বাধ্য হয়েই স্বীকার করতে হবে যে এ মাপে বাঙালির উন্নতির বহর বড় বেশি নয়। আরব সমুদ্রের তীরের দুই-একটি জাতির কাছে তো আমরা দাঁড়াতেই পারি না। এমনকী যাঁরা বাংলার বাইরে থেকে কেবল পাগড়ি কি টুপি নিয়ে এসে বাংলার বুকের উপর দিয়ে মোটর হঁহাকাচ্ছেন, তাদের পাশেও আমরা নিতান্ত খাটো। আমাদের নিত্য দুঃখ-দৈন্যের চাপিটা যখনই কোনও নৈমিত্তিক কারণে একটু বেড়ে ওঠে তখনই এই ব্যাপার নিয়ে আমাদের আন্দোলন, আলোচনা, ধিক্কার, অনুশোচনার সীমা থাকে না। কলেজ-ফেরত বাঙালির ছেলে নিরক্ষর অ-বাঙালির ব্যবসায়ে কেরানিগিরির উমেদার, এই উদাহরণ তুলে আমরা বাঙালির মতি গতি এবং সর্বোপরি আমাদের বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার দুরবস্থা স্মরণ করে যুগপৎ ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠি। এ শিক্ষা যে কেবল ব্যৰ্থ নয়, উন্নতির পথে পায়ে শিকল তাতে আর সন্দেহ থাকে না। কেননা শিক্ষিত বাঙালির চেয়ে যে নিরক্ষর দিল্লিওয়ালা শ্রেষ্ঠ এর পরিচয় তো একের মোটরকার ও অন্যের ছেড়া জুতোতেই সুপ্রকাশ। কিন্তু বাঙালির মনের এমনই মোহ যে এর প্রতিকারে কেউ স্কুল কলেজ তুলে দেবার উপদেশ দেয় না। প্রস্তাব হয় এগুলিতে অন্যরকম শিক্ষা দেওয়া হোক। শিল্পবিদ্যালয় ও কারবার শেখার স্কুলে দেশটা ভরে ফেলা যাক। অথচ সকলেই জানি মোটরবিহারী দিল্লিওয়ালা কি শিল্প, কি সওদাগরি কোনও স্কুলেই কোনওদিন পড়েনি।
জার্মানযুদ্ধ আরম্ভ হবার পর থেকে পৃথিবী-জোড়া দুরবস্থার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাংলাদেশের অবস্থা অতি সংকটের জায়গায় এসে পৌছেছে। এ সংকট যে কত বড়, আর আমাদের দারিদ্র্যের ব্যাধি যে কত প্ৰবল তা আমরা এর যে-সব বিষ-চিকিৎসার ব্যবস্থা দিচ্ছি। তা দেখলেই বোঝা যায়। আচাৰ্য প্রফুল্লচন্দ্র তার উচ্চশিক্ষিত ছাত্রদের উপদেশ দিচ্ছেন, ‘সবাই মাড়োয়ারি হও; আর উপায় নেই।’ এ কথা বেরিয়েছে তার মুখ থেকে যার সমস্ত জীবন বৈশ্যত্বের একটা প্ৰতিবাদ। ধনের গৌরব ও ক্ষমতার মোহ যার কাছে প্রলোভনের জিনিসই নয়। যাঁর নৈষ্ঠিক ব্ৰহ্মচৰ্য আর ঋষির তপস্যা বিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ ভারতবর্ষেও জ্ঞানের তপোবন ও শিষ্যের মণ্ডলী গড়ে তুলেছে। যিনি বিদ্যা ও প্রতিভা দিয়েছেন দেশের সেবায়, নিজেকে লোপ করে। এ যুগে যিনি কারখানা গড়ে তুলেছেন নিজের পকেট নয় দেশের মুখ চেয়ে। আর ‘মাড়োয়ারি হওয়া’ ব্যাপারটি কী তা গেল-যুদ্ধের টানে সবার সামনে বে-আবু হয়েই দেখা দিয়েছে। মাড়োয়ারিগিরি হচ্ছে ইউরোপীয় বৈশ্যত্বের কবন্ধ। ইউরোপের বৈশ্য পৃথিবীই লুট করুক, আর দেশের মাথায়ই চড়ে বসুক, দেশকে সে ঠিকই অন্ন জোগাচ্ছে। আজকের ইউরোপের ধনসৃষ্টির সে যে মূল উৎস তাতে সন্দেহ করা চলে না। কিন্তু মাড়োয়ারিগিরি ধনসৃষ্টির পথ দিয়েই হাঁটে না। ব্যাবসা-বাণিজ্যের ওই উত্তমাঙ্গটি তার নেই। তার কাজ হল বিদেশের তৈরি জিনিস চড়া দরে দেশের মধ্যে চালানো, আর দেশের উৎপন্ন ধন সস্তা দরে বিদেশির হাতে তুলে দেওয়া। এবং এই হাত বদলানোর কারবার থেকে যত বেশি সম্ভব দেশের ধন, যার সৃষ্টিতে তার কড়ে আঙুলেরও সাহায্য নেই, নিজের হাতে জমা করা। সেজন্য যে তীব্ৰ লোভ ও একাগ্র স্বার্থপরতা দরকার তার নাম ব্যাবসা-বুদ্ধি। এ ব্যাবসা-বুদ্ধি যে কত বড় নির্লজ্জ আর কতদূর হৃদয়হীন গেল-যুদ্ধের সময় পৃথিবীর সব দেশে তা প্রমাণ হয়েছে। দেশের নিতান্ত দুৰ্দশা ও সংকটের সময়ও দেশ-জোড়া দুরবস্থার ভিত্তির উপর নিজের ধনের ইমারত গড়ে তুলতে কোনও দেশের কোনও বৈশ্য কিছুমাত্র গ্লানি বোধ করেনি। এবং এক রাজদণ্ডের শাসন ছাড়া এদের নিষ্ঠুরতা আর কোনও কিছুরই বাধা মানেনি।
ধনসৃষ্টির সঙ্গে নিঃসম্পর্ক সওদাগরি ইউরোপেও যথেষ্টই আছে। কিন্তু সেখানে সেটা ধন উৎপাদন ও ধন বিতরণের আনুষঙ্গিক উপদ্রব। আর মাড়োয়ারিগিরি হল নিছক উপদ্ৰব। উৎপাত এটা যেমন হাস্যকর তেমনি সংকটজনক। দেশের কৃষক নিরন্ন বলে স্বল্পমূল্যে তার শ্রমের ফল হতে জমা করে দেশের লোক নিরুপায় বলে চড়া দামে তা বিক্রি করার মধ্যে কোথায় যে দেশের ধনবৃদ্ধি ও উপকার আছে তা অর্থ-নীতিশাস্ত্রের মহামহোপাধ্যায়েরাও আবিষ্কার করতে পারবেন না। আর গলা যদি নেহাতই কাটা যায়। তবে ছুরিটা বাঙালির না হয়ে অ-বাঙালির এতে এমনকী ক্ষুব্ধ হবার কারণ আছে। সম্ভাবনাটা সুদূর, কিন্তু যদি সত্যই বাংলার গোটা শিক্ষিত-সমাজটা ‘মাড়োয়ারি’ই হয়ে ওঠে। তবে নিশ্চয় জানি আচাৰ্য প্রফুল্লচন্দ্ৰই সবার আগে বলবেন এর চেয়ে বাঙালিজাতির না খেয়ে মরাই ভাল ছিল।
৬
ইউরোপের বৈশ্যত্ব বাংলার মাটিতে ভাল ফলেনি। অথচ ইউরোপের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় ভারতবর্ষের সব জাতির চেয়েই বেশি। বাংলার বাইরে বাঙালি তো একরকম খ্রিস্টান বলেই পরিচিত। কথা এই যে, যে ইউরোপের সঙ্গে বাঙালির নাড়ির যোগ সেটা বৈশ্য ইউরোপ নয়, ব্ৰাহ্মণ ইউরোপ। কল-কবজ ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের আধুনিক ইউরোপ ছাড়াও আর একটা আধুনিক ইউরোপ আছে, যে ইউরোপ প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার উত্তরাধিকারী, যে আধুনিক ইউরোপ মানুষের মনকে মুক্তি দিয়েছে, জ্ঞানের দৃষ্টি যেমন সূক্ষ্ম তেমনি উদার করেছে। যার কাব্য, সাহিত্য, কলা, দর্শন, বিজ্ঞান, মানুষের সভ্যতার ভাণ্ডার জ্ঞান, সত্য, সৌন্দর্যে ভরে দিয়েছে। এই ইউরোপের আনন্দলোকই বাঙালির মন হরণ করেছে, কলের ধোঁয়ায় কালো ইউরোপ নয়। সেইজন্য বাংলার মাটিতে এখনও জামসেটজি তাতা জন্মোনি, কিন্তু বাংলাদেশ রামমোহন ও রবীন্দ্রনাথের জন্মভূমি। এখনও বড় কলওয়ালা কি ভারী সওদাগরের আমরা নাম করতে পারিনে, কিন্তু জগদীশ বসু ও প্রফুল্লচন্দ্র বাঙালি জাতির মধ্যেই জন্মেছেন। বাঙালির নাড়িতে পশ্চিম থেকে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ও মধ্যযুগের মুসলমান সভ্যতা, দক্ষিণ থেকে দ্রাবিড় ও পূর্ব থেকে চিন সভ্যতার রক্ত এসে মিশেছে। ইউরোপীয় আৰ্য-সভ্যতার বিদ্যুৎস্পর্শে যদি এই অপূর্ব প্রয়াগ-ভূমিতে আমরা একটি অক্ষয় নূতন সভ্যতা গড়ে তুলে মানবজাতিকে দান করতে পারি। তবেই আধুনিক বাঙালি জাতির জন্ম সার্থক। না হলে আমরা পায়ে হেঁটে চলি কি মোটরগাড়িতে দৌড়াই, তাতে কিছুই আসে যায় না। কিন্তু এ সার্থকতার জন্য ইউরোপের যে উৎস থেকে জ্ঞান ও সৌন্দৰ্য উৎসারিত হচ্ছে তা থেকে চোখ ফিরিয়ে যেখানে তার কারখানায় মাল তৈরি হচ্ছে সেখানে দু’চোখ বদ্ধ করে রাখলে চলবে না; বাঙালির মাড়োয়ারি হওয়া একেবারেই পোষাবে না।