ইউরোপের বৈশ্য-প্রভুত্বের খোঁচা এমনি করে ইউরোপের বাইরে তাম্র কালো পীত সব রঙের লোকের গায়ে এসেই বিঁধছে। ইউরোপের বৈশ্য চায়। এরা নিরলস হয়ে তার কারখানার কাজের উপাদান আর মজুরের খাদ্য জোগায়। কিন্তু এ ছাড়া এর আরও একটা দিক আছে। ইউরোপ যেমন এদের কর্মশীলতা চায় তেমনি সঙ্গে সঙ্গে চায়। এ কর্মক্ষমতা সীমা ছাড়িয়ে না। ওঠে এবং বিপথে না চলে। শিল্পের উপাদান জোগান এবং কৃষি পশু থেকে খাদ্য উৎপাদন, এতেই নিঃশেষ না হয়ে যদি এদের শক্তি ও বুদ্ধি নবশিল্পের নূতন বিদ্যা শিখে উপাদানকে শিল্পদ্রব্যে পরিণত করার দিকে চলে সেটা ইউরোপের চোখে অমঙ্গল। কেননা ইউরোপের আধুনিক শিল্পবাণিজ্যের মোটকথা বাকি পৃথিবী উপাদান ও খাদ্য জোগাবে, আর ইউরোপ ওই উপাদান থেকে তৈরি শিল্পদ্রব্যের এক অংশ বিনিময়ে ফিরিয়ে দেবে। যদি এ ব্যবস্থা উলটে গিয়ে খাদ্য ও শিল্পসামগ্ৰী দুই-ই বাইরে থেকে ইউরোপের দরজায় উপস্থিত হয় তবে বদল দিয়ে এদের ঘরে নেবার মতো জিনিস ইউরোপের বড় বেশি থাকবে না। কেননা ইউরোপ যে শিল্প-বাণিজ্যে আর সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে সে তার দেশের প্রকৃতির গুণে নয়, লোকের প্রকৃতির গুণে। কিন্তু এ কথা যেমন গৌরবের তেমনি আশঙ্কার। যে-সব দেশে প্রকৃতি ইউরোপের চেয়ে অকৃপণা, সে দেশের লোকের মনের পঙ্গুত্ব ও শক্তির খর্বতার উপর এ শ্রেষ্ঠত্ব টিকে আছে। মন সচল হলেও যে ইউরোপের শিল্প-বাণিজ্যের নূতন কৌশল শিখে শক্তি সঞ্চয়ে দেরি হয় না তার পরিচয় জাপান দিয়েছে। এবং যেখানেই এ পরিচয়ের আভাস পেয়েছে, ইউরোপ তার নাম দিয়েছে ‘আতঙ্ক’। কারণ ইউরোপের বিশ্বপ্রেমিকেরা যা-ই বলুন-না, ধন ও শক্তিতে ইউরোপ এখন যেমন আছে তেমনি থাকবে, আবার বাকি পৃথিবীটাও ধনী ও শক্তিশালী হয়ে উঠবে, জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বর্তমান অবস্থায় এর কোনও সম্ভাবনা নেই। ইউরোপ প্ৰধান হয়েছে, আর সবাই ছোট ও খাটো আছে বলে। সে প্রাধান্য বজায় থাকবে – আর সবাইকে ছোট ও খাটো করে রাখতে পারলে।
৫
বৈশ্য-ইউরোপের চাপ পৃথিবীর যে-সব প্রাচীন সভ্য জাতিগুলির উপর এসে পড়েছে তাদের সবারই মনে হয়েছে ওর হাত থেকে রক্ষার উপায় ওই বৈশ্যত্বকে ধার করে তার উপর শিল্প, বাণিজ্য, সমাজ ও রাষ্ট্র গড়া। কেননা চোখে দেখতে ইউরোপের বাহুতে বল দিচ্ছে তার সব অদ্ভুত কৌশলী কাজের সরঞ্জাম ও উপকরণের বিচিত্র বাহুল্য। আর এ সরঞ্জাম ও উপকরণ সবই জোগাচ্ছে তার বৈশ্যের কর্মব্যবস্থা। প্রাচ্য দেশের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচ্য জাপান পাশ্চাত্যের এই কৰ্মকৌশল অল্পদিনেই আয়ত্ত করেছে। এবং ফলে পশ্চিম ইউরোপের প্ৰবল জাতিগুলির মতো ইউরোপের চোখে সেও একটা প্রধান জাতি। তারও কারখানার কলে ইউরোপের মতো মজুর খাটিয়ে শিল্প-সামগ্ৰী তৈরি হচ্ছে; সেগুলো জাহাজে উঠে পৃথিবীর বাজারের যত ফাঁক জায়গা দরকারি, অদরকারি, সাচ্চা, ঝুঁটো, ভারী ও ঠুনকো মালে ভরে দিচ্ছে, এবং আর সবার মাল সরিয়ে নিজের জন্য কতটা জায়গা খালি করা যায় তার চেষ্টা দেখছে। মহাজনি-জাহাজের পেছনে তারও মনোয়ারি জাহাজ সেজে রয়েছে; এবং পৃথিবীর শান্তির জন্য ইউরোপের আর পাঁচজন শান্তিপ্রয়াসীর মতো সেও কামান, বন্দুক, গোলা, গুলি তৈরি করে যাচ্ছে। বিশ্বহিতের বাণী তার মুখ থেকেও সমান তেজে ও সমান বেগেই বেরোচ্ছে; এবং মানবজাতির সভ্যতা রক্ষা ও বিস্তারের জন্য দুর্বল জাতির সুফলা দেশের গুরুভার বহনে তার পীত-স্কন্ধের ঔৎসুক্য কোনও শ্বেত-স্কন্ধের চেয়ে কম নয়। বৃদ্ধ চিন ডাইনে ইউরোপ ও বীয়ে জাপান দুদিক থেকে খোঁচা খেয়ে ওই বৈশ্যত্বের দিকে লুব্ধনেত্ৰে তাকাচ্ছে। কিন্তু তার প্রাচীন সভ্যতার গভীর শিকড়, আর প্রকাণ্ড দেহের বিরাট বিপুলতা তাকে সোজাসুজি ইউরোপের বৈশাত্বের পাঠশালায় ঢুকতে দিচ্ছে না। ইউরোপের নবীন বিদ্যার বেগ তার প্রাচীন সভ্যতাকে একটা নূতন সৃষ্টির পথে নিয়ে যাবে, এশিয়া সেই আশায় তাকিয়ে আছে। এবং সমস্ত বাধা কাটিয়ে পাছে চিন নিজের বৈশ্যমন্ত্রে জাপানের মতোই সিদ্ধিলাভ করে সেই আতঙ্কে ইউরোপ মাঝে মাঝে চার দিক হলদে দেখছে।
আমাদের ভারতবর্ষে এ বৈশ্য-তন্ত্রের খাস তালুক। কেননা এ মহাদেশ ইউরোপের সেই দেশের অধীন রাজ্য যেখানে বৈশা-তন্ত্রের মূর্তি সবচেয়ে প্রকট, আর বৈশ্য-প্ৰভুত্বের মহিমা সবচেয়ে উঁচু। এবং ‘কনস্টিটিউশন্যাল ল’র পুথিতে যাই থাকুক আমরা সবাই জানি ব্রিটেনের বৈশ্যােরাজই আমাদের রাজা। স্বভাবতই প্ৰজার জাতির চোখে উন্নতি মানে রাজার জাতির মতো হওয়া। সেইজন্য আমাদের দুঃখ, দৈন্য, দুর্দশার কথা যখনই ভাবি তখন সহজেই মনে হয় এর প্রতিকারের উপায ভারতবর্ষকে বিলাতের মতো বড় বড় কারখানায় ভরে ফেলা; দেশের লোককে গ্রামের মাটি থেকে উপড়ে এনে শহরের কলে জুড়ে দেওয়া। এবং সেজন্য সর্বপ্রথম দরকার সকলে মিলে বৈশাকে দেশের মাথায় তোলা যাতে যার-ই মগজে বুদ্ধি আর মনে উৎসাহ আছে তার দু’চোখ এদিকে পড়ে। আমাদের সরকারি বে-সরকারি রাজপুরুষেরাও ভারতবর্ষের যে-জাতি বৈশ্যামহিমা যতটা আয়ত্ত করেছে তাকে ততটা উন্নত বলে স্বীকার ও প্রচার করেন। এবং আমাদের বড়-ছোেটর প্রমাণ যে তাদের হাতের মাপকাঠি সে কথা বলাই বাহুল্য।