এ বিষয়ে একটা ভুল ধারণা থাকিয়া যাইবার সম্ভাবনা আছে। আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাপ্রণালীর সহিত বিলাতের শিক্ষাপ্রণালীর তুলনা করিয়া আমাদের কর্তৃপক্ষেরা এবং তাহাদের বন্ধুবান্ধব সর্বদাই বলিয়া থাকেন, এবং আমরাও শুনিয়া শুনিয়া বলি যে, বিলাতে ইস্কুল-কলেজে ছাত্রদের চরিত্র গঠিত হয়, আর আমাদের ইস্কুল-কলেজ হইতে ছাত্রেরা কেবল কতকগুলি কথা মুখস্থ করিয়া চলিয়া আসে। কথাটা সত্য বলিয়াই ধরিয়া লওয়া যাক। কিন্তু ইহাতে এ প্রমাণ হয় না যে, বিলাতের ইস্কুল ও ইউনিভার্সিটিতে যে শিক্ষা দেওয়া হয়, তাহার ফলেই ছাত্রদের চরিত্র গঠিত হয়। বরং আমাদের কর্তৃপক্ষেরা উলটো কথাই বলেন। তাহারা বলেন যে, সেখানকার ইস্কুল-ইউনিভার্সিটির life বা আবহাওয়াতেই শিক্ষার্থীদের চরিত্র গড়িয়া ওঠে। অর্থাৎ সেখানকার ছাত্রদের চরিত্র সেখানকার বিদ্যালয়গুলির সামাজিক জীবনের ফল, শিক্ষার ফল নয। সুতরাং সামাজিক অবস্থার গুণে যেটা আপনা হইতেই জন্মলাভ করে, সেটাকে শিক্ষার ঘাড়ে চাপাইয়া আমাদের ছাত্ৰগণের কোনও হিতৈষী যেন তাহাদের পাঠ্য-পুস্তকের মধ্যে শেলির পরিবর্তে Smiles-এর আমদানি না করেন।
৩
এখন শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি আদর্শ-মানুষ গড়াও না হয়, শিক্ষার্থীর চরিত্রগঠন করাও না হয়তবে তাহার উদ্দেশ্যটা কী? এ প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া খুব কঠিন নয়, এবং সে উত্তরও সকলেরই জানা আছে; কিন্তু সেটা প্রকাশ করিয়া বলিতে আমরা সকলেই অল্প-বিস্তর লজ্জিত হই। কেননা উত্তরটা অতি সাধারণ রকমের, এবং বড় কথা বলিয়া ও শুনিয়া আমরা যে আত্মপ্রসাদ লাভ করি।—সোজা কথা বলায় ও শোনায় আমরা সে-সুখে বঞ্চিত হই।
কথাটা এই যে–শিক্ষার উদ্দেশ্য বিদ্যাশিক্ষা দেওয়া; অর্থাৎ যার প্রথম সোপানকে সমস্ত বিষয়টার নামস্বরূপে ব্যবহার করিয়া আমরা বাংলা কথায় বলি-লেখাপড়া শিখানো। কি পুরাতন, কি বর্তমান সমস্ত শিক্ষাপ্রণালীর লক্ষ্যই যে এই বিদ্যাশিক্ষা দেওয়া, তাহ টোল, পাঠশালা, ইস্কুল, কলেজগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করিলেই প্রত্যক্ষ করা যায়। নিতান্ত সূক্ষ্মদশী বিজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়া এই স্কুল বিষয়টা আর কাহারও চোখ এড়াইবার সম্ভাবনা নাই! শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে যে-সকল তত্ত্বকথা আছে, তাহদের উদ্দেশ্যই এই নিতান্ত সোজা কথাটাকে চাপা দেওয়া, যাহাতে তাহা নিজগুণে প্ৰকাশ না হইয়া পড়ে।
তত্ত্বজ্ঞানীদের সমস্ত বচন উপেক্ষা করিয়া এবং বিজ্ঞব্যক্তিদের উপদেশ অগ্রাহ্য করিয়া, পৃথিবীর শিক্ষালয়গুলি যগন বরাবর বিদ্যাশিক্ষা দেওয়াকেই তাঁহাদের প্রধান লক্ষ্য করিয়াছে, তখন ইহার মূলে যে নিছক বোকামি ছাড়া আরও কিছু আছে, তাহাতে অতি-বুদ্ধিমান ভিন্ন আর কেহ সন্দেহ করিবেন না। আমরা স্পষ্ট করিয়া বলিতে চাই যে, বিদ্যাশিক্ষাই যে কাৰ্যত শিক্ষার লক্ষ্য হইয়া আছে, কেবল তাঁহাই নহে, প্রকৃতপক্ষে উহাই শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত। একটু ভাবিয়া দেখিলে বোঝা যাইবে যে, বিদ্যাশিক্ষা জিনিসটা মানবসমাজের যুগযুগান্তরসঞ্চিত সভ্যতার সহিত পৃথিবীতে নবাগত মানবসস্তানের পরিচয করানো। এই পরিচয় শিক্ষার দ্বারাই সম্ভব, এবং শিক্ষা ভিন্ন আর কোনওরকমেই হইবার উপায় নাই। আদিম কাল হইতে বর্তমান কাল পর্যন্ত বহু-আয়াসলব্ধ সভ্যতার ফল নানা বিদ্যারূপে সঞ্চিত আছে ও হইতেছে। শিক্ষা এই বিদ্যাগুলির সঙ্গে মানুষের পরিচয় সাধন করে। অতি সভ্যসমাজের শিশুও অসভ্য হইয়া জন্মায়, এবং শিক্ষার মধ্য দিয়া এই বিদ্যাগুলির সহিত পরিচয় লাভ না করিলে অসভ্য অবস্থাতেই বাড়িয়া উঠিত। অসভ্য অর্থ বুদ্ধিহীনও নয়, হৃদয়হীনও নয়, অসভ্য অর্থ বিদ্যাহীন। অসভোর সমাজ সেই সমাজ, যাহার প্রতিপুরুষের লোকের জন্য পূর্বপুরুষের ও পূর্বকালের এমন কোনওই সঞ্চিত বিদ্যা নাই, যাহা বিশেষ শিক্ষা ভিন্ন আয়ত্ত হয় না। সভ্যসমাজের লোক ইস্কুল-কলেজে শিক্ষা না পাইলেও বংশানুক্রমের ফলে এবং সামাজিক অবস্থার প্রভাবে মোটামুটি সভ্য সমাজেচিত বুদ্ধি ও চরিত্র লাভ করে; কিন্তু রীতিমতো শিক্ষা না পাইলে অতি বড় পণ্ডিতবংশের প্রতিভাবান সন্তানও মুর্থই থাকিয়া যায়। কেননা বিদ্যার বংশানুক্রম নাই। সকলরকম বিদ্যাই প্রতি যুগের লোককে নূতন করিয়া আয়ত্ত করিতে হয়। এবং এই ক্ৰমাগত নুতন চেষ্টার ফলেই মনুষ্যসমাজের লব্ধ বিদ্যা প্রালব্ধ না হইয়াও রক্ষিত হয়। যদি পৃথিবীর একপুরুষের সমস্ত লোক একবার সমস্ত বিদ্যাশিক্ষা হইতে বিরত থাকে, তবে মানুষের আদিকাল হইতে একাল পর্যন্ত সঞ্চিত সমস্ত বিদ্যা ও সভ্যতা একপুরুষেই লোপ পায়, এবং মানুষকে আবার প্রাচীন বর্বরতায় কঁচিয়া বসিয়া সভ্যতার পুনর্গঠন আরম্ভ করিতে হয়। সুতরাং বিদ্যাশিক্ষা ব্যাপারটা একেবারে অকিঞ্চিৎকর জিনিস নয়। ইহার অর্ধ-মানুষের বহুযুগের চেষ্টার ফলে অর্জিত সভ্যতার সহিত পরিচিত হইয়া, অসভ্য অন্তত ন-সভ্য অবস্থা হইতে সভ্য হওয়া এবং সঙ্গে সঙ্গে এই কষ্টলব্ধ প্ৰাচীন সভ্যতাকে রক্ষা করা।
কথাটা আরও পরিষ্কার করিতে হইলে একবারে অনেকটা গোড়ার কথা ধরা ছাড়া উপায় নাই।
৪
মানুষের সভ্যতা অতি প্রাচীন। সচরাচর কথাবার্তায় আমরা এই প্রাচীনতা সম্বন্ধে যে ধারণা প্রকাশ করি, ইহা তদপেক্ষা অনেক বেশি প্রাচীন। প্রাচীন সভ্যতার কথা উঠিলেই আমরা বৈদিক, ব্যবিলন, বা মিশরের সভ্যতার কথা তুলিয়া এমনভাবে কথা কই, যেন ওইগুলি মানবসভ্যতার আদিম অবস্থা। প্রকৃতপক্ষে ওই সকল সভ্যতা অতি সুপরিণত এবং মানুষের সভ্যতার প্রথম অবস্থা হইতে বহুদূরে অবস্থিত। অনেক বিষয়ে ওই সকল সভ্যতা যেস্থানে আসিয়া পৌঁছিয়াছিল তাহার পর হইতে একাল পর্যন্ত মানুষের সভ্যতা সেদিকে আর বড় বেশি দূর অগ্রসর হয় নাই। এই কথা মনে না থাকায় আমরা যাহাকে আধুনিকতা বলি, প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে পদে পদে তাহার পরিচয় পাইয়া আশ্চৰ্য হই, এবং এই সকল সভ্যতা হইতেও বহু প্ৰাচীন অথচ পরিপুষ্ট সভ্যতার বিবরণ আবিষ্কার হইলে আমরা অতিমাত্রায় বিস্ময় প্রকাশ করি।