সুদর্শনবাবু বললেন, না স্যার কষ্ট আছে, ওই যে বললাম না হাসলে পরে মাথায় কঁকি লাগলে ব্যথা লাগে। যন্ত্রণা হয়। ডাক্তারবাবু বললেন, এর কিছু করা যাবে না। আপনি হাসা ছেড়ে দিন। এখন থেকে হাসবেন না।
সেই থেকে সুদর্শনবাবু হাসা ছেড়ে দিয়েছেন। মানে ছাড়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু হাসা ছেড়ে দেয়া সহজ কাজ নয়। হাসি সম্পূর্ণ বন্ধ করার আগে এ নিয়ে আরও একদিন আরও একশো টাকা ভিজিট দিয়ে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন, সুদর্শনবাবু। সুদর্শনবাবুর জিজ্ঞাসা ছিল একটা, হাসা ছেড়ে দিলে কোনও ক্ষতি হবে না তো? সুদর্শনবাবু বলেছিলেন, অতি বড় বেয়াড়া বদমাইস, শয়তান লোক পর্যন্ত হাসে। হার্টের রোগী, ফঁসির আসামি, জজসাহেব, মন্ত্রী, উকিল, পুলিশের দারোগা, ডাক্তার পর্যন্ত হাসে। হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে, থানার লক-আপে, শ্মশানে পর্যন্ত তোক হাসে। এ অবস্থায় যদি আমি হাসি বন্ধ করি আমার কোনও ক্ষতি হবে না তো?
অনেক রকম ভেবেচিন্তে ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, আপনার কথার মধ্যে একটা যুক্তি আছে। কিন্তু আপনি তো ইচ্ছে করে বা শখ করে হাসি বন্ধ করছেন না। হাসতে আপনার কষ্ট হয়, যন্ত্রণা বাড়ে তাই আপনি হাসি বন্ধ করছেন। তা ছাড়া আরও একটা কথা আছে হাসতে যে হবেই এমন কোনও কথা নেই। কোথাও কোনও বইতে, ডাক্তারি শাস্ত্রে এমন কথা লেখা নেই যে হাসতে হবেই, প্রতিদিন এতক্ষণ না হাসলে মানুষ মরে যাবে বা তার কোনও কঠিন অসুখ হবে।
সুদর্শনবাবু বললেন, একদম হাসে না এমন কোনও রোগী আপনি দেখেছেন কি?
ডাক্তারবাবু বললেন, না। সেরকম দেখেছি বলে হলফ করে বলতে পারব না। তবে অনেক রোগীর মধ্যে দু-চারজন এরকম ঘটতেই পারে। সে হয়তো হাসে না কখনওই, কোনও কারণেই হাসে না। সে হয়তো নিজেই জানে না, যে সে কখনও হাসে না। অন্যেরাও হয়তো খেয়াল করে না। এই রকমভাবে না হেসে সে দিব্যি মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, কাটিয়ে দেয়। খায়-দায়-ঘুমোয়, বাজার করে, অফিস করে কেউ কিছু টের পায় না। কেউ ধরতে পারে না যে এই লোকটি একদম হাসে না। এই পর্যন্ত একদমে বলে একটু থেমে খুবই দার্শনিকের মতো গলায় ডাক্তারবাবু বললেন, আর ধরবেই বা কী করে। কেউ তো আর সব সময় হাসে না। কথায় কথায় তো আর সর্বদা হাসার দরকার পড়ে না। কেউ যদি একেবারেই কখনও না হাসে সেটা ধরা সহজ নয়। যে লোকটাকে এখন হাসতে দেখা যাচ্ছে না সে যে কখনওই হাসে না সেটা কী করে বোঝা যাবে?
ডাক্তারবাবুর সুপরামর্শ শুনে খুবই দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন সুদর্শনবাবু।
বলা বাহুল্য ডাক্তারবাবুর কথা শুনে তার খুব হাসি পাচ্ছিল। বহু কষ্টে ডাক্তারবাবুর সামনে হাসির বেগ দমন করেছিলেন।
কিন্তু ডাক্তারবাবুর ওখান থেকে ফিরে এসে যখনই ডাক্তারবাবুর উপদেশ তার মনে পড়ছে তিনি অনর্গল হাসির দমকে ফেটে পড়েছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মাথার মধ্যে বাঁদিকের কপালটা যন্ত্রণায় মুচড়িয়ে উঠেছে। তীব্র ব্যথায় হাসি থেমে গেছে। কিন্তু হাসির কারণটা থেকে গেলে, যত যন্ত্রণাদায়কই হোক হাসি বন্ধ করা কঠিন।
এ ছাড়া আরেকটা গোলমেলে ব্যাপার আছে। সুদর্শনবাবুর ঠাকুরদা ছিলেন হেড পণ্ডিত। বাবা ছিলেন হেডমাস্টার। দুজনেই মোটাসোটা লম্বাচওড়া, কৃষ্ণকায় পুরুষ। আর, সুদর্শনবাবু রোগা, ফরসা চিকন চেহারার মানুষ।
আসলে সুদর্শনবাবু হলেন, মা-গঠনী মানুষ। মায়ের মতো গঠন পেয়েছেন। সুদর্শনবাবুর সেই কৃশকায়া অনতিদীর্ঘা পরমা সুন্দরী জননীর জননী অর্থাৎ তাঁর দিদিমাও একই রকম ছিলেন।
সুদর্শনবাবুর পিতা-পিতামহ ছিলেন স্বভাবত এবং বৃত্তিগত কারণে গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। দৈনন্দিন পৃথিবীতে তাঁরা হাসির কারণ খুঁজে পাননি। বিশেষ কখনও হাসতেন না।
আদতে এটা একটা শৃঙ্খলার নিয়মানুবর্তিতার ব্যাপার। সব কিছু নিয়মমাফিক, শৃঙ্খলার মধ্যে চললে এমন কিছু ঘটা বা ভাবা সম্ভব নয়, যাতে হাসি পেতে পারে।
সুদর্শনবাবু যদি পিতৃপিতামহের সরাসরি উত্তরাধিকার পেতেন তাহলে হাসি বন্ধ করার ব্যাপারে তাকে অত কষ্ট করতে হত না।
কিন্তু ওই যে বলেছি, সুদর্শনবাবু মা-গঠনী সন্তান। তার জিন-কোষ, চিন্তা-ভাবনা সবই মাতৃতান্ত্রিক। ফলে হাসির ব্যাপারটা তিনি জন্মসূত্রে পেয়েছেন মায়ের দিক থেকে।
সুদর্শনবাবুর দিদিমা ছিলেন সুখে-দুঃখে দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে সদারসিকা। দুয়েকটা ছোট উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা প্রমাণ হবে।
দিদিমা ছাদে আমসত্ত্ব শুকোতে দিয়েছেন হালকা বাঁশের ফাঁক ফাঁক ঝুড়ি চাপা দিয়ে। সেই ঝুড়ি উলটিয়ে কালো পাথরের অতিকায় থালা ভরতি আমসত্ত্ব নামাতে গিয়ে ওলটানো ঝুড়ি এবং শূন্য থালা দেখে দিদিমা হেসে আকুল হয়ে গেলেন। সেদিন কেন যে তিনি অত হেসেছিলেন সুদর্শনবাবুর সেটা আজও বোধগম্য নয়।
আরেকবার একটা ব্যাঙ উঠোন থেকে বার বার লাফ দিয়ে ঠাকুরদালানের বারান্দায় উঠবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কিছুতেই প্রয়োজনীয় উচ্চতায় উঠতে না পারায় বার বার বারান্দার নীচে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল। দিদিমা পুজোর ঘরে পুজো বন্ধ করে হাসতে লাগলেন।
সুদর্শনবাবুর মায়ের ব্যাপারে একটা ঘটনার উল্লেখ করলেই যথেষ্ট।
সুদর্শনবাবুর মা একদিন পা পিছলিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। সে সাংঘাতিক পড়া। এক ঘর লোকের সামনে ভারী শরীর নিয়ে মেঝেতে মাথা ঠুকে গিয়েছিল। সাধারণত কেউ হঠাৎ পা পিছলিয়ে পড়ে গেলে যে পড়ে সে ছাড়া বাকি সবাই হেসে ওঠে। কিন্তু এক্ষেত্রে একটা ব্যতিক্রম হয়েছিল। সকলের সঙ্গে নিজের পতনে তিনিও হেসেছিলেন, তখন কিন্তু তাঁর মাথা ফেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে কপাল দিয়ে।