৫
আৰ্যত্বের ‘আর্যামি’ এতক্ষণ যা বর্ণনা করেছি। সে হল তার একটা মাত্র দিক। কেননা ব্ৰহ্মের যেমন দুইরূপ, এ আর্যামিরও তেমনি দুই মূর্তি; সগুণ ও নিৰ্গুণ, ক্রিয়াশীল ও নিস্ক্রিয়। বলা বাহুল্য যে, বর্তমানে এর প্রথমটির বিকাশ হয়েছে ইউরোপের আর্য-সমাজে, দ্বিতীয়টির পূৰ্ণ-প্রকাশ আর্যভূমি ভারতবর্ষে। পশ্চিম শাখাটি দাবি করছে সর্বজ্ঞত্ব ও সৰ্বেশ্বরত্ব; তার ক্রিয়ার দাপটে আর সকলের হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া একরকম রুদ্ধ। আর পুবের শাখাটি ‘নিষ্কলং নিস্ক্রিয়ং শান্তং’, ‘অপ্ৰাণ’ ও ‘আমন’। সকলেই জানে যে সগুণত্বের সিঁড়ি দিয়েই নির্তৃণত্বে পৌছিতে হয়। ভারতীয় আর্যেরাও অবশ্য তাই করেছেন। ক্রিয়াশীলত্বের সিঁড়ি দিয়ে নিস্ক্রিয়ত্বের ছাদে এসে পৌছেছেন। এটা যে পরমার্থের অবস্থা তাতে সন্দেহ নেই, কেননা ‘একরূপে অবস্থিত যে অৰ্থ’ তাই হল পরমার্থ। যাঁরা এ অবস্থা থেকে ভারতের আৰ্য-সমাজকে আবার সচল অবস্থায় নিতে চান তাঁরা ইভলিউশনের’’ গতিবিধির কোনও খবরই রাখেন না।
যাহোক, আৰ্যামির এই সগুণ ও নিৰ্গুণ প্রকাশের মধ্যে একটি আন্তরিক মিল রয়েছে, কেননা এ দুই হলেও মূলে এক। সে মিলটি হচ্ছে যে, দুয়ের পথই বিবেকানন্দ যাকে বলেছেন ছুৎমাৰ্গ, বাইরের স্পর্শ থেকে বাঁচিয়ে নিজের শুচিত রক্ষা করা। তবে পশ্চিমের ওদের পথ হল আর সবাইকে তাড়ানো, আমাদের কৌশল হল সবার কাছ থেকে পালান। শেষ পর্যন্ত কোনটায় বেশি ফল হয় বলা কঠিন।
মানুষে মানুষে চরিত্র ও মনের শক্তির যে তফাত, জাতির সঙ্গে জাতির সে তফাতের চেষ্টার কোনও অর্থ আছে কি না, এবং থাকলে সেটা ঠিক কোথায় সে তর্ক না-হয় নাই তোলা গেল। মেনে নেওয়া যাক, এ তফাত আছে। কিন্তু প্ৰভেদমাত্রই উচু নিচুর সম্বন্ধ নয়, এবং বর্তমান পৰ্যন্ত কাজের পরিমাণও একটা জাতির শক্তিসামর্থ্যের শেষ প্রমাণ নয়। কেননা মানুষের ইতিহাস কিছু শেষ হয়ে যায়নি যে, এখনই লাইন টেনে হিসাব নিকাশ আরম্ভ করা যেতে পারে। আজ যাঁরা পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ ও প্রবল, তাঁরা ট্যাসিটাসের জার্মনেরই বংশধর। তখন দাড়ি টেনেছিলেন বলে ট্যাসিটাসের ঠিকে যদি ভুল হয়ে থাকে, তবে এখন দাড়ি টেনে স্টুয়ার্ট চেম্বারলেইন-এর ঠিকই বা শুদ্ধ হবার সম্ভাবনা কোথায়! আর শ্রেষ্ঠত্ব, তার অর্থ যাই হোক, যদি প্রভুত্বের নিয়োগপত্র হয়, তবে তার শেষ কোথায়? আৰ্যত্ব এমনকী ইউরোপীয় আৰ্যত্বের সীমায় এসেই বা তার গতিরোধ হবে কেন? শ্রেষ্ঠের মধ্যেও শ্রেষ্ঠতমের দাবি কেনই বা না চলবে! কেননা, ‘আৰ্যামি’ ভেদেরই মন্ত্র, মৈত্রীর বন্ধন নয়। শোনা যাচ্ছে যে বর্তমান যুদ্ধ আরম্ভ হবার পরেই ফ্রান্সের নৃতত্ত্ববিদ পণ্ডিতেরা প্রমাণ করেছেন যে, প্রশিয়ানরা মোটেই আৰ্য-জাতির লোক নয়, তাঁরা ইউরোপের প্রস্তর যুগের অধিবাসীদের একবারে অবিমিশ্র বংশধর। এবং সে যুগের যে-সব মাথার খুলি পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে বর্তমান কালের যে মাথার সবচেয়ে আশ্চর্যজনক মিল, সে হচ্ছে প্ৰিন্স বিসমার্কের মাথা।
মানুষের সভ্যতা যাঁরা গড়ে তুলেছেন, তাঁরা সবাই অসাধারণ মানুষ। কিন্তু কোনও বিশেষ বংশ, কুল বা জাতি থেকে তাঁরা আসেননি। এবং নিজের বংশ, কুল বা জাতির সঙ্গে তাদের যে মিল তার চেয়ে অনেক বেশি মিল পরস্পরের সঙ্গে। শুদ্ধোদন যখন শাক্যকুলের সিদ্ধার্থের ভিক্ষুবেশ দেখে ব্যথিত হয়েছিলেন তখন ভগবান বুদ্ধ তাকে বলেছিলেন যে, এই তাঁর কুলধৰ্ম; তাঁর বংশ রাজবংশ নয়, বুদ্ধেরা তার পূর্বপুরুষ। প্রকৃতির এই যে ইঙ্গিত, এই হল মানুষের মিলনের সত্য পথের ইঙ্গিত। বংশ, কুল, জাতি কিছুই অসত্য নয়, কিন্তু সে সত্য হল ব্যাবহারিক। এরা কাজ চালাবার উপায়, কিন্তু মৈত্রীর সম্বন্ধ কাজের সম্বন্ধ নয়। এই কাজ চালাবার দলকে ধরে মানুষের মধ্যে মৈত্রীস্থাপনের চেষ্টা পণ্ডশ্রম। কেমন দলের সঙ্গে দলের সম্বন্ধ সব সময়েই থাকবে কাজের সম্বন্ধ, সে ‘অ্যালায়েন্সই হোক, আঁতাতই হোক, আর লিগ অব নেশনই হোক। তাতে শান্তি আসতে পারে। কিন্তু মৈত্রী আসবে না। কেননা মৈত্রীর জন্য চাই মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন, দলের সঙ্গে দলের আদান-প্ৰদান নয়। এবং সে কেবল তখনই সম্ভব, যখন বংশ, জাতি, রাষ্ট্রের প্রাচীর মানুষের চেয়েও উচু হয়ে উঠে দৃষ্টিকে বাধা না দেয়; যখন নামরূপের মায়া যা এক, তাকে বহু করে দেখানোর কাজ থেকে নিবৃত্ত হয়।
——————–
(১) ‘কুলোপদেশেন হয়োহপি পূজ্য
স্তস্মাৎ কুলীনাং স্ক্রিয়মুদ্বহন্তি ॥’ (বশিষ্ঠ-সংহিতা)
বৈশ্য
মনু উপদেশ করেছেন, শূদ্র সমর্থ হলেও ধনসঞ্চয় করবে না। কেননা বহু ধনের গর্বে সে হয়তো ব্ৰাহ্মণকেও পীড়া দিতে আরম্ভ করবে। অথচ এই ভৃগুসংহিতা যে-সমাজের ধর্মশাস্ত্র তার ধনসৃষ্টি ও ধনসঞ্চায়ের কাজটি ছিল বৈশ্যের হাতে। এ বর্ণটি সম্বন্ধে যে শাস্ত্রকারের এমন আশঙ্কা হয়নি, সম্ভব তার কারণ বৈশ্য ছিল আৰ্য সভ্যতার ভিতরের লোক-দ্বিজ। শাস্ত্রের শাসন ছাড়াও তার মনে এই সভ্যতার বাঁধন ছিল, যার টানে কেবল ধনের জোরে বিদ্যা ও বুদ্ধিকে ছাড়িয়ে চলার কল্পনা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল।
বিংশ শতাব্দীর বৈশ্যের অবশ্য কোনও ধর্মশাস্ত্রের বালাই নেই; সভ্যতার বাঁধনকেও সে একরকম কাটিয়ে উঠেছে। কেননা বৈশ্য আজ সভ্যতার মাথায় চড়ে ব্ৰাহ্মণকে ডেকে বলছে, তোমার কাজ হল আমার কারখানার কল-কবজা গড়া, কাঁচামালকে কেমন করে সস্তায় ও সহজে তৈরি মাল করা যায় তার ফন্দি বাতলানাে; না হয় আমার খবরের কাগজে আমার – মতলবমতো প্ৰবন্ধ জোগানো। শূদ্রকে বলছে, এসো বাপু ! তোমার স্ত্রী-পুত্ৰ-কন্যা নিয়ে, লেগে যাও আমার কলের কাজে; পেট-ভাতার অভাব হবে না। আর জেনো এই হচ্ছে সভ্যতা, এতে অসূয়া করা মানে দেশদ্রোহ, একেবারে সমাজের ভিত ধরে নাড়া দেওয়া। ক্ষত্রিয়কে বলছে, হুঁশিয়ার থেকে যেন এই যে ব্ৰাহ্মণ-শূদ্রের তৈরি আমার কলের মাল দিকে দিকে ছুটিল, জলে স্থলে এর গতিকে অবাধ রাখতে হবে, তোমার কামান, বন্দুক, জাহাজ, এরোপ্লেন যেন ঠিক থাকে। বিদেশের বৈশ্য যদি এই বণিকপথের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে, নিজে গুডো হয়ে তাকে গুড়ো করতে হবে। তাতে দেশের জন্য প্ৰাণ দিয়ে তোমারও অক্ষয় কীর্তি লাভ হবে, আমারও গোলাগুলি, রসদ, হাতিয়ারের কারখানার মুনাফা বেড়ে যাবে। আর ঘরেও তোমার কাজের একেবারে অভাব নেই। আমার কলের মজুরেরা অতিরিক্ত বেয়াড় হয়ে উঠলে তাদের উপর গুলি চালাতেও মাঝে মাঝে তোমার ডাক পড়বে।