যেমন গতিক দেখা যাচ্ছে, তাতে করে প্রাচীন ও আদিম আৰ্যজাতির অদূদ্ষ্টে কী আছে বলা কঠিন। আসছে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তাঁরা বিধাতার সৃষ্টি বলে কায়েম হয়েও বসতে পারেন, আবার মানুষের কল্পনা বলে বাস্তব পদার্থের লিস্টি থেকে তাঁদের নামও কাটা যেতে পারে। কিন্তু একটা বিষয়ে আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। আর্যজাতির কপালে যা-ই ঘটুক, তাঁরা বস্তু হয়ে চেপেই বসুন, আর অবস্তু হয়ে উড়েই যান, ‘আৰ্যামি’ বস্তুটির তাতে বিশেষ কোনও ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। যাঁরা মনে করে, কারণ না থাকলেই আর তার কার্য থাকে না, তাঁরা না পড়েছে দর্শনশাস্ত্ৰ, না আছে তাদের লৌকিক জ্ঞান। ‘নিমিত্ত’ কারণ যে একটা কারণ, একথা আরিস্টটল থেকে অন্নভট্ট পর্যন্ত সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন। এবং ও-কারণটি নিজে ধ্বংস হলেও তার কার্য ধ্বংস হয় না। যেমন নিজের বোনা কাপড়খানির পূর্বেই তাতি বেচারির জীবনান্ত ঘটতে কিছুই আটক নেই। আর পুথি ছেড়ে সংসারের দিকে চেয়ে দেখলেও এর ভুরি ভুরি প্রমাণ চোখে পড়বে। যুদ্ধ থেমে গেছে কিন্তু ‘পাবলিসিটি বোর্ড’ চলছে; জার্মানভীতি ঘুচে গেল অথচ ‘রিফর্ম স্কিম’ নিয়ে আমাদের তর্ক শেষ হয়নি; এমনকী বিলাতের কলের মজুরেরা যেমন যুদ্ধের মধ্যে দুবেলা পেটপুরে খেয়েছে, যুদ্ধের পরেও তেমনি চলুক বলে হাঙ্গাম উপস্থিত করেছে।
কিন্তু প্রকৃত গোড়ার কথা এই যে, ‘আৰ্যামি’র সঙ্গে ‘আর্যের’ আসলে কোনও কাৰ্যকারণ সম্বন্ধ নেই। আর্যজাতি পৃথিবীতে যতই প্রাচীন হন না কেন, ‘আৰ্যামি’ জিনিসটি যে মনুষ্য সমাজে তার চেয়ে ঢের বেশি প্রাচীন, তাতে বিন্দুমাত্ৰ সন্দেহ করা চলে না। বুৎপত্তি দিয়ে বস্তুনির্ণয়ের চেষ্টা করে শুধু এক বৈয়াকরণ; এবং ও-জাতটি যে কাণ্ডজ্ঞানহীন একথা সর্ববাদিসম্মত। ‘আৰ্যামি’ হল মানুষের সেই মনোবৃত্তির প্রকাশ ও বিকাশ, বিলাতি পণ্ডিতদের মতে যাতে ইত্যর প্রাণী থেকে মানুষ তফাত, অর্থাৎ তার ‘সেলফ কনশাসনেস’; আর দেশিতত্ত্বজ্ঞদের মতে যার সম্পূর্ণ বিনাশ, অথবা যা একই কথা–চরম বিকাশই হচ্ছে পরামুক্তির পথ, অর্থাৎ অহংজ্ঞান। সমাজতত্ত্ববেত্তারা বলেন, মানুষ যে পরের মধ্যে নিজের সাদৃশ্য দেখে, তাতেই সে অপরের সঙ্গে সমাজ বেঁধে ঘর করতে পারে। এই সাদৃশ্যবোধ হল সমাজবন্ধনের একটা পোক্ত শিকল। কিন্তু সবাই জানে ভিন্ন জিনিসের মধ্যে সাদৃশ্যজ্ঞানটা সাধারণ বুদ্ধির কথা। সূক্ষ্মবুদ্ধির কাজ হচ্ছে একইরকম জিনিসের মধ্যে থেকে তফাত বের করা। সুতরাং মানুষ যখন সূক্ষ্মবুদ্ধির জোরেই করে খাচ্ছে, তখন তার বুদ্ধির স্বাভাবিক বেঁধাকটা হল পরের সঙ্গে নিজের সাদৃশ্য নিয়ে খুশি না থেকে, এই মিলের মধ্যে অমিল কোন কোন জায়গায় তাই খুঁজে বের করার দিকে। আর এ খোঁজে কাকেও ব্যর্থ হতে হয় না। কেননা একে তো লাইবনিজ প্রমাণই করে গেছেন যে, সংসারে দুটি বস্তুর ঠিক একরকম হবার কোনও জো-ই নেই; আর লাইবনিজ ছিলেন একজন দিগগজ গণিতজ্ঞ লোক। তারপর সবাই নিজেকে জানে সাক্ষাৎভাবে, অন্য সকলকে পরোক্ষে। আমার বুদ্ধি আমার কাছে স্বপ্ৰকাশ, অন্যের বুদ্ধি আছে কি নেই, সেটা অনুমানের কথা। কাজেই আমি যে অন্য সকলের চেয়েই ভিন্নরকমের, এবং মোটের উপর এ-রকমটি আর হয় না, এ জ্ঞান যেমন ব্যাপক তেমনি গভীর। নিজের সম্বন্ধে এই মর্মগত বোধটা লোকে যখন প্ৰকাশ করে ফেলে, তখন তার নাম হয় ‘অহংকার’, দ্বিতীয় ভাগ থেকে বেদান্তগ্ৰন্থ পর্যন্ত সবাই যার একটানা নিন্দা করেন। আর এ ভাবটি যখন একটা দলকে ধরে প্রকাশ হয়, তখন সেই বস্তুটিই হল ‘আর্যামি’। কেবল দলের প্রকারভেদে নামের রকমভেদ ঘটে, যেমন আভিজাত্য, ব্ৰাহ্মণত্ব, পেট্রিয়টিজম, অ্যাংলো-স্যাকসনত্ব ইত্যাদি। এবং ভাট, চারণ, কবি, ঐতিহাসিক সকলে মিলে মানুষের সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এর জায়গান গেয়ে আসছে।
সংসারে এমন সব সরলবুদ্ধির লোকও আছে যাঁরা প্রশ্ন করে বসে ব্যক্তির পক্ষে যেটা দোষের, সমাজ বা জাতি, অর্থাৎ ব্যক্তিসমষ্টির পক্ষে সেইটিরই বর্ধিত সংস্করণ বা ‘এনলার্জড এডিশন’ কোন প্ৰশংসার?—-অবশ্য এর সোজা উত্তর এই যে, ব্যক্তি আর জাতি এক নয়, কেননা যদি তা হত, তা হলে ও-দুয়ের নাম এক না হয়ে, ভিন্ন ভিন্ন হবে কেন! উক্তরূপ প্ৰশ্নকর্তাদের পাণ্ডিত্যের উপর বিশেষ শ্রদ্ধা নেই; না হলে জার্মন, অ-জার্মন সবরকম পণ্ডিতের প্রাচীন নুতন নানা মত তুলে এ-ও দেখানো যেত যে, জাতি বা ‘স্টেট’ জিনিসটা মোটেই ব্যক্তির সমষ্টি নয়। কেননা ও-নিজেই একটা স্বতন্ত্র ব্যক্তি, যার একটা নিজস্ব গুণ, ইচ্ছা, অনুভূতি আছে, যা জাতি বা স্টেটের লোকদের গুণ, ইচ্ছা ও অনুভূতি থেকে স্বতন্ত্র, মোটেই তার সমষ্টি নয়। অর্থাৎ দেশের সব লোক দরিদ্র হলেও দেশটা ধনী হতে কোনও আটক নেই। আর এ-কথা যে ঠিক, ভারতবর্ষের প্রত্যেক লোককেই তা স্বীকার করতে হবে। এইসব সূক্ষ্মী অথচ প্ৰকাণ্ড তত্ত্ব যাদের বুদ্ধির অগম্য তাদের জন্য একটা সহজ ছোট উত্তর দেওয়া যাচ্ছে। কারু নিজের সম্বন্ধে অহংকার প্রকাশ করাটা যে, সমাজে নিন্দার কথা, তার কারণ ওই এক অহং-এর খোঁচা আর সকল অহং-এর গায়ে লেগে তাদের ব্যথিত করে তোলে। কিন্তু একটা গোটা দলকে ধরে যখন এটি প্রকাশ হয়, তখন দোষটা আর থাকে না। এবং এতে দলের সকলেরই সহানুভূতি পাওয়া যায়। অবশ্য একদলের অহংবোধটা অন্য আর একদলের গায়ে লাগেই লাগে। কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। কেননা আমাদের যা কিছু রীতি, নীতি, বিধি, নিষেধ, সে সবই হল ছোট হোক বড় হোক কোনও একটা দলের লোকদের পরস্পরের প্রতি ব্যবহারকে লক্ষ্য করে। একদলের সঙ্গে আর একদলের ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রিত করা এ-সব কোনও কিছুরই লক্ষ্য নয়! সেইজন্য লোকের সঙ্গে কথায় ও কাজে যে লোকের ভদ্রতার সীমা নেই, সেই লোকই একটা সমস্ত জাতির সম্বন্ধে কথায় বা ব্যবহারে কোনওরকম ভদ্রত রক্ষার প্রয়োজন বোধ করে না। যে লোক জীবনে কাকেও কোনওদিন কড়া কথা বলেনি, সেও দল বেঁধে একটা গোটা দেশকে পোষণে ও শোষণে কিছুমাত্র দ্বিধা করে না।