৫
রোমান সভ্যতার এই যে উচ্চ জয়গান, এ যে কেবল মিথ্যা তুতি তা নয়, এর কলরোল পৃথিবীর প্রবল জাতিগুলির মন চিরদিন বিপথের দিকেই টানবে। যেই যখন শক্তিশালী হয়ে উঠবে তারই মনে হবে মানুষের বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে পৃথিবীর যতটা অংশের উপর পারা যায়, নিজের আধিপত্যের একরঙা তুলিটা বুলিয়ে নেওয়া কেবল স্বাৰ্থ সিদ্ধির উপায় নয়, সভ্যতায় শ্রেষ্ঠত্ব লাভেরই পথ। এ যে অতিশয়োক্তি নয়, তার প্রমাণ মমসেন থেকেই তুলে দিচ্ছি। সিজারের গল বিজয়ের বর্ণনা মমসেন এই বলে আরম্ভ করেছেন–’যেমন মাধ্যাকর্ষণ ও আর আর পাঁচটা প্রাকৃতিক নিয়ম যার অন্যথা হবার জো নেই তেমনি এও একটা প্রাকৃতিক নিয়ম যে, যে জাতি রাষ্ট্র হয়ে গড়ে উঠেছে সে তার অ-রাষ্ট্রবদ্ধ প্রতিবেশী জাতিগুলিকে গ্ৰাস করবে, এবং সভ্যজাতি, বুদ্ধিবৃত্তিতে হীন তার প্রতিবেশীদের উচ্ছেদ করবে। এই নিয়মের বলে ইতালি জাতি (প্রাচীন জগতের একমাত্র জাতি যে শ্রেষ্ঠ পলিটিক্যাল উন্নতির সঙ্গে শ্রেষ্ঠ সভ্যতা মেশাতে পেরেছিল, যদিও শেষ বস্তুটির বিকাশ তাতে অপূর্ণভাবে এবং কতটা বহিরাবরণের মতোই ছিল) পুবের গ্রিকদের, যাদের ধ্বংসের সময় পূর্ণ হয়ে এসেছিল, তাদের করায়ত্ত করতে, এবং পশ্চিমের কেল্ট জার্মনদের, যাঁরা সভ্যতার সিঁড়ির নীচের ধাপে ছিল, তাদের উচ্ছেদ সাধন করতে সম্পূর্ণ অধিকারী ছিল।’
প্রাকৃতিক নিয়ম যে কেমন করে অধিকারে পরিণত হয় সে রহস্যের চাবি হয়তো হেগেলের লজিকেও মিলবে না। সে যাই হোক এ নিয়ম’ ও ‘অধিকারের’ মুশকিল। এই যে এর জন্য পৃথিবীর সমস্ত জাতিকে সারাক্ষণ নখদন্ত বের করেই থাকতে হয়। কেননা মল্লাঙ্গনই হচ্ছে এ ‘অধিকার’ প্রমাণের একমাত্র স্থান। কারণ বুকের উপর চেপে বসতে পারলেই প্ৰমাণ হল যে চেপে বসার অধিকার আছে; আর তাই হল এ অধিকার প্রমাণের একমাত্র শাস্ত্রীয় প্রথা। তারপর শক্তি থাকলেই যখন অধিকার’ আছে, তখন শক্তির পরীক্ষার অধিকার থেকেও কাউকে বঞ্চিত করা চলে না। পরীক্ষা না করলে তো শক্তিটা ঠিক আছে কি না তা আগে থেকে আমনি জানিবার উপায় নেই। শেষ পর্যন্ত ফেলা হলেও ‘হলে’ ঢোকার অধিকার অস্বীকার করা যায় কেমন করে? গেল চার বছর ধরে এই পরীক্ষাটা সারা ইউরোপ জোড়া চলছে। মমসেনের সৌভাগ্য যে বেঁচে থেকে তার প্রণালীর ফলটা দেখে যেতে হয়নি। কিন্তু প্রাচীন রোমের গুণগানে যাঁরা মুখর, আধুনিক জার্মানির উপর মুখ বঁকানোর তাদের কোনও অধিকার নেই। কার্থেজ ও মিশর বিজয় যদি রোমের পক্ষে ছিল গৌরবের, তবে বেলজিয়মকে গ্ৰাস করা জার্মানির পক্ষে আগৌরবের কীসে? আজকাল পলিটিকসে যা হীন, কালকার ইতিহাসে তা মহৎ হয় কোন ন্যায়ের জোরে?
এই যে পলিটিক্যাল শক্তি ও সভ্যতার তুতিগান–এ মূলে হল একটা ‘মায়া’। শঙ্কর ব্যাখ্যা করেছেন মায়ার প্রকৃতি অধ্যাস’, —একের ধর্ম অন্যে আরোপ করা। পৃথিবীর আদিযুগ থেকে যখন জাতিতে জাতিতে লড়াই চলে আসছে আর কোনও ‘লিগ অব নেশনে’-ই তা শেষ হবে বলে যখন বোধ হয় না, (কেননা ‘লিগের’। একটা অর্থ হচ্ছে এর ভিতরে যাঁরা আসবে না। তাঁরা শত্ৰু, আর বাইরে যাদের রাখা হবে তাদের এজমালিতে দমন করা চলবে) তখন জাতির রাষ্ট্ৰীয় শক্তি তার আত্মরক্ষার পক্ষে অমূল্য। জাতির প্রাণই। যদি না বাঁচে তবে তার মনের বিকাশও কাজে কাজেই বন্ধ হয়। কিন্তু এই শক্তি যখন আত্মরক্ষায় নয়-পর-পীড়নেই রত থাকে, রক্ষার চেষ্টায় নয়–ধ্বংসের লীলাতেই মেতে ওঠে তখনও যে তার পূজা, তার মূলে হল অধ্যাস’। একের গুণ আর একজনে দেখা, রামের পাওনা শ্যামকে বুঝিয়ে দেওয়া। অবিশ্যি এ দুয়ের সম্বন্ধ অতি নিকট। কিন্তু একান্ত ‘অবিষয় হলে তো ‘অধ্যাসেরও উৎপত্তি হয় না।
আশ্বিন ১৩২৫
আৰ্যামি
আমাদের আদিম আৰ্য প্রপিতামহেরা ধরা পৃষ্ঠের ঠিক কোন জায়গা থেকে যাত্রারম্ভ করে যে পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছেন, সে প্রশ্নের একটি নিশ্চিত জবাব দেওয়া শক্ত। তাঁরা কি মধ্য-এশিয়ার পশ্চিম দিকটায় ভেড়া চরাতেন, না নরওয়ের উত্তর-মাথায় মাছ শিকার করতেন, এ তর্কের কোনও মীমাংসা হয়নি। ভাষাতত্ত্বের প্রমাণে যে যব তাঁরা সকলে মিলে নিঃসন্দেহই খেতেন, তা তাদের চাষ করে-পাওয়া, না ইউফ্রেটিসের তীরের বুনো যাব, সে বিষয়েও মহা মতভেদ রয়েছে। তারপর তাদের সবারই মাথার প্রস্থের একশো গুণকে দৈর্ঘ্য দিয়ে ভাগ করলে ভাগফল যে কখনওই পাঁচাত্তরের বেশি হত না, একথা আর এখন কোনও পণ্ডিতই হলপ করে বলতে রাজি নন। বরং শোনা যাচ্ছে যে, যেমন আমাদের বাঙালি ব্ৰাহ্মণেরা সবাই এক আৰ্যবংশাবতংস হলেও তাদের চেহারায় এ-মিলটা ধরার জো নেই, কেননা কেউ কটা কেউ কৃষ্ণ, কারও মাথা গোল কারও চেপটা, তেমনি আদিম আৰ্যদের মধ্যেও চেহারার এই গরমিলের দিকেই প্রমাণের পাল্লাটা নাকি বেশি ভারী হয়ে দাড়াচ্ছে। এমনকী একদল কালাপাহাড়ি পণ্ডিত এরই মধ্যে বলতে শুরু করেছেন যে, আৰ্য বলে কোনও একটা বিশিষ্ট জাত, অর্থাৎ একটা বিশিষ্ট জাত যাকে ওই এক নামে ডাকার কোনও বস্তুগত কারণ আছে, কোনওদিনই কোনওখানে ছিলনা। ওটা একটা ভাষাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের পণ্ডিতদের মানসিক সৃষ্টি, ‘ওয়ার্কিং হাইপথিসিস’।