৩
কিন্তু এই মহাজন সম্প্রদায়টির ইউরোপে যা প্রভাব ও প্রতিপত্তি ধন গৌরবের উপর তার সামান্য অংশই নির্ভর করছে। যার টাকা নেই। সে যার টাকা আছে তাকে দূরে থেকেই নমস্কার করতে পারে যদি না জীবিকার জন্য তার দরজায় দাড়াতে হয়। এইজন্য ইউরোপের পক্ষে তার মহাজন শ্রেণিটিকে কেবল টাকার খাতির দিয়ে দূরে রাখা সম্ভব নয়। কেননা এই শ্রেণিটিই হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউরোপের অন্নদাতা। আর তা দু’রকমে। নূতন শিল্প ব্যবস্থায় দেশজুড়ে ধনসৃষ্টির যেসব ছোটখাটো ব্যবস্থা ছিল তা লোপ পেয়েছে। একমাত্র কৃষি ছাড়া ইউরোপের সমস্ত ধন প্রকৃতপক্ষে উৎপন্ন হচ্ছে এই মহাজনদের বড় বড় কারখানায়। এবং কৃষি জিনিসটিও আজ ইউরোপের চোখে অতি অপ্রধান শিল্প। কারণ পশ্চিম ইউরোপ আবিষ্কার করেছে নিজের অন্ন দেশে জন্মানোর চাইতে কলের তৈরি শিল্প-সামগ্ৰী দিয়ে বিদেশ থেকে তা কিনে আনাই তার পক্ষে বেশি সহজ ও সুবিধার। এবং সে শিল্পের জন্য যে কৃষিলভ্য কাঁচামালের দরকার তার সম্বন্ধেও সেই কথা। ফলে পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ লোকের জীবিকার উপায় হচ্ছে মহাজনদের এই বড় বড় কারখানাগুলিতে ও তাদের অফিসে হাতে বা কলমে মজুরগিরি করা। অর্থাৎ— এই মহাশ্রেষ্ঠী সম্প্রদায়টি সাক্ষাৎ সম্বন্ধেই এদের মনিব ও অন্নদাতা। আর পরোক্ষে ইউরোপের সবারই অন্নবস্ত্র এরাই জোগাচ্ছে। জীবনযাত্রার যা কিছু উপকরণ তা হয়ে আসছে এদের কারখানা থেকে, নয় তো এদেরই কারখানার কলে তৈরি মালের বিনিময়ে। যাদের হাতে জীবন-মরণের কাঠি রয়েছে তাঁরা যে সর্বময় হয়ে উঠবে এতে আর বিস্ময় কী!!
কিন্তু এ বৈশ্য-প্রভুত্বের সবচেয়ে যা প্রধান কথা তা হচ্ছে আধুনিক যুগের নূতন ব্যবস্থায় এই যে-সব অতিকায় শিল্পবাণিজ্যের প্রতিষ্ঠান মহাজনদের মূলধনে ও চেষ্টায় গড়ে উঠেছে এগুলি যত লোকের অন্ন জোগাচ্ছে এর পূর্বে ইউরোপের পক্ষে তা অসাধ্য ছিল। আর অন্ন বাড়লে যে জীবও বাড়ে এটা প্ৰাণবিদ্যার একবারে প্রথম ভাগের কথা। ফলে গেল একশো বছরের মধ্যে ইউরোপের লোকসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এবং এখন এ বিরাট জনসংঘের জীবিকা জোগাতে হলে ইউরোপের আধুনিক শিল্প-বাণিজ্যের চাকা একদিনও অচল হলে চলবে না। এর আয়তন যদি একটু খাটো কি বেশ একটুকু মন্দা হয় তবে ইউরোপ তার সমস্ত লোকের মুখে আর অন্ন দিতে পারবে না। উনবিংশ শতাব্দীর শিল্প-বাণিজ্যে যে লোক বেড়েছে, বিংশ শতাব্দীতে তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হলে সেই শিল্প-বাণিজ্য ছাড়া আর গতি নেই, এ যে কত সত্য জার্মান যুদ্ধের এক আঁচড়েই তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যুদ্ধের ধাক্কায় এ শিল্প-বাণিজ্যের কল যেই একটু বিকল হয়েছে অমনি ইউরোপ জুড়ে কলরব; ইংল্যান্ডে চিনি নেই, ফ্রান্সে কয়লা নেই, জার্মনিতে চর্বির জন্য হাহাকার, অস্ট্রিয়ায় দুধ না পেয়ে শিশু মরছে। আর একথা আরও স্পষ্ট হয়েছে, গেল-যুদ্ধের ফলে মূলধনী মহাজনদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের রকম-সকমে। রুশিয়ার বোলশেভিক, জার্মানির সোস্যালিস্ট, কি ইংল্যান্ডের ন্যাশান্যালিজেশন পন্থী এমন কথা কারও মুখে ওঠেনি যে, এই যে আধুনিক ইউরোপের দৈত্যাকৃতি সব শিল্প-বাণিজ্য, যা কলের ও কাজের চাপে মানুষকে পিষে ফেলছে, একে ভাঙা দরকার। কেননা ইউরোপ মৰ্মে মৰ্মে জানে যে, এই শিল্প-বাণিজ্যই তার প্রাণ। একে মারতে গেলে মরতে হবে। তাই এখন সবারই লক্ষ্য কী করে এই শিল্প-বাণিজ্যকেই বহাল ও সচল রাখা চলে, কিন্তু তার বর্তমান মালিক মহাজনদের ছেটে ফেলা যায়। এ চেষ্টা সফল হবে কি না তা ইউরোপের ভাগ্যবিধাতাই জানেন। কিন্তু যত দিন না হবে, ততদিন বৈশ্য ইউরোপীয় সমাজ ও রাষ্ট্রের মাথায় চড়েই থাকবে। কেননা ইউরোপের মুখের অন্ন তার হাতের মুঠোয়।
৪
বলা বাহুল্য ইউরোপের বৈশ্য-প্ৰভুত্বের বেগ কেবল ইউরোপ বা ইউরোপিয়ান জাতিগুলির মধ্যেই আবদ্ধ নেই; পৃথিবীময় সে নিজেকে জানান দিচ্ছে। কেননা ইউরোপ আজ সমস্ত পৃথিবীর প্রভু। এবং স্বভাবতই এ প্রভুত্বের প্রয়োগ হচ্ছে ইউরোপের প্রভু বৈশ্যের মারফত, তারই সুবিধা ও প্রয়োজনমতো। ইউরোপের বিজ্ঞান আজ বাহুবলে ইউরোপকে অজেয় ও দুৰ্নিবার করেছে। এবং সমস্ত পৃথিবী প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে ইউরোপের জিত রাজ্য। কিন্তু এ জয় অশ্বমেধের রাজচক্রবর্তীর জয় নয়। যুদ্ধের উল্লাস কি জয়ের গৌরব এর লক্ষ্য নয়। এর উদ্দেশ্য হল জিত দেশ ও পরাজিত জাতিকে ইউরোপের কারখানার কলের চাকায় জুড়ে দেওয়া। যে শিল্প-বাণিজ্য ইউরোপকে অন্নবস্ত্র দিচ্ছে ইউরোপের বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগ তার চাই-ই চাই। সেখানকার মাটির রস টেনেই ওরা বেঁচে রয়েছে। যে কাঁচামাল কলে-তৈরি শিল্পে পরিণত হবে, তা প্রধানত আসছে ইউরোপের বাইরে নন-ইউরোপিয়ান লোকদের দেশ থেকে। জীবনযাত্রার যে-সব উপকরণ, বিশেষ করে খাদ্য, যা ইউরোপের মাটিতে জন্মে না বা কলে গড়া চলে না, তাও বেশির ভাগ আনতে হবে ওখান থেকেই। অবশ্য এ দুই জিনিস ইউরোপ গায়ের জোরে কেড়ে নিতে চায় না। তার কারখানার তৈরি শিল্পের বিনিময়েই কিনতে চায়। কিন্তু এদের জোগান যাতে অব্যাহত, আর পরিমাণ যাতে প্রয়োজনমতো হয় সে ব্যবস্থা তাকে করতেই হবে। কেননা কারখানার কল একদিনও বসে থাকলে চলবে না। সুতরাং এ-সব গরম দেশের অলস লোকেরা যদি নিজের ইচ্ছায়, অথবা লাভের লোভে এ-সব জিনিস যথেষ্ট পরিমাণে উৎপন্ন করে সুবিধা দরে জোগান দিতে না চায় তখন ইউরোপকে বাধ্য হয়েই হাতে চাবুক নিতে হয়, সঙিনের খোচায় এদের কাজের ইচ্ছাকে জাগিয়ে রাখতে হয়। এমনকী দুই-চারজনার হাত পা কেটে দিয়ে তাদের বাকি সঙ্গীদের হাত-পা’গুলো যাতে কলের চাকার বেগের সঙ্গে তাল রাখতে উৎসাহী হয়। সে চেষ্টা থেকেও পশ্চাৎপদ হলে চলে না। জার্মান অধ্যাপক নিকলাই তার যুদ্ধ ও জীবতত্ত্ব’ নামের পুথিতে লিখেছেন যে, পৃথিবীর পঞ্চাশ কোটি ইউরোপিয়ান ও ইউরোপ থেকে ছড়িয়ে-পড়া শ্বেত মানুষের হাতে এখনই এমন যন্ত্রপাতি আছে যে, আসছে বিশ বছরের মধ্যে তাঁরা পৃথিবীর একশো কোটি নানা জাতির অ-শ্বেত মানুষদের একেবারে নির্মূল করে উচ্ছেদ করতে পারে। এবং ফলে সমস্ত পৃথিবীটা কেবলমাত্র, অন্তত নিজেদের চোখে, উন্নততর শ্বেত জাতিদেরই বাসস্থল হয়। এ বিশ বছরের পরে, অর্থাৎ— যখন চিন তার সমস্ত লোককে আধুনিক অস্ত্র ও যুদ্ধ-বিদ্যায় শিক্ষিত করে তুলবে এবং নিজের ‘ড্রেডনট’ ও কামান গোলা নিজেই তৈরি করতে শুরু করবে, যেমন এখন জাপান করছে, হয়তো এ আর সম্ভব হবে না। কিন্তু ইউরোপ যে এ-কাজে হাত দেবে না তা নিশ্চয়, কেননা ব্যাপারটা এমন ভয়ানক যে কল্পনায় তাকে ফুটিয়ে তুললেই পিছিয়ে আসতে হয়। এবং অধ্যাপক নিকলাই-এর মতে এ জেহাদ প্রচার করা মানে স্বীকার করা যে প্রকৃত জীবনযুদ্ধে, যেখানে জয়ী হতে হয় পরকে মারার শক্তিতে নয়, নিজের বাঁচার শক্তিতে, শ্বেতের চেয়ে অ-শ্বেত শ্ৰেষ্ঠ। সুদূর ও সূক্ষ্ম তত্ত্বের আলোচনায় এখানে একটা হাতের কাছের মোটাকথা চোখ এড়িয়ে গেছে। ইউবোপ যদি আসছে বিশ বছরের মধ্যে পৃথিবীর সব অ-শ্বেত জাতিগুলিকে উচ্ছেদ করতে সমর্থ হয় তবে তার পরের দশ বছরের মধ্যে ইউরোপ আর বর্তমান ইউরোপ থাকবে না। তার কল-কারখানার বেশির ভাগই অচল হবে। তার শিল্প-বাণিজ্য সমাজ-রাষ্ট্র সব ব্যবস্থারই মুলে টান পড়বে। কারণ পৃথিবীজুড়ে শস্যক্ষেত্রে, মাঠে, অরণ্যে যে-সব কৃষ্ণ, তাম্র, পীত হাত দ্রব্যসম্ভার জুগিয়ে ইউরোপের সভ্যতার স্কুল শরীরকে স্কুলতর করে তুলছে তার সবগুলিকে যদি সাদা হাত দিয়ে বদল করতে হয় তবে কারখানার কলে দেবার মতো হাত ইউরোপে আর বেশি অবশিষ্ট থাকে না। ইউরোপের লোকসংখ্যার ইউরোপে বসে অন্নসংস্থান অসম্ভব হয়। যে-সব ভিত্তির উপর ইউরোপের বর্তমান সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে একটা প্রধান হল নন-ইউরোপিয়ান ও অ-শ্বেত লোকদের পরিশ্রমের ফল সহজে ও স্বল্পমূল্যে পাওয়া। প্রাচীন গ্রিক-রোমান পণ্ডিতেরা দাসের শ্রম বাদ দিয়ে নিজেদের সভ্যতার অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারতেন না। আধুনিক ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা যে পারেন তার কারণ নােমরূপের বদল ঘটালে জানা-জিনিস চিনতে পণ্ডিতদের কষ্ট হয়; আর মনে যা ওঠে তা স্পষ্ট করে খুলে বলার অভ্যাস প্রাচীন পণ্ডিতদের যত ছিল আধুনিক পণ্ডিতদের তা নেই।