উপরের বর্ণনায় আৰ্যজাতির আধিপত্য-দাবির অংশটা, অর্থাৎ এ ন্যায়ের প্রতিজ্ঞাটি, প্ৰসিদ্ধ লেখক হাউস্টন চেম্বারলেইনের ‘উনবিংশ শতাব্দীর ভিত্তি’ নামক অপূর্ব গ্রন্থ থেকে অনুবাদ করে দিয়েছি। চেম্বারলেইন জাতিতে ইংরেজ, শিক্ষায় জার্মান; এবং তাঁর পুথি রচনা করেছেন জার্মানভাষায়। যাঁরা চেম্বারলেইন-এর মতামতের খুব সদয় সমালোচক নন তাঁরাও স্বীকার করেছেন যে, তার হাতের কলম হল সোনার কাঠি। বস্তুত সে কলম যে সলীল ও স্বচ্ছন্দ গতিতে প্রাচীন ও আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার বিচিত্র ইতিহাসের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে, তাতে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। তাঁর গ্রন্থের প্রায় প্রতি পৃষ্ঠা থেকে যে রসজ্ঞতা ও সূক্ষ্ম-বিশ্লেষণ, শ্ৰদ্ধা ও ঘূণা, অনুরাগ ও বিদ্বেষের তীব্র আলো ঠিকরে পড়ছে তাতে অল্প-বিস্তর চোখ না। ঝলসে যায় না। কিন্তু আর্যজাতির পক্ষে এই যে সর্বাধিপত্যের দাবি, যা র্তার পুথিতে গোঁড়া থেকে শেষ পর্যন্ত, বারবার উপস্থিত করা হয়েছে, এর কদৰ্যতা ও ভীষণতা চেম্বারলেইন-এর কলমের কালিতেও একটুকুও ঢাকা পড়েনি।
কেননা এর পাণ্ডিত্যের পোশাক আর যুক্তির মুখোশ খুলে ফেললে যা বেরিয়ে পড়ে, সে হচ্ছে আদিম নগ্ন বর্বরতা, যা নিজের দলের বাইরে কাকেও শত্ৰু ছাড়া আর কিছু মনে করতে পারে না। এবং হয় মৃত্যু নয় দাসত্ব এ ছাড়া সে শত্রুতার আর কোনও অবসানও কল্পনা করতে পারে না। হয়তো মানুষের ইতিহাসে এমন এক দিন ছিল যখন সমস্ত জাতি মানুষের দল, কি আর্য কি অনাৰ্য, এই মনোভাব নিয়েই প্ৰতিবেশী অন্য সব দলের সঙ্গে কারবার করত। এবং এও সম্ভব যে এই নির্মম বিরোধের উষ্ণ রক্তের স্পর্শেই মানুষের সভ্যতার প্রথম উন্মেষ ঘটেছে, তার সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যবহারে প্রাণ ও গতিসঞ্চার হয়েছে। কিন্তু মানুষের এই যে আদিম ভয় ও বিদ্বেষ, লোভ ও নিষ্ঠুরতা, এ হল প্রকৃতির অদম্য ও অন্ধ শক্তিরই রূপান্তর। এ তর্ক করে না, যুক্তি দেয় না, ন্যায়ের দোহাই পাড়ে না, সুন্দরবনের বাঘের মতো শিকার দেখলেই তার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে। দামোদরের বন্যার ধবংসলীলার মতো ধর্মশাস্ত্রের প্রমাণে এরও কোনও বিচার চলে না। কিন্তু যখনই তর্ক করে, যুক্তি দিয়ে, ন্যায়-ধর্মের ইন্দ্ৰজাল সৃষ্টি করে জাতির উপর জাতির আধিপত্যকে, দলের সঙ্গে দলের শত্ৰুতাকে খাড়া রাখতে হয় তখনই বুঝতে হবে যে, সে জাতি প্রকৃতির গোড়ার ধাপ ছাড়িয়ে উঠেছে। কারণ সে জাতির কাছে নিঃসন্দেহ প্ৰমাণ হয়েছে যে জাতির সঙ্গে জাতির, দলের সঙ্গে দলের এক শত্রুতার সম্বন্ধ ছাড়া অন্য সম্বন্ধ সম্ভব, এবং সেই সম্বন্ধই নিত্য ও ঘনিষ্ঠ। এ ধাপে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির ধর্মকেই ধর্মের বিচারে আশ্রয় করলে ধর্মও এখন তাকে বিচার করবে। প্রস্তাবনা ও প্রথম অঙ্ককে সমস্ত নাটকের ভিতর দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে টানতে চেষ্টা করলে কাব্যের সৌন্দৰ্য তাতে কেবল আঘাতই পাবে।
মানুষের সভ্যতায় আর্যজাতির দান অনেক, হয়তো অপূর্ব ও অতুলনীয়। কিন্তু মানুষের উপর তার আর্যামির আঘাতও কম প্রচণ্ড নয়। আৰ্য-রোম অনাৰ্য-কার্থেজকে একবারে ধুলা না করে তৃপ্ত হয় নাই, অর্থাৎ অন্য একটা সভ্যতাকে একবারে ধ্বংস না করে নিজের সভ্যতাকে বজায় রাখবার কোনও পথ সে খুঁজে পায়নি। যে হিন্দু আৰ্য ওষধি ও বনস্পতিতে বিশ্বপ্রাণের স্পন্দন উপলব্ধি করেছে, ‘দসু্য’ ও ‘রাক্ষসের প্রাণের উপর সেও কোনও মায়া দেখায়নি। আধুনিক ইউরোপীয় আৰ্য দুটি মহাদেশ থেকে সেখানকার অনাৰ্য অধিবাসীদের একেবারে মুছে ফেলেছে, এবং আর একটা মহাদেশ থেকেও মুছে ফেলবার চেষ্টায় আছে। এ চেষ্টার সমর্থনে যুক্তির অবশ্য অভাব নেই। এই উচ্ছেদ ও ধ্বংস না হলে যে আধুনিক আৰ্য-সভ্যতার যে গৌরব, তারও বিকাশই হতে পারত না। এই গরীয়সী সভ্যতাকে পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেওয়াই হল ধর্ম। এবং যাদের রক্তের মধ্যে এই সভ্যতা রয়েছে তাদের সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া ছাড়া এর অন্য কোনও উপায় নেই। তাতে যদি অন্য সব জাতিকে পৃথিবী ছেড়ে গিয়েও এর জায়গা করে দিতে হয় মানবজাতির পক্ষে সেও মঙ্গল। লক্ষ্মণের কাছে অগস্ত্য-ঋষির পরিচয় দিতে রামচন্দ্র তীকে ‘পুণ্যকৰ্মা’ বলে উল্লেখ করেছেন, কেননা তার ত্ৰাসে দক্ষিণ দিকে ‘রাক্ষসেরা পা বাড়াতে সাহস না করায় সে দিকটা ‘লোকদের’ বাসের উপযুক্ত হয়েছে। এবং এ যুক্তির উত্তর দেওয়াও কঠিন। কেননা যা ঘটেছে তার বিরুদ্ধে যা ঘটেনি। তাকে ওজনে তোলা চলে না। বর্তমান আৰ্য-সভ্যতা না গড়ে উঠলে আৰ্য অনাৰ্য মিশাল সভ্যতা কীরকমের হত, কি তেমন কোনও সভ্যতা সৃষ্টি হতে পারত কি না। এ তর্ক এখন তোলা একবারেই নিস্ফল, কারণ এর কোনওরকম মীমাংসার সুদূর সম্ভাবনাও নেই। কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের উপর আধিপত্য ও উচ্ছেদের দাবিটাও যে কত অচল, মানুষের সভ্যতার গোটা ইতিহাসটাই তার প্রমাণ। এ দাবির গোড়ার কল্পনা হল এই যে, যে জাতি একবার বড় হয়ে উঠেছে সে চিরকালই বড় থাকবে, এবং আর কেউ বড় হয়ে উঠতে পারবে না। অথচ যেসব জাতির পর জাতি এতকাল ধরে মানুষের সভ্যতাকে কখনও ধীরে কখনও দ্রুত গড়ে তুলেছে তাদের কেউ কারও বংশধর নয়। আজই কি হঠাৎ মানুষের সভ্যতায় এই ধ্বংস ও সৃষ্টি লীলা থেমে গেল!! অথচ চিরকালই তো যে মাথায় উঠেছে সেই মনে করেছে সে একেবারে অচ্যুত। এবং পূর্ব পূর্ব শ্রেষ্ঠ জাতির পতন হলেও তার যে কেন সেটা ঘটবে না। তার কারণ খুঁজে বের করতে কারও কখনও কষ্ট হয়নি। প্রতিদিন জীব যম-মন্দিরে যাচ্ছে দেখেও অমরত্বের কল্পনা আশ্চর্য সন্দেহ নেই, কিন্তু আরও বেশি আশ্চর্য এই কল্পনা যে, যাঁরা বেঁচে আছে তাঁরা যে কেবল অমর হবে তা নয়, আর নতুন কারও জন্মও হবে না।