৩
‘আৰ্যামি’ যত রকমের আছে, বলা বাহুল্য, তার মধ্যে সেরা হচ্ছে জন্মগত ‘আৰ্যামি’। এর কারণও খুব স্পষ্ট। জন্মকে ভিত করে ‘আর্যামিীর অহংকার দাড় করানো যেমন সহজ, এর শ্ৰেষ্ঠত্বের স্পর্ধাটাও হয় তেমনি গগনস্পশী। জন্মের উপর যে জীবের গুণাগুণ নির্ভর করে তা ঘোড়ার বংশে যখন ঘোড়া আর গোরুর বংশে গোরুই জন্মাচ্ছে তখন অস্বীকার করবার জো নেই। আর ভেদটা কেবল পৃথক-জাতীয় ভেদ নয়, স্বজাতীয় ভেদও বটে। সে কথা নবীন লেখক হাউস্টন চেম্বারলেইন ও প্রাচীন ঋষি বশিষ্ঠ(১) দুজনেই তেজি ঘোড়ার উচু বংশের দৃষ্টান্তে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং জন্মের উপর শ্রেষ্ঠতার দাবিকে ভিত্তিহীন বলে সরাসরি অগ্রাহ্য করা চলে না, এবং এ দাবি উপস্থিত করতেও এক জন্মানো ছাড়া আর কিছুই অপরিহার্য নয়। কোনও বিশেষ বংশের সঙ্গে বিশেষ গুণের যোগাযোগ আছে কি না। সে তর্ক তোলা যায় বটে, কিন্তু এর মীমাংসার কোনও সম্ভাবনা না থাকাতে কারও কোনও ভয়ের কারণ নেই। বর্তমান বংশধরদের মধ্যে গুণটানা থাকলেই যে সে গুণ বংশে নেই এটা একেবারেই প্ৰমাণ হয় না। কেননা বর্তমানে হয়তো। ওটা ‘লেটেন্ট’ ভাবে রয়েছে, ভবিষ্যবংশীয়দের মধ্যে ঠিক ফুটে বেরোবে! ‘অ্যাটেভিজম’ যে একটা প্ৰত্যক্ষ ব্যাপার তার ভুরিভুরি দৃষ্টান্ত তো ডারউইনের পুথিতেই রয়েছে! ‘জার্ম প্ল্যাস্ম্ জিনিসটি যে অমর, সে তথ্য বাইস-ম্যানই প্ৰমাণ করে গেছেন।
আর এই সহজ দাবিটির বহরই বা কী বিরাট। এ যে শ্রেষ্ঠত্ব, এ মিশে রয়েছে একেবারে রক্তের সঙ্গে, তৈজস-নাড়ির অণুতে অণুতে। যার সঙ্গে সে রক্তের সম্পর্ক নেই, সে সারা জীবন তপস্যাতেও এর কাছে ঘেঁষতে পারবে না। অথচ এই দুর্লভ মহত্ত্ব যাঁরা পেয়েছে তাঁরা পেয়েছে একবারে বিনা আয়াসে; মিতাক্ষরা বংশের ছেলের মতো কেবলমাত্র জন্মের জোরে ও জন্মের সঙ্গে। একে লাভ করতেও যেমন আয়াস নেই, বজায় রাখতেও তেমনি কষ্ট নেই। কেননা এ শ্ৰেষ্ঠত্বকে ঝেড়েও ফেলা যায় না, এর নষ্ট হবারও ভয় নেই। সহজ কথায় জন্মগত আৰ্যামিটি হচ্ছে দল বেঁধে প্রতিভা ও আরও কিছু উপরির দাবি। কেননা প্রতিভারও উত্তরাধিকার নেই।
এ-কথা বোধহয় আর না বললেও চলে যে, মিত্তির বংশের গৌরব ও নয়নজোড়ের বাবুয়ানা থেকে আরম্ভ করে কুলীনত্ব, ব্ৰাহ্মণত্ব, দ্বিজত্ব, শ্বেতচর্মত্ব এবং অবশেষে আৰ্যত্ব পর্যন্ত সবই হল জন্মগত আৰ্যামিরই প্রকারভেদ। এর প্রতিটিই একটা-না-একটা আস্ত দলের পক্ষে অসাধারণত্বের দাবি। অবশ্য কোনও দল ছোট, কোনওটি মাঝারি, কোনওটি অতি প্রকাণ্ড। কিন্তু সর্বত্রই দলের লোকদের পরস্পর সম্বন্ধ হচ্ছে সপিণ্ড সম্বন্ধ, হয় বস্তুগত্যা, নয় কল্পিত। তবে এ সপিণ্ডত্বের সাত পুরুষে নিবৃত্তি হয় না। দরকার হলে একে ব্ৰহ্মার মুখ পর্যন্ত, কি আদি আর্যভূমির আদিম আৰ্য-দম্পতি পর্যন্ত অনায়াসে টেনে নেওয়া চলে। এবং যাঁরা খবর রাখেন, তাঁরা বোধহয় এর একটাকে আর একটার চেয়ে বড় বেশি অপ্রামাণ্য বলতে সাহসী হবেন না।
৪
জন্মগত আৰ্যামি এ পর্যন্ত যত রকমের দল ধরে প্রকাশ হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় দল হল আৰ্যত্বের দল। আৰ্যামি ও আর্যত্ব দুটি যে এক জিনিস নয়, দ্বিতীয়টি প্রথমটিরই প্রকারবিশেষ মাত্র, এতক্ষণের আলোচনায় এই কথাটি নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয়েছে; সুতরাং এর পুনরালোচনা নিম্প্রয়োজন। কিন্তু এই ‘আৰ্যামি’ বিশেষের দু-একটি বিশেষত্বের আলোচনা না করলেই নয়। কেননা আৰ্যামির এই বিরাট প্রকাশটিকে একবার ধারণা করতে পারলেই আৰ্যামির স্বরূপ বুঝতে আর কিছু বাকি থাকবে না।
এই আর্যামির ছোটখাটো দাবিটি কতকটা এইরকমের— পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টির পর থেকে যতসব জাতির আবির্ভাব হয়েছে, আর্যজাতি যে তাদের মধ্যে কেবল সর্বশ্রেষ্ঠ তা নয়, তার শ্রেষ্ঠত্ব একবারে অতুলনীয়। আৰ্যেন্তর কোনও জাতির সঙ্গে শরীরে কি মনে তার কোনও তুলনাই চলে না। আদিকাল থেকে একাল পর্যন্ত মানব-সভ্যতার যা কিছু সৃষ্টি তা সবই হয়েছে আৰ্যজাতির কোনও-না-কোনও শাখার হাত দিয়ে। অন্য সব জাতির সামান্য যা দান, তা সফল ও সার্থক হয়েছে, কেবল আৰ্য-মহারাজ তা গ্ৰহণ করে নিজস্ব করেছেন বলে। এ জাতির যা আচার, ব্যবহার, ধর্ম, সমাজ তাই হল সদাচার, সধর্ম, শিষ্ট সমাজ, আর এর বাইরে সবই অনাৰ্য’ ও ‘বারবারিকা’। সুতরাং পৃথিবীর আধিপত্যে আর্যজাতির যে দাবি সে খাঁটি ন্যায়ের দাবি। গ্রিক-আৰ্য আরিস্টটল বলেছেন যে হঠাৎ যদি পৃথিবীতে একদল লোকের আবির্ভাব হয়, যাঁরা কেবল শরীরের আয়তনে ও গড়নে দেবতাদের মতো আর সব মানুষের চেয়ে তফাত ও শ্রেষ্ঠ তবে সবাই নির্বিবাদে স্বীকার করবে যে, আর সমস্ত লোকের উপর তাদের আধিপত্যের ধর্ম ও ন্যায়সংগত অধিকার রয়েছে। এবং যদি কেবল সামান্য দেহের সম্বন্ধেই এ কথা ঠিক হয়, তবে মনে যাঁরা অসাধারণ সাধারণ লোকের উপর তাদের আধিপত্যের অধিকারটা কত বেশি! এই কথাটাই খুব অল্পের মধ্যে প্রকাশ করে তিনি বলেছেন যে, ‘এক জাতির লোক স্বভাবতই স্বাধীন, আর এক জাতির লোকের স্বভাবই দাসত্ব।’ এই হচ্ছে সার সত্য। কেননা স্বাধীনতা জিনিসটা মনুষ্যত্বের সামান্য ধর্ম নয় যে সব মানুষেরই তাতে কোনও অধিকার আছে; কারণ এ তো খুব স্পষ্ট যে, সে অধিকার নির্ভর করে স্বাধীনতার মূল্যোপলব্ধির ক্ষমতার উপর, যার ভিত্তি হল দেহের ও মনের শক্তি। এ কথা খুব নিৰ্ভয়েই বলা চলে যে, অনেক জাতির লোক রয়েছে স্বাধীনতার কল্পনাও যাদের অজ্ঞাত। সেইজন্য দাসত্ব কি প্ৰভুত্ব দুই অবস্থাই তাদের সমান। যতটুকু উন্নতি তাদের সম্ভব, অবস্থাভেদে তার কোনও প্রভেদ ঘটে না। ইহুদি, চিনা, সেমিটিক ও অর্ধসেমিটিক জাতিগুলি এর দৃষ্টান্ত।