ঞবিধির সূক্ষ্ম বিচার ও বিচারপ্রণালীর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আলোচনা করেছে; ও যাঁরা চতুরার্য সত্য ও অষ্টাঙ্গ মার্গ উপদেশ করেছে; যাঁরা শ্রুতিকে ধর্মজিজ্ঞাসুদের পরম প্রমাণ বলেছে; ও যাঁরা বলেছে বেদ লোকযাত্ৰাবিদদের লোকনিন্দ থেকে রক্ষার আবরণ মাত্র(১); ন্যায়-দর্শন যাদের তত্ত্বপিপাসার নিবৃত্তি করেছে, ও যাঁরা অখণ্ড অদ্বয়-বাদে না পৌছে থামতে পারেনি–তারা সবাই ছিল আৰ্য, এবং হিন্দুসভ্যতা গড়ার কাজে সবারই হাত আছে। একদল অনুশাসন দিয়েছে গৃহস্থাশ্রমে যজ্ঞানুষ্ঠানে দেবঞ্চণ ও প্রজোৎপাদনে পিতৃঋণ শোধ দিয়ে তবে বানপ্ৰস্থী হয়ে মোক্ষ চিন্তা করবে, নইলে অধোগতি হবে; অন্য দল উপদেশ করেছে যেদিন মনে বৈরাগ্য জগবে সেইদিনই প্ৰব্ৰজা নেবে। রাজ্যরক্ষা ও রাজ্যবৃদ্ধির উপায় রাজাকে শেখাবার জন্য একদল ‘অর্থশাস্ত্ৰ’ রচনা করেছে; অপর দল ‘ধর্মশাস্ত্ৰ’ লিখে সে পথ দিয়ে হাঁটতে রাজাকে মানা করেছে। কেউ বলেছে পুত্রের জন্মমাত্র সে পৈতৃক ধনে পিতার মতোই স্বত্ব লাভ করে, কেউ বিধান দিয়েছে পিতা যতদিন বেঁচে আছে পুত্রের ততদিন কোনও স্বত্ব নেই। যে লৌকিক প্রবচন বলে, এমন মুনি নেই যার ভিন্ন মত নেই, তার লক্ষ হিন্দু-সভ্যতা-স্রষ্টাব্দের এই মতবিরোধের বৈচিত্ৰ্য।