এই যে বৈশ্যপ্রভুর ব্যবস্থা, যার বর্ণ ধর্ম কথনের প্রথম কথা হচ্ছে ব্ৰাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয়, শূদ্র এই তিন বর্ণের এক ধর্ম, চতুর্থ বৰ্ণ বৈশ্যের শুশ্রীষা, এরই নাম “কাপিটালিজম’ বা মহাজন-তন্ত্র। এর নাগপাশ গত একশো বছর ধরে ইউরোপীয় সভ্যতাব প্রতি অঙ্গে পাকে পাকে নিজেকে জড়িয়ে এসেছে এবং আজ তার চাপে সে সভ্যতার দম বন্ধ হবার উপক্রম। গত যুদ্ধের কামানের শব্দে ট্রেঞ্চের মধ্যে জেগে উঠে ইউরোপের সভ্যতা এ বজর্বাধন থেকে নিজেকে মুক্ত করবার যে ব্যাকুল চেষ্টা করছে তারই নাম কোনও দেশে ‘সোভিয়েট’, কোনও দেশে “ন্যাশন্যালিজেশন’।
২
আধুনিক ইউরোপের সমাজ-ব্যবস্থায় যে করে বৈশ্য-প্ৰভুত্বের প্রতিষ্ঠা হয়েছে তার ইতিহাস বিস্ময়কর কিন্তু জটিল নয়। এর মূল ভিত্তি হল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ইউরোপীয় জাতিগুলির মধ্যে জড়-বিজ্ঞানের আশ্চর্য উন্নতি, প্রকৃতির সকল কাজের শক্তি ও নিয়মের জ্ঞানের অচিন্তিতপূর্ব প্রসার এবং সে জ্ঞানকে মানুষের ঘরকন্নার কাজে লাগাবার চেষ্টার অপূর্ব সাফল্য। এর ফলে ইউরোপীয় সভ্যতার স্থূলদেহ উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যে দেখতে দেখতে একেবারে নবী কলেবর নিয়েছে। সে চেহারা ইউরোপের ও ইউরোপের বাইরের পূর্ব পূর্ব যুগের সমস্ত সভ্যতার চেহারা থেকে একেবারে ভিন্ন রকমের। বাষ্প আর বিদ্যুৎ এই দুই শক্তিকে লোহার বাঁধনে বেঁধে ইউরোপ যে শিল্প, কারু, কৃষি, বার্তা, ব্যাবসা, বাণিজ্য গড়ে তুলেছে তার কাজের ভঙ্গি ও সামর্থ্যের সঙ্গে কোনও যুগের কোনও সভ্যতার সে দিক দিয়ে তুলনা করাই চলে না। যেমন ফরাসি অধ্যাপক সেনোবো লিখেছেন–এদিকে অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপের সঙ্গে আজকার ইউরোপের যে তফাত, অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপের সঙ্গে প্রাচীন মিশরের তফাত তার চেয়ে অনেক কম। বলা বাহুল্য এ তফাত কলকারখানা, রেল স্টিমার, টেলিগ্রাফ টেলিফোনে মূর্তিমান হয়ে রয়েছে। এবং আশা করা যায়, অল্পদিনেই মোটর, এরোপ্লেন সে মুর্তির অদল-বদল ঘটিয়ে এ তফাতকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। কিন্তু এই যে ইউরোপ কারখানায় কলে শিল্পসামগ্ৰী তৈরি করছে, রেলে স্টিমারে তার পণ্য পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিচ্ছে, টেলিগ্রাফ টেলিফোনে দাম দস্তুর বেচাকেন। চালাচ্ছে, এর ভিতরের লক্ষ্য কিছুই নুতন নয়। সেটি অতি প্রাচীন, মানুষের সভ্যতার সঙ্গে একবয়সি। সে লক্ষ্য হল–কী করে মানুষের জীবনধারণের ও সে জীবনের শোভা সম্পদ বিধানের সামগ্ৰীগুলিকে যথেষ্ট পরিমাণে জোগান দেওয়া যায়। পশুপালন, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য সবই এই প্রশ্নেরই উত্তর। কেবল উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর ইউরোপ তার শিল্প-বাণিজ্যের কৌশলে ও ব্যবস্থায় এ সমস্যার যে সমাধান করেছে, জিনিসের জোগান হিসাবে তা তুলনারহিত। যা মানুষের অসাধ্য ছিল তা সুসাধ্য হয়েছে; যা বহুদিন, বহুজন ও বহু আয়াসসাধ্য ছিল সামান্য লোকের নামমাত্র পরিশ্রমে তা মুহূর্তের মধ্যে সাধিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞেরা হিসাব করেছেন, আজ কলের তাঁতে একজনে যে কাপড় বোনে সেটা হাতের তাঁতের ত্ৰিশজন তাঁতির কাজ; হাতের চরকার এগারোশো জনের সুতো আজ কলের চরকায় একজন কেটে নামাচ্ছে।
কিন্তু এ নব শিল্প-বাণিজ্যের এই যে অদ্ভুত কৰ্মসমর্থ্য, একে চালনা করতে হলে গুটিকতক উপায় অপরিহার্য। তার মধ্যে প্রধান হল বিপুল আয়তনের উপাদানকে একই জায়গায় একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ শিল্প-সামগ্ৰীতে পরিণত করা এবং তার জন্যে চাই বহু লোককে একত্র জড়ো করে তাদের নানারকম মজুরির সাহায্য। আধুনিক কলের দৈত্য, উপকথার দৈত্যর মতোই নিমেষে পর্বতপ্রমাণ কাজ করে ওঠে, কিন্তু সত্যিকার দৈত্য হওয়াতে সে চায় কাজের পরিমাণ মালের জোগান, আর মানুষের হাতের সাহায্য। সুতরাং শিল্প-বাণিজ্যের এই নূতন কৌশলকে কাজে লাগাতে হলে, চাই দেশ-বিদেশ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে জমা করা, কল গড়ে কারখানা বসানো, আর সে কল-কারখানা চালাবার জন্য নানারকম বহু মজুর একত্র করা। এবং এ-সবারই জন্য চাই টাকা, অর্থাৎপূর্বসঞ্চিত ধন। যাতে মাল কেনা চলবে, কল-কারখানা তৈরি হবে, মজুরের মজুরি জোগাবে। এবং সে টাকা অল্পস্বল্প হলে চলবে না, একসঙ্গে চাই বহু টাকা। কেননা এ ব্যাপারের মূল কথাই হচ্ছে, যা পূর্বে নানালোকে নানা জায়গাতে অল্পেীস্বল্পে এবং অল্পস্বল্প তৈরি করত, তাই করতে হবে এক জায়গায়, এক তত্ত্বাবধানে, বিদ্যুৎগতিতে আর হাজার গুণ বেশি পরিমাণে। ফলে ইউরোপ জুড়ে কল-কারখানা তারাই বসিয়েছে হাতে যাদের ছিল জমানো টাকা এবং কলের চাকার পাকে পাকে নামতার আর্যার মতো সে টাকা বেড়ে উঠেছে। আর টাকা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কলও বেড়েছে। কারখানাও বড় হয়েছে। অর্থাৎটাকার অঙ্কটাও আর বেড়ে চলেছে। আর এও অতি স্পষ্ট যে এই কলের তৈরি মালের রাশিকে দেশ-বিদেশে কাটাতে হলে চাই বড় মূলধনী ব্যবসায়ী, যাঁরা একদমে একে নিঃশেষ করে কিনে নিতে পারবে। ছোট ছোট ব্যবসামীর হাত দিয়ে ধীরে-সুস্থে এ মাল কাটানোর চেষ্টা করা এ-সব কারখানার মালিকদের পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়। এমনি করে আজকার ইউরোপের যে বিরাট ধনসম্পদ তার একটা প্ৰকাণ্ড অংশ এসে জমেছে সংখ্যায় অতি অল্প একটি শ্রেণিবিশেষের হাতে–যাঁরা কারখানার মালিক বা সেই কারখানার মালের ব্যবসায়ী। হিসাবে দেখা গেছে যে আমেরিকার যুক্তরাজ্যে (যা ইউরোপের একখণ্ড ‘ছিট’ মাত্র) দেশের সমুদয় ধনের এক পঞ্চমাংশেরও বেশি রয়েছে লোক সংখ্যার ত্ৰিশ হাজার ভাগের এক ভাগের হাতে। ধনের গৌরব সব দেশে, সব কালেই ছিল ও থাকবে। সুতরাং এই অতি-ধনী বৈশ্য শ্রেণিটি যে ইউরোপের সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিপত্তিশালী হবে এতে আশ্চর্যের কিছুই নেই।