৩
এই যে ছয়-সাতশো বছরের রাজ্যজয় ও রাজ্যশাসনের পলিটিক্যাল ইতিহাস, রোমান সভ্যতা ও গৌরবের কাহিনিরও এই হল অন্তত চোদে আনা। একে বাদ দিলে রোমান সভ্যতার যা অবশিষ্ট থাকে তার গৌরবের কাছে প্রাচীন হিন্দুসভ্যতার কথা দূরে থাক, তার চেয়ে অনেক ছোট সভ্যতারও মাথা নিচু করার কোনও কারণ দেখা যায় না। হেলেনিক সভ্যতার দৃষ্টান্তটি চোখের সামনে থাকতে নিজেদের সভ্যতার এই স্বরূপ সম্বন্ধে রোমানদের মনেও সংশয়ের কোনও অবসর ছিল না। আগস্টসের সভাকবি তার যুগের আত্মবিস্মৃতি রোমানদের প্রকৃত রোমান-গৌরব স্মরণ করিয়ে দিতে গিয়ে বলছেন, ‘জানি আর আর সব জাতি আছে যাঁরা কঠিন ধাতুকে সুষমাময় গড়ন দিতে পারে, পাথরের হিম দেহ থেকে প্ৰাণের বিপুল উচ্ছাস খুঁড়ে বের করতে পারে, জ্ঞানের আঙুল আকাশে তুলে নক্ষত্ৰলোকেরও সকল বার্তা একে দেখাতে পারে, কথার সঙ্গে কথা গেথে লোকের করতালি নিতেও তাঁরা পটু, কিন্তু রোমান, এসব কাজ তোমার নয়। তোমার কাজ হল–সকল জাতির উপর রাজত্ব করা। সেই হল তোমার শিল্পকলা। তোমার গৌরব হল বিজিত রাজ্যে শান্তি আনা, উচুমাথাকে যুদ্ধে নিচু করা, পতিত যে শত্রু তাকে করুণা দেখান।’ ‘এনিড’ যে ইতিহাস নয়, কাব্য, পতিত শক্রকে করুণা দেখানের কথা বলে ভার্জিল বোধ হয় তারই ইঙ্গিত করেছেন। কেননা রোমের ইতিহাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এ বস্তুটি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। যাহোক, লাতিন কবির রোমান সভ্যতা ও গৌরবের এই বর্ণনাটি আধুনিক কালের রোমানতত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতেরাও একরকম সকলেই মেনে নিয়েছেন। কারণ না মেনে উপায় নাই। এবং এরই মধ্যে মানুষের সভ্যতা, প্রকৃতি ও শক্তির বিরাট বিকাশ দেখে তাঁরা বিস্ময়ে স্তম্ভিত ও প্রশংসায় উচ্ছসিত হয়ে উঠেছেন। মানি, বহু জাতিকে যুদ্ধে পরাজয় করতে হলে জাতির মধ্যে যে বীর্য, যে ঐক্য, যে রাজনৈতিক বুদ্ধি ও বন্ধনের প্রয়োজন, তার মূল্য কিছু কম নয়। কিন্তু এই বস্তুকে সভ্যতার একটা শ্রেষ্ঠ বিকাশ বললে মানুষের প্রকৃতিকেই অপমান করা হয়। আর জাতির এই বীৰ্য, ঐক্য ও বুদ্ধি যখন পরের দেশ জয় ও পরের উপর আধিপত্যেই নিঃশেষে ব্যয় হয়, তখন তার শক্তি দেখে অবশ্য স্তম্ভিত হতে হয়, যেমন কালবৈশাখীর রুদ্রমূর্তিতে মানুষ স্তম্ভিত হয়। প্রকৃতপক্ষে একটা সমগ্ৰ জাতি, নবীন শক্তি সঞ্চারের আকস্মিক উন্মাদনায় নয়, কিন্তু যেমন মমসেন দেখিয়েছেন, শতাব্দীর পর শতাব্দীর সূক্ষ্ম লাভ লোকসানের হিসােব গণনা করে চোখের সুমুখে যখনই যাকে প্রবল বা বর্ধিষ্ণু দেখেছে তারই বুকের উপর পড়ে তার জীবনের বল নিঃশেষে শুষে নিয়ে নিজেকে পুষ্ট করেছে, রোমান ইতিহাসের এই ব্যাপারটি তার ভীষণতায় মানুষকে স্তম্ভিত না করেই পারে না; খ্রিস্টান ও পারসি পুরাণে যে অন্ধকার ও অমঙ্গলের দেবতার কল্পনা আছে সেটা ভিত্তিহীন নয় বলেই মানুষের বিশ্বাস জন্মায়।
আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রোমের এই প্ৰবল পলিটিক্যাল সভ্যতা, কেবল সমসাময়িকদেরই মাথা ভয়ে হেঁট করিয়ে রাখেনি, কিন্তু উত্তরকালের ঐতিহাসিকদেরও শ্রদ্ধায় নতমুণ্ড করে রেখেছে। প্ৰাণতত্ত্ববিদেরা হয়তো বলবেন মানুষ পশুরই বংশধর; শক্তির বিকাশ দেখলেই পূজা না করে থাকতে পারে না। মমসেন বলেছেন, এথেন্স যে রোমের মতো রাষ্ট্র গড়তে পারেনি, সে জন্য তার দোষ ধরা মূর্থিতা। কেননা গ্রিক প্রকৃতির যা কিছু শ্ৰেষ্ঠত্ব ও যা কিছু বিশেষত্ব, তা ছিল তেমন একটা রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রতিকূল। অনিয়ন্ত্রিত রাজতন্ত্রকে বরণ না করে, গ্রিসের পক্ষে জাতীয় একতা থেকে রাষ্ট্রীয় ঐক্যে পৌঁছান সম্ভব ছিল না। সেই জন্য গ্রিসে জাতীয় একত্বের যখনই বিকাশ ঘটেছে সেটা কোনও রাষ্ট্রীয় ভিত্তির উপর ভর করে নয়। অলিম্পিয়ার ক্রীড়াঙ্গন, হোমারের কবিতা, উরিপিডিসের নাটক, এইসবই ছিল হেলাসের ঐক্য বন্ধন। ঠিক আবার তেমনি ফিডিয়াস কি আরিস্টফেনিসের জন্ম দেয়নি বলে রোমকে অবহেলা করা অন্ধতা। কেননা রোম স্বাধীনতার জন্য স্বাতন্ত্র্যকে, রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য ব্যক্তির ইচ্ছা ও শক্তিকে নির্মমভাবে দমন করেছে। ফলে হয়তো ব্যক্তিগত বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়েছে, প্রতিভার ফুলও মুকুলেই ঝরে পড়েছেঃ কিন্তু তার বদলে রোম পেয়েছে স্বদেশের উপর এমন মমত্ববোধ ও ‘পেট্রিয়টিজম’, গ্রিসের জীবনে যার কোনওদিন প্ৰবেশ ঘটেনি। এবং প্রাচীন সভ্যজাতিগুলির মধ্যে রোমই স্বাধীন রাজতন্ত্রের ভিত্তির উপর জাতীয়-ঐক্যের প্রতিষ্ঠায় কৃতকাৰ্য হয়েছে। সেই জাতীয়-ঐক্যের ফলে কেবল বিচ্ছিন্ন হেলিনিক জাতির উপরে নয়, পৃথিবীর সমস্ত জানা অংশের উপর প্রভুত্ব, তাদের করতলগত হয়েছিল।
আমাদের শাস্ত্ৰে ‘পুরুষের’ শ্রেষ্ঠ আর কিছু নেই, তাই শেষ, তাই ‘পরা গতি’। পরিচিত সমস্ত পৃথিবীর উপর অবাধ প্ৰভুত্ব কি মানবসভ্যতার ‘পুরুষ, তার ‘কাষ্ঠা’ ও ‘পরা গতি’! এ প্রভুত্ব তো কালে উঠে কিছুকালের পরই বিলোপ হয়; মানুষের সভ্যতার ভাণ্ডারে কিছুই স্থায়ী সম্পদ রেখে যায় না। আমার সুমুখে উরিপিডিসের কয়েকখানি নাটক রয়েছে। এগুলি তো কেবল খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর হেলাসের ঐক্য-বন্ধন নয়। তেইশশো বছর আগেকার এথেন্সের নাগরিকের মতো আমিও যে আজ সে কাব্যের রসে মেতে উঠছি। এগুলি যে চিরদিনের জন্য মানবসভ্যতার অক্ষয় মঞ্জুষায় সঞ্চিত হয়ে গেছে। যুগের পর যুগ বিশ্বজন এর সুধা আনন্দে পান করবে। আর রোমের প্রভুত্ব?–সেটি রয়েছে— ওই মমসেনের পৃষ্ঠায়। এই যে প্রভেদ, এ তো মমসেনের চার ভালুমও মুছে ফেলতে পারেনা। একে কেবল মানুষের সভ্যতার প্রকার ভেদ বলে আপস-মীমাংসার চেষ্টায় কোনও ফল নাই। এর একটির চেয়ে আর-একটি শ্রেষ্ঠ, নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ; যেমন জড়ের চেয়ে জীবন শ্রেষ্ঠ, প্ৰাণের চেয়ে মন শ্রেষ্ঠ।