মানুষের সভ্যতার ধারা দুই। এক ধারা বয়ে যাচ্ছে–কেবলই কালের মধ্য দিয়ে— জাতিকে, সভ্যতাকে ভাসিয়ে নিয়ে স্মৃতি ও বিস্মৃতির মহাসাগরে মিশিয়ে দিচ্ছে। নূতন জাতি, নূতন সভ্যতার স্রোত এসে ধারার প্রবাহকে সচল রাখছে। আর এক ধারা জন্ম নিয়েছে কালেরই মধ্যে, কিন্তু কালকে অতিক্রম করে ধ্রুবলোকে অক্ষয় স্রোতে নিত্যকাল প্রবাহিত হচ্ছে। নূতন স্রোত এসে এ ধারাকে পুষ্ট করছে, কিন্তু এতে একবার যা মিশছে, তার আর ধ্বংস নেই, তা অচ্যুত। কেননা এ লোকে তো পুরাতন কিছু নেই, সবই সনাতন, অর্থাৎ চিরনূতন। সভ্যতার সৃষ্টির এই যে নশ্বর দিকটা এ কিছু তুচ্ছ নয়। এইখানেই বিবিধ মানবের বিচিত্র লীলা, সমাজ গঠনে, রাষ্ট্র নির্মাণে, শৌর্যে, বীর্যে, মহত্ত্বে, হীনতায় চিরদিন তরঙ্গিত হয়ে উঠছে। হোক না এ মৃত্যুর অধীন, তবুও জীবনের রসে ভরপুর। কিন্তু মানুষ তো কেবল জীব নয়। সে যে মর-আমরের সন্ধিস্থল। মৃত্যুর পথে যাত্রী হয়েও সে অমৃতলোকেরই অধিবাসী। তাই তার সৃষ্টির যেটা শ্রেষ্ঠ অংশ সেটা কালের অধীন নয়। তার ইতিহাস আছে কিন্তু তা ঐতিহাসিক নয়। সেখানে যে ফুল একবার ফোটে তার প্রথম দিনের গন্ধ সুষমা চিরদিন অটুট থাকে; যে ফল একবার ফলে, রসে আস্বাদে তো চিরদিন সমান মধুর।
দুই সভ্যতার যদি শ্রেষ্ঠত্বের মীমাংসা করতে হয়, তবে মানুষের সভ্যতার এই অক্ষয় ভাণ্ডারে কার কতটা দান, তাই হল বিচারের প্রধান কথা। এ মাপকাঠিতে মাপলে, রোমান সভ্যতা গ্রিক কি হিন্দুসভ্যতার সঙ্গে এক ধাপে দাড়াতে পারে না। তাকে নীচে নেমে দাঁড়াতে হয়। যত দিন তার সাম্রাজ্য ছিল, তত দিন তার বলের কাছে–সবারই মাথা নিচু করে থাকতে হয়েছে। কিন্তু উত্তরকালের লোকেরা কেন তার কাছে সম্রামে নতশির হবে? তাদের জন্য তো সে বিশেষ কিছু সঞ্চয় করে রেখে যায়নি। তার যা প্রধান দাবি, তার পলিটিক্যাল শক্তি ও বুদ্ধি, তার পাওনা তো তার সমসাময়িকেরা একরকম ষোলো আনাই মিটিয়ে দিয়েছে। আমাদের কাছে সে দাবির জোর খুব বেশি নয়। তার গৌরবের চোদে আনা হল তার ইতিহাস। কিন্তু ইতিহাস জীবনের কাহিনি হলেও জীবন নয়, কেবলই কাহিনি। তার পৃষ্ঠার সঙ্গে মানুষের আত্মার কোনও সাক্ষাৎ যোগ নাই। একজন ফরাসি পণ্ডিত রোমানদের দার্শনিক আলোচনা সম্বন্ধে বলেছেন যে, সেগুলি এখন বক্তৃতা-শিক্ষার ইস্কুলের ছাত্রদের লেখা প্ৰবন্ধের মতো মনে হলেও যাদের জন্য সেগুলি লেখা হয়েছিল তাদের জীবনে ওর প্রভাব ছিল খুব বেশি। সুতরাং এ সব দার্শনিকের মূল্য বুঝতে হলে সেই সময়কার রোমের ইতিহাসের সঙ্গে সে-সব মিলিয়ে পড়তে হবে। হায় রোম, তোমার দার্শনিক চিন্তারও ইতিহাসের হাত থেকে মুক্তি নাই!
৪
রোমের পলিটিক্যাল গৌরবের গুণগান মুখে যতই কেন থাকুক না, রোমান সভ্যতার এই প্রকৃতিটি পণ্ডিতদের মনে অস্বস্তির সঞ্চার না করে যায়নি। সেই জন্য ইউরোপের বর্তমান সভ্যতা, রোমের সভ্যতা ও সাম্রাজ্যের কাছে কেমন করে কতটা ঋণী, মমসেন তার বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন, এবং ছোট বড় মাঝারি সকল পণ্ডিতই তার পুনরাবৃত্তি করেছেন। সে ব্যাখ্যার প্রধান কথাটা এই—রোম সাম্রাজ্যের প্রাচীর যদি বর্তমান ইউরোপীয় জাতিগুলির অসভ্যকল্প পূৰ্বপুরুষদের ঠেকিয়ে না রাখত, তবে তাঁরা যখন রোম সাম্রাজ্যের উপরে পড়ে তাকে ধবংস করেছিল, সে ঘটনাটি ঘটত আরও চারশো বছর আগে। এবং তা হলে বিস্তীর্ণ রোম সাম্রাজ্যের মধ্যে–স্পেনে, গলে, ড্যানিউবের তীরে তীরে, আফ্রিকায়, হেলেনিক সভ্যতার নব সংস্করণ মেডিটারেনিয়ন সভ্যতা যে শিকড় বসাতে সময় পেয়েছিল, তা আর ঘটে উঠত না। আর তার ফল হত এই যে, ওই অর্ধসভ্য জাতিগুলি ওই সভ্যতার সংস্পর্শে এসে যে আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতা গড়ে তুলেছে, তা কখনও গড়তে পারত না।
মানুষের ইতিহাসে যে ঘটনাটা একরকমে ঘটে গেছে, সেটা সেরকম না ঘটে অন্য রকম ঘটলে তার ফলাফল কী হত এ তর্ক নিরর্থক। তাতে ‘স্বপ্নলব্ধ’ ইতিহাস ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। সুতরাং রোম সাম্রাজ্যকে তার চৌকিদারির প্রাপ্য প্রশংসাটা নির্বিবাদেই দেওয়া যাক। কিন্তু এ তো রোমান সভ্যতার কোনও গৌরবের কাহিনি নয়! এবং রোম সাম্রাজ্যকে যাঁরা চারশো বছর ধরে রক্ষা করেছিলেন তাঁরা নিশ্চয়ই আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার মুখ চেয়ে তা করেননি! আর এটাও যদি গৌরবের কথা হয় তবে রোমকে আরও একটা গৌরবের জন্য পূজা দিতে হয়। সে হচ্ছে ঠিক সময়ে সাম্রাজ্যের প্রাচীরকে রক্ষা করতে না পারা। কেননা রোম যদি আরও চারশো বছর সাম্রাজ্যকে অটুটই রাখতে পারত, তবে তো আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতা আরও চারশো বছর পিছিয়ে যেত এবং হয় তো সে সভ্যতা আর তখন গড়েই উঠতে পারত না! ইতিহাসে তার ওজন কত, সেটা সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বের মাপ নয়।
এই যে চারশো বছর ধরে পৃথিবীর একটা বৃহৎ অংশে বিচিত্র সব জাতি পরস্পরের সংস্পর্শে এল তার ফলে সৃষ্টি হল কী? মেডিটারেনিয়ন সভ্যতার এই প্রকাণ্ড শূন্যতা, সমস্ত পলিটিক্যাল সভ্যতা–রাজ্য-জয় ও রাজ্য-শাসনের সভ্যতার উপর একটা বিস্তৃত ভাষ্য। বিস্তীর্ণ বাগানের চারপাশে পাথর দিয়ে বেড় দেওয়া হল পাছে আকস্মিক বিপৎপাতে বাগান নষ্ট হয়। পাথরের দেয়াল খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, কিন্তু বাগানে ফুলও ফুটিল না, ফলও পাকল না।