আধুনিক ইউরোপীয় রাজ্যগুলির মধ্যে ‘ইন্টারন্যাশানাল ল’ বলে যে আপসি ব্যবহারনীতির চলতি আছে, সকলেই জানে যে, তার গোড়ার কথা হচ্ছে সমাজে বা রাষ্ট্রে মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবহারের যে-সব নিয়মকানুন গড়ে উঠেছে, রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের ব্যবহারে সেইগুলিকে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। ডাচ পণ্ডিত হুগো গ্রোসিয়াসকে এই আন্তর্জাতিক ধর্মশাস্ত্রের প্রবর্তক বলা চলে। এ সম্বন্ধে যিনি কিছুমাত্র আলোচনা করেছেন তিনিই জানেন যে, রোমান ব্যবহারশাস্ত্ৰে লোক-ব্যবহারের যে নিয়মগুলি সর্বসাধারণ, সুতরাং স্বাভাবিক বলে গণ্য হয়েছিল, গ্রোসিয়াস সেইগুলিকেই তাঁর মৈত্রীবিগ্ৰহ সংহিতার ভিত্তি করেছিলেন। ব্যক্তির নীতিকে সমষ্টির রীতি করে তোলার এই চেষ্টা কতদূর সফল হয়েছে, ১৯১৪ সালে তার একটা পরীক্ষা আরম্ভ হয়েছে, এবং ১৯১৮ সালেই তার শেষ হয়েছে এমন মনে করবার কোনও সংগত কারণ নেই।
একটা অবাস্তর কথা দিয়ে ‘আৰ্যামির এই উৎপত্তি পর্বের অধ্যায় শেষ করা যাক। ইংরেজ-দার্শনিক হবস গ্রোসিয়াসেরই সমসাময়িক লোক ছিলেন। তিনি কল্পনা করেছিলেন যে, আদিতে মনুষ্য-সমাজ রাষ্ট্রবদ্ধ ছিল না। এবং কাজেই পরস্পরের প্রতি ব্যবহারের কোনও বঁধাের্বাধি নিয়মও চলতি ছিল না। সে ছিল একটা নিত্য বিগ্ৰহ বিবাদের যুগ, যখন প্রত্যেকেই ছিল প্ৰত্যেকের শত্ৰু, এবং সবারই হাত তখন সবারই বিরুদ্ধে তোলা থাকত। এই ভয়ানক দুরবস্থাটা মোচন করবার জন্যই সবাই মিলে একটা ‘স্টেট’ গড়ে তার হাতে আত্মসমৰ্পণ করেছে, এবং ‘স্টেট’ পরস্পরের প্রতি ব্যবহারের আইন-কানুন বেঁধে দিয়ে বৈষম্যের জায়গায় শান্তি এনেছে। বহু পণ্ডিত প্ৰমাণ করেছেন এবং এখনও করছেন যে, হবসের এই কল্পনাটা একেবারে অনৈতিহাসিক। মানুষ কোনওদিনই সমাজ ছাড়া ছিল না, এবং কোনও রাষ্ট্র-গড়ার মজলিসের প্রসিডিং, কি পাথরে কি তামায়, এ পর্যন্ত কোনও পুরাতত্ত্ববিদই আবিষ্কার করতে পারেননি। কিন্তু একটা সন্দেহ মনে না এসে যায় না। মানুষের আদিম অবস্থার এই যে কল্পনাটা সেটা হবস নিয়েছিলেন তাঁর সমসাময়িক ইউরোপীয় রাজ্যগুলির পরস্পরের সম্বন্ধ থেকে। অর্থাৎ গ্রোসিয়াস চেয়েছিলেন, লোক-ব্যবহারের নীতি নিয়ে এই সম্বন্ধকে নিয়ন্ত্রিত করতে, আর হবস কল্পনা করেছিলেন, এই নীতি নিয়ম প্রচলনের পূর্বে লোকের সঙ্গে লোকের সম্বন্ধ ছিল রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্বন্ধেরই মতো। পাঠককে মনে করিয়ে দিচ্ছি যে গ্রোসিয়াসের বিখ্যাত পুথির ছাব্বিশ বছর পরে হবসের ‘লিভিয়াথন’ প্ৰকাশিত হয়।
২
আৰ্যামির জন্ম রহস্যটা একবার প্রকাশ হলে তার জীবন-চরিত্যের হেরফেরগুলো বুঝতে আর কষ্ট হয় না।
বড় হোক, ছোট হোক একটা দলের নাম দিয়ে নাকি এ জিনিসটিকে চালাতে হয়, তাই শ্রেষ্ঠত্বের দাবিকে অল্প-বিস্তর মোটারকম বাহ্যিক লক্ষণের উপরেই দাড় করানো ছাড়া উপায় থাকে না। গায়ের চামড়ার রং, মাথার খুলির মাপ, সাগরবিশেষের পশ্চিম পারে কি পর্বতবিশেষের উত্তর ধারে নিবাস স্থান, খাবার জিনিসে নাইট্রোজেনের প্রাচুর্য কি স্নেহ-পদার্থের আধিক্য, পূর্বপুরুষ ঘোড়ায় চড়ে বর্শা চালাতেন কি মাটিতে দাঁড়িয়ে তির ছুড়তেন, এইরকম যাহোক কিছু একটার উপরেই একটা প্ৰকাণ্ড অভিমানের ইমারত গড়ে তুলতে হয়। অবশ্য এই চর্মাস্থি-বিদ্যা, ভৌগোলিক-তথ্য, ভক্ষ্যাভক্ষ্য-বিচার এর প্রত্যেকটিরই ‘ইনুয়েন্ডো’ বা ইঙ্গিত হচ্ছে মানসিক ও আধ্যাত্মিক গুণাবলির এক একটি লম্বা ফর্দ। এ-সব লক্ষণের সঙ্গে এ-সব গুণের কোনওরকম অন্যথা সিদ্ধিশূন্য’ বা নিত্যসম্বন্ধ আছে কি না সে সন্দেহে আৰ্যামির অভিমানকে কখনও সংকুচিত হতে হয় না। কেননা লক্ষণগুলি হল বাহ্যিক অর্থাৎ প্রত্যক্ষ, আর গুণগুলি হল নিগূঢ় অর্থাৎ আনুমানিক। প্রত্যক্ষ নিয়ে তর্ক চলে না, আর তর্কের ভূমিই হল অনুমান। এবং তর্ক জিনিসটার সুবিধা এই যে, এ ব্যাপারে পরাজয় নির্ভর করে বিপক্ষের শক্তির উপর নয়, নিজের ইচ্ছার উপরে। নিজে স্বীকার না। করলে তর্কে হার হয়েছে, এ অবশ্য কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। কেননা সেইটিই হবে আবার একটা তর্কের বিষয়।
ব্যক্তির অহংকারের চেয়ে সমষ্টির অহংকারের একটা শ্রেষ্ঠত্ব এই যে, এক এক যা নিয়ে কোনওরকমেই অহংকার করা চলে না, দল বেঁধে তাকেই একটা দুৰ্জয় অহংকারের কারণ করে তোলা যায়। এক যুগের ফরাসিরা সে যুগের ইংরেজদের বুদ্ধিসুদ্ধিতে বিশেষ মুগ্ধ না হয়ে, তাদের নাম দিয়েছিল ‘জনবুল’। আজ ইংল্যান্ডের খবরের কাগজ লেখকেরা এই নামটাকেই একটা উৎকট জাতীয়-অভিমান প্রকাশের রাস্ত করে তুলেছে। এ-জাতির বুদ্ধি যে একটু মোটা বলে বোধ হয়, তার কারণ এ-বুদ্ধি হালকা নয়, গুরুতর রকমের ভারী; এতে যে বেশি ঢেউ খেলে না, এর অতলস্পর্শ গভীরতাই হল তার কারণ: এ জাত যে চট করে একটা ‘থিয়োরি’ কি ‘আইডিয়েল’ নিয়ে মেতে ওঠে না তার কারণ এদের স্থির ‘প্র্যাকটিক্যাল’ বুদ্ধি; ফরাসির মতো এদের সাম্য ও স্বাধীনতা এক দিনে কুড়িয়ে পাওয়া নয়, কারণ নজিরের পর নজির ধরে ক্রমশ এর আয়তন বৃদ্ধি হচ্ছে, সেইজন্য গতিটা একটু মন্থর। কিন্তু আমার সন্দেহ হয় যে, ‘জনবুলত্বের’ এত গুণব্যাখ্যান সত্ত্বেও কোনও ইংরেজ এটা স্বীকার করতে রাজি হবে কি না, তার নিজের বুদ্ধিটা আপাতদৃষ্টিতেও একটু মোটা, যতই গুরুত্ব এবং গভীরতা সে দৃষ্টিবিভ্রমের কারণ হোক না কেন। অর্থাৎ ‘জনবুলত্বের’ উপর জাতীয়-অভিমান অনায়াসে দাড় করানো যায়, কিন্তু কোনও ব্যক্তির পক্ষে ওটাকে নিয়ে অহংকার দেখানো একটু শক্ত। বোধহয় ঠিক এই কারণেই আমাদের জাতীয়-চরিত্রের দুর্বলতাগুলিকে লজ্জা দিয়ে বিদায় করবার জন্য প্রবন্ধে, গানে, বক্তৃতায় যে-সব চেষ্টা হয়েছে, তাতে তেমন আশানুরূপ ফল দেখা যায় নাই। কেননা লজ্জা জিনিসটা মানুষে পায় কোনও কারণে দল থেকে তফাত হয়ে পড়তে হলে। সুতরাং সবাই মিলে দল বেঁধে লজ্জা পাওয়াটা বড় একটা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। বরং জাতীয়-জীবনের অবস্থা দেখে সবাই মিলে যে লজ্জা পাওয়ার চেষ্টা করছি এই ব্যাপারটিকেই একটা অহংকারের কারণ করে তোলা কিছুই কঠিন নয়।